হিন্দোল ভট্টাচার্য

হিন্দোল ভট্টাচার্য’র কবিতাগুচ্ছ

 

অস্ত্র

 

যেখানে দাঁড়াই, দেখি, মূর্তিগুলো ভাঙা, পড়ে আছে
যুদ্ধে মৃত সৈনিকের রক্তমাখা শরীর যেমন।

চকচকে ধারালো অস্ত্র দিনে দিনে মরচে পড়ে যায়।

প্রতিটি মূর্তির কিছু কথা আছে, জানেন ভাস্কর।
প্রতিটি অস্ত্রের থাকে বেদনা, বিষাদ।

ক্ষতস্থান থেকে শুধু রক্ত পড়ে। রক্ত, প্রাণ নয়।

ভাস্কর জানেন, তিনি কার মূর্তি গড়তে গিয়ে
কাকে গড়ে তুলেছেন একা।

যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে পড়ে থাকে তার ক্ষয়।

 

 

অভিশাপ

 

যে বিষাক্ত হয়ে আছি, এই বিষ তোমাদের দেওয়া।
আমার ওষুধ নেই, অপমান আছে।
মনে হয় এ কথাটি বলেছি আগেও;
মনে হয় খোকা খোকা মুখ করে কেঁদেছি অনেক।
তবু বিষ হয়ে আছি, গায়ে জ্বালা, ফোসকা চারিদিক
ভালো লাগে তবু, ভাবি, কেন এতবার তুমি মেরেছ আমাকে?
আমার কলম থেকে প্রতি শব্দ অন্ধকার শীত ত্রিভুবনে
কোথাও ঈশ্বর নেই দেবতায়, তোমাদের কাছাকাছি গেলে
কিছু তো সাহস হত, কিছু ফুল ফুটত আঙিনায়,-
এখন বিষাক্ত লিখি, আয়ু থেকে লাফ দেয় আয়ু চিরকাল
যেভাবে চোখের সামনে ছায়া অন্ধকার হয়ে যায়।

কেন এত রক্তদাগ লেগে থাকবে বলো এই খেরোর খাতায়?

 

 

 

শিশুশিক্ষা অকাদেমি

 

জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়ছে ওপাড়ার সভ্যতার আলো
ঝাপসা কতদিন হলো সেলাইফোঁড়াইগুলো আজও
আমাদের ভাঙা ঘরে ঢেউ তুলে সহিস হলো না।
তাহলে কি সূর্যোদয় হবে শুধু ভাড়াটে-পাড়ায়?

শুনেছি খিদের ঘরে হাসি ও বিষাদ মিশে যায়
মুখ খুলতে গিয়ে কেউ চুপ করেই থাকে আজীবন
এত আলো মেখে মেখে হাড়মাংসে ধিকিধিকি ধোঁয়া
বুঝি, চোখ খুললে ওরা প্রজাপতি হয়ে যেতে পারে।

আমাদের আছে শুধু পোলাপানে মুখর আকাশ
পাশেই ছোঁ মেরে ট্রেন পাতালে গুটিয়ে ফেলে ডানা
আনন্দ লেখার কথা তবুও সন্দেহ নিয়ে ভাবি
কে এত রক্তের ছিটে দিল আজ মোচার খোলায়!

জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়ছে ওপাড়ার সভ্যতার আলো
আমাদের ঘর ভাঙে, উঠোনে ডিগডিগ করে লতা
ভালো-মন্দ নাম ধরে ডাকতে গিয়ে বুঝি, অন্ধকার
আমার অসভ্য দেশে তোমাদের করুণার মতো…

 

 

 

তক্ষক

 

নিশীথে, ধানের ক্ষেতে এসে বসে স্রোতস্বিনী রাই
জলের ইচ্ছার পাশে এতদিন কে ছিল কিনার?
চাঁদের আশায় সেও বুড়ো হয়ে গিয়েছে বাগানে,-
কে যেন দিয়েছে প্রেম, কাঁঠালের আঠা হে বাউল
এ জীবন পদব্রজে ধন্যবাদ জানানো কৌশল।
খিলখিল শুঁটকো হাসি, হাঁ করে বাতাসটুকু নিয়ে
বিবাহের জন্য কিছু বিজ্ঞাপন দেওয়ার বয়ান।
নিশীথে, ধানের ক্ষেতে এসে বসে স্রোতস্বিনী রাই
মহারাজা আসিবেন সিংহাসনে টাইমবোম রেখে
পাগল-পাগল চোখে কে জানায় সবুজ সেলাম?
এত নৌকো নয় ডুব চারিদিকে পুরস্কৃত মুখ
কী আলো হালুম শব্দ, বনে বনে রক্তমাখা চাঁদ
এমন জীবনদায়ী বাঘভালুক অতিথি ঘনালে
একটি পয়ার লিখে যদি কেউ আত্মহত্যা করে?

মৃত্যু কি ধানের ক্ষেতে অশরীরি লাঙলকিশোরী?

 

 

 

খরা

 

আগুন, তোমাকে দেখি সুন্দরের বিধবা দুহাতে;
এত যে নির্জন পুড়ে যাওয়া তার কাছে এসে বসি।

বসি,- তবু একটূ খানি সরে যাই, আমাদের মাঝে
রূপসী শস্যের ক্ষেতে ঢুকে পড়ে পরকীয়া পাখি।
যে নদী শুকিয়ে যায়, তারও খাত বিরহপ্রবণ।

এত যে ফাটল ধরে তলায় তলায়, তারও মুখ
দেখিনি কখনো, ভাবি কতদূর পোড়াব দুহাত!

আমার কৃষকধর্ম বীজ পোঁতে সামান্য গোপন…
যে মুখে একদিকে খিদে, তার অন্যদিক তবু পোড়া-
আমারও তো ভাঙা কুলো, দুহাতেই মাটি ধুলো ছাই…

আগুন নিজেই আরও ভস্ম হয় আগুনের কাছে

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment