অনিতেশ চক্রবর্তী

অনিতেশ চক্রবর্তী’র কবিতাগুচ্ছ

 

 

নেহাতই কবিতাগুচ্ছ

 

যে নক্ষত্র নিভছে, আমি তার সুড়ঙ্গের মুখে
ওরা আতর মাখাচ্ছে চাদরের গায়ে। জয়দেব
নদী বয়ে যাক, বয়ে বয়ে যাক, ও ছাতিম
গন্ধে প্লাবিত দৃষ্টি কে নেবে? কত সুর, মন্ত্রগুপ্তি
আমি লিখে গেছি সব, স্বরে ভুল নেই
ঘুঙুর বেঁধে কে নামল মাটিতে! থামো, এই তাল
এই লয়, জন্ম, উপত্যকা, আমাদের। এর সব কথা
জেনে গেলে না-হওয়া বাসায় রোদ খেলবে না
যে মাদুর ভিজছে, আমি তার ভিতরে গোটানো
ওরা গুছিয়ে নিয়েছে সব– নাম, বাস্তু, যতি–
জ্বরে জল আসে অঙ্গে, নক্ষত্র সাক্ষী, অসহ্য
বিস্ময়ে ছটফট করতে করতে আমি নেমে যাচ্ছি
সুড়ঙ্গের মুখে আর শুনছি, ‘বুবুল, বুবুল,
এই তো দরজা, আলো, যেটুকু আমাদের…’

 

 

শাড়ির নিকটে এক টান, সে আমার আবাল্য পাপ
মাকে দেখে লোভ হত, মায়ের মতন কেউ হোক
যে আমার চুল পাবে, নাক পাবে, আমি যার ঘ্রাণ—
আমি যার গলি ধরে ছুটে যাব দু-দুটো বছর
থামব না যদ্দিন সুতো কেটে যাবে অন্য পাড়ায়
সেখানে রঙের কাছে কেউ ঘোর বহুরূপী, কেউ
হামেশা ভেঙায়, ব্যোম ভোলা, ল্যাল ল্যাল ল্যাল
মেরে মুখ ভেঙে দেব, আয়, বাঁড়া, বেহায়া কুকুর
আমাকে ভেঙাবি! পালানোয় তোর থেকে দড়
আমি, এই গলি ধরে ছুটে যাব দু’দুটো বছর
দাঁড়াব না, যদ্দিন মায়ের মতো কেউ
যে আমার চোখ পাবে, বাসা পাবে, আমি যার ঘ্রাণ
চিনে ডুবে যাব নরকের বীভৎস রোদে, আর সেই শাড়ি
আমাকে জড়িয়ে নিয়ে ভেসে যাবে অন্য পাড়ায়

 

 

চাঁদের সমীপে ঘুরছি, তারাশিলা স্থাপিত স্বঘরে
মোটা আতপের চাল ভেঙে খাই, এক নারী থেকে
অপর শ্মশানে যারা অগ্নি বাসা দিল, হাতে দিই
গূহ্য সুরস্বাদ, সামান্য যতি, সুধা, আমার কলিজা
অবশেষ। এ গেহ ত্যাগের আগে কোনও মৃত্যু
বাধা মানছে না– তরল নদীর মতো রতিভাব
সেও ছেড়ে গেলে, তোমাকে খবর দেব–
বেঁচে থেকো প্রিয়, ততদিন

সাধুসঙ্গ ঢের হল। এবারে চাঁদের ঘরে ভাব–
ভাবের অতলে পুড়ছে আসমুদ্র নূরের জমিন
যৈছেরে বিজরী, তুমি অঙ্গ দাও সঙ্গে দাও সুর
সামান্য চাউল দিও ক’রাত্র খাইনি কিছুই
অঢেল ক্ষুধা হে চাঁদ, গোটা আমি পাক হয়ে যাই
যে পাত্রে ঢালছ সেথায় রঙ নেবে আলোর শরীর
আমাকে খাওয়ার মতো সুখ আর কোথাও পাবে না

অভিশাপে শিশুলাভ, আশীর্বাদে বংশলোপাট
কী অসহ্য লীলামোহে ডুবে গেল রসনাভৈরবী
তুমি মিছে উন্মাদিনী, আমি ঘোরে অঘোরপাতক
নদী বয়েছে যখন যেতে দাও, বুক জ্বলে গেল
আমাদের কোনও সাড়া না পায় যেন-বা প্রতিবেশী

 

 

মায়ের নিকটে ডাকলে, আমি বেঁচে উঠলাম, বুবুল
নইলে কী হত আমার! সামান্য বিকেলে আজো
রোদের পালকে সোনা গেঁথে যায়, দেহে জল আসে–
এসবই বীজের প্রাণ! এমন সবুজ আগে
আমাকে দেখেছ! ছাল-চামড়া নেই, হাসছি

আর তোমাকে দেখেছি প্লাবনের মতো
দূরত্ব দেখিনি, কিছুতেই। কী বীভৎস স্বপ্ন
বুবুল, তিতকুটে শীত গলা টিপে ধরে, আমি
কার কাছে যাব! বলব, ছাদ নেই, বলব,
আমাকে সে ভুয়ো কক্ষপথে ঠেলে দিল!
মুক্তির মতো নকল বিশ্বাস শেখাল আমাকে…

এসবই ভ্রান্তির কথা। চিরকাল বলে কিছু নেই
দূর থেকে ঘন, কাছাকাছি গেলে কত ফাঁক
জঙ্গল জঙ্গলে ঘোরো, দেখেও শেখোনি এতদিনে!
কোনো গাছ মরে যেতে যেতে অক্ষয় করেছে ছায়া!

কিছু ভ্রম শ্বাসপ্রদায়িনী, কিছু মিথ্যে মায়ের মতন
কিছুদিন থাকবে, ভুলে, অসুখে, গাছের আশ্রয়ে
আমিও তো এর বেশি চাইনি কিচ্ছু কোনোদিন
যা শুনলে তোমার সব ডুবে যাবে অন্ধ কুয়োয়
কুয়োয় অগাধ শীত, শীতের ভিতরে ডুবো ভয়

এই যে ডাকলে, বুবুল, আয়ু ফিরে এল।

 

 

ভরা আবাদের মাঝে ভুল গান কেন গাস, মাছিমল!
কে তোর গানের ফাঁদে ডুব দেবে সুড়ঙ্গে আবার!
ভুলে আছি, এর চেয়ে ভালো থাকা কপালে সইবে না।

খোদায় মালুম, কবেকার কথা ভেসে আসছে
বাদার, চৌপাটে নেশা তক হয়ে গেল বাঁশুরি কা ধুনে
রাজরাপ্পার জঙ্গলে আজ নূর
অজ্ঞাতকুলশীল কেউ কালাম দিচ্ছে, সারা রাত ধরে
সহসা চাঁদের থেকে আরও এক চাঁদ
নেমে আসছে মধুর মাটিতে

সে অনেক দূরের গল্প। দূরের দেশেও কত গান থাকে
কত গূহ্য ঝোঁক, তারা, তাহাদের কথা বলছে
জন্মান্তরে আর যে-ভুল হবে না, তার কথা–
সংসারী কি তাতে শিক্ষে পায়!
আলো ধোয় লোলুপ তালুতে!

জ্ঞান মুখ্যু, মাছিমল, ভুল গানে যে দেহ জাগবে না
ওই চিমসেপানা নদী, বৈকুন্ঠ ছোঁয়ার আগে
মরে যাবে।

 

 

যে-সময়টা মাঠে লাট্টুর মতো ঘুরত, তার মধ্যে
গৌতমদা ঢুকে বসে আছে। অঝোরে বৃষ্টি, ঠাকুমা খেলার ভিতর
মাথা গলিয়ে দিচ্ছে বারবার। রুমেলা নাম্নী পাগলি
এখনও ফেরেনি। তার কি পায়ে গুলি লেগেছে! বরের দেহ পুলিশ

পোড়াতে দিল না। সন্ধের পর
ওই ভাঙাঘাটের ডোম ভিজে যাবে পরীদের
লালায়, চ্যুইংগামের মতো কাদা হবে
বাবার সাইকেল নিয়ে আমি সেই পাঁকে পাক খাচ্ছি,
এর ওর হাত, কাটিয়ে, সুপুরি গাছের নকশা–
সুজয় লেগস্পিন ছাড়ল, ওহ!
ওই আকাশ আবার নেমে আসছে মিনারের চুড়োয়– ঘুর্ণি!
কত ঘর ঘুরে গেল, কত ভাগ্য, কত দেশোয়ালি দোস্ত
ঠাকুমা খেলার ভিতর ঢুকে খুঁজে যাচ্ছে রুমেলাপিসিকে
ওহে গৌতমদা,
তুমি সেই লাট্টুর থেকে আজও বেরোতে পারলে না!

 

 

এই ভিড়ে কতজন প্রতারক মিশে আছে!
আমি যে খাদের পাশে, কারো কিছু আসে-যায়, ঘুম উড়ে ছলকে

পড়ে পাশের নদীতে?
তবুও তাদের কথা শুনে যেতে হবে!
যাহার সমস্ত গেল, তাহার না আছে রাঘব, না সংঘ
তোমার শরীরে এলে ঘুম পায়, এ কথা জানলে
বাবুদের উদ্দাম লালায় ঘর-বাড়ি লাট হয়ে যাবে

ভিড়ের সমস্ত কথা তোমাকে পাঠিয়ে রেখেছি

 

 

অযথা কঠিন করে লিখছি মনে হয়
সংকট তো একাকী আসে না, একান্নবর্তী যত ভয় গিলে খেতে আসে
এসবও সহজে লিখব!
সহজে কে যেতে পারে, তুমি যাবে?
সীমানা পেরোলে যেন কপোতাক্ষ নদী অপেক্ষায় শীর্ণ থেকে শীর্ণতর
মাতৃঘাতী আগুন এসে হাউহাউ কাঁদছে উঠোনে–
এতেও ব্যয়ের গল্প, গল্পের ভুলে কত দেশ পিছলিয়ে পর হয়ে গেল।
কত ভয় দল বেঁধে খেয়ে নিল রাতের কলোনি
এসবও সহজে লিখব!
সহজে কে যায়, তুমি যাবে?

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment