সঙ্ঘমিত্রা হালদার

আমার সমর্পণ

রবীন্দ্রনাথের সমর্পণ, সমর্পণের রবীন্দ্রনাথ 

‘আমার হৃদয়বৃত্তিগুলো যদি আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত আর যাই হোক কোনও রূপসৃষ্টি সম্ভব হত না’ — কিছুদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা কথোপকথনে পড়লাম এই কথাটা। সেই থেকে আগ্রহের পায়চারি আর সন্ত্রাস যুগপৎ খেলে যাচ্ছে আমার ভিতরে। আগ্রহ – কেননা কথাটি মাত্র এক লাইনের হলেও তার গায়ে লেগে আছে একজীবনের পরিশীলনের ছায়া। তার মন। সেই মনের আলো-হাওয়া-চরিত্র। আসলে কথাটা সব শিল্পীর, সারাজীবনের। ভাবি, হৃদয়বৃত্তি যদি প্রবল না হত তবে কী করে লিখলেন সেইসব গান যা পূজার ঘরে কাটাকুটি খেলতে খেলতে আসলে প্রেমের ভুবনে ফাঁদ পাতে? জানি, শিল্পী মাত্রেই ব্যালান্সড। সব সত্য আপেক্ষিক। সব সত্য মুহূর্তের। তবু, প্রায় একটা ছড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হতে থাকে। কেননা আমার গানের রবীন্দ্রনাথ, আমার প্রবল হৃদয়বৃত্তির রবীন্দ্রনাথ কেবলই ভেঙে চুরে যাচ্ছে। হাজারটা প্রশ্ন আর প্রতিপ্রশ্ন পোকার হুল বসিয়ে দিচ্ছে, যার নিরসন নেই। 

হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ে যায় সেই গানটার কথা। যা আমার মধ্যে বহুবছর ধরে অস্বস্তির কাঁটা বিঁধিয়ে রেখেছে। ‘আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি/ তুমি অবসরমতো বাসিও… তুমি চিরদিন মধুপবনে/ চির- বিকশিত বনভবনে/ যেয়ো মনমতো পথ ধরিয়া/ তুমি নিজ সুখস্রোতে ভাসিয়ো…’ আমি জানি সমর্পণের চেয়ে শান্তি কোথাও নেই। সুন্দর কোথাও এত রূপবান নয় আর। কিন্তু সমর্পণের এই ভাষা আমি চিনি না। বুঝি না। বা বলা ভালো বুঝলেও আমার আয়ত্তে নেই সেই সমর্পণ। আর যা নিজের আয়ত্তে নেই, তার প্রতি চির-দুর্বলতা– চির-অস্বস্তি তাই যাবার নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের আর সব গান যখন আমাকে পূর্ণ অথবা রিক্ত করে কিংবা ব্যাকুলতা নামক চির-বাঁশিটিকে জাগিয়ে রাখে, এই গানটা আমাকে চির-অস্বস্তির কাঁটা বিঁধিয়ে দেয়। ভাষাটা আমার মাতৃভাষা, স্প্যানিশ কিংবা মান্দারিন নয়, তবু তার মর্মোদ্ধার বছরের পর বছর করতে পারিনা। এই অভাববোধ জিভ কষাটে করে তোলে। নিজের মধ্যে কিছু একটা ‘কম’ টের পাই। টের পাই, এই কিছু একটা ‘কম’-এর, একটা অভাববোধের অনুভূতি আমাকে গানটা থেকে কিছুতেই দূরে যেতে দেয় না। 

অস্বস্তি ফিরে ফিরে আসে। এবার অবশ্য আরও এক নতুন কাঁটা এসে বেঁধে। না, গানটাকে কেন্দ্র করে নয়। ডি.এল. রায়, অতুলপ্রসাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উপরের কথাটাকে কেন্দ্র করে। যে কথাটা আমাকে সমর্পণহীন এক রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শেখায়। অন্যদিকে তাঁর গানে চির-সমর্পণের রবীন্দ্রনাথ। দ্বন্দ্ব দু’খানা-আধখানা করে দেয়। বুঝি, যে রবীন্দ্রনাথকে গান থেকে গানে সমর্পণের রবীন্দ্রনাথ হিশেবে জেনে এসেছি এতকাল; ব্যক্তিজীবনে হয়ত তাঁরও কিছু পিছুটান ছিল। হয়তো শিল্পের কাছেই। হয়তো জীবনের কাছে। তাই হৃদয়বৃত্তির রাশ যেন বা লাগামের রশিটা থেকে কিছুতেই আলগা হতে দেননি। যেন বা সামলে চলেছেন নিজেকেই। নিজেকে রক্ষা করেছেন নিজেরই দুহাতে প্রাণপণ। আর এই আগলে-রাখাগুলো দিয়ে প্রাণপণে শিল্পে-গানে বারুদ ঠুকেছেন। যেন দীপক রাগ গেয়ে আত্মদগ্ধ হওয়ার আগে তুখোড় মুন্সিয়ানায় মেঘ-মল্লার গেয়ে ওঠা, নিজেকে বাঁচাতে। আসলে প্রেম আর পূজার ঘরে যেমন স্পষ্ট কোনও বিভাজন চলে না, জীবন আর শিল্পেও কি তত বিভাজন চলে! যার চলে তার চলে, আর যার চলে না তার দুই নদীর পাড় কেবল নিজের মধ্যে ভেঙে পড়ে। ভাঙে আর মিশে যায়। বুঝি, মেঘ-মল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামানোর আগে আত্মদহনও তো সত্যি! তেমনি, কিছু কাঁটা থাকবেই, নাহলে শুশ্রূষার প্রয়োজনই তো ফুরবে! কাঁটার ক্ষতটুকু না থাকলে শুশ্রূষা আমাকে যেমন নেবে না, আমারও তো পাওয়া হবে না তাকে। সব চেনা, সবটুকু বোঝার মতো নিঃসঙ্গতা আর কীই বা আছে!

ভাবি, একজন লেখকের লেখা ছাড়া কি সত্যিই আর কোনও বড় সমর্পণের আধার থাকতে পারে? নাহলে অন্তত গানে যে প্রবল হৃদয়বৃত্তির রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই তিনি এমন স্বীকারক্তি দিলেন কীভাবে! ডি.এল. রায়-অতুলপ্রসাদের সঙ্গে কথোপকথনে রবীন্দ্রনাথের কথাটার যেন আস্তে আস্তে মর্মোদ্ধার করতে পারি—হৃদয়বৃত্তিগুলো যদি আমার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত, তবে আর যাই হই আমার রবীন্দ্রনাথ হওয়া সম্ভব হত না। সত্যিই তো এমন সূক্ষ্ম ব্যালেন্স— তাঁর গানের মনের সঙ্গে সমান সঙ্গত করে। ভাবি গানকে বোধহয় নিজের পুরোটা সমর্পণ করতে পেরেছিলেন। তাই সেখানে কোনও মেদ নেই, ক্লান্তি নেই। ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু—আসলে ক্লান্তি থেকে উত্তরণের পথ। তাই তো ‘প্রকাশই সাহিত্য’ বলেও শেষমেষ ‘জীবনবল্লভ’কে বলেছেন– 

       ‘ওহে জীবনবল্লভ,  ওহে সাধনদুর্লভ, 
           আমি  মর্মের কথা অন্তরব্যথা  কিছুই নাহি কব–
           শুধু  জীবন মন চরণে দিনু  বুঝিয়া লহো সব। 
         (দিনু চরণতলে– কথা যা ছিল দিনু চরণতলে– 
                প্রাণের বোঝা বুঝে লও,  দিনু চরণতলে। )
                        আমি  কী আর কব।। 

অর্থাৎ যে কথায় যে বেদনায় যে অনুভূতির চোরাগোপ্তা কাঁটায় ধনুকের ছিলার মতো আমি টানটান আর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছি আর বেঁকে যাচ্ছি, কিন্তু বলতে বা প্রকাশ করতে পারছি না সেই কথাও তুমি বুঝে নাও। আমাকে ভারমুক্ত করো। এখানে ওই প্রকাশ না-করতে পারাটাকে প্রকাশ করলেন ‘কিছুই নাহি কব’ বলে। কিছু না-বলে কেন? কেননা অব্যক্তের অবহ ভারটিকে প্রকাশ করলে সে কি কিছুটা অব্দি diluted হয়ে যায় না! অবহের যাতনা তাই বোবা এক বেদনায় সঁপে দিলেন জীবনবল্লভ নামক আধারটিকে আশ্রয় করে। জীবনবল্লভ তাঁর আশ্রয় এখানে সত্যি। বা উল্টোটা, আশ্রয়টাই জীবনবল্লভ। আরেকটু বড় করে ভাবলে লেখা আর শব্দ আর সুর সেই অবহের চিরকালের আশ্রয়। তাই ভরসা হয় আমার সব অবহ কথার আশ্রয় হয়ে উঠবে আমার লেখা। ভরসা হয় আমাকে প্রকাশের যোগ্য হয়ে উঠবে আমার শব্দ। পরমুহূর্তেই ভয় হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি বাড়তি আধার ছিল—সুর। আমার কাছে কেবল শব্দ! ভয় হয়। আবার মনে হয় দায়িত্ব সেক্ষেত্রে আমার শব্দ আর প্রকাশের উপর খানিক বেড়ে গেল। শব্দ দিয়েই আমাকে পূরণ করতে হবে সব অব্যক্তকে। এও এক চ্যালেঞ্জ। সুরের মতো একটি অতিকায় ও সূক্ষ্ম মাধ্যম আর নেই। কিন্তু তাতে কী! আমার অবহকে তো আমার নামাতেই হবে। কেবল শব্দ দিয়ে। আমার লেখার কাছে। শাদা পাতার কাছে। আমার জীবনবল্লভ নেই। কিন্তু তাতে কী! আমার একটা রবীন্দ্রনাথ আছে। আমার দৈত্যের মতো একা ও অতিকায় এক রবীন্দ্রনাথ আছেন। 

             শব্দমাত্র সম্বল করে কীভাবে নিজের অতিকায় পাথরচাপা আর্তিকে একটু একটু উন্মুক্ত করে তাতে বইয়ে দিতে হয় ধারা, কীভাবে চিরচঞ্চল করে তুলতে হয় তিনিই তো তার সবথেকে বড় দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। আবারও একটু ভয়ের ছায়া দুলে যায়, কেননা দৃষ্টান্তটি আবার আমাকে গান থেকেই নিতে হবে–   
                          স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হল–
                            যাবার আগে শেষ কথাটি বোলো ॥
                            ফিরিয়া চেয়ে এমন কিছু দিয়ো
                            বেদনা হবে পরমরমণীয়–
                            আমার মনে রহিবে নিরবধি
                           বিদায়খনে খনেক-তরে যদি    সজল আঁখি তোলো ॥

তবু ভাবি সুর নাহয় এখানে বাদই দিলাম। বলার ভঙ্গিটি কী অপরূপ! যেন এই কথাগুলোর আর্তি, বলার সময় তার ভাঁজ, না-বলা কথার গুঞ্জরণে মনের কোণে পেকে ওঠা রেখার চঞ্চলতা সবই সেই ভঙ্গিতে ফুটে আছে। গানটিতে ভালো করে লক্ষ করলে দেখব, বলার কথা আসলে একটি। হ্যাঁ, একটিই। দু’জনে মিলে স্বপ্নবৎ থাকার পর হঠাৎ, খুবই হঠাৎ করে জাগার বেলা উপস্থিত হয়েছে। জাগার বেলা মানে চলে যাওয়ার বেলা। যেতে তো হবেই, কিন্তু যাওয়ার আগে একটি মাত্র চাওয়া। কী সেই চাওয়া? চাওয়াটি হল—যাওয়ার আগে প্রিয়জনের চোখে যেন আর্তিটি থাকে। সেই আর্তিমেশানো একটা তাকানোই হবে পরম পাওয়া। কিন্তু বলা যখন হল এই একটি কথাই কীরকম ভেঙে ভেঙে বলা হল। ভেঙে ভেঙে বলা হল কেননা যাতে তুমি আমার হৃদয়ের গোপন থেকে উঠে আসা আর্তিটি টের পাও। আস্তে আস্তে তার অন্তঃস্থলে দড়ি ধরে বা দড়ি ছাড়া সেই কুয়োর অতলে নেমে যেতে পারো। যাতে তুমিও সমান চঞ্চল হও। আর মরে যাও। মরে যেতে যেতে আবার আঁকড়ে ধরো তাকেই। তার রোদজলছায়া যেন তোমাকে সমভাবে স্পর্শ করে। অনুরূপভাবে আমার মনটিও যেন তুমি ছুঁতে পারো। তবেই না তুমি বুঝবে আমি কী চাই! কেমনভাবে চাই! কতটা চাই! তবেই না তুমি সেই তাকানোটা তাকাতে পারবে! যে তাকানোয় আমার হৃদয়ে ধাক্কা লেগে ছড়ে যাবে। আবার নদীর মতো শুশ্রূষাও দেবে। নদীর মতো কেন বললাম? কেননা ওই যে বলেছেন—‘সজল আঁখি তোলো’! তোমার কান্না যেন আমাকেও কাঁদায়। তবেই না হৃদয়ের দুকূল ভাসবে। তবেই না তা হবে চিরদিনের। 

                  হঠাৎ মনে হয় লেখা আমার সমর্পণের জন, একথা ঠিক। আমি তার শিরা ধমনীতে স্রোত বইয়ে দিতে চাই একথাও সত্যি, কিন্তু যখন লেখাও পাশে এসে দাঁড়ায় না তখন তো একজন রবীন্দ্রনাথ আমার থাকে, আমার সমর্পণের রবীন্দ্রনাথ। মনের অসহ ভার নিয়ে যার কাছে আমি প্রায় নিয়ত দাঁড়াই, আর যে আমাকে সেই দুঃসহ ভার থেকে মুক্তি দেয়। প্রায় নিয়ত। 

 

আমার সমর্পণ, সমর্পণে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের গান ঘনঘোর অন্ধকারে ভারী মেঘ ফেটে মাঝেমাঝে বিদ্যুৎচমক আনে বুকে, এ কথা সত্য। ভুলে যাই মাইল মাইল অন্ধকারের স্মৃতি, স্মৃতির ঘূর্নি। যে অনুভূতি আমার ছিল না, সেই অনুভূতির আকুলিবিকুলি ফিরে আসে হৃদমাঝারে, এক একটা গান শোনার পর। নতুন হই। নিজের খোলস ঝরে যায়। যে আমি হয়ত অবহেলায় হারিয়ে ছিল, চকিতে তার স্পর্শ—তার বিস্ফোরণ আমাকে দিশেহারা করে, নিজেকে হারিয়ে আবার নিজেকেই খুঁজে পাবো বলে। এই জাদুকাঠি ছোটবেলার রূপকথার গল্পের থেকেও মধুর। জীবনের বাঁকে যখন কেউ হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে, এই লোকটার গান আমাকে হাত ধরে ঝড়ে জলে রোদে কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়েছে। হাত ছাড়ার আগে মোড়কে গুঁজে দিয়েছে নিত্যনতুন আনন্দের রিনরিনে ব্যথা, দুঃখের স্পর্শতাপ, বিরহের পূর্ণতা। কী পাইনি তার হিশেব গুলিয়ে গেছে সেইসব পাওয়ায়। তবে লোকটা এতকিছুর পরও আমাকে বড় অস্বস্তিতে ফেলেন। এই অস্বস্তির হাত থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করি। কিন্তু দিন যায়, অস্বস্তি বাড়ে। তাই সেই অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলার একমাত্র উপায় হল তার চোখে চোখ রাখা, কাঁটা দিয়ে কাঁটা সরিয়ে ফেলা। 

যাকে এতটা আঁকড়ে থাকি, তার কাছে সমর্পণে কোথাও একটা কাঁটা বেঁধে মাঝেমাঝে। ভদ্রলোকের ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল। কিন্তু ঈশ্বর’ নামক ব্যাপারটাকে আমি কিছুতেই মানতে পারি না। ঈশ্বর’ ধারণাটাই আমার কাছে একদল লোকের তার নাম ভাঁড়িয়ে খেয়ে পরে বাঁচবার কৌশল বই বেশি কিছু মনে হয় না। অথচ ভদ্রলোক দু’পা যেতেই যেতেই মাঝেমাঝে ‘প্রভু’ জীবনদেবতা, ‘ভবের কাণ্ডারি’ এরকম নানা বিশেষণ এনে ফেলেছেন গানে। তাঁর জীবনদেবতাকে আমি যদিও ‘ঈশ্বর’ ভাবতে পারি না, ফলে সেখানে সমস্যা হয় না। জীবনদেবতাকে আমি দিব্য মানুষ ভেবে নিতে পারি, যে আমার একান্ত প্রিয় সেইই আমার জীবনদেবতা। কিন্তু সবসময় এমন এড়িয়ে থাকা যায় না। যেমন কিছুদিন ধরে একটা গান শুনছি। আমার জীবনের রকমফেরই এমন, একটা গান আমি মাসাধিককাল শুনে থাকি, কখনও বা বছরাধিককাল। কিছু করার থাকে না তখন, জীবনের এই বিচিত্র দাবিকে আমি জোর করে রুখে দিই না। তো কদিন ধরে আমি ‘যে তরণীখানি ভাসালে দুজনে আজি হে, নবীন কাণ্ডারি’ গানটা ল্যুপে রেখে শুনছি। যতবার শুনছি একটা কাঁটা খিঁচ খিঁচ করে বাধছে। কিছুতেই যাচ্ছে না। যাচ্ছে না বলেই চোখে চোখ রেখে এই কথা বলার  অভিপ্রায়। 

এমনিতে গানটা দুজন মানুষ, যারা এক হয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করছে তাদের উদ্দেশ্যে। যারা নবীন সংসারে প্রবেশ করল মাত্র। এই নবীন সংসার আসলে তো দুটোমানুষের একত্রে নবজন্মও বটে। কী অপূর্ব কী যথাযথ এই শব্দ-পরিমিতি, ভাবলে শিহরণ হয়। প্রথমে বলা হল যে তরণীখানি দুজন ভাসালে, তারপর বলা হল হে নবীন কাণ্ডারি। এই যে নবীন কাণ্ডারি বলা হল—এখানে এসে প্রতিবার আমার শিহরণ হয়। হে নবীন কাণ্ডারি—দুজনের অস্তিত্ব এখানে এসে যেন যৌথ ও এক হয়ে যাচ্ছে যুগপৎ! কী ব্যালেন্স শব্দের! এ সংসার এই বিবাহ আসলে অনেক বেশি অন্তরের, অন্তরে অন্তরের সায় মেশানো গান্ধর্ব্য রীতির। আচার-আচরণ যে কত অপ্রয়োজনীয় রবীন্দ্রনাথের গানে মজলে বোঝা যায়। এই আড়ম্বরহীনতার সৌন্দর্য বোধহয় ছোটবেলার নিয়ামত খালিফা যে ভুল করে জামায় বোতাম রাখতে ভুলে যেতেন তার বদলা, তার পরিবর্ত সৌকর্য কিভাবে ধারণ করতে হয়, সেই ছেলেবেলা থেকে চর্চা করে গেছেন। আবার প্রসঙ্গে ফিরি, কিন্তু পরেই আবার বলছেন সেই নবীন সংসারীর উদ্দেশ্যে, এই সংসারজীবনে যে নৌকা তারা ভাসালো তার কাণ্ডারি যেন তাকেই করা হয়, যিনি ভবের কাণ্ডারি। কিন্তু আমার কী হবে! আমি যে ভবের কাণ্ডারি ব্যাপারটা মোটেই হজম করতে পারি না! গানটা এত প্রিয় তাকে ফেলতেও পারি না। এক অদম্য টানে গানটা আমায় টানে। যেমন চাঁদের টানে জোয়ার। 

দোটানায় পড়ি মুহূর্তের জন্য – এমন আবেদন যে গানের তাকে সরাই কিভাবে! আমি বাধ্যত গানটার কাছে ফিরি। অবাক হয়ে ভাবি— ‘সুখে দুখে শোকে আঁধারে আলোকে/ যেয়ো অমৃতের সন্ধানে। বাঁধা নাহি থেকো আলসে আবেশে,/ ঝড়ে ঝঞ্ঝায় চলে যেয়ো হেসে,’ এই যে সুখে দুঃখে আঁধারে আলোকে অমৃতকে সন্ধান করার করার কথা বলা হচ্ছে, এই অমৃত কি কোনও ‘ঈশ্বরের’ পক্ষেই হাতে করে তুলে দেওয়া সম্ভব! এই অমৃত তো কেবল নিজের মধ্যেই অনন্তকাল ধরে সন্ধান করে যেতে হয়, তাকে নিরবধি নিজের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে হয়! নিজের ভিতর তাকে না জাগালে তার ছায়াও তো বহির্জগতে পড়বে না! তারপরই তো আসছে সেই অমোঘ কথা – ঝড়-ঝঞ্ঝা যাই আসুক নিজের ভিতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে, তবেই তো তাকে অতিক্রম করতে পারা যাবে! নিজের প্রেমের অপার সৌন্দর্য কেবল নিজের মধ্যে আটকে রাখলে তাকে ছোট করা হয়, তার বিপুল ঐশ্বর্য দিয়ে এই পৃথিবীকেও ছুঁতে হবে। কেননা প্রেম অন্তরে যে আলো আনে, তাতে গোটা একটা বিশ্ব এঁটে যায়, তার জোয়ারে সে সবাইকেই প্লাবিত করতে পারে! প্রেমের আলো এসে পড়লে তার সকলকে, তুচ্ছতম বস্তুটিকেও জাপটে ভালোবাসতে সাধ হয়। একমাত্র প্রেম সব সীমানা ভেঙে সবাইকে ভালোবাসার পূর্ণতা জোগায়।

কিন্তু এতকিছুর পরও খিঁচটুকু যায় না। প্রেমই একমাত্র এই পৃথিবীটাকে এমন সুন্দর করে দেখতে শেখায়, তবে ‘ঈশ্বর’ ব্যাপারটার ভূমিকা এখানে ঠিক কতটা বা কীই বা এমন হতে পারে? তারপরই হঠাৎই খেয়াল হয় ভবের কাণ্ডারি প্রথমে বলেছেন বটে, তারপরই বলেছেন – ‘কালপারাবার যিনি চিরদিন করিছেন পার বিরামবিহীন/ শুভযাত্রায় আজি তিনি দিন প্রসাদপবন/ সঞ্চারি॥/ নিয়ো নিয়ো চিরজীবনপাথেয়,’ যেন হুঁশ ফেরে, আরে কালপারাবার শব্দটা তো এনেছেন ভদ্রলোক! অভিপ্রায় তাঁর যাই থাকুক, এই ‘কালপারাবার’ স্বয়ং সময় আমার কাছে। একমাত্র সময়, যে আছে বলে আমাদের সুখও চিরদিনের নয়, দুঃখও নয়, জীবন এত অনিত্য, তাই এত মহার্ঘ্য এই জীবন। কাণ্ডারি তো সময় ছাড়া আর কেই বা! বিশেষজ্ঞরা কী বলবেন আমি জানি না। কিন্তু আমি আমার মতো করে এ যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম। জানি এমন সমাধান সবক্ষেত্রে হবে না। তবে কেন জানি না আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের যত বয়স হয়েছে, একান্ত ঈশ্বরপ্রীতি ম্লান হয়ে এসেছে। জীবনদেবতা, জীবনে ধ্রুবতারার মতো যেন, একটা কাউকে আশ্রয় করতে চাওয়া। যার হাত ধরা যায় কিনা জানি না। কিন্তু অভিমান করা যায় যার উপর। ঈশ্বরের চোখে কি চোখ রাখা যায়? অভিমান? আমি জানি না! কিংবা, আমার মতে, যায় না!        

 

Facebook Comments

Related posts

2 Thoughts to “আমার সমর্পণ”

  1. গৌতম চৌধুরী

    খুবই ভালো লাগল গদ্যটি। নিবিড় আর আন্তরিক। লেখাটির শেষে এসে এই যে আপনি বলেছেন – ‘তবে কেন জানি না আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের যত বয়স হয়েছে, একান্ত ঈশ্বরপ্রীতি ম্লান হয়ে এসেছে।’, এমন অনুভবের যথেষ্ট সারবত্তা আছে। ঠাকুরের শেষ জীবনের, বিশেষ ক’রে শেষ ১০বছরের, গান বাছাই ক’রে পড়লেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

    1. Sanghamitra Halder

      হ্যাঁ গৌতমদা, এটা বারবার মনে হত। আপনি বললেন বলে এই মনে হওয়ায় জোরালো ভরসা পেলাম। ভালো থাকবেন।

Leave a Comment