অমিতরূপ চক্রবর্তী

অমিতরূপ চক্রবর্তী’র কবিতাগুচ্ছ

 

ইভ

আমাদের দুষ্প্রাপ্য উৎসাহের মতো কিচিরমিচির করে উঠছে গাছের অলিগলিতে প্রচুর পাখি। তোমার পিছলে যাওয়া হাত আমি ফিরে এসে ধরতে পারি নি। শুধু মণিবন্ধের উল্টো পিঠে একটা কাচের চুড়ি ভেঙে, ফেটে ক্রুদ্ধ ইন্দ্রধনুর মতো হয়ে গিয়েছিল। নাবালক ফেনাগুলি হতভম্বের মতো তোমার আমার দুজনেরই হাতে লেগেছিল। যেন তারা এই, এই প্রথম কোনও আতঙ্কের মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও আমরা জানি সেটা আতঙ্ক নয়, নিছকই একটা ব্যর্থতা। তবু আমাদের মতো পরিণামদর্শিতা বা ভাষাবোধ তো ওই নাবালক ফেনাগুলির ছিল না। ওরা শুধু সিঁড়ির ধাপে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখছিল দু’জন মানুষ কেমন মল্লযোদ্ধার মতো আচরণ করছে। তাদের মুখের ভাঁজ, গায়ের রঙ পাল্টে যাচ্ছে মুহূর্মুহূ । যেন একটুকরো কল্পবিজ্ঞানের দৃশ্য। দুই অতিকায় নরনারীর যুদ্ধের দৃশ্য। অথচ যা আদপেই কোনও যুদ্ধ নয়। এখানে কারোরই মৃত্যু ঘটবে না। কোনওদিনই ঘটবে না। হয়তো কয়েকদিন একটা ক্ষত স্থানীয় উত্তেজনার মতো লাল হয়ে ফুলে থাকবে। হয়তো কয়েকদিন অন্য একজন তার খুলির ভেতরকার কুয়াশায় আবছা হয়ে উপস্থিত হয়ে ইংরেজিতে যাকে বলে বাউ ডাউন- তেমন করবে আর তারই আরেকটা প্রতিবিম্ব ওই ঝাপসা কুয়াশার ভেতরে দাঁড়িয়েই প্রথমজনের সব প্রার্থনাকে নাকচ করবে। এ যুদ্ধ নয়, বরং একে বলা যায় নোনতা সহাবস্থান অথবা একটু অলৌকিক, যাতে হয়তো- বা সামান্যই মাথা গলানো যায়

দুষ্প্রাপ্য উৎসাহ, মানে আমাদের দুষ্প্রাপ্য উৎসাহ যা দিয়ে চলার রাস্তা, দুইপাশের সুদৃশ্য সব অট্টালিকা, লাল গর্ভাশয়ের মতো উৎসব অথবা ঐশ্বরিক কেনাকাটার মতো দানাদার সব মুহূর্ত তৈরী হয় অথবা যৌথ অভিজ্ঞতার- তা কখনও গেরুয়াধারী সাধুর মতো আসে। সদরে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে হাঁক দেয়। আমরা মরে থাকার শিশির ভেঙে, কবরের আস্তরণ ফেলে উস্কোখুস্কো চেহারায় উঠে বসি। মুখে খড়কুটো, মাটিতে মিশে থাকা বালুর কণিকা বা কারও অন্য কোনও জন্মের পরিত্যক্ত ছেঁড়া নেতানো মাফলার- এইসব। চোখের মিরর ভিউয়ে বেলা দশটার জ্বলন্ত উঠোন, অতিরিক্ত জল বিনা বাধায় একটা গুল্মময় স্থানে গড়িয়ে পড়ছে বা কাল্পনিক কোনও বেড়াল যেন দেওয়াল থেকে পৃথিবীতে যার অস্তিত্ব নেই- তেমন কোনও ফটোগ্রাফ মাটিতে ফেলে দিচ্ছে বা যেন অনভিপ্রেত বনফুলে কীভাবে চারপাশ অগোছালো ময়লা হয়ে গেছে- এগুলোই দপ দপ করে ওঠে। তুমি নগ্ন ইভের মতো হাতে আপেলটি নিয়ে আমাকে তাড়া দিতে থাক, দুর্বার হাত নেড়ে আমাকে তাড়া দিতে থাক যেন সময়ের প্রান্ত আড়াল থেকে টেনে নিচ্ছে কেউ অথবা তা আগুন লেগে আলোরও আগে পুড়ে ছাই, ছাই হয়ে যাচ্ছে। আমিও উঠে দাঁড়াই। মাটি অবধি ঝুলে থাকে আমার অসাড় লিঙ্গ, লিঙ্গের মূলে আদিম আদিমতম নামগোত্রহীন ঝোপ। তারপর আপেলে কামড় দিতেই ভোজবাজির মতো আমূল, আমূল বদলে যায় সব 

আয়নার পায়ের কাছে কতদিন ধরে আমার সেই কবেকার চিরুনি পড়ে আছে। বারান্দার মাঝখানে কোনও সুযোগ্য কারণ ছাড়াই তোমার একটি সোজা একটি ওল্টানো স্লিপার । গতরাতে বাইরে মেলে রাখা অসময়ের ম্রিয়মাণ বর্ষাতি এখনও ঝুলছে কেমন অলক্ষে 

 

দৈব

আমার মনে হয় তুমি যখন পাতলা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নাও, তখন পুরো হেমন্তটাকেই গায়ে জড়িয়ে নিলে- এরকম ভাব। আমি তোমার পেছনে, তোমার অদূরে একটা হৃদয়ে শীতল গাছের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার এমন সন্ধ্যা উপভোগ দেখি। তোমার চাদরে ঢাকা ছোটখাটো সাজানো শরীরটা দেখি । কী সুন্দর অল্পের মধ্যে সাজানো তোমার শরীর। একটা টিপয়, ডুমো গোল গোল বাতি বা কয়েকটা রোমশ পাইনের আপাত ভয়ংকর ডাল। জলের পাইপ লোকচক্ষুর আড়াল দিয়ে বয়ে যেখানে, যে- দেওয়ালে প্রয়োজন, সেখানে স্মিত কল হয়ে ফুটে আছে। অত্যল্পের মধ্যে কী মনোরম গোছানো ব্যবস্থা। হৃদয়ে শীতল একটি একা গাছের মতো আমিও কখনও ভাবি আমাদের মধ্যেকার দূরত্ব কত বড় হল এবারের হেমন্তে । হয়তো পাশাপাশি আছি কিন্তু কাছাকাছি আছি কি? টিপয়, ডুমো গোল গোল বাতি বা ওই রোমশ পাইনের আপাত ভয়ংকর ডাল- এরা কার বা কীসের নেপথ্য? ওই রোমশ পাইনের ডাল দেখে কেন আমার গা ছমছম করে? এসব কখনও তোমাকে বলি না । বলার কথাও নয় । কখনও যদি বলি চারপাশের অদৃশ্য হাওয়ার ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে একদল নরমুণ্ডু হেসে উঠবে। তাদের চোখের চারদিকে সাদা রঙ, ঠোঁটের চারপাশে লাল অথবা কারও শুধু, শুধুই দু’পাটি যাকে ফানি বলে- সেরকম দাঁত। ইঁ করে আছে। তাই আমি কিছু বলি না তোমাকে, যদিও জানি কোথাও না কোথাও কোনও দৈব ঘড়ির টিকটিক শব্দে আমাদের মধ্যেকার দূরত্ব বাড়ছে। তার নীচে দাঁড়ানো এক আগন্তুক। সে নিজের দূরত্বের জন্য আমাদের দূরত্ব মাপছে 

তুমি কখনও আমার নগ্ন পিঠে হাত রাখো । হয়তো খেয়ালবশত কিন্তু আমি, মানে ঠিক আমিও নই- আমার উবু হয়ে থাকা বুকের ভেতরে যে- অন্ধকার, সেই-ই যেন বলে ওঠে এ জীবাশ্ম হয়ে যাবার আগেকার পার্থিব বা নশ্বর সান্ত্বনা। তাই কি? আমি তোমাকে বুঝতে না দিয়ে ওই বক্তা অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করি। ওর ঝুঁটি চেপে মাটিতে চেপে রাখি। যখন ও থরথর করে নিস্তেজ হয়ে যায়, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তোমার দিকে তাকাই। তোমার মাথায় কোঁকড়ানো কাঁচা চুল। ভেসলিন দেওয়া ঠোঁট ঠিক রোদ নয়- অন্য কিছুর প্রতিফলনে বিচূর্ণ হয়ে আছে। হয়তো মাথার দিকের জানালার পর্দার। তোমার আঙুল তখনও আমার নগ্ন পিঠের ঢালে। আনমনা পর্যটকের মতো। যার আলো ও অন্ধকারের ভয়- দুই-ই আছে। নেশা আর হ্যাংওভারের ভয়- তাও আছে। কোথায় কোন ঘড়ি প্রতিনিয়ত আমাদের দূরত্ব বেড়ে যাবার হিসেব রাখছে- কে ওকে একাজে নিযুক্ত করে দিয়ে গেল? আমার ভেতরে এখনও অনেকটাই সরষে তেলের মতো রোদ লাগা তপ্ত প্রান্তর পড়ে আছে। যেখানে দাঁড়ালে আকাশকে আকাশ, দূরের পাহাড়কে পাহাড় এবং উত্তাপকে উত্তাপই মনে হয়। পাইনের রোমশ ডালকে আমি আপাত ভয়ংকর ভাবি, তার কারণ ভয়ংকরের অর্থ আমি জানি। হৃদয়ে শীতল এই যে একা গাছ হয়ে তোমার পেছনে, তোমার অদূরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, তোমার হেমন্ত জড়ানো ছোটখাটো নম্র শরীরটা দেখছি, দুই পায়ের মধ্যে দেহভার পাল্টে পাল্টে বিন্যস্ত করার সময় তোমার চকচকে উপহারের মতো নিতম্ব অবধি যে নড়ে উঠছে- তাও দেখছি 

 

তুমি বল, এসব সত্ত্বেও কেউ কি চা জুড়োবার আগেই জীবাশ্ম হয়ে যাবে

 

ধান

যে দরজাটির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে উষ্ণ আর্দ্র অন্ধকার। অন্য এক প্রজ্ঞার বাতি এখানে জ্বলে, হয়তো কোনও কারণে আজ জ্বলে নি। এরকম কত মানুষের সংসারও থাকে। আজীবনই বাতি জ্বলে না। মৌমাছির ছেড়ে যাওয়া চাকের মতো কক্ষময় এক প্রজ্ঞা হাহাকারকে তাড়া করে শুধু। আমি যে দরজা দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে পায়ের নীচে ম্যানহোলের জল। ছপছপ আমারই পায়ের শব্দ। কত আলাদা আলাদা স্রোত, আলাদা আলাদা বর্জ্য বা ওঠার আগেই গলে যাওয়া চাঁদের হলুদ রক্ত এখানে, এই জলে মিশে আছে। সঙ্গমের পর ছুড়ে ফেলা তার আগের আর্তিময় মুখ, ঠোঁটের জালক কিম্বা অলংকৃত ব্রা- সব এখানে ভাসছে শ’য়ে শ’য়ে পোড়ানো চিঠির মত। তুমি দূরে আছ, বেশ দূরে । অনেকটা প্রান্তর, ধূসর মোমের মতো শস্যের খেত তার আগে। অসংখ্য জলস্থল বা সংকীর্ণ বাঁক। মানবযোদ্ধার বর্শা যতক্ষণ না বিঁধে ফেলতে পারছে ছলনাময়ীর গলা- ততক্ষণ তার নগ্ন পিঠে ছোঁওয়ানো থাকে আগ্নেয়াস্ত্র। ইতিহাস এভাবেই চলে। আসন্ন ইতিহাসও এভাবেই চলে। যাঃ- বলে তুমি একটা ছেঁড়া পল্লব ছুড়ে দিলে। আপাতদৃষ্টে এ-হয়তো শুধুই হর্ষ বা ঠিক শীৎকার নয়, এমন শীৎকার- যা আমাকে লাইটহাউসের সঙ্গ দেয়। হয়তো, হয়তো- বা আমি ঠিক পথেই এগোচ্ছি- এ কথাই বলে 

মোড়কের বাইরেই আমি আমি অথবা তুমি বা তোমার মৃত্যুর পর আরও আরও তুমি। বলিরেখা গালের টোল পিছিয়ে থাকা একটা দাঁত অথবা স্থায়ী পেটের গন্ধ। কতরকম মঞ্জরিত এথিক্সের ডালপালা। কুসুমিত প্রস্তাব এসে বিনা আলোড়নে ফিরে গেল। এমন তো কত মৃতদেহ থাকে। তাকে ঘিরে দুর্নিবার ঘাস ওঠে। সেই ঘাসের ফাঁক দিয়ে যখন মহীয়সী চাঁদের ফালি ফালি আলো কীটপতঙ্গের লালা অথবা ম্যান্ডেবলের গায়ে এসে পড়ে- তখন হয়তো গাঢ় কৃষ্ণাঙ্গ ধানের অযুত অযুত মরশুম। মেপে দেখার নেই কতদূর এগোলাম। ভেজা জংগল, নম্র পাথর ও দু-দশকের জীবাশ্ম হওয়া সব গাইডদের পাশে রেখে উঠে যেতে হবে। এখন যেখানে, সেখানে তোমার স্তনের মাংস শুরু। বাসি চন্দনের মতো তার আকাশস্পর্শী ঘ্রাণ। বড় বড় রেডউডের মতো চঞ্চল বা অতর্কিতে সরে যাওয়া সব শিরা উপশিরা। এখানে মানুষের ধ্যাস্টানো বিছানা পাতা, মাছি ওড়া একেকটা শূন্য গ্লাস এবং চিমনির কাচে কবেকার মরে থাকা মথ। মনে হল এইসব বিছানা, শূন্য গ্লাস বা চিমনির কাচে মরে থাকা মথ যে-দিন জীবিত ছিল- সেটা কোন দিন। সেইসব দিনে কি মানুষ পরিযায়ী পাখির মতো একদেশ থেকে অন্যদেশে উড়ে যেত ? কোনও বিপদের আঁচ পেয়ে আত্মগোপন করত ? সূর্যের ঠাণ্ডা ত্বক দিয়ে কয়েকটা টিকটিকি সাদা সিলিংয়ের দিকে উঠে যায় কেবল

 

পুরুষাঙ্গ

দুপুরবেলায় নিজেদের খুব কাছে একটা কাক ডেকে উঠলে কীরকম যেন শীত শীত করে দু’জনেরই। এই ডাক শুভপ্রদ কিনা আমরা জানি না। তবে এইটুকু জানি শীত যেন হঠাৎ, হঠাৎই এসে আমাদের গায়ে ঢুকে যায়। কবেকার ঠোঁট থেকে আচমকা পলেস্তারা খসে পড়ে গিয়ে যে ভাষায় আর ফিরব না ভেবেছিলাম- সেই ভাষায় আমরা কথা বলতে শুরু করি। কত কথা বলি। ভাবিও নি যে এমন সব কথা আমরাও আবারও বলতে পারব। কথাগুলো যেন আঙুরথোকার মত আমাদের গলা থেকে ঠোঁট অবধি ঝুলে ছিল। বলি আমাদের দেশে নতুন ধান আসার কথা। ভটভটি চালিয়ে চলে যাওয়া অপরিচিত মনখারাপের কথা। জলের নীচে কড়ি খুঁজতে গিয়ে কে কার আঙুল ধরে মটকে দিয়েছিলাম অথচ মুখে তার বিন্দুমাত্র অভিব্যক্তি ছিল না- সেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া কথা। অথবা কাপড় সরে যাবার পর অশরীরী যাকে মনে হয়েছিল- সেই পাশাপাশি দমবন্ধ করা পা দুটো দেখে ভয় পাবার কথা। তুমিও বল আমি কেমন চাক ভাঙা বুনো জন্তুর মতো লজ্জা পাচ্ছিলাম। বার বার ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে ফিরে আসছিলাম তোমার কাছে। বুকে কৌতুক ভরে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল। তুমি শিক্ষয়িত্রীর মতো মতো তখন চেনাতে শুরু করলে কাঁসার খোলের নীচে কীভাবে বেঁচে থাকে প্রকৃত মাংসের স্তন কিম্বা ফসলের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কীভাবে পৌঁছতে হয় খাদের সমান হীরকদ্যুতি যোনির কাছে আর তখন, সে-সময় আমি কীরকম ষাটোর্দ্ধ ব্যক্তির মতো আচরণ করছিলাম আর কালপুরুষ আকাশ থেকে তাঁর সব সহচর নিয়ে, অনুগত নিয়ে এই দু’জন মর্ত্যবাসীর বালখিল্যতা দেখছিল 

আজ অবশ্য অনেকদিন প্রায় বিস্মৃতকাল পরে নিজেদের কাছে এমন কোনও কাক ডাকল। কথা বলতে বলতে আমি লক্ষ করলাম তোমার গালে যে ব্রণের দ্বীপ তৈরি হয়েছিল, তা দূরে চলে গেছে অনেকটাই। কেবল আবছা একটা আভাস আছে। তুমিও বোধহয় দেখছিলে আমার চুল মুছে যাচ্ছে যেন সেখানে একটা হাইরাইজ তৈরি হবে অথবা দাড়ির ভেতরে যে একটা জলাভূমি কবে যেন কীভাবে তৈরি হয়েছে- সেটাও। গলার পেশীতে যে শিথিল গোধুলি নেমেছে- তাও। কথার ফাঁকে ফাঁকে যে দৃষ্টি আমরা আর কোনওদিন ব্যবহার করব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- সেই দৃষ্টিও আবার ব্যবহার করছিলাম। তুমি আমার কলঙ্কের মতো স্তনে হাত রেখেছ। পুরুষের স্তন সেভাবে কি উথলে ওঠে বা দিগন্ত অবধি ঢেউ বিকিরণ করে? এ তো শীলমোহরের মতো। যার নীচে সব অপাঙতেয়, বাতিল বা যা প্রকাশ হবার কথা নয়- সেইসব লিপিবদ্ধ রোল অথবা ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া পুরনো রেক্সিনের ব্যাগ থাকে। আর কিছু নির্দয় শিরা থাকে যক্ষের মতন। ভাবি তোমাকে বলি- বরং পায়ে তোমার পা রাখো। তাতে কাঠে কাঠে লেগে যদি- বা সামান্য আগুনও জ্বলে ওঠে। সেদিকে অনেক দাহ্যবস্তু আছে। অনেক শুকনো গাছ। শুকনো ঘাসের মাইলকে মাইল মাঠ। পরিত্যক্ত চাঁদের জঙ্গল- যেখানে কেউ আসে না। সেসব ধরে গেলে খারাপ কী? হয়তো এই-ই শুভপ্রদ। আগুন ওপরের দিকে সোনালি অজগরের মতো অগ্রসর হবে। একসময় হয়তো দু’জনেই দেখব আশ্চর্য এক আগুন গায়ে টেনে যেসব ভাবি নি, সেইসব কথাই বলে যাচ্ছি আমরা। বাইরে তখন কয়লার মতো রঙ। বিকেলের মুখ অদ্ভুত লাল। সম্পন্ন সব ঘরবাড়ির মাথায় এক একটা নির্দিষ্ট তারা ফোটবার আগে পোশাক ঠিক করে নিচ্ছে 

 

মস

এই যে ঘন দুচোখ দিয়ে তাকিয়ে চোখের সামনে আলোকিত শূন্যতাকে দেখছি, মনে মনে তার গায়ে কিছু ছিদ্র, কিছু ফাটল তৈরি করার চেষ্টা করছি- এও এক বিবিধতা। এই যে পরক্ষণেই ভাবলাম আমার গালে যে অনির্বচনীয় দাড়ি জন্মেছে, সামাজিকতার জন্যে সেগুলোর উৎখাত দরকার অথবা বাইরের ফেমিনিন গেটটির লালচে অলকগুচ্ছের কাছে নিষ্প্রাণ হয়ে একটা সাদাটে বাতি জ্বলছে, হয়তো বস্তুগ্রাহ্যতার বাইরে বহুযুগ থেকে- তাকেও এবার খুলে আনা দরকার। রাত মিশকালো হয়ে নামছে। যত অ-স্বতন্ত্র রান্নাঘর আছে- সেসব এখন প্রত্যেক বাড়ির আলাদা আলাদা মিহি চালের ভাতের গন্ধে বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে অথচ এরা কোথাও কোনওদিন উড়ে যায় নি। যায়ও না। শুধু চুপসে যাবার জন্যে অপেক্ষা করে বা এই যে প্রায় একই সময়ে ভাবলাম কপালের চামড়ার নীচে দপদপ করতে থাকা হিমায়িত যন্ত্রণাটাকে ঘুমের ভেতরে ঢুকে টেনে সরিয়ে ফেলতে হবে- এও এক বিবিধতা। চাঁদের ফালির মতো এই যে কখনও কখনও কী যেন নেই অথবা কী যেন করাই হয়ে উঠল না- এমন নিঃস্বতাগুলো অলীক স্রোতে ভাসতে ভাসতে আসে- সেও কী নয়? কখনো চাদরে মোড়া পায়ের শিখরের দিকে তাকিয়ে দূরদেশের কথা ভাবি বা কখনও সমুদ্রে গেলে কীভাবে সরলরেখায় তুমি আমি হাঁটতাম আর বাতাস গর্জমান হাউন্ডের মতো আমাদের পিছু নিত- সেও ভাবি। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম একটি বাড়ির আলো ভেতর থেকে নিভে গেল তখন প্রশ্ন আসে, এ কি ভেতর থেকে নিভল নাকি প্রায় ত্রিভুজ যে খাঁচা, সেই খাঁচার অন্তর থেকে। অন্তর থেকে কখনও কি কিছু সাময়িকভাবে নিভে যায়? নাকি নিভে যাওয়ার বদলে আত্মগোপন করে? তোমার চুড়ির ঠোকাঠুকি শুনতে পাচ্ছি বা পোশাকের খসখসে হাওয়া বয়ে যাওয়া। থুতনির গায়ে যে দাড়ি তাকে ছুঁলে কখনও কখনও ঝাউবনের মতো লাগে 

খেতে যখন বসব, পা দুটো টেবিলের নীচে প্রায়ান্ধকারে কিছুক্ষণ মুষড়ে পড়ে থাকবে। তোমারও পা থাকবে আমার আড়াআড়ি করে রাখা বিষণ্ণ দুটো পায়ের কাছাকাছি। দুটো দেশের নাগরিকের মতো হৃদ্যতা বা প্রভেদ ওদের। হয়তো কোনও ভাঁজে পোষণ করা চাপা অসহিষ্ণুতাও। অথচ আলোয় যেটুকু দৃশ্যমান সেই কোমরের উপরিভাগ, তারা একইসঙ্গে খাবে আজকের জন্য নির্ধারিত খাবার। বাটি থেকে দুগ্ধস্নানের মতো পীতাভ ডাল ঢেলে নেবে। অন্য হাতে খুঁজবে নুনের পাত্র আর চোখের তেজস্ক্রিয় দৃষ্টি এ অন্যকে মাঝে মাঝেই এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে যাবে। ভাতের উদ্ভাসে চিবুকের দিক থেকে কাছের বা দূরের মনে হতে পারে। খেতে খেতে আমি ভাবতেও পারি পায়ুকাম যারা করে- সেইসব মানুষ বা মনুষ্যবর্গের কথা। তারাও তো এভাবেই গোল শাপলাফুলের মতো একটা টেবিলের প্রান্তে বসে খায়, যে হাতটি ব্যস্ত নয়- সেই হাতে আমাদের মতোই কোনও আড়ালে কুয়াশার মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে নুনের পাত্র খোঁজে। তারপর বেসিনে হাত ধোয়। আয়নায় তাদেরও মুখ নিয়ে তাদেরই আত্মারা দেখা দেয়- যেমন আমাদের। আঙুল দিয়ে যখন ঠোঁট মুছে ফেলি বা কচ্চিৎ দলছুট দু- একটা জলকণা কোথাও লেগে থাকে- একে পরিসমাপ্তি বলা যায়? উষ্ণ পাপোশ কি এই পরিসমাপ্তিতে অন্তর থেকে সায় দেয়? কেন জানি মনে হয় বিছানায় ওঠার পরেই সব দেশ সব সভ্যতা সব রাষ্ট্র সব জাতি আলাদা আলাদা হয়ে যায়। বিবিধ শব্দটা অন্য ভাবে যেন প্রকট হয়ে ওঠে। দেওয়ালে টাঙানো জন্তুর ছালের মতো প্রকট হয়ে ওঠে। নিম্নমুখী মাথায় চোখ, আঁখিপল্লবও। মুখে জিভ, দাঁত শুকিয়ে যাওয়া লালা। নাকের উর্বরে লোম অথচ অ্যাতো বিবিধতার মধ্যে সেই রক্তিম শিরাটি দুই পাড়কে একত্র করে রাখা সেতুর মতো কোথাও, কোথাও নেই। শীর্ষ থেকে মূলত্র অবধি কোথাও অ্যাতোটুকুও নেই 

তবুও-এ পরিসমাপ্তি নয় হয়তো- বা। শুধু আত্মগোপন করে থাকা ওই আলোর মতো

 

প্রদর্শক

কেমন গালের শ্বেতির মতো রৌদ্র ছিল আজ। বিয়ের বয়েস পেরিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলির গায়ে সেই রোদ। অচ্ছেদ্য দাড়ির মতো ঘাসে সেই রোদ। কী ভাবছিলাম মাথা হেঁট করে হাঁটতে হাঁটতে। একটি অশীতিপর অংশে এসে মনে হল এইখানে কখনও একটি আকর্ষক কাঠমল্লিকার গাছ ছিল। সামান্য কিছু ফুল ফুটত ওতে। দেখে মনে হত যেন স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নেওয়া পথ প্রদর্শক। চোখের কোনায় পিঁচুটি নিয়ে সদ্য যে দোকানগুলো জেগেছে, ওরা কেউ-ই সেই কাঠমল্লিকার গাছ দেখে নি। রামকিঙ্করের মূর্তির মতো ওর কোমরের ভাঁজ বা মুচড়ে যাওয়া দেখে নি। গালের শ্বেতির মতো রোদের পাখনা ওদের মুখেও আছে। হড়কে পড়া কাঁচা ডিমের কুসুমের মতো এই যে আরও একটি প্রত্যেকের দিন শুরু হল- তা কোথায় কীভাবে গিয়ে জওয়ানদের ইউনিফর্মের মতো অন্ধকার হবে? বাইশটি জেব্রা আসবে বাদামি অদ্ভুত ঘোড়াগুলির লোভে বা গন্ধে? স্যাম্পেল টেস্টিংয়ের মতো কয়েকটা বাড়ির অন্দরে উড়ে যাওয়া যায় যদি দেখা যাবে মাটির আস্তর থেকে মানুষের মুখ বেরিয়ে আসছে। মুখগহ্বর ছেড়ে পেটের ভেতরে চলে যাচ্ছে একটা বিরক্ত সরীসৃপ। জেলিমাখানো সূর্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে আক্রমণাত্বক কয়েকটি অল্পবয়েসি পাখি 

অ্যাতোক্ষণে তোমার মুখের মাটি কতখানি ধুয়ে গেছে? নিঃসঙ্গ টিলার মতো নাক বা খরস্রোতা নদীর মতো দুইচোখ জেগে উঠেছে কি? অথবা দুই পাড়ের বড় বড় সাদা পাথর আর শালবন? আমি যে কাঠমল্লিকা গাছের কথা বলছিলাম, সেই পথ প্রদর্শক গাছটি তুমিও দ্যাখো নি। আকাশে ভেসে যাওয়া এই জেলিমাখানো সূর্যের আচরণ আজ অনেকটা আহ্লাদি বেলুনের মতো। কেন? আজ কি বিশেষ কোনও দিন? বিশ্বময়তার কোনও দিবস? যেদিন স্কুল- কলেজ বা বরফপড়া সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। বিষণ্ণ কফির কাপ তার গায়ে লতাপুঞ্জে ঢাকা কোনও নোটিশ ঝুলিয়ে রেখে দেবে? ধরো, তোমাকে বলছি- এখন যদি খুব তাড়াতাড়ি ধোঁয়া ওঠা একখণ্ড উল্কার মতো ঘরে ফিরে আসি, গেটের কঙ্কালে টোকা দিয়ে ঘরে ফিরে আসি অথবা চুনাপাথরের মতো এই উঠোনটা খুব সহজেই পেরোই- কী অভিনবত্বের দেখা পাব? বেরিয়ে যাবার সময় যে দরজার শিথিল পর্দাটি আমাকে তার স্তনের স্পর্শ দিয়ে কিছু বোঝাতে চেয়েছিল, সে এখনও করুণ হয়ে দোল খাচ্ছে। চেয়ারে আমার ছাড়া পোশাকের উল্টো পিঠে আমারই রোমকূপ দিয়ে বেরিয়ে আসা সব পিঁপড়েরা ঘুরছে। সারা ঘরে বা অন্য ঘরেও প্রথম আঁচল সরানোর মতো শূন্যতার দিকে চলে যাওয়া একটা জ্বলজ্বলে চোখের কাতর আগ্রহ

এর চেয়ে আর বেশি কিছু নয়, সত্যিই বেশি কিছু নয় 

 

ফুল

তোমার কুন্দনিভ দাঁতের ওপর দিয়ে একটা হাসির স্রোত দৌড়ে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ছে গালের অন্ধকারে, যেখানে তোমার লালা আছে । পেছনের মাঢ়ীর দাঁতেরাও বোধহয় সামনের দৃশ্যমান দাঁতের মতো অ্যাতো সুন্দর কিম্বা সুসজ্জিতও নয়। মুখগহ্বরের ভেতরে যতটুকু সূর্যের আলো যায়, মানুষের দৃষ্টি যায়- ততটকুই তুমি তোমার মতন। যেখান থেকে অন্ধকার শুরু হল, সেখান থেকে তোমার স্বতন্ত্র বলে কিছু নেই। এই যে কী কারণে হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়েছ, তোমার লালাভ মুখগহ্বরের মধ্যে আমার চোখ পৌঁছে যাচ্ছে- এই অবধি আমি তোমাকে হিংসা করি। ঘ্রাণ নেবার বা বোঝার চেষ্টা করি, প্রতিপক্ষ হই তুমি যে কাঁধে হেলে পড়েছ- তার। হয়তো শিকারে যাবে। একটি কাঠের কটেজ তোমাদের আপ্যায়ণ করবে। কটেজের চৌহদ্দিতে দাঁড়ানো একটি মণিময় গাছের দৃষ্টি তোমাদের সবসময় অনুসরণ করবে। না, প্রতিহিংসাবশত একথা বলছি না। পরিচিতির কাঠপুল পেরোলে তো এমনই হয়। হাওয়ার মধ্যে হরিদ্রাভ বাঘের আত্মা জাগে। আমি জানি শিকার থেকে ফিরে তুমি যতই নিজেকে অপরিবর্তিত দেখাবার চেষ্টা কর- তুমি তা নও। তোমার নাম কি সেখানে অনাকর্ষক হয়ে যায় নি? হরিদ্রাভ বাঘ যেমন তোমার পিছু নিয়েছে, তেমনি পিছু নিয়েছে কাঠুরে যুবতীর। পরিচিতির কাঠপুল পেরোলে তুমি শুধু, শুধুমাত্র একটা ফুড কন্টেনার 

কটেজের স্নানঘরে তুমি যখন ব্রা খুলে দাঁড়াবে, দুনিয়া-কাঁপানো কোনও ঘটনাই ঘটবে না। হয়তো ঐ একই সময়ে তোমারই অসংখ্য প্রতিলিপি একই সঙ্গে স্নানঘরে ব্রা খুলে দাঁড়িয়েছে । তোমার বালতির জলের মতোই সকলেরই বালতির জল, আদিষ্ট একটি জরোসরো মগ। জংলা রোদের ছাপ গাছে বা নখের আঁচড় গাছে । কাঠুরে যুবতীর স্তন উন্মুক্ত হয়ে আছে যেমন উন্মুক্ত হয়ে আছে অনেক জলাধারের ঢাকনা । প্রভেদ শুধু এদিকে । কাঠপুলের এ-পারে । অনেক প্রদীপ্ত আলো, উৎসবের তাপ আর চিত্রিত লতার মতো কথায়। এখানেই তোমার প্রেক্ষাপট হয় সপার্ষদ একটি বাড়ি, সুগন্ধি চুলের একফালি, সৈকতের মতো বাহুমূল এবং অন্তর্বাসের আড়ালে থাকা মহার্ঘ অন্ধকার । সভ্যতায় হরিদ্রাভ বাঘেরা থাকে না। থাকে বিসর্পিল সব অলিগলি, চাপা কণ্ঠস্বর মাখা লেন বা একখণ্ড চলন্ত কুয়াশার ভেতর দুলতে থাকা নৌকো। সেখানে কী ঘটছে, কে দেখতে পায়? ব্যবহৃত মানুষ ব্যবহৃত মানুষকে খোঁজে। ব্যবহার্য যোনি ব্যবহার্য লিঙ্গকে খোঁজে। জলাধার ঢেকে তুলে রাখা হয় প্রায় চাঁদের নিকটে। অনেক রাতে কয়েকটা পাখি হয়তো তার গা ঘেঁষে বা ওপর দিয়ে উড়েও যায়। শরীরকে ঘুমন্ত দেখে চাদর হয়তো নেমে চলে যেতে চায় অন্য কোথাও। কিন্তু তখনই কি বিপর্যয় আসে না? সহসাই কোনও মুত্রনালি জেগে উঠে পায়ে স্লিপার গলিয়ে দাঁড়ায়। কেকার মতো অকস্মাৎ জ্বলে ওঠে বাথরুমের সবগুলি আলো 

জ্বলে ওঠে কি না?

হরিণের গায়ে শুধু জ্যোৎস্নার পাতা খসে খসে পড়ে

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment