হাসান রোবায়েত

তারাধূলিপথ

ভাবছি, একদিন তৃণের আভার পাশে নতজানু আমি—ভেড়াগুলো গুল্মশোর ধরে চলে গেল বাবলার তীরে—যেন এক রুদ্ধদ্বার ঈশান ও নৈঋত কোণে—অশ্রুত সেই কাঠ কী বিপুল একা!

ওপারে তোমার বেলাভূমি—শান্ত এক ঢেউ ধুয়ে দিলো তিতির আঙুল:—চিত্রাক্ষীর ছায়া ঘুমিয়েছে পাতার উপর—

 

এতোটা মরণ নিয়ে কোন ভৈরবী ফিরে যাবে হাওয়ায়—

 

ভাবছি, একদিন মহুল নদীর ধারে, ভেড়াগুলো শ্রান্ত হয়ে পানির উপর বিছিয়ে দেবে আত্মার ঢেউ—যখন, শিশুরা পার হয় ঘুম, তৃণের কথোপকথন—

ওপারে তোমার বোল—মাধুগাঙে নবমীর পানি—রেণুর কল্লোল, হেলে পড়ছে তিতি ফুলের উপর—এখানে, মধ্যাহ্নের তীরে হায় রু! রূপস মর্মর! চিত্রিত বাতাসের নিচে—

 

একটি অন্ধ ভেড়া—চারদিকে অজস্র পথ

 

১০

 

ভাবছি, একদিন ঘুঘু ও নদীর কাছে ভেড়াগুলো ফেলে যাবে সমস্ত কথা, তৃণভাব-মহুয়ার কাছে—তখন, হয়তো কেউ সান্দ্র পানির নিচে দেখছে ক্লান্ত শব, নদীটির পাখোয়াজ ভরা মেঘ

 

চারদিকে সোনালী মাছের ছায়া কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মোনামুনির পাতায়, ছলাৎ ছলাৎ শব্দে—আর তিতি ফুল নম্র আঙুলে তার ধরে রাখে তোমার ঋষভ—

 

তুমি কি মায়াবীপাড়ের নদী—!

 

হু হু এক বাতাসের ছায়া—!

 

এতদূর মূকাভিনয় আর শতরঞ্জির কাছে আমি এক ভারাক্রান্ত সুর—অদূরে তিতির এক শীলিভূত তারাটির খোঁজে গুমরে কাঁদছে একা,

 

একা—

 

১১

ভাবছি, একদিন যদি শ্বাস ফিরে দেখতে পাই গভীর দ্বিধার পাশে কয়েকটি কমলালেবু পেকে উঠে আবার অস্ত যায় ফুলে—এই যে শরীর, হাসির সমান এক নিঃসঙ্গ বনতল—দিনান্তে, ঘাসের ছিন্নবনে ঝরে যায় ভেড়াদের দিন—

 

অনন্তের বালু ঘড়ির ভেতর নক্ষত্রের উচ্চতা বলে যেন কিছু নেই শুধু তিতি ফুল নিশ্চুপ বাতাস হয়ে কাঁপে, উড়ন্ত মাছরাঙাদের চোখে

 

‘মানুষ কোথায় যায়—?’ নিমগাছটির প্রশ্ন এই—

 

১২

 

 

ভাবছি, একদিন দূর লণ্ঠনের ভেতর ম ম করতো সময়—দু চার শিখা উল্টিয়ে সেসব কবেই রেখে দেওয়া হলো কাঠগন্ধের পাশে—যেন আরো অনেক দিন পর অন্য কোনো ইশারার দিকে চেয়ে সেসব পাওয়া যাবে অনায়াসে—এমন অবিশ্বাস আর আত্মতা নিয়েই আমার ঝরে যায় দিন—সে দিনের রঙ কেমন আমি ভুলেও জানতে পারি না—তখন, হয়তো কেউ নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের ধারে বসে, যে রেণু সূর্যাস্ত দেখছে আনমনে, কিভাবে অনুভব করেছিল তাকে!

 

আজ এই নিরন্ন রোদ আর অনেক পাতার হাওয়ায় কোনোদিন যাওয়া হবে না সেই নদীটির কাছে যেখানে তোমার ছায়া আমার মৃত্যুর পাশে ছড়িয়ে দেয় রজোনীল বুদ্বুদ—তৃণগুল্মের পাড়ে তুমি কি বিস্তৃর্ণ হেম—!

 

শান্ত ভেড়ার চোখে ডুবছে পাখির শিস—

 

১৩

ভাবছি, একদিন আমাকে চলে যাওয়া ধরে সেই পথ বিস্তীর্ণ শুয়ে আছে হাওয়ায়—ঘুমন্ত পেয়ারার পাতা তারাদের ভাগ্যহীন আলোয় নিঃশব্দে পেরিয়ে যায় ঝরা—কূপের গভীরে বসে ইউসুফ কি ভেবেছিলেন, মৃত্যুকে ধারণ করে নি কোনোদিন এই মাটি, এই অমৃতজঠরের চিৎকার—

 

আজও আমাদের রাত হয় বহু কিন্নর ঘাসে অথবা শাপান্ত করে মানুষের মুখ—ঘাসের তন্তু থেকে ফিরে ভেড়াগুলো রেখে দেয় শীতার্ত-উজ্জ্বল পাড়—

 

ওপারে তোমার রূপ—অলাত-শস্যের উপর বয়ে যায় হাওয়া—  তিতির অন্ধকার ধরে আছে তোমার আঙুল

 

তুমি কি ভূমিশ্রী? রজোনীল হাওয়া?

 

যে যায়, কেন সেই নির্বাক অশ্রু-সভায় কেঁপে ওঠে স্নায়ুবন! হে আমার আসমুদ্রবীথি, সেইসব ভেড়াদের সাথে যদি দেখা হয়—ঢেউয়ের সমাপ্তি হয়ে বলো, তৃণের গভীর এই হাওয়া, কতকাল আজন্মদুখী!

১৪

ভাবছি, একদিন কত মানুষই তো চলে যায়—কেউ বলে আবার কেউ না বলেই! তারপর, হঠাৎ করে বুঝে ফেলি, ওপারে যাবার মতো আর কোনো সাঁকো নেই, কেউ হয়তো দাঁড়িয়েও নেই—

 

তবু কি চিরন্তন একটি আমি—এপারের আধো-মানুষ—অপেক্ষায় নেই কোনো এক সমাপ্তি-পথের!

১৫

ভাবছি একদিন, আমাদের না হওয়া দেখার সন্ধ্যায় কোথাও মৃত্যু হলো কারো—পৃথিবীপাড়ের সেই ঘরে কেউ নেই, একা হারিকেন অনন্ত বেদনায় কেঁপে কেঁপে নিভে গেল ম্রিয়মাণ, নদীটির পাড় ঘেঁষে একটি নৌকা আসে যায়, শান্ত পানির নিচে মাছেদের কথোপকথন ভেসে আসে বুদ্বুদ হয়ে, তারপর নিখিল ঊর্ধ্বের রাতে তাদের কথা হয় আকাশগঙ্গার সাথে—

 

সেই, সন্ধ্যাদূরের ঘরটিতে শাল্মলী বাগানের ব্যথা, ভেড়াগুলো তৃণের হৃদয়ে মুখ ডুবিয়ে জমিয়েছে ছোট ছোট শিশির, তাদের পিঠের উপর জোছনার ঠাণ্ডা হাওয়া—সময় পাক খেতে খেতে বনতল, শিলীভূত নক্ষত্রের ছায়া, ঘুমন্ত দুপুর—ফিরে আসে, ফিরে যায়—

 

তুমি কি খাড়িপথ বেয়ে চলে যাওয়া নদীটির অন্তহীন ভূমিকাল—! একাকী চরের ভেতর ডাহুক পাখির দু চোখ—!

 

১৬

ভাবছি একদিন, গভীর ঘুমে মেঘের রুহ ছোঁয়া বিটপীর আলোছায়াময় বনে তলিয়ে যাচ্ছি—চারপাশে, অনেক কালের ঘ্রাণ, ঝরাপাতার উপর সে কোন শতাব্দীর আলো, পাখির সুরের উপর ভাসতে ভাসতে যেন বহুদিন হলো পড়ে যাচ্ছি এই ক্রমলীন জলআলেয়ার ছোট ছোট কণায় ধাক্কা খেয়ে—কোথাও, অনেক দূরের মঠ থেকে ভেসে আসছে ঘন্টার ধ্বনি—দক্ষিণে উপবন—কিন্নর ঋতুর দোলা কাঁপছে বাতাসে—মঠের ওপারে কেউ পাহাড়ি ঘোড়ায় চড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রাচীন বাজনার সুর—ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে আমার—গানের শেষাক্ষরে শিশুরা রেখে দিচ্ছে নিমফুল—

 

ট্যাঞ্জারিন বাগানের মধ্যে নিশ্চুপ, ছায়াঘেরা একটি কুয়া—পানির উপর টুপটাপ ঝরে যাচ্ছে ট্যাঞ্জারিন ফুল—কে যেন রশি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বালতিতে তুলে আনছে মন্দালোকিত নক্ষত্রের সুর, বিস্তীর্ণ বিষণ্নতায় স্তব্ধ চরাচর—কেবল বরফখণ্ড থেকে নেমে আসা সারি সারি ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে বাঁশপাতা ঝড়ে যাওয়া মধ্যদুপুরের ক্লান্তিতে—আরো অনেক দূরে, উঁচু-নিচু উপত্যকায় ফুটে আছে হাজার হাজার টিউলিপ, মাঝে মাঝে দেখা যায় মাঠের পরে মাঠ ছড়িয়ে আছে ঢোলকলিমর বন—সেই প্রাচীন গাছটির নিচে জেগে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি—সহস্র নৌকা ভিড়ে আছে সূর্যমুখী নদীটির পাড়ে, তাদের খোলভর্তি উজ্জ্বল রঙের টিউলিপ—গমের বাগান হয়ে বাতাসের ছোট ছোট মেয়ে দৌড়ে যাচ্ছে সেইসব নৌকার দিকে—

 

ভেড়াগুলো কলমির বনে খেলছে তিতির সাথে, নিরাকুল স্তব্ধতার ভেতর তুষারের নিঃসঙ্গতা, পৌষের অস্তমান কুয়াশায় কাঁপছে দূরের বিষাদ—

 

তুমি কি তাদেরও ওপার—! অর্থহীন তারাদের আলো যেখানে বনভূমির হৃদয় শান্ত করছে প্রতিদিন—শোকাতীত ফুলের উপর ছোট ছোট ট্যাঞ্জারিনের স্বেদ—!

 

আমার মৃত্যু যেন এত মৃন্ময়, নক্ষত্র-বিস্তৃত একটি ঝর্ণার ধ্বনি—

 

১৭

 

ভাবছি, একদিন, প্রাচীন দুপরের নিচে কয়েকটি ভেড়ার সাথে কথা হবে—নদী পার হয়ে কারা যেন চলে গেল রেলকলোনির দিকে! সেসব জানে না তার অমিত পিয়াল—কোথাও, হয়তো পড়ে আছে পৃথিবীর শেষ সাঁকোটির ছায়া—চাতালের জাম গাছ আমাকে ডাকছে অজস্র পত্রসমেত—

 

ক্ষমা: এক দীর্ঘ দ্বীপান্তর—

 

চৈত্রমুখর নোনা হাওয়া, তোমার মলিন গীতে আমাকেও রেখো কোনো সুরে: গভীর কাঠের ভেতর যতদূর সরোদের ছায়া—

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment