অনুপম পোল্লে

অনুপম পোল্লে’র কবিতাগুচ্ছ

 

 

শূন্য ক্ষতস্থান

 

প্যাঁচার নির্জনতা বাড়ায় যে নক্ষত্র তাকে আমি ছেড়ে এসেছি-
জ্যোৎস্নায় আধো ডোবা অবৈধ মৃত্যুর লোভে ভালোবেসেছি
বিষণ্ন রাতের জবানবন্দী জুড়ে ছেঁকে ওড়া জোনাকির মতো
ফুটে থাকা তোমার গন্ধরাজ, শৈশবের রঙীন নদী যত;

হারানো বাড়ি-চিঠি-স্নেহ ফিরিয়ে আনে সমুদ্র বারবার
তোমাকে কীভাবে ভোলে শূন্য ক্ষতস্থান
তোমাকে কীভাবে ভোলে কবিতা আমার!

শৃগাল ক্ষুধার্ত হলে রাত্রি বেড়িয়ে পড়ে সম্ভোগ শিকারে;
হুহু মেঘ-চোখে, তুমি আড়াল হয়েছো দীর্ঘ শ্রাবণের ভারে
যেন উড়ন্ত চিলের আদলে ছেড়ে যাচ্ছ প্রতি পিছুটান
যেন পিছু নাও অন্তহীন মর্মরের যা স্বপ্নকে ঘর বলে মানে
আর হাওয়ায় হারিয়ে যায় বিন্দু বিন্দু দেহ -যেন স্বেদ;
পড়ন্ত বিকেল চেয়ে বুকে জমে কত রজনীর বিচ্ছেদ
তখন তুমি প্রকৃত নিরস্ত্র; তখন তোমার এলোচুল-
তখন তোমার ছায়া অরণ্য, শরীরের মতো ফোটে ফুল।

 

 

কালো তিল

 

এবার বুকের কাছে হাত পেতে রাখি দীর্ঘ কাল
এবার সমুদ্র এলে ফিরে চলে যেতে দেবো না
শেষ বিকেলের দামি রোদ ভেঙে ছুঁয়েছে তোমাকে
বিষাদ নেমেছে দেখো ছায়া হয়ে দীর্ঘ মানুষ

সমস্ত জল মাটি অচেনা আকাশ পুড়ে নিষ্ফলা
তোমার কন্ঠস্বরে সেখানেই বাড়ি ও বিশ্রাম
যেন অরণ্য ঘরে এলো বসন্তে, যেন কালো তিল,
যেন কুয়াশায় ঢেকে গেলে এইবার চিবুক ছোঁব

বুকের ভেতর কিছু খাদ কিছু রাত চুঁয়ে কালো হলে ঘর
নদীর গভীর জলে নিয়ে চলো কান পাতবো-
আমরা সবাই ঘাম মেঘ, দেখো ছুঁতে ছুঁতে চমক লাগে
ঘুমের ভিতর সারা রাত হাঁটে শরীরের দাগ

এবার আমার ক্ষত হও- নীল হয়েছে বাতাস
এবার স্রোতের মতো সবুজ তরী ছিনিয়ে নাও
দূর ঘেঁষে সাদা কালো হয়ে সাজে বিগত সময়
যেভাবে কিছু জানালা চিরকাল ছায়া হয়ে থাকে।

 

 

 

শীত ভাগাভাগির সময়

 

আমার সাদামাটা পথ মুছে যায় সমুদ্র সফেনে
যে কারণে চাঁদ ভেঙে যায় প্রতিদিন
উচ্ছন্ন শহরের গায়ে
তোমার হদিশ পেতে চেয়ে,
প্রতি দিশা চেয়ে থাকে ব্যাকুলতা ঠিক যেখানে
কোকিলের গাঢ় নীল ডিমের খোসার মতো
তোমার চলে যাওয়াটাই থেকে যায় ধুলোয় পাতায়
সজনের ফুল ঝরে সেখানে থাকুক
সূর্যের ঢল থেমে সেখানে থাকুক
কুরবানের বিকেল আর কত বেগনী হবে!
তুমি অন্ধকার ভালোবাসো কোল পেতে তাই
শরীর ছিন্ন করে ছায়া হয়ে থাকছি সহজে
বোতামের ফাঁস গলে বাতাস তোমার ঘ্রাণ বয়;
হাতের মিঠে ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠা হাত,
তুমি বসন্তের কথা বলো-
যেভাবে দু’জোড়া ঠোঁট কথা বলে
শীত ভাগাভাগির সময়।

 

 

 

উপলব্ধি

 

নিরুদ্দেশের পথে, যদি না হেমন্তের বিকেল
তার আকাশে তন্নতন্ন করে
খুঁজে বেড়ালো রঙ যেভাবে প্রতিটা গল্প শেষ হয়ে
আসে যখন তুমি সম্পূর্ণ একা
আমাদের মুক্তিও ততক্ষণ সাময়িক,
শুধু মৃত্যুকেই বহন করে চলি দীর্ঘ কাল;

থোকাথোকা ফুল ফুটে চলেছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো
শিকল ভেঙে অরণ্যের বুকে এসে দাঁড়িয়েছে যে কুমারী
তার আব্রু তার কন্ঠস্বর তার ঘ্রাণ হয়ে ওঠে যে নদী
তাকে ছুঁতে চেয়ে কেঁপে ওঠে যে হাত তোমার-
তাকে সীমাহীন লাঞ্ছনায় ছুটে আসে পেয়াদা
তোমাকে ছুঁড়ে দেয় পাতালঘরে যেখানে পড়ে আছে দাদির লাশ,
চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে অস্বস্তি, তাড়া করে শেষ ইচ্ছে,
একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ঈশ্বরের টোপ,কোথাও একটা আলিঙ্গন
যেমনটা তুমি বাবার কাছে চেয়ে কখনো পেলেনা
বুঝে যাও ভাগ করে নেওয়ার মতো সময় কেন এত ক্ষীণ,
আর তুমি জানো রক্তে বেড়েই চলেছে দীর্ঘশ্বাস যাতে
শিরা ছিঁড়ে নিলেও, জানো, এই দিকভ্রষ্ট শূন্যতা এই
গোপন বিষের জ্বালা ছাড়া কিছুই নেই শৈশবটুকু নিংড়ে;
তুমি কথা বলতে চাওনা তুমি কথা বলতে চাওনি
শুধু মৃত্যুকেই বহন করে চলো দীর্ঘ কাল।

 

 

 

 

আগুন

 

আকাশ কম্পাসে মেপে ভেঙে যাচ্ছে ঘোড়াদের ছায়া
কুয়াশায় শার্শী ভিজে যায়; হিম হয়ে থাকে বিষণ্নতা

একটা দেশলাইয়ে লুকানো থাকে ততটা আগুন
একটা ম্লেচ্ছ-পাড়া পুড়ে যেতে পারে অনায়াসে

মৃত্যু লক্ষ্য করে ছুটে যায় দমকল গাড়ি
বই-খাতা পোড়ে দেখো মুখ বুজে তোমার মতন

উড়ে যাওয়া শাড়ি ছুঁতে পা বাড়ায় রক্তাক্ত মেয়েটা
যেন মিটে গেলো তার জলপরী হবে-হবে-সাধ

কুড়ানো পরিচয় খুঁজে হাঁটতে নেমেছে ছেঁড়া চটি
এভাবে বৃত্ত শুরু, কেন্দ্র বদলে যায় বারবার

অদূরে ছোট্ট থানা, ভিডিও চলছে শিকারের
হঠাৎই মৈথুনের টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেছে সমারোহে

আগুনের আঁচ গায়ে শহর গিয়েছে সুখী ঘুমে
স্বপ্নিল ঠোঁট বেয়ে লালা মিশে যাচ্ছে নদীতে…

 

 

 

 

আদিম ঢেউ

 

বেলা পড়ে এলে আমাদের জানালায়
শব্দের খোঁজে সমুদ্র এসে যায়;
পর্দার গায়ে নোনা বালি গুঁড়ো গুঁড়ো;
আমার চিবুকে ঝিনুক-স্তূপের চূড়ো।

যে সব গল্পে নারীরা বেঁধেছে জাল,
পতাকারা ছিল কাঁকড়ার মতো লাল,
সে সব গল্পে তুমি ছিলে যার মেয়ে,-
সাগর এনেছে বেঁধে সে’ই গান গেয়ে।

যে সব স্বপ্নে আমরা মিথ্যা নই,
আমাদের গান, গল্প, আকাশ, বই,
সে সব স্বপ্নে সন্ধ্যে নামার পর
আমাদের বুকে জমে থাকে বালুচর।

বালুচর জুড়ে অচেনা কথার ঢেউ
তুমি আমি ছাড়া আর জানবেনা কেউ।
রাতে চাঁদ এলে নোনা হাওয়ার পাড়ায়
ঢেউ আসে, ঢেউ ভালবাসা হতে চায়।

 

 

 

 

জন্মদিন

 

সোনার চুলে বুক ঢেকেছে রোদ
আগুন থেকে জন্ম নেওয়ার ভিড়ে
তোমার নামে ঘর কেটে কিৎকিৎ
ঘাসের আগায় জমেছে শীত ধীরে

তুষার হয়ে পালক ঝরে আসে
দূরের সুবাস যাচ্ছে কিছু চেনা
সন্ধ্যা হয়ে আছে তোমার গায়ে
চোখ তুলে কেউ তাকাতে পারছেনা

ঝরা পাতায় হারিয়ে গেলে পথ
আকাশ থেকে ধার করা আশ্রয়
হাওয়ার রাতে জ্যোৎস্না মেখে নিলে
দুয়ার ভেঙ্গে লক্ষ্য দেখা যায়

অবশিষ্ট রাতের আলো এসে
মিশিয়ে দিলো যা কিছু পৃথক
তোমার আমার উড়ান বাকি তবু
শব্দে ভিজে যাচ্ছে ঠোঁটের ত্বক

তৃষ্ণা জমে আছে আকন্ঠ
শিশির মেখে ঘুমিয়ে গেছে কাক
ফুলের বনে পাপড়ি খোলো তুমি
আজকে তবে জন্ম নেওয়া যাক।

 

 

 

পরী

 

বিদ্যুৎ চমকানোর অমোঘ মুহূর্তে আয়নায় ঢুকে গেলেই
জানতে পারবে পরীর ডানাও ঠিক প্রজাপতির মতো
সবকটি কাঁটাতারে লেপ্টে আছে তার আঁশ,
আকাশে তারা নিভে গেলে পরে তার সারা বুক জুড়ে
জ্বলে ওঠে জোনাকির ক্ষত
যার আলোয় বৃষ্টি থামার পর কোমরে ঝলমল করে কাঠগোলাপ
মেঘ চিরে রোদ এলে কথা বলে ওঠে তার ছায়া তার ঘ্রাণ,
শূন্য রেল-স্টেশনে দোলনা দিয়ে তৈরি তার ঘরে
অন্ধকার নেমে এলে সে মুছে নেয় ঊরুর বিষাদ,
প্রতিটা বাতিঘরে জ্বেলে রাখে সমুদ্রকপোত
আর প্রতি ফুলমন্থনে উঠে আসা বিষাক্ত লালা
সে ছড়িয়ে দেয় দেওয়ালে দেওয়ালে
যার নাগাল পেতে ছুটে বেড়ায় পিছিয়ে পড়া দিন
অথচ তুমি জেগে উঠতে চাও কোনো দুর্ঘটনায়
যাতে তোমার সারা শরীরে লেপ্টে যায় তার কাজল
যেভাবে ঘাসে ঘাসে ধাক্কায় টুকরো টুকরো হয়েছে জ্যোৎস্না।

 

 

 

আমাদের ঘর

 

প্রতি রাস্তা আমাদের টেনে নামায় নীচে, যেদিকে খাদ।
শরীর চিরকালই পরিশ্রুত খনিজ,
নোনা সমুদ্রতল রাস্তা করে নেয় বুকে শুয়ে।

মেঘে মেঘে ঘর-বাড়ি ভাঙে; বাতাসে বাতাসে নিম্নচাপ,
শিথিল হওয়ার রাত নারীদেহে খুঁজে নেয়
জেরবার করার পৃথিবী।

কেউ ভেলকি দেখাবে ভেবে বসে আছে সবাই দর্শক
পানশালায় ছুরি দিয়ে হাত কেটে নিচ্ছে সময়,
গ্লাসে গ্লাসে ভরে গেছে পাতা ঝরার রূপকথা;

মৃত্যু-কামনার রঙে জ্যোৎস্নায় ভিজে হাসে বিবর্ণ শহর
যেন জুয়া হেরে বেখেয়ালে ধরা পড়ে গেছে
তবু বুনো শাল জানে প্রিয় ঘর শূন্যতার;

যে ঈশ্বরের কাছে আমরা ভুলে যাই ভীরু যাতায়াত,
সাবধান! তার পোশাক পরে রাজা হওয়া যায়
ভেবে প্রত্যেকে খুলে রাখছে মুখোশ,

সবাই ভাব করছে যেন আগুন জ্বলে না পথে পথে;
বাতাস মুখরিত হয় কুঁড়ি ফোটা মাংসের ঘ্রাণে-
আমাদের ঘর খুব কাছে এখানেই ।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment