স্বদেশ সেন

স্বদেশ সেনের স্বদেশ

স্বদেশ সেনের বাছাই কবিতা

কোথায় এক পরিবর্তন

কোথায় এক পরিবর্তন
প্রচল থেকে কোথায় আছে অন্য
অরুণা যায় থেকে অরুণা আসে
এই সামান্য মুদ্রায়
দিনরাত ও শরৎ হেমন্ত সব যায়।
জন্ম-পঙ্‌ক্তি থেকে একটা লাইন পড়ো
সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ
পড়ো এমন করে, এমন অসাধারণভাবে পড়ো
যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়।

 

অস্থায়ী

পায়রা পিছলে যাবে
এমনি হ’য়েছে আকাশ
রোদ এমন
যে কাগজে ছাপানো যায়।
যত ছোট বড় ক’রেই তাকাও
আর ধরে রাখো নিজেকে
মনে হবে
এই ছড়িয়ে গেলো
এই কেঁপে উঠলো বুক।
এমন এমন লোক এখন বাইরে
এমন সব মাতোয়ারা গেছে ভেতরে
ওড়িশীপাক দিয়ে মেয়েরা এমন ভাবে হাঁটছে
এমন ভাবে সিঁদুর রাখছে কপালে
যে বুঝতে পারবে না
কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না।
এমনকি বুঝতে পারবে না
আমাদের আর স্থায়ী চাকরি নেই।

 

দেখা হবে, বাদাম

তোমাকে নিয়েছি আমি, আমাকে নিয়েছে আজকাল
দেখা হবে।
সঠিক বর্ণের মধ্যে
শব্দের মৌলিক ধ্বনি ধরে
প্রবাহে, কুয়োর কেন্দ্রে, অথবা সমস্ত বর্ণফলে ;
মনে মনে জেনো
হয়তো তখনো নয়
গুঞ্জনের গায়ে পড়ে থেকে
নবীকরণের মধ্যে
প্রোটিন পর্যায়ে
নতুন ও অন্য ব্যবহারে
ভরা চুলে করবীর মতো
দেখা হবে।
আমাদের কত গাছে ধরেছিলো গাছের বাদাম
দেখা হবে।

 

রাস্তায় যদুনাথ

দু’ একটা অদ্ভুত রাস্তা থাকে
দু’ একটা ফাঁকা বহির্ভূত রাস্তা
দু’ একজন ধু ধু করা লোক থাকে সেই রাস্তায়
যারা ফেরে না, ফোকরে তাকায় না
যে পায়ে কাদা সেই পায়ে কাঁকর
এমন মরিয়া ম্লান, মায়াতুর, চালতার পচা …
জমা পড়ার একটা পাহাড় আছে দূরে
মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে …
একটা কার কুকুর যায় – পেছনে পেছনে লোক
মাঝ বালতিতে যা নেই সেই মৃদু জলের শূন্য
ফাঁদে পড়া ষাট বছরের এখন কেবল মধ্যে মধ্যে ফাঁপ
কেবল ধুলো কেবল লালচে ধুলো
ওই অনিলের জং এবং ওই অনিলার জং
দু’ একজন হাটুরে লোক ওই রাস্তায়
দু’ একটা গরদ আর গামছার ছায়া
যদুনাথের ওই মৃত্যু যদুনাথের ওই সুশীলা মা।

জাদু

একটা কি চাঁদ উঠেছে না বৃষ্টিতে ভিজেছে অর্জুন গাছ
সেই অর্জুন গাছে বসেছে পায়রা
লাল পা, শাদা গা, নীল ঘুম ?
ও জাদুবাজ তামাড়িয়া, সিল্ক, গরদ আর টায়রা
একটা কি সূর্য উঠেছে না আগুনের ব্লুম ?

 

শেষ পর্যন্ত

আমাকে একটা কাজ দাও, যে কোন, যেমন তেমন একটা কাজ
মাইরি-মেরী করে বলছি
একটা কাজ দাও
এই নিত্যিদিনের বানভাসি আর ভাল লাগছেনা।
বেসিমার চুল্লিতে দুহাতে করে আমি লোহার ক্কাথ ছেঁকে দেবো
আমি ঝুড়িতে চন্দন নেবার মতো করে টানবো স্ল্যাগ
আমাকে একটা ন’শো পাউন্ডের বৈদ্যুতিক হাতুড়ি করে নিও
যা দিয়ে জ্বলন্ত ইনগটগুলো ছু’ বলতে ঊরুর নীচে পেড়ে ফেলা যায়।
তা নইলে কী করবো বুকের এই ন’লক্ষ কিলোওয়াট
জলবিদ্যুৎ নিয়ে
শেষে কি জ্বালাবো তোমাদের সাজানো বাগান,
টেরিন, মেহগিনি, ফুলবাড়ি
আমি কি শেষ পর্যন্ত জ্বলতে জ্বলতে দু’চোখের চামড়া খুইয়ে
তোমাদের অন্দরে ঢুকে পড়বো?

 

সরোদ

নতুন জিভের মতো অল্পলাল ভাষাটা আমাকে দাও
আমাকে দেখাও পাথরের পৃথিবীতে জ্বলছে নিভছে আলো
দূরে—অন্ধকারে জল—তার প্রবাহ আমাকে দেখাও।
চলে যায় সুখের রেখা তার টানা শব্দ কোন্‌ আকাশে যায়
কেন সুন্দর কেন সুন্দর এত একটি মুনিয়া তার শাদা ডিম।

ওই নতুন ট্রাইসিক্‌লের সারা রাস্তা সোনার তারের মতো শব্দ
ওই কীটপতঙ্গ যারা শব্দ করে—জঙ্গলে, শরতে, মধ্যখানে
যে মাঠ ময়দান এমন ভুবন ও তার আকাশ দেখে দেখে পাগল
যারা যারা চুপ করে আলো দিয়ে যায় ময়দানবের মতো
ওই সব আমার সাজমহল দূরে, দুঃখে, তারায়
ওইতো একটু শীতের ঘাম জড়িয়ে আছে আকবরের তারে

 

যোগ

ঘুম থেকে ওঠা আজ অন্য একরকম
এই সহসাই ভালো লাগছে
এ সকাল যেন হাতে ধরা যায়
বোঝা যায় কাছে আছে রোদ।

সব সুন্দর কথাই দরকারি কথা
দিন এখন ঘুরে বসে দেখার মতো
হালকা প্রকৃতি ও তার ভার দেখা
গাছের নীচে গাছের প্রতিফলিত পাতা।
এইতো ঠিক মনোভাবের খেলা, যাতে
দুধ দোয়ানোর সাড়াশব্দ থাকে।

নিরাময় ছাড়া আর অন্য কথা নেই
মিল দিয়ে মেলানো হ’ল মিলন
মেলামেশার ভেতর দিয়ে ঢুকে যাওয়া
মনপ্রাণে আর নতুন চাহিদা নেই।

পয়সা না, আজ ঢেলে ছড়াবে হাসি
সদাবাহার এসে উঠবে কোথাও
যোগ হচ্ছে মানে অনেক মিলে যাচ্ছে
ঘটে যাচ্ছে সকালবেলার মিলনসার।

 

শাদা ফিল্মগুলি

আমার কথার ওপরে এলো তোমার কথা
ফুটে উঠলে তুমি গ্রামের রেলগাড়ির মতো ধীরে
একটা ঘাসের কায়দায় দাঁড়িয়ে শুনলে দুই কানে
এ জীবন থেকে ওই অন্য জীবন কথা।

এই চলচ্চিত্রে তুমি আমি আছি ফিল্ম হয়ে
আমরা মিশে আছি আর কেউ যেন না পায়
চোখে আজ সব আছে ভারী হয়ে
ক্যামেরা চাকার মতো সব সমতলে চালু আছে।

আলোর ভেতরে আছে সব ফিল্ম শাদা
কিছু মৌখিক আছে যাকে আকৃতিতে পায়
ভারী বেদনায় চোখ গলিত হয়ে আসে
মানুষের কত রূপ ও অনুকম্পিত ভাব আছে।

শাদা সাফ জল আর কালা মাল ঘাঁটা
সব ঘাঁটার ভেতরে আছে গাছ পাথরের ফটো
সখা সই সুখে নেই তবু যেন আছে
গ্রীষ্মের জলের মতো আকাশে কিছু তারা।

 

দূরে এবার

নীল রবারের থাবা পড়ে গেছে এইসব আকাশের গায়ে
কী ভাবে যে খেলে গেছে শরতের যত ভালো
যত কিছু আলো

ধামাচাপা ছুটি এসে খাড়া হও
আমাদের বেড়ানোর একশেষ করো
পাহাড় দেখাও, জল, বেহালা কাঠের গাছগুলি।

কিছুই ছিলো না কোন—দেখিনি শুনিনি কিছু কানে
আমাদের এই জন্ম—এই কি সাধের জন্ম—পড়ে গিয়ে আছে
প্রথমেই সব ভাব চটে যায়
প্রথমেই শত কাতরতা
কী যে যা তা হয়ে গেলো
হ’লনা তো বুক থেকে, চোখ থেকে
ভারী জল থেকে কিছু পাওয়া।

আমাদের দিতে থাকো এইসব—নতুনের থেকেও নতুন
একবার ছাড় দাও—আবার নজর দাও আমাদের দিকে
একমাস চাপা খুশি
একমাস যেন বড় সুখ
রোগা মানুষের আমি
চারিদিকে আজকাল, আরো কত দিন।

 

যে তুমি মেরেছো

চলেছো আমাকে মেরে, চলে গেছো
একটা ছুরি খুব মেরে গেছো
লক্ষ করেছি তুমি ছুটে গিয়ে পলাতক হলে।
বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো
ভালোবাসলে না সে রকম – দশা তাই মারাত্মক হ’ল
ছিলো আরো কত গান দু’মিনিটে সেগুলি হারালো।
কোন কোন চোট আমি অনেক সারিয়ে নিতে পারি
সমস্ত মৌরির মতো আমিও অনেক সইতে পারি
শুধু উপলক্ষ্য চাই একটু দূরে যদি আমি একা।
যে তুমি চলেই গেছো সে কি জাজ্জ্বল্যমান হতে পারে
নিজের হত্যায় এসে সহমত হয়ে যেতে পারে
এতটা সম্ভব হলে ভালো হ’ত – এত ভালো হ’ত।

 

এ এমন দিন

ফিরে আসার কোন শেষ নেই
ঘরেই থাকো আর আমবাগানে
অন্নজলে কিম্বা হাসপাতালে থাকো
পায়েই হাঁটো কিম্বা চালাও শখের গাড়ি
যদি রসিক হয়ে থাকো কোনোভাবে
যদি বা অলস, লম্পটের ভাবনা ভাবো
হেরাফেরী চাও কী ঝামেলা থেকে ফেরো
যতই ডাক্তার হও বা ঘরের ফেলনা
বেদনাদায়ক কিম্বা বিনোদক
এ এমন দিন
ফিরতে পারবেনা ঘরে ফেরার মতো

 

অক্ষর নেবেনা কিছু

ধ’রেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবেনা কিছু
তোমাকে আমার বলা হয়েও তা হবে না
আমি যে থমকে গেছি তার চিহ্ন এই দেখো
সামগ্রিক রঙ থেকে খোয়ানো আসল রঙ।

দু’ একটা যদিও হয় তাও হবে অন্য আরো
হয়তো নিশ্চিত ফুল সেও হবে অন্যরকম
গুমোট জানালা তার বাইরে আটকে যাবে
অবাক ক’রবেনা আর অবাক কান্ডের ফুল।

মুখের নিশ্চয়-দাগ তা হ’লে তবুতো দাগা
তুমি যাকে মস্ত বলো তা সে কে বানাবে
ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবেনা কিছু
অযথা তাড়িত হবে হাতছুট্‌ লেখার হাত।

তোমার খাবার ঠিক পাতের মাঝখানে দিতে
পারবোনা এ বিষাদ জেনে ব’লে রাখি
হাঁপিয়ে ওঠার এই অতি-চিহ্নগুলি দেখো
জেনো একজন গেছে, খুবই সে হাঁপিয়ে গেছে।

 

তোমার পক্ষে

আমি তোমার পক্ষে আছি
সর্বজন তোমাদের পক্ষে।
আমি যদি রূপের কাছে বসি
তবু কত গুণের কাছে বসে আছি
মাটির পুণ্যের কাছে বসে থাকি আবার
নিরালা স্বাদের তুঙ্গ ঠেসে বসা।

কই, মেঘে আকাশে কই বর্ষাকাল
কথা ছিলো অনেকানেক বর্ষার
কথা ছিলো শরৎ যেমনকে তেমন একটা লম্বা শরৎকাল।
পাকা আমের পথে গিয়ে কতই ডাকা হলো
কই আমগুলাবী, কই রে আমার
কই রে বসন্তে আমাদের ভাবনা
গাছে ফুলে ধুলোয় জামতলা
আর হিমেল কোথায়, হিমেল আমার, কত
আমাদের খুঁজে বেড়ানো!

আমি তোমার পক্ষে আছি
আজ সুপ্রভাত বলবো
কত সর্বজন তোমাদের পক্ষে
কাঁচা হিম আর সারি হরিতের পক্ষে
আমি তোমার বসে আছি।

 

ভয়

টেলিফোন বাজতেই একদিন একটা ভয় হতো
কি বলতে কি জানি বলে ফেলার ভয়
যাবো তো কোথায় যে যাবো তার ভয়
দেখো রে অজানা চোখ তো তাতেই আমার ভয়।
ভয় কত রকম? ভয় নানা রকম।
বড়বাবুর ভয় বলেও এক ভয় ছিলো আমার
আমার ছিলো হিঁদু-মোসলেমের ভয়।
এক ঘর সোজার পরে দু’ঘর ওলটানো আমি ভয়
কী আর কে আর বলতে বলতেই ভয়
পাতলা করে জ্বলে যেতে আমি সেই গোপনে কাঠের বাস্তু ভয়।

 

এখানে পড়ুক ঝুমকা

আমি স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ভূত বুঝিনা, যেমন
বুঝি ক্ষুধা। ঠান্ডা জল গলায় নামলে বুঝি
আমি কষ্ট করে বুঝেছি নেতাজী গান্ধিজী রুশী বিপ্লব
বুঝেছি টাটার বিজ্ঞাপনের ভাষা –নারীর মূল ও শাখামূল
আমি বুঝি দিনমজুরির পরে কেন মহুয়া চাই দোসাদের, কুর্মীর, কামিনের
কেন চারাগান আর পাটকল, কেন ফেল করা পাশ করা মানুষ
টিকিট টোকেনের যুদ্ধ
আমি বুঝি প্রেম, পয়জার, আপনা নাম ও জয়স্তম্ভ

হে অস্পষ্ট কবিতা, আমি তোমাকেও দুপাশে ফিরে
কোলবালিশসম বুঝতে চাই
আমি দেখতে চাই দারুণ গোপনে কোথায় বাড়ছে তোমার
নীল তিল
আমি চাইনা উদাসী বাংলা মেয়ে
পড়ে থাকুক দূর পালামৌ জেলায়
তাঁবু আজ এখানে পড়ুক, পড়ুক ঝুমকা।

একদা ডালিম গাছ

তোমাকে জৈষ্ঠ্য মাসে পেয়েছে
এখন সেই আশ্চর্য রস হবে তোমার
তুমি ছুটবে কালভার্ট ডিঙিয়ে, দ্রুত
ঘন এবং ডাঁটো হবে, ঠান্ডা অহংকারে আলোকিত
রাত্রে জানালার নয় বর্গফুট আলোর মতো
চন্দনার কলুদ ফুলের মতো
তুমি এখন বুঝবে
কী করে আখের আঁশ ভিজে যায় কাবেরীর জলে।

একদা ডালিম গাছগুলি বড় জব্দ
কেননা সে ডালিমের ভার
ডালিমের ভার নামে একদিন ডালিমের ডালে।
এই তো সময়-
তুমি কাদার ভেতরে শুনবে ডাকছে কত মেঘ
গরম বুকের দুধ কার যেন
প্রসবপ্রয়াসী ডাক কার যেনএবং কোথায় যেন বুলবুল বুলবুল শব্দে
দুধ ফেটে যায়।


বিশেষ কৃতজ্ঞতা- শংকর লাহিড়ী

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment