সঙ্ঘমিত্রা হালদার

ধরে নেওয়া যাক ভ্যান গখ

ধরে নেওয়া যাক, ভ্যান গখ এই জন্মে এক কফি শপের মালিক। মালিক অবশ্য নাম কা ওয়াস্তে। সে কেবলই সুযোগ খোঁজে ছোট্ট টাউনটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে। ওর যে কফিশপ সেটা বড় শহরের লাগোয়া আরেকটা শহর। নদীর এপার ওপার। ওর কাফেটা থেকে বেরিয়ে  মিনিট কুড়ি সড়ক পথ ধরে এগিয়ে সেতু পেরলেই বড় শহর। সেতুর নীচ দিয়ে বয়ে গেছে মজে যাওয়া নদী। ধরা যাক, ভ্যান গখের নাম এই জন্মে অর্পণ সরখেল। অর্পণ সরখেলের নাম যে ভ্যান গখ সেটা অবশ্য সে নিজে জানে না। ওর খুব কাছের বন্ধু যেমন মহুল, জানে। প্রায় বছর তেরো’র আগের ঘটনা। অর্পণ তখনও এককামরার ফ্ল্যাট কাম স্টুডিও কেনেনি। ওর দাদুর পৈতৃক বাড়ির তিনতলার ছাদের ঘরটাই তখন ওর স্টুডিও। সেই ঘরে প্রচুর আলোবাতাস আর ভারী সব পর্দা লাগানো ছিল। অর্পণ তখন একটা ছোট ফার্ম হাউসে চাকরি করত। তখনও তাদের পৈতৃক কাফেটায় সে বসতে শুরু করেনি। অবশ্য কাফে তখন ছিল না। দোতলার লম্বা-চওড়া ঘরটা তখন ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বুকশপ। অর্পণ ফার্মের চাকরিটা ছাড়বে ছাড়বে করছিল শুরু থেকেই। কোন ছোটবেলায় তার মা মারা গেছেন। তারপর বছর সাতেক আগে শেষ ছাদটাও সরে গেলে সে সেই বুকশপকেই কাফে বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কাছাকাছি একটা এককামরার স্টুডিও কাম ফ্ল্যাট নেয়।

যে ছেলে পুরনো বুকশপ’কে সময়োপযোগী কাফেতে বদলে ফেলতে পারে, কোনও পিছুটান না রেখে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সাহস রাখে, সে যে কী করে এমন অস্থিরতা বয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ, খুব অবাক লাগে মহুলের। তখন অবশ্য কাফে হয়নি, চাকরিও ছাড়েনি অর্পণ। তবে চাকরির জন্য যে কাজে মন দিতে পারছে না সেই অস্থিরতা কেটে বসছিল ক্রমশ। চাকরির কারণেই তখন সে কোনও ক্যানভাসই মনের মতো করে শেষ করতে পারছিল না। চাকরির দায়িত্ব সামলে একটা ক্যানভাস শেষ করতে যতটা সময় লাগছিল তাতে অর্পণের মন অভিজ্ঞতা সবই পালটে পালটে যাচ্ছিল, এক একটা ক্যানভাসের কাজ গুটিয়ে আনার আগেই সেই বদল সে টের পাচ্ছিল নিজের মধ্যে। ফলে অস্থিরতা আরও বাড়ছিল। অনেকদিন হল অর্পণ আর ফার্মের চাকরি করে না। কিন্তু অস্থিরতা কি কিছু কমেছে? মহুল ভাবে। ভ্যান গখ আজই তার ফ্যাকাশে হয়ে আসা স্টিল রঙের অল্টো এইট হান্ড্রেড নিয়ে বেরিয়ে গেছে। অন্যান্য বারের মতোই এবারও সে জানে না ভ্যান গখ ঠিক কোথায় যাবে। সত্যি বলতে অর্পণও কি জানে সে কোথায় থামবে, কতদূর যাবে! 

প্রায় তেরো বছর আগেকার ঘটনা। মহুল তখন পিএইচডি শেষ করে দীর্ঘ প্রবাসজীবনের পর চেন্নাই থেকে ফিরেছে। তো, পুরনো পাড়ায় ফিরে বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া তার অবশ্যকর্তব্য। তাছাড়া অর্পণ কি শুধুই তার বাল্যবন্ধু? সে কলেজ শেষ করে চেন্নাইয়ে পড়তে চলে যেতে বাধ্য না হলে আজ হয়ত ব্যাপারটা অন্যরকম হত। বাল্যবন্ধুর প্রতি যখন আস্তে আস্তে আকর্ষণটা তৈরি হচ্ছে, তখনই তার চেন্নাই যাওয়ার সুযোগ আসে। এখানে থাকলে টানটা হয়ত শেষমেষ ছিলা হয়ে বেঁকে যেত, হয়ত অনেককিছুই অন্যরকম হত। কে জানে! 

সাধারণত অর্পণের কাছে গেলে সে তার ছাদের ঘরেই যেত। অর্পণই তাকে নিয়ে যেত। কেননা অর্পণের আঁকা ছবি, তার ছবি-সংগ্রহের প্রতি যে মহুলের সুতীব্র কৌতুহল আছে, আর কিছু না রাখলেও সেই খবরটুকু অর্পণ রাখত। বছর তেরো আগে সে দিনও অর্পণ তাকে ছাদের স্টুডিও ঘরে নিয়ে বসিয়েছিল। স্কুলজীবন কলেজজীবনে এই ঘরটাই অর্পণের পড়ার ঘরও ছিল। মহুল এই ঘরে বেশ কয়েকবার এসেছে। স্কুলজীবনে বিশেষত, নোট নিতে এসেছে সে। কলেজজীবনেও বার দুই এসেছে সে। মূলত তার ছবির সংগ্রহের টানে। আর অর্পণের নতুন কোনও আঁকার কাজের খবর পেলে চলে এসেছে সে। আজ প্রায় বছর ছ’সাত পর আবার সেই ছাদের স্টুডিওতে। চিলেকোঠার ঘরে সাধারণত এত জানালা থাকে না। অবশ্য আয়তনের দিক দিয়ে দেখলে এই ঘর এতটাই বড় যে তাকে কোনওভাবে চিলেকোঠার ঘর বলা যায় না। বরং স্টুডিও শব্দটা যায় বেশ। ঘরে একটাও বাড়তি কোনও আসবাব নেই। একটা পুরনোদিনের সোফা কাম বেড। একদিকের দেওয়ালে অর্পণের ইজেল, স্ট্যান্ডে বসানো ক্যানভাসের উপর শাদা কাপড় ফেলা। শেষ হওয়া কিছু ছবি দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে মেঝের উপর রাখা, দেওয়ালে হেলান দিয়ে। অন্যদিকের দেওয়াল ঘেঁষে ছিমছাম একটা শোকেস। সেই শোকেসে বিখ্যাত কিছু চিত্রকরের ছবির কালেকশান। ছবির উপর বেশ কিছু বই। আর শোকেসের লাগোয়া একটা ওয়ালনাট রঙের টেবিলের উপর ওর আঁকার কিছু সরঞ্জাম। বাকি দু’দিকের দেওয়ালজুড়ে বিখ্যাত কিছু চিত্রকরের আঁকার কপি বড় করে বাঁধানো। এই অভ্যেস অর্পণের বহুদিনের। তখনও অর্পণ চাকরি করে না, কিন্তু হাতে টাকা জমলেই সে প্রিয় কিছু ছবি বড় করে বাঁধিয়ে এনে দেওয়ালে টাঙায়। গড়িয়াহাটের এক দোকানের সন্ধান সে কীভাবে যেন কলেজজীবনে পেয়েছিল। তারপর থেকে সেখানেই যেত। দু’দিকের দেওয়ালজুড়ে খুব যত্ন নিয়ে সেই ছবিগুলো টাঙানো। এতদিন পরে সে এই ঘরে এলেও বেশিরভাগ ছবিই সে এই দেওয়ালে দেখেছে আগে। শুধু মাতিসের দুটো আর গগাঁ’র একটা নতুন ছবি এপাশের দেওয়ালে বাঁধানো হয়েছে এই ক’বছরে। বাকিগুলো সবই চেনা। পিছন ঘুরে অন্যদিকের দেওয়ালে তাকাতেই যেন ছ্যাঁকা খেল মহুল। ‘রেমিনিসেন্স অফ ব্রাবান্ট(মার্চ-এপ্রিল, ১৮৯০), হুইটফিল্ড উইথ আ রিপার(সেপ্টেম্বর, ১৮৮৯), হুইটফিল্ড উইথ ক্রো’জ (জুলাই ১৮৯০), এই তিনটে ছবি তার মুখস্থ এ দেওয়ালে, আগেই ছিল। এখন তার নীচে ভ্যান গখের আরও দুটো ছবি দেখল। ‘ট্রিস এন্ড আন্ডারগ্রোথ (জুলাই ১৮৮৭) আর ‘দ্য হিল অফ মন্তমাট্রে উইথ স্টোন কোয়ারি’ (জুন-জুলাই, ১৮৮৬)। এই দেওয়ালের অন্তত সত্তরভাগই ভ্যান গখ। কিন্তু ছ্যাঁকা খাওয়ার কারণ হল সেই ছবিগুলোকে এমনভাবে আঘাত করা যেন ভারি কোনও ধাতববস্তু দিয়ে থেঁতলে রক্ত বের করে দিতে চাওয়া হয়েছে! শুধু তাই নয়, ক্যানভাসের থেঁতলে যাওয়া কাচের উপর কেউ যেন আক্রোশে দলাদলা রাগ উগরে দিয়েছে, নতুন করে দলা দলা রঙ ছুঁড়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন! আবারও শিউরে উঠল মহুল। 

অর্পণ যেন তৈরি হয়েই ছিল। মহুল ওর দিকে ঘুরতে যাবে, পলকের মধ্যে অর্পণ কথা ঘোরাতেই যেন বলল—

‘যা গরম, আমি কি নীচ থেকে তোর জন্য ঠাণ্ডা কিছু নিয়ে আসব?’

মহুল তখনও থই পাচ্ছে না। কোনওরকমে বলল—

‘কিন্তু ছবিগুলো… এইরকম…’

‘নিজেকে একরকম শাস্তি দিচ্ছি বলতে পারিস।’ অর্পণ যেন বেশ খানিকটা জোর দিয়ে কেটে কেটে বলল কথাগুলো।

‘কিসের শাস্তি অর্পণ? যে ছবিগুলো তোর জীবনের সমান প্রিয়, যে ছবিগুলো কিনতে, বাঁধাতে তুই একসময় টিফিনখাওয়ায়, সিনেমা দেখায়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ায় কাটছাঁট করেছিস, বছরের পর বছর পয়সা জমিয়ে, টিউশান করে এই ছবি কিনেছিস, তাকে এভাবে…’  মহুলের কথা একপ্রকার লুফে নিল অর্পণ—

‘খুন করছি। নিজেকে তো একবার খুন করা যায়। কিন্তু নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে বারবার খুন করতে গেলে আরও হাজারগুণ কষ্ট সহ্য করা শিখতে হয়।তারপরও বেঁচে থাকতে কী সাংঘাতিক মনের জোর লাগে তুই ভাবতেও পারবি না।’

‘কিন্তু কেন অর্পণ!’

‘এই ‘কেন’র উত্তর যদি আমাকে দিতে হয়, সেটা খুব বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াবে রে। তুই এতদিন পর এসেছিস, এসব প্রসঙ্গ প্লিজ বাদ রাখ।’ জানলার পাশে রাখা টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ার টেনে নিতে নিতে বলল অর্পণ।

‘কিন্তু আমি তো আজ এতদিন পরে বাইরের লোকের মতো দেখতে তোকে আসিনি!’ কথাটা বলে নিজেই চমকে গেল মহুল।

‘তাহলে কার মতো করে দেখতে এসেছিস তুই, মহুল?’ 

‘তোর কী মনে হয়?’

‘আমার তো কিছুই মনে হয় না। জাস্ট কিছুই মনে হয় না। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

‘কেন এসেছি তাহলে চেন্নাই থেকে ফিরেই তোর এখানে?’

‘সম্ভবত তোর এখানে আড্ডা দেওয়ার মতো কেউ নেই বলে। তাছাড়া তুই আমার ছবির কালেকশন দেখতে পছন্দ করিস, তাই!’

অর্পণের এই কথায় মহুলের এত কষ্ট হচ্ছিল, এত দমবন্ধ হয়ে আসছিল যে মনে হচ্ছিল ওই ছবিগুলোর মতো ও অর্পণকে এক্ষুনি ফালাফালা করে দেবে। কেন কোনওদিন ওর মনের কোনও হদিশ, কোনও ছলনার কূলকিনারা করতে পারল না অর্পণ? কেন? মনে হচ্ছিল একছুটে ও অর্পণের ঘর থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে, এক্ষুনি। কিন্তু পা এতটা, এতটা ভারি ঠেকছিল যে মনে হচ্ছিল যেন মেঝেতেই ধপ করে বসে পড়বে। গলা নাক চোখ দিয়ে কী যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যিই তো কেন এল ও আজ নিজে থেকে এখানে? অর্পণকে ও তো ফিরেই ফোন করেছিল। নিজের পিএইচডি শেষ করার কথা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা যতটা সম্ভব তখন সংক্ষেপে জানিয়েছিল। কই তাকে তো একবারও দেখা করতে বলেনি অর্পণ! ভুল করেও বলেনি। ও কি তাহলে জোর করেই অর্পণের কাছে চলে এসেছে? ভুল করে?

‘ফ্রিদা কাহলো’র খুব ভালো একটা কালেকশন জোগাড় করেছি। দেখবি?’—অর্পণ ততক্ষণে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে মহুলের কাছে। 

মহুলের আবারও খুব ইচ্ছে করল ঘর থেকে একছুটে বেরিয়ে যায় অর্পণের কথার কোনও উত্তর না দিয়েই। সে এতক্ষণ ধরে কথা বলছিল না বসেই, সোফার পিঠের উপর খানিকটা দুহাতের ভার রেখে। এতক্ষণে অর্পণ একদম ওর কাছে চলে এসেছে। মহুল খেয়াল করল এই কয়েক বছরে অর্পণের গায়ের গন্ধটা যেন অনেকখানি পালটে গেছে। 

‘সরি বাবা… একটু তো বস… কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি আর?’ এত নরম করে কথাগুলো বলল অর্পণ, এত নরম করে যে আগের নিষ্ঠুর ছেলেটা যেন সে নয়, আর কেউ! খুব ছোটবেলায় স্কুলে আন্টি মহুলকে বকলে যেরকম অর্পণেরও চোখ ছলছল করত, মনে হল সেই নরম কতদিনের চেনা ছেলেটা অনেকদিন পর আজ আবার ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

কারও সামনে নিজের চোখের জল ফেলা একদম না-পসন্দ তার। কিন্তু কী যে হল, টপটপ করে গোটা গোটা গরম ভারি তরল লাভা গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। 

‘বলছি তো খুব স্যরি! আর এরকম হবে না…’ ধরা গলায় শুধু এটুকুই বলতে পারল অর্পণ। তার হাত এবার প্রায় ঠেকে গেল মহুলের হাতে। ওর ডানহাতের কড়েআঙুল আস্তে আস্তে ধরে ফেলল মহুলের বাঁহাতের কড়ে আঙুল। 

তারপর একসময় মেঝের উপর তুমুল ঝড় বয়ে গেল, এর জন্য অবশ্য তারা দু’জন কেউই প্রস্তুত ছিল না। বাইরে থেকে আপাত শান্ত অর্পণ যে কীরকম শ্বাপদের মতো ক্ষুধার্ত আর অস্থির, তার কোনও আন্দাজ মহুলের ছিল না। অর্পণের মধ্যে কোনও নরমের সন্ধান সে সেদিন পায়নি, আজও ভাবলে কষ্টে কুঁকড়ে যায় মহুল। সে সেদিন তন্নতন্ন করে অর্পণকে খুঁজছিল, না পেয়ে আরও জেদ কেটে বসে যাচ্ছিল। আর অর্পণ গভীর থেকে আরও গভীরে যখন ডুবে যাওয়ার কথা, বারবার ভেসে উঠছিল। কাকে খুঁজছিল অর্পণ? তিয়াসা? ওর মিউজ? আজ বোঝে মহুল, ওদের এক শরীরে কেন লয় কেটেছিল সেদিন। দুটো শরীর ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যখন আবার গুছিয়ে নিচ্ছে, প্রায় বিকেল। মনে হল যেন অনন্তকাল। তবু এত অতৃপ্ত ছিল সেদিন মহুল! কিন্তু কেন? আজও একটা দৃশ্য বারবার ফিরে আসে। অর্পণ তখন নিজেকে প্রায় গুছিয়ে উঠে বসেছে, মহুল হাঁটু মুড়ে বসে পিঠে ঠোঁট রেখে পিছন থেকে আপ্রাণ জড়িয়ে ধরেছিল ওকে—

‘আর একটু থাক না প্লিজ, এভাবেই।’ বলেছিল মহুল। 

নিজের মনের ভাব লুকতে চায়নি সে। কিন্তু অর্পণ কি বুঝেছিল ওর মনের হাল? ওর অতৃপ্তি? সম্ভবত বুঝেছিল। বুঝেছিল বলেই ওরা তারপর থেকে কেউই আর এই একটা দিনের রেশ পরবর্তী জীবনে টানতে চায়নি। পিয়াল জানে এই মিউজ খোঁজার ছলেই অর্পণ আরও আরও শরীরে গেছে। শান্তি পেয়েছে কি? মহুল জানে না। মহুল জীবনে নোঙর করেছে, তারই কলিগের কাছে। শান্তি পেয়েছে কি? মহুল নিশ্চিত নয়। তবে তার জীবনে সেদিনের ঝড় অর্পণের প্রতি সব মোহ ভেঙে দিয়েছে। বন্ধু হিশেবে সে এখনও অর্পণের কাছে ছবির গল্প, মাতিসের গল্প, ভ্যান গখের গল্প শোনে, তার প্রয়োজনে রঙের টিউব কিনে আনে। তার আঁকা দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু অর্পণের জন্য কষ্ট পাওয়া, সেই মোহ সে কাটিয়ে উঠেছে।  

সেদিন ওরা নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার পরও মেঝেতেই আরও কিছুক্ষণ কাটিয়েছিল। ফ্রিদা কাহলো’র ছবির আর্টপ্লেটগুলো অর্পণ আগেই সোফায় রেখেছিল, ওঠার সময় সে সেটাকে আর একটু ঠেলে দিল—

‘একটু বস। তোকে একটা জিনিস দেখাই। হয়ত কিছুটা বোঝাতে পারব, জানিনা।’ মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলল অর্পণ।

শোকেস থেকে ওর প্রিয় ভ্যান গঘের ‘আ কমপ্লিট পেইনটিং অফ ভ্যান গখ’ নিয়ে এল সে। এমনভাবে ওর পাশে বসে ‘হুইটফিল্ড উইথ ক্রোজ’ পাতাজোড়া ছবিটা খুলল যেন ওদের মধ্যে একটু আগের লণ্ডভণ্ড মিথ্যে—

‘এটা ওঁর শেষ কাজ কিনা জানি না। কিন্তু ছবিটা যে মাসে আঁকা, সেই মাসেই উনি মারা যান। জুলাই, ১৮৯০। কলেজজীবনে ছবিটা যখন দেখতাম, এমনকি তখন তো ‘লাস্ট ফর লাইফ’ পড়ে ফেলেছি, একাধিকবার, তাও মনে হত ছটফটে নীলের তলায় পেকে থাকা গমের আলোয় চারদিক বুঝি কীরকম ভেসে যাচ্ছে! আসলে কচু বুঝতাম আমি! ওই কাকগুলো? আসলে তো ওই প্রাণবন্ত নীল আর নিরাময়ের হলুদ আলো ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিতে চাইছে! এখন ওই ছবিটার দিকে তাকালেই কাকগুলো আমার মাথার ঘিলু অব্দি ঠুকরে দেয়! উফ!’

কথাগুলো বলেই অর্পণ সত্যি সত্যি দু’হাতে কান চাপে। মহুলের অসহায় লাগে। ও অর্পণের কষ্ট মুছিয়ে দিতে পারবে না ভেবে কষ্ট হয়। খুব ভালো করে বইয়ের পাতায় খুলে রাখা ‘হুইটফিল্ড উইথ ক্রোজ’ দেখে। একটু আগে ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া ধুলোমাখা অর্পণের মুখের দিকে তাকায়। ঘন কোঁকড়ানো চুল প্রায় কাঁধ ছুঁয়ে ফেলেছে অর্পণের। 

‘হয়ত বোকার মতো শোনাবে, একটা কথা বলব?’ অবশ্য উত্তরের তোয়াক্কা না করেই সে বলে যায়—

‘যে ছবিটা এত কষ্ট দেয়, তাকে নামিয়ে রাখা যায় না? মানে এই দেওয়ালে সবসময় চোখের সামনে না রেখে যদি’…

কথা শেষ করতে দেয় না অর্পণ—

‘ক’টা ছবি নামিয়ে রাখব মহুল? ক’টা ছবি? ‘হুইটফিল্ড উইথ আ রিপার’ ১৮৮৯-এর সেপ্টেম্বরে আঁকা, তুলনায় সাদামাটা। আবারও পেকে যাওয়া গমের আলো, গমক্ষেত, কৃষক ফসল কাটছে। ঠিক, বেশ মৌতাতামার্কা ছবি। তুইও হয়ত তাই বলবি। কিংবা একজন কমিউনিস্ট হয়ত দেখবে, খেটেখাওয়া মানুষের জন্য এক স্বপ্নদেখা ছবি। কিন্তু আমার খুব অস্থির লাগে ছবিটা দেখলেই। শুধু মনে হয়, একটা লোক কী নিদারুণভাবে পেকেওঠা গমক্ষেতের মতো হলুদ আরোগ্য চাইছে প্রাণপণ! কিন্তু পাচ্ছে না। পাচ্ছে না বলে ছবিতে প্রাণপণ বলে উঠছে সেই কথা। যাকে শেষ পারানির কড়ি, বন্ধু ভেবেছিল, সেই গগাঁ ছেড়ে যাচ্ছে। নিজের কান কেটে ফেলছে। অ্যাসাইলামে ভর্তি হচ্ছে। পারছে না। কিছুতেই সেই আরোগ্য আসছে না। প্রাণপণ ছবিতে তাই যেন কুঁকড়ে গিয়ে শুশ্রূষা দিচ্ছে। নিজেকেই। ‘ট্রিজ অ্যান্ড আন্ডারগ্রোথ’ খুব ভালো করে ছবিটা খেয়াল কর, যতটা মন দিয়ে আন্ডারগ্রোথের কথা বলা, ততটা ট্রিজ নয়, কেন? আসলে লোকটা আশ্রয় খুঁজছে। নিজেকে ওই আন্ডারগ্রোথে খুঁজে পাচ্ছে! ‘রেমিনিসেন্স অফ ব্রাবান্ট’ ওটাও ১৮৯০-এ আঁকা, মার্চ-এপ্রিলে। ভালো করে খেয়াল কর’ – ব’লে দেওয়ালের দিকে তাকাল অর্পণ। খেয়াল হল ছবিটার বেশকিছুটা অংশ ভাঙা কাচের উপর দলাদলা রঙ ছুঁড়ে দেওয়ায় দেখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকেই। 

‘দাঁড়া, এখান থেকেই দেখ।’ বলে অর্পণ কোলের উপর বইটা তুলে নিয়ে ছবির পাতাটা খুলে ফেলল। আর ফিরিয়ে দিল মহুলের দিকে।

‘যা বলছিলাম, ভালো করে দেখ, একটা লোকের কীরকম আকাশ-জমিন ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছে খেয়াল কর। ব্রাবান্টের স্মৃতি হিশেবে যদি কেবল তার ভূপ্রকৃতি জেগে থাকে মনে, তবে তার আকাশ মিনিমালিস্ট হতে পারে। কিন্তু আকাশ-জমিন প্রায় এক ডাইমেনশানে চলে আসতে চাইতে পারে না।’ একটানে কথাগুলো বলে যেন একটু হাঁপিয়ে উঠেছিল অর্পণ।

এতক্ষণ নিজের অজান্তেই দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিল মহুল, একটু আগে ঠোঁটটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, খেয়াল হতেই ছেড়ে দিল সেই ঠোঁট। তারপর বেশ এলোমেলোভাবে কথাগুলো বলল—

‘কিন্তু এই যে নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছিস…’

‘তোর কি মনে হয়, খুব ভালো লাগছে আমার? উপায় থাকলে…’

‘আমি তা বলছি না রে। আমি বলছি এই যে তুই কষ্ট পাচ্ছিস, লাগাতার কষ্ট পাচ্ছিস, এতে তোর নিজের অনেক অভিজ্ঞতাও জুড়ে আছে আমি নিশ্চিত। কিন্তু এটাও তো হতে পারে, যে তুই হয়ত নিজে জানিস না, তোর এই কষ্ট পাওয়া হয়ত অন্যের জীবনেও প্রভাব ফেলছে!’

‘এক্সাক্টলি! এক্সাক্টলি! আমি এটাই বলতে চাইছি মহুল! আমার সময়ে ভ্যান গখ যদি এই যন্ত্রণাগুলো পেতেন আমি দায়ি থাকতাম ভীষনভাবে দায়ি থাকতাম! কিংবা ভাইসি ভার্সা। ধর, ভ্যান এইসময়ে অলিপাবে বসে আছে। ধর তার নাম জীবন দাশ। জাস্ট কথার কথা। সে একজন খদ্দেরের জন্যে অপেক্ষা করছে। যে তার ছবি কেনার ব্যাপারে কথা বলবে। কিন্তু খদ্দের আসছে না। এদিকে জীবন দাশের কাছে টাকা এত কম সে একটার বেশি বিয়র অর্ডার করতে পারছে না। সে দুঃখে সবটুকু বিয়র খেয়েও নিতে পারছে না। কেননা তার ওই একটাই বিয়র কেনার সামর্থ ছিল। অনেকটা সময়জুড়ে তাই তাকে ওই গরম হয়ে যাওয়া বিয়র তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার ভাণ করে যেতে হবে। অর্ডার বয়রা যখন তার দিকে তাকাবে আড়ে আড়ে, কবজিতে ঘড়ি না থাকলেও তাকে ঘড়ি দেখার ভান করতে হবে। খদ্দের আসছে না কেন? কেননা বাজার নাকি খারাপ যাচ্ছে। কোন বাজার? ছবির বাজার। অথচ বিগত সাতমাস সেনসেক্স চড়চড়িয়ে উঠছে। বড়লোক আরও বড়লোক হওয়ার দৌড়ে এগোচ্ছে। কোটিপতিদের সঙ্গে বাকিদের গ্রাফের ব্যবধান আরও বাড়ছে। কোটিপতিরা ছবির নিলামে এখন খুব একটা সময় ব্যয় করছে না। আর যারা আর্টের সত্যি সত্যি ভক্ত, তারা একটা ছবি কেনার মতো সামর্থ রাখে না। খদ্দের, যার কিনা আজ আসার কথা ছিল, সে অঙ্ক টঙ্ক কষে বুঝেছে সে যদি একটা গ্যালারি বানায় যেখানে এইসময়ের আঁকিয়েদের ছবি থাকবে, ৫০০ টাকাও যদি টিকিটের দাম হয়, লোক আসবে না। তাহলে কেন আসবে সে, বরং অলিপাবে জীবন দাশকে ঝোলাবে।’ 

‘বেশ। বাজারের সঙ্গে আর্টের দূরত্বটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু অলিপাবের জীবন দাশ থুড়ি ভ্যান গখকে তুই কী করে কষ্ট দিলি, সত্যিই বুঝলাম না!’

‘বলছি। যে খদ্দেরটা ভ্যান গখকে কথা দিয়ে অলিপাবে বসিয়ে রেখেছে, আসবে বলে, সে আসলে কথা দেওয়ার সময়ই জানত আসবে না। তাই তার মোবাইল এখন সুইচড অফ। খুব পয়সাওলা লোক যেহেতু, তার কোনও ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নেই। এবার সে জানতই যখন তাহলে কথা দিয়েছিল কেন ভ্যান গখকে? আসলে সে চেয়েছিল, আর যাতে ভ্যান গখ তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট না চায়। যাতে অপমানিত হয়। দ্বিতীয়বার না আসে। এই ব্যবহার আসলে সে জীবন দাশের সঙ্গে বলে করেছে, কেননা তার ছবি বিক্রি হবে, এই নিশ্চয়তা নেই। অথচ গণেশ পাইনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখলে সে নিজেই অন্তত তিরিশ মিনিট আগে এসে অর্ডার দিয়ে রাখত। এবার কথা হল সে জীবন দাশের সঙ্গে এমন ব্যবহার করল কেন? এক, জীবন দাশের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারে বলে করেছে। দুই, তার সংবেদনশীলতা নেই বলে করেছে। সংবেদনশীলতা ক্ষয়ে গেছে বলে করেছে। কিংবা হতে পারে জীবন দাশকে অপমান করে তার ভালো লাগছে বলে করেছে। এবার কথা হল কেন সে অমন? হতে পারে সে কখনও অপমানিত হয়েছে, তাই সুদেআসলে তুলছে। মনে রাখতে হবে যে নিজে অপমানিত হয় না, তার অপমানিত হওয়ার বোধও তৈরি হয় না। বা ধরা যাক, একসময়ে সে তার বাবার মৃত্যু দেখেছে, চিকিৎসার অভাবে। তার মনে বদলা নেওয়ার বোধ তৈরি হয়ে আছে। এসবের জন্য যে শুধু রাষ্ট্র দায়ি, সমাজ দায়ি, তা নয়। এই সমাজ মানে আমি, তুই, এরকম অনেক আমরা। আমি তুই সরাসরি ভ্যান গখকে হয়ত চিনি না। কিন্তু আমার বন্ধুর বন্ধু বা পরিচিতর পরিচিত, সে চেনে। যে চেনে তাকে হয়ত আমার পরিচিত অপমান করেছে, বা করতে বাধ্য হয়েছে। আমার পরিচিতকে হয়ত আমি অপমান করেছি বা করতে বাধ্য হয়েছি। তার দূরাবস্থার জন্য হয়ত দায়ি। এই সমাজ এই দেশ আসলে একটা চেইন সিস্টেম। সবাই সবার অবস্থার জন্য কমবেশি দায়ি। এমনকি আমি তুই হাত নাড়লেও এই বিপুলবিরাট মহাবিশ্বে তার প্রভাব পড়ে! বেশ, আরও স্পষ্ট করে বলছি। ধর, ফেসবুকে আমার বন্ধু সংখ্যা ৫০০। এই পাঁচশ জনের কেউ বারাক ওবামার বন্ধু নয়। এমনকি কেউ আমেরিকায় থাকে না। কিন্তু একজন যে আমার বন্ধুতালিকায় আছে, সে আমেরিকা প্রবাসী একজনের বন্ধু। সেই আমেরিকা প্রবাসী আবার এক খোদ আমেরিকানের বন্ধু। সেই খোদ আমেরিকান আবার এক আমেরিকান অধ্যাপকের বন্ধু। সেই অধ্যাপক আবার তাঁর কলেজে আমেরিকার এক কনসাল জেনারেলের মেয়েকে পড়ান। সেই মেয়ে আবার অধ্যাপকের বন্ধু এবং বারাক ওবামারও বন্ধু তালিকায় আছে। খুব কঠিন?’

‘আমার খারাপ থাকার জন্য তুই কি তাহলে কিছুটা দায়ি?’ কথাটা সেদিন বলতে গিয়েও মহুল ঠোঁট চেপে নিয়েছিল সেদিন।

এরপর আরও কয়েকবার অর্পণের ভাঙচুর, এমনকি দেওয়ালে নিজের কপাল ফাটিয়ে ফেলা, এসবের সাক্ষী থেকেছে। একটু ভুল হল, সেসব চিহ্নের সাক্ষী থেকেছে। তারপর মহুল নিজের পড়ানো, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবু এপাড়ায় এলেই অর্পণের সঙ্গে দেখা না করে, সেই ছাদের ঘরে না এসে পারেনি। এখন অবশ্য এক পাড়া হলেও ঘর বদলেছে অর্পণ। সেখানেও বেশ কয়েকবার গেছে মহুল। আজ যেমন বাড়িতে ওকে না পেয়ে কফিশপে যেতে শুনল অর্পণ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে, এরকম বেশ কয়েকবার দূর থেকে হলেও সাক্ষী থেকেছে। অর্পণের খারাপ থাকায় মহুল কি একটু হলেও দায়ি? মহুল নিজেকে যতবার এই প্রশ্ন করে অর্পণের সূত্র কিছুতেই সেখানে কাজ করে না। সে জানে অর্পণের খারাপ থাকায়, ওর এই অস্থিরতায়, মহুলের কোনও জায়গা নেই। মহুলের মাঝেমাঝে এসব ভেবে অস্থির লাগে। আবার শান্ত হয়ে আসে সে।   

 

২.     

যেকথা বলছিলাম, সুযোগ পেলেই ভ্যান গখ থুড়ি অর্পণ সরখেল তার ছোট্ট ঘিঞ্জি শহরটা ছাড়িয়ে একটু দূরে জায়গা খোঁজে। যেখানে টাঙানো আকাশে ছটফটে নীলের তলায় গাছেদের সমবেত আহ্বান, ডালে ডালে পাখি সব করে রব, সেইরকম একটা জায়গা। বন্ধু বান্ধব ভাবে খেয়াল। একা মানুষের খেয়াল। অর্পণ একা তো বটেই। সেই কোন ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে, তারপর সবই কেমন ছাড়াছাড়া। পারিবারিক সূত্রে এই কাফেটা অবশ্য সে পেয়েছে। নাহলে কী যে হত! আত্মীয় সেই অর্থে কাফেটা। ওর হাতখরচ, ভাত ডাল রঙ ক্যানভাসের টাকা সব সেই দেয়। অবশ্য চিন্তার ভাঁজ একজনের কপালে পড়ে, সে মহুল। সে-ই একমাত্র জানে অর্পণ যখন কপালে রগের দপদপানিটা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না, ওকে বেরিয়ে পড়তে হয়। ওই সময় অর্পণ থুড়ি গখ এতটাই ভায়োলেন্ট হয়ে যায়, যে মহুল ওকে আটকাতে সাহস পায় না। চিন্তা হয়। তাও চুপচাপ মেনে নেয় গখের এই হুটহাট বেরিয়ে পড়া। ওই ভায়োলেন্সের চিহ্ন সবথেকে বেশি থাকে ওর কপালে আর দু’হাতের তালুর উল্টো দিকে। ভায়োলেন্ট হয়ে গেলে সবচেয়ে আগে নিজের কপাল ঠুকতে থাকে অর্পণ। তারপর কপাল আর না নিতে পারলে সবচেয়ে আক্রোশে নিজের দু’হাত এলোপাথাড়ি দেওয়ালে মারতে থাকে, সজোরে মুঠো পাকিয়ে। তারপর একসময় প্রায় অজ্ঞান হয়ে মেঝের উপর শরীর ছেড়ে দেয়। হুশ ফিরলে  অবসন্ন শরীর নিয়ে হয় ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ায়, ততোধিক ক্লান্ত হয়ে, নাহলে বাড়ির বাইরে এদিক ওদিক একটু ঘোরাঘুরি করে। হাঁটতে হাঁটতেই মনে মনে তৈরি হয়। সেইদিন বা তার পরেরদিন  ক্যানভাস কিটটা নিয়ে কোথাও একটা বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে সামান্য কিছু খাবার, অনেকসময় আবার তাও নেওয়া হয়ে ওঠে না। তবে রক্ষাকবচের মতো সঙ্গে সবসময় তার এটিএম কার্ড থাকে। যাওয়ার পথে কোথাও একটা গাড়ি থামিয়ে টাকা তুলে নেয়। সেই অর্থে জমানো বলতে কিছু নেই অর্পণের। সবই মোটামুটি খরচ হয়ে যায়। ও জানে নিঃস্ব হওয়ার মধ্যেও একধরনের আনন্দ আছে। একমাত্র যখন রঙ কিনতে পারে না, তখনই ও মহুলের কাছে হাত পাতে। মহুল ওর একদম ছোটবেলাকার বন্ধু। সে বোঝে। রঙের টিউবের সঙ্গে বাড়তি কিছু টাকাও রেখে যায়। যদিও এ পর্যন্ত একবারই তার সোলো এক্সিবিশান হয়েছে। ছবি সাকুল্যে দুটোর বেশি বিক্রি হয়নি। সেসবই অবশ্য মহুলের চেষ্টায়। তবে সেসব ভেবে সে কাজ করে না।  

অর্পণ আজ বেরিয়েছে নদীর ধার ঘেঁষে নিরিবিলি দেখে  কোথাও একটা ক্যানভাস স্ট্যান্ড লাগাবে। অনেকদিন ধরেই মনের মতো কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। শেষ একটা বড়ো কাজ ও করেছিল তাও বছর দেড়েক আগে। তারপর থেকে যে কাজেই হাত দিয়েছে, কেমন যেন মণ্ড পাকিয়ে গেছে। শরীর আর মনে ক্ষোভ আর ক্রোধের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে কাজ যেন তার ভাপে মণ্ড পাকিয়ে যাচ্ছিল। শরীরের প্রতিটি কোষ থেকে যেন ব্যর্থতার ভাপ বেরোচ্ছিল। কোনা হাইওয়ে ধরে আজ খুব দ্রুতই বোম্বে হাইরোডে এসে পড়েছে। মিনিট তিরিশ এগোতেই গাড়ি থামাতে বাধ্য হল। সামনে বিশাল গাড়ির লাইন। এই রোডে এতবার এসেছে, কখনও এমন হয়নি। অ্যক্সিডেন্ট? তাহলে আরও বেশ কয়েকঘন্টা হয়ত এভাবেই আটকে থাকতে হবে। খাবার বলতে কেক আর সঙ্গে কয়েকটা কলা নিয়ে এসেছে ও। কী মনে করে গাড়ি থেকে বেরবার সময় কাঁধে ক্যানভাস কিটটা সঙ্গে নিল। প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর লোকজনের কাছে খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারল ব্যাপারটা। কলকাতা থেকে মন্ত্রী এসেছেন। বক্তৃতা ইত্যাদি করার পর কৃষকেরা তাঁদের ফসলের দাম হিমঘরের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে মন্ত্রীর কাছে দরবার করার পরও কোনও সুরাহা মেলেনি। এই দরবার নাকি প্রায় দেড় বছর ধরে চলছে। মৌখিক আশ্বাস ছাড়া এখনও অব্দি নাকি কিছুই মেলেনি। ফলে কৃষকেরা আজ তৈরি হয়েই এসেছিলেন। টমেটো নাকি কৃষকেরা এইমুহূর্তে হিমঘরে মজুত করার ব্যবস্থা না পেয়ে ৫০ পয়সা কিলো দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। ফলে আজ মন্ত্রীর কথায় কোনও আশ্বাসবাক্য না থাকায় তাঁরা তাঁদের ক্ষেতের সব টমেটো রাস্তায় ঢেলে দিয়েছেন। 

আরও মিনিট পাঁচেক এগোতেই অর্পণ নিজেই দেখল সেই দৃশ্য। বস্তা বস্তা টকটকে লাল টমেটো রাস্তায় ডাঁই করে ফেলা, বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে। রাস্তার এক ধারে মন্ত্রীকে ঘিরে তাঁর অনুগামীরা। সেই অনুগামীদের মধ্যে এক খ্যাতনামা সাহিত্যিককেও চিনতে পারল অর্পণ। শহরে তাঁর অনুষ্ঠানের হোর্ডিং পড়ে মাঝেমাঝেই। অর্পণ চিনতে পারল। এরই মধ্যে মন্ত্রীকে ঘিরে জটলাটা ক্রমশ তারই দিকে এগিয়ে আসছে যেন। অর্পণ অবাক হয়ে সেই দিকে ভালো করে তাকাতে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। আসলে মন্ত্রী গাড়িতে উঠবেন। মুহূর্তের মধ্যে মন্ত্রী গাড়িতে উঠলেন। কৃষকেরা কেউ কেউ কিছু টমেটো নতুন করে রাস্তায় ঢাললেন। মন্ত্রীর গাড়ি সেই রাশিরাশি টমেটোর উপর দিয়ে রাস্তা রক্তজলে ভাসিয়ে চলে গেল। তাঁর গাড়ির পিছনেই বিখ্যাত সাহিত্যিকের গাড়ি পিছু নিল। দু’মিনিটের মধ্যেই জায়গা প্রায় ফাঁকা হয়ে এল। শুধু কিছু কৃষক কিছু আন্দোলনকারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বসে পড়লেন। একটু আগে এঁদেরই কাউকে কাউকে অর্পণ দেখেছে ঝুড়িতে করে টমেটো রাস্তায় ঢালতে। ভ্যান গগের বুকের ভিতর ওই টোমেটোর রক্তস্রোত যেন বান ডেকে গেল। সে একটু দূরে ড্রয়িং খাতা খুলে সেই সারি দেওয়া ঝুড়ি থেকে টমেটো ফেলা আঁকল। সেই স্কেচের এককোনে উবু হয়ে বসে থাকা দুটো লোক, বিড়ি খাচ্ছে। ছবির নাম মনে মনে ভেবে নিল ‘দ্য ডিজাস্টার’। অর্পণের মনে পড়ল কিনা আমরা জানি না। আমরা যারা সেই স্কেচ দেখলাম, আমাদের অবধারিত ভাবে মনে এল ‘দ্য সাওয়ার’(ভ্যান গখ, ১৮৮৮)! সৃষ্টির অপর পিঠে ধ্বংস। যে ‘দ্য সাওয়ার’ এঁকেছিল, সেই কি তবে আঁকল ‘দ্য ডিজাস্টার’? আমরা জানি না। শুধু সূর্যাস্তের আলোয় যখন তার কণ্ঠার হাড় আরও বেশি জেগে উঠেছে তখন গুলিয়ে যাচ্ছিল আয়নায় এক কানে ব্যান্ডেজ বাঁধা আত্মপ্রতিকৃতিটার সঙ্গে। ওদের দুজনের দেখা হয় ছবিতে। শুধু একজন অন্যজনকে সহ্য করতে পারে না। 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment