অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়-এর কবিতাগুচ্ছ

প্রকৃতি, পরমা

এক
নিজেকে পড়তে পড়তে প্রতিবার
খুঁজে পাই নদীর ওপর ঝুঁকে পড়া গাছ বেগুনী বেগুনী ফুল, কালচে পাতায় ঘুম, মৃত্যুজটিল ফাঁদ।
আমার আঙুল সেই গিঁট খুলে খুলে ঘুম দিতে চায়।
অবিন্যস্ত মায়া থেকে কাচপোকা বেছে রাখে
কলসির অতল গভীরে, গর্ভগৃহে।
ভেজা গামছায় ঢাকে গতরাত্রের পান্তা ডোবানো টকজল।
কোথাও বৃষ্টি এলে এ পাড়ায় নদী ফুলে ওঠে।
কাত হয়ে থাকা নৌকোর খোলে স্যাঁতসেঁতে শীতলপাটির খুলে যাওয়া লেখার পাতার মত অবিকল। পান্ডুলিপির গায়ে জমে ওঠা বাস্পবিতান, মেঘপুরাণের ইতিকথা, জলভারনত অক্ষরমালা।
সন্ধ্যাসকাল তবু দেওয়ালের কাছে যাই
অভ্যেসবশে।
জানলাবিহীন তার দৃষ্টি ছাড়িয়ে উঠে যাওয়া কতদূর, দেখি!
ওইপারে বেড়ে ওঠা চারাগাছে ফুলফল নেই, ফলত: বাতিল—

অবয়বহীন—তাই হাওয়াকে চিনিনা
দমবন্ধ মৃত্যুর আগে তাকে
জড়াতে চাই না কেউ কখনো ভুলেও

 

দুই
অসহনীয় ব্যথা থেকে ক্রমশ আলাদা ইন্দ্রিয়পরায়ন জেগে থাকাগুলো।
শূন্যের ভিতর নামিয়ে দড়ি ছেড়ে দেওয়া ওই হাত
যাকে বিশ্বাস করে অতলের দিকে নেমে গেছে ঘড়া
আর ডুবে মরে গেছে বারবার,
ইতিহাস বইয়ের আড়ালে।
কত শত আয়োজনের বিভায় ধরে রাখছ মুহূর্তের বিস্ময়
আর সেই অবসরে দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠছে সময়—

 

তিন

নিজেদের তাড়া করে করে হাতঘড়ির ভিতর ঘুমিয়ে পড়েছে দ্যাখো বড়কাঁটা ছোটকাঁটা
তাই এত ঘুম সুনিবিড়, এই অবেলার?
অথচ জেগে থাকার ভিতর একটা গাছ নিজস্ব রাজ্যপাট নিয়ে এতদূর চলে গেল। করোটির অন্ধকারে পাপড়ি সাজালো। বিচ্ছেদপর্ব লেখার ব্যস্ততায় অন্ধ আঙুল সেসব লক্ষ্য করলো না এরপর আর। একঘেয়ে বৃষ্টিপতনের গায়ে জড়িয়ে থাকা লতাপাতা পচনের সূত্র মেনে ক্রমশ পিছল। ক্ষীরদই হলুদ ও হাতপাখা মাথায় ভিজে যাচ্ছে মায়ের লালপেড়ে শাড়ি সেই কবে থেকে! আমি ত সমাপনবিন্দু খুঁজিনি কখনো এই ঋতুমোহে। পুতুলখেলা সামলাতে সামলাতে মাটি মাখি, জল মাখি, জঙ্গল মাখি।
দেখি —মৃত বেড়ালছানা বুকে আগলে মা ষষ্ঠী এইমাত্র অরণ্যে প্রবেশ করছেন।

 

চার

হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছি এইবার আর লক্ষ করছি যা আঁকড়ে ছিলাম তা আসলে নিজেরই করতল।
পিঠের ওপরের স্পর্শ ধাতব, তীক্ষ্ণ
শলাকার মত উপড়ে আনছে হৃপিন্ড
সাজিয়ে রাখছে সুস্বাদু খাদ্যতালিকায়।
কোথাও কোনও মেঘ ছিল না এইসব কাটাকুটি খেলায়…

খর রৌদ্রে পুড়ে তামাটে মুখ মানচিত্র

রঙিন নিশানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
খেয়াল করিনি পায়ের কাছে হাঁ-হয়ে থাকা মৃত্যুফাঁদ, ঘন সুড়ঙ্গ, জটিল গোলকধাঁধা…

সব চিঠি পৌঁছবে একদিন এই ভেবে বয়স্ক হয়ে যাওয়া শিশুটি জানেনি
ভুল ঠিকানার খাম ডাকঘরে পড়ে থাকে গন্তব্যহীন

অপেক্ষার দিক থেকে যে নদীর বয়ে যাওয়া, তাকে ছুঁয়ে থাকি
ফুল কুড়োতে আসা ছেলেমেয়েগুলো কবে যেন বনস্থলী হয়ে ওঠে, নিজেরাই

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment