শংকর লাহিড়ী

হার আর্মস ফুল অফ ফ্লাওয়ার্স : ওয়াইন, পারফিউম ও কবিতার গঠন সম্পর্কিত একটি গবেষণা  

 

১. 
এ জীবনে, বস্তুগতভাবে, অনেকের মতো আমারও দুটো প্রিয় জিনিস হলো মদিরা ও আতর– ওয়াইন ও পারফিউম। দুটোই ফরাসী, প্রধানতঃ। খাঁটি ফরাসী সুগন্ধী ও ফরাসী ওয়াইনের স্বাদ-গন্ধ মাত্র কখনো আমি পেয়েছি
সেই থেকে মনে হয়েছে, সমর্পিত হওয়ার জন্যে এর চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে। ফ্রান্স ও ইতালির সেইসব মাইল মাইল বিস্তৃত রৌদ্রকরোজ্জ্বল আঙুরের খেত– বার্গান্ডি, টাসকানি ! ‘স্টিলিং বিউটি’-ছবিতে বার্তোলুচ্চি সেই টাসকান ভূখন্ডের এক ঝলক  দেখিয়েছিলেন।   

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, মৃত্যুকালে যেন মুখে কিছু চিনি নিয়ে মরি। কেন যে চিনির মিষ্টত্ব ইচ্ছা করেছিলেন জানি না। তবে মদের উল্লেখ করেননি। শুধু একটু মিষ্টিমুখে মরে যেতে চেয়েছিলেন, আহা। তবে আমার পছন্দ আলাদা। যদি কোনও দিন স্বপ্নের মতো মৃত্যুর আয়োজন হয়, তবে মৃত্যুর আগে লাস্ট সাপারে, শেষ সময়ে যেন একটু রেড ওয়াইনের সুস্বাদ মুখে লেগে থাকে। এবং যেন নাকে ভেসে আসে কোনও সুরভি। যুঁই, বকুল, বা রজনীগন্ধার মতো কোনও একরৈখিক সুগন্ধ নয়। চন্দনের গন্ধও নয়। এগুলোর সাথে কতবার বোড়ালে বা কেওড়াতলায় বা সুবর্ণরেখার শ্মশানঘাটে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে যে, এইসব গন্ধ আমাকে হতাশ ও বিষণ্ণ করে। এবং আমি কিছুতেই হতাশা নিয়ে মরতে চাইনা। প্রকৃত প্রস্তাবে, আমি এই আশা নিয়ে শেষ বারের মতো মরে যেতে চাই যে, এই পৃথিবী ক্রমশঃ সুরভিত হয়ে উঠবে। বরং আমার ভালো লাগে শিউলি ফুলের গন্ধ, যার সাথে স্তরে স্তরে শিশিরে ভেজা ঘাসের গন্ধ আর নরম রোদের গন্ধ জড়াজড়ি করে থাকে। সেই গন্ধে শিহরণ ওঠে বাংলার সবুজ প্রান্তরে। ‘আজি মাঠে মাঠে চল বিহরি, তৃণ উঠুক শিহরি শিহরি’। এবং সেই সৌরভ যেন উৎকৃষ্ট কবিতার-ই মতো, যা একরৈখিক নয়।   

ফরাসী পারফিউমের মধ্যে আমার প্রিয় : হিউগো বস, পাকো রাব্যান, ওপিয়াম, জিভঁছি, নিনা রিচ্চি, বোগারী, ইভ সাঁ লরঁ। এরা সকলেই বিমোহিত, গুঞ্জিত, সমর্পিত ও প্রবলভাবে আসক্ত হওয়ার মতোকখনো গভীর স্বেচ্ছাচারী, অপ্রতিরোধ্য ও  রহস্যময়। তবে বহুপ্রশংসিত ‘শ্যানেল নাম্বার ফাইভ’ আমাকে কিছুটা হতাশ করেছিল ; জানি না, আমার নিজের স্নায়ুবিকারও হয়ে থাকতে পারে। বিকারের কথায় মনে পড়লো, একবার লন্ডনে হিথ্রো এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপে, ‘খ্রিশ্চান ডিয়র’ [Christian Dior] পারফিউমকে ‘খ্রিশ্চিয়ান ডাইয়র’ বলায় কাউন্টারে কালো স্কার্ট পড়া অসামান্য রূপসী তরুণীটির কি খিলখিল হাসি। সে আমাকে নির্ঘাৎ এক উজবুক ঠাওরেছে।  আসলে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, কার্বন-ডাই-অক্সাইড পড়েছি। আমার কাছে ডি-আই মানে, ডাই ; সেই সুত্রে ‘ডাইয়র’।                                       

২. 
কবিতার কি কোনও বিষয় হয় ? এই অবাক প্রশ্নটা কবিতার সাথে জড়িয়ে আছে কয়েকশো বছর, বা বলা যায় কয়েক হাজার বছর ধরে। কী বলেছেন প্লেটো, অ্যারিস্টটল ? কী বলেছেন মালার্মে, ভালেরী, এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, আইয়ুব সাহেব, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, বা স্বদেশ সেন ? এছাড়া আছেন সেই কালুবাবুরাও, যার উল্লেখ আছে উৎপলকুমার বসুর কবিতায় : “যতদিন কালুবাবু জীবিত আছেন, চিন্তা নেই বুঝে নেব রক্তকরবী”। কবিতার এই ‘বিষয়’ আজও লিটিল ম্যাগাজিনে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়। হ্যাঁ-পন্থী এবং না-পন্থী। হ্যাঁ, বিষয় আছে। না, বিষয় নেই। হ্যাঁ, আছে। না, নেই।  হ্যাঁ। না। আমার মতে বিষয় একটা সূক্ষ্ম তন্তুজাল, যা কবিতাকে আলতো হাতে ধরে রাখে। স্বদেশ সেনের মতে বিষয় একটা হ্যান্ডেল, যা দিয়ে কবিতাকে আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। 

এছাড়াও প্রশ্ন আছে। কবিতা কি নির্মাণ, না সৃষ্টি ? বারেবারেই ঘুরেফিরে আসা এই প্রশ্নটিকে আমি সম্ভ্রমে এড়িয়ে গিয়েছি। এই নিয়ে অনেকে প্রবন্ধ লিখেছেন, তর্ক করেছেন, বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের কাটাকুটিও খেলেছেনতবুও সংশয় কাটেনি, রফা হয়নি কোনও। অনেকেই মনে করেন, উৎকৃষ্ট কবিতা কবির হাতে নির্মিত হয়। কিন্তু নির্মাণ শব্দটি শুনলেই অনেকে স্মরণ করেন রাস্তাঘাট, বাড়ি, ফুটপাথ, মন্দির বা নদীবক্ষে সেতু নির্মাণের কথা ; যেন একটা কুতুব মিনার, লাল কেল্লা, লন্ডন ব্রীজ, বা ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান নির্মিত হচ্ছেতাঁরা ঘনঘন মাথা নাড়েন– কবিতা কখনও চেষ্টার দ্বারা, শ্রমের দ্বারা, কোনও নিয়ম বা প্রযুক্তির দ্বারা নির্মিত হতে পারে না। কবিতা কবির মনে ডানা মেলে উড়ে আসে, অথবা সে আকাশচারী শ্বেতহংসীর মুখে-ধরা দেবশিশুটির মতো ; দেবী সরস্বতী তাকে সোজাসুজি কবির কলমে সমর্পিত করেন। কবি তাকে আধোঘোরে, ঘুমঘোরে, অথবা স্বপ্নে পেয়ে থাকেন, এবং সরাসরি লিখে ফেলেন কাগজে কলমে। অর্থাৎ কবিতা সৃষ্ট হয়, ভূমিষ্ঠ হয়– কবি অথবা দেবী সরস্বতীর কোনও গোপন ও দুর্বোধ্য ব্যবস্থায়। 

আমি এই দু’দলের কারো সাথেই সহমত হতে পারিনি। কবিতা পড়তে পড়তে এবং লিখতে লিখতে ক্রমে এই মীমাংসা হয় যে, উৎকৃষ্ট কবিতার পেছনে আছে, একই সাথে, তার সৃষ্টিরহস্য এবং নির্মাণ কৌশল। যুগপৎ। মনোজগতের গভীরে সৃষ্ট হ’য়ে, তাকে লিখে ফেলার সময়ে কবির হাতেই যেটুকু নির্মাণ। এবং এই নির্মাণকৌশলও বিচিত্র ও রহস্যময়। সৃষ্টির সমতুল্য। যা কখনোই শপিং মল বা রিভার ব্রীজ বানানোর মত নয়। এর কারণ কবিতার গঠন। মাল্টি-স্টোরিড টাওয়ারের সাথে কবিতার মিল শুধু এটুকুই যে, কবিতারও অনেকগুলো স্তর থাকতে পারে। কিন্তু তাদের বিন্যাস অনেকটাই ভিন্ন। 

তো, এইমতো সৃষ্টি ও নির্মাণের যুগলবন্দী আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে, যা কবিতার মতোই কিছুটা রহস্যময়, বহুস্তরীয়,  জটিল, জৈব, বিমূর্ত, অনেকাংশে অজ্ঞাত ও আবেগাশ্রিত— আমি ভাবি। তখনই আমার ভাবনাকে মাতিয়ে তোলে দুটি বস্তু— মদিরা (ওয়াইন) ও আতর (পারফিউম)। মনে পড়ে তাদের গঠন ও গুণাবলীর কথা। তাদের বহুস্তরীয় পিরামিড-সদৃশ গঠন ও স্বাদের বিভাজন। যার সাথে আশ্চর্য সাযুজ্য আছে কবিতার। এদেশে কবিতা নিয়ে এত আলোচনা হয়ে গেছে, তবু কোনও কবি বা প্রাবন্ধিকের লেখায় এই নিয়ে কোনও উল্লেখ বা আলোচনা আজ অব্দি আমি দেখতে পাইনি।   


৩. 
এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার প্রথমেই কিছুটা মনোযোগ দিতে হবে
‘ইঞ্জিনিয়ারিং অফ্‌ পারফিউম’ এবং ‘অ্যানাটমি অফ্‌ ওয়াইন’ বিষয়ে। কর্মজীবনে একবার ব্যাঙ্ককের একটি শপিং মলে গিয়েছিলাম, সারাদিনের অফিসের কাজের শেষে, সন্ধ্যায়। সেখানে খোঁজ করছিলাম, কি কি পারফিউম পাওয়া যায়। কাউন্টারের এক বিদেশিনী বয়স্কা মহিলা প্রতিবার নতুন পারফিউম দেখানোর আগে আমায় একটা গন্ধ শোঁকাচ্ছিলেন, আগের পারফিউমের রেশ কাটিয়ে নতুনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে বলে। সেটা ছিল ছোট্ট কাচের জারে রাখা রোস্টেড কফি বীন্স। প্রতিবার ওই কফির গন্ধ শুঁকিয়ে তারপরে তিনি আমার হাতের কব্জির পিছনে স্প্রে করে দেখাচ্ছিলেন নতুন পারফিউম। পাকো রাব্যান, শ্যানেল, গুচ্চি, ইভ সাঁ লরঁ। সেই থেকে পারফিউম ও ওয়াইনের গঠন-বিন্যাসের প্রতি আমি মনোযোগ দিই। বিভিন্ন পত্রিকায় (এর মধ্যে সেকালের ইংরেজি ‘সানডে’ ম্যাগাজিনও) বিশেষজ্ঞদের লেখা ‘পারফিউম রিভিউ’ ছিল আমার খুব প্রিয় এবং অবশ্যপাঠ্য। যেটুকু হাতে পেয়েছি।   

পারফিউমের ‘পিরামিড সদৃশ’ গঠনে সাধারণতঃ তিনটে স্তর থাকে। টপ নোটস (বা হেড নোটস), মিডল নোটস (বা হার্ট নোটস) এবং  বেস নোটস। কোনও পারফিউমের গন্ধ নাকে এলে, এই টপ বা হেড নোটসের গন্ধটাই সবচেয়ে প্রথমে আমরা শনাক্ত করি, এবং এটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় কারণ, এদের ‘হাই ইভাপোরেটিং রেট’। এদের মধ্যে পড়ে লেমন এবং ল্যাভেন্ডার জাতীয় সুরভি। এর সামান্য পরেই, আমাদের ঘ্রাণশক্তি চিহ্ণিত করে নেয় দ্বিতীয় পর্যায়ের সুরভি বা, মিডল নোটস-কে ; যেমন হিবিস্কাস ফুলের গন্ধ, গোলাপের গন্ধ, ইত্যাদি। এরা চেতনায় ক্রমশঃ প্রকাশ্য হয়ে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। এদের পরেই আসে দীর্ঘস্থায়ী বেস নোটস, যেমন কস্তুরী, ভ্যানিলা, মাস্ক। এরাই সম্মিলিতভাবে চিহ্ণিত করে একটা বহুস্তরীয় পারফিউম বা সুগন্ধীকে। এদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সাজানো থাকতে পারে আরও অনেক মৃদু, স্বল্প মৃদু, এক্সহটিক সুগন্ধী তেল বা নির্যাস : পাহাড়ি অর্কিডের ফুল, ইউরোপের নানা রসালো সিট্রেস ফল, তামাক, মাখন, চন্দন, এলাচ, লবঙ্গ, মহুয়ার ফুল, শিরিষ ফুল, ল্যানটানা, প্রাচীন কাঠ, লেদার, বৃষ্টিবন, ভিজে মাটি, চকোলেট, পায়েস, বেকারি, কুয়াশা, অথবা নানান ভেষজ তেলের সুগন্ধ। ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়, বিন্যাসে, গঠনে, তাদের অপার কামনা বাসনার সাংগীতিক আবেদন। এর সবটাই যে শিশিতে থাকে, তাও নয়। কিছুটা থাকে আমাদের মনেও। 

বিভিন্ন শব্দ, ধ্বনি, দৃশ্য ও স্মৃতিচিত্রের কুশলী ও রহস্যময় বিন্যাসে কবিতাও অনেকটা এভাবেই বিক্রিয়া করে পাঠকের মননে। পারফিউমের স্তরীয় ও সূক্ষ্ম আবেদনকে উপভোগ করার জন্য যেমন প্রয়োজন হয় পরিশীলিত ঘ্রাণচেতনার, তেমনই উৎকৃষ্ট কবিতাকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্যও অবশ্যই প্রয়োজন হয় একটা উন্নত ও পরিশীলিত মনের। যারা স্থূল দাগের বিনোদন এবং চড়া স্বাদের ব্যঞ্জনে অভ্যস্ত, এমন অপরিণত পাঠকের কাছে তাই উৎকৃষ্ট মদিরা, আতর ও কবিতার আবেদন অনেকাংশে অধরাই থেকে যেতে পারে।            

    

৪.
  জীবনানন্দের বহুচর্চিত
‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রথম পাঠের পরে আমাদের মনে যেসব দৃশ্যসংগীতের প্রবাহ রচিত হয়, তার মধ্যে আছে পথ হাঁটা, সিংহল সমুদ্র, নিশীথের অন্ধকার, মালয় সাগর, ক্লান্ত নাবিক ইত্যাদি। এগুলোই তার টপ নোটস, যা কিছুক্ষণ মনকে জড়িয়ে রাখে। এর পিছুপিছু ক্রমে এসে ভীড় করে ক্লান্ত প্রাণ, রৌদ্র, শিশির, শান্তি, বনলতা, ইত্যাদি শব্দ-ধ্বনি-স্মৃতি মিশ্রিত আইকন বা অভিজ্ঞানগুলি। এগুলো গুঞ্জন তোলে পাঠকের মনোজগতে, স্থায়ী হয় দীর্ঘক্ষণ। এগুলোই কবিতাটির মিডল নোটস, যা মিলিতভাবে একটা বোধের জন্ম দেয়, যা দীর্ঘদিন কবিতাটিকে চিহ্ণিত করে। এগুলো স্মৃতিনির্ভর, কিন্তু এ-ও চিরস্থায়ী নয়। 

যা চিরস্থায়ী, যা কবিতার একটা চিরকালীন ও কালজয়ী আবেদন রাখতে পারে পাঠকের বোধে, তা হোল এর বেস নোটস। নিভে গেলে, লেনদেন, শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি, ঝিলমিল, ফুরায় -ইত্যাদি শব্দের রহস্যময় মিলিত দ্যোতনায় যা ক্রমে গড়ে ওঠে কবির কলমে। কবিতার এইসব শব্দবন্ধই তার এসেন্সিয়াল অয়েলস। তাদের সিনট্যাক্স বা বিন্যাস, এবং বিভিন্ন স্তরীয় অবস্থানের প্রভাবেই গড়ে ওঠে কবিতার সামগ্রিক আবেদন ও তার রহস্যময় জটিলতাএটা অনেকাংশে কবির অজ্ঞাতেও ঘটে যেতে পারে। হয়তো কোনও পরিশীলিত পাঠক বা প্রাবন্ধিক পারেন তাকে শনাক্ত করতে।  

এরকমই আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কবি স্বদেশ সেনের ‘ব্রিজ পার হয়ে’ কবিতাটা।  


“ব্রিজ পার হয়ে যাবো—সুদূর অক্ষরে কাঁপা পথ

ঝুমকা থামো, আমি সাইকেলে চড়েছি

দূরে যাবো বলে :  দুষ্টু পাতা কেন 

ডাকো ? কি কারণে জল তুমি শিশিরের মতো

নীরবতা ! আকাশের কোণে কোণে পাখি নিয়ে খেলা

আকাশের। মেঘের মতন যাওয়া—এই যাওয়া ভালো। 

আমার দুচোখে আর এ-ছাড়া কোথাও ভালো নেই

শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন

সবুজ পোলের কাছে ; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো।” 

 

এখানে, টপ নোটস (ক্ষণস্থায়ী) :  ব্রিজ / ঝুমকা থামো / সাইকেল / শিশির / দুষ্টু পাতা ইত্যাদি। 

মিড নোটস (দীর্ঘস্থায়ী) :  মেঘের মতন যাওয়া / সবুজ পোল 

বেস নোটস (চিরস্থায়ী):  ভালো নেই / একমন / ঝরে যাওয়া।  

 

এখানে লক্ষ্য করা যাক, পারফিউমে যা ‘টপ নোটস’, কবিতায় তা শব্দচয়ন ও ধ্বনিমাধুর্য (sound play & euphony)। মিডল নোটস : দৃশ্যকল্প ও রূপক (imagery & metaphors)। আর, বেস নোটস : বিষয়সূত্র, অলংকার-দ্যোতনা ও ভাবের গভীরতা (subject handle, allegory and insight)। এসবের মধ্যে বিশেষ কোনও নোট একাধিক স্তরেও থেকে যেতে পারে।  

 পারফিউম ও কবিতার আরেকটা মিল হোল, ভালো পারফিউম যেমন আলাদা আলাদা সুগন্ধীর নামে চিহ্ণিত হয় না, বরং সবটার একত্রিত বিন্যাসের (হোলিস্টিক) অভিঘাতেই তার পরিচয়, কবিতার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই একটা সামগ্রিক আবেদন ঝংকার তোলে পাঠকের মনোজগতে। কোনও কবিতার উৎকর্ষতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে, তার ভিন্ন ভিন্ন নোটসের স্তরীয় বিন্যাসকে খেয়াল করা উচিত ; কীভাবে তারা একটা সামগ্রিক ঝংকার তৈরী করে পাঠকমনে। এলিয়ট বলেছিলেন- ভালো কবিতার সব দিক ঠিক ভাবে বুঝে ওঠার আগেই তার সামগ্রিক আবেদন ছুঁয়ে যায় পাঠকের মন। ‘a good poetry communicates before it is understood’.  

কবিদের জীবন যেমন বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ও বিচিত্রমুখী হয়ে থাকে, তেমনই হয়ে থাকে বিখ্যাত সুগন্ধির স্রষ্টাদের ক্ষেত্রেও। যেমন মনে পড়ছে, বিখ্যাত ফরাসী সুগন্ধি ‘শ্যানেল নাম্বার ফাইভ’-এর স্রষ্টা, কোকো শ্যানেল-এর বিচিত্র ওঠাপড়ায় ভরা শিল্পীজীবনের সংকট ও সাফল্য। বহু পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী তিনি, সফল ফ্যাশান ডিজাইনার ও ক্যাবারে সিঙ্গার। জার্মান নাৎজি বাহিনীর গুপ্তচর ছিলেন বলেও শোনা যায়। অথচ ওঁর স্বপ্ন ছিল একদিন এমন একটা সুগন্ধি সৃষ্টি করা, যাতে থাকবে একজন পূর্ণ নারীর অন্তর-শরীরের মৃদু সুরভি। সেই হোল ‘শ্যানেল নাম্বার ফাইভ’। তবে সে কাহিনী আজ এখানে বলার সুযোগ নেই।  

 

। 
আতর বা পারফিউমের মতো, মদিরা বা ওয়াইনেরও আছে স্তরীয় জটিলতা যা ক্রমশঃ প্রকাশ্য হয় আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে, মননে। আমার ভালো লাগতো ওয়াইন টেস্টারদের রিপোর্ট পড়তে। বস্তুত, সেইসব লেখা পড়েই আমি ওয়াইনের প্রতি আকৃষ্ট হই। উৎকৃষ্ট ওয়াইনের রসাস্বাদন করার জন্য যেমন একটা পরিশীলিত মনের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই কবিতার ক্ষেত্রেও। এগুলো যাঁরা ভালো বোঝেন, যাঁদের ঘ্রাণ ও স্বাদগ্রন্থি উচ্চমানের, যাঁরা অনুভব করতে পারেন স্বাদ ও ঘ্রাণের তারতম্যের সূক্ষ্মতা, তাঁরাই কনোশেয়র (connoisseur)।
 

ধরা যাক, ওয়াইন গ্লাসে রেড-ওয়াইন পরিবেশন করা হয়েছে। এবার সেটাকে এক ঢোঁকে গিলে ফেলেন যিনি, তিনি আনাড়ি, পর্দার মিস্টার বিন। ওয়াইন পান করারও কিছু প্রথা আছে, যাতে তার কৌলিন্য ও গুণমানের প্রতি সুবিচার করা হয়। প্রথমে গ্লাসটি হাতে নিয়ে পানীয়কে একটু দুলিয়ে নিয়ে আলতো করে নাকের কাছে এনে তার প্রাথমিক ঘ্রাণ পেতে হবে। এটাই ওয়াইনের অ্যারোমা, বা বোকে (bouquet)। এর একটু পরেই আসবে, ওয়াইনে চুমুক দিয়ে তার স্বাদগ্রহণ পর্ব। কিন্তু তার আগে, অ্যারোমা বা বোকে (পুস্পস্তবক) নিয়ে আর একটু বলা যাক। এর কয়েকটা ভাগ আছে—প্রাইমারী অ্যারোমা (ফল বা ফুলের ঘ্রাণ), সেকেন্ডারী ( ক্রিম, ইস্ট বা বেকিং-এর হাল্কা গন্ধ, যেটা আসে ওয়াইনের প্রস্তুতপ্রণালী থেকে), এবং টারশিয়ারী ( শুকনো ফলের, মশলার, বা ওক কাঠের গন্ধ ; যেটা আসে কাঠের ব্যারেলে দীর্ঘকাল গচ্ছিত থাকার কারণে)। 

এইসব গন্ধ স্তরে স্তরে মিলেমিশে ক্রমশঃ প্রকাশ্য হয়ে ওয়াইনকে মহার্ঘ করে তোলে। পান করার আগে, ঘ্রাণেই তার প্রতি এক মধুর আসক্তি এভাবে সৃষ্টি হয়। কিন্তু ওয়াইনের মূল বিষয় তার ঘ্রাণ নয়, তার গঠন। যেমন কবিতা সম্পর্কে কবি আলোক সরকার লিখেছিলেন—‘কবিতা বিষয়নির্ভর নয়, কবিতা গঠননির্ভর’। সেভাবেই, ‘Wine is NOT about flavour, it’s about structure. Actually, many of its flavours are really structure in disguise’– আমি প্রাজ্ঞদের কথা কোট করলাম।  

ওয়াইনের বিচার্য গুণাবলীকে সাধারণতঃ পাঁচভাগে লেখা হয় : স্তবক/ঘ্রাণ – তারল্য – স্বাদ – তীব্রতা – রেশ। ইংরিজীতে, Bouquet — Body – Palate – Structure – Finish। শেষের চারটি হোল তার স্বাদ নিয়ে। মুখের মধ্যে ছোট্ট এক সিপ নিয়ে, সারা মুখে তাকে ছড়িয়ে দিয়ে অনুভব করতে হয় তার স্বাদের স্তরগুলো। এর সব শেষে থাকে ফিনিশ। ঠিক যেমন একটা কবিতা সম্পূর্ণ পাঠের পরে, তার একটা সামগ্রিক দীর্ঘস্থায়ী আবেদন, বা ইমপ্রিন্ট থেকে যায় আমাদের মনে।        

‘Bouquet = flavours/aroma of a wine acquired from grapes and from fermentation. It
also comes from ageing wine in new oak barrels.
Body of a wine is how it feels in the mouth, its texture (skim milk vs. cream). Structure of wine refers to intensity of tannins / acidity.  A wine can be light, nimble, even svelte, or brawny, muscular, broad. It can also be flabby, dull, or ponderous.
Palate = actual taste of wine in the mouth. (If you continue to eat the same food you’ll never expand your palate.)
Finish = aftertaste of wine that lingers. It’s the most important factor in judging the character & quality of a wine.’ 

প্যালেটে পূর্ণ স্বাদ পাওয়ার পরে, এই ‘ফিনিশ’ নামক সর্বশেষ অনুভবটির আবার রকমফের আছে।  

‘Juicy’ and ‘Fresh’ Finish – ‘It indicates  just-ripe fruit flavors on the finish, and this is most commonly found on young  ‘freshly’ made wines from moderate climates.’ (এইটা কবিতায় কোনও  স্বতঃস্ফূর্ত, বা খুব সহজ সরল উচ্চারণ থেকে পাওয়া যেতে পারে)।    

Tart and Tingly Finish – ‘This wine will taste more tart or bitter on the finish. On a good quality wine the acidity will tingle and persist; giving the wine a delicate, mouthwatering long finish that will drive you to another sip.’ (কবিতাতেও কোনও একটু শ্লেষ বা তির্যক উপাস্থাপনার জন্যে হয়তো তাকে বারবার পড়তে সাধ জাগে)।  

The Soft Finish – ‘This is the classic ‘ahhh’ moment for most wine drinkers. While the wine may be completely dry, the finish has a note of softness and elegance to it’.   

এই ‘সফট ফিনিশ’, যাকে ‘আহ্‌হ্‌’ বলি, তার কথায় মনে পড়লো সঙ্গীতবিশারদ শ্রদ্ধেয় কুমারপ্রসাদের একটা কথা। তিনি লিখেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে শ্রোতারা তো হামেশাই বাঃ বাঃ বলে থাকেন। সেটা কোনও ব্যাপার নয়। তবে উচ্চমার্গের গায়কী যদি কখনো শ্রোতাকে তৃপ্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়, একমাত্র তখনই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘হায়!’ শব্দটি। -তো, এমনটাই হয়ে থাকে কবিতার ক্ষেত্রেও। এলিয়টের প্রুফ্রক-এ ‘লা ফিগলিয়া কে পিয়ঞ্জে’ (La Figlia Che Piange) কবিতাটা পাঠ শেষ করে আমি এমনই মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওর মিড নোটসের সেই লাইনটা—‘উইভ, উইভ দা সানলাইট ইন ইয়োর হেয়ার’। এবং কবিতার সবশেষে—‘Sometimes these cogitations still amaze / The troubled midnight and the noon’s repose’. কিন্তু কবিতাটা শেষ হওয়ার পরে আমার মনে হয়েছিল এর টপ, মিডল এবং বেস নোটসগুলো যেন পিরামিডের একস্তর থেকে অন্য স্তরে চলাচল করেছে। চেতনায় তাই ফিরে ফিরে আসছে অনেক লাইন, কবিতা শেষ হওয়ার পরেও। উইভ, উইভ দা সানলাইট… এ পেইন্ড সারপ্রাইজ… টোর্ন অ্যান্ড ব্রুইজড… অ্যান্ড হার আর্মস ফুল অফ ফ্লাওয়ার্স।  হার আর্মস ফুল অফ ফ্লাওয়ার্স।        

-হায় !

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment