ইরাবান বসুরায়

সত্যিকারের স্বদেশের খোঁজে

জন্মভূমির বর্ণপরিচয় নূতন করে পড়তে বলেছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

সমর সেন বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো চমক নয়, মামুলিভাবেই শুরু করেছিলেন তিনি, তাতে ছিল আবেগ ও উচ্ছ্বাস, শিথিলতা। তা বেশ গতানুগতিকও। ১৩৫০-এ প্রকাশিত প্রথম বই ‘গ্রহচ্যুত’-তে ছিল অনির্দিষ্ট প্রেমের আকুতি বিরহবেদনা, নিঃসঙ্গতার বোধ। জীবনানন্দ- প্রভাবিত সেইসব দুর্বল পঙ্‌ক্তি ছিল প্রথাসিদ্ধ ‘তুমি’-র উদ্দেশে। কবির মনোজগৎই তার উৎস, বস্তুপৃথিবীর সঙ্গে তা সম্পর্কহীন।

তার মধ্যেই হঠাৎ উঁকি মারে লাঞ্ছিত জীবনের মর্মবেদনা ‘চোখের স্বপ্ন ক্ষুধার আগুনে গিয়েছিল পুড়ে’ (নগরীর চোখে চোখে/গ্রহচ্যুত)‘। ‘নতুন মাস’ বা ‘২৬শে জানুয়ারি’ কাব্যগ্রন্থেই মাঝে মাঝে ধরা পড়ছিল ব্যক্তিগত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। পাঁচ বছর বাদে ‘রাণুর জন্য’ কাব্যগ্রন্থে তা আর একটু স্পষ্ট হলো। প্রেমোচ্চারণে এল কিছুটা গভীরতা, একার গণ্ডিতে ঘুরপাক খাওয়ার বদলে চোখ গেল বাইরের অস্থির পৃথিবীর দিকেও। ইতিমধ্যে স্বাধীনতা এসেছে দেশকে দু টুকরো করে।

প্রেম হারিয়ে যায়নি, বহিরঙ্গের প্রত্যক্ষতার বদলে তা এখন অন্তর্লীন বোধের উপর জোর দিচ্ছে। অন্যদিকে দেখছেন কবি রুক্ষ সময় কেড়ে নেয় সবকিছু, যৌবনকেও। ‘কান্নাকে শরীরে নিয়ে যারা রাত জাগে/… … পৃথিবীর সেই সব যুবক যুবতী’ যারা ‘হঠাৎ আকাশে ছোঁড়ে দু-চারটি কল্পনার ঢেলা’, কী পায় তারা! ‘হে যুবক, হে যুবতী, পৃথিবীতে তোমাদের কতটুকু দাম?/কান্নাকে শরীরে নিয়ে কার ঘরে কতটুকু দিয়ে গেলে আলো?’ (মুখোশ/রাণুর জন্য), এটি প্রশ্ন নয়, এক যন্ত্রণার্ত উপলব্ধি। তা সত্ত্বেও কবি এখনও বুঝে উঠতে পারেন না কী বলবেন! স্বাধীনতার আনন্দ থেকেও বড়ো হয়ে উঠছে মোহভঙ্গের বেদনা। কখনও তাই বিদ্রূপ মর্মভেদী হয়ে ওঠে– ‘দুধের অভাবে শিশু আম-আঁটি খাক/ফুটপাথে, রাস্তায়/মরতেও যে চ্যাঁচায়/বেয়নটে গেঁথে দাও তার চোখ, নাক’ (রাইবেঁশে নৃত্যসংগীত/উলুখড়ের কবিতা) এই প্রত্যক্ষতায় আছে প্রতিবাদ, এর পাশেই তিনি লেখেন ‘কীবা আসে যায় বন্দর যদি শ্মশানের ছাই গায়ে মাখে/ঘরে ঘরে মরা শিশুর কান্না ক্ষুধিত মায়েরা মনে রাখে’ তখন এই ‘কীবা আসে যায়’ যতটা না অসহায়ত্ব, তার থেকেও বেশি ক্লীবত্ব। বিদ্রূপ তাই ক্ষমতাধারীদের বিরুদ্ধে ততটা নয়, তার বদলে দারিদ্র্য আর মৃত্যুর ছবিটা তুলে বলে দেওয়া যে ‘কাব্যের ফাঁকে “নেই নেই” ঢোকে, জাত-কবিদের ভাত মারে/ কিংবা শিল্পী স্বপ্ন বানায় হাজার শিশুর মরা হাড়ে’ তাতেও ক্লীবত্ব ঘোচে না।

আত্মগত প্রেম বিরহ মান-অভিমান আশা যন্ত্রণার পর্ব পেরিয়ে আসছেন কবি, তাকাচ্ছেন বাইরের পৃথিবীর দিকে, তা কিছু মধুর নয়। সে পৃথিবী ক্ষতবিক্ষত, তার শরীর জুড়ে রক্তক্ষরণ। সে ক্ষুধায় অস্থির, সেই ক্ষুধার কাছে স্বদেশের স্বাধীনতাও তুচ্ছ হয়ে যায়। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর অর্ধ দশক কাটতে না কাটতেই এই তাঁর উপলব্ধি। ‘রাণুর জন্য’ থেকেই তাঁর মনে হতে থাকে স্বাধীনতার আসলে এক রঙিন তামাশা মাত্র, শুধু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। এই উপলব্ধি বেদনার্ত করে তোলে কবিকে, সেই সঙ্গে ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদীও, কখনও বা বিষণ্ন।

কবি কী লিখবেন! কেবল ধারাভাষ্য তো কবির কাজ নয়। কবিতার দায় সত্য উচ্চারণ, কেবল বাইরের সত্য নয়, নিজের মধ্যে যা অনুভূত হচ্ছে সেই সত্য। পথ খুঁজেছেন চীনের বিপ্লবে, লেখা হয় ‘নতুন চীন: আধুনিক রূপকথা’। এই আধুনিক রূপকথায় কোনো অসম্ভবের কথা লিখতে চাননি, লিখেছেন একটি সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে ওঠার কথাই। এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ভারতবর্ষ, ১৩৫৯’-এ লেখা হয়েছিল ‘এখানে ভোর কুয়াশা, তাই পাখি ডাকে না’ আর এখন লিখছেন ‘মেঘ নেই, মেঘ কেটে গেছে’ (নতুন চীন: আধুনিক রূপকথা)। কেবল ভিন্ন দেশে এই রূপকথা দেখছেন না তিনি, দেখছেন এক ভিন্ন আদর্শে, ভিন্ন রাজনীতিতে।

বদলে যেতে লাগল কবির লেখা, জন্মভূমিকে তিনি ক্রমাগত নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে থাকেন। কবির ‘তুমি’ রজনীগন্ধা, তবুও তা ধূলিধূসর হয়ে যায়, ফুলের মতো দেহেও পোড়োজমির স্বাদ আসে, ‘রূপকথার ছেঁড়া পাতা অন্ধকারে কেটে নেয় বুভুক্ষু ইঁদুর’। স্বদেশকে জানছেন ধূমাবতী বলে, যে সন্তানের ভাত কেড়ে খায়। তবু আশা থাকে, খুব দৃঢ় স্বরে বলেন ‘সে জাগবে। জাগবেই। আমি তাকে কোলে নিয়ে/বসে আছি রক্তে পুঁজে মাখামাখি রাত্রি/ভেলায় ভাসিয়ে… … …/সে জাগবে, জাগবেই, লখিন্দর সে আমার।’ (বেহুলা/লখিন্দর)। পাঠক সংশয়াচ্ছন্ন হতে পারেন–কী করে এত ক্লান্তি যন্ত্রণা ব্যর্থতা পেরিয়ে এই আশায় পৌঁছনো গেল? ‘কালো মেঘের ফিটন চড়ে/কালীঘাটের বস্তিটাতেও আষাঢ় এল/… … …শীর্ণ হাতে শিশুরা খোলে খিল’ (বর্ষা) দেখার পরেই কী করে দেখলেন ‘তুই হাসলে সুয্যি হাসে ফুল ফোটে বনেও’ (তুই)? এই আশার উৎস কি পাওয়া যাবে ‘প্যারীর আগুন’ বা ‘৭ নভেম্বর’ কবিতায়! রূপকথা নয়, কবি শুনছেন ‘রুটি দাও’-র ভিক্ষার শেষে ‘অগ্নিগর্ভ কালবৈশাখী গান’, জানছেন ‘কবর থেকে দেখো লেনিন মাথা তোলে’।

স্বাধীনতার পর এক দশক কাটার আগেই শুরু হয়ে গেল স্বপ্নভঙ্গের পালা। সময় দুঃসময় হয়ে ওঠে। কবিতায় প্রবল হয়ে উঠল সংশয়, সেই সঙ্গে কিছু হতাশাও। গত শতকের ষাটের দশক জুড়ে নানা রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন। ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-র রোম্যান্টিকতার ছ মাস পরেই প্রকাশিত হয় ‘সভা ভেঙে গেলে’, তার পাঁচ মাস বাদে ‘মুখে যদি রক্ত ওঠে’। পাঁচ বছরে নটি কাব্যগ্রন্থ, একটি ছাড়া আরগুলি শীর্ণকায়। চীন-যুদ্ধের ফলে দেশ জুড়ে অশ্লীল জাতীয়তাবাদের জোয়ার, উনিশশো চৌষট্টিতে পশ্চিমবঙ্গ ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছেষট্টিতে সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তুমুল খাদ্য-আন্দোলন, সাতষট্টিতে কংগ্রেসকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা আর সেই মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেওয়া–আন্দোলন আর চক্রান্ত দেখতে দেখতে কবিতা লিখতে হচ্ছিল কবিকে। ‘তোমার লাগি/বন্ধু, আমার/মন যে কেমন করে’ (শিউলিঝরা মাসে/তিন পাহাড়ের স্বপ্ন) থেকে ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তাঁর উচ্চারণ, তিনি দেখছেন ‘পৃথিবী জুড়ে অন্ধকার/সারাটা রাত ছুরি শানায়’ (কঙ্গো, ১৯৬১/সভা ভেঙে গেলে) আর বিপন্ন বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন ‘… সে একজন কবি। সে কবিতা লেখে, আর/যাতে মাইনে বাড়ে/সেজন্য রোজ ঘুম থেকে উঠেই মস্ত একটা বাড়ীতে যায়,/সেখানে গিয়ে একজন মানুষের পা টেপে’ (টাইফয়েড/সভা ভেঙে গেলে)। এই উপলব্ধি সুখের নয়। কবিতা কেন লেখেন এই প্রশ্নের উত্তরে কবি একবার জানিয়েছিলেন ‘আজ অন্যরকম প্রেম, এমনকী কখনও ঘৃণা, যা প্রতিবাদের ভাষা, আমাকে কবিতা লেখার প্রেরণা দেয়’। ‘মুখে যদি রক্ত ওঠে’-তে এই প্রতিবাদের স্বর অনেক স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন।

একদিন তিনি লিখেছিলেন একটা রুটির কাছে প্রিয়ার চোখে মণিও তুচ্ছ, আজ তিনি লিখলেন ‘অন্ন চিন্তা অন্ন গান
অন্নই কবিতা’, এমনকী বললেন ‘সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে/ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে’ (অন্ন দেবতা/মুখে যদি রক্ত ওঠে)। শাসকরা মানুষের দুঃখযন্ত্রণাকে মানতে চায় না, অস্বীকার করতে চায় শত্রুর ভয় দেখিয়ে, দেশপ্রেমের জিগির তুলে। কবি লেখেন– ‘মুখে যদি রক্ত ওঠে/সে-কথা এখন বলা পাপ। … … এসময় রক্তিবমি করা পাপ;’ (মুখে যদি রক্ত ওঠে/মুখে যদি রক্ত ওঠে)। তিনি জানছেন ‘স্বাধীন স্বদেশে আজ সকলেরই ভিক্ষুকের বেশ’, এখন নরকযাত্রাই যেন সব থেকে স্বাভাবিক। সংশয় জাগে ‘আর কতকাল /সইতে হবে এমন আকাল’। কিন্তু উত্তর দেবে কে?

বারবার তিনি বলবেন ক্ষুধার কথা, লাঞ্ছনার কথা। প্রেমের উচ্চারণেও মিশে যাচ্ছে ঘৃণা ও প্রতিবাদ। কবি অনুভব করেন আশ্চর্য ভাতের গন্ধে সারা রাত যায়, তবু ক্ষুধার্ত মানুষকে দূর থেকে সেই গন্ধে জেগে থাকতে হয়, কেননা ‘বাছারে, আমরা অচ্ছুৎ, তাই যেভাবে যতই ডাকো/কোনো দেবতাই বস্তিতে আসে নাকো’ (কালো বস্তির পাঁচালী/মুখে যদি রক্ত ওঠে)। হত্যা আত্মহত্যা আকীর্ণ স্বদেশে অনাহারে মৃত্যুকে কবি কী করে মেনে নেবেন! তাঁর মনে হয় ‘ আমার স্বদেশ রক্তবমি করছে’ (স্বদেশ/মুখে যদি রক্ত ওঠে)। তবুও তিনি প্রেমের কথা বলতে চান। তবে মনে করিয়ে দেন সে প্রেমকে অর্জন করতে হয় দহন-ক্ষমতা, তবেই প্রেমের সার্থকতা, ‘আগুন ছাড়া মিথ্যে ভালোবাসা’, তাই বলতে হয় ‘এসো, আমরা আগুনে হাত রেখে/প্রেমের গান গাই’ (ফুল ফুটুক, তবেই বসন্ত/মুখে যদি রক্ত ওঠে)।

‘ভিসা অফিসের সামনে’-র ভূমিকায় কবি লিখেছিলেন ‘এ-গ্রন্থের সমস্ত কবিতাই মানুষ ও মনুষ্যত্বের নামে, যে-মানুষ দেশ জাতি ধর্মের সমস্ত গণ্ডি পেরিয়ে আজ আর একজন মানুষের সহোদর, যে-মনুষ্যত্ব … … এখনো আমাদের প্রেম শেখায় এবং ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে, ঈর্ষার বিরুদ্ধে, দাঙ্গা আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে সকল সময় সতর্ক করে দেয়’। এই মানুষ আর মনুষ্যত্বকেই কবি খুঁজেছেন তাঁর কবিতায়। কখনও কখনও মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটে, ভালোবাসা হেরে যেতে থাকে। মনে হয় থাকে এত লেখা এত সৃষ্টি, সবই অর্থহীন। জীবনে জীবন যোগ করা যাচ্ছে না–‘ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে/আমি যদি মাটিকে জানতাম!’ একটা বিশ্বাসে স্থির হতে চাইছেন তিনি। বামপন্থী আন্দোলনে একটা ধাক্কা লেগেছে, কম্যুনিস্ট পার্টি ভাগ হয়েছে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সে পার্টির সদস্য ছিলেন না, কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টিটিই তো অনেক ভুল করলেও মানুষের জন্য লড়াই করত, কাজেই বিশ্বাস একটু টলে যায়। ক্লান্তি, অন্ধকার আর গভীর কুয়াশার মধ্যে তবুও শীর্ণ ভালোবাসা মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, ১৯৬৫-তে বসে তিনি লেখেন মে দিনের কবিতা ‘চারদিকে নবজন্ম, দেশে দেশে শঙ্খ বাজে,/শোনা যায় মানুষের গান’।

ইতিমধ্যে ঘটেছে আরও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা– যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার আমলেই নক্সালবাড়ির অভ্যুত্থান। সময়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা গেল ‘ওরা যতই চক্ষু রাঙায়’ ও তার একমাস পরে প্রকাশিত ‘নভেম্বর-ডিসেম্বরের কবিতা’ শীর্ষক দুটি কাব্যপুস্তিকায়। এই কবিতাগুলির লেখা হচ্ছিল ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ চাপে। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে নানা অগণতান্ত্রিক চক্রান্ত আর পুলিসি নিপীড়নের বিরুদ্ধে শানিত হয়ে উঠল তাঁর কলম। এখানে ব্যঙ্গবিদ্রূপ একটা অস্ত্র, অনেক সময় তা কিছুটা ভাষণে আক্রান্ত। কবি একবার বলেছিলেন ‘… এমন কবিতাও কিছু আছে, যারা ইস্তেহারধর্মী। সময়কে বুকের কয়েক ফোঁটা রক্ত দিয়ে হয়ত একসময় তারা কোথায় হারিয়ে যায়।‘ কবিতায় অলৌকিক বিশুদ্ধতা প্রত্যাশা করলে পাঠক তাঁরা হয়ত এই কবিতা বা আরও পরের কবিতায় অস্বস্তি বোধ করবেন, অস্বীকারও করতে চাইবেন, কিন্তু তাঁদের ইচ্ছাপূরণের দায় কবির নেই। ঈষৎ উচ্চকিত হলেও এগুলি কবির সৎ উচ্চারণ। তিনি যখন লেখেন ‘রক্ত রক্ত শুধু রক্ত, দেখতে দেখতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়/… … … এই তোমার রাজত্ব, খুনি! তার উপর কী বাহবা চাও?/আমরাও দেখব, তুমি কতদিন এইভাবে রাক্ষস নাচাও!’ (উত্তরপাড়া: কলেজ হাসপাতাল/ওরা যতই চক্ষু রাঙায়), তখন বোঝা দরকার যে এখানে ক্রোধের সঙ্গে মিশে আছে বেদনা, আর সেখান থেকে তিনি পৌঁছে যান প্রতিবাদে। মাটিকে না জানার আক্ষেপ করলেও মাটিকে তিনি চিনতেন, জানতেন মানুষের চাওয়াপাওয়াকে। সেই চাওয়া সামান্য হলেও তার জন্য যে কত দাম দিতে হয় সেই নির্মম সত্যটিকে কবিতায় তুলে ধরতে তাঁর দ্বিধা হয়নি। ‘প্রতিটি রুটির টুকরো রক্ত মাখা/প্রতিটি রুটির টুকরো, প্রতিটি ধানের শিষ জ্বলে যেন/ফিনকি দেওয়া খুনের নিশান’ (মেঘ নাচে/নভেম্বর-ডিসেম্বরের কবিতা)।

১৯৭১-এ প্রকাশিত হলো তাঁর ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে’। সে এক বিস্ফোরণ। সূচনায় আছে গোবিন্দচন্দ্র দাসের উদ্ধৃতি–‘স্বদেশ স্বদেশ করিস কারে, এদেশ তোদের নয়’। এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বইটির অভিপ্রায়। সত্তরে তাঁর উচ্চারণ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, আরও গভীর ভাবে স্পর্শ করতে চাইল মানুষকে। মন্ত্রের মতো উচারিত হলো–‘যে মানুষ গান গাইতে জানে না/যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।/তুমি মাটির দিকে তাকাও, মাটি প্রতীক্ষা করছে;/তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়’ (জন্মভূমি আজ)।

১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যে কটি কবিতার বই বা পুস্তিকা বেরিয়েছে তাতে আছে এই ক্ষোভ জ্বালা আর প্রতিবাদের তীব্র স্বর। বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই বাস্তবতাকে যেমন অস্বীকার করেননি তিনি, আবার বধ্যভূমির রক্তস্রোতকেও মানেননি শেষ কথা বলে। শিল্পকে কখনও কখনও হয়ে উঠতে হয় নিরলংকার। যখন সত্য নগ্ন, তখনও শিল্পের দায় তো সত্য হয়ে ওঠাই। জীবনের সত্যকে পুরো অস্বীকার করে কি রচনা করা সম্ভব শিল্পের সত্য? এই সত্যকে চিনলেও কেউ অন্ধ সাজেন, কেউ বা বোবা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানতেন এবং মানতেন নরকেও মাথা উঁচু রাখতে হয়। ‘এই নরকে কীসের কবিতা/কার জন্য বা?’ বললেও তাঁকে কবিতা লিখতে হবে, কবিতাই লিখতে হবে।

তিক্ততা আর জ্বালার পাশেই থাকে তাঁর ভালোবাসার উচ্চারণ, কার্কশ্যের পাশেই শুশ্রূষার স্নিগ্ধতা। এই ভালোবাসা দিয়ে তিনি আবিষ্কার করতে চান তাঁর সত্যিকারের স্বদেশ। ১৯৭৬-এ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘শীত-বসন্তের গল্প’। লড়াইয়ের সৈনিকরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে নিহত অথবা কারান্তরালে, লড়াইও সাময়িক ভাবে পর্যুদস্ত। জরুরি অবস্থার ছায়ায় আপাতত শান্তিকল্যাণ। শ্মশানের শান্তিতে কবি এক বিপন্নতা অনুভব করেন, বোঝেন জন্মভূমিকে জানতে হবে নিজের অনুভূতি দিয়ে, কেবল তত্ত্ব দিয়ে নয়। তাঁকে মনে করিয়ে দিতে হয় ‘মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে/নতুন করে পড়,/জন্মভূমির বর্ণপরিচয়’ (সূচনা কবিতা/শীত-বসন্তের গল্প)।

মায়ের আঁচলের মতো এক সত্যিকারের স্বদেশ খুঁজেছিলেন তিনি, আর যে স্বদেশকে তিনি দেখেন সেখানে অনাহার আর মৃত্যুই স্বাভাবিক আর সংগত। প্রতিবাদ এখানে অপরাধ, খেতে চাওয়াও অপরাধ। তবুও মানুষ প্রতিবাদ করে, এক থেকে অনেক হয়। সেই প্রতিবাদই তো তার মনুষত্বের অন্যতম দিক, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় বারবার স্পর্শ করতে চেয়েছেন এই ‘প্রবাহিত মনুষ্যত্ব’-কে।

কবি কি নির্মল প্রেমের কাছে ফিরবেন! অনুভব করছেন সময় ফুরিয়ে আসছে, এখনও যদি প্রেমের শুদ্ধতায় অবগাহন না করা যায় তাহলে আর কবে করবেন? ফিরে আসে সেই ‘তুমি’, অন্যভাবে। তাকে বলতে হয় ‘কত বছর চোখের জলে তোমার পায়ের ছায়া পড়েনি’ (তোমার কাছে/দিবস রজনীর কবিতা)। ভালোবাসায় অবগাহন করতে চাওয়া তো আসলে মনুষ্যত্বের অমল প্রবাহেই স্নান করা। আকাশে রক্তের হোলি, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসে, হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে থাকে বাতাস, কবি কী করে লিখবেন বিশুদ্ধ প্রেমের কবিতা? তবু লিখতেই হবে, প্রেমই তো শুদ্ধতা। কবিতা না হয় ‘অতলান্ত অপ্রেমের মধ্যে ঘুমিয়ে’ থাক, ‘…আমি জেগে থাকি/আর এক আরম্ভের জন্য… মৃত্যুর মুখোমুখি…’(হওয়া না-হওয়ার গল্প/আর এক আরম্ভের জন্য)। মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এই জেগে থাকা আর অপেক্ষা ভালোবাসার জন্য, মানুষের জন্য, কবিতার জন্য।

যে মানবীয় লাবণ্যকে ছুঁতে চেয়েছিলেন কবি, তার জন্য অনেক কঠিন অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আসতে হয় তাঁকে। বিস্ময় বিপন্ন হয়ে যায় যখন জানেন কুয়াশায় লঙরখানাকে মনে হয় কবিতার স্বর্গীয় উদ্যান। ভালোবাসার মানুষকে অনুভব করা যায় বেদনার স্পর্শে, সেজন্যই তাঁর অপেক্ষা চোখের জলের জন্য। ‘মানুষের পৃথিবী, আগে তার খিদে মেটা’ এই প্রবল দাবির সামনে কবিতাকে তিনি হারিয়ে যেতে দিতে চান না। এখান থেকেই জীবনের পাঠ শুরু করতে চান কবি, তাই তাঁর প্রেমের কবিতা, তার জন্যই আগুনের পথ হাঁটা, তারই জন্য জেনে নেওয়া ‘পেটের আগুন খিদে।হাঁটতে শিখেছে;/গলার রক্ত খিদে/পৃথিবী দেখছে/হাতদুটি তার খিদে/ কেবল বলে: দে।/পা দুটি তার খিদে/পৃথিবী গিলছে’ (জাতক/ভাতে পড়ল মাছি)। মানুষের জীবনকে জড়িয়ে তাঁর কবিতা, অথচ এই বিষণ্ণ অভিজ্ঞতাকে মেনে নিতে হয় যে অর্ধেক জীবন পায়ের নীচে মাটিই থাকে না। ‘যেখানে মাটি সেখানে পাথর’, বেদনা জড়িয়ে যায় তাঁর উচ্চারণে ‘আমার ভুবন আমার হলো না’। তবু তাঁকে চলতেই হয়। চলাই তাঁর প্রেরণা, পথের অভিজ্ঞতাই তাঁকে রসদ জোগায়।

সারা জীবন ভালোবাসার কবিতাই লিখতে চেয়েছেন তিনি, তাঁর কবিতায় আছে এই স্পর্শের আকুলতা।

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment