যশোধরা রায়চৌধুরী

স্ববিরোধ, মহানতা, ক্লিশে

“মহান শিল্পীদের জীবনীতে প্রায়শই পড়ি তাঁদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা কথা। পড়ি, এবং ভীষণ বিভ্রান্তবোধ করি। ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিজীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তাঁর শিল্পের আদৌ কী দাম আমি দেব? যতই মহৎ হোক সেই শিল্পকীর্তি, তবু আমি তার কানাকড়ি মূল্যও দেব কি? পণ্ডিতেরা বলেন, ভুল, এই বিচার ভুল।

শিল্পীও একজন মানুষ, আর সব মানুষের মতো তার ভিতরেও রয়েছে একই সঙ্গে সাধু এবং শয়তান। এবং নিজের ভিতরে এই সাধু-শয়তানের দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে তার শিল্প। সুতরাং, শিল্পীর ব্যক্তিজীবন দিয়ে তার শিল্পের বিচার এক মারাত্মক ভুল। পণ্ডিতেরা সর্বদাই এত ঠিক কথা বলেন! এত খাঁটি সত্য কথা! এবং সব সত্যই কী অদ্ভুত নির্মম! কোমলতার পক্ষে কি কোনও সত্য নেই?

না, কোমলতার পক্ষে কোনও সত্য নেই, শুধু বেদনা রয়েছে। সেই বেদনার কাছে আমি আজীবন গুম হয়ে থাকি। দেখি যে, আমার মনে গোঁজ হয়ে আছে একটিই কঠিন কথা। কথাটা এই যে, শিল্পী হবার তাড়নায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সংসার ভেঙে দিয়ে, এবং নিজেদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে তার গ্রামের মামাবাড়িতে ফেলে রেখে, প্যারিসে এসে রদ্যাঁর শিষ্য বনে যাওয়ার জন্যে রিলকে-র সমস্ত কবিতা আমার কাছে অস্পৃশ্য মনে হয়; অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলো-র গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্যে পিকাসো-র সব ছবি আমি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারি।

জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না। সেই অপরাধ, সেই আঘাত আরেকটি নীরব প্রাণে যে ক্ষত সৃষ্টি করে, শিল্পীর আজীবনের সকল শিল্পকর্ম দিয়েও সেই ক্ষতটির ক্ষমা হয় না, শুশ্রূষা হয় না। সমস্ত শিল্পের চেয়ে সেই ক্ষতটি বড়। সমস্ত শিল্পের বিরুদ্ধে, সেই ক্ষতটিই ঈশ্বরের বিষণ্ণ কবিতা”

 ( ক্ষত, রণজিৎ দাশ )

এ কবিতা গত পনেরো কুড়ি বছরের সময়কালে আমার ও আমার বন্ধুবান্ধব বা সমমনস্ক পরিচিতদের আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে। কবিতাটি প্রায় অমোঘ, ছুরির মত আমাদের মননে কেটে বসে গেছে, এবং প্রতিবারের পাঠে উঠে এসেছে নতুন নতুন মুখ। বিখ্যাত শিল্পী সাহিত্যিকের মুখ। কষ্ট হয়েছে, বিস্ময় হয়েছে, অবিশ্বাস করেছি কত না মানুষের কার্যকলাপ দেখে, শুনে, প্রতিবার হয়ত অমানুষিক নিষ্ঠুরতাই শুধু নয়, অদ্ভুত বৈষম্যমূলক আচরণ, বৈপরীত্য, স্ববিরোধ দেখে। সংকীর্ণ মনের পরিচয় বা আত্মম্ভরিতা, অহংকারের  ক্লিন্নতা দেখে। অপরকে তুচ্ছজ্ঞান করার ঔদ্ধত্য দেখে। 

প্রশ্নগুলো আমাদের আশেপাশে বহু যুগ ধরেই আছে। সম্প্রতি আবার  নন্দিতা দাসের পরিচালনায় ‘মান্টো’ ছবিটি দেখতে দেখতেও এরকমই কিছু কথা মনে হচ্ছিল। ছবিটি ভাল লেগেছে আমার এবং আরো অনেকেরই। যে কোনো বায়োপিক দেখার ক্ষেত্রে দর্শকের একটা ঝুঁকি থাকে। বিখ্যাত কো্নো চরিত্র, যে কোনো সেলিব্রিটি, দর্শকের মনের ভেতরে একভাবে বাসা বেঁধে থাকেন। তাঁর একটা চবি তো থেকেই যায় মানসপটে। সে ছবির সঙ্গে যদি পরিচালকের ছবিটি না মেলে? এই ভয়টা তাড়া করে ফেরে । মান্টোভক্ত হিসেবে মান্টোর ওপর ছবি দেখতে যাবার আগে, গত দু’বছরে খবর হিসেবে পড়া মান্টো ছবিটি নিয়ে নানা আলোচনা, বিতর্কও মাথায় থেকে গেছে। আমার আকৈশোরের মান্টোপ্রীতি বলেছে এক আগুন আগুন মানুষের কথা। কিন্তু মানুষ আর বাণী তো এক নয়। মানুষের জীবন বড় ক্ষতবিক্ষত। মানুষের ভেতরে আপন ঘরে পড়শি বসত করে। কোন মানবদরদী বাবাকে আমরা সন্তানের প্রতি অবহেলা করতে দেখিনি কি? অথবা কোন উচ্চমার্গের শিল্পী বা সাহিত্যিককে দেখিনি, নিষ্ঠুর হতে তাঁর ব্যক্তিজীবনে, তাঁর অতি দৈনন্দিন জীবনে আশেপাশের আত্মীয়দের ছেঁড়া পাপোশের মত ব্যবহার করতে দেখিনি কি? 

নন্দিতা দাসকে আমার ব্যক্তিগত ধন্যবাদ, সব “বাণী”র ওপর দিয়ে একজন আস্ত মানুষের গল্প বলে গেছেন তিনি। এক মানুষের ক্ষতবিক্ষত জীবনের গল্প। ব্যক্তি, বিশেষ করে সে যখন এক লেখক… তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও ব্যঙ্গে জর্জর করেন যিনি লেখায়, তাঁর আশপাশকে, সেই লোকটির অন্তর্লীন ভালনারেবিলিটি। ভুল সিদ্ধান্ত। হেরে যাওয়া। সবার থেকে সরে যাওয়া। এলিয়েনেশন।  প্রচন্ড ইমপালসিভ, আবেগপ্রবণ এক সত্তার ক্রমশ ভ্রান্তি ও মানসিক অসুখের দিকে চলে যাওয়া। সবটা মিলিয়ে নিঝুম করে দেওয়া এক “চেনা মানুষের” কথা। তবু, আবার এক পুরনো ক্লিশেতে উপনীত হতেই হয় এই কাহিনির মধ্যে দিয়ে। 

ক্রমাগত মদ্যপান করতে থাকা পতনশীল মান্টো, তাঁর পরিবারকে অবহেলা, ও পরিবারের উদ্বেগ, সর্বংসহা স্ত্রী। এই অংশে সামান্য হলেও আমার মত দর্শক অস্থির হয়ে ওঠেন। কেননা, বাংলায় অন্তত, অনন্ত সৃষ্টিশীলের সংজ্ঞাই প্রায় হয়ে গিয়েছে অপরিমিত মদ্যপান ও স্ত্রী সন্তানকে উপেক্ষা । আমরা যত না মনোযোগ দিই সৃষ্টিশীলতার দিকটায় তার চেয়ে অনেক বেশি দৈবী মাহাত্ম্য আরোপ করি মদ্যপানে আর অনিয়মিত যাপনে! এ প্রায় এক রোগের মত। ঠিক যেভাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখের বিষয়ে আমাদের আছে কিছু কিছু ধারণা। এগুলোতে এমন এক পুরনো বহূচর্চিত মাহাত্ম্যের গল্প আছে, যা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। নন্দিতা দাস অবশ্য অব্যবহিত পরেই আবার সামলে নিয়েছেন। ফলত ছবির শেষ একেবারেই দৈবী পতনের আখ্যান থাকেনি। কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা এইই, যে, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, ব্যক্তিজীবনে, মানুষ হিসেবে কেমন হবেন, এটাই বিরাট এক প্রশ্ন, যার দুদিকেই ধার, দুদিকেই কাটে। 

যদি মানুষ হিসেবে ভা্লো হতেই হয় তাঁকে, ভালো শিল্পী বা কবি হতে… ভালো লেখক বা সমাজকর্মী হতেও, তবে আমরা এক ধাঁধায় পড়ব আমরা। নাম কাটা যাবে এত্তো এত্তো জন প্রিয়, সম্মানিত, বড় মাপের বলে যাঁদের দেখি তাঁদের অনেকেরই। 

আর যদি, মানুষ হিসেবে তিনি কেমন তাতে কিচ্ছু না যায় আসে?  আশেপাশের লোকেদের সঙ্গে, ব্যক্তিগত জীবনের আত্মীয় বান্ধবের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার যদি জঘন্য হয়? যদি তিনি মেয়েদের অপমান করেন, স্ত্রীকে অবহেলা করেন, অনেকগুলি মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেন…তাহলে? তিনি শিল্পী হিসেবে তেমন বড় থেকে যাবেন? মিথ্যে হয়ে যাবে না তো, তাঁর যাবতীয় লেখা ও কথা, মানুষের ভালোর জন্য, মানুষের শুভের জন্য তাঁর যাবতীয় অভিপ্রায়!

 

টয়লেট, এক প্রেম কথা

জোড়াসাঁকো গিয়ে দেখেছিলাম , দু দুটো কোণের ঘরের বৃত্তান্ত। পুব দক্ষিণ খোলা, জানালা খুললেই কদমগাছের ডাল দেখা যাওয়া… বা ওই জাতীয় কোন মহীরুহের ছায়া পড়া, বাগানমুখী, সদরমুখী উন্নততর ঘরটি রবিবাবুর লেখার ঘর। আলো আর বাইরের মাঠের দিকের খোলা জানালা  দিয়ে আসা হাওয়া যা চিন্তাভাবনা কল্পনার উদ্রেক দেয়। আর ঠিক উলটো দিকের কোণের ঘর? পুব দক্ষিণের উলটো তো উত্তর-পশ্চিমই হয়। জানিনা, কেউ নাও মানতে পারেন। জেনেছিলাম ওই ঘরটিতে মারা গেছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী। জীবনের শেষ দিনটিতে সন্তানদের কাছে পান নি। শীত ও গ্রীষ্মে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা আর গরম সেই উত্তর-পশ্চিমের ঘরটি কেন কবিপত্নীর জন্য নির্দিষ্ট হয়? পত্নী বলেই? কিন্তু রবিঠাকুরের মত বাঙালির ঈশ্বর কি এতে করে একটুখানির জন্য হলেও আমার কাছে ছোট হয়ে যান না?

ঠিক সেরকম গল্প শোনালেন আর একজন। তাঁর সবরমতী আশ্রমের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। দুটো আলাদা আলাদা বাথরুম। টয়লেট। স্বচ্ছ ভারতের দৌলতে স্বচ্ছ টয়লেটের দাবি আমাদের কর্ণে রোজ মধু ঢালছে। আর স্বচ্ছতার ব্যাপারে যিনি আমাদের সবার বড় অ্যামবাসাডর, সেই আইকন গাঁধিজির বাথরুমে বিদেশ থেকে আনা কমোড… বিলিতি কমোডে সজ্জিত আশ্রমের একটিই বাথরুম। যে আশ্রম কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলত। যে আশ্রমে নিজে হাতে সব কাজ করতে নিজেকে নয়, নিজের অনিচ্ছুক স্ত্রী কস্তুরবা’কে বাধ্য করেছিলেন এই কর্মযোগী। কস্তুরবা’র বাথরুমটিতে গিয়ে, ট্যুরিস্ট মেয়েটির চোখে জল আসে। নোংরা অন্ধকার আর কুৎসিত, পুরনো ধরণের বসা পায়খানা সেখানে।

৯৯% ভারতবাসীই তো বিশ ত্রিশের দশকে অমন পায়খানায় নিত্যকৃত্য করেছেন। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা এইই, যে, গাঁধিজির নিজের জন্য যে টয়লেটটি রচিত হয়েছিল তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত উকিলসাহেবের নিত্যকৃত্যের জন্য বাছাই করা ব্রিটিশ টয়লেট বৌলটি লাগানো হয়!

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মহান মানুষদের জীবনী বলে কথা। স্ববিরোধ তো থাকবেই! 

বড়মানুষদের কথা থাক। আসি আমাদের নিজেদের স্ববিরোধিতায়। আমরা যারা কবি নই, মহাত্মা নই, দার্শনিক নই। একটু আধটু লিখে কলার তুলি। আমরা যারা সামান্য লোক। আমরা এক অন্য স্ববিরোধের খপ্পরে পড়ে
গেছি তো বেশ কিছুদিন যাবতই। সেই যবে থেকে বিশ্বায়ন, পণ্যায়ন এসে আছড়ে পড়ল এ পোড়া দেশে। 

 

মধ্যবিত্তের স্ববিরোধ

ব্যাপারটা এখন বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম অসুবিধে হত খুব। এই যেমন, নব্বই দশক। সদ্য সদ্য দেখছি কীভাবে গ্রাস করছে শহরের উপকন্ঠগুলো আকাশঝাড়ু বাড়িরা, আর পণ্যায়ণের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে গরিব গরিব কলকাতার ওপর। কীভাবে মনমোহনের অপরূপ বিশ্বায়ন মশালার নুনঝালে স্বাদু হয়ে উঠছে এযাবতের নিরিমিষ ভারতীয় অর্থনীতি, যার মূল কথাই ছিল কনট্রোল… নিয়ন্ত্রণ…লাইসেন্স রাজ। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে মুক্ত অর্থনীতির দিকে আধো আধো পায়ে যেতে যেতে ভারতের বুকে এই পোড়া বাংলাটা পালটে যাচ্ছিল নব্বই দশকেই, আর তার অভিঘাত এসে পড়েছিল আমার মত পঁচিশ ত্রিশের কোঠার নব্যনব্যাদের। 

তখনই তো সদ্য উঠেছি পণ্যসংহিতার রাগি রাগি কবিতা লিখে… ওহো শ্যাম্পু দেওয়া চুল, ওহো সূক্ষ্ম সাবানের কাচা/ রঙিন কাপড় তুমি উড়ে উড়ে ঠ্যাং দেখিও না… অথবা ‘নিরুদ্বিগ্ন ক্রেতাহীন হয়ে যাবে গোটা একটা দেহের বাজার”, “বিশুদ্ধ বন্ধন নামে একটি নতুন তেল বাজারে এসেছে” এইসব লিখেটিখে মনে একটা বিপ্লবী ভাব এসেছিল। বন্ধন শব্দটির ভার, একটি সর্ষের তেলের প্যাকেটজাত পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার আশ্চর্য শ্লেষ ভেবে, তেলের ঝাঁঝে নয়, চোখে জল এসেছিল। 

তখনই সেই সব ঘটনা। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন চলছে তখনো, তাই আরো বেশি করে জানি, কম্পিউটারকে “আসিতে নাহি দিব” বলেই নব্বইতে গুটিগুটি পায়ে সে আপদকেও গ্রহণ করতে হয়েছে সরকারি কাজে। শহর গ্রামাঞ্চল ভরে গেছে রাজীব গান্ধির বিপুল টেলি বিপ্লবের ফসল এসটিডি  আইএসডি বুথে। আর কদিন পরেই খুলে যাবে মোবাইল ফোনের দুনিয়া, তখনো তা গাবদাগোবদা মোটাসোটা আছে… খুব দামি। কিন্তু এর পর পর জীবন হবে মোবাইল জাত। মোবাইল ঘটিত। মোবাইল নিয়ন্ত্রিত। গ্রামেগঞ্জে ছেলেমেয়েরা খুন হবে আইপড বা স্মার্টফোনের জন্য, বা খুন করবে তারা বাবা মায়েদের, ভাইবোনেদের। ডিজিটাল বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে আসবে ডিজিটাল ঈর্ষাও। 

সেই সময়েই, আজীবন খদ্দর খদ্দর ইমেজের, খেটেখাওয়া, দুর্বল, প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে উপন্যাস ও গল্প লেখা এক খ্যাতনামা লেখিকা হঠাৎ যেন ক্যাজুয়ালি বলে ওঠেন, পার্ক স্ট্রিটের শাড়ির দোকানগুলো এক্সপ্লোর করেছ তো? রঙ্গোলির শাড়ি সবচেয়ে ভাল।

পার্ক স্ট্রিটের শাড়ির দোকানগুলিতে তার কিছুদিন পরে আমার পা পড়বে, জানতে পারব তারা কোন অন্য গ্রহের শাড়ির দোকান না, আর “অবাঙালি” ক্রাউডের পদধূলিরঞ্জিতও শুধু না বরং বহু আঁতেল দিদিমণি আশপাশের অসংখ্য স্কুল কলেজে যাঁরা পড়ান তাঁরা রেগুলার কাস্টমার। কিন্তু সেটা বলা বাহুল্য। আমিও এখন কিনি সেইসব দোকানে। আলাদা করে কোনো দোকানকে কালো রঙে রাঙাতে চাইনি আমি, আমি শুধু বলতে চেয়েছি, এ সবই ছিল সেই সব খদ্দর খদ্দর-দের চোখে এর আগে অব্দি খুবই অস্পৃশ্য, আর রইল না কবে থেকে? সেই নব্বই দশক! 

নব্বই দশকের জলবিভাজিকার একদিকে বৃষ্টিচ্ছায় “খেটেখাওয়াদের” জন্য মুক্তাঞ্চল, আর অন্যদিকে অর্থবান হয়ে যাওয়া “বড়লোক”দের অনুকরণে  সবকিছু কিনতে পারার স্বাধীনতা। এ যাবৎ যা কিছু ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে, বিদেশ থেকে “ইমপোর্টেড” মার্কা, মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদে দূষিত, দ্রুত বাঙালির কাছে তা হয়ে ওঠে ইন থিং, ধরার ছোঁয়ার হাশিল করার সম্ভাবনাময়। ওই নব্বইএর পর পরই। 

ফলত, কোনো দারিদ্র্য দূরীকরণের সেমিনার ভেঙে বেরিয়ে, কোনো উঠতি বিপ্লবী বা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট যখন বলে ফেলেন, পিৎসা হাটের এর হোম ডেলিভারির নাম্বার আমার ছেলের মুখস্ত। আহা ওই থিন ক্রাস্ট! একটা পেপারনি আর ট্রিপল চিজ নিয়ে দেখ। আমি কেমন থতমত খেয়ে যেতাম। 

বেশ অসুবিধা হত। তারপর তো যত বিপ্লবী যত আঁতেল মানবপ্রেমী ও সমাজকর্মী, শিল্পী সাহিত্যিক ফিলম মেকার নাট্যকার প্রমুখের মিটিং প্লেসই হয়ে গেল “কাপে কফি ডে” নামের চেইন স্টোর। যেখানে এক কাপ কফির দাম একশো থেকে দেড়শো টাকা।

এখন আর অসুবিধা হয়না। যে আমি কোনদিন চোখে কাজল দেওয়াকেও বেশি সাজগোজ মনে করতাম সেই আমিও ভুরু প্লাক করাই। ঠোঁটে রঙ মাখাকে বেশ আপত্তির লাগত আশি দশকে। এখন নিজেই মাখি। এক প্রজন্মের তফাৎ। আমাদের আশি দশকের মার্ক্স এঙ্গেলস পড়া আর মান্টো পড়াও ছিল আর্থসামাজিক চিত্র। আর ২০১৮’র আইনক্স, বা মাল্টিপ্লেক্সে যাওয়াও আর্থসামাজিক। ৫০০ টাকা দিয়ে মান্টো-র টিকিট কেটে, পাঁচ হাজারি রিবক জুতো আর মাংগোর আট হাজার টাকার পোশাকের উইন্ডো শপিং করে, বড় বাকেটে চিজ পপকর্ণ আর বড় কোক খেয়ে, সিনেমাটার দারিদ্র্য, প্রচুর “স্ট্রাগল” , দেশভাগের যন্ত্রণা, মৃত্যু ও ধর্ষণের বারমাস্যা দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে (অথবা চোখের জল ফেলে) আবার বেরিয়ে পিটার ক্যাটের চেলো কাবাবে মন দিতে পারি দিব্যি।

এটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় করে আলোচনা চলেছে। কিন্তু তাতে লাভ কি? হতেই পারে বাঙালির তথা ভারতীয়ের জীবনযাপন আমূল পালটেছে গত ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছরে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই থাকে, তা হল, আমরা যে জীবন যাপন করি আর আমরা যে চিন্তাধারাকে বলি, জ্ঞাপিত করি, কপচাই, তার মধ্যে কি কোনো মিল থাকা দরকার, না দরকার নেই? আমরা যে চিন্তাধারায় প্রতিবাদ করি, যে চিন্তাধারায় মানবদরদী কবিতা লিখি, যে চিন্তাধারায় অসংখ্য ছোট বড় কাগজে বড় মালটিন্যাশনালের গুষ্টির তুষ্টি করি, যে নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা কপচাই, যদি ব্যক্তিগত’তে সেই মালটিন্যাশনালের প্রতিটি প্রডাক্টকে এনডর্স করি, জুতো থেকে জামা, জামা থেকে খাবার, খাবার থেকে শেভিং ক্রিম অথবা স্যানিটারি প্যাডে, ব্র্যান্ডেড প্রডাক্টের জয় গাই, সেটাতে আমার ওই আগের কাজগুলো, মানে ঐ নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের নিন্দাগুলো, মিথ্যে হয়ে যায় না কি? 

খেতে না পাওয়া মান্টো, দরিদ্র অবস্থায় লিখে চলা মান্টো, নারী, শিশু, বয়স্ক, দেশভাগের বলি উদবাস্তুদের নিয়ে লেখা, অসহ্য এক পৃথিবীর অসহ্য সব গল্প লেখা  মান্টো। তাঁকে ভালবাসা জানানো মানে কি তাঁর ছবি আঁকা মাগ-এ কফি খাওয়া? যেমন চে গ্যেভারার আঁকা জামা পরা ফ্যাশন, ঠিক তেমনই?

মান্টোর সময়ের জীবন যাপন আমরা এক প্রজন্মেই হারিয়েছি। একজ্যাক্টলি এক প্রজন্মে। আমরা, মানে ১০% বা ৫% ভারতীয় কিন্তু আমরাই তো দাপাচ্ছি সোশাল মিডিয়ায়৷ ১৯৭০-৮০ অব্দি গ্রীষ্মের দুপুরে ও রাতে মাটিতে মাদুর পেতে শোয়া আমাদের স্বাভাবিক যাপন ছিল। এমনকি রাতে ছাতে শোওয়াও, গ্রীষ্মে। মায়েরা ছোটো বেলায় গোটা গ্রীষ্ম সন্ধে থেকে রাত ছাতেই থাকতেন। বাড়িতে খাট ক’টা ছিল?
বহু ভাইবোন ও অঢেল আত্মীয়স্বজনসহ, মায়েরা বাবারা খোলা আকাশের নীচে আর খুপরি ঘরে মিলিয়ে তেঁতুল পাতায় সুজন হয়ে দিব্য আনন্দ গান হাসি মজায় বেড়ে উঠেছিলেন। অভাব তো তাদের হাতের গামছা ছিল। কাট টু আমাদের প্রজন্ম।  শেষ কবে মাটিতে বসেছি? প্লাস্টিকের বোতলে কেনা জল খাওয়ার অভ্যাস আমরা কতদিনে করেছি? কতদিনে লুপ্ত হল স্টেশনে নেমে বোতলে জল ভরার হুড়োহুড়ি? 

 

ভুল ঐকাত্ম্যের ভয় : কবি ইজ ইকুয়াল টু তান্ডবকারী

আমাদের অল্প বয়সে এই ভুল ঐকাত্ম্যটাই বরং মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, যে, কবি শিল্পীমাত্রেই হবেন অমিতাচারী, মাতাল, তান্ডবে পটু। কেন ঢুকেছিল কে জানে। তার আগের প্রজন্মের পর প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের মত সকালে নিম পাতার রস খাওয়া সংযম সাধকের গল্প চলত। সাদা ধুতিপাঞ্জাবির ভদ্রলোক বুদ্ধদেব বসু বা বিষ্ণু দে ছিলেন ইন্টেলেকচুয়ালের প্রতিমা রচনার উপাদান। হঠাৎ পাঁচের দশকের ঘুর্নিতে আমরা পেয়ে গেলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় সমরেন্দ্র দীপক তারাপদ শরৎদের। আর ঘুরে গেল আমাদের মানদন্ড। 

আসলে সময়টাও তো গোলমেলে ছিল। যাকে বইতে আমরা পড়ি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নৈতিকতার অবক্ষয় রূপে। দেশভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ সবকিছুর পর আমরা পাই যে সমাজ। সেখানে কতিপয় তরুণ তাঁদের জমজমাট লেখা দিয়ে শুধু নয়, জীবন যাপন দিয়েও চোখ কাড়েন আমাদের। আর তারপরই আমার মতে সেই ভুল ঐকাত্ম্যের প্রচলন। তাঁদের বিপুল রকমের মেধা মনন ও প্রতিভা, সৃজনশীলতাকে আমরা মাপতে থাকি কে কত বার খালাসিটোলায় গিয়েছেন, কে কত পেগ মদ্যপান করেছেন তাই দিয়েই। যিনি সংসারকে অবহেলা করেছেন, যিনি অসংখ্য কাচের বাসন আছড়ে ভেঙেছেন, তিনিই যেন বড় কবি হবার যোগ্যতা লাভ করেছেন। অথচ এই কাহিনির উল্টো পিঠে আসে বেদনার কথা। যিনি কবি তিনি কষ্ট পান, তিনি চেষ্টা করেন নেশামুক্তির। সেসব অকথিত থেকে যায়। 

ধরা যাক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা। আমরা তাঁকে হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যান থেকে সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা অব্দি যা কিছু ভেবেছিলাম তা তো তাঁরই চিত্রকল্পে তাঁকে দেখা। 

 

সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা

শক্তি চট্টোপাধ্যায়
যুদ্ধে যেতে হয়নি, তবু গায়ের ক্ষতচিহ্নে
লোকটা মধ্যযুগের যোদ্ধা — সঠিক মনে হবে
তরবারির খর আঘাত কোনখানে পড়েনি?
একটি চোখ রক্ত-ঢেঁড়শ, চলচ্ছক্তিহীনও
লোকটা যদি পাগল হতো, বাতিল করা যেতো
পাগলও নয়, ছাগলও নয়, অভিসন্ধিমূলক
সে দোষে দোষী নয়, বরং পরের উপকারী
স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনচেতা, মদ্যপায়ী, ভেতো!
অসুখ এক উদাসীনতা, অথচ সামাজিক
লোকটা কিছু রহস্যময়, লোকটা কিছু কালো
নিজের ভালো করেনি, তাই, অন্যে ক’রে ভালো
সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা কিছুটা নির্ভীক

অথবা আমরা দৈনন্দিন, সাংসারিক “সুখ” নিয়ে তাঁর মতামত জেনেছি এই কবিতা থেকে। 

 

যদি পারো দুঃখ দাও, আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি
দাও দুঃখ, দুঃখ দাও – আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি।
তুমি সুখ নিয়ে থাকো, সুখে থাকো, দরজা হাট-খোলা।
প্রেমিক শক্তিকে আমরা বারে বারে অনুকরণ করেছি। যে প্রেমিক বলেন, 

ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে…
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে। না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার, বিমনা-
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে। 

 

সুতরাং আমরা, সামান্য পাঠকবর্গ, মানুষ শক্তিকে চাইনি। মানুষ শক্তিকে জানার কাজটাও যে কাজ, ভাবিইনি। মানুষ হিসেবে, অথচ, তাঁকে জানার অন্য এক পরত তো থেকে যায়। দুটো মিলিয়েই তো শক্তি। যেমন পিকাসোর কথা জানি তাঁর পত্নী ফ্রাঁসোয়া জিলোত-এর লেখা থেকে। তেমনি অন্য এক শক্তিকে চিনি তাঁর পত্নী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত আত্মকথা “আন্তরিক পর্যটনে” বইটি থেকে। 

এতদিন ধরে গল্পকথায়, মানুষের আড্ডায় আড্ডায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামক বিপুল বিতর্কিত মানুষটিকে নিয়ে অসংখ্য গাথা তৈরি হয়ে উঠেছে, অথচ মীনাক্ষীর লেখা তার অনেকগুলিকেই চ্যালেন্জ করে। অনেক কথাতেই মনে হয়, যেন অন্য কোনো শক্তিকে উঠে আসতে দেখছি এখানে। মানুষ মাত্রেই দোষে গুণে। এবং তারও চেয়ে বড় যা, এই মিথপ্রতিম মানুষটির বিষয়ে তীব্র স্ববিরোধী কথা শোনা যায়। মানুষটির যাবতীয় খ্যাতিই এই দুই মেরুর মধ্যের দোলাচল ঘিরে। ভাল খারাপের দ্বন্দ্ব, পরিবার পরিজন বন্ধু কর্মস্থল সর্বত্র সুসম্পর্ক তছনছ করা জীবনযাপন। আমরা এতকাল একমাত্রিকভাবে, তাঁর এই তছনছিয়া স্বভাবের কথাকে জোর গলায় বলেছি। যেন বা কবি হওয়া মানেই তছনছিয়া হওয়া, না হলে কবিতা লেখা যাবেই না। মদ্যপান না করলে, বহু হল্লা, হুল্লাট না করলে কবিতার ভাষা ভাঙা যাবে না। এখানে একটা কথা আমরা ভুলে যাই যে শক্তির মত শব্দক্ষমতা নিয়ে আসা কবি এই বাংলায় খুব কম ছিলেন, আর তাই, তাঁর জীবনযাপনকে শুধু অনুকরণ করেই সম্ভব নয় তাঁর কাব্যদক্ষতাকে ছুঁতে পারা। আমরা অনেকেই পারবো না তাঁর মত ভিড়ে বসে কবিতা লিখতে। বলতে পারবো না, “চারপাশের শব্দ একটা হারমনির কাজ করে – ফাঁকা নিঃশব্দ জায়গায় লিখতে বসলে কেমন একটা অনুষ্ঠানের মতো মনে হয়।“ জীবন যাপনের স্বীকারোক্তির ছন্দ ও শব্দ ভাঙানিয়া কবি শক্তির ২৪ ইনটু ৭ ( আজকের ভাষায়) কবিতায় ডুবে থাকা কপি করতে পারব না আমরা অনেকেই। 

এই লেখা থেকে আমরা পাই বাবা শক্তিকে, পাই বন্ধু শক্তিকে। স্বামী শক্তিকেও। মীণাক্ষী লিখছেন, “বন্ধুদের বাদ দিয়ে শক্তিকে আলাদা করে ভাবা যায় না। আমরা শুধু নিজেরা আলাদা করে সংসার করিনি, শক্তির যে বন্ধুরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের ছোটো সংসারে স্থান করে নিয়ে সংসারটিকে বড়ো করেছিলেন … অন্ধকারে আলো জ্বেলে আমার জীবনযাত্রাটিকে সহনীয় করেছিলেন… তাঁদের কথা না লিখে তো আমার উপায় নেই। শক্তি তাঁদের সবাইকেই সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে।” অর্থাৎ তছনছকে স্বীকার করলেও, তার ভেতরেও প্রাপ্তি হিসেবে রেখেছেন মানবিক সম্পর্কগুলোকে। ভয় হয় ভাবতে আজকের দিনে যেখানে মানবিক সম্পর্কগুলোও অপ্রতুল, এক তছনছিয়া (এই শব্দটির প্রচলনের জন্য শ্রীজাতকে ধন্যবাদ)  সংসার সেখানে আরো কত দুর্বহ দুঃসহ হতে পারে। 

সবচেয়ে বড় বেদনা রয়েছে এই স্মৃতিচারণে, যেখানে যেখানে মীনাক্ষী তাঁর আপনতম মানুষটির বিষয়ে কিছু আন্দাজ-কনজেকচার-প্রকল্প উপস্থাপিত করেছেন। যেখানে বলেছেন, এক বা একাধিকবার রিহ্যাব-এর গিয়ে শক্তি যখন মদ্যাসক্তি থেকে উঠে আসতে পারছিলেন, এমনকি, মদ্যবিরহিত অবস্থায় কবিতাও লিখতে পেরেছিলেন, তখন কলকাতা ফিরেই, “শক্তি যদি মদ না খায় আর কবিতা লিখতে পারবে না”-প্রকল্পে বিশ্বাসী কিছু মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে, আবার তিনি ফিরে গেছেন তাঁর নেশার চক্রে। এবং সেই নেশাই হয়েছে তাঁর শরীরকে অকালে ভঙ্গুর করে দেওয়ার কারণ। স্নায়ুগুলিকে করেছে দুর্বল।

কী হলে কী হতে পারত, এ কথা তো আপনজনের মনেই আসবে। আমাদের কাছে এ এক ট্র্যাজেডির উপাখ্যানও। যে গল্পে এক শিল্পীর জীবনের তলায় চাপা পড়েছে দায়িত্ববান স্বামী বা স্নেহময় পিতার রোলগুলি। যে গল্পে আত্মত্যাগের সম্পূর্ণতায় উপস্থিত এক বুদ্ধিদীপ্ত, মেধাবিনী মহিলা… মীনাক্ষী নিজে। 

 

 বিপ্রতীপ একটি কেস স্টাডি : কবি ও সংসারীর যুগ্মতা

একই সময়ে ছিলেন, বেঁচে, এই বাংলায়। তিনি কবি বাসুদেব দেব। ষাটের কবি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরকারি আধিকারিক ছিলেন, ছিলেন হোমিওপ্যাথি চর্চাকারী, অতিপ্রাকৃত চর্চাকারীও, এবং বেদ উপনিষদের অনুবাদকর্মে রত। কবি হিসেবে চিরদিন আন্ডাররেটেড। মানুষ হিসেবে তাঁর বিচ্ছুরণ অনেকেই জানে। তাঁর কবিতা পড়তে লোকে ভুলে গেছে এবং তাঁর জীবিত কালেই কবিযশোপ্রার্থনার ভাগ কম কম হয়ে আসছিল তাঁর, এসেছিল নির্বেদ। মানুষ হিসেবে প্রচুর স্নেহ ও ভালবাসা তিনি বিলিয়ে গেছেন তাঁর অনুজদের অনেককেই। একটা কেস স্টাডি হিসেবেই যদি তুলে নিই ওঁকে?

পড়ছি তাঁর এক সাক্ষাৎকার। পাচ্ছি দুটি বিপ্রতীপ কোণ। একজন কবিকে বুঝতে সাময়িকভাবে সাক্ষাৎকারগুলি কতটা জরুরি তা জানি। আবার এও জানি যে সাক্ষাৎকারে হয়ত বা ধরা পড়েই না একজন মানুষের সবকটি দিক। বহুতল হিরের মত দ্যুতিময় মানুষের সবদিক ধরতে পারার মত গভীর সংবেদ ক’টি সাক্ষাৎকারকারীরই বা থাকে? কিন্তু বাসুদেব দেবের এই সাক্ষাৎকারটি, সুবীর ঘোষ গৃহীত, আশ্চর্যভাবে এই বহুমাত্রিক মানুষটির অনেকগুলো মাত্রাই ছুঁয়ে গেছে। আমরা যাঁরা বাসুদেব কাকুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাদের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত তথ্যের এক সঠিক যুগলবন্দি এখানে পাই। এই সাক্ষাৎকারে, প্রশাসক, সমাজসেবী, কবি, গদ্যকার, সম্পাদক , বেদ উপনিষদের অনুবাদক, ধার্মিক ও সাংসারিক বাসুদেব দেবকে উঠে আসতে দেখে আশ্বস্ত হই খুব। কিন্তু যে মানুষ এই পশ্চাৎপট জানেন না, যাঁদের কাছে কবি শুধুমাত্র একমাত্রিক এক ভাবুকমাত্র? তাঁদের কাছে এই দুটি স্টেটমেন্ট বা আপাতবিপরীত দুই বিবৃতির কী অর্থ হবে, ভাবতে ইচ্ছে করেঃ

বিবৃতি ১ : গার্হস্থ্য আমার কবিতার প্রধান বাতাবরণ। তারপর চালচিত্রে দেশ ও কাল। সাদামাটা সংসার জীবনের মধ্যেও কেমন এক রহস্য ঝিলিক মারে কখনো।

বিবৃতি ২ : কয়েকটি বহুব্যবহৃত শব্দ দিয়ে আমরা কি প্রকাশ করতে পারি এই জীবনের মহিমা ও অনন্তের উদ্ভাস? আমরা ঘুড়ি হয়ে মেঘের দিকে ভেসে যাই… এই আমাদের নিয়তি, ব্যর্থতা।

এই দুই বিপ্রতীপ কোণের মধ্যে সেতু বন্ধন করবেন কী ভাবে? কীভাবে সেতুবন্ধ সম্ভব হয়েছিল বাসুদেবের। একদিক সীমিত, অন্যদিকে অনন্ত। একদিকে তুচ্ছতা, সাংসারিক জীবনের ছোট ছোট ভাল মন্দ। অন্যদিকে বিশালতা, বসুধৈব কুটুম্বকম।

আমরা জানি, কবিতা ও কবির শেষ পরিচয় তাঁর দর্শন। হয়ত এই দার্শনিক স্থানাংক বিচারের মধ্যে দিয়ে একজন ভাল মানুষ, একজন ভাল কবি, দুইয়ের বিচার। আমরা জেনেছি আগেই, যে শিল্পীর ভেতরে কখনো কখনো ক্রুর শয়তানও বাস করেন। যে শিল্পী, ইতিহাস থেকে জানি, স্ত্রীর গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেন, মদ্যপান করে বমি করেন সারারাত, যে শিল্পী, বন্ধুদের লেখা থেকে চুরি করেন। মহৎ শিল্পী আর সংকীর্ণ মানুষের সহাবস্থান আমরা আগেও দেখেছি।

একজন মহৎ মানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার ভেতরে দুই বিপ্রতীপ কোণের অবস্থান খুব বেশি দেখিনি। কবি বাসুদেব দেবের ভেতরে সেই সত্তার সম্পূর্ণতা পেয়ে আমরা মুগ্ধ হয়েছি বার বার। কিন্তু কবিতা? সে যে বড় অভিমানিনী স্বয়ংসিদ্ধা, কখনো কখনো এসেও মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যায় সে। সে কি মানে এই বৈপরীত্য, অনন্ত ও সানন্তের?

সে কি মানে, যে একই কবির হাতে একবার দৈনন্দিন জীবনের ধারাবিবরণী লেখা হয়,

“পানের বাটায় চুনের দাগ  পান শুকোচ্ছে
ঠাকুরের আসনের তলায় এক টাকার নোট
বাক্সের নীচে বিবর্ণ চিঠি হাত থেকে খুলে নেওয়া আংটি
বাতিল চাবি “ ( মা, রৌদ্রের ভিতরে চিঠি)
বা বহু পরে লেখা এই লাইনগুলি
“বড় বেশি বানানো কথাবার্তা, শব্দ ব্যবহার
নিয়মমাফিক সব, এমনকি ঠোঁটের নিকট এই চায়ের কাপটিও
এই সব কিছু জড়িয়ে আছে মশারির মতো আমাদের চৈতন্যে
এর মধ্যেই মশারি তুলে অকৃত্রিম মৃত্যুর আদর, লাইজলের গন্ধ…” ( মশারি, অগ্রন্থিত, ১৯৮৪-৯৩)
ক্ষুদ্র দৈনন্দিনতাকে বিশেষ একটি মূল্য দেবার কথা  নিজে স্বীকার করে নিয়েছেন বাসুদেব। এই অদ্ভুত যাত্রাপথে আপনি, পাঠক, নিজের অজান্তেই সঙ্গী হচ্ছেন যে কবির, তিনি অনুবীক্ষণ দিয়ে স্যালাইনের তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা নুনজল ঝরতে দেখেন, আর একইসঙ্গে ধরে ফেলেন ব্রহ্মান্ডের পালস!
দেখা যাক এবার, ব্রহ্মান্ডের নাড়ী টিপে থাকার নমুনাগুলি, আরো কিছু। যদিও ওপরের ঐ সম্পূর্ণ উদ্ধৃত ছাতা কবিতাটিই যথেষ্ট নমুনা বলে আমরা মনে করি, তবু, সংশয় ভঞ্জনের জন্য দেখব আরো কিছু বাসুদেব পাড়ি… দৈনন্দিন থেকে উড়াল, চিরন্তনের দিকে…

১। তেরছা আলো এসে পড়েছে বাদামি মোজার ওপর…। থাকো, আরশোলার মতো/ পুরোনো বাকসের ফাঁকে/…চঞ্চলতা নেই হাঁটাহাঁটি নেই/ সমসত বিশ্বব্রহ্মান্ড/ একটা ফলের মত পেকে উঠেছে নিঃশব্দে/ থাকো শুধু সঙ্গে থাকো

(মোজা)

২। বড় বেশি কথা কওয়া, এসো পাশে বসো
দেখে যাও নুনচিনি এখানে সমান
সমস্ত পৃথিবী ইতিহাস জ্যোৎস্নার ভিতর…  ( নুন চিনি)

যে সব কবিতা পাঠক অভ্যস্ত আছেন জীবন মৃত্যু প্রেম নিয়ে গোলাকার, বিশাল ও খুব আকাশচুম্বী সামান্যীকরণ পড়ে নিতে, কবিতায়, তাঁরা ধাক্কা খেতেই পারেন এখানে এসে, আবার নিচু হয়ে ছোট্ট পেরেকের মত বা ছোট্ট ব্যাঙ এর ছাতার মত কুড়িয়ে নিতে শিখতে পারেন। কবি এখানে আপনাকে ছোট হয়ে নিচু হয়ে মাথা নামিয়ে নিয়ে সরু চোখে কবিতা পড়াতে শেখাচ্ছেন, কবি এখানে আপনার সঙ্গে আছেন আপনার মোটা আর গোদা হয়ে যাওয়া স্পর্শগ্রহণ শক্তি, শ্রবণশক্তি দৃষ্টিশক্তিকে সূক্ষ্মতার সুশ্রূষা দিয়ে সারিয়ে তুলবেন বলে… আপনার মননের ধার কমে গেছে কি? তাহলে এই ছায়াময় সজনে তলায় দুদন্ড বসুন পাঠক!

দু’মেরুর মধ্যে দোলাচলের কথাটি আমরা বাসুদেবকে খুঁটিয়ে পড়তে পড়তেই আবিষ্কার করতে চাই। যেমন স্বাদ নিতে চাই পথের ধারে, কামারকুন্ডু স্টেশনের মিষ্টির দোকানের সীতাভোগের । যেমন খেতে চাই ময়দানের ভোরের কুয়াশায় ভাঁড়ের চা। যেমন হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় শিহরিত হয়ে অনুভব করি, জীবনের অর্ধেকটা অপচয়িত, কিন্তু বাকি অর্ধেকটা হিরের টুকরোর মত ঝকঝক করছে, সামনে!

“নশ্বরতার মধ্যে কখনো কখনো এসে পড়ে অতিজীবনের কাকজ্যোৎস্না। বিষয় উপকরণের মধ্যে থেকেও কেটলির বাষ্পের মত একটা দীর্ঘশ্বাস বা আর্তি উঠে আসে অন্য জীবনের জন্য। এই দুই জীবনের মধ্যে এক মায়াবী সেতুর মত আমার অকিঞ্চিৎকর কবিতা দুলতে থাকে। “ লিখেছিলেন বাসুদেব। 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment