অমিতরূপ চক্রবর্তী

অমিতরূপ চক্রবর্তী’র কবিতাগুচ্ছ

পিঠ

এই আশ্চর্য হাওয়ার মধ্যে দূরে চলে যাওয়া আঙুল ও জাহাজের আলো ফিরে আসবে । তখন টিপটিপে বৃষ্টি শুরু হবে অনেকটা রহস্য গল্পের মতন । চাঁদ পুরোপুরি মুছে যাবার পর আকাশ অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়াবে । একটি গাছে জোনাকির ফুল । এই আশ্চর্য হাওয়ার মধ্যে দূরে চলে যাওয়া আঙুল ও জাহাজের আলো ফিরে আসবে । তোমার শীতল পিঠ থেকে অনেকগুলি পোকা বেরিয়ে উড়ে যাবে সঙ্গীর খোঁজে

আজ প্রত্যেকে অনুভব করবে উরুতে পোশাক যেন অতিরিক্ত মাত্রায় খসখস করছে । অনুভব করবে শিরদাঁড়া বরাবর যেন হেঁটে , মাংসের খোঁজে চলে যাচ্ছে কোনওকিছু । একটি ঘামের গাড়ি টলোমলো করতে করতে এসে দাঁড়াবে কণ্ঠার কাছে । সব গোড়ালি বেয়ে সরসর করে উঠে আসবে জ্যান্ত লতাপাতারা ঠোঁট ও মুখের দিকে

শহর পরিত্যক্ত হবে । এরিয়াল ভিউ থেকে মনে হবে এযেন প্রকাণ্ড মৃত এক কুমীরের পিঠ । কিছু লুমিয়েন্স শৈবাল ভাঁজে ভাঁজে জড়ো হয়ে আলো করে রেখেছে তার ক্লিষ্ট চোখ , করাতের মতো দাঁত আর রোমশ হৃদয় । এই আশ্চর্য হাওয়ার মধ্যে যার মৃত্যুও নিরাপদ দূরত্বে এসে থামে , থমকে দাঁড়ায়

রক্ত

উল্টোদিক থেকে তোমার পিঠের ফলক দেখতে পাই । সেখানে যে ভূমিশায়িত হবার দিনক্ষণ লেখা আছে , সযত্নে খোদিত আছে , পোশাক অতিক্রম করে তা স্পষ্ট দেখা যায় । হয়ত কাছে যাবার দরকারও পড়ে না , তীক্ষ্ন পাহাড় শৃঙ্গের মতো সেসব মায়ালোকিত হয়ে চোখে ধরা দেয় । বিষণ্ণ গাছের ছায়া-বাতাসের মতো তোমার খানিকটা অনর্গল চুল , যাদেরকে তুমি পেছনে সরিয়ে দিলে ভারমুক্ত হও , উন্মুখ থাকো , ভাল থাকো – সেইসব প্রাচীন ঝুরির মতো চুল ফলকের রহস্য বাড়ায়

আকাশ থেকে একটা গোলাপি আঙুল নেমে আসছে এখন । যৌনতা , বন্ধুত্বের অবিস্মরণীয় সব মুহূর্ত , ভাষা গোধুলির রঙ হয়ে জমে আছে চারপাশে । আমি উল্টোদিক থেকে তোমার খুলি ও মস্তিষ্কের অন্ধকার , না – তোলা মশারি ভেদ করে দেখতে পাই কী সবুজ জলে থৈথৈ তোমার চোখ , মুখের সরু সরু সব খাল । হয়ত তুমি একটা উড়ন্ত প্রশ্নকে আবারও চেপে ধরে নতুন করে বিড়বিড় করছ

কীসব অদ্ভুত প্রসঙ্গে আর মতানৈক্যে আমাদের দূরত্ব বাড়ে – কমে , স্থানাঙ্ক পাল্টে যায় । কখনও অপরাধ করে ফেলা তাড়ানো ঘোড়ার মতো দুজনেই দু-দিকে সমান্তরাল পথে , সমান্তরাল ছন্দে হাঁটি । মেদবহুল উরুর পৃথিবীতে আমাদের ঘিরে যে রোগ ও তিলের শহর , কাদা ঘেটে আসা মফস্বল অথবা জঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে এমন রীতিবহির্ভূত গ্রাম – সেসবের গায়ে কারা এসে যেন সাংকেতিক মোম জ্বেলে যায় । আমাদের চোখমুখ আবারও চকচক করে

একেবারে শুরুর বিন্দুতে ফিরে আসে

ঝুল

দুটো ঘর , যাদের মসীলিপ্ততা চাঁদ ছাড়িয়েও বেশ আরও কিছুটা দূর এগিয়ে গেছে , ঘুমোতে যাবার আগে অভিযাত্রীসুলভ দীর্ঘ বিরামে কিছুক্ষণ বসে থাকে । সমসাময়িক যে গাছগুলি , রোদের সঙ্গে আকুল , বুক ভাঙা রমণের পর ঝিমিয়ে পড়েছে এবং হাওয়া এসে তাদের নতমুখকে আরও নত করে যাচ্ছে – তারা আর কিছুক্ষণ পর কবরের দিকে চলে যাবে । অবশ্য এখনও রোদের শরীরে ঘাম , গ্রীবার ঋজু পেশী , কোমরের নীচে গলে যাওয়া পাথরের চিহ্ন । দুটো ঘর অন্যমনস্ক চোখে সেসব দেখছে । তাদের ভেতরে নির্জন কাঠের মতো শান্তি

শুকনো খটখটে লোকায়ত অবশ্য একইরকমই থাকবে । অন্য বাড়ির দেওয়াল যেভাবে বৃষ্টির দাগের আড়ালে রক্তপাতের কথাকে উপস্থাপিত করে কিম্বা সিঁড়ির ওপরে এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা চটি , জুতো বোঝাতে চায় ভুল নিয়মে কারা অতিজীবীত হয়ে আছে । পরাভূত জানালার পর্দা যেমন সামান্য উড়ে বোঝাতে চায় মৃত্যুভয় পেরিয়ে আরও নেপথ্য খননের কথা

অভিযাত্রীসুলভ ঘরদুটি বিরাম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসে । তাদের চোখের সামনে কিছু নেই , শুধু সমুদ্রের জলরাশি ছাড়া , আসন্ন ছোট – বড় ঢেউগুলো ছাড়া । জলের অনেক নীচে , স্বচ্ছ এক বৃত্তে কবেকার এক ডুবে যাওয়া জাহাজ , মূল্যবান কড়ি – বরগা আর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকা কোনও এক সময়ের সোনালি বিষের গ্রন্থীওলা শেকল । তার গায়ে চলমান মাছের ঝাঁক , অদ্ভুত রঙীন শৈবাল

দুটো ঘর এবার সম্বৃত হয়ে সাদা দাঁতের মতো ঘুমের তুষারে হাঁটা দে

নগ্ন

একদিন ভূমিকায় হাত রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হয় । মূল যে দরজাটি , যার ওপারে চেনা আলো , আমাকে তোমাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় বহুবার দেখে দেখে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া গাঢ় নিঃশ্বাসের মতো দেওয়াগুলি , মস্তিষ্কহীন বিছানার সুদূর প্রসার , স্ফিতাকার টিকটিকির শিকারের দিকে এগিয়ে আসা অথবা জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকা মূক ঈশ্বরের মতো মাথার জানালা – সেসব কীরকম অশৌচ বাড়ির মতো থমথম করে । চাঁদের উল্টোপিঠে যে আকাশ , তার মতো অন্ধকার জড়ো করে রাখে । এদিন সশরীর কোনও অর্থই নয় , যেন পাহাড় ডিঙিয়ে আসা কোনও তৃণভূমি পুড়ে যাবার ধোঁয়া , নরম এক লতার কঙ্কাল

অব্যাহতি থেকে এক সূচালো পীচের রাস্তা ক্রমশ হলুদ পত্ররেখার দিকে যায় । উঁচু – নীচু নুড়িপাথরের দিকে যায় । গরিষ্ঠ রাতের দিকে যায় । বেহালা ছড়ের মতো আত্মা দেহ থেকে দেহান্তরে বারবার আসা – যাওয়া করে । তাতে যে করুণ , ঠাণ্ডা বাতাসের মতো শব্দ হয় , তা কখনও তোমার মতো নিদারুণ অথবা পাশের শহরে চলে যাওয়া কোনও খুনীর তামস

কুক কুক করে একটা পাখি কোনও এক অন্তরালবর্তী কোণ থেকে ডাকে । মনে পড়ে এক পাশাপাশি ভাসমান সংযুক্ত বিকেল , আত্মার মতো অবাধ এক জানালা দিয়ে ঘরের বা নীরব সুড়ঙ্গ থেকে মশারা নক্ষত্রের ডালে , পাতায় উড়ে যাচ্ছিল । আমাদের মধ্যে তখন দূরে গিয়ে বেঁকে যাওয়া ধানখেত চেরা কোনও রেললাইন ছিল কি ? গায়ে , ঘাড়ের পেছনে আশ্চর্য কাচের আঙুল নিয়ে তুমি উঠে গিয়েছিলে । কোনও বৈধ পোশাকের ওদিকে , কোনও সেরে ওঠা ক্ষতের সিঁড়িতে

ভূমিকায় হাত রেখে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখি আমার অন্তর থেকে কিছু মর্মাহত শাখাপ্রশাখা বের হয়ে এল । যেমন স্বপ্নে প্রেতাধিক মানুষের হয়

চোয়াল

একটি পুরনো বিষণ্ণ রোদের নিঃশ্বাস মেখে গাছগুলি স্থির হয়ে আছে । ফাঁকে অনতিক্রম্য আকাশ , মেঘ ও পাহাড়ের রেষারেষি । সামান্য নীল জলমুখী তিমিমাছের মতো উঁবু হয়ে আছে । নির্ভয়ে বাতাস চলে যাচ্ছে দেহ – দেহান্তর পেরিয়ে । আমাদের পরম্পরাহীন দেহ দিয়ে , চোখ ও ঠোঁটের ব্যাবধান দিয়ে এমনই নির্ভয়ে অনেক বাতাস , দিনের হরিণ ছুটে যায় । আমাদের যে আঙুল , পায়ের আবেগ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরার আগেই মরে গেছে – তার ফাঁক দিয়ে , পরিসর দিয়ে বাতাস বয়ে যায় । হরিণের পিছু পিছু চতুষ্পদ অন্ধকারও আসে

কিছু জানি না – এমন নিরুদ্বিগ্ন মুখের পরে এক আন্দোলিত সমুদ্রের সীমানা শুরু হয় । তার ঢেউগুলো পরপর যূথবদ্ধ ভাবে আসে । এদের কেউ কেউ চিরকালের জন্য তীরে থাকে । কেউ কেউ ব্যর্থকাম হয়ে জলের কবরে ফিরে যায় ।এই চলাচলও আমাদের আমাদের ঠোঁট ও চোখের ব্যাবধান দিয়ে হয় । অদৃশ্য ভাঙা এক চোয়ালের ভেতর দিয়ে

কতকিছু আমাদের প্রয়োজন । নরম এক ভয়াবহ পাহাড়ি সপ্তাহ শুরু হবার আগে । মাটি ফুঁড়ে আর্ত এক হাত উঠে আসার আগে । এইসব শৃঙ্খলিত , কিছুটা শিথিল ভাবনাগুলো আমরা যে – যেভাবে আছি , (পাথর কিম্বা চলৎশক্তিহীন দাঁতের সমষ্টি) সে – সেভাবেই ভাবি । দেবদূত নেমে এসে দেখে গেছেন আমাদের ভেতর নিভু নিভু করেও কিছু কাঠ আর পাতার রহস্য জ্বলছে , এখনও জ্বলছে

পশম

চোখ যা কিনা অংশত চাঁদের মতো ঢুকে আছে তোমার কৃষ্ণসার রাতে , চুলের পেছনে , চিড় ধরা পাথরের মতো – সে রোজ কতগুলি মৃত্যুভয়াতুর সংসার পেরিয়ে আসে । কেউ কাউকে অন্যমনস্কতায় হারিয়ে ফেলে রোজ । ফিরে আসার আগে কত অগ্নিবর্ণ যুগ শেষ হয়ে যায় । চাদরের কুন্ডলী থেকে এক দেহ উঠে যায় , অন্য দেহ এসে বসে । কিছু অখ্যাত সৎকার হয় , সেই ছাই , অস্থির শেষ জলের ওপরে ভেসে থাকে শুধু

বহুল প্রচারিত কিছু শোক আর ভগ্নদশার পাশে জুবুথুবু এক সোনালি পশম শুয়ে থাকে । ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পা ফেলে ফেলে কিছুটা আত্মপরিচয় , রোমকূপের স্রোত তোমাকে আমাকে একা ফেলে রেখে যায় । এই এমন এক অমীমাংসিত ঘর , যার প্রতিটা কোনায় আড়ালে – আবডালে মিশে আছে থকথকে বিষ আর ঘুরপথে নেমে যাবার সিঁড়ি , কুমীরের ফ্যাকাসে পেটের ঘ্রাণ – সেই ঘরে আমাদের একটিই হাওয়া ফিরে আসার জানালা

কারও মুখ মাথার ভেতরে আকাশের মতো জেগে উঠে থাকে ।তার অজ্ঞাত পরিচয় নখ , হাতের ধৃষ্টতা আঁতিপাঁতি করে খোঁজে পরিচিত উত্তাপ বা বুকের বালিশ । একটি সংসার দুটো সংসারে ভাঙে , দূর – দূরান্ত কালো করে একসময় নিরস্ত্র বৃষ্টিও আসে , শুকনো পাতা উড়ে দৃশ্যমানতাকে বদলেও দেয় হয়তো – বা

তবু যেন ফিরে আসার আগে অনেক উরুসন্ধি , অনেক অগ্নিবর্ণ যুগ শেষ হয়ে যায়

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment