সরকারবাহাদুরের সমালোচনা।
১৯২৫। ফোর্ডের মডেল-টি গাড়ির চাহিদা তখন এতটাই তুঙ্গে যে হেনরি ফোর্ড নিশ্চিন্তে বলে দিলেন “A customer can have a car painted any color he wants as long as it’s black”। মোদ্দা কথা হল রং নিয়ে ত্যাঁদড়ামি করলে চলবে না, যা বানাচ্ছি তাই নিতে হবে নইলে কেটে পড়ো। “কাস্টোমার ইজ দ্য কিং” গোছের কথা তখন মূল্যহীন। ফোর্ড সাহেবের সেই বিখ্যাত উক্তির টেম্পলেটেই দিব্যি সাজিয়ে দেওয়া যায় এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি; ““A Citizen can say anything about the Government as long as it’s Pro-Government”। অর্থাৎ গদগদ ফর্ম্যাটে সরকার বাহাদুরের প্রশংসা না করতে পারলেই হয় আপনি ইমরান খানের গুপ্তচর নয়তো আইসিসের জয়েন্ট সেক্রেটারি।
প্রশংসা ও নিন্দে প্রসঙ্গে বলি। য়ুভাল হারারি তাঁর লেখা বইগুলোতে একটা কথা খুব স্পষ্ট ভাবে লিখেছেন এবং যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে বুঝিয়েছেন। ওপিনিওন বা মতামত জিনিসটা আপেক্ষিক; সেগুলো আর যাই হোক নিরেট নয়। অর্থাৎ আমার চোখে ব্যাটসম্যান শচীনের চেয়ে ব্যাটসম্যান সদাগোপান রমেশ বেশি “ভালো” হতেই পারে; সে কথা ফলাও করে বলাতেও অন্যায় নেই যতক্ষণ “ভালো”র ডেফিনিশনটাই অস্পষ্ট রয়েছে। তবে হ্যাঁ, আমি যদি বলি রমেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের চেয়ে বেশি রান করেছেন; সে’টা বলা মানে ফ্যাক্ট কে ঘেঁটে দেওয়া। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো অতি সরল কিন্তু রাজনৈতিক তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রে এই ফ্যাক্ট আর ওপিনিওনের ফারাকটা গুলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে “আধুনিক চাণক্যগিরি”। ফ্যাক্ট চটকে মেখে তা দিয়ে ওপিনিওন মজবুত করার ব্যাপারটা অবশ্য নতুন কিছু নয়; সেটাই প্রোপাগান্ডা আর সেখানেই ছিল নাৎসি জার্মানির মূল শক্তি। এ প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত “ওপিনিওন” প্রকাশ করি; আমরা কি ইতিমধ্যেই ১৯৩০ দশকের জার্মানির মত বিষিয়ে গেছি? সহজ কথায় বলি; আমার মতে (ওপিনিওনে) “না”। আর তাছাড়া ১৯৩৫ আর ২০২০র পৃথিবীর মধ্যে বিস্তর ফারাক, ইন্টারনেট দুনিয়ায় নাৎসিপনার নক্সা এক হবে না। আবারও বলি আমার মতে সে জার্মানি যে অন্ধকারে ছিল, আমরা আদৌ সেখানে নেই। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর সমস্ত নাগরিকের ওপর একটা ভয়ানক “ট্রেন্ড অ্যানালিসিস”-এর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গেছে। সমস্ত নাগরিককে সজাগ থাকতে হবে যাতে আর একজন হিটলার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ইতিহাসের পাতায় অনিষ্টকারী শাসকের উদাহরণ নেহাত কম নেই কিন্তু হিটলার ও তাঁর নাৎসি পার্টি একদিক থেকে অনন্য কারণ তাদের উত্থান আকস্মিক নয়; দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থনই তাদের সৃষ্টি করেছে। অতএব আমাদের কর্তব্য আর একটা “থার্ড রাইখ”এর সামান্যতম সম্ভাবনাকেও চিহ্নিত করতে পারে এবং সেগুলোকে আস্কারা না দেওয়া।
সংখ্যালঘুদের সম্বন্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনে ভয়, প্রোপ্যাগান্ডার ব্যবহার, ইতিহাসের “ফ্যাক্ট” দুমড়েমুচড়ে দেওয়া; এই চিহ্নগুলো সম্বন্ধে সজাগ থাকা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। মনে রাখতে হবে এই ব্যাপারটা ঠিক বিজেপিকেন্দ্রিক নয়। সরকার কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম যারই হোক না কেন; তাদের অনবরত প্রশ্ন করে যাওয়াটাই নাগরিক হিসেবে আমাদের একমাত্র দায়িত্ব। যে সরকার যত শক্তিশালী হবে, তাদের জনসমর্থন যত বেশি থাকবে; তাদের প্রশ্ন করার (এবং সমালোচনা করার) দায় ততটাই বেশি হওয়া উচিৎ (উল্লেখ্যঃ ইন্দিরা সরকার এবং এমার্জেন্সি)। সেনাবাহিনী থেকে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক; যাবতীয় সম্পদ থাকে সরকারবাহাদুরের হাতে, উত্তর দেওয়ার দায় তার সবার চেয়ে বেশি। আজকাল আমরা প্রায়ই শুনি “আমরা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো”। তাতে যে কী হাতি-ঘোড়া গর্ব রয়েছে কে জানে! পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার সময়টুকু বোধ হয় জেনারেল জিয়া উল হকের কড়া ইসলামিক শাসন; এবং সে শাসনের মূলমন্ত্র ছিল যে কোনও সরকার-বিরোধী আলোচনাকে থাবড়ে দমিয়ে রাখা। কাজেই আমাদের আর পাকিস্তান হয়ে কাজ নেই।
সরকারের সমালোচনা আমাদের করতেই হবে, না করে উপায় নেই। আর ভোট যেহেতু এ দেশে দিই, সেহেতু এ দেশের সরকারেরই সমালোচনা করব; বেশ করব, একশো বার করব।
নাৎসিদের কাজকর্মের ব্যাপারে গুছিয়ে জেনে রাখাটা আখেরে উপকারী। কারণ ওই; ট্রেন্ড অ্যানালিসিসের দায়িত্ব আমাদের সকলের। উইলিয়াম শিরার সাহেবের “দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ থার্ড রাইখ” বইটা রেকমেন্ড করে রাখলাম।
রাজনৈতিক তর্ক এবং লজিকের লেজ।
হোয়াটাবাউটারি শব্দটা আমার ভারী প্রিয়। লজিক মুচড়ে দিতে এ শব্দের জুড়ি নেই। তবে এটাও ঠিক যে হোয়াটাবাউটারি এক ধরণের স্বীকারোক্তিও বটে। ইতিহাস ব্যবহার করে বর্তমানের গোলমাল ঢাকার চেষ্টা সমস্ত সরকারই করে কিন্তু নাগরিক হিসেবে চোখে ঠুলি পড়লেই মুশকিল। আর সোশ্যাল মিডিয়া ডিবেটের যুগে এ জিনিসটা যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু থাম্বরুলটা গুলিয়ে দিলে কিছুতেই চলবে না; যার ক্ষমতা বেশি, উত্তর দেওয়ার দায়ও তারই বেশি। আর ক্ষমতার দিক থেকে দেখতে গেলে সবার ওপরে গভর্নমেন্ট তাহার ওপরে নাই। তবে হোয়াটাবাউটারির একটা সুবিধেও রয়েছে; “অমুকের অন্যায় নিয়ে কথা বলছ, তমুকের অন্যায়ের সময় কোথায় ছিলে”, এর মধ্যে অমুকের অন্যায় প্রসঙ্গে একটা প্রচ্ছন্ন স্বীকারোক্তি রয়েছে বইকি।
“ট্রেন্ড অ্যানালিসিস” এবং “সতর্ক” থাকার প্রয়োজনের কথা এর আগেই উল্লেখ করেছি; ইতিহাস সাক্ষী যে এই অতি-সতর্কতাতেই দেশের ও দশের মঙ্গল। হোয়াটাবাউটারির যুক্তি ফলিয়েই এক সময় নাৎসিরা নিজেদের প্রোপাগান্ডা যন্ত্রকে নির্বিচারে ব্যবহার করেছে। সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে উড়িয়ে দিতে হোয়াটাবাউটারির জুড়ি মেলা ভার; “তখন কোথায় ছিলে” বলে দিব্যি এখনকার গুরুতর প্রশ্নগুলোর দায়ভার এড়িয়ে থাকা যায়। এবং লজিক ও যুক্তি অবলীলায় ঘেঁটে দেওয়া যায়।
কিন্তু এ লেখার বিষয় নাৎসি অত্যাচার নয়। বর্তমান ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলাটুকু ছাড়া এ লেখার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই লজিক ঘেঁটে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা বেশ সরল হয়ে এসেছে। ২০১৯ সালে ৯০ কোটি ভারতীয়র ভোট দেওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে ভোট দিয়েছিলেন প্রায় ৬০ কোটি। এদিকে বর্তমানে ভারতে হোয়্যাটস্যাপ ব্যবহার করছেন প্রায় ৪০ কোটি মানুষ; অর্থাৎ একটা বড় অংশের ভোটারদের কাছে খবরের উৎস হয়ে দাঁড়াচ্ছে হোয়্যাটস্যাপ। উত্তর কোরিয়ায় শুনেছি সরকারের তরফ থেকে জোর করে রেডিও গছানো হত এবং আইন করে মানুষকে রেডিও শোনানো হত; যাতে তাদের “ট্রেন” করা যায়। রেডিওর ব্যবহার খোদ গোয়েবেলসও কম করেননি। কিন্তু এ যুগে কিস্তিমাত হচ্ছে হোয়্যাটস্যাপে। ভুয়ো খবর ছড়ানো হচ্ছে শুধু তাই নয়, অম্লান বদনে সেই মিথ্যেগুলোকে সত্যি বলে চালানো হচ্ছে এবং চালানো যাচ্ছে।
উদাহরণঃ দীপিকা জেএনইউতে যাওয়ার পরের দিনই ছপক সিনেমাটা সম্বন্ধে একটা গাঁজাখুরি তথ্য ছড়িয়ে পড়ল, সিনেমায় মুসলিম অপরাধীর নাম পাল্টে নাকি হিন্দু নাম রাখা হয়েছে। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী টেলিভিশনে এসে নিশ্চিন্তে সেই ভুয়ো খবর টেবিল চাপড়ে সত্যি বলে চালিয়ে দিলেন।
এই “ফেক নিউজ” তাও যেমন-তেমন। যেটা প্রায় দাবানলের মত আজকাল ছড়িয়ে পড়ছে সে’টা হল “টুইস্টেড (বিকৃত) লজিক” ব্যাপারটা । অবশ্য এ ব্যাপারটা পৃথিবী জুড়েই এখন ঘটছে। তবে এ দেশে বসে আমাদের গায়ে বাড়তি কাঁপুনি কেন ধরা উচিৎ?
কাঁপুনির কারণ ১।
ওই। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে পারার মত সফল পলিটিকাল মডেল খুব কমই রয়েছে। আর এই আতঙ্কের ফলাফল যে কী গোলমেলে তাঁর উদাহরণ আমাদের আশেপাশে কম নেই (বার্মার রোহিঙ্গাদের কথাই ভাবুন)।
আমাদের আচমকা ধারণা হয়েছে যে এই বেলা সাবধান না হলে দেশের হিন্দুদের সমূহ বিপদ। বহু খবর (সব ভুঁয়ো অবশ্যই নয়) নিয়মিত চালচালি হচ্ছে যে “সংখ্যালঘু তোষণ করতে গিয়ে” দেশের কী ক্ষতিই না এদিন হয়েছে। চারিদিকে একটা গেল গেল রব।
“গেল গেল” ব্যাপারটা ঠিক কতট যুক্তিযুক্ত?
ভারতবর্ষের ১৩.৫% মানুষ মুসলমান। (উৎসঃ http://censusindia.gov.in/Census_And_You/religion.aspx)
২০১৪-১৫ নাগাদ সরকারি চাকরীতে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে প্রায় ৯% মত মুসলমান। (উৎসঃ https://pib.gov.in/newsite/mbErel.aspx?relid=147820)
২০১৫র ইকোনোমিক টাইমসের একটা সমীক্ষা অনুযায়ী কর্পোরেট উচ্চপদে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র ৩% মুসলমান। ( উৎসঃ https://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/muslims-constitute-14-of-india-but-just-3-of-india-inc/articleshow/48849266.cms?from=mdr )
এ’টা গেল অর্থনৈতিক দিক (অবশ্যই সামগ্রিক পরিস্থতিতিটা সম্যক ভাবে শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়। বাড়তি খবরের জন্য এই লিঙ্কটাও রইলঃ https://www.hindustantimes.com/india-news/untouched-by-economic-growth-destitution-illiteracy-hurt-india-s-muslims/story-Lz5HhyifFkPxZ4pu5gT85N.html) ।
কাজেই বিজেপির আগে যারা সরকারে ছিলেন তারা মুসলমানদের স্বার্থে প্রাণপাত করেছেন, এমন ভাবাটাও নেহাতই হাস্যকর।
ক্ষমতার দিক থেকে ভারতীয় মুসলমান কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন?
লোকসভায় ৫৪২টা সীটের ২৭জন মুসলমান (৫%)। গুজরাতের ১০% মানুষ মুসলমান কিন্তু গত তিরিশ বছরের মধ্যে কোনও গুজরাতের মুসলমান লোকসভায় পৌঁছতে পারেননি। উত্তর প্রদেশের প্রায় ২০% মানুষ মুসলমান অথচ বিধানসভায় যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে স্রেফ ৬% মুসলমান।
আবারও বলতে হয়, শুধু কয়েকটা ডেটা-পয়েন্ট থেকে নিখুঁত অ্যানালিসিস সম্ভব না হলেও; “গেল গেল” হাহাকারটা কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন করাই যায়।
এতটা বলেই মনে হল এই বুঝি কেউ বলবেন “এত যে বড় বড় বাতেলা ঝাড়ছেন, আপনি জানেন পাকিস্তানে হিন্দুদের কী দশা? জানেন বাংলাদেশে কত শতাংশ হিন্দু সরকারি চাকরী করছেন”? সে ক্ষেত্রে জানবেন; প্রথমত এটা খুবই নিম্নমানের হোয়াটাবাউটারি। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের মত হতে চাইনা বলেই এত কথা। আর হ্যাঁ, যে দেশে আমার ভোট রয়েছে, আমার কাঁধে সে দেশের পাপ পুণ্যের দায় সবার আগে বর্তাবে।
কাঁপুনির কারণ ২।
ইতিহাস এফোঁড় ওফোঁড় হতে শুরু করেছে।
প্রথমত, এই যে বিজেপি সাতচল্লিশের কংগ্রেসের কাজকর্ম তুলে গাল পেড়ে ২০২০তে ভোট চায় বা এই যে সাতচল্লিশের কংগ্রেসের কাজকর্ম দেখিয়ে ঢেঁকুর তুলে কংগ্রেস ২০২০তে ভোট চাইছে; গোটা ব্যাপারটাই অস্বস্তিকর। ১৯৪৭য়ের কংগ্রেসের ভালো-মন্দের সঙ্গে বর্তমান কংগ্রেসকে জুড়তে চাওয়াটা নিতান্তই অবান্তর।
কিন্তু দেশভাগের ন্যারেটিভে জল মিশলে সমস্যা তো হবেই; কারণ ওই দেশভাগকে ছুঁয়েই স্বাধীন ভারতবর্ষের পথচলা শুরু।
কিছু কিছু মোটা দাগের কথা গুলিয়ে গেলে বড় সমস্যা।
যেমন, নেহেরু গান্ধী মিলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নিয়েছেন কাজেই ভারতবর্ষে বসে ধর্মের কন্টেক্সট গুলিয়ে দিলে চলবে না। সে সময়ের ইতিহাস সবিস্তারে জানলে এমন অবান্তর প্রশ্ন মাথায় আসার কথা নয়। কথাটা আদৌ নেহেরু-গান্ধী ভক্ত হয়ে বলা নয়। দেশভাগ মেনে নিতে বাধ্য হওয়া আর ধর্মের ভিত্তিতে “টু-নেশনস থিওরি” (যার ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল) মেনে নেওয়া এক নয়। কেন নয় তা এই প্রবন্ধের পরিসরে আলোচনা করার কোনও মানে হয় না। দুএকটা বই পড়লেই সেই সময়টা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আমার প্রিয় বই হল অ্যালেক্স ভন তুনজেলম্যানের লেখা “ইন্ডিয়ান সামার” বইটা। “নেহরু গান্ধীর জন্য দেশভাগ হয়েছে” এ অভিযোগ দুম করে উড়িয়ে দেওয়াটা এ যুগে হঠকারী ব্যাপার হবে। কিন্তু আয়রনিগুলো স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে এই বইয়ের জবাব নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পাল্লায় পড়লে মুসলিমদের সর্বনাশ হবে, মোটের ওপর এই থিওরিতে ভর দিয়ে সফল হয়ছিলেন জিন্নাহ। দেশভাগের সব দোষ ‘নেহরু গান্ধী’র বলে গলা ফাটানো যায় বটে, কিন্তু অলটারনেটিভগুলো ঠিক কী কী ছিল? একটা মুসলিম রাষ্ট্রের পাশাপাশি হিন্দু রাষ্ট্র? কিন্তু তা’তে কি জিন্নাহর আশঙ্কায় শিলমোহর পড়ত না? এ বইতে লেখক মজবুতভাবে এমন সব প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন এবং পাঠককে যত্ন করে গাইড করেছেন; অবশ্য পাঠ্য।
আর একটা ব্যাপার বেশ ইন্টারেস্টিং, আজকাল চলতি বলছে নেহেরু অতি বদ কিন্তু সর্দার প্যাটেল লাজবাব। কে ভালো কে মন্দ সে প্রসঙ্গে না গিয়ে যেটা স্পষ্ট করেই বলা যায় দুজনেই ক্যাবিনেটে পাশাপাশি ছিলেন। তাদের মতপার্থক্য নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু সর্দার আর নেহেরুর কাজেকর্মে যোগাযোগ ছিল না, এ সব থিওরি অদ্ভুত এবং হাস্যকর। (ইয়ে, মানে বলেই ফেলি। অমিতবাবু বলছেন ক্রোনোলজি সমঝিয়ে আর নরেন্দ্রবাবু বলছেন আরে ওসব নিয়ে আমরা কিস্যু আলোচনা করিনি; এমন স্পষ্ট গোলমালের স্বপক্ষেও আজকাল যুক্তি শুনি। কিছুটা তো অবাক লাগেই। ক্যাবিনেটের একজন পার্লামেন্টে, বিভিন্ন সভায় এক কথা বলবেন আর ক্যাবিনেটের নেতামশাই উলটো কথা বলবেন; এমনটা হতে পারে না। ঠিক তেমনই, নেহেরু-প্যাটেল এক ক্যাবিনেটেই ছিলেন, দায়ভার ভাগ করে নেওয়া ছাড়া তাঁদের গতি নেই।
মোদ্দা কথা হচ্ছে “লজিকাল গোলমালের” খপ্পরে পড়ে আমরা নিজেদের মনের মত করে ইতিহাস সাজাতে আরম্ভ করেছি। আর তার চেয়েও বড় কথা; শুধু সাতচল্লিশের দেশভাগ নয়, আজ থেকে তিনশো চারশো বছর আগের ইতিহাস উল্লেখ করে আমরা হিসেবনিকেশ “ব্যালেন্স” করতে চাইছি। ঘুরেফিরে ট্রেন্ড অ্যানালিসিসে ফিরে যাওয়াই আমাদের কর্তব্য। ইতিহাসের হিসেবনিকেশ “ব্যালেন্স” করতে চাওয়ার সুড়সুড়ির মধ্যে দিয়েই কিন্তু নাৎসিদের পথ চলা শুরু। আবারও বলি, আমরা সেই অন্ধকারের ধারেকাছে ইতিমধ্যেই হয়ত পৌঁছে যাইনি; কিন্তু আমাদের দায় সতর্ক থাকার।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯।
দুমড়ানো লজিক, অপপ্রচার এবং ভ্রান্ত ইতিহাস বোধ; এগুলোর মিশেল বড় বিষাক্ত।
X = দেশভাগের গোলমাল মেটাতে নাকি এই আইন, অথচ আফগানিস্তানকে এই আইনে জুড়ে নেওয়া হয়েছে যার সঙ্গে দেশভাগের কোনও সম্পর্ক নেই।
Y = প্রতিবেশী দেশের নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়া হবে অথচ বর্মার উল্লেখ সেখানে নেই। ঠাঁই পাবেন না পাকিস্তানের আহমাদিয়ারাও।
এই X আর Y মিলিয়ে এই আইনের মাথামুণ্ডু বুঝতে গেলে যা দাঁড়ায় তা হল চন্দ্রবিন্দুর চ এবং বেড়ালের তালব্য শ। জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সঙ্গে জুড়লে কী গোলমাল হবে সে আলোচনা অবশ্যই জরুরি; কিন্তু একটা অদ্ভুত “মিথ” পরিবেশিত হচ্ছে যে এনপিআরের সঙ্গে না জুড়লে নাকি এই নাগরিকত্ব আইনে কোনও সমস্যাই নেই। ওই X আর Yতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই আইনে লজিকের গোলমাল অবশ্যই আছে।
হারারির “ওপিনিওন বনাম ফ্যাক্ট” দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই X আর Yয়ের সমস্যাটা ‘ফ্যাক্ট এবং লজিক’এর মাথায় একটানা দমাদম মুগুরের গুঁতো মেরে চলেছে।
এবার আসি ওপিনিওন বা মতামতে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে শুধু ধর্মীয় নিপীড়নটুকু দেখলেই আমাদের দায় শেষ হয়ে যায় না বোধ হয় (আবারও বলি, এটা যেহেতু নিতান্তই মতামত; এ নিয়ে তর্কের দায়ভারটুকু আমি অস্বীকার করব না)।
এ বিষয়ে আলোচনা কম হয়নি, নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদ আর তার পাল্টা প্রতিবাদে বাজার সরগরম। সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনের বিরোধিতাকে নস্যাৎ করতে যে সব লজিক ব্যবহার করা হয়েছে তা বেশ অদ্ভুত।
এই যেমন এর বিরোধিতা যারা করছেন তারা চান না পাকিস্তান বাংলাদেশের উৎপীড়িত হিন্দুরা আশ্রয় পাক। কী মুশকিল, অবশ্যই তাঁদের আশ্রয় পাওয়া উচিৎ; উৎপীড়িত হলেই পাওয়া উচিৎ, তাঁর ধর্ম যাই হোক না কেন। এরকম বহু অদ্ভুত পাল্টা যুক্তি শোনা গেছে তাবড় নেতাদের মুখ থেকে। এ বিষয়ে বাড়তি কিছু না লিখে কৃষ অশোকের এই “চিট শিটের” লিংক দিয়ে রাখলাম।
কিন্তু এই সুযোগে যেটা আমাদের না করলেই নয় সেটা হচ্ছে ভারতীয় নাগরিকত্ব সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করা। গত মাসখানেকে বেশ কিছু লেখা প্রবন্ধ পড়লাম বটে, কিন্তু এই বিষয়ে সেরা আলোচনাটা হয়েছে অমিত ভর্মার “দ্য সিন আন সিন পডকাস্টের” এই পর্বে; https://twitter.com/krishashok/status/1208797673731633157?lang=en । পর্বের নাম “সিটিজেনশিপ ব্যাটেলস” এবং অমিতের সঙ্গে আলোচনা জুড়েছেন ঐতিহাসিক শ্রীনাথ রাঘবন। এবং যুক্তি সমৃদ্ধ ঠাণ্ডা মাথার আলোচনা এ কলার-টানাটানির যুগে সত্যিই বিরল। বিশেষত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে আধুনিক ভারতবর্ষে নাগরিকত্বের ইতিহাস সহজ ভাষায় বুঝতে এই পডকাস্টের জুড়ি মেলা ভার।
প্রসঙ্গত বেশ কিছু বই ও প্রবন্ধের কথা এই লেখায় উল্লেখ করেছি। শেষে বলি, এর আগে বহুবার পড়া থাকলেও জর্জ অরওয়েলের “অ্যানিম্যাল ফার্ম”টা না হয় এই বাজারে আর একবার পড়েই ফেলুন। “All animals are equal, but some animals are more equal than others”; রাজনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি অনন্তকাল ধরে এই “সাম আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদার্স”য়ের ট্র্যাজেডিতেই আটকে রইল।