দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম

দুর্জয় আশরাফুল ইসলামের গুচ্ছ কবিতা

ভিটে-বাড়ি

যে কোন জলদিঘিকে মনে হয় কবিতায় ছুঁয়ে আছে
আর যে হাঁসেরা খেলা করে অলস দুপুরবেলা তাদের
আঙুলের মাপ নেবে বলে থরথর করে জল নামছে
নরম রোদের ভেতর এই স্মারকচিহ্নের খেলা চলে –
ছায়ামেঘ দূরে বসে থাকে অপেক্ষায়, কখন বাঁশিতে
সুর তুলতে তুলতে আলস্য গাঢ় হয়, পৃথিবী ঘুম যায়;

যে কোন চোখের গল্পে হরিণ মূর্তি নামে, দাবাঘর ঘিরে
স্তব্ধতা যেরকম। অতীতের প্রেমিকেরা আজ কোথায়,
হাতপাখার বুননে যে গ্রীষ্মকাল তার উত্তাপ থেকে সরে
বৃষ্টিমণ্ডলের দেশে? নড়ে ওঠে বন্ধ্যা বাতাবিলেবু গাছ,
কোন খোঁজ নেই, শুধু জানি খুঁড়তে জানলে আজও
পাওয়া যেতে পারে পিতৃভূমির শিকড়বাকড়, মুদ্রাক্ষর

আশাবাদ

তলিয়ে যেতে যেতে ভাবি এই বুঝি ডেকে নিচ্ছো আমায়
তোমার বহির্মুখের অন্তরালে উঁকি দেয় ফুল ফল ঘাস –
একটি নবীন মেয়ে সাঁকো ধরে হেঁটে যায় দৃশ্যের অধিক
মলিন প্রার্থনা আজ জলের সমান্তরাল ছুটে দিকবিদ্বিক
আকাশে আলো নেই তবুও হিরের আংটি হলো প্রদীপ
অন্ধকার ভীষণ জেনে সে কথাই বাজে বুকে অপার্থিব;
তলিয়ে যেতে যেতে ভাবি এই বুঝি পাচ্ছি তোমায় গভীর
আশ্চর্য গ্রহণের নিচে যুদ্ধসফল, অতলে সাজানো দ্বীপ।

জ্যোৎস্নাপাত

কোথাও বিজ্ঞাপনের মতো আলোড়িত হচ্ছে রাত
আলোর মফস্বল পেরিয়ে একে একে খুলে যাচ্ছে দরজা
আমরা তার কতটুকুই বা জানি –
একার ব্যালকনিতে বসে বন্ধুকে লিখি অসুখের জিজ্ঞাসা
বাণীময়, তবুও এই শহরের বাইরে যতখানি স্তব্ধতা
উগড়ে আসা বিষ, ঠোঁট ছুঁয়ে নামা জলের মিছিল
সব উপেক্ষা করে আকাশে তাকাই,
ক্যাবলাকান্তের মতো একটা ভীষণ চাঁদ তাকিয়ে আছে
আমারই দিকে,কী দেখে সে?

সন্ধ্যা রজনীগন্ধা

কোথাও সন্ধ্যালোক নামছে বিনীত হাসির আগে, আর সেতারে বাধা সুর ছড়িয়ে পড়ছে পায়ে হাঁটা অনেক দুরত্বের পথ থেকে নন্দনকাননে, দেবীর মতো পাঁচটা আঙুল ঢেউ তুলছে সুনিপুণ যদি, দৃষ্টিপাত এমনই ক্যাবলাকান্ত, কাঙাল মনুষ্যজীব বলে বৃথা শোরগোল তুলতে চাচ্ছে পাতার মফস্বল।
যেন অনন্তকাল এই আকাঙ্ক্ষার পরিসীমা অস্পর্শ গমনাগমনের পথ ধরে ঝুলে আছে চশমার নীচে, আর বয়স এক সুদক্ষ শিল্পকারিগর, নানা রঙিন কারুকার্যের ভেতর সঞ্চিত করে অভ্র-আবীর, মন্বন্তরের করোটির ভেতর যা সদা বর্তমান, চাতকের তৃষ্ণা বুকে নিয়ে পরাজিত মানুষ।

পৃথক ভোর

আজ পৃথক ভোর জাগে; সিড়িতে চুম্বনের দাগ নিয়ে
জনারণ্যের বিবিধ সেতু পার হয়ে যায় ভিনদেশী।
বেড়ালের আর্তস্বরের পাশ ঘেষে ভেঙে পড়ে স্ফূর্ততা
ভিখিরির হাত ভরে আসে ঝরে যাওয়া পাতা কড়ি।
অনুকম্পা আর পরমানন্দের পৃথক মেজাজ বাতাসে
বৃষ্টি আসে, বৃষ্টি নাই এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর বাঁশি
ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গতিবিদ্যা এসে ক্রমশ স্তব্ধতা শিখে
চারিদিকে নির্জনতা, শূন্যতার তীর্থস্থান, পাখিও নাই
আর তুমি ঘুমিয়ে থাকো, কোন উড়াল স্বপ্নের চরাচর
গভীর রঙিন এক পৃথিবী, সফলতা পালকে স্পষ্টত;
বাউলের নৌকা কেবলই যায়, বৈঠাহীন উজান পথ
তোমাকে নিয়ে, যাদুমন্ত্রের দেশ, দিব্যপৃথিবী যেখানে
আজ পৃথক ভোর জাগে; সিড়িতে রক্তের স্পষ্ট দাগ
বড়শি কাঁধে কাঁধে জলের আসর ছাড়ে শিকারি দল

বাঁশি

হলদে খামে সে চিঠি আমিও পেয়েছিলাম
আশ্চর্য এক বর্ষাবেলায় –
সে চিঠির আলোড়ন আজ এতদিন পরেও
শান্ত হাওয়া আনে
পড়শি দূরের বাতাবিলেবু গাছ
নড়ে ওঠে;
আর কি সব মনে পড়ে…
মনে পড়া মুহূর্ত ঘিরে নামে ছায়া-স্রোত
কে যায় কোথায় দূরে কে যে আসে কাছে
কিছুই মনে আসে না আর
শুধুই মনে হয় সব সে হলদে সুরে মেশা
জীবনের সমাবর্তন
জলধারার পাশেও তৃষ্ণারকম…
বাঁশি বেজে ওঠে কেবলই ঘন্টি ধরে…

দূরভিসন্ধি

আমি কী পারতাম সাপ হয়ে এমন ঢুকে যেতে
গৃহদ্বার! যদি তটস্থ হাওয়া কাঁপিয়ে দেয় বুক
আমি কী পারতাম অমন করে ধ্বংসমূল হতে!
তোমার সদাপ্রেমের গান আকাশে বাতাসে
লোকালয় ভরে ওঠে নতুন ফসলের আগে,
তবুও প্রভূত ভয় অগ্নিদাহের মত ছড়িয়ে যায়
আর মানুষেরা ঘুমোয়। বিভ্রাটের শহরে শান্তি
আমি কি পারতাম অমন বিশ্বাসের সব ছিঁড়ে
নীল হয়ে ফুটতে তোমার কন্ঠস্বরের সম্মুখে…
অজস্র জাগরণ নিয়ে রাত্রির অতি গভীর দেশে
ঢুকে যেতে বিষের প্লাবন হয়ে একা একা,
তুমি আর আমাকে পারো না ফেরাতে জেনে
মুর্চ্ছা যাওয়া মহাকাল, গাঢ় হয় তার বলিরেখা

Facebook Comments

Related posts

One Thought to “দুর্জয় আশরাফুল ইসলামের গুচ্ছ কবিতা”

  1. ‘তলিয়ে যেতে যেতে ভাবি এই বুঝি ডেকে নিচ্ছো আমায়’

    আমিও ভাবি। কী অদ্ভুত সুন্দর সব পঙক্তি! বারবার পড়ি।

Leave a Comment