সোহম দাস

কালিম্পং পর্ব

 

“আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ,
জানে তা কি এ কালিম্পঙ।”

১.

বাস্তবে ব্রজেন, সিনেমায় ব্রাউন 

 

পাহাড়ি সবুজের পরতে পরতে তখন শেষ শরতের ঔজ্জ্বল্য। শিলিগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম সকাল ন’টায়। কালিম্পং পৌঁছেছি তখন বেলা এগারোটা অতিক্রান্ত। বাংলার পাহাড়ের এমনিতেই একটা আপন করে নেওয়ার আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। তার উপর এই অঞ্চলে এই প্রথম। চারিদিকে একটা অভ্যর্থনার ভাব। তার উপর গত কয়েকদিনের ঝড়বৃষ্টি-ধসের পালা কাটিয়ে উঠে রোদ ঝলমলে কালিম্পং যেন নতুন রূপে আবির্ভূতা। 

পরিবারস্থ অন্যান্য সকলের মধ্যে আছে আমার তেরো-বছর বয়সী অনুজ ভ্রাতা। আমার সহকারী, আমার ছায়া। মনটা কাঁচা। তাই আদেশ-উপদেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, এমন একটা প্রভাবশালী ভাবনা থেকেই তাকে বলেছি এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য। 

ছায়াঘেরা-শান্ত-নিবিড়ঃ গ্রাহাম’স হোমসের ভেতরকার পরিবেশ

স্কটিশ মিশনারিদের হাতে গড়া শৈলাবাস এখন ব্যস্ত জনপদ। আর এখন তো আলাদা জেলা। যখন গেছি, তখনও অবশ্য তা হয়নি। দার্জিলিঙের মতো এখানেও ঘিঞ্জিভাবটা পুরোমাত্রায় জাঁকিয়ে বসেছে। উচ্চতা দার্জিলিঙের চেয়ে অনেকটাই কম। সাড়ে বারোশো মিটারের মতো উঁচু। তার উপর গত কয়েক বছরে অজস্র গাছ আর যত্রতত্র পাহাড় কেটে হোটেল বানানোর চক্করে আজকাল এখানেও গরমটা মাত্রাছাড়া। একসময় পাখার দরকারই পড়ত না, আর এখন নাকি গরমের সময় পাখা ছাড়া থাকাই যায় না। গাড়ি চালাতে চালাতে এসব কথাই বলছিল সুদীপ। সুদীপ তামাং। পেদংয়ের ছেলে। আপাতত আমাদের সাইট সিইংয়ের দায়িত্বে। জানেও অনেক কিছু। সুদীপের এসব কথা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, তিনি যখন আসতেন সেই আশি বছর আগে তার পর থেকে এতবছরে পরিবর্তনের এমন ভয়ঙ্কর দ্রুতগামীতা, মেনে নিতে পারতেন কী? 

সুদীপকেও ততক্ষণে বলেছি আমার ‘মোস্ট ডিজায়ার্ড’ গন্তব্যটির কথা। সেখানে যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়, ততই ভালো। কাজের জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে। যদিও জানি না, আদৌ কোনও কাজ অন্তত এই কালিম্পঙে হবে কিনা। কারণ কলকাতায় ইন্টারনেটের সৌজন্যে যতটা পড়াশোনা করে এসেছি, তাতে ভরসা করার মতো কিছু পাইনি। তবু অকুস্থলে গেলে কিছু তো পাওয়া যাবে, অন্তত কিছু অরিজিনাল ছবি তো তুলে আনতে পারব। 

এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে একটা স্কুলের গেট। ভেতরটা অবশ্য স্কুল বলে মনে হবে না। চারিদিকে সবুজের ছায়াখেলা। বাগান। পাখি ডাকছে। অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। এটা সাইট সিইং পয়েন্টের তালিকাভুক্ত নয়। অতএব, এখানে থামতে বলাটা নিয়মমতো নিয়মবিরুদ্ধ। তবু সুদীপ আমার অনুরোধে গাড়ি থামাল। 

গ্রাহাম’স হোমসের মূল প্রশাসনিক ভবন

আমি দাঁড়িয়ে আছি ডক্টর গ্রাহাম’স হোমসের সামনে। রেভারেন্ড জন অ্যান্ডারসন গ্রাহামের তৈরি স্কুল। চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের এক মিশনারি। ১৮৮৯ সালের ৬ই এপ্রিল এখানে পা রেখেছিলেন তিনি আর তাঁর স্ত্রী ক্যাথারিন। দার্জিলিং থেকে টাট্টুঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছিলেন গ্রাহাম দম্পতি। সেই যে পা রাখলেন হিমালয়ের এই ছোট্ট প্রান্তটিতে, আর কখনও দেশে ফিরলেন না। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে অন্ধ সংস্কার থেকে ‘বাঁচানো’। প্রচ্ছন্ন ঔপনিবেশিক মনোভাব, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই স্কুলপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি সত্যিই তাঁর মহত্ত্বের পরিচয় রাখে। মূলত, স্থানীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের জন্যেই স্কুলটা তৈরি করেছিলেন জন। যদিও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শব্দটা শুনতে যতটা রাশভারী মনে হচ্ছে, আদপেই তা নয়। বরং এইসব বাচ্চাদের জন্মের ইতিবৃত্তটাই বড় করুণ। স্থানীয় লেপচা, নেপালি, ভুটিয়া অবিবাহিতা মহিলারা শিকার হতেন ব্রিটিশ প্রভুদের লালসাতৃপ্তির। সেই অন্ধকারের ফল হিসাবে পৃথিবীর মুখ দেখত হতভাগ্য এই শিশুরা। বলা বাহুল্য, তাদের জন্মের পর তাদের কোনোরকম দায়িত্বই পালন করতে চাইত না সাহেবরা। ‘অবৈধ’ তকমার অন্ধকার থেকে তাদের মুক্তির আলোয় আনার জন্যেই জনের এই মহৎ উদ্যোগ।

ভেতরটা আগেই বলেছি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আলোকিত। এখানে গাছ লাগাতে হয় না, আপনা থেকেই তারা ঘিরে রাখে ঈশ্বরপৃথিবীকে। সেদিন রবিবার। তাই স্কুল ছুটি। সামনের একটা পুকুরের ধারে কিছু ছাত্র মাছ ধরার আয়োজন করছিল। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, এখানে আলাদা আলাদা ভবন রয়েছে। প্রকৃতির সাথে একাত্মতা। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা। মূল প্রশাসনিক ভবনটি বন্ধ, তাই কিছু তথ্য সংগ্রহের ইচ্ছে থাকলেও সেটিকে সংবরণ করে নিতে হল। বেরোবার সময় স্থাপনকালটা দেখলাম। ১৯০০। ২৪শে সেপ্টেম্বর। কির্নেন্ডার কটেজ ভাড়া নিয়ে মাত্র ছ’জন ছাত্র (যাদের মধ্যে দুজন ছিল ওই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের) নিয়ে সেন্ট অ্যানড্রুজ কলোনিয়াল হোম নামে শুরু হয়েছিল পথচলা। সালটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার মনে হল, ঠিক এর পরের বছরই শান্তিনিকেতনের আশ্রমচত্বরে কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটা কো-এডুকেশনাল স্কুল খুলবেন রবীন্দ্রনাথ। একই সময়ে যাত্রা শুরু করা দুটি শিক্ষাঙ্গন, ভাবনাতেও কত মিল। অথচ দুই শিক্ষাবিদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ শেষ জীবনে এসে।

গৌরীপুর ভবন-সম্মুখ দৃশ্য

জন গ্রাহামের কথা বরং পরে কোথাও বিশদে আলোচনা করা যাবে। আপাতত, আমাদের গন্তব্য দুরপিন দারা রোড। মঙ্গলধাম পেরিয়ে অবশেষে রাস্তার এক প্রান্তে একটা উতরাই দেখা গেল। কদিন আগে যে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, সেটা এবার বোঝা গেল ঢালের মুখে দাঁড়িয়ে। কাদায় ছপ ছপ করছে এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। গাড়ি থেকে নামলাম। একটা সরু পায়েচলা পথ নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। সাবধানে নামছি ঢাল বেয়ে। এবার দেখতে পাচ্ছি প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ। অভিমান আর অহংকার একসাথে প্রতিফলিত হচ্ছে সেখান থেকে। গৌরীপুর লজ। অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে। সাদা দেওয়ালে অনবরত শ্যাওলা জমে তা আর সাদার পর্যায়ে নেই। রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে জেনেছি, একসময় নীচের দিকে ধাপ কেটে ৬৪টি সিড়ি ছিল। সেসবই বা কোথায়? 

বাড়ির চত্বরেই চলছে কনস্ট্রাকশনের কাজ। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হবে সামনেই। কনস্ট্রাকশনের কাজের কারণেই চারিদিকে আরও বেশি জলকাদা হয়ে জায়গাটা হাঁটার অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। আসলে ইতিহাসের সমাধি-খনন। কতবছর আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে জানে!

সঞ্জিতার ধারণা, কবি এই ঘরেই ‘জন্মদিনে’ কবিতা পাঠ করেছিলেন

বাড়ির এখনকার বাসিন্দা এক মাঝবয়েসী মহিলা আর তাঁর তিনটি ফুটফুটে মেয়ে। ভাড়াটে। এছাড়া রয়েছে কতকগুলো মোরগ-মুরগি। একতলার যে অংশটা এখন মাটিতে মিশে গিয়েছে, ঠিক তারই ওপরের অংশে একটা ঘর নিয়ে থাকেন তিনি। নাম, সঞ্জিতা শর্মা। তাঁর মুখে জানলাম, এখানে তাঁরা রয়েছেন চার পুরুষ ধরে। তাঁর মাতামহ এই বাড়ির চৌকিদার ছিলেন। তাঁর মা তখন খুব ছোট, সেসময় রবীন্দ্রনাথ এখানে আসছেন। মায়ের নাম ছিল কৃষ্ণা। ছোট্ট কৃষ্ণা নাকি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধকে রীতিমত ভয় পেতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি এসে হাঁক দিতেন-‘বিটি, মিঠাই লে আ’। পরবর্তীকালে সঞ্জিতার বাবা পদমলালও চৌকিদারি সামলেছেন। পদমলাল, কৃষ্ণা কেউই আর বেঁচে নেই এখন। বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে সঞ্জিতার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা। সন্দীপ রায়ের ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। সঞ্জিতা তখন সন্দীপকে অনুরোধ করেছিলেন, যদি বাড়িটার কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ফল হয়নি। তাই বাড়ির সাথে সাথে সঞ্জিতাও কেবল দিনই গোনেন। এই বুঝি বিপজ্জনক নোটিশ পড়ল বাড়িতে।

এই বারান্দায় বিশ্রাম নিতে বসতেন রবীন্দ্রনাথ

বাড়ির দুরবস্থা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হয়েছে বিস্তরসরকার বা প্রশাসন কারোরই হেলদোল নেই। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি ‘ভূতের বাড়ি’ বলেই বেশি পরিচিত। গৌরীপুর লজ বললে কেউই বুঝবেন না। বেশ কসরত করে নেমে একতলার দিকটায় যেতে হয়। সব ঘরে তালা ঝুলছে। একটা ফলক। ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে “জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন’। কে করিয়েছিলেন, সেসব কিছু লেখা নেই। তবে যিনিই করিয়ে থাকুন, ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে যে প্রথম লাইভ টেলিকাস্টের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল এই বাড়ি, অন্তত সেই স্বীকৃতিটুকুর লিখিত খোদাইটি করিয়েছেন বলে তাঁকে ধন্যবাদ।  

ঘরের বেশিরভাগ জানলাতেই কাচ নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলোও দেখলাম ভাঙা। অনায়াসে ভেতরটা দেখা যাচ্ছেদেওয়াল মেঝের কিছু অংশে খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা। প্রতিটা ঘরেই ফায়ারপ্লেস। সেটা দেখতে দেখতে আবারও আমার সুদীপের কথাটা মনে পড়ছিল। এখন কালিম্পঙে শীতেও আর তেমন ঠাণ্ডা পড়ে না আর তখন শরতের আভাস আসতে না আসতেই ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া ঢুকে পড়ত এই বাড়ির জানলা দিয়ে, একথা কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর লেখাতেই পড়েছি। আট দশকের তুলনাতেও এই পরিবর্তনটা একটু বেশিই ড্রাস্টিক মনে হল। অবশ্য, এই অতি-বদলের বেশিরভাগটা হয়েছে গত দু’দশকেই বলতে গেলে। নয়ত সুদীপ ওকথা বলত না। 

গৌরীপুর লজ এই নামটা কেন, সেটা নিয়ে আমার বেশ খটকা ছিল। কারণটা বলছি। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এরকম বিশুদ্ধ বাংলা নাম চট করে এই অঞ্চলের কোনও জায়গার হতে পারে না। এটা সকলেই লক্ষ্য করে থাকবেন, এখানকার নামগুলোয় ‘ঙ’ বা ‘ং’-এর চোখে পড়ার উপস্থিতি। যেমন-দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মংপু, রংপো, রিয়াং, পেদং। এগুলো বেশিরভাগই স্থানীয় তিব্বতি বা লেপচা নাম থেকে উদ্ভূত। নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি সুখিয়াপোখরি, জোড়পোখরি, মানেভঞ্জং এই নামগুলো আবার নেপালি। সেক্ষেত্রে গৌরীপুর বলে কোনও জায়গা কালিম্পঙে থাকবে, এটা রীতিমত বেমানান লাগে।যয

এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা পাওয়া যাবে মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে। চিঠির তারিখ ৪.৪.১৯৩৮। অর্থাৎ, অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর লাইভ ব্রডকাস্টের এক মাস আগেই লেখা এ চিঠি। প্রতিমা দেবী তখন অসুস্থ হয়েছিলেন। ডাক্তার তাঁকে পাহাড়ি খোলা হাওয়ায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আসতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের মৈত্রেয়ীকে লিখছেন-

“কল্যাণীয়েসু (য়াসু) 

বীরেন্দ্রকিশোরের কাছ থেকে তাদের কালিম্পঙের বাড়ি চাবা মাত্র তারা উৎসাহপূর্ব্বক দিয়েছে এমন কি অন্য একজন মাতব্বর লোককে দিয়েছে সরিয়ে। বউমাকে ডাক্তার দীর্ঘকাল পাহাড়ের হাওয়ায় রাখতে চায়, তাঁর সঙ্গে পরিচারিকা ও অনুচরবর্গ থাকে, এই উপলক্ষ্যে আমার ভগ্ন শরীরের ভার তার উপর দিতে চাই-আমার এখন দরকার মাতৃশুশ্রূষার। যাই হোক তুমি যখন নিকটেই আছ, তখন ক্ষণে ক্ষণে আমাকে বলপূর্ব্বক হরণ করে নিয়ে যেতে পার্ব্বে-কিন্তু দলেবলে তোমার গৃহস্থালির মাঝখানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যবায় আছে। আমাদের সংখ্যা বহুল, সময় সুদীর্ঘ এবং অবস্থা শোচনীয়। ইতি ৪।৪।৩৮ 

স্নেহাসক্ত 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”

এই চিঠি থেকেই পরিষ্কার, কালিম্পঙের বাড়ি ঠাকুর পরিবারের ছিল না। বীরেন্দ্রকিশোর বলে যার কথা উল্লেখ করেছেন কবি, তিনি হলেন প্রবাদপ্রতিম সেতারবাদক পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠা তাঁরই হাত ধরে। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ওপর লেখা ‘ইন্ডিয়ান মিউজিক অ্যান্ড মিয়াঁ তানসেন’ তাঁর একটি সমৃদ্ধশালী কাজ। তানসেনের কন্যা সরস্বতী দেবীর শেষ বংশধর মহম্মদ ওয়াজির খাঁয়ের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। বিলায়েত খাঁয়ের পিতামহ ইমদাদ খাঁ, উস্তাদ আলাউদ্দিনের মতো মানুষরা ছিলেন তাঁর গুরু। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, শ্যামাসঙ্গীতের  পান্নালাল ঘোষ তাঁর ছাত্র ছিলেন। বীরেন্দ্রকিশোরের বাবা ব্রজেন্দ্রকিশোরও ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড় পৃষ্ঠপোষক। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের (এই সংস্থাই বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে, পরবর্তীকালে যেদুটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান একত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দিয়েছে) পত্তন যখন হয়, সেই কাজেও অর্থসাহায্য করেছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। এই ব্রজেন্দ্র এবং বীরেন্দ্ররা ছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার। সেখানে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়িটির নাম ছিল গৌরীপুর হাউস। সেই অনুকরণেই কালিম্পঙের বাড়িটিরও এই নাম। এখানে ব্রজেন্দ্রের পরিবার গ্রীষ্মাবকাশ-যাপনে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরির নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সেখানে গিয়েছিলেন, তখন রায়চৌধুরি পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয়তা হয়। তবে কালিম্পঙে রায়চৌধুরিদের বাড়িটি কবে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ব্রজেন থেকে ব্রাউন-বাস্তব থেকে সিনেমায় বাড়ির মালিকানা বদলের এমন চিত্রনাট্যটি কিন্তু বেশ মজার।

পাহাড় এমনিও রবীন্দ্রনাথকে কোনোদিনই খুব বেশি টানেনি। আজন্ম রোমান্টিক, প্রকৃতিপ্রেমিক কবি অপার্থিব সৌন্দর্যের পাহাড়ি ঠিকানা পছন্দ করতেন না, একথা ভাবতে একটু কষ্টই হবে। কিন্তু এটাই সত্য। স্থাণুবৎ পাহাড়ের দুর্গমতার দরুণ চারিদিকে প্রাণের অভাব তাঁকে টানত না। সেই তুলনায় নদীর গতিময়তা তাঁকে চিরচঞ্চল করে রেখেছিল আজীবন। প্রতিমা দেবী লিখেছেন-‘বাবামশায় পাহাড় পছন্দ করতেন না, নদীর ধারই ছিল তাঁর প্রিয়, বলতেন, নদীর একটি বিস্তীর্ণ গতিশীলতা আছে, পাহাড়ের আবদ্ধ সীমার মধ্যে মনকে সংকীর্ণ করে রাখে, তাই পাহাড়ে বেশিদিন ভালো লাগে না।’ কন্যাসমা মৈত্রেয়ীকেও স্বয়ং কবি লিখেছেন-‘তারপরে যে শিব কেদারনাথ, যিনি মাঠের শিব আমি তাঁরই চেলা, ভালোবাসি সমতল দেশকে, মাথা উঁচু পাহাড়ের নজরবন্দী আমার বেশি দিন সয় না, তা ছাড়া সারাদিন শীতবস্ত্রের আবেষ্টনকে আমি দৌরাত্ম্য বলেই মনে করি।’ আরেকটি চিঠিতে লিখছেন-‘বাংলাদেশের মতোই আমার মনটা নদী-মাতৃক।’ নিজেকে বর্ণনার এমন সহজ অথচ প্রাঞ্জল ভঙ্গিটি বোধহয় তাঁর পক্ষেই সম্ভব।

মৈত্রেয়ী দেবী নিজেও একথা লিখেছেন-‘উনি কোনো এক পাহাড়ে দ্বিতীয়বার যেতে চাইতেন না।’ অথচ, বাবার সাথে সেই যে শিশুকালে ডালহাউসি বেড়াতে গিয়েছিলেন, তার পর থেকে দীর্ঘজীবনে বহুবার হিমালয়ের বিভিন্ন শৈলশহরে তাঁর লম্বা ছুটি কেটেছে। ১৯০৩ সালে যক্ষ্মা-আক্রান্ত মেজমেয়ে রেণুকাকে নিয়ে কুমায়ুনের আলমোড়ায় কাটিয়েছেন জীবনের একটি অসহায় করুণ অধ্যায়। মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের পাশে বসেও লিখেছেন ‘শিশু’, ‘গীতাঞ্জলি’র কয়েকটি গানের উপর কাজ শুরু করেছেন। মানিব্যাগ হারিয়ে গিয়ে হয়ে পড়েছিলেন সহায়সম্বলহীন। আবার কীসের টানেই যেন আরও তিনবার ফিরে গিয়েছেন আলমোড়ার বাড়িতে। শিলংকে তো তিনি বাঙালির চির-সুকুমার মনে একপ্রকার অমরত্ব দিয়ে গেছেন ‘শেষের কবিতা’র আঙ্গিকে। খোদ দার্জিলিং শহরে তিনি এসেছেন ছ’বার। শেষবার যখন আসেন ১৯৩৩ সালের জুন মাসে, সেসময় মৈত্রেয়ী দেবীও এসেছিলেন বাবা-মা, ভাইবোনেদের সাথে। ডাক্তার নীলরতন সরকারের বাড়ি গ্লেন ইডেনে উঠেছিলেন কবি ও তাঁর পরিবারবর্গ। দাশগুপ্ত পরিবার উঠেছিল স্টুয়ার্ট লজে। 

মৈত্রেয়ীর সাথে কবির আলাপ অনেক আগে থেকেই। তাঁর বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে প্রগাঢ় পণ্ডিত। তরুণ বয়স থেকেই কবির সাথে তাঁর চিঠি আদানপ্রদান হয়েছে। সুরেন্দ্রনাথের সংস্কৃতের দখল ছিল অসাধারণ, সেটা অবশ্য সেইসময়কার প্রায় সব বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরই ছিল। বাবার শিক্ষায় মৈত্রেয়ীরও সংস্কৃত ও বাংলার দখল খুব পরিণত হয়েছিল। সেই বাবার সূত্রেই কিশোরীবয়স থেকেই কবির কাছে যাওয়া-আসা, কবিতা শোনার পরম সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন মৈত্রেয়ী। মহামানবের সান্নিধ্যে জীবনের সেই অমূল্য সময়ের ছবি তিনি নিজেই সুনিপুণভাবে এঁকে দিয়ে গেছেন। তাই সেসব কথার অযথা পুনরাবৃত্তির কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কিছু কিছু ঘটনার কথা অবশ্যই লিখব তবে সেটা কেবলই প্রসঙ্গক্রমে।

যে চিঠিটির কথা এখানে উল্লেখ করেছি, সেটা থেকে আরও একটা জিনিস পাঠক বুঝতে পারবেন, যে মৈত্রেয়ী সেসময় কালিম্পঙের কাছাকাছি কোথাও একটা থাকেন, কবির সেখানে যাওয়ার কথা। অনেকেই হয়ত একথা জানেন, তাও একবার বলে দেওয়া ভালো, যে, মৈত্রেয়ী তখন থাকেন মংপুতে। তাঁর স্বামী ডক্টর মনোমোহন সেন তখন সেখানে গভর্নমেন্ট কুইনাইন ফ্যাক্টরির উচ্চপদস্থ কর্মী। সিঙ্কোনার পাতা থেকে কুইনাইন নিষ্কাশনের দায়িত্বে ছিলেন। মৈত্রেয়ী-মনোমোহনের বিবাহ সম্পন্ন হয় ১৯৩৪-এর ১৯শে জুন। তারপর থেকেই মৈত্রেয়ী মংপুবাসিনী। 

তখনকার মংপু একপ্রকার পাণ্ডব-বর্জিত পাহাড়ি গণ্ডগ্রাম। চারিদিকে ঘন অরণ্যে ঘেরা। রাত বাড়লেই বন্যজন্তুর আনাগোনা বাড়ত। বিশেষ করে ভালুকের উপদ্রব খুবই ছিল। কলকাতার এলিট সমাজের শিল্প-সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠা একজন মেয়ের কাছে ওই অরণ্যপ্রবাস ছিল একরকম নির্বাসনই। তাঁর সেই একাকীত্বের বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে আসতেও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন অদ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ।

গৌরীপুর লজের বিষণ্ণ-চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে চিরনবীন কবি ছুটি কাটাতে এই দুটি জায়গাতেই কেবল আসতেন। পালা করে। পাহাড় তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল না। নিজেকে বলেছেন ‘পৃথিবীর কবি’। দেশ-বিদেশের নানান কোণায় মাটির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে তাঁর পায়ের ছাপ। তাহলে শেষ বয়সে কীসের টানে বারবার ছুটে এসেছিলেন এই গিরিরাজির কোলে? কেবলই মৈত্রেয়ীর ‘নির্বন্ধাতিশয্যে’ নাকি বাংলার পাহাড়ের অপার্থিব গৃহোন্মুখীতার কাছে ধরা দিতে? মনে হয়, তাঁর ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’-র শিশিরবিন্দুটিকে খুঁজতেই বুঝি এই স্বেচ্ছা-প্রত্যাবর্তন।

এমন কন্ট্রাডিকশনও বুঝি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব।

 

২.

সেদিন জন্মদিন

 

জন্মদিনে’ পাঠরত রবীন্দ্রনাথ। ছবিটি তুলেছিলেন কোড্যাক কোম্পানির একজন চিত্রগ্রাহক। সূত্রঃ দার্জিলিংগভ ডট ইন

যে চিঠিটার কথা লিখেছি, সেটার সূত্র ধরেই বলি, এখানে যে কবি মৈত্রেয়ীর বাসভবনে আসতে সংকোচ বোধ করছেন, তার কারণ তো স্পষ্ট করেই চিঠিতে লিখেছেন। আসলে মংপুতে চলে যাওয়ার পর থেকেই কবিকে তাঁর নিজের সাজানো সংসারে আনার জন্য মুখিয়ে থাকতেন মৈত্রেয়ী দেবী। কবিরও ইচ্ছে ছিল প্রবল। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে বয়সের বাধা। তার উপর সারাজীবন ধরে প্রিয়জনকে ভালো রাখতে গিয়ে, বিশ্বভারতীকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের শরীরকে একটু বেশিই অবহেলা করেছিলেন কবি। ফলত, বড় রোগ সেই অর্থে না থাকলেও পুরনো ছোটোখাটো রোগ থেকে মাঝেমাঝেই সংক্রমণ হতো।

উক্ত চিঠির মাসচারেক আগে ১৯৩৭-এর ১লা ডিসেম্বর একটা চিঠি লিখেছিলেন মৈত্রেয়ীকে। শান্তিনিকেতন থেকে সপ্তাহখানেকের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন প্রয়োজনীয় ডাক্তারি চেক-আপের জন্য। সেখান থেকেই লেখা। চিঠিতে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানাচ্ছেন, ‘দু তিন দিন ধরে অতল স্পর্শে নেমেছিলুম-আমাকে ডাঙায় টেনে তুলেছে। এখন পরিচিত সংসারের স্পর্শ আরো নিবিড় করে পেয়েছি। সবচেয়ে পেয়েছি তোমাদের স্নিগ্ধ হৃদয়ের বেদনার দান। …চিকিৎসার উত্তরকাণ্ড চলচে। আর দিন দশেকের মধ্যে ছুটি পাওয়া যাবে আশা করচি। তারপরে চলে যাব শান্তিনিকেতনে।’ 

শান্তিনিকেতন ফিরে ২০শে ডিসেম্বর তিনি আরেকটি চিঠি লেখেন মংপুর ঠিকানায়। শীতের কমলালেবু পাঠিয়েছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। দার্জিলিং পাহাড়ের সুমিষ্ট লেবু উপহার হিসেবে পেয়ে কবির মন প্রফুল্ল। তবে এই চিঠির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটি হল, রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে বলতে গিয়ে এক্স-রে নিয়ে একটি অসাধারণ উপমা ব্যবহার। তাঁর লেখা থেকেই উদ্ধৃতিটি তুলে দিচ্ছি-‘এবার কিছু দীর্ঘকাল কলকাতার কাছে বেলঘরিয়ায় আটকা পড়েছিলুম-নীলরতনবাবু চিকিৎসার জালে আমাকে জড়িয়েছিলেন। এক্স-রে প্রভৃতি অত্যাধুনিক আলোকবাণ রুগ্ন অঙ্গের পরে বর্ষণ চলছিল-বিচক্ষণদের মতে এতে রোগের মূল ধ্বংস হবে। আমি তো জানি প্রাণটাই রোগের মূল মৃত্যুর আহ্বান কর্ত্তা।’

সবেধন নীলমণির মতো পড়ে রয়েছে এই স্মৃতিফলক

এখানে ‘রোগ’টি নিতান্ত সাধারণ কোনও রোগ নয়। এমনিতে কিন্তু সারাজীবন তাঁর বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য ছিল। সেই ছোটবেলায় দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে যে অভ্যাস করিয়েছিলেন ভোরে শয্যাত্যাগ করে দিনের কাজ শুরু করার, সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও সেই নিয়ম পালন করে গেছেন। নিয়মিত ভোর চারটেয় উঠে সারাদিন অক্লান্ত খেটে যেতে পারতেন। রাত্রি ভিন্ন অন্য কোনও সময়ে শয্যা গ্রহণ তাঁর নিয়মবিরুদ্ধ ছিল। নির্মলকুমারী ওরফে রাণী মহলানবিশকে একবার বলেছিলেন-“তোমরা আশ্চর্য হও এত কম ঘুমিয়েও আমার শরীর খারাপ হয় না দেখে। আমার তো মনে হয় বেশি ঘুমোলেই শরীর খারাপ হয়। ছেলেবেলায় যখন পৈতে হয় তখন প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল যে দিনে ঘুমোব না-দিবানিদ্রা বিশেষভাবে নিষিদ্ধ। তখন নতুন ব্রহ্মচারী, খুব উৎসাহের সঙ্গেই সব নিয়ম পালন করতুম। ছেলেবেলার সেই নিয়ম জীবনে বরাবর পালন করেছি, দিনে ঘুমোনো অভ্যাস করিনি। তাই এখন কাউকে দিনে ঘুমোতে দেখলে ভাবি, জীবনে অধিকাংশ সময় এরা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলে, ভোগ করলে কতটুকু?” 

এহেন দেহে-মনে চিরসবল মানুষটি হঠাৎই একটি ভয়ঙ্কর সংক্রমণে আক্রান্ত হলেন। তাঁর কানের পিছনে একটা ড্রাই একজিমা ছিল। সেসবকে নিয়ে আদৌ কোনোদিন ভাবিত ছিলেন না, স্বভাবতই যত্ন-টত্নের ধারও ধারতেন না। আর অন্য কেউ তাঁর সেবাশুশ্রুষা করুক, এসবও তাঁর বরাবরের অপছন্দ ছিল। ওই একজিমাটি হঠাৎ বিষিয়ে উঠে সেই সংক্রমণ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। দিনটা ছিল ১৯৩৭-এর ১০ই সেপ্টেম্বর। উত্তরায়ণ কমপ্লেক্সের ‘কোনার্ক’ বাড়িতে একদিন সন্ধেবেলা কয়েকজনের সাথে গল্প করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। কী ভাগ্যিস সেদিন সকলে কাছাকাছি ছিলেন তাই রক্ষে, কারণ কোনার্কে তিনি একাই থাকা পছন্দ করতেন। 

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবনী’-র চতুর্থ খণ্ড থেকে জানা যাচ্ছে, তখনও শান্তিনিকেতনে টেলিফোন চালু হয়নি। তাই টেলিগ্রাম করা হলেও যেহেতু প্রকৃত অবস্থাটা পুরোপুরি টেলিগ্রামে জানানো সম্ভব নয়, তাই সেই রাত্রেই ধীরেন্দ্রনাথ সেন বোলপুর স্টেশন থেকে একটি মালগাড়িতে চড়ে খানা জংশন অবধি আসেন, সেখান থেকে হেঁটে বর্ধমান আসেন। বর্ধমান থেকে কলকাতায় ফোন করে সমস্ত খবর জানান। খবর পেয়ে ভোরের প্রথম ট্রেন ধরেই ড. নীলরতন সরকার কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন চলে আসেন। গাড়িতে এসে উপস্থিত হন দুই প্রাক্তনী প্রমোদকুমার রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ (যিনি আবার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাইও বটে)। রোগপরীক্ষা করে ড. সরকার বুঝলেন, ইরিসিপ্লাস।

ইরিসিপ্লাস একধরনের ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত সংক্রমণ। স্ট্রেপ্টোকক্কাস পাইয়োজিনস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে এই সংক্রমণটি ঘটে। একজিমা বা অন্য কোনও ঘা শরীরে থাকলে সেই ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যাকটেরিয়াটি মানবশরীরে প্রবেশ করে। দেহে ফ্লুইড জমা হয়ে অনেকসময়ে পা ফুলে এডিমা দেখা দেয়, ফলে ইরিসিপ্লাসকে সেলুলাইটিস ভেবে ভুল করার ঝুঁকি থাকে। প্রতিষেধক হিসাবে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। সেসময় খুব সম্ভবত পেনিসিলিনই চলত। 

কবির ক্ষেত্রে রোগটা খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। টানা দুদিন অচৈতন্য ছিলেন। তবে অসাধারণ যাঁর জীবনীশক্তি, তাঁকে শয্যাগত করে রাখে, এমন সাধ্য কার! একসপ্তাহ বাদেই উঠে বসলেন এবং ‘বিশ্ব-পরিচয়’ ও ‘ছড়ার ছবি’র ভূমিকা লিখলেন ২রা আশ্বিন, ১৩৪৪। ভূমিকা দুটির জন্যে বইদুটির প্রকাশ আটকে ছিল। সেবছর পুজোর আগে দুটো একসাথেই প্রকাশিত হল। কবির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সংবাদপত্রে তখন নিয়মিত খুঁটিনাটি খবর প্রকাশিত হতো। দেশবিদেশ থেকে খবর জানতে চেয়ে চিঠি আসত। গান্ধীজী নিয়মিত টেলিগ্রাফ পাঠাতেন। সেইসময় দ্বিতীয় চীনা-জাপানি যুদ্ধ চলছে। চীনে সর্বত্র আক্রমণকারী জাপানী সেনার অকথ্য, অমানবিক অত্যাচার। সেখান থেকেও কবির শরীরের অবস্থা জানতে চেয়ে চিঠি এসেছিল। চিঠি পাঠিয়েছিলেন শিক্ষাবিদ ড. সাই ইয়ান-পেই এবং প্রজাতান্ত্রিক চীনের এগজামিনেশন অফ ইয়ান দপ্তরের সভাপতি দাই জিতাও। দেশের দুঃসময়েও তাঁরা যে কবির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেছেন, কবি তাঁর চিঠিতে সেই কারণে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তাঁদেরকে প্রেরিত চিঠিতে কবি লেখেন-“My sympathy and the sympathy of our country is wholly with your country.” মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসে লিখেছিলেন ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি। প্রথম আটটি কবিতা ২৫শে সেপ্টেম্বর থেকে ১০ই অক্টোবরের মধ্যে লেখা।

তিনদিন বাদে ১২ই অক্টোবর কবি সম্ভবত নীলরতনবাবুর হুকুমেই খাস কলকাতা থেকে খানিক দূরে বেলঘরিয়ায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়ি ‘গুপ্ত নিবাসে’ এসে উঠলেন। এই বেলঘরিয়ার উল্লেখ মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা ২০শে ডিসেম্বরের চিঠিতে রয়েছে। সেসময় দেশের বড়বড় নেতা-নেত্রীরা তাঁর সাথে বিভিন্ন জরুরী বিষয় আলোচনা করে গেছেন। সুভাষচন্দ্র বোস, জহরলাল নেহরু, সরোজিনী নাইডু, জীবিত কৃপালনি প্রমুখ প্রথম সারির নেতাদের পায়ের ধুলো পড়েছিল গুপ্ত নিবাসে। এইসময়ে আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে, তবে সেগুলো এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। যাইহোক, প্রশান্ত ও রাণীর তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রনাথ তিন সপ্তাহ ছিলেন। ৪ই নভেম্বর শান্তিনিকেতন অভিমুখে যাত্রা করেন। তারপর আবার চিকিৎসার কারণে ২৭শে নভেম্বর কলকাতায় এসে ৪ই ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে ফিরে যান। ওই সপ্তাহখানেকের কলকাতা-বাসকালে মৈত্রেয়ীকে ১লা ডিসেম্বরের চিঠিটি লেখা।

এরকম কঠিন অসুখ এবং বয়সজনিত ঝুঁকির কারণে সারাজীবন ধরে স্বাধীন চলাফেরায় অভ্যস্ত আত্মনির্ভর মানুষটাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষজীবনে পরনির্ভর হতে হয়েছিল। ৪ই এপ্রিল, ১৯৩৮-এ লেখা চিঠিটার মাসখানেক আগেই আরেকটি চিঠিতে তাঁর বয়ান মোটামুটি এইরকম-

“কল্যাণীয়াসু

       মৈত্রেয়ী শারীরিক মানসিক আবহাওয়ার চাঞ্চল্যবশত কর্ম্মসূচি পাকা করে স্থির করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখনকার মতো কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারছিনে-কিন্তু মনে রইল তোমার নিমন্ত্রণ যদি সহজে সম্ভাব্য হয় তো হয়ে যাবে। ইতি ৮।৩।৩৮

স্নেহরত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”

যাইহোক, শঙ্কা কাটিয়ে সেযাত্রা কবি অবশেষে এসে পৌঁছলেন কালিম্পঙে। দার্জিলিং জেলার পূর্বপ্রান্তে এই প্রথমবার পদার্পণ তাঁর। তারিখটা ২৬শে এপ্রিল, ১৯৩৮। সেদিন বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ গাড়ি তাঁকে নিয়ে কালিম্পং পৌঁছয়। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব অনিলকুমার চন্দ, বেদজ্ঞানী অ্যাটর্নি হীরেন দত্ত। কালিম্পং থানার সামনে পাইন আর ওক গাছের পাতা এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল তোরণ। মানুষের একান্ত আপন কবিকে স্বাগত জানানোর জন্য এমন অনাড়ম্বর আন্তরিকতাই বুঝি শ্রেয়। গৌরীপুর ভবনের খোলা হাওয়ার পরিবেশ, চারিদিকের বাগান, নির্জনতা দেখে কবি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে যান। ব্রজেন্দ্রকিশোর বাগানের মালি বিষ্ণুলাল শর্মাকে দৈনন্দিন কাজের ভার দিয়েছিলেন। এই বিষ্ণুলালই সম্ভবত সঞ্জিতার দাদু। 

জীর্ণ বারান্দা

সঞ্জিতার সহায়তায় বাড়ির ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল। দোতলার যে ছোট বারান্দাটায় রবীন্দ্রনাথ বিশ্রামের জন্য এসে বসতেন, একসময় সেখান থেকে দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথুলা। এখন বসতি হয়ে গেছে। দূষণের পর্দা ভেদ করে শুভ্র হিমশিখরের দৃশ্যমানতা আর সম্ভব হয় না। তবে সামনের গাছ দুটি আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকবে, আরও কতদিন। এরকম ইতিহাসের স্মৃতি-বিজাড়িত জায়গায় এসে এই গাছেদের দেখে মনে হয়, যদি ওরা কথা বলতে পারত, কোনোভাবে!

কবির সম্বন্ধে যতটুকু পড়েছি, তাতে জেনেছি, তাঁর দৃষ্টি চলে যেত বহুদূর। সুদূরের পিয়াসী মানুষটি যে সুদূরকেও অতিক্রম করে গেছেন। শুধু সাদা চোখের দৃষ্টিতে নয়, অন্তর্দৃষ্টিতেও। সামনের গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে এসে পড়েছে বারান্দায়। আমার জুতোর চাপে মর্মরধ্বনি উঠছে তাদের। যেন একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কেউ। সঞ্জিতার কথা আর কানে ঢুকছে না তখন। আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই অদেখা সময়ে। সময়টা যে বড় প্রিয় আমার।

যেবছর পা রাখলেন এই বাড়িতে, তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৩৭ থেকে শান্তিনিকেতনে ১লা বৈশাখ তাঁর জন্মোৎসব পালিত হতো। সেবছরেও তাই হয়েছিল। কালিম্পঙে এসে কবি এটা ভেবেও বেশ খুশি ছিলেন যে, ২৫শে বৈশাখ বেশ শান্তভাবে কেটে যাবে। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। ১লা মে গৌরীপুর ভবনে প্রায় তিনশো লোকের সমাগম হয়েছিল সকলের ‘প্রাণের ঠাকুর’কে দেখার জন্যে। সকলেই স্থানীয় মানুষ। সেসময় গরমের ছুটি কাটাতে আসা বাঙালিরাও এসে ভিড় করতেন গৌরীপুর লজে। কবিও শহরের নানা অনুষ্ঠানে যেতেন। নতুন দেখা কালিম্পং তাঁকে সত্যিই মুগ্ধ করতে পেরেছিল।

আমার জানতে ইচ্ছে করে, কীভাবে আসতেন প্রতিবার? শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পঙের সড়ক-যোগাযোগ কীরকম ছিল সেইসময়? পুরো কি গাড়িতে আসতেন নাকি শিলিগুড়ি থেকে তিস্তা ভ্যালি রেলওয়ে এক্সটেনশন যেটি তখন ছিল, সেই ছোট রেলে গেলখোলা অবধি এসে সেখান থেকে গাড়িতে আসতেন? এই বিষয়টি কেন উত্থাপন করলাম, সেকথা বলিযে কয়েকটি বিষয়ে আমার অতিশয় আগ্রহ আছে, তার মধ্যে অন্যতম এই ভারতীয় রেলের ইতিহাস। আর বিশেষত, উত্তরবঙ্গগামী রেলপথের এত বিবর্তন হয়েছে, যে সেটা এমনিও বড় বেশি আকর্ষণীয়।

যে তিস্তা ভ্যালি এক্সটেনশন রেলওয়ের কথা বললাম, সেই লাইনটা ছিল দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়েরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। মোট ৫১ মাইল পথ। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলের (এখন যার নাম মহানন্দা স্যাংচুয়ারি) মধ্যে দিয়ে যাওয়া সেই রেলপথে প্রায়ই দেখা মিলত বন্যজন্তুর। চিতাবাঘ, হাতি, হরিণ, কখনও কখনও নদীতে জল খেতে দেখা যেত স্বয়ং ডোরাকাটাকেও। সন্ধে হলেই স্টেশন কোয়ার্টার থেকে আর বেরোতেন না আবাসিক কর্মীরা। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, যে এটি ছিল সুন্দরী তিস্তার উপত্যকা বরাবর। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, ঝর্ণা সব মিলিয়ে অপরূপ প্যাকেজ। স্টেশনগুলি ছিল শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি রোড জংশন, সেবক ফরেস্ট সাইডিং, সেবক, সাড়ে তেরো মাইলস, কালিঝোরা, রেলি সাইডিং, রিয়াং এবং গেলখোলা (কালিম্পং রোড)। গেলখোলাকে বহু জায়গায় গেলিখোলা বা গিয়েলখোলা বলা হয়েছে। গেলখোলার উল্লেখ মৈত্রেয়ী দেবীর ‘স্বর্গের কাছাকাছি’তে রয়েছে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে যে প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের অপারেশন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের, সেই অপারেশনের খবর জানার জন্য রথীন্দ্রনাথকে ট্রাঙ্ককল করতে গেলখোলায় এসেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী, কারণ মংপুতে তখন টেলিগ্রাফ অফিস বা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কিছুই ছিল না। গেলখোলার রেলওয়ে কোড নেম ছিল GEKA। ‘খোলা’ মানে নদী। সেসময়ে কালিম্পঙে আসতে হলে পর্যটকেরা গেলখোলা অবধি আসতেন, তারপর লাইন পেরিয়ে গরুর গাড়ি অথবা পায়ে হেঁটে কালিম্পঙে পৌঁছতেন। এই রেলপথটির তত্ত্বাবধানে ছিল গিলিন্ডার্স অ্যান্ড আরবুথনট কোম্পানি। গরুর গাড়ির পরিষেবাটিও তাদেরই প্রদত্ত ছিল। ১৯৫০ সালে তিস্তার বিধ্বংসী বন্যায় এই লাইনটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, আর এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনও প্রয়াস দেখায়নি সরকার। ১৯৫১ সালে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয় তিস্তা ভ্যালি এক্সটেনশন রেলওয়ে। অবশ্য প্রথমবার কবি টানা মোটরেই এসেছিলেন শিলিগুড়ি থেকে এই তথ্য রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের লেখা থেকেই জেনেছি।

বিষয়ে ফিরি। রবীন্দ্রনাথ কালিম্পঙে আসার কয়েকদিন বাদে একদিন ঘোড়ায় চড়ে গৌরীপুর লজে এলেন জন গ্রাহাম। তাঁর আবাসিক বিদ্যালয়টি ডেলো পাহাড়ের ঢালে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রয়েছেন দুরপিন পাহাড়ের দিকে। মধ্যে পাঁচ মাইল চড়াই-উতরাই পথ। কিন্তু বৃদ্ধ জন সেসব গ্রাহ্য না করেই দিব্যি চলে এসেছেন। জন রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র চারমাসের ছোট ছিলেন। সেই হিসাবে তিনিও তখন বার্ধক্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছেন। 

হিমালয়ের ছায়ায় থাকা কালিম্পঙে সমসাময়িক উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির গনগনে আঁচ সেভাবে লাগার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তাও সেইসময়ের তপ্ত রাজনীতির নিয়মিত খবর রাখতেন জন। মহাত্মাজীর দর্শনকে বরাবর সম্মান করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সাথেও তাঁর এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো বলে শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথ একদিন তাঁর স্কুল পরিদর্শনে গেলেন। সেন্ট অ্যানড্রুজ কলোনিয়াল হোমসে তখন ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাতশো। স্কুলের পরিবেশ, পঠন-পাঠনের ধরনে নিজের ভাবনাকে খুঁজে পেতে দেখে খুশি হয়েছিলেন কবি। গ্রাহামের আশ্রমে বসেও বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেন। 

কালিম্পঙে এসেই একটি অতি-আবশ্যিক কাজ সেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেটি হল তাঁর পথ চেয়ে বসে থাকা মৈত্রেয়ী দেবীকে টেলিগ্রাম করা। “Have just arrived will be pleased to see you”। মৈত্রেয়ীও বোধহয় অপেক্ষা করেই ছিলেন। পঁচিশে বৈশাখের দিন সকালেই এসে উপস্থিত হলেন স্বামী মনোমোহন ও বোন চিত্রিতাকে সঙ্গে নিয়ে। চিত্রিতা দেবীকে দেখে ডক্টর মনোমোহন সেনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের চটজলদি কৌতুকবাণ-“ডাক্তার, তুমি তো ভাগ্যবান হে! একটি পাওনা, একটি উপরি? আমাদের তো এত সৌভাগ্য ছিল না!”

সেন পরিবার ছাড়াও ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে কবির অতিথি হয়ে এসেছিলেন পরিব্রাজক-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল। তখন তিনি ‘যুগান্তরে’র সম্পাদক। তাই কবির জন্য যুগান্তরের ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা’র বেশ কিছু কপি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন শশাঙ্ক চৌধুরি। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’-এ সেই যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার। তিস্তা ভ্যালি রেলপথের কথা সেই বর্ণনায় ভালোই পাওয়া যাবে। অবশ্য এই লেখা তিনি যেসময়ে লিখছেন, সেটা ১৯৫০-এর পরে, ততদিনে উপত্যকার বুক চিরে যাওয়া সেই রেলওয়ের সলিলসমাধি হয়ে গেছে। প্রকৃতির রোষের কাছে মানবশ্রেষ্ঠ জাতির প্রযুক্তিও হার মেনে গেছে। তখন মোটরগাড়িই একমাত্র ভরসা। সেই অংশটুকুর কিছুটা তুলে দিচ্ছি-“শিলিগুড়ি এসে গাড়ি ঘুরল সেবকপুলের (তিস্তার ওপর যে সেতু সেবক করোনেশন ব্রিজ নামে খ্যাত) দিকে-গেলিখোলার পুরনো রেললাইনের গা বেয়ে। সেই পথ চলে গেছে পাহার-পর্বতের অন্তরপুরে। বিদ্যুতবেগে গাড়ি ছুটলো। …গেলিখোলার পুরনো শীর্ণ রেলপথটি দেখতে পাচ্ছি পাশে পাশে। তিস্তার দুরন্তপনার জন্য এপথে ট্রেন চলাচল আর সম্ভব হলো না। জলের ধাক্কায় লোহার লাইন মুচড়ে যায়, স্লিপারগুলি উৎখাত হয়ে অদৃশ্য হয় এবং গাড়ি ও এঞ্জিন ডুবজলে তলিয়ে থাকে। ফলে আজকাল মোটরবাস ও লরীওয়ালাদের রামরাজত্ব। তিস্তার এই পথটিতে আমার প্রথম অভিযানটির কথা মনে পড়ছে। সেবার শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনে আসছিলুম। সঙ্গে ছিলেন বন্ধুবর শশাঙ্ক চৌধুরী। আগের দিন থেকে বৃষ্টি হবার ফলে পাহাড়ে যেমন ভাঙন ধরেছিল তেমনি দুরন্তপনা বেড়ে উঠেছিল। ফলে কালিঝোরা পর্যন্ত গিয়ে ট্রেন আর যেতে পারল না। কিন্তু দুর্যোগ যতই ঘন হোক আমাদের কোথাও থামলে চলবে না। সেটা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ এবং বাংলা তারিখ ছিল ২৫ বৈশাখ। মহাকবির জন্মদিনে আমরা যাচ্ছিলুম কালিম্পং-এ। রবীন্দ্রনাথ তখন সেখানে। তাঁর পাদপদ্মে দেওয়ার জন্য কিছু নৈবেদ্য ছিল সঙ্গে। তার মধ্যে শ্রীঅমল হোম আমার হাত দিয়ে প্রণামী পাঠিয়ে ছিলেন একঝাড় রজনীগন্ধা এবং একটি কলমফুল যদি বা শুকোয় কবির কলম যেন শুকোয় না কোনোদিন।”

এখানে এই যে বৃষ্টি, পাহাড়ের ভাঙনের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক, এই দুর্যোগের ফলে রাস্তায় কয়েকদিন আগে পোঁতা টেলিফোনের খুঁটিগুলি উপড়ে পড়েছিল। সেদিনই কবির হাতে দূরভাষ কেন্দ্রের উদ্বোধন হল। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে জুড়ল কলকাতা আর কালিম্পং। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ (খুব সম্ভব সি. সি. ওয়ালিক) এলেন। এসেছিলেন বেতার-বিশেষজ্ঞ নৃপেন্দ্র মজুমদারও (অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ভারতীয় অনুষ্ঠানগুলির প্রযোজক ছিলেন। তাঁর সহকারীদের মধ্যে ছিলেন বীরেন রায়, চলচ্চিত্র-সংগীতের কিংবদন্তী রাইচাঁদ বড়াল, ‘অমর এগারো’ মোহনবাগান দলের মিডফিল্ডার রাজেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ)। টেলিফোন পরীক্ষা হল বারবার। প্রবোধ সান্যাল লিখছেন-“মহাকবি একবার মাঝে মাঝে একবার ভীষণ শব্দে গলা ঝাড়া দেন, একথা সকলেরই মনে আছে। কিন্তু আজ কাব্যপাঠকালে সেই আওয়াজটির দাপটে সূক্ষ্ম যন্ত্রটা বিদীর্ণ হয়ে যাবে কিনা, এই আশঙ্কাটা ছিল রথীন্দ্রনাথ প্রমুখ অনেকের মনে। সেজন্য উদ্বেগও ছিল। মাঝখানে নৃপেনবাবু একবার আমাকে বললেন, ঠিক ওই চেয়ারে বসে যন্ত্রে মুখ রেখে কলকাতাকে একবার ডাকুন তো? আপনার গলায় যদি না ফাটে তবে আর ভয় নেই।

“কেঁপে উঠলুম। ওটা যে কবির আসন! কিন্তু নৃপেন্দ্রবাবুর ফরমাশ শুনতেই হোলো। নধর মখমল-বসানো চেয়ারে বসে কয়েকবার ডাকলুম, হ্যালো, ক্যালকাটা…হ্যালো…?

“কলকাতা থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব এলো-‘ও-কে।’ (o.k.)”

ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে পড়ল দুরপিন পাহাড়ের অস্তাচলেসাড়ে সাতটা কী আটটার সময়ে বেল বাজল। কবি গিয়ে বসলেন নির্দিষ্ট আসনে। সকলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে দেওয়া হল অবাঞ্ছিত শব্দের হাত থেকে মুক্তি পেতে। বাইরে রাখা আছে রেডিও সেট। কবির আবৃত্তি কলকাতা ঘুরে ব্রডকাস্ট হবে সেই যন্ত্রে। সকলের মধ্যে জন গ্রাহামও ছিলেন বলে শোনা যায়। বাড়ির চারিদিকে বসানো হয়েছিল টেলিফোনের তার। গৌরীপুর ভবনের ঘরে বসে কবি আবৃত্তি শুরু করলেন-“আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে/ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে/মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।…”

টানা পনেরো মিনিটের পাঠ। একটি দীর্ঘকবিতা। নাম ‘জন্মদিন’। সেই পাঠ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা, সেখান থেকে দিল্লী, বোম্বাই, লখনৌ, পেশোয়ার, লাহোর। একই সময়ে ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত মুখরিত হল বিশ্বকবির উদাত্ত কণ্ঠের মাদকতায়। সেই মায়াবী মুহুর্তের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার। সেটুকুও তুলে দিলুম পাঠকদের জন্য-“আমাদের পায়ের নীচে কালিম্পঙ থর থর করতে লাগলো কিনা সেকথা তখন আর কারো মনে রইলো না। জ্যোৎস্না ছিল সেদিন বাইরে। একটা মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকের মধ্যে আমরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিলুম। ভুলে গিয়েছিলুম পরস্পরের অস্তিত্ব।” প্রথম লাইভ ব্রডকাস্ট। কালিম্পঙের সাথে কলকাতার দূরভাষ যোগাযোগটিও সেদিনই স্থাপিত হল, যোগ্যতম লোকের হাতেই।

‘জন্মদিন’ কবিতায় কয়েকটি লাইন ছিল এরকম-“তারি অঙ্গে এঁকেছিল পত্রলিখা/আম্রমঞ্জরীর রেণু, এঁকেছে পেলব শেফালিকা/সুগন্ধি শিশিরকণায়;”। মৈত্রেয়ী দেবী ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে লিখেছেন, এই ‘এঁকেছে পেলব শেফালিকা’-র পরিবর্তে আগে অন্য একটা লাইন লিখেছিলেন কবি, ‘এঁকেছিল তন্বী শেফালিকা’। দুটির মধ্যে কোনটি রাখা উচিত, এ ব্যাপারে তিনি মৈত্রেয়ীর কাছে পরামর্শ চান। মৈত্রেয়ী তো শুনে খুব আশ্চর্য হয়ে যান। মহিরুহসম তিনি, সারাজীবন ধরে অত কিছু রচনা করেছেন, দেশ-বিদেশে অগণিত সম্মান, তারপরেও নিজের নাতনির বয়সী একটি তরুণীকে কী অবলীলায় জানতে চাইছেন, কোন লাইনটা বেশি ভালো। তিনি যে আমাদেরই লোক। 

মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে কবির কীরকম খুনসুটির সম্পর্ক ছিল, সেটা ওইদিনকার দু-একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। এসবই মৈত্রেয়ী দেবী ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’-এ লিখে গিয়েছেন, তবু সেগুলো এখানে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলুম না। মনোমোহন সেনকে তো যেতে না যেতেই শ্যালিকাসঙ্গ নিয়ে কৌতুক করলেন। সেদিন দুপুরে চিত্রিতা দেবী ‘সঞ্চয়িতা’ বইটি নিয়ে তাঁর কাছে বসে কবিতাপাঠের ব্যবস্থা করছেন, সেখানে উপস্থিত হলেন মৈত্রেয়ী। কবি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে রাগাবার জন্যে বলে উঠলেন-‘এ কি, তুমি টের পেলে কি করে? আমরা এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে কাব্যালোচনা করে নিচ্ছিলুম,-‘আব্রিত্তি’ যাকে বলে,-যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো এসো মোর হৃদয়নীরে।’ প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ‘আবৃত্তি’ শব্দটির ‘আব্রিত্তি’ উচ্চারণ কবি একদমই বরদাস্ত করতেন না। কারণ হিসেবে, সঠিক সংস্কৃত ব্যাকরণ শিক্ষার অভাবকেই দায়ী করেছিলেন।

জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তাড়া তাড়া চিঠিপত্র এল সেদিন। কবি মনোযোগ দিয়ে সকলের চিঠি পড়তেন। উত্তরও দিতেন। তাঁর কাছে আপন-পর, দেশী-বিদেশী প্রভেদ ছিল না। মৈত্রেয়ীকে বললেন-‘তুমি একটা কবিতা লিখলে না যে? কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তোমার ভক্তি অসম্ভব দ্রুত কমে যাচ্ছে। ওইতো কাগজ কলম রয়েছে, চট করে, ‘হে রবীন্দ্র কবীন্দ্র’ বলে একটা লিখে ফেলনা।’ আহা, এসব পড়েও বুঝি আরাম!

চিত্রিতা দেবীর চশমার খাপ নিজের মনে করে জোব্বার পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। এদিকে খোঁজার সময় পাওয়া যায় না। তাঁর ‘পুরাতন ভৃত্য’ বনমালী বলেছিল-‘বাবামশায়ের পকেটটা দেখেছেন?’ শুনে তিনি উত্তর দেন-‘যদি নিতেই হয় তেমন তেমন জিনিস নেব, চশমার খাপ নেব?’ পরদিন যথারীতি চশমার খাপ-সমেত চিঠি এসে পৌঁছল মংপুর ঠিকানায়। মৈত্রেয়ী দেবী মজা করে লিখেছেন-‘সেখান (জোব্বার বিশাল পকেটের গহ্বর) থেকে চশমার পুনরুদ্ধার বনমালীর অমর কীর্তি। সেই থেকে কোনো কিছু হারালে প্রথমেই মনে পড়ত,-‘বাবামশায়ের পকেটটা দেখেছেন?’’ 

সেই বিশেষ দিনটায় ফিরতে ইচ্ছা করছিল বারবার। মানসচক্ষে ভেসে উঠছিল ছবিটা-অট্টালিকা-চত্বর লোকে লোকারণ্য। পাশে রাখা রেডিও সেট। বিশ্বকবির কণ্ঠ বেজে উঠবে তাতে। একখানা যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী থাকা। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, আবেগ, ইতিহাস সব একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সৌজন্যে ওই একটি মানুষ। এসব ভাবছিলাম আর দেখছিলাম বাড়ির একপাশের ঝুলবারান্দাটাকে। বাড়ির এ অংশটা একটু বেশিই জীর্ণ মনে হল। আসলে ওই মেলাতে না পারা আর মেলাতে যাবার চেষ্টা করার অসহায়ত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যা ভাবছি, তা যেন সবই গল্পকথা। আসলে কি রবীন্দ্রনাথ বলে কখনও কেউ ছিলেন?

 

(ক্রমশ)

Facebook Comments

Related posts

2 Thoughts to “কালিম্পং পর্ব”

  1. অনির্বাণ ভট্টাচার্য

    কমেন্ট নিষ্প্রয়োজন। লেখক ক্রমশ আকাশ ছুঁচ্ছেন …

  2. Atri Bhattacharya

    ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় ! বরাবরই দেখে আসছি, গবেষণায় যাদের প্রথাগত শিক্ষা রয়েছে, যে কোন ইতিহাস তথ্যপ্রমাণসহ যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার ! সোহমবাবুর সাহিত্যিক ইনটুইশনের সঙ্গে পারঙ্গম মেধা ও সুপটু সুপেলব লেখনীর ত্রহ্যস্পর্শ যোগ হয়ে লেখাটি বড় সুপাঠ্য হয়েছে। কালিম্পং এই বাংলার অন্যতম প্রমোদতীর্থ। ঘটনাচক্রে, “সাহিত্য শার্লক” কৌশিক মজুমদার-ও এখানে বছরকয় কাটিয়েছেন। কাজের সূত্রে, আমাকে এবং আমার পিতৃদেবকেও উত্তরবঙ্গে কিছুকাল থাকতে হয়েছে। নেহাৎ অভিজ্ঞতার সূত্রে জ্ঞাত একটি তথ্য দিই। অন্তে অনুস্বারবিহীন নাম দার্জিলিং জেলা এবং সংলগ্নে বিরল হলেও অলভ্য নয়। রোহিনী, কৃষ্ণনগর, পানিঘাটা – ইত্যাকার নামের জায়গা দার্জিলিং জেলার আশেপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে। ডঃ গ্রাহাম’স হোমস কালিম্পং জেলার কালিম্পং এক নং ব্লকের অন্তর্গত একটি গ্রাম পঞ্চায়েত, যার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত এই ১৫০০ ছাত্র, ৭৬ জন শিক্ষক ও ৩০০ কর্মচারীসহ একশো ঊনিশ বছর বয়সী এই স্কুলের সঙ্গে তুলনা চলে পার্শ্ববর্তী জেলা কার্শিয়াং-এ স্থিত ও আরো ২১ বছরের পুরনো ডাউহিল স্কুলের, যার প্রথম হেডমাস্টার-ও ছিলেন গ্রেট ব্রিটেন নিবাসী। যাই হোক, আশা নিয়ে বসে থাকলাম পরবর্তী পর্বগুলির জন্য।

Leave a Comment