শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

খুঁজতে খুঁজতে যতদূর

প্রাচীন দুনিয়ার দিকে

একটি ভূমিকা 

ফিরি ইউরোপে। ২০০২ সাল থেকে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এই মহাদেশের সঙ্গে ২০০৭ সালে গিয়ে সে পৌঁছলো এক প্রত্যক্ষতায়। এই বিষয়ে নানা লেখা ছড়িয়ে আছে, কৌরবের পাতায়, অন্যান্য জায়গায়। এই গদ্যমালায় আমি লিখতে চাই কীভাবে ইউরোপে রচিত এস্পানিওল ভাষার কবিতা এবং সরাসরি এস্পানিয়া নামক দেশের পাঠ সংস্কৃতি আমার সামনে এক অন্য দুনিয়া খুলে দিয়েছে। আর সেই প্রসঙ্গে ফিরতেই হয় ২০০৭ সালে। খুয়ান রামোন খিমেনেস এর একটি প্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ পাচ্ছে। সে বই বিস্ফোরক কারণ সে এক তীব্র মাংসল প্রেমের কবিতা, কবির উত্তুঙ্গ যৌবনের চিহ্ন। সে বইতে স্পষ্ট করে লেখা আছে কোথাকার সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে কবি প্রেম করেছেন, এমনকি পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গেছে সন্তপ্রতিম কবির আঁকা তাঁর সেই প্রেমিকার নগ্নিকাচিত্র। যথারীতি সেই সঙ্ঘ প্রতিবাদ জানিয়েছে। যদিও ১০০ বছর আগেকার সেই কবিতা স্বাভাবিক নিয়মেই খানিক ধার হারিয়েছে। কিন্তু সেই বই প্রকাশ একটি ঘটনা। কারণ স্পেনে খুয়ান রামোনের পরিচতি আমাদের রবীন্দ্রনাথেরই মত। তাঁর মাংসল প্রেমের কবিতা বোধহয় কেউ আশা করেননি। এই ঘটনা আমার সামনে একটি সম্পূর্ণ নতুন দিক চিহ্নিত করে। প্রথমত আমি খুয়ান রামোনের নাতনির (কবির ভাইপোর মেয়ে, আমার সঙ্গে ২০০৬ এর কলকাতা বইমেলায় আলাপ ও ইমেইল সম্পর্ক) মারফত পরিচিত হলাম খোসে আন্তোনিও এক্সপোসিতোর সঙ্গে, যিনি খুয়ান রামোনের অপ্রকাশিত বইটি গবেষণা করে তৈরি করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। পরিচিত হলাম সমসাময়িক স্পেনের কবিতার কিম্বদন্তি কবি আন্তোনিও কোলিনাসের সঙ্গে। এবং পরিচিত হলাম এস্পানিয়া তথা ইউরোপের সন্ত-অবিনির্মাণের খেলার সঙ্গে। কবি এক রক্তমাংসের মানুষ, তিনি সন্ত নন। অনুষ্ঠানে মনে করিয়ে দেওয়া হল দান্তে যখন কম্মেদিয়া লিখছেন তখন তিনি সমাজের চোখে অপরাধী। দেশ থেকে বিতাড়িত। আর এই অনুষ্ঠানের পরে ছোট ঘরোয়া যে মধ্যাহ্নভোজের অনুষ্ঠানে আমি ডাক পেলাম, তা আমার কাছে এক অশেষ শিক্ষামূলকের সূচনাবিন্দু।  

এমনিতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের কাছে দুপুরের খাওয়া এক দীর্ঘ সময়ের কাজ। আমার সে যাত্রায় আমার পাশে ছিলেন আন্তোনিও কোলিনাস। কথা বলতে গিয়ে যা বেরিয়ে এলো তা আসলে সমসাময়িক এস্পানিওল কবিতার প্রস্থানভূমি ও নতুন স্বদেশ। যে স্বদেশের মূল লক্ষ্য কবিতাকে অভিজ্ঞতার বাইরে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ দৈনন্দিনের দুনিয়ার আবেগের খেলা থেকে খানিকটা বাইরে দেখা। ভাষার সহ্যক্ষমতা বাড়ানো। যদিও আন্তোনিও নিজে ভাষার দিক থেকে প্রাচীনপন্থী। কিন্তু বিষয়ে নন। আসলে তিনি যে প্রজন্মের প্রতিনিধি, ১৯৭০ এর দশক, সেখানে তাঁদের হাতেই শুরু হয়, “আমি ভাত খেয়ে ট্রেন ধরলাম, গায়ে তোমাদের দেওয়া নুন ঘাম” গোছের কবিতা থেকে বেরিয়ে এক অন্য সন্ধান। আমিও উত্তেজিত হয়ে গেলাম। শুরু হল সন্ধান। আসলে তো আমি বাংলা কবিতার সেই অংশের মানুষ যেখানে এই অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে উঠে কল্পনা শক্তির পরখ করাকেই কবিত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। না হয় আমি বাক্স বাজানোতে মজে বাজিয়েছি তালবাদ্য, কিন্তু বুনিয়াদি শিক্ষায় তো লেগে আছে জমিল সৈয়দ, অঞ্জলি দাশ সুব্রত সরকারের দাগ! এবং পরোক্ষে মণীন্দ্র গুপ্ত। আমার অসুবিধে হল না এই অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে উঠে কল্পনায় শান দেওয়া কবিতার কাছে পৌঁছতে। আমার কবি বন্ধু মারিফে সান্তিয়াগো বোলানিওস এর সঙ্গে চলল আড্ডা, কাফেতেরিয়া, মাদ্রিদ শহর, গার্সিয়া লোরকা, দামাসো আলোনসো এবং অবশ্যই আন্তোনিও মাচাদো। এঁরা প্রত্যেকেই আমাদের সঙ্গে জীবিত কবিদের মতই রইলেন তাঁদের আড্ডা মারার প্রাচীন কাফেতেরিয়াগুলোয়। 

২০০৭ এর মাদ্রিদবাস ভাষা শিক্ষার অছিলায় হলেও আসলে তা কবিতা শিক্ষারই। বুদ্ধদেব বসু প্রণীত বাংলা কবিতার মান নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে একমত না হলেও তাঁর রিলকের ভূমিকা আমার জীবনে চিরসখা। কবি সর্বক্ষণই কবি, তার সমস্ত অবস্থানে, চেতনে অচেতনে। এই ভূমিকাটি আমার আমার কিশোর মনে এতই দাগ কেটেছিল ‘জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ গানটি আমার আজও মনে হয় কবিতার অপেক্ষার কথা। আমারে যে জাগতে হবে কী জানি সে আসবে কবে ইত্যাদি। এই অপেক্ষা এবং সর্বক্ষণ কবিতায় থাকা যদিও ২০১২ অব্দি হয়ে ওঠেনি, কারণ তখনও সামাজিকভাবে লেখক হবার বাসনা আমি ছাড়তে পারিনি, ফলত উপন্যাস লিখতে গেছি, কিন্তু কবিতা নামক যে মহাবৃক্ষের চারা ১৯৯৭ সালে জমিল সৈয়দ পুঁতেছিলেন, তার আমার মত নাবাল জমিতে ডাল মেলতে সময় নিয়েছে। শিকড় ছড়িয়েছে। দীর্ঘ দশক ধরে। আমি কবি হতে পারবো কিনা জানি না তবে কবিতা পাঠক হিসেবে আমার ভিত পোক্ত করেছে। ২০০৭ সাল সেই ভিতের উপর আরও পোক্ত ইমারত গঠনের এক বিরাট ধাপ। 

কারণ এই সময় থেকেই শুরু হয় একটু আগে উল্লেখ করা “অপেক্ষা”-র কবিতা থেকে বেরিয়ে আসার সূচনা। যা কিছু আমাদের স্বভাব কবিতা তার উপর নির্মাণের ধাপ বসানো। আর এই শিক্ষার এক তীব্র সূচনাবিন্দু ২০০৭ এর সেই মধ্যাহ্নভোজ। ওই একই সময়ে আমি ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলাম কৌরব অনলাইনের সঙ্গে, আর্যনীল মুখোধ্যায়ের সঙ্গে, এই সব মিলিয়ে নির্মাণনিষ্ঠ স্বভাব কবিতার বাইরে, অনুপ্রেরণা নির্ভর কবিতার বাইরে গিয়ে, সন্ধান নির্ভর কবিতার দিকে সরে আসছিলাম। এই পর্যায়ে আমাকে জাগতে তো হবে, তবে তার মনে পড়ার অপেক্ষায় নয়, বরং তার সন্ধানে। শিখলাম পরিকল্পনা করে কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি নির্মাণ। শিখলাম কবিতার বই মানে সারাবছরের লেখা দুই মলাটে বেঁধে দেওয়া নয়। অন্যভাবেও তাকে দেখা যেতে পারে। 

কীভাবে সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখবো পরের কিস্তিগুলোতে। 

 

উৎসাহী পাঠকের জন্য সূত্র 

https://www.classicspanishbooks.com/contemporary-spanish-poetry-antonio-colinas.html

মধ্যাহ্নভোজের ছবি

 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment