অনির্বাণ ভট্টাচার্য

‘অ্যানাদার ডে, অ্যানাদার পিকনিক’ – রাস্কিন বন্ডের আত্মকথা, স্মৃতি-বিস্মৃতির এক পাহাড়ি জার্নি

পুরোনো পাপ দীর্ঘ ছায়া ফেলে দেয় জীবনে। প্রখ্যাত রহস্য লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির প্রসঙ্গ টেনে যে বইয়ের শুরু তার পরতে পরতে অবশ্য কোনও রহস্য নেই, আছে নস্টালজিয়া, শান্ত এক রোদেলা দুপুরের মতো আরাম, আবার পাশাপাশি তীব্র এক বিষাদ। অল্প-বিস্তর রাস্কিন বন্ড পড়া পাঠক প্রথম দুটির সঙ্গে পরিচিত হলেও কোথাও মিস করে যাবেন তৃতীয় সেই বিষাদ। ২০১৮-র পেঙ্গুইন ভাইকিং থেকে প্রকাশিত বই ‘Beauty of All My Days’-এ সেই বিষাদ কোথাও তার আগের বছরের অনেক বেশি পরিকল্পিত এবং বহুপাঠ্য বই ‘Lone Fox Dancing’-এর সঙ্গে মিলে গেলেও কখনওই রিপিটিটিভ নয়। আমার, আমাদের প্রিয় রাস্টির চরিত্রগুলি, ঘটনাগুলি তাঁর ফিকশন বা নন-ফিকশনে বারবার এসে পড়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে। তাঁর দেরাদুন, তাঁর বাবার জ্যাজ মিউজিক রেকর্ড, তাঁর ম্যাপলউড লজ, তাঁর পরী টিব্বা, অ্যাডাপ্টেড ফ্যামিলি – এসব মাঝেমধ্যে আসবে জেনেই বারবার রাস্টির কাছে ফিরে যাওয়া। কারণ, সবকিছুর পর শেষমেশ ওই আরামটা দরকার। তাই ‘Lone Fox Dancing’ – এর একবছরের মধ্যেই আবার একটা স্মৃতিকথা কোথাও একটু বেশি পুনরুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করলেও তা স্রেফ হাওয়ার উড়িয়ে দেয় এবইয়ের পাতার পর পাতা। কারণ, ওই যে বললাম বিষাদ। সেখানেই ‘বিউটি অফ অল মাই ডেজ’ স্বতন্ত্র …

শুরুতেই রাস্টি বললেন – ‘Dear Reader, forgive the absence of chronology…’। তাই ‘লোন ফস্ক ড্যান্সিং’-এ যেভাবে বাঁধা টাইমলাইনে তাঁর জীবনকে ধরেছিলেন রাস্কিন, এ বইয়ে সেসব নেই। শুধু কিছু vignette। আর দুর্মূল্য কিছু সাদা কালো ছবি। মা, বাবা, বোন, কাকা, রাস্টির নিজের ছোটবেলা, মুহূর্তের পর মুহূর্তের কোলাজ – ছবিগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেইসব গল্পগুলোকে। গ্র্যানির বাড়িতে ছোট্ট রাস্কিনের বাগান, মালি ধুকির বকুনি, আর প্রকৃতির সঙ্গে, একসময়ের গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যানের ছোট্ট ভার্সনের সলিলোকি, ‘পিটুনিয়া, গুড মর্নিং’, ‘স্ন্যাপড্রাগন, হাউ আর ইউ টুডে’, ‘জিনিয়া, ইউ লুক থারস্টি’। লোন ফস্ক ড্যান্সিং-এ সিমলা বিশপ কটন স্কুলের সেই টানেলটার কথা এখানেও উঠে এসেছে। বন্ধু ব্রায়ানের হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া এবং অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে রাস্টিদের তৈরি করা স্কুলের কাছেই, অথচ স্কুলের ভেতরে নয় এমন এক অদ্ভুত রেক্লিউস, রাস্টির কথায় – ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’ – শুধু স্কুল জীবন না, বৃহত্তর পৃথিবীর তাণ্ডবের থেকে রাস্টি এবং এক পাঠান ছেলে আজহারের পালানো, বন্ধুত্ব, কামারাদেরি। একটি পোকাও কোনওদিন মারতে চাননি রাস্কিন। জানলার শার্সিতে কাগজের চাপে থ্যাঁতলানো ব্লু-বটল ফ্লাইয়ের মৃতদেহের কাছে আসা কাচের ওপারে তার বন্ধুরা, বোম্বের ল্যামিংটন রোডের স্যাঁতস্যাঁতে হোটেল ঘরের টিকটিকি, ফোটানো সেদ্ধ ডিম ছিনিয়ে নেওয়া কাক – পাতায় পাতায় মনুষ্যেতর চরিত্র এবং তাদের সঙ্গে লেখকের কথা, সংলাপে হিউমার এবং ভালোলাগা এক বিষণ্ণতার মাখামাখি।

এই বিষণ্ণতাই কোথাও তীব্র হয়ে যায়, চত্রিত্রভাবে বড় সরাসরি হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। লন্ডনের লিসেস্টার স্কোয়ারের যৌনকর্মীর বাড়িতে বিস্কুটের টিনের মতো দেখতে একটা বাক্স, ভেতরে কনডোম – পয়সা মিটিয়েই আসছি বলে সরে গেছিলেন রাস্কিন – ‘It also represented a failure on my part, and I was to stay away from highly scented women for a long, long time …’। ‘Leftovers from the Raj’ অধ্যায়ে তীব্র কিছু চরিত্র, যাঁদের কথা আগে দেখিনি রাস্কিনের লেখায়। সাদা চামড়ার ‘আংরেজ কবাড়ি’ ডিন স্প্রেড বাতিল খবরের কাগজ বিক্রি করতে করতে এবং রাস্তার ছেলেদের ঢিল, ঠাট্টা শুনতে শুনতে একদিন নিজের এককামরার ঠান্ডা ঘরে রক্তবমি করতে করতে চলে গেল। দূর সম্পর্কের এক বোনের সঙ্গে সম্পর্কে থাকা বুড়ো ফস্টার নিজের ঘরেই মদ বানাতে বানাতে বিকিয়ে দিলেন আসবাব, বাড়ির ছাদ; একটা আস্তাবলে দম্পতির রাতবিরেতের ঠাট্টা, আওয়াজ। 

এর বাইরে আবার পরিচিত, সাধারণ ছোট ছোট মুখেদের নিয়ে রাস্টির জয়যাত্রা। ‘History only tells us about the great ones who left their footprints on the sands of time. Dhuki spent most of his life growing sweet peas and petunias for an old lady. That’s the kind of life I try to celebrate …’। নস্টালজিক পৃথিবীতে চলে আসে ষাটের দশকের মুসৌরি, যখন ‘Radio enlivened the house, cinema enlivened the town’। বিস্কুটের টিন থেকে বের করা মিস কেলনারের একের পর এক ঐশ্বর্য, পঙ্গু বৃদ্ধার রিকশ করে শহর ঘোরা, আর্থিক অনটনে একটা সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া চেনা বেকারির আওয়াজ। ‘ফেয়ারওয়েল, মিস কেলনার …’। অথবা ম্যাপলউড লজে টিটেনাসে চলে যাওয়া ছোট্ট সুরেশ, এবং সেই ম্যাপলউ থেকেই আইভি কটেজে চলে যাওয়া, কারণ ‘the house was haunted by the cries of little Suresh …’

এবং এসবের ভেতরেই নিবিড় এক দার্শনিক মন রাস্কিনের। ‘Man was a god of sorts in his own spheres, but on a lovely mountainside he is no more important than an ant – and not half as industrious!’ থরো-র ওয়াল্ডেনের মতো কিছুটা বৈপরীত্যে তিরতির করে বওয়া নদীর ধারে তাঁর আইভি কটেজের ঘরটিও তেমন একটি রেক্লিউস। ‘I sought solitude, but I did not seek loneliness. You can be lonely in a crowd, in a big city, if you have no friends. And you can live alone in a cottage in the hills and be far from lonely, because for a greater part of the time you will be busy keeping the old cottage from falling down.’ সলিচিউড এবং লোনলিনেস – মূলত এই পার্থক্যের সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে বাইরে, পৃথিবী, রাজনীতি, ক্রুড রিয়েল বাস্তবের কচকচি – রাস্কিনের লেখায় এসব কেন আসেনি? কেন রাজনীতি নেই? সেখানেও অকপট এই প্রাজ্ঞ। ‘Why I never write politics? … well, I concentrate instead of birth and death and the interval between.’ রাস্কিন এমনই সপাট। ছোটোছোটো মুখ, জোনাকি, পাহাড়, পোকা – যে রাস্কিন এদের বন্ধু, তীব্র যান্ত্রিক মানবসভ্যতায় তিনি যে ব্রাত্য হবেন, খুব স্বাভাবিক। তাঁর নিজের কথাতেও শ্লেষ – ‘at least dead leaves serve a purpose; they enrich the soil, mankind pollutes it …’ লন্ডনের একটি ভিউপয়েন্টে স্থানীয় একটি কবরখানা ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পেয়ে তেমনই ক্লিশে মানবসভ্যতার কিছু প্রতিনিধিকে দেখে হাসি পায় রাস্কিনের – ‘the cemetery does have the best view. Unfortunately, its inhabitants are not in the best position to appreciate it …’

এইসমস্ত নিয়েই ‘বিউটি অফ অল মাই ডেজ’। ক্রনোলজি ছাড়া মানুষ রাস্কিন বন্ডকে ধরতে পারার এক আয়না। ‘Mystical when I want to be, down to earth when I had to be …’ তাঁর জামনগর, তাঁর নেলসন এডির গানের রেকর্ড, তাঁর টাইপরাইটার, একের পর এক চলে যাওয়া কুকুর, বেড়াল, বাগানে চিতার আক্রমণ, টিকে থাকা হেরে যাওয়া সাহেব পাড়া, মিস কেলনার, পরী টিব্বার ভুতুড়ে পাহাড়ে হঠাৎ দেখা দিয়েই হারিয়ে যাওয়া সেই কিশোরী, মুসৌরির জানলায় ঝিঁঝিঁ, রাজোউরি গার্ডেনের অন্ধকার টিমটিমে ঘরের বাইরে গ্রীষ্মের সন্ধের বাতাস – এসব নিয়েই আরও অনেকদিন লিখুন, বেঁচে থাকুন রাস্কিন। আরও একটা স্মৃতিকথা, আরও কিছু চরিত্র, কিছু হারিয়ে যাওয়া বনভোজনের মুহূর্ত বিস্মৃতি থেকে বাঁচিয়ে তুলুন – ‘fade in, fade out/ Another day, another picnic …’

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment