দিব্যেন্দু দলুই

দিব্যেন্দু দলুই-এর কবিতাগুচ্ছ

০.০১
শাপলার বেদনা যেথা রূপ হয়ে ফুটে আছে, সেইখানে
		মজে গেল ঘুণে-ধরা শালতির গলুই

পরিহাস ছলকে ওঠে জোছনার, নির্জন ঢিবির খেদ
বিহ্বলতা এনে দেয়— ঝিনুকের বোবা ঘুম, নক্ষত্রের নীচে
গূঢ় কালো জলের নির্বন্ধ, টানা ঝিঁঝিঁডাক শুনে যে-শ্রমিক
নেমে গেল গহীন পাতালে, তার বুকের কাদায় শিঙিমাছ

মরে গেছে বহুদিন: মেয়েটি বাসন মাজছে আঘাটায় বসে
দু-চোখে তমালছায়া, থুতনিতে লাজুকতম তিল, ঝুড়ি হাতে
জোছনার দশক ডিঙোচ্ছে হাওয়া
দিয়েছিল সে আমার অসুখে শেকড়বাটা লেপে
				   কোনো একদিন
আমি তার গোলাপি নরম ঠোঁটে রেখেছি বিষের নীল, আজও
রাত গেলে বেগনি আভায়

ফুটে ওঠে সেই প্রেম শালতির শরীর ঘেঁষে: যে-প্রেম বর্ডার ক্রস করে
পালিয়ে এসেছিল এই মেঘেদের ইটভাটায়, মন্বন্তরকালে


০.০২
ছেড়ে আসি লাল লাল পোস্টকার্ডে-মোড়া ডাকবাক্সের শহর

ছেঁড়া ও বাতিল চিঠি, খামের প্রশ্রয়চ্যূত, পুঁটলি করে বাঁধা
পিঠে নিয়ে চলেছি গঞ্জের পথে, স্পোক-ভাঙা মুমূর্ষু রিকশায়
দু-পাশে বিপণি, বার্চ, নীল টালি, সবুজ কাচের শেলফ জুড়ে
থরে থরে সাজিয়ে-রাখা পেপসি, পাপ, কফিনশিল্পীর কালো কোট

জমানো যা-কিছু মেঘ, জন্মদিন, বুকের গোপন জাদুঘর
লেখার টেবিল, জুতো, জাঁতাকল— পড়ে আছে পরিকল্পনায়
চন্দন কাঠের বেঞ্চ পড়ে আছে কাজুবনে, বোবা ও নিঝুম

তাসের শহর ছেড়ে গেছি দূর, ফার্নে-ঢাকা ফাঁকা এ-বাড়ির
সম্পূর্ণ দখল নেবে জুন মাসে জেলফেরত জোনাকির দল


০.০৩
আমাদের দেখা হল ঝরে-যাওয়া মেপল পাতার মরসুমে

পাহাড়তলির স্কুল তখনও ডাকেনি পাখিদের

বিকেলের বারান্দায়, বসে আছি বেতের চেয়ারে মুখোমুখি
কনে-দেখা আলো এসে পড়েছে তোমার গালে, সোহাগী মাফলার
বেড় দিয়ে রেখেছে তার মায়া, মিথ, নীল পশম ঢেকে আছে বুক

সবকিছুই সাজানো ছবির মতো মনে হল, যতটুকু
হাসি বা হরফ
ছেঁকে নিলে— গানের ধ্রুপদ, হৃদয়ের শ্রম যেন সেটুকুই
লতাপুষ্প-আঁকা এই বিষণ্ণ তামার কেটলি, জড়িবুটি মেশানো চায়ের
সবুজ পেয়ালা থেকে ছড়ানো সুবাস যতদূর

ডেকে আনে তৃষিতকে, তারও বেশি উঠে আসি
পাকদণ্ডী বেয়ে গুপ্তচর
একদিন তোমার ওই চোখের ছায়ায়
থেমেছিল ঘোড়া, ব্যথিত হ্রদের পাশে থমকে গিয়েছিল
				 প্রাচীন গির্জার পথ


০.০৪
সমূহ কথার জাল থেমে আছে কুয়াশায়, হিম লেগে শান্ত হয়ে আছে
				      ভেজা চরে মৃত বেলেহাঁস

এই মর্মে আসি আর যাই, সারারাত জলের নিহিত কোলাহল
গাছের রহস্য দিয়ে বুঝে নিতে নিতে
ফুলে ফুলে ওঠে তার মাথার ভিতরে গাঢ় মেঘ
পরপার জুড়ে সব দীর্ঘ নীল নিমজ্জিত গাছ

আমার না-দেখা মুখ মনে পড়ে গেল
শুধু এক নিবিড় জানলার খোঁজে কতকাল
উন্মাদ ফিরেছে হাওয়া, কতদিন ফুল থেকে ফুলে
হোঁচট খেয়ে বেড়িয়েছে অসুখী ভ্রমর, তাকে ডেকে নিল প্রতিষ্ঠান
প্রতিষ্ঠান ছিবড়ে করে তাকে ছুঁড়ে ফেলল পুনরায়, কেউ তো জানে না
কী যে কূট জোছনায় জ্বলে-পুড়ে গেল মেধাবিষ

‘বেসিক্যালি, ভাষাই কালপ্রিট’— চাপা খল হেসে চুরুট ধরালেন প্রফেসর

তোমারও চশমার কাচে মুছে-ফেলা রোদ্দুরের লিপি
তোমারও জামার ফাঁকে বহুযুগ জমানো পাথর
কে যেন শহর ছেড়ে মায়াবী নদীর ডাকে হেঁটে গেল একা—
তার ঠোঁট থেমে আছে রূঢ় হিম কুয়াশার নীচে
নাইলন কথার জাল স্তূপাকার পড়ে আছে রূপোলি বালিতে

কতবার বেদনার মুখে উঠে নেমে গেছে জলতল
ছলনায় ছলনায় জোনাকিরা ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেছে বুক
সেসব জখম থেকে অভিমান মেলে
উড়ে যাবে একদিন সোনালি সুতোর বেলেহাঁস
নরম সুখের পাশে গেঁথে যাবে ঢেউ

আমার নিখোঁজ লাশ চুরি করে নিয়ে যাবে জালছুট জেহাদি কোনো মাছে
তুমুল কথার ভিড়ে যে-ছিল সহজ রূপকথা: সেই মেয়েটির কাছে
Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment