শতাব্দী দাশ

খবরাখবর

১.

বাঁশের বেড়ার মাঝবরাবর বাঁশেরই ফাঁক ফাঁক দরজা। দড়ি পেঁচিয়ে আগল দেওয়া৷ হাতের বাণ্ডিলখানা নামিয়ে রেখে শান্তি দড়ি আলগা করে। বাইরে বেরোয়। তারপর বান্ডিল তুলে নেয়। ঠোঙার বান্ডিল। জ্যালজেলে শাড়ির কিনারখান মাথায় টানে। বাবলা আর বাঁশঝাড় ঘেঁষাঘেঁষি পথ। ছোট ছোট ঘর। হুই যে মুচিবউ গা ধুচ্ছে ডোবায়, তার সিঁদুর ধোয়া কপাল আর আকাশের রঙ এখন প্রায় এক। মুচিবউ আঁচল পেতে দিয়েছে জলে, চুনো মাছ ধরার আশে। শান্তি শুধোয়, ‘পাইলু?’ 

মুচিবউ ফিরে চায়। মাথা নাড়ে। মাছ ওঠেনি। 

‘দুকান যাউচ?’

‘হ। ঠুঙা লাগিব হাবুল’র। মোর লাগিব নুতন বিলেড।’

‘আজি হব নাকি? তাগো ছুয়া?’

‘হ।’

সে হনহন হাঁটে মাথা নীচু৷ ইদিক-উদিক তাকালে প্রাতঃকৃত্যরত দেওর-ভাসুরদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতে পারে। গাঁ পেরিয়ে আলপথ। দুই ধারে বাউন-কায়েতের জমি। সেথা বেজাতের হাগায় দোষ নেই অবশ্য। জৈব সার বেজাতের বর্জ্য থেকেও মেলে। বেজাতই আবাদ করে জমি, নয় কি? মালিকরা থাকে ওধারে, বাজার পেরিয়ে। বাজারের এপার-ওপার মিলে গাঁ নেহাত ছোট নয়। সিধা সড়কের সঙ্গে সমকোণে সে গাঁ ঢুকে গেছে অনেক দূর, রেলপথ পর্যন্ত।

শান্তি গজগজ করতে করতে এগোয়৷ যতই শৌচালয় বানাও, ভ্যান রিসকায় হাঁকো, মাঠ ছাড়া মরদের কোষ্ঠ সাফ হয় না। হাবুল দোকান খুলেছে কি? তার মাঠের কম্মো সারা হল? বিলেড দরকার। যে কোনো মুহূর্তে সময় হতে পারে৷ ভোরের কুয়াশাভেজা সবুজের ভিতর থেকে আধোঘুমে ডাকে ডাহুক। বলে, সময় হয়ে এল। 

আলপথ বেমক্কা ঠোক্কর খেয়েছে বট গাছে। বট গাছের ধার দিয়ে সড়কে উঠতেই কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায় দূরপাল্লার ট্রাক। এ রাস্তায় রাতভর ট্রাক চলে। বাংলা পেরিয়ে উড়িষ্যা। উড়িষ্যা পেরিয়ে অন্ধ্র। মালবাহী ট্রাকের ভার চুপচাপ বয়ে রাস্তার বুক ক্ষয়ে গেছে। অথচ বাস্ যায় দিনে মোটে তিন চারখান। পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে পরিত্রাহী হর্ন মারতে মারতে আসে তারা। থামে না। বাস্ স্ট্যান্ড বাজার পেরিয়ে, গাঁয়ের অপর পারে, ওদের বসতের দিকে, যারা থাকে ওধারে। তাই কি স্বাভাবিক নয়? শান্তিদের পাড়া থেকে পাক্কা চার কিলোমিটার হাঁটা পথ।

বাস পৌঁছে দেবে গঞ্জে। গঞ্জে হাসপাতাল। বিয়োনো নিখরচায়। এমন নয় যে হাড়ি-মুচি, বাগদি-বাউরি হাসপাতালে ডরায়৷ কিন্তু বাস স্ট্যান্ড পৌঁছানো বালাই। বিশেষত যদি জল ভাঙে, তবে পাঁকাল মাছের মতো ছটফটায় পোয়াতি। তার চেয়ে এই বেশ৷ শান্তি কাকী ‘ছুয়া’ ধরে, তাই পোয়াতির নিশ্চিন্দি। ছ মাসের পর, থেকে থেকে খোঁজ নেয়, পরামর্শ দেয় মুফতে। শান্তির প্রজ্ঞায় তাদের ভরসা আছে। আশা দিদিদের মতো রঙিন সিন্থেটিক শাড়ির শখ ছিল শান্তির এককালে। খাতায় কলমে তা প্রাপ্য নয়। অতএব সাইড বিজিনেস, ঠোঙা। তাতেই নিয়মিত আয়, তবু তাকে ঠিক পেশা মানে না শান্তি। তার চেয়ে ‘দাই’ ওজনদার।

এ বিদ্যে জানত তার ঠাকমা। পানের খিলি গালে ঠেসে বাচ্চা ধরত অনায়াসে৷ ঠাকমার মেয়ে ছিল না। পুত্রবধূকে বিদ্যে দিয়ে যেতে চেয়েছিল বুড়ি। মা গিয়েছিলও দু চারবার, ঠাকমার সাথে। হাত পা হিম হয়ে যেত পোয়াতির চিৎকারে৷ ঠাকমা ক্ষান্ত দিল৷ তেরো পার হতে শান্তিকে সঙ্গে নিল। সে ঠাকমার ধারা পেয়েছে। ঠাণ্ডা মাথা, নিপুণ হাত, তীক্ষ্ম চোখ। অতঃপর ষোলোতেই বিয়ে হল তার। প্রথম যেবার শউরবাড়ির পাড়ায় বাচ্চা ধরল শান্তি, একা, তখন সে কুড়ি। তদ্দিনে ঠাকমা প্রাগৈতিহাসিক বিদ্যে উত্তরসূরীকে সমর্পণ করে গত হয়েছে দু বছর। 

নিমকাঠি ভেঙে দাঁতন করছে হাবুল। দোকান আধা ঝাঁপ ফেলা৷ সার বেঁধে নিমগাছ রাস্তার অন্য পারে, শ্মশানের দিকটায়। সড়কের ডানদিকে গাঁ আর বাঁদিকে টানা শ্মশান৷ আগে ভাগ-বাঁটোয়ারা ছিল৷ পূব দিকে বামুনের শ্মশান দিয়ে শুরু। তারপর কায়েতের, রাজুর। অতঃপর হাড়ি, মুচি, বাগদি, বাউরি, ডোম… সকলের পরলোকের গতি একে একে৷ বছর দশ আগে এই মতো চলত। এখন পঁচিশ বিঘাটাক জুড়ে ক্রিয়াকর্ম হয় না আর। বদলে যন্তর বসেছে পূবদিকে৷ ছাউনি তলায় একখান চুল্লি। বোর্ডে লেখা, ‘শান্তির আশ্রয়।’ শান্তি হাসে। ‘শান্তির আশ্রয়’-এ শান্তির ঢোকা হবে নাকো। কে জানে কোন ক্ষেতের ধারে ধিমি ধিমি পুড়বে সে! বাস্ স্ট্যান্ড, চুল্লি, ওরা — সকলেই থাকে ওধারে। শান্তি জানে, তার লাশও পূবদিকে বহিরাগত। 

কুলকুচি সেরে হাবুল ঝাঁপ খুলেছে এইবার। ধূপ জ্বালে বউনির আগে। শান্তি দোকানের সামনেটা জুড়ে দাঁড়ায়। হাবুল গাঁয়ের প্রাইমারিতে প্যারাটিচার হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। ধরা-করার মুরোদ নেই, তবু। তাছাড়া হাড়ি-মুচি মাস্টার হলে ছেলেপিলে মানবে কি? হাবুল অতঃপর বিয়ে করে শউরের টাকায় দোকান দিল রাস্তার ধারে৷ 

ধূপ ঘোরাতে ঘোরাতে হাবুল দেখে নেয় বান্ডিলের আকার। ধূপদানিতে ধূপ গুঁজে, কপালে দুইহাত ঠেকানো হলে জার্মান সিলভারের বাক্স থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে এগিয়ে দেয়। শান্তির পান খাওয়া দাঁত বিসদৃশ হাসি ছড়ায়। তারপর সে বলে, ‘বিলেড।’ 

চৌখুপি প্যাকেট থেকে চৌকো জিনিস বেরিয়ে আসতেই খপ করে ধরে বাড়ানো হাতে। 

হাবুল শুধায়, ‘কিট্ কাঁইকি তুমহর?’ 

‘নুতন বিলেড লাগিব। তু জানিবু কিন্তিকি? ছুয়া হউ, দেখিবু।’

সরকারি কিট্ আছে, কুলুঙ্গিতে রাখা। সেবার একমাসের ট্রেনিং ছিল গঞ্জ হাসপাতালে। কাঁচি, মলম, ডেটল, ব্যান্ডেজ, সুতো, গজ… দিয়েছিল সবই। তবু, নাড়ি কাটতে নতুন কাঁচি হলে ভাল হয়। নিদেন ব্লেড। হাবুলের দোকানে এক এক করে জড়ো হচ্ছে মদ্দরা। হকার অব্যর্থ লক্ষ্যে কাগজ ছুড়ে দিল উড়ন্ত সাইকেল থেকে। এ কাগজ এখন খদ্দেরদের হাতে হাতে ঘুরবে দিনমান। বাকি ছ-সাতটা কাগজ যাবে ওধারের ছ-সাত বাড়ি। ছ-সাত বাড়ি ব্যক্তিগত খবরকাগজ পড়ে এ গাঁয়ে৷ বাকিদের ভরসা হাবুলের দোকান। খদ্দেররা কাড়াকাড়ি শুরু করার আগে হাবুল সন্তর্পণে পাতা ওল্টায়।

 

২.

 

সুন্দরবন, ২০২০:  অ্যানপুরের সরকারি  স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে রোগী-পরীক্ষার জন্য দুটো টেবিল আছে – বিছানা বা বিদ্যুৎ কিছু নেই। এখানে এএনএম, কতিপয় আশা কর্মী এবং একজন পুরুষ নার্স চিকিৎসা করেন। যদিও, প্রসব এখানে হয় না। প্রসব সহায়িকা দুর্গা মন্ডল জানান, ‘আমরা মহিলাদের বহু কষ্টে সম্মত করাই হাসপাতালে প্রসব করার জন্য (যেহেতু হাসপাতালের দূরত্ব এবং খরচ দুটো বড় অন্তরায়)। এমনকী পঞ্চায়েত থেকে নানা কৌশল নেওয়া হয়, বলা হয় হাসপাতালে প্রসব করলে তবেই একমাত্র জন্ম সার্টিফিকেট এবং রেশন কার্ড পাওয়া যাবে।’ তবু সুন্দরবন অঞ্চলে শতকরা ৫৫ শতাংশ শিশুর জন্ম বাড়িতেই হয়। সবসময় নৌকো পাওয়া যায় না। কোনো সময়ে আবার হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না। তখন আবার ওখান থেকে পাঠানো হয় কাকদ্বীপ হাসপাতালে, সে আরও পঁয়ত্রিশ কিলোমিটারের পথ। গর্ভবতী মহিলাদের কাকদ্বীপে যেতে হলে তাঁরা নদীর জোয়ার এবং দুর্গম রাস্তার ঝুঁকি নিয়েই যান। তবে বেশিরভাগেরই পছন্দ বাড়িতে প্রসব। বায়েরমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাঃ বেণিমাধব চট্টরাজ অবশ্য বলেন, এই অবস্থা শুধু সুন্দরবনের নয়। নদীর বাহুল্য, নৌকার অপ্রতুলতা— এসব অজুহাত মাত্র। নানা জেলায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যাই হাসপাতালে আসায় প্রসূতির অনাগ্রহের কারণ।

 

৩.

 

বান্ডিল ঝুলিয়ে ফিরতি পথ ধরে শান্তি। এ বান্ডিল ঠোঙার নয়, হাবুলের দোকানের পুরোনো খবর কাগজের। আবার তৈরি হবে একশ, আড়াইশ, পাঁচশ গ্রাম বা এক কিলো, পাঁচ কিলো ঠোঙা। আজ উনুন চাপানোর তাড়া নেই। মেটে বারন্দায় ঠ্যাং ছড়িয়ে জল ঢেলে মুড়ি খাচ্ছিল অভিমন্যু। ঝাড়াই-মাড়াই-এর সময়। জন খাটতে যাবে। দুপুর গড়ালে পান্তাভাত বাবুবাড়িতে জুটে যাবে। সেই যবে অভিমন্যুর বাপের হাত গলে গেল ঝাড়াই মেশিনে, তবে থেকে সে বাদ গেছে বাবুদের হিসাব থেকে৷ যন্ত্রের যন্ত্রণা বড়। যেমন ধরো হাসপাতাল। কত যন্ত্র! কালো জলে ছুয়া সাঁতরায়, টিভিতে দেখা যায় স্পষ্ট। মলম লাগিয়ে ক্যামেরা বোলায় ডাক্তার ঢাউস পেটে। শাড়িখানা নামিয়ে দিতে হয়। পোয়াতি খানিক লজ্জা, খানিক ভয়ে পাথর হয়ে থাকে। তার হাত ঘামে শান্তির মুঠোর ভিতর।

হাসপাতালে যাওয়ার ডাক সে পায় এমনকী বাউন-কায়েত পাড়া থেকেও। ওরা বাসে যায়, হাসপাতালে বিয়োয়। কিন্তু সঙ্গে যেতে শান্তিই ভরসা। ছুয়ার বাপেদের মাথা ঘামাতে বয়ে গেছে মেয়েলি ব্যাপারে। সুবিধে-অসুবিধে ডাক্তার-নার্সকে বুঝিয়ে বলবে কে?

দাশেদের বউকে যেবার হাসপাতালে নিয়ে গেল, শান্তি নার্সকে বলল, ‘যমজ ছুয়া।’ পেটে হাত বুলিয়ে বোঝা যায়। তরুণ ডাক্তার তাকালো বিরক্তি নিয়ে। প্রথমটা বেরোনোর মিনিট তিনেকের মাথায় আরেকটা বেরোলো। ফ্যাকফ্যাক হেসেছিল শান্তি। পুও না ঝিও, তাও আন্দাজ লাগাতে পারে সে, তবে মনে মনে৷ বলে না। সবাই সমান নয়৷ ঝিও, মানে মেয়ে-ছা খসাতে আজকাল উড়িষ্যা যাচ্ছে। 

অভিমন্যু বেরোনোর আগে বলে গেল, ‘আজ যাউচ তো?’ দশাসাই ছেলের ভিতর যে কাদামাটি মন পতপত করে, তাকে বিলক্ষণ চেনে শান্তি। পাণিগ্রাহীদের জমিতে এখন কাজে লেগেছে অভিমন্যু। সে বাড়ির বউ বোবাপানা। পোয়াতি মাস আটেক হল৷ শান্তিকে সঙ্গে করে হাসপাতাল গেছিল তৃতীয় মাসে। তারপর আর তলব হয়নি৷ মাসখানেক আগে অবশ্য শান্তি নিজের গরজে গেছিল একবার৷ বাচ্চা হাসপাতালে হোক, তবু পোয়াতির খোঁজ রাখাকে সে দায় মানে৷

সে বউ গতকাল ঢিমে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল অভিমন্যুর পিছে৷ সূর্য তখন পশ্চিমপানে ঢলে পড়ছে৷ নিজের দীর্ঘ ছায়ার পাশে অভিমন্যু একখানি নারীছায়া দেখে চমকে উঠেছিল৷ ধানের আঁটি নামিয়ে রেখেছিল। উদরখানি হাতে চেপে ধরেছিল পিছনের মেয়েটি। ঘোমটা খসে গেছিল। বাউনবাড়ির বউ দুপুররোদে ছোটজাতের মরদের সঙ্গে শুনশান খামারে, লোকে দেখলে কী বলবে ভেবে দরদর ঘামতে থাকে অভিমন্যু। অথবা শুধু লোকভয় নয়, বউটির উদর চেপে ধরা ফর্সা হাতের গোছ, ক্লান্ত লাবণ্য তাকে ঘামায়। বউ যেন ভূতগ্রস্ত। হিসহিসে গলায় বলে, ‘শান্তিমাউসিকু আসিতে কইব? খুব, খুব দরকার।’ জরুরি তলব দিয়ে ত্রস্ত প্রসূতি অন্তর্হিত হয়।

আজ বাগদিদের ছুয়া হবে। আজই আবার বাউনবউ-এর ডাক। সে বেটির সময় হয়নি। তাও কেন ডাকে? অভিমন্যুর বর্ণনায় আসন্ন বিপদের আঁচ। কী ধরনের বিপদ, ঠাহর হয় না। পুরোনো কাগজের বান্ডিল আলগা করতে করতে শান্তি ভাবে, যেতে হবে। ঠাকমার বিদ্যের কেরামতিতে ফি ডেলিভারি একখান শাড়ি আর এক কিলো চাল পাওয়া যায় বলে নয়। বগাল যেমন করে সাঁঝবেলায় গরু টেনে নিয়ে যায় গোয়ালে, সেইভাবে পোয়াতির ভয় বা বিপদ তাকে টেনে নিয়ে যায় পাড়ায়-বেপাড়ায়। দড়ির বাঁধন আলগা হতে অক্ষরমালা ছড়িয়ে পড়ে ঘরে।

 

৪.

 

হাবড়া, ২০১৮: পুকুরে ভাসছে সাতাশটি কৌটো, খুলতেই মিলল মাংসপিণ্ড, যা আসলে অবৈধ গর্ভপাতের ভ্রূণ! গোটা ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে পুকুরের ধারে বসে কিছু যুবক মাছ ধরছিল। সেই সময় পুকুরের ধারে একটা বস্তা দেখতে পায় তারা। সন্দেহ হওয়ায় বস্তা খুলতেই বেরিয়ে পড়ে কৌটোগুলো। আর তাতেই মেলে অতগুলো ভ্রুণ। পুলিশ এসে কৌটোগুলি উদ্ধার করে। আপাতত হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে ভ্রুণগুলিকে। পুলিশ জানিয়েছে, মনে করা হচ্ছে কোনও নার্সিংহোমে অবৈধ গর্ভপাত করিয়ে ভ্রুণসমেত কৌটোগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছে। এলাকার কোনও নার্সিংহোম এই কাজে যুক্ত নাকি বাইরে থেকে কেউ এসে ফেলে গিয়েছে সেগুলি, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

 

৫.

 

অভিমন্যুর বাপ দোলায় দুলছে নিস্পৃহ৷ একটেরে মেটে একটা ঘর। লাগোয়া হেঁসেল আর দড়ির দোলা খাটানো দাওয়া। এ অঞ্চলে লোকে চেয়ার পাতার বদলে দোলা খাটায়। নাইলনের, বা দড়ির। বাচ্চা, বড়ো সকলেই মৃদুমন্দ দোল খায়। ছুয়াদের দোলাতে মাদুর পেতে ঘুম পাড়ায় মা। অতিথি এলে আদর করে দোলা পেতে বসায়। চোঙায় মুখ লাগিয়ে উনুনে তিনবার ফুঁ দিয়ে শান্তি কালো কড়াখানা বসায়। তেল গরম হতে বেছে রাখা শাক ঢেলে দেয়। রান্নাঘর ফেলে শোওয়ার ঘরে কুলুঙ্গি থেকে কিট্ নামায়। শস্ত্রদের থালায় সাজিয়ে রান্নাঘরে ফেরে। শাক হয়ে এলে শান্তি উনুনে জল চাপায়। ভাপ উঠলে এমন ঘোর লাগে, যেন অলৌকিকের আবাহন। তন্ত্রসাধকের কায়দায় বিড়বিড় কিছু আউড়ে থালা থেকে ছুরি কাঁচি একে একে ফেলে দেয় শান্তি ফুটন্ত জলে। তারপর আবার দৌড়। অভিমন্যুর বাপের সামনে ঠক করে কাঁসার বাটিতে পান্তা আর শাকভাজা রেখে আসে। আবার শোবার ঘরে ঢুঁ মারে। পরিষ্কার কাপড় ছেঁড়ে। রান্নাঘরে এতক্ষণে স্টিলের যন্ত্রপাতি তেতে উঠেছে। সাঁড়াশি দিয়ে একে একে তাদের উদ্ধার করে শান্তি৷ কাঁচি, ফরসেপ। ছেঁড়া কাপড়ও ভিজিয়ে নেয় গরম জলে। অতঃপর শস্ত্রসকলের গা মোছে৷ ঘামটাম ঝরিয়ে তারা নেয়েধুয়ে প্রস্তুত। নতুন ব্লেডখানা কিটবাক্সে ভরে নেয় সে গজকাপড় আর তুলোর পাশে৷  

মাথা ছেনে শান্তি চিরুনির ডগা দিয়ে সিঁথি রাঙায়। ডিবেয় রাখা পেরেকের আগা দিয়ে টিপ আঁকে। আলনা থেকে অন্য শাড়িখান নামিয়ে জড়ায়। রান্নাঘরের পিছনের দাওয়া দিয়ে বেরোয় সে এইবেলা৷ শিকলি তোলার আগে হাঁক পাড়ে, ‘আসুচি।’ নুলো অর্জুন নিরাসক্ত ‘হ’ সহকারে সাড়া দেয়। 

পাঁই পাঁই ছোটে শান্তি আল ভেঙে। ফাটা পায়ে এবড়োখেবড়ো ঢ্যালা বেঁধে। মাথার উপর সূর্য দেখে আন্দাজ করে, বেলা নয়টা হল বুঝি৷ বাগদি বউ-এর বাড়ি থেকে তলব এসেছিল ভোর ভোর। ব্যাথা উঠছে। রোগাপানা ছুঁড়িকে দেখে এসেছে দিনকয়েক আগে। পেটের ভিতর থেকে বাচ্চাকে জন্মপথের কাছে নামানোর কৌশল শিখিয়েছে বারবার। সে বেটি লজ্জা পায় আর হাসে। বেড়া ঠেলে ঢুকতে তার খালি-গা শউর ছাগলঘর দেখিয়ে দেয়। বিপিন বাগদির ছাগল আছে দুইখান। তাদের দুইয়ে বাগদি বউ দুধ ফিরি করে মাঝেসাঝে। সে দুটো এখন বেঁধে রাখা ছাগলঘরের এককোণে। হাগামোতা ছাড়া তাদের আর কোনো ঝামেলি নেই। বউমানুষ আরেক কোণে চাটাইতে শোয়া। কাতরাচ্ছে। মাথাখানা শক্ত করে যে ধরে আছে, তাকে শান্তি আগে দেখেনি। বেটির মা কি? শাউড়ি হাওয়া টানছে। দরদর ঘামছে মেয়ে। আঠারো উনিশ বয়স। মাথায় ঘোমটা দিয়ে গামলা ভরা গরম জল আর মগ দিয়ে যায় মেয়ের জা। শান্তির সঙ্গে চোখাচুখি হতে ব্যস্তসমস্ত বলে, ‘মাউসি, হাত ধুই আসো। পানি রখিছি।’

উঠোনে কুসুম কুসুম জল আরেক গামলায়৷ পাশে লাইফবয়। হাত ধুয়ে এসে শান্তি দেখে, নিচু চালের বাঁশ লক্ষ্য করে একখান দড়ি ছুঁড়ছে পোয়াতির জা। বাঁশের উপর দিয়ে সে দড়ি চালান হলে শক্ত গিঁট পাকায় সে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে৷ বটের ঝুরির মতো দড়িটা ঝুলতে থাকে মেটে মেঝে পর্যন্ত। শাউড়ি তার আগাখান ধরিয়ে দেয় কাতরানো মেয়ের হাতে। বলে ‘দড়ি ধরিকি চাপ দিও বউ। কোঁত পাড়ো।’ মেয়ে দুই হাতে শক্ত করে দড়ি চেপে পাছাখান তোলে। কোঁত পাড়ে প্রাণপণ। শান্তির হাতে তার শায়া-শাড়ি উঠে আসে বুকে পেটে। চিল্লানি এখন বুঝি বা বড় রাস্তা থেকে শোনা যায়। ত্রিভুবন এফোঁড় ওফোঁড় করে সে মন্দ্র মেয়ের চিৎকার। জীবনে প্রথমবার চেঁচালো কি মেয়ে? নাকি চিল্লিয়েছিল আর একটি মাত্র বার, যখন ওই মধ্যবয়সিনী, যে এখন চুপচাপ তার মাথাখানি ধরে আছে, তার গর্ভপথ তাকে উদগীরণ করেছিল? মায়ের কান্নার পরেই শিশুর ধরতাই…শান্তির প্রৌঢ় কান এসবে অভ্যস্ত৷

এ বেটির বউনির বাচ্চা। গর্ভপথ এখনও লাজুক, আড়ষ্ট। শান্তি চোখ আর হাত যথাস্থানে নিমগ্ন রেখে মাথা নেড়ে নেড়ে প্রবোধ দেয়, ‘টিক্কে, টিক্কে, আউটিক্কে মা, আর একটু।’ 

মাথাখান দেখা যায়। অবশেষে। যখনই মাথাখান সুড়ঙ্গপথের মুখে দেখা যায়, শান্তির মগজে সন্ধের শাঁখ বেজে ওঠে। রক্তে ক্লেদে স্রাবে মেশা বাচ্চাটিকে বের করে কোলে নিলে, দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে। পোয়াতির হাঁফানি, অন্য বউদের উল্লাস, আর বাচ্চার কান্না মিলে বিচিত্র শব্দকল্পদ্রুম তৈরি হয়।

নতুন বিলেড দিয়ে নাড়ি কাটে শান্তি। কিট থেকে নেভোশিল পাউডার ছড়িয়ে দেয়। সুতো বের করে নাড়ি বাঁধে৷ নাড়ি ছেঁড়া ধন যত কাঁদে, বউরা তত খিলখিলায়। শুধু ছুয়ার বাপ ছাগলঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে চুকচুক করে৷

শাউড়ি ব্যাটাকে ধমক লাগায়। ‘ঢঙ করুচু কাঁইকি? লক্ষ্মী আসিচি।’ ফুল ঝরে পড়ে এইবার৷ যে ফুল শিশুটিকে ধরেছিল আলতো এতক্ষণ। শান্তি হাঁফ ছাড়ে৷ কাজ সারা হল৷ এইবার কুসুম কুসুম জলে বাচ্চাকে ধুয়ে, পরিষ্কার ন্যাকড়ায় মুছতে লাগে। মায়ের বুকও ধুয়ে দিতে হবে। তাকে শেখাতে হবে দুধ দেওয়ার কায়দা।  

শান্তি মনে ভাবে, এই ভালো। পকেট গরম না হলে উড়িষ্যা দূরস্থান, গঞ্জের হাসপাতালেও যাওয়ার জো নেই। বাছাবুছির অতএব বালাই নেই। মেয়ে-ছা খসাতে গেলেও পকেটের রেস্ত চাই। পেটের একটাও ছবি ওঠে না এসব পোয়াতির। আশাদিদিরা এসে কার্ড করিয়ে যায়। কিন্তু গঞ্জে নিয়ে যাবে কীসে? বাস্ তো ওদের… যারা থাকে ওধারে, যাদের চুল্লি জোটে মরার পর, যাদের বাড়ি ব্যক্তিগত খবর কাগজ যায়…

 

৬. 

 

বাংলাদেশ, ২০১৯: বাংলাদেশের দক্ষিণাংশ জুড়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবিন্যস্ত, অপরিচ্ছন্ন বসতির ছড়াছড়ি। সেখানে দুটি হাত, ব্লেড আর কিছু প্রাথমিক সামগ্রী নিয়ে নিয়মিত শিশুজন্মে সাহায্য করেন ধাত্রী জোহরা বিবি। নিজের জায়ের সন্তান ধরার পর থেকে প্রায় প্রতি হপ্তাতেই তাঁর ডাক পড়ে। জোহরা আফশোস করেন, তার সরকারি কিট্ উচ্ছেদের সময় রয়ে গেছিল পুড়িয়ে দেওয়া গাঁয়ের বাড়িতেই। এখানে কিটের আশা নেই। এখানে জোহরার ধাত্রী হিসেবে তো নয়ই, নাগরিক হিসেবেও নাম ওঠার সম্ভাবনা নেই। যে শিশুদের জন্ম হয় জোহরার হাতে, তাদেরও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সরকারি স্বাস্থ্যে অধিকার নেই।

২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় হিংসা বৃদ্ধি পাওয়ায় জোহরার পরিবার সহ সাত লক্ষ রোহিঙ্গা দেশছাড়া হয়। সতের দিন হেঁটে জোহরারা দক্ষিণ বাংলাদেশে পৌঁছন। পথে নিজের জায়ের প্রসবে সাহায্য করতে হয় জোহরাকে। তিনদিন বাংলাদেশ বর্ডারে কাটিয়ে তাঁরা রিফিউজি ক্যাম্পে আসেন। দিন দিন ক্যাম্প ঘিঞ্জি হচ্ছে আরও, জোহরার আক্ষেপ। বসতির জনসংখ্যা বাড়লে কীভাবে একা হাতে শিশুজন্ম সামলাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত জোহরা। তিনি ভাবছেন, এবার  রিফিউজি ক্যাম্পের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ বিদ্যা শিখিয়ে যাওয়া দরকার। 

 

৭.

 

পাণিগ্রাহীদের এলাহি বাড়ির বাইরে খামার। সেখানে অভিমন্যু তখনও ঝাড়ছে ধান। মায়ের ক্ষীণ মূর্তিখানি দূর থেকে দেখে তার হাত শ্লথ হয়। আজ কয়েকবার ভিতরে উঁকি মারার চেষ্টা করেছে সে। তরুণীর চোখে ছিল বোবা ভয়, গতকাল। শাউড়ির নির্দেশে সে মেয়ে পান্তাভাত দিয়ে যায়নি আজ। খাওয়ার সময় হলে ক্ষ্যান্তমণি ঝি জামবাটি রেখে গেল৷ অভিমন্যুর ইচ্ছা হয়েছিল, বউ কেমন আছে, শুধোয়৷ সাহস হয়নি৷ রাতে ঘুমোতে দেয়নি শঙ্কিত চোখ, আলুথালু বেশ। অথচ কালকের আগে ঘোমটা টানা সে বউয়ের মুখও দেখেনি অভিমন্যু। মাকে দেখে সে বল পায়। 

মা গম্ভীর কেজো চোখে যায়। অভিমন্যু জানে, শান্তি এখন নিজেতে নেই৷ সৃষ্টিরহস্য ভর করেছে তার পরে। নিপুণ দুটো হাত সদ্যোজাতকে ধরে যখন, গাঁয়ের লোক অবাক মানে৷ সেই সময়ের স্থিতধী মাকে চিনতে অসুবিধা হয় অভিমন্যুর, যখন বিলেডের এক কোপে নাড়ি কেটে জড়িয়ে দেয় সুতো। শান্তি নিশ্চুপে শোনেনি কোনো চক্রব্যূহের রহস্য। সে স্বয়ম্ভূ, নিজেই জ্ঞানের আকর৷ তার হাত সাবলীল ঢুকে যায় গর্ভপথে। টেনে আনে প্রাণ, মাথাখানি ধরে৷ 

মা তাকে ফেলে এগিয়ে যায়। ধানের আঁটি আবার তুলে নেয় অভিমন্যু৷ মা ঢুকছে পাণিগ্রাহী বাড়িতে৷ হয়ত হাসপাতাল যেতে হবে বউকে নিয়ে। এ’পাড়া মাকে বাচ্চা ধরতে ডাকে না৷ এ’পাড়ার সামনে বাস্ থামে। তবে পোয়াতি বউ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে যাতায়াত-টিফিন বাদে দিনে কুড়ি টাকা আয়। বউটা কী বলতে চাইছিল? কাটা ছাগলের মতো চোখে কী ভাষা ছিল? বেলা একটার বাস পেয়ে যাবে ওরা, এইবেলা বেরুলে। অভিমন্যু কাজে মন দেয়।

একটার বাস দূর থেকে হর্ন মেরে আসছে। অথচ ওরা বেরোয় না৷ সহসা বাসের বিকট হর্নকে ছাপিয়ে মড়াকান্না। কাঁদছে, নাকি ম্যা ম্যা করছে বলি দেওয়া ছাগলের ছিটকে যাওয়া মাথা? বাচ্চা বেরোনোর সময়ের যে চিৎকার, তার থেকে অনেক তীব্র নয় কি এ আর্তনাদ? ভুল হল। পরিমাণগত নয়, গুণগত ফারাক৷ এ চিৎকারে প্রচেষ্টা নেই, আনন্দ নেই। কলজে মোচড়ানো যন্ত্রণা শুধু৷ অতঃপর আর্তনাদ গোঙানি হয়ে যায়৷ বাস্ পাঁচ মিনিট জিরিয়ে হর্ন বাজিয়ে রওনা দেয়। তার ধোঁয়া আর নারীর গোঙানি, দুয়েরই রেশ থেকে যায় দুপুরের দাবদাহে। 

 

৮.

 

দিল্লি, ২০২১: জনসংখ্যা কমানোর প্রয়াসে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ এক নতুন খসড়া জনসংখ্যা নীতি প্রকাশ করেছে। দুইয়ের বেশি সন্তান যাদের আছে, তাদের সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা, পদোন্নতি বা সরকারি ভর্তুকি পাওয়া বন্ধ হতে পারে৷ বিশেষজ্ঞ গবেষকরা অবশ্য পূর্ববর্তী তথ্য সহকারে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নতুন নীতি কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলতে পারবে না। পরিবর্তে, এটি অনেকগুলি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে কন্যা ভ্রূণহত্যা বৃদ্ধি, অনিরাপদ গর্ভপাত ও মাতৃমৃত্যু। 

বিশ্বে কন্যাভ্রূণ হত্যার হার সবচেয়ে বেশি ভারতে। আবার ভারতের মধ্যে কন্যাভ্রুণ হত্যায় উত্তরপ্রদেশের স্থান আশঙ্কাজনক৷ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অবশ্য বলছেন, এটি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘জনসংখ্যার ভারসাম্য’ রক্ষা করবে। প্রসঙ্গত, জাতীয় লিঙ্গানুপাত ভয়ানক হ্রাস পাওয়ার পর চীন ২০১৬ সালে তার কয়েক দশকের পুরনো ‘এক-সন্তান নীতি’ বাতিল করেছিল।

 

৯.

 

সেদিন রাতে শান্তি চোঙায় ফুঁ দিচ্ছিল। আগুন হলহলিয়ে উঠছিল। স্পষ্ট দেখেছিল অভিমন্যু, মায়ের চোখে জল। অথচ স্বীকার যাবে না। বলবে, ধোঁয়া… 

নুলো অর্জুন চুপচাপ দোলায় দুলছিল। অভিমন্যুর জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল, অনেক অনেক রক্ত? বউটার লালচে গা ফ্যাকাশে মেরে গেছিল?

‘মরা ছুয়া ধরিচি মু আজ।’ 

হঠাৎ চোঙা ফোঁকা থামিয়ে বলে শান্তি। উনুনের আলোয় নিজ হাত দুটি দেখে। যেন এখনও রক্ত। অর্জুন দোলা থামায়। শাবকহারা হস্তিনীর মতো শান্তি দোলা ছাড়াই নিষ্ফল রাগে দোলে। 

অভিমন্যু মাকে জড়ায়। শান্ত করতে চায়। মা আনতাবড়ি বকে। গঞ্জে এক রিক্সাওয়ালা পুংলিঙ্গ নিশ্চিত করার ওষুধ ব্যাচে। সে জোচ্চুরি শান্তিও জানে। শিকড়-বাকড়ের টোটকায় নাকি মেয়েছেলেও পেটের মধ্যে ব্যাটাছেলে হয়ে যায়। অথচ ক্যাম্পে বলেছিল, একবার পেটে ফল ধরলে লিঙ্গবদল হয় না ইচ্ছেমতো৷ ভ্যান রিসকায় সে কথা বারবার হেঁকে গেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র৷ বাউন-কায়েত-রাজু-হাড়ি-মুচি-বাগদি… পেট হলে, শান্তিও প্রত্যেকের বাড়ি বয়ে বলে আসেনি কি? থানায় হত্যে দিয়েছে বিক্রি বন্ধ করতে। দুদিন জেলে রাখে। তারপর অন্য কোনো রিক্সাওয়ালা, পান-বিড়িওয়ালা…

বউ জানতে পেরেছিল, শাউড়ি ওষুধ কিনেছে৷ বাচ্চার ক্ষতি হবে, কেঁদেকেটে বলেছিল বরকে৷ বর মায়ের অবাধ্য হয়নি৷ কাল দুপুর থেকে পেটে মোচড়। কোনোমতে উঠে খবর দিয়েছিল অভিমন্যুকে। রাতে রক্ত ভাঙল। রক্ত বাঁধ মানে না দিনভর। সাত মাস৷ মাংসপিণ্ড বের করে এনেছিল শান্তি৷ পুয়ো না ঝিও, জানার আর উপায় ছিল না। মংসপিণ্ডকে দাহ করতে ওরা নিয়ে গেছিল শ্মশানের চুল্লিতে। বাউন মাংসপিণ্ড। বাঁচার না হোক, চুল্লিতে অধিকার৷ হাউহাউ কেঁদে চলা ফরসা বউটাকে জড়িয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল শান্তিমাউসি৷ মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়, শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

 

১০.

 

সুখী সুখী ভাব করা জোড় দেখলেই সামন্তর মনে হয়, হয় টিকিট কাটেনি নয় অন্য লফড়া । অফিসফেরতা প্রেমিক-প্রেমিকা হোক বা কলেজ ছাত্র-ছাত্রী, হাত ধরাধরি করে প্ল্যাটফর্ম পেরোলে মটকা আরও গরম হয়। তবে অফিস বা কলেজে যাওয়া মেয়েগুলো তড়পায় বেশি, এমনকী প্রেমিকদের চেয়েও বেশি৷ অতএব পয়লা পছন্দ হল লটঘট করা কুলি-কামিন আর কাজের মেয়ের জোড়। ছোটবেলায় দেখেছিল, শঙখ লাগা সাপের জোড় ভাঙায় মস্তি নিত সাড়া পাড়া। এইবেলায় মন্ডল যাদের জেরা করছে, তাদের দেখতেও জিআরপি ঘরের বাইরে লোক জমেছে। ওরা টিকিট কাটলেও, সামন্তর মন বলছিল ডাল মে কুছ কালা জরুর হ্যায়। ঢলানি এমন, যা বিয়ে করা মাগী-মরদের হয় না। ক’দিন ধরেই লক্ষ্য রাখছে। ছেলেটি ভাড়া শ্রমিক। তেমাথা থেকে সোনারপুর স্টেশন হয়ে লোকালে চেপে যাদবপুর স্টেশনে নেমে বসে থাকে৷ কেউ না কেউ নিয়ে যায় বাগানের ঘাস কাটতে, মাল বইতে, রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে করে। বউটার সাথেই আসে। বউটা কাজ পেয়েছে আয়া সেন্টারে। কিন্তু বউই কি? জিজ্ঞাসাবাদে বাপের নাম বলে যখন দুজন, জাত মেলে না। ভেগেছে নাকি? সামন্ত রগড়ের গন্ধ পায়। ঘরে ডাকে। ভিড় ওদের ঘিরে চাক বাঁধছে। মাপছে বউটাকে। ছেলেটা থাপ্পড় খেল মণ্ডলের হাতে। বউটা থম মেরে বসে আছে।

মামলাটা আগাপাশতলা বুঝতে ঘণ্টা তিন লাগল। রাজ্য পুলিসকে ইনভলভ করতে হল। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের সঙ্গে কানেক্ট হল শেষতক। ওখান থেকেই ভেগেছে। এক মাস আগের মিসিং ডায়রি আছে বউ-এর নামে। পালিয়েছিল বাড়ির মজুরের সঙ্গে। টিভি তখন গাঁকগাঁক খবর পড়ছিল। হরিয়ানায় শিশুর লিঙ্গ নিশ্চিত করার ভুয়ো ওষুধে বাড়ছে স্টিলবর্ন…উপাদান খতিয়ে দেখতে পাঠানো হয়েছে রসায়নাগারে…সামন্ত টিভি মিউট করে। রাজ্য পুলিসের সঙ্গে জরুরি কথা সেরে নেয়। অতঃপর ঘন ঘন সাংবাদিকদের ফোন আসতে থাকে। 

রাজমিস্ত্রীর সঙ্গে বাড়ির বউ-এর পালানো দিয়ে যে সিরিজটা শুরু হয়েছিল, তার নতুন এপিসোড পেয়ে কাগজ খুশি। চ্যানেলও। লোকে খাচ্ছে। কিছু অ্যাংগেল ঢোকালে প্যানেল বসিয়ে পুরভোটের আগে পর্যন্ত টানা যাবে। একটা ভারতীয় মূল্যবোধ অ্যাংগেল, একটা ফেমিনিস্ট, একটা কমিউনিস্ট…এছাড়া একজন হালকা যৌনধর্মী সাহিত্যকুশলী লাগবে, আর একজন বলিয়ে-কইয়ে সাইকোলজিস্ট মাস্ট। শেষে ফেসবুক থেকে কটা পোস্ট পড়ে শোনাবেন সঞ্চালক। জনমানস, খিল্লি, পিএনপিসি— এসব নিয়েও বিশ্লেষণ হবে। মোটামুটি এই ফর্ম্যাট।

ছেলেটির বাড়ি ভাঙা পড়েছে গাঁয়ে। তার বাবা-মা পালিয়েছিল আগেই। এটাও ঢোকাতে আপত্তি নেই সঞ্চালকের। কিন্তু ফোকাস ঘেঁটে যাবে কিনা, আর বিজ্ঞাপন বিরতি কতটা সময় ছাড়ে, তা ভাবার।

 

১১.

 

ভোর ভোর খবর কাগজ হাতে এসেছিল হাবুল। সাতের পাতায় বাউনবউ আর অভিমন্যু মুখ ঢাকার চেষ্টা করছিল। চক্রব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ বড় সহজ কাজ নয়। সে যদি বা পারা যায়, বেরোনার হ্যাপা আরও বেশি। ব্যূহ ভেদ করে বেরোতে পারেনি যে শিশু, তার মায়ের বুক উপচানো দুধ মনে পড়ে৷ দুধের কসম, অপত্যকে রক্ষার জেদ শান্তিকে পেয়ে বসে।

চাপা গলায় হাবুল বলেছিল, ‘পলাই যাও। সনাতন ভ্যান রিসকা লেই আসুচি। গাঁওর ভিতর দেইকি ইস্টেশন ছাড়ি আসিব।’  

অভিমন্যু বুঝি বা জেলে এখন। চক্রব্যূহ ভেদ করে বেরোনোর কৌশল তাকে শেখানো বাকি। দ্রোণ, কৃপ, অশ্বথামারা ঘিরে ধরেছে… শান্তি রওনা দেয়।

শান্তির সঙ্গে নেবার কিছু ছিল না, নুলো অর্জুন আর কুলুঙ্গির কিটখানি ছাড়া।

**********

 

ঋণ: আল জাজিরা, দ্য ওয়্যার, এই সময়, পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment