তন্ময় ভট্টাচার্য

জন্মান্তর

(১)

  • এ বেটা, এক গ্লাস দে!

লোকদুটো মদ খাওয়া থামিয়ে তাকাল বালকনাথ বাবাজির দিকে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি, ছোট্ট শরীর টলমল করছে অনেকক্ষণ ধরেই। ইতস্তত করতে লাগল ওরা। বালকনাথ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী সোচ্‌ছিস? সাধুকে ফিরাতে নেই। দে জলদি।’ লোকদুটোর মধ্যে যে চেলা গোছের, প্লাস্টিকের গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলল, ‘দিচ্ছি, তবে আমাদের এই বাবুকে একটু আশীর্বাদ করে দাও।’ আংটিভর্তি হাত মাথায়-মুখে বুলিয়ে দিলেন বালকনাথ। ‘আশীর্বাদ আশীর্বাদ! সতীমা’র কৃপায় তোর সব ভালো হবে। খুশ থাকবি তুই। আশীর্বাদ। …আরেকটু জল ঢাল্‌ না বে!’ মদ আর জল মেশানো টইটম্বুর সেই তরল এক ঢোঁকে ভিতরচালান। তারপর গ্লাসটাকে এককোণে ছুঁড়ে, নাচতে নাচতে অন্যত্র…

শশীতরুর বাঁধানো চাতাল থেকে নামল দুলাল। মুখে মৃদুহাস। এতক্ষণের দৃশ্য দেখতে দেখতে যে-কৌতুক জমেছে, ঝেড়ে ফেলা প্রয়োজন। এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগল শ্মশানকালী মন্দিরের পেছনের চত্বরে। সামনের দিকটায় বিশাল ম্যারাপ বেঁধে বাউল গানের আসর বসলেও, পিছনের এই আবছা-অন্ধকার নেশা-ভাঙের স্বর্গ। প্রত্যেকেই হয় মদ নয় গাঁজা নিয়ে এদিক-ওদিক বসে। সাধু, ভক্ত, সাধারণ মানুষ – কমতি নেই কারোর। দুলালের খুব একটা অভ্যাস নেই এসবের। সঙ্গেও আনেনি কিছুই। অবশ্য চাইলে স্বাদ থেকে বঞ্চিত করবে না কেউই। মানুষে-মানুষে মেলামেশায় নেই এখানে। তবে তারও আগে পেটের খিদে শান্ত করা প্রয়োজন। খানিক আগে চক্কর মারতে মারতে দেখে এসেছিল, একধারে খালের মতো মাটি কেটে তাতে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো। ওপরে বিশাল ডেকচিতে চাপানো খিচুড়ি। যে-কেউ খেতে পারে। বাধা নেই কোনও। শশীতরু গাছ পিছনে ফেলে দুলাল এগিয়ে গেল আসরের দিকে। বাঁশের বেড়ার বাইরে, খোলা মাঠেই, সার দিয়ে প্রায় শ’দেড়েক লোক বসে। শালপাতা বিতরণ চলছে। একটু জায়গা করে সকলের সঙ্গে বসে গেল দুলালও। গরম-গরম খিচুড়ি। খাওয়া শুরু করার আগে, আকাশে হাত তুলে বলে উঠল সকলে – ‘জয় সতীমা!’ আর কোনও পদ নেই। দরকারও নেই অবশ্য। ওই খিচুড়িটুকুই খিদের মুখে অসম্ভব তৃপ্তি নিয়ে এল।

দশটা বাজে প্রায়। সতীমার থান থেকে ঘুরে আসবে একবার? হাঁটা লাগাল দুলাল। একটু দূরে-দূরে, পথের দু’দিকে গানের আসর। সবগুলোতেই মাইকে তারস্বরে গেয়ে চলেছেন একেকজন বাউল। অবশ্য বাউলদর্শন তো দূরের কথা, লোক জড়ো করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্যই দেখতে পেল না সে। লোকে শুনছেও সেসব ভিড় করে। বিরক্ত মুখে ডালিমতলার দিকে পা বাড়াল দুলাল। এখনও ভক্তের ঢল প্রচুর। সতীমার বাড়ির দালানেও আশ্রয় নিয়েছে একদল। কিন্তু এখানে এত ঠেলাঠেলি, এত চিৎকার! রাত কাটবে তো শান্তিতে? জনস্রোত ঠেলে-ঠেলে ফিরে গেল আবার সেই শ্মশানকালীর চত্বরেই। শশীতরুর তলায় ওই ফাঁকা জায়গাটুকু, যেখানে আগে বসেছিল সে, দখল হয়ে গেছে। আরেকটু এগিয়ে, একটা অশ্বত্থগাছের বাঁধানো পায়ে কিছুটা ঠাঁই মিলতে পারে বুঝে, সেঁধিয়ে গেল সেখানেই।

খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো এই প্রথম। স্থানমাহাত্ম্য কখন যে তাকেও রাত্রির একজন করে নিয়েছে, খেয়াল নেই। এভাবেই বসে থাকতে হবে? দুলাল চোখ বোলাল চারদিকে। আলোছায়ার খেলা ঘন হয়ে উঠেছে। হলুদ হ্যালোজেন হেরে যাচ্ছে তান্ত্রিকদের কাছে। দুলাল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আগুনের দিকে। কিছু না-বুঝেও নিজের মতো বুঝে নিল সে। ডানদিকের কোণ ঘেঁষে শ্মশানের দাহক্ষেত্র। কয়েকজন সাধু আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। বালকনাথকে দেখা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে, নাচতে নাচতে উবু হয়ে বসে ছিলিম টেনে নিচ্ছেন দিব্যি। আবার উঠে দাঁড়িয়ে উদ্দাম নাচ। আসরে গায়কের ‘খেজুরগাছে হাঁড়ি বাঁধো মন’ বালকনাথের মনে ঢেলে দিয়েছে সমস্ত রস। অন্যান্য সাধুরা তো বটেই, এমনকি সাধারণ মানুষও হাসছে তাঁর নাচ দেখে। দুলাল খুঁটিয়ে দেখল তাঁকে। বড়জোর চারফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। একটা কালো জোব্বা আর কালো কৌপীন পরনে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। খুলে-রাখা জটা আছড়ে পড়ছে হাঁটুর কাছে। বয়স মোটেই তিরিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। নেশার তোড়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন এদিক-ওদিক। গাছতলার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, দুলাল তাঁর চোখের দিকে তাকাল একবার। অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখদুটো। মুখে কোনও জটিলতার ছাপ নেই। সত্যিই বালক যেন। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে-মাঝেই আকাশে হাত তুলে হুঙ্কার দিচ্ছেন – ‘ম্যায় বালকনাথ হুঁ। ম্যায় সব্‌ জানতা হুঁ।’ অন্যান্য সাধুরা বিরক্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছেন এসব শুনে। 

চরিত্র বটে একটা! – ভাবল দুলাল। চত্ত্বরের এই পিছনদিকটা একাই জমিয়ে রেখেছেন হুল্লোড় করে। অবশ্য অন্যান্যরাও যে কিছু কম যান, তা নয়। মদ ও গাঁজার গন্ধ ভেসে আসছে প্রতিটা কোণ থেকে। গানের সঙ্গে-সঙ্গে বোতল বা ছিলিম আকাশে তুলে দুলে উঠছেন অনেকেই। চাটাইয়ের ওপর ছড়িয়ে থাকা ভক্তরাও বাবাজিদের প্রসাদ নিয়ে গলা মেলাচ্ছে এক-এক সময়। যত না আলো, তার চেয়ে বেশি ধোঁয়া ছেয়ে আছে চারপাশে। আর, বাঁধানো গাছতলায়, দুলালও বাবু হয়ে বসে আছে একলা। দেখছে। লোকমুখে শোনা কথা থেকে জন্ম নেওয়া সমস্ত অনুমান একে একে দৃশ্য হয়ে ফুটে উঠছে তার সামনে। শুধুমাত্র গ্রামীণ একটা মেলাকে কেন্দ্র করে এত লোকের রাত্রিবাস বিস্মিত করছে তাকে।

ঘড়িও যেন, বারোটা পেরিয়ে আর কিছুতেই এগোতে চাইছে না সামনের দিকে…

 

(২)

  • হোই, ভাগ্‌ হিঁয়াসে!
  • না, ভাগব না। আমায় টানতে দে আগে।
  • শালা এখানে আমার ভক্তদের বারোটা বাজাতে এসেছিস!
  • ও বাবাজি, রাগ করিস কেন! 
  • হট্‌ হট্‌। কাছে আসবি না একদম। কিচ্ছু পাবি না। ভাগ্‌।

বালকনাথ রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন বুড়া সাধুর দিকে। কাঁচা কয়েকটা খিস্তি বেরিয়ে এল তাঁর মুখ দিয়ে। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বুড়া সাধু। তেড়ে মারতে গেলেন বালকনাথকে। ভক্তরাই ধরে বেঁধে বসাল তাঁকে। এক ভক্ত, ঢুলুঢুলু চোখে তার ছিলিম তুলে দিল বালকনাথের হাতে। বালকনাথ লোকটির পিঠে জোরে চাপড় মেরে ‘জিতে রহো বেটা’ বলে হেসে উঠলেন। দু’হাতের ফাঁকে ছিলিম নিয়ে সজোরে টান। দমকে উঠল আগুন। তারপর আবার। আবার এবং আবার। বুড়া সাধু বললেন, ‘অনেক টেনেছিস। ভাগ্‌ এখন।’ বালকনাথ হঠাৎ লাফ দিলেন বুড়া সাধুর দিকে। দাড়িশুদ্ধু মুখটা বারকয়েক নাড়িয়ে দে ছুট্‌। শশীতরু পেরিয়ে আরেক অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে শরীর। বুড়া সাধু অপ্রস্তুত চোখ চারপাশ থেকে ঘুরে এল বারকয়েক। চোখ পড়ল দুলালের চোখে। করুণ হেসে, বিড়বিড় করে কী বললেন, বোঝা গেল না কিছুই। 

মানুষজনের ভিড় এখন অনেকটাই পাতলা। যে-যার মতো চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে চাটাইয়ে, গাছতলায়। গান অবশ্য সারারাতই চলবে। শ্মশান থেকেই একটা মেটে রাস্তা নেমে গেছে ঢালুর দিকে। ঘুরপাক খেতে খেতে মিশে গেছে ধান ও সরষের ক্ষেতে। সেদিকটা পুরো অন্ধকার। রাত পোহালেই দোল। পূর্ণিমার তিথি অবশ্য লেগে গেছে সন্ধ্যাতেই। দুলাল দেখল, নিখুঁত গোল চাঁদটা গাছপালার মাথায় আলো দিতে কার্পণ্য করছে না মোটেই। এই রাতেও দু’একটা পাখির ওড়াউড়ি। সাদা ডানায় উৎসব মাখা, বিশ্রাম নিতে ভুলে গেছে আজকের দিনে। জেগে তো অনেকেই। সতীমার তীর্থে এসে একটা রাত না ঘুমোলে কিছু যায়-আসে না। রোজকার সংসারী মানুষগুলো একটু মুক্তি পেতে ছুটে এসেছে এতদূর। অন্ধকারে মাঝেমাঝে দমকে উঠছে ফুলকি। ভেসে আসছে টুকরো গানের আওয়াজ। কুপি জ্বালিয়ে কেউ-কেউ গোল হয়ে বসে। আলোয় চকচক করছে দেশি মদের বোতল। খানিকক্ষণ বাদে বালকনাথকে দেখা গেল সেদিক নেমে যেতে। এক মাতালের হাত ধরে গৌরনাচ। বিশাল চুল বটের ঝুরির মতো দুলে-দুলে উঠছে আনন্দে। কানে-কানে সেই মাতালকে কী বললেন। তারপরই হো হো হাসি এবং পিঠের মধ্যে দুম্‌ করে এক ঘা।

বেশ কেটে যাচ্ছে সময়টা। দুলালের পাশে তারই সমবয়সি দলটা মদ-গাঁজা টেনে ঘুমিয়ে। সামনের দিগন্তছোঁয়া মাঠ থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে সরাসরি লাগছে বুকে। শীত করছে বেশ। বুকের কাছে হাঁটু ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে বসল দুলাল। শুয়ে তো পড়াই যায়! কিন্তু উৎসবের এই শ্মশানরাত্রির যতটুকু দেখা যায় ঠাঁইনাড়া না হয়ে, হারাতে চায় না সে। তিনটে বেজে গেছে অনেকক্ষণ। বুড়া সাধুর চাটাইয়ে সারারাত নেশা করার পর, ঝিমুনি লেগেছে ভক্তদের। সাধুও, বাঁ-হাতে কলকে ধরে, ঝুঁকতে ঝুঁকতে পৌঁছে গেছেন কোলের কাছে। পিছন থেকে শোনা যাচ্ছে বাউলগানের সঙ্গে বালকনাথের গলার আওয়াজ। মাঝে-মাঝে জটার আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে আড়ালে। দুলাল দেখল, এই শেষরাতে আশেপাশের মানুষগুলোর মধ্যে সে ছাড়া আর একজনই মাত্র ঋজু হয়ে বসে। এই সাধুটি অনেকক্ষণ ধরেই দুলালের লক্ষে আছেন। অন্যদের মতো চঞ্চল নন মোটেই। লোক টানার জন্য নাচতে বা হুংকার দিতে হয়নি তাঁকে। আশেপাশে যে দু-তিনজন ভক্ত, ঘুমিয়ে কাদা। তিনিই একা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন আসরের দিকে। মাঝেমাঝে গানের পদ শুনে শিশুর মতো হেসে চিৎকার করে উঠছেন, ‘জয় তারা!’ হাতদুটো গানের সঙ্গে-সঙ্গে সাঁতার কাটছে হাওয়ায়। গাঁজা ছাড়া অন্য কোনও নেশাদ্রব্যও বোধহয় মানা। লাল উত্তরীয়, লাল কৌপীন আর মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা সাধুটির পিছনে মাটিতে পোঁতা একটা ত্রিশূল, সামনে মোমবাতি জ্বলছে সেই শেষ-সন্ধ্যা থেকেই। মনে-মনে তাঁর নাম ‘উদাসবাবা’ দিল দুলাল।

চারপাশ প্রায় শান্ত। মাথার ঠিক ওপরেই অশ্বত্থগাছের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নাআকাশ। দু’একটা লোক ক্ষেত থেকে উঠে এসে, টলতে টলতে চলে যাচ্ছে আসরের দিকে। দাহক্ষেত্রের কাছে তান্ত্রিকদের যজ্ঞের আগুন নিভে গেছে কখন, খেয়াল করেনি দুলাল। হঠাৎ জটা দোলাতে দোলাতে দৌড়ে এলেন বালকনাথ। পা টিপে-টিপে, চাটাইয়ের ওপর উঠে ঝুপ করে বসে পড়লেন বুড়া সাধুর পাশে। তারপর তাঁকে জড়িয়ে ধরে আবদার করলেন গাঁজার। ঝিমুনি ভেঙে বুড়া সাধু বালকনাথের হাতে তুলে দিলেন কলকে। হেসে উঠলেন দুজনেই। টানে আর গন্ধে অনেকক্ষণ পর আবার ভরে উঠল শ্মশান।

দুলালের চোখ উদাসবাবার দিকে। তাকিয়ে আছেন বালকনাথের কাণ্ডে। মুখ ফিরিয়ে দুলালের চোখে চোখ পড়তেই, হেসে উঠলেন। ‘বাবা, শুধু পোশাক পরলেই সাধু হওয়া যায় না। এইটুকু অন্তত চাই—’ নিজের বুকের ওপর হাত রাখলেন তিনি। দুলাল অবাক হল খুব। উত্তরে হাসল শুধু। ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে রইল গাছপালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে। ‘বাবা!’ ডাক শুনে আবার মুখ নামাল সে। ‘ভালো করেছ। আকাশে তাকানোই ভালো। সেখানেই তিনি আছেন।’ দুলাল এবারও বলল না কিছু। উদাসবাবা হেসে উঠলেন খিলখিল করে। আসর থেকে ভেসে আসছে, ‘এক মন যার সেই যেতে পারে।’ ‘শুনলে বাবা?’ উদাসবাবা জিজ্ঞাসা করলেন। দুলাল মাথা নাড়িয়ে ডুব দিল নিজের মধ্যে।

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে, পৌনে পাঁচটা বাজল। খানিক পরেই ভোর। বড় ঠান্ডা লাগছে তার। ঝিমুনিও নামছে ক্রমশ। দুলাল শুয়ে পড়ল অশ্বত্থগাছের সেই পায়ে। নতুন দেখার আগে, খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয়া যাক।

(৩)

সামান্য যেটুকু ঘুম, লোকজনের গলার আওয়াজে টেঁকার জো নেই। আকাশে পরিষ্কার আলো ফুটে গেছে। হুহু হাওয়া কাঁপন লাগিয়ে দিচ্ছে শরীরে। সামনে দিয়ে চা-ওয়ালা যেতে দেখে এক কাপ চা কিনে খেল। তাতেও বিশেষ লাভ হল না কিছুই। উদাসবাবার দিকে তাকাল দুলাল। টান দেওয়ার আগে কলকে ছুঁয়ে প্রণাম। এখনও সেই আগের মতোই বজ্রাসনে বসা, ঋজু মেরুদণ্ড। আজ দোল। আস্তে আস্তে শ্মশান ছেড়ে লোকজন এগোবে সতীমায়ের মেলার দিকে। আসরের গান শেষ। রাত কাটানোর প্রয়োজনও ফুরিয়েছে অনেকের। দুলাল বসে রইল চুপচাপ। হইহই করে কোত্থেকে আবার হাজির বালকনাথ। এখনও কথা জড়ানো। হাতের মুঠোয় লাল আবির। ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটা মানুষের কপালে টিপ পরিয়ে দিচ্ছেন তিনি। চোখে মুখে আনন্দ। সকালের আলোয় বাবাজিকে বড় ভালো লাগল তার। সামনে আসতেই মুখ বাড়িয়ে দিল দুলাল। বালকনাথ বড় যত্নে টিপ পরালেন। কপাল থেকে লাল-লাল গুঁড়ো ঝরে পড়ল নাকে, কোলে। দুলাল দু’হাতে মেখে নিল সেই রং। খুব ইচ্ছে হল, বাবাজিকেও টিপ পরিয়ে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে বুড়া সাধুর কাছে চলে গেছেন তিনি। সেখানে সবাইকে আবির মাখিয়ে, সাধুর সারা মুখ রঙে ভরিয়ে দিয়ে বালকনাথ এগোলেন উদাসবাবার দিকে। উদাসবাবা গম্ভীর, চেপে ধরলেন তাঁর হাত।

  • রঙের দিনে এমন করতে নেই বাবাজি। টিপ দিতে দে!
  • না, আমায় দেবে না। রং মাখব না আমি।
  • কেন? সবাই মাখছে, তুই মাখবি না কেন?
  • বারণ করেছি, আমায় দেবে না।

বালকনাথের হাত ঠেলে সরিয়ে দিলেন তিনি। বালকনাথের মুখে হাসি। সেই হাসির পিছনে একটা কষ্টের ছাপ দেখতে পেল দুলাল, যা গত রাত থেকে একবারও চোখে পড়েনি। ‘কষ্ট’ শব্দটা মানায় না যেন তাঁর সঙ্গে। আশেপাশের দু’একজন ভক্তের কপালে টিপ পরিয়ে, বালকনাথ চলে গেলেন শশীতরুর দিকে। 

দুলালের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল রাতেও খেয়াল করেছে, সাধুদের পরস্পরের মধ্যে চাপা রেষারেষি ভীষণ। একজন আরেকজনের দিকে বাঁকা চোখে তাকান। ঈর্ষায় ভোগেন যেন বা। একমাত্র বালকনাথকেই সে দেখেছে সবার কাছে অনায়াসে হাজির হতে। হয়তো নেশার তাগিদই তাঁকে বারবার ছুট্‌ করিয়েছে এর-ওর-তার জমায়েতে। কিন্তু উদাসবাবা এমন করলেন কেন? ওঁকে তো বাকিদের থেকে আলাদা মনে হয়েছিল! 

দুলাল গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। উদাসবাবা তাকে সামনে দেখেই হাত ধরে বসালেন সামনেটিতে, ‘বসো বসো বাবা! কাল রাত থেকে কত কথা হয়েছে আমাদের!’ মুখে সরল হাসি। দুলাল বিশ্বাস করতে পারল না, এই মুখই একটু আগে কঠিন হয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে বালকনাথের রং। দুলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘এই যে এত ঠান্ডাতেও খালি গায়ে বসে আছেন, পারেন কী করে? আমরা তো পারি না!’ হেসে নিজের বুকের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বললেন উদাসবাবা, ‘আমার সঙ্গে মা আছেন। মা’ই সব সামলে নেন।’ ‘আচ্ছা, সাধনা করে কী লাভ! আপনাকে কাল রাত থেকেই দেখছি শান্ত, আমরা পারি না কেন?’ প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল দুলাল, বড্ড অপরিণতির পরিচয় দিয়েছে সে। হাসলেন উদাসবাবা, ‘আমার ভেতরটা বড় খাঁটি গো। আমি অন্যদের মতো নই। বামদেবের শিষ্য আমি। তারা মা’র সন্তান। একান্নতীর্থ ঘুরেছি। আমার মধ্যে ভেজাল নেই কোনও।’ কথাটা খুব একটা ভালো লাগল না শুনতে। ভেজাল যে নেই, তা উনি নিজের মুখে বলবেন কেন? সে তো মানুষ মিশেই বুঝতে পারবে! সাধুর বেশে ইনিও কি শেষ পর্যন্ত প্রচারসর্বস্ব? 

কিন্তু কথাগুলো বলার সময় মুখের হাসিটাকে কিছুতেই মিথ্যে ভাবতে পারল না সে। এক ভক্ত উদাসবাবার জন্য এক গ্লাস আখের সরবত এনে রাখলেন সামনে। উদাসবাবা গ্লাসটা তুলে দিলেন দুলালের হাতে, ‘তুমি খাও বাবা।’ ‘সেকি! আপনার জন্য আনা হয়েছে, আমি নেব কেন? না না, এ হয় না। আপনিই নিন।’ ‘মা আমায় বলেছেন, ভাগ্যে থাকলে আরও পাব। এটা তুমি নাও বাবা। নিলে আমার ভালো লাগবে।’ আর আপত্তি করতে পারল না দুলাল। খেয়ে নিল পুরোটাই। উদাসবাবা বললেন, ‘পড়াশুনা কিছুই শিখিনি। বারো বছর বয়সেই এই বেশ ধরেছি। আমি শিখেছি মানুষের কাছ থেকে। মানুষের সঙ্গে মিশতেই যদি না পারি, মন্দ যদি চিনতেই না পারি, ভালোকে আলাদা করব কী করে!’ হাসলেন তিনি। দুলাল চুপ করে বসে আছে সামনে। “আচ্ছা বাবা বল তো, ‘মড়ার ওপর বসে পণ্ডিত/মড়ার সঙ্গে কহে কথা/এই পথে দুই পা তিন মাথা’ – এর অর্থ কী?” তন্ত্রসাধনা আর দেহতত্ত্বের ইঙ্গিত উঁকি দিচ্ছে কি? ধারণার কথা জানাতেই উদাসবাবা মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু, হয়নি। এই প্রশ্নটা আমি অনেক শিক্ষিত লোককে করেছি। কেউই বলতে পারেনি।’ ভেতরে-ভেতরে আবার বিরক্ত হল দুলাল। উনি কত জানেন, সেটাই কি বোঝাতে চাইছেন? তবু ধৈর্য ধরে উত্তরের অপেক্ষা। “এই যে ‘মড়ার ওপর বসে পণ্ডিত’ – অর্থাৎ তুমি যার ওপর বসে আছ, এই চাটাই, এটার কি প্রাণ আছে? না তো? এটা মড়া। ‘মড়ার সঙ্গে কহে কথা’ – তুমি যে বই পড়ো, বইয়ের কি প্রাণ আছে? নেই তো! আর ‘এই পথে দুই পা তিন মাথা’ – মানে এই শুকনো জীবন দেখে স্ত্রী, দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে পণ্ডিতকে ছেড়ে। স্ত্রী’র দু’পা আর কোলে দুই সন্তানসহ তিন মাথা – দূর থেকে দেখলে চলে যাওয়ার দৃশ্য এমনটাই চোখে পড়বে না?” দুলাল বিস্মিত হল এমন ব্যাখ্যায়। শুকনো শাস্ত্র ছেড়ে মানুষ পড়ো – এই-ই কি বোঝাতে চাইলেন উদাসবাবা? হাত ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আবার কবে দেখা হবে? আর হবে কি?’ ‘যদি ভাগ্যে থাকে, চলতে চলতে দেখা হয়ে যাবে ঠিকই!’ 

কিছুটা এগিয়েও আবার ফিরে এল সে। ‘আচ্ছা, বালকনাথ বাবাজির থেকে আবির নিলেন না কেন?’ উদাসবাবা হাসলেন। জবাব দিলেন না কোনও। দুলাল ‘আসি’ বলে অন্য পথ ধরল। দোলের সকালে সতীমার থান থেকে একবার ঘুরে আসতে চাইছে মন।

(৪)

সকাল সাতটা। একটু-একটু রোদ উঠলেও, ঠান্ডার প্রকোপ যায়নি এখনও। দুলাল অবাক হয়ে দেখল, এরই মধ্যে কত মানুষ হিমসাগর পুকুরে স্নান সেরে পুজো দিতে চলেছে সতীমা’র থানে। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে সামান্য এগোতেও সময় লেগে যাচ্ছে অনেকটা। কেউই রং খেলা শুরু করেনি এখনও। বেলা আরেকটু বাড়লে আবিরে-আবিরে ছেয়ে যাবে পথ। ডালিমতলায় তিলধারণের জায়গা নেই। সেদিকে পা বাড়াল না আর। মানুষের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল হিমসাগর পুকুরের কাছে। সেখানেও তিলমাত্র কমতি নেই ভিড়ের। দলে দলে লোক নামছে জলে। একদল অপেক্ষা করছে সিঁড়িতে। কেউ কেউ আবার স্নানের পর দণ্ডি কাটছে। দণ্ডি কাটার এই পথ শেষ হবে একেবারে সতীমার দোরে গিয়ে। এতে নাকি মানতপূরণ হয় অনেকের। অসুখ সেরে যায়। দুলাল একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। ‘ও বাবা…’ ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরল। সামনে সার দিয়ে বসে অনেক ভিকিরি, তাদেরই একজন ডাকছে তাকে। গায়ে নামাবলি জড়ানো এক বৃদ্ধা, বয়স সত্তর পেরিয়েছে অনেকদিন আগেই। ভিক্ষা চাইছে। দুলাল হাঁটু মুড়ে বসল বৃদ্ধার সামনে। বৃদ্ধা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

  • এখানে প্রত্যেকবছর আসো?
  • হ্যাঁ, বাবা। 
  • কেন? কী হয় এখানে এসে?
  • এ যে বড় পুণ্যির জায়গা! 
  • কীরকম?
  • এই তো, তুমি যদি এ-বছর ডালিমগাছে মাটির ঘোড়া বেঁধে কিছু মানত কর, আর পরের বছর এসে সেই ঘোড়া খুলে নিয়ে যাও, তবে তোমার মানত ফলবেই।
  • তুমি ফল পেয়েছ?
  • হ্যাঁ, বাবা। আমি যা মানত করেছিলাম, একবছর বাদে সত্যিই তা ফলেছে।

বৃদ্ধার মুখে বিশ্বাসের ছাপ দেখে চমকে গেল দুলাল। জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, হিমসাগর পুকুরে স্নান করলে কী হয়?’ বৃদ্ধা জবাব দিল, “এই পুকুরের জলে স্নান করলে সব রোগ কেটে যায় গো। বোবাকে এই জলে স্নান করিয়ে বলা হয় ‘বল্‌ সতীমা!’ যতক্ষণ না সতীমার নাম করে, লাঠি দিয়ে পেটানো হয় তাকে। মেরেই যায়। একসময় সতীমার নাম নিলে বলা হয়, ‘বল্‌ বাবা!’ এভাবেই বোবার মুখে বুলি ফিরে আসে। বড় জাগ্রত আমাদের এই সতীমা।” দুলাল আর কথা বাড়াল না। পকেট থেকে দু’টাকার খুচরো বৃদ্ধার হাতে দিয়ে উঠে পড়ল। অমনি হাঁটুর কাছে টান। ‘ও বাবা, আমার এই বোনটা বড় দুঃখী। ওকেও কিছু দিয়ে যাও না গো!’ বৃদ্ধা হাত বোলাচ্ছেন দুলালের হাঁটু আর পায়ের পাতার মাঝখানে। বড় অস্বস্তি হল তার। পাশেই আরেক মহিলা, তার হাতেও খুচরো দু’টাকা দিয়ে ছাড় পেল সে। ‘ভালো হোক বাবা’ পিছনে ফেলে হনহন করে এগিয়ে গেল বড় রাস্তার দিকে। 

এখান থেকে ফেরার পথ কাছে। কিন্তু এখনই ফিরতে ইচ্ছে করছে না দুলালের। আবার এই ভিড়ও ভালো লাগছে না। মেলা দেখতে এসেও মেলার থেকে শ্মশান প্রিয় হয়ে যাবে শুধুমাত্র একটা রাত কাটানোর ফলে, ভাবেনি দুলাল। যদিও সে-রাত শ্মশানের স্বাভাবিক রাত নয়, উৎসবের রাত। তবু ওই চেনা মুখগুলো টানছে আবার। ভিড় ঠেলে শ্মশানের দিকে পা বাড়াল। দিনের আলোয় রাতের সেই রহস্য অনেকটাই মরে এসেছে। গানের আসর শেষ, লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এদিক-ওদিক। ওপাশের মাঠ ভেঙে লোকজন উঠে আসছে মেলায় যাবে বলে। 

বুড়া সাধু চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। রাতের নেশা কাটেনি এখনও। অশ্বত্থগাছের নিচে যে দলটা দুলালের পাশে ঘুমিয়েছিল, তারাও উধাও। অচেনা কয়েকজন শরীর এলিয়েছে সেখানে। ছিলিম এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে এদিক-ওদিক। উদাসবাবার দিকে নজর গেল এবার। নতুন কিছু ভক্ত জুটেছে তাঁর, তাদের সঙ্গেই কথাবার্তায় ব্যস্ত। কলকে প্রসাদ করে দিচ্ছেন তাদের। মাথা ঘোরাতেই দুলালকে দেখলেন দূরে। হেসে হাত তুললেন। উত্তরে সেও হাত তুলল হেসে।

চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল দুলাল। কে যেন নেই। অশ্বত্থগাছের ওপাশ থেকে চিৎকার করতে করতে বালকনাথের হেঁটে আসা দেখে মন ভালো হয়ে গেল তাঁর। শেষ বেলায় তাঁকে দেখতে না পেলে একটা ফাঁক থেকে যেত। চোখমুখ, জটা সব আবিরে ছেয়ে গেছে। এমনকি কালো জোব্বাও রঙিন হয়ে উঠেছে এতক্ষণে। দুদিকে তাকাতে তাকাতে হেঁটে আসছেন তিনি। উদাসবাবার সামনে এসেই স্থির। কলকেটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই বাবাজি, একটু প্রসাদ দিবি নাকি?’ উদাসবাবা মৃদু হেসে কলকে তুলে দিলেন বালকনাথের হাতে। মুঠিতে নিয়ে বুক ভরে টান। ‘ব্যোম ভোলেনাথ। জয় সতীমা কি…’। ধোঁয়া উড়তে লাগল হাওয়ায়। কলকেটা ফেরত দিয়ে, উদাসবাবার মাথায় হাত বুলিয়ে হনহন করে ফিরে গেলেন, যেদিক থেকে এসেছিলেন।

ঘাড় ফিরিয়ে দুলালের দিকে তাকালেন উদাসবাবা। দূর থেকে প্রণাম জানাল সে। ডানহাতটা আকাশে খানিক উঠল বোধহয়। তারপর, মুখ ফিরিয়ে আবার ভক্তদের সঙ্গে আলোচনায় ডুব। 

চোখ দিয়ে শেষবার অশ্বত্থগাছের ঠাঁই ছুঁয়ে, ধীরে ধীরে শ্মশান থেকে বেরিয়ে গেল দুলালচাঁদ…

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment