গৌতম চৌধুরী

গৌতম চৌধুরী’র কবিতাগুচ্ছ

অপরগুচ্ছ

১.
উঁচুনিচু সাত রকম অন্ধকার। নিজের ছায়াও অচেনা ঠেকিতে পারে। ওদিইকে খেলার প্রহর গড়াইয়া যায়। অবশ্য, খেলিতেই হইবে, এমন কোনও মাথার দিব্য কেহ দেয় নাই। ঘরের কোণে থুম ধরিয়া বসিয়া নেশাভাঙ করিলেই বা কাহার কী! তুই বেটা মর্‌, মরিস না কেন – বলিয়া ঘুলঘুলির ফাঁক হইতে শাপান্ত করিবে একটি ঘাঘু মাকড়সা। সে ভাবিতেছে, তাহার বাড়া ভাতে বুঝি ছাই পড়িল। ঘর-দুয়ার ফাঁকা থাকিলেই তাহার পোয়াবারো। একটু পরে ছাদের কার্নিসে বসিয়া জ্যোৎস্না ভাঙিতে বসিবে পরীর দল। ঘুলঘুলির ফাঁক হইতে উপুড় হইয়া তাহাদের ঠ্যাঙের দুলুনি দেখিবে মাকড়সা। তাহার দৃষ্টি অতটুকুই। ঠ্যাঙের উপরে পরীদের আর কিছু আছে নাকি! ইহা লইয়া ভাবিতে গিয়া যে-দার্শনিক অন্ধ হইয়া গিয়াছিল, আজ তাহাকেই ঘিরিয়া বসিয়াছে পরীরা। চক্ষু নাই, তাই হাত দিয়া স্পর্শ করিয়া সে সবকিছু অনুভব করে। পরীরাও খিলখিল হাসিতে ভাঙিয়া পড়ে। আর সাত রকম অন্ধকার হইতে ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে সাত রকম জ্যোৎস্না …

২.
সেইসব দৃশ্যের কোনও ক্ষমা নাই। বাতাস আলো ও ছায়া, প্রান্তরের বিরান জুড়িয়া তবু দৌড়ায়, নাচে। ছায়াবাজিদের কখনও ত্রিপল চাপা দিয়া রাখা হয়। মানুষের যেমন বুদ্ধি! মোড়ক জুড়িয়া লতাবিতান গজায় গায়ে গায়ে। রোদ জল হিম লাগিতে লাগিতে একদিন বেবাক উইয়ের কম্বলে ঢাকা পড়িয়া যায় সব। তাহা প্রাকৃতিক। প্রকৃতিরও কত না তর তম। কল্পনার কত না অগম্যি। নহিলে বিটপী কি অমন থরথর করিয়া কাঁপে! লুটাইয়া পড়িতে চায় ভূমিস্পর্শমুদ্রায়? অথচ প্রাণপণে স্থির। ওই তো এক টুকরা জমিনে আমূলপ্রোথিত। কী এক শূন্যের দিকে আঙুল বাঁকিয়া যায় তাহার। ভিখারির প্রায় মেলিয়া ধরিতে চায় অঞ্জলি। পারিলে হাঁটু মুড়িয়া বসে। মুখ ডুবাইয়া দেয় সন্ধিপ্রহরে। সবটাই বুঝি ভূগর্ভ-আঁধারের শয়তানি। কুনাট্য সবই। তবে তো বৃক্ষছেদনে কোনও পাপ নাই। কুঠার ও কাঠুরিয়াই শেষ মুক্তি তবে। তবু কে যেন তছনছ করে সব অনুলেখ, সকল দণ্ডের অধ্যাদেশ। কে যেন ভাঙিয়া পড়িতে বলে, কেবলই, ক্ষমাহীন নানান দৃশ্যে…

৩.
অজ্ঞাতের চালাঘর। খড় উড়িয়া যায় ইতস্তত। ধুধু আলোয় কাঁপিতে থাকে তাহার অস্তিত্ব। আসলেই কি তাহা কাঁপে! কাঁপে দৃষ্টি। কাঁপে দৃশ্যের বোধ। তবু চক্ষু অপলক রহিতে চায়। শরীরও ধাইতে চায় সেইদিকে। যাহা অনিশ্চয়। তাইই যদি, তবে মাথার উপরে ছাউনির ছায়া কেন! সে কোন্‌ শুশ্রূষার সাধ? বাতাসের বুকে আরও কী কী উপকরণের ছবি যে আঁকা! এক ঘটি জল? একটি হাতপাখা? গামছার বাতাস? একটি সামান্য শীতলপাটিও কি বিছানো কামরার এক কোণে? কিন্তু সেইখানে শুইবার জো নাই। শেষশয্যা বলিয়া উৎকীর্ণ আছে। হা হা, সেই নিশ্চয়তা এড়াইবে কে! তবে কি সেই অবসানের মুহূর্তটি রচার জন্যই তৈরি হইয়া আছে ঐ খড়ের ছাউনি? তবে আর অজ্ঞাত কী রহিল এই মলিন জীবনে …

৪.
মাঝে মাঝেই একটি দুটি করিয়া ফুল পুড়িতে থাকে। চটাস চটাস করিয়া শব্দ হয়। খানিক ধোঁয়া উঠে। মিথ্যা সহ্য করিতে পারে না তাহারা। তাই এই দশা। অথচ সত্য ও মিথ্যা কত অনাবিলভাবে মিলিয়া মিশিয়া থাকে। এ উহার জামা বদল করিয়া পরে। জড়াইয়া মড়াইয়া একই পরিবারের ছেলেমেয়েদের মতো ঝাঁক বাঁধিয়া বাজার-দোকান করে, সভ্যতা-সংস্কৃতি করে। এ উহাকে আলাদা করিয়া চিনিতেও পারে না। কিন্তু সেই ঝাঁক যখনই কোনও বাগানে গিয়া পৌঁছায়, কী যেন ঘটিয়া যায় গাছে গাছে। ডালপালাগুলি সহসা চুপ মারিয়া যায়। পাতাগুলি লম্বা শ্বাস টানিয়া গন্ধ লইতে থাকে বাতাসের। ফুলগুলি সবচেয়ে স্পর্শকাতর। অত ভিড়ের মধ্যেও কীভাবে যেন মিথ্যাগুলিকে চিনিতে পারে। আর থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠে। হঠাৎ একটি চচ্চড় শব্দ হয়। দপ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠে। পুড়িতে থাকে একটি ফুল। মিথ্যারা তাকাইয়া তাকাইয়া সেই পুড়িয়া যাওয়া দ্যাখে। আর তাহার নাম দেয় বহ্ণ্যুৎসব। তাহাদের তো পুড়িয়া যাইবার কোনও ভয় নাই …

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment