সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতাগুচ্ছ

পুনর্বার কবিতাগুচ্ছ

১.

শীতের সমূহ ভয় থলি ভরে এল এই সন্ধে-শনিবারে
সর্পভয় সবুজে সবুজ আর রক্তমাখা ঘোরলাল বেগুনি কালশিটে
সদ্য জেগে-ওঠা মুখ ভাঙা ও পাণ্ডুর
দ্যাখো দূর থেকে
একে বলো মার, বলো সরস্বতীবৎ সাদা কলহের গুণে
জিভ পুড়ে যাচ্ছে চুনে, মনে পড়ে কথা সব
মনে পড়ে শীতের থাপ্পড়

রোমশ দুবাহু আজ ঝুঁকে পড়ছে শীতের বাজারে
কী কঠিন পেশি, তাতে ঝুলে রয়েছে খাদ্যাখাদ্যসমুচ্চয়, থলি
যে-থলিতে ভরা আছে ছোটো ছোটো অঙ্গরাশি
হাসি, বাঁকা
একে একে গুনে নিই হিসেব মিলিয়ে
গুনে নিই নিজের আঙুল
নিমেষে মচকে যাই ভেঙে যাই ব্যথায় ফ্যাকাশে
সবজির উৎসব আজ দিকে দিকে কী উপচে পড়েছে
আমি ভয় পাই
ছুটে যাই দিগ্বিদিকে তেলে ও মশলায়
ভয়গুলি নিমজ্জিত করি আর শেষে
মুখ লুকোই বাসনকোসনে, আগুনেও
বেঁকে যেতে যেতে দেখি পিছু নিচ্ছে কারা

কাল ছুটি-রবিবার পড়বার আগে আজ সমূহ ভয়ের সবজি ফের তাড়া করেছে

বন্ধঘর ভায়োলেন্স তেলরঙে রান্না-আঁকা রাতের পাহারা

 

২.

বলো শ্যাম বংশীধারী, বলো বলো যা যা আছে নাম
নামগান করতে করতে চলো যাই তীর্থনিকেতনে
আমরা কি তুচ্ছ নারী, কে বলে, বুকের পাটা কার
সে বুকে ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোই বারংবার

আমরা উতলা যত মেয়েলোক, আমাদের উতলা ঘরদোর
এইটুকু ঘরে কি এত ধরতে পারে ঠাটঠমক নাজ ও নখরা
ঘুঙুরেরা বোল তুলছে সারেঙ্গিও বেসুরে বিধুর
কী দূর বেবুশ্যে মেয়ে কালীঘাট-পটেতে সিন্দুর
পরে দ্যাখো হাস্যমুখে চেয়ে আছে, ও মেয়ে জানে না
পিরিতি মচকে গেলে কিচ্ছু প্রশমন দেয় না চুন আর হলুদ

এসো তবে মেয়েদল, প্রাণে প্রাণ পানপাতা সাজাই
ঘরে নাঙ এলে পরে মালা দিই বকুলে বকুল
এইসব সন্ধেখেলা হারমোনিয়ামের শেষ গান
ভোররাতে মিলিয়ে যাবে। ভোররাতে কে বা সুজনি টান
করে মেলে দেবে বুকের উপর বলো, শীতে জড়োসড়ো
পাখিরাও ডানা ঘষবে পেতলের দাঁড়ে, আর ভয়
মস্ত বড়ো ভয় এসে চেপে বসবে তোরঙ্গে প্যাঁটরায়

গতর শুকিয়ে এলে চোখের দু’ধারে কাকরেখা
এত ভয় কোথায় লুকোবি বল দুর্দিনের চালডালসম্বল
তাই বলি শ্যাম, বলি বংশীধারী, চলো তীর্থে যাই

দেবতার পদদাপ শীত মানে না, মানে না রাতের কোনো ভয়
থান ফেঁড়ে, বোরখা ফুঁড়ে মানদাসুন্দরী কিংবা বিলকিস বানোকে ছিঁড়ে খায়

 

৩.

শেষতক উৎসব এল আমাদের
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভিখিরির মতো
ধরে গেছে মাথা আর ধরেছে দু’পাও
মনে মরচে পড়ে গেলে পর
রাস্তায় তাকিয়ে দেখি ওই আসছেন উৎসব

উনি ময়ূরবাহন, স্লিম ও ট্রিম, ওঁর চুলের কেয়ারি
দেখে দেখে উত্তেজিত হরমোন, শেষে হয়ে বিষম মরিয়া
বাড়ি থেকে পালানোর পথ খুঁজে ফেরে
মেয়েদের প্রাণের উৎসব, সে-ও কম যায় না কিছু
পিছু নেয়, রাস্তাঘাট মুড়ে ফেলে আলোয় আলোয়
জোরে শিস দিয়ে ডাকে, জোরে শব্দ করে

মাথা-ধরে-থাকা আর মরচে-পড়া মন
এসব ধরন তার কাছে তুচ্ছবৎ
ঘরবসত জমায় সুন্দর
খাটবিছানায় খুব শব্দ হয় তাতে

এত শব্দ প্রেমে ও প্রহারে
ঘুম না-আসা রাত্তির যত ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে থাকে
দিনরাত ঝাপসা করে দিয়ে
শেষমেষ উৎসবের দেখা পাওয়া যায় কদাচিৎ

দ্যাখো, দ্যাখো আমাদেরও মরে যাওয়া ঘরদোরে
খোড়ো চালে আগুন লাগিয়ে কীরকম
জ্বলজ্বলে উৎসব এলেন!

 

৪.

এত রেশমের বেশ কেন আজ পরেছ, ঠাকুর,
এই ঘোর কমলা রঙ এই চীনাংশুক
হাতজোড় গরদপরা সারি সারি সেবাদাসী চোখবন্ধ করে বসে আছে

মাঝে মাঝে দুলছেও, তুমি তো ভালোই বোঝো, হে গুরুগোঁসাই,
এই দোলা, এ কেবল মীরাভজনের সুরে ঊর্ধ্বগামী নয়
এ নীচেও নেমে যাচ্ছে পাতালের দিকে, সাপের বিষালো গর্তে
শুকনো ক্লিটোরিস আর অফলা জরায়ু জুড়ে জুড়ে
রেখে যাচ্ছে মাস্টারবেশন

ঠাকুর, তুমি তো জানো মেয়েদের জেগে-ওঠা হনু আর দু’চোখের কালি
যেন শীত পড়বার আগে হুলুস্থুলু পাতা ঝরে যাওয়া
কাঁটাভর্তি ন্যাড়া ডালপালা

তাই আসো, চর্ব্যচূষ্য খাও আর কচিমুখী হলুদ শাড়ির মেয়েটিকে
বলো আরও জোরে জোরে ময়ূরপাখার
ব্যজনী দোলাতে বলো জোরে
সে-ঘাড়ের কোমরের দোলে দোলে
কী খোঁজো, না, সাধনসঙ্গিনী বড়ো কষ্টকর
মূলাধার থেকে সহস্রারে, পদ্মে যাওয়া তোমার কম্মো না, তুমি জানো

শুধু সেবা নিতে নিতে ষোলোবিধি ব্যঞ্জনে প্রসাদ
কচি শাড়িদের দিকে চাও
চাও শুধু ধ্বজভঙ্গ, হে দিব্যপুরুষ,
আর দোলা দ্যাখো, চেতনাবচেতনের আরাম, কঠোর
মাস্টারবেশন

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment