তথাগত

তথাগত’র কবিতাগুচ্ছ

অহরহ দেবতা আমার

১.
কিচ্ছু লিখছি না। হে নাথ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঘটে গেলে পরে
কিছুই লেখেনি কোনো কবি। হৈমন্তী বা চৈতি – ফসলের এই
সুমধুর নামগুলো মানুষের ভাষা থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে।
কে লেখে? কী লেখে? সমুহ মাত্রাগণনা রীতি মান্য করে তারা ভুল লেখে, মিথ্যে কথা লেখে।
ভুল আশা ভুল দ্রোহ ভুল মঞ্চে শৃঙ্গারশতকগাথা।
ফুল তার মধু , দিয়েছে, অবিশ্বাসে – সেই কথা লেখো।
বাতাস, উদ্গ্রীব বলাকা চঞ্চুতে রেখেছে কোমল স্তন, বলেছে
হে কোমলপ্রাণ, বসন্তকর্ণিক, এসো, ছিঁড়ে খাও।
– এই অবিশ্বাস্য ছবিটিকে লেখো।

কিছুই লিখিনা নাথ।
বীরের মৃতদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে নরম পাখিতে – এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ফেলে
আমি, খ্রিস্টপূর্ব শতকের কবি, মূক ও বধির হয়ে আছি।

 

২.
ধুলোর চেয়েও ভঙ্গুর করে দাও প্রভু, আমি হাওয়ায় হাওয়ায় এই চৈত্রঋণ শোধ করে যাব।
কী বা দাবি নাবিকের অনর্গল সমুদ্রলাঞ্ছনা ছাড়া?
ফুটোপাত্রে সকল অমৃত মোর শুষে নিয়েছে ব্যাকুল মৃত্তিকা। এই তো বেসেছি ভালো।
মাটির স্তনের দিকে চেয়েছি অনিমেষ, মা গো, বুকের উপর ওই পদযুগ রেখে তুমি
ল্যাংটো নৃত্য করো, আমি কালগহ্বর দেখি।
চম্পা শেফালি পদ্ম যূথিকাকে সকল রাত্রি শুধু এই কথা বলি ভানুমতির খেল দেখা বালা ,
অশ্রুমতী হয়ে আর কতক রহিবি?
কোলেস্টেরল বেড়ে গেছে, হাঁফ লাগে, মাঝ রেতে একা একা মদ খেতে ভরসা পাইনা আর,
সিগারেট গুনি। ইসিজি মেশিনে দেখি ব্যাসকূট ফুটে ওঠে ওই —
দ্বৈপায়ন বলছে আর অর্থ-ব্যঞ্জনায় হাবুডুবু গণপতি চেয়ে আছে শূন্যে, মহাকাশমেঘে।

আমার চোখের পরে চোখ রাখো নাথ, ভয় কীসে? ধুলোর চেয়েও কতো ভঙ্গুর করেছ।

 

৩.
সারা দিন কাকে লিখি আমি? তোমাকে? নাকি নিজেকেই লিখি? দগ্ধ ময়ূরের কথাও কি লিখিনি আমি? শ্রাবণের মেঘ করেছিল তাই ডানা মেলে দিয়েছিল শিখিপক্ষী আর সহসা বজ্রে তার গান আর নৃত্যের মুদ্রাগুলো পুড়ে হল ছাই – সে কথাও কম তো লিখিনি!
লিখে খায় যাঁরা, বেনিয়াবৃত্তিতে যাঁরা ধর্মজ্ঞ হয়েছে, প্রজাপালনে যাঁরা আকাশের ঘুড়িবৎ রঙিন ও উড্ডীন তাদের কথাও লিখি। সিএএতে ঘাড়ধাক্কা খাবে যারা, কিম্বা মালবাহী ওই গাধাটিকে, হোটেলের বেহারি চাকর, আপিসের নেপালি দারোয়ান, ফুলের নকল পরাগ – ইহাদেরও লিখি।
কেবল তোমাকে লিখিনি। চাকরি পাচ্ছি না ভেবে, দয়াময়, যদি দয়াপরবশ হয়ে পড়ো, যদি তোমার প্রেমের করুণ ও কঠিন মীড়গুলো থেকে আমি ছিটকে সরে যাই নাথ!
এতো সহস্র আলো প্রভু, বৃথাই জ্বেলেছ। আর ওই অতো রঙের দোয়াত? মাঝে মাঝে আমাকেও লেখো!

 

৪.
প্রভু তোমার মুদ্রা সে কি বরাভয়? সে কি স্থির? তাকে চঞ্চল বলের মতো
ভূর্ভুব পার করে শূন্যে ছুঁড়ে দাও। যে মেয়েটি নাচে, ও পাড়ার , দুর্মতি পুরুষের
উচ্ছল ডানা যেন, আহা, আহা, তাকে আমি থামতে দেখিনি। তাকে আমি শ্যামা শ্যামা ডাকি।
চঞ্চল হাওয়ায় তার শ্যামাশিষ দুলে ওঠে , মা গো, এ গলি ও গলি পাথার – সমুদ্র বনবন
বনবন আমাদের চেতে দড়ি ঘুরিয়ে সে মারে। তবু। ও মুদ্রা তুমি অচল রেখোনা।
এ পাড়া জন্ম আর ও পাড়া মৃত্যু। মাঝের পাড়াটিকে তুমি ধূসর রেখেছ প্রভু।
ও কি ঘুম? ও কি স্থির? ও কি বরাভয়?

 

৫.
অহরহ ফাঁকা লাগে দেবতা আমার। সমুদ্র-বাণিজ্যে যাব, কড়ি কই!
এ পারের দোকানে বাজারে দেনা হলো ঢের। পৃথিবীর কাছে কীই বা চেয়েছি আমি
দিনান্তে করুণ মদ্য ছাড়া! সরকারি চাকুরির লোভ বহুকাল গেছে।
বহুস্তনী রমণীরা চারিধারে ঘোরে, বাচাল ও মূর্খ মনে হয়।
মেঘে মেঘে আন্দোলন দেখেনিকো তারা।
এক যক্ষ দেখেছিল।
পাহাড়ে অরণ্যে শুধু ঘুরি। গঞ্জের পুরাতনী হাটে। সুবিশাল পুষ্করিণী, তার পাশে বসি।
মনে পড়ে কালিদাস ভবভূতি ভারবি বা মাঘ। কতযুগ চলে গেছে।
হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খেয়ে সভ্যতা নিজেরই অভিশাপে নিজেকে মেরেছে।
শুধু বেঁচে আছে আসন্ন আষাঢ়, যার মেঘে, যার বজ্রে মাতাল কবিরা কেউ পেতেছে হৃদয়,
পুড়িয়েছে হাত।
আমিও তাদের ছাই, অশ্রুমাল, তমালবিপিনছায়ে তোমাকে কাছে ডাকছি,
দুরন্ত কুরঙ্গী ওগো দেবতা আমার।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment