সাদিক হোসেন

সংকেত

দুনিয়া যখন দশদিন ধরে টানা কেঁপে উঠছে – সেই সময় এইরকম ভুলভ্রান্তি করা কি আদৌ মাফযোগ্য? রতন বারুই রোজ সকালে যা করে, আজও তা-ই করল, প্রথমে জানলাটা ফাঁক করে চোরের মত দোকানটার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকল, তারপর ভেতর ভেতর টেনশানে ক্ষয়ে গেল।
গতরাতে ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। দোকানটার সাইনবোর্ড তাতে হেলে গেলেও বৃষ্টিজলে ধুয়ে খানিকটা সাফসুতরো হয়েছে। ফলে হলুদের উপর লাল রঙ দিয়ে ‘মহম্মদ আলি, এল এল বি’ লেখাটা প্রায় নতুনের মত জ্বলজ্বল করছে।
রতন বারুই আর একবার চারপাশটা দেখে নিতে চাইল। কোথাও কোন সন্দেহজনক কিছু ঘটেছে কিনা তা তার জেনে রাখা দরকার। সামনের রাস্তাটা খানাখন্দে ভর্তি। তাতে জায়গায় জায়গায় জল জমেছে। দত্তদের আমগাছটায় বেশ ফল ধরেছিল। এখন সেটাকে খালি খালি লাগছে।
রতন বারুই আবার দোকানটার দিকে ফিরল। নাম-ডিগ্রীর বিবরণ বোর্ডের সঙ্গে সমানুপাতে হেলে গিয়ে তার দিকে প্রবল বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিয়েছে। নিচে লেখা – সোম থেকে শনি। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত্রি নটা। চমকে উঠল সে।কাল তো রবিবার ছিল, তবে?
এদিকে সুইচ টিপে কখন যে রান্নাঘরে চলে গেছিল বড় মেয়েটা! এখন জলের ট্যাঙ্কি ভরে গিয়ে ছড়ছড় করে জল পড়ছে ছাদে। জল পড়ার শব্দ শুনেই সে মোটরটা বন্ধ করতে দৌড়ল। আর কান্ড দেখো! কেউ ঘরের মাঝখানে এমন করে টুলটা রেখে দেয়?
আ মাগো…
বাপ আছাড় খেয়েছে। শম্পা রান্নাঘর থেকে ছুটে এল তৎক্ষণাৎ। ছোট মেয়ের মুখ ভর্তি মাজন। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। কী করবে বুঝতে পারছে না।
রতন বারুই নিজেই চেঁচাল, ‘দেখছিস কী, তোল তোল। মাগো মরে গেলুম।
চ্যাংদোলা করে তাকে খাটে বসানো হল।
পায়ে প্রবল যন্ত্রণা। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে যেন। মাম্পি ছুটেছে বরফ আনতে। একটু জল খাবে, হাওয়া বাতাস খাবে, ওমা, অমনি পাখা বন্ধ হয়ে গেল। কী? না লোডশেডিং হয়নি, ফিউজ উড়ে গিয়েছে। শম্পা নীচতলা থেকে টিভির আওয়াজ শুনতে পেল।
অতএব সঞ্জু ছাড়া গতি নেই।
সঞ্জু, এই সঞ্জু।
রতন বারুই যতই যন্ত্রণায় কেৎরে গিয়ে সঞ্জুকে ডাকতে থাকল, সে লক্ষ্য করল, বড় মেয়ে শম্পার মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সে গলার আওয়াজ কমিয়ে দিল। ক্রমশ গোঙানির ঢঙে সঞ্জুকে ডাকতে থাকল।
মাম্পি বরফ নিয়ে হাজির।
শম্পা বলল, ‘তুই বাবার পায়ে বরফটা ঘষে দে। আমি সঞ্জুদাকে ডেকে আনছি’।
‘তোকে কোথাও যেতে হবে না’। রতন বারুই শম্পাকে ধমক দিল, ‘তুই কোথাও যাবি না। তুই আমার পায়ে বরফ ঘষে দিবি। আর মাম্পি, তুই যা তো। তুই গিয়ে সঞ্জুকে ডেকে আন। আ মাগো’।
ডাকার আগেই সঞ্জু উপস্থিত। বুঝি সে এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল।
‘সকাল সকাল চেঁচাচ্ছ কেন?’
‘চেঁচাব না? আমি কি এমনি এমনি চেঁচাই? আমি কি পাগল-ছাগল?’
‘হলোটা কী?’
‘মাগো’। রতন বারুই বালিশে হেলান দিয়ে শম্পার দিকে তাকাল, ‘এবার তুই রান্নাঘরে যা’।
‘যাচ্ছি’। শম্পা মুখ ঝামটা দিয়ে রান্নাঘরে চলল।
মাম্পি জানাল, ‘বাবা পড়ে গিয়েছে’।
‘কোথায়?’
রতন বারুই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তবে চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না সেটি কী কারণে ছলছল করছে – অভিমানে নাকি যন্ত্রণায়?
সঞ্জু বলল, ‘দাঁড়াও, আমি আয়োডেক্স নিয়ে আসছি’।
‘ওসব পরে হবে’খন। তুই আগে ফিউজটা ঠিক কর’।
‘ফিউজ উড়ল কখন?’
‘বাবা যখন পড়ে গেল’।
‘কাকু পড়ল আর ফিউজ উড়ে গেল?’
‘হ্যাঁ, তা-ই হল’। রতন বারুই ওদের ঠাট্টাটা ধরতে পেরে সিরিয়াস হয়ে পড়ল, ‘মাম্পি সঞ্জুকে ফিউজটা দেখিয়ে দে। শম্পা, এই শম্পা’।
শম্পার রাগ তখনও কমেনি। সে বাপের ডাকে সাড়া দিল না।
রতন বারুই গোঁৎ মেরে মাম্পি আর সঞ্জুকে লক্ষ্য করতে থাকল।
বারমুডার উপর ইয়াব্বড় একখানা টি-শার্ট গলিয়ে ঘরের মধ্যে দিব্য হাঁটা-চলা করছে ঢ্যাঙাটা। এই দৃশ্য পৃথিবীর কোন বাবা কি কখনও মেনে নিতে পারবে?
সে যতই মুখ ঘুরিয়ে থাকল, দেখব না দেখব না করল, ততই সঞ্জুর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারল না।
সে বুঝতে পারল, এই যে টেনশানে টেনশানে সে শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, খিটখিটে হয়ে পড়ছে – এর পেছনে সঞ্জুর দায়টাও কম নয়।
আহ, ছেলেটা যদি একতলার ঘরটা অমন করে দখলে না রাখত, তবে কি তড়িঘড়ি করে সে দোকানটা মহম্মদ আলিকে ভাড়া দিত? তখন নিশ্চয় খোঁজ খবর নিয়ে তবে যা-হোক অন্য কিছু ব্যবস্থা করা যেত।
কিন্তু ছেলেটা সেই যে বাপের হাত ধরে চলে এল, আর তো গেল না।
রতন বারুই আরেকবার সঞ্জুকে দেখল। সঞ্জু টুলের উপর উঠে ফিউজ লাগাতে ব্যস্ত। মাম্পির হাতে এক গোছা পুরনো তার। আশপাশে শম্পার দেখা নেই।
তখনকার ধমকটা তবে এখনও কাজে দিচ্ছে! রতন বারুই অত যন্ত্রণার ভেতরও নিজের মনে হাসল।
‘নাও, হয়ে গিয়েছে’। সঞ্জু টুল থেকে নামতে নামতে বলল, ‘পাখার সুইচটা মেরে দেখো’।
মাম্পি সুইচ দিল।
পাখা ঘুরল না।
দদাম করে ফিউজ ওড়ার শব্দ পেল সবাই।
‘এটাই বাকি ছিল। মাগো’।
‘হলোটা কী?’ শম্পা রান্নাঘর থেকে চেঁচাল।
মাম্পি বলল, ‘বোম পড়েছে’।
সঞ্জুর মুখ চুন।

রতন বারুই ভেবে দেখেছে, এই যে গল্প-উপন্যাসে জীবনের সঙ্গে নদীর তুলনা টানা হয়, তা শুধু মিথ্যে নয়, একেবারে ভাঁওতাবাজি। জীবন নদীর মত অত সরল নয় যে এর বাঁকে বাঁকে সভ্যতা গড়ে উঠবে। বরঞ্চ এত প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও কখন যে বড় বড় ঘটনাগুলো চোরা বাঁকে ঢুকে গিয়ে হাপিস হয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না।
সকাল ১০টা থেকে ১১টা হল, ১১টা থেকে ১২টা হল – রতন বারুই-এর পায়ের যন্ত্রণা যেই কী সেই। মাম্পি অম্রুতাঞ্জন মালিশ করে দিয়েছিল, তাতেও কিছু হল না। শম্পা জিন্ট্যাকের সঙ্গে পেনকিলার খাওয়ালো, তাতেও একই রেজাল্ট।
বিকেলের দিকে সঞ্জু আবার উপরে উঠে এল। এবার সে ভদ্রলোকের মত জিন্সের সঙ্গে শার্ট পরেছে।
‘ব্যথা কমলো কাকু?’
রতন বারুই কোনোমতে ছেলেটার দিকে তাকাল। এখন আর ঝগড়া করবার তাপ নেই। রাগও দেখাতে পারছে না। হাজার হোক নিজের জ্যাঠতুতো দাদার ছেলে তো, তাই ভরসা করে বলল, ‘আমাকে একটু বাথরুমে নিয়ে চলো তো’।
প্রায় কিতকিত খেলার ঢঙে এক পা তুলে সঞ্জুর ঘাড়ে ভর দিয়ে বাথরুমে গেল। ফিরল সঞ্জুর কোলে।
শম্পা বলল, ‘সঞ্জুদা এবার কী করব বল?’
সঞ্জু আর দেরি করল না।
সটান রিক্সা ডাকতে বেরিয়ে গেল।

বাপের পা ভাঙলে মেয়ের ওজন কি কমে যায়? তা না হলে, ধামসী শম্পা সমেত তার বাপকে নিয়ে রিক্সাওলা অমন পাঁইপাঁই করে ছুট লাগাল কোন মন্তরে! সঞ্জু যতই চৌখুস হোক, রিক্সাটাকে কিছুতেই সে ফলো করতে পারল না। কখন যে তারা মহম্মদ আলির দোকান পেরিয়ে বাম দিকে ঘুরে আবার ডাইনে তরফ বেঁকে গিয়ে মেইন রোডে উঠে পড়েছে – তা তার নাগালের বাইরে থেকে গেল।
এদিকে শম্পার কাছে খুচরো ছিল না। একটাই নোট – তাও দু’ হাজারের। সঞ্জু যতক্ষণে ডাঃ হালদারের চেম্বারে পৌঁছুলো, ততক্ষণে বারুই বাবুর মুখ লাল লাল। শম্পা যেন প্যাকলা রিক্সার কাছে সঞ্জুর এমন হেরে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছে না। এতক্ষণ সে সিটেই বসেছিল। সঞ্জুকে দেখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লাফ দিল রাস্তায়।
যা ভাবা হয়েছিল, ঘটনাটার গুরুত্ব তার থেকে বেশি।
টিবিয়া, ফিবুলা আর টেলাস – এই তিনটি হাড় দিয়ে আমাদের গোড়ালিটি তৈরি। এক্স-রে’তে দেখা গেল, ফিবুলার পেছনের অংশে চিড় ধরেছে। অতঃপর প্লাস্টার। ডাঃ হালদার জানিয়ে দিলেন দেড়মাস বাম পায়ে ভর দিয়ে হাঁটা-চলা করা যাবে না।
এমনিতে বাইরে-ঘাটে বিশেষ যেতে হয় না রতন বারুইকে। বছরখানেক আগে সে বেঙ্গল ক্যামিকেল থেকে ভলেন্টিয়ার রিটায়ারমেন্ট নিয়েছিল। তখন ভেবেছিল ট্রাভেলস এর ব্যবসা করবে। অনলাইন টিকিট বুকিং থেকে প্যাকেজ ট্যুর – সব। শিলিগুড়িতে তার এক বন্ধুর ট্রাভেলসের ব্যবসা রয়েছে। তার থ্রু’তে বিভিন্ন হোটেল মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিসকাউন্টে বুকিং। সেই অনুযায়ী কম্পিউটার কেনা হল। ব্রোশিওর ছাপানো হয়ে গেল। সারাদিন নতুন নতুন প্ল্যান নিয়ে ডিসকাশন। কিন্তু সকলে যা ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটল। ধান্দা ফাঁদবার আগেই ধান্দায় লাল বাতি জ্বলে গেল। উপরন্তু বিশ হাজার জলে।
একতলায় দুটো ঘর। একটাতে দখল নিয়েছে সঞ্জু। সেটি চলে প্রাচীন ভারতীয় রীতি অনুযায়ী – অর্থাৎ, অতিথি দেব ভব। অন্যটি ভাড়া নিয়েছে একজন প্রাইভেট টিউটর। সে মাসে দেড় হাজার দেয়।
কিন্তু দুনিয়া যখন দশদিন ধরে টানা কেঁপে উঠছে, তখন কী যে হয় আর কী যে হয়না তা কেউ বলতে পারে না। চলন্ত বাসের টায়ার ফেটে যায় রাস্তায়, আকাশে উড়তে থাকে হাউই আর স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো ওয়েদারের খবর চলে যায় অন্য কোন দূতাবাসে। এই ধরো, যে দোকানটায় মহম্মদ আলি এখন আইনের ব্যবসা ফেঁদেছে, সেইখানে এই কদিন আগে অব্দিও দিলীপের ইলেক্ট্রিক সরঞ্জামের দোকান ছিল। সে চাইনিজ সেট বেচত, আবার রিচার্জের কার্ডও বিক্রি করত ঢের। কিন্তু ঐ যে, রতন বারুই বাড়ি ফিরে ভাঙা পা নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবল, দুনিয়া যখন দশদিন ধরে টানা কেঁপে ওঠে তখন কোন দোকান যে চলবে আর কোনটায় মহম্মদ এসে যাবে তা কেউ বলতে পারে না।
অতএব, তখন, মাম্পি একখানা মাথার বালিশ তার বাম পায়ের তলায় দিয়ে দিলে সে ক্রমশ ঘুমে ঢলে পড়ল। আর তখনি দেখতে পেল দোকানের দরজাটা খোলা হয়েছে। পর্দা দুলছে। আস্তে আস্তে দুলছে। দোলার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের কিছু অংশ মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। বই-এর গাছি, কলমদানি, অ্যাশট্রে – এইগুলি উঁকি দিচ্ছে যেন। ভেতরে বুঝি টেবিল ফ্যান চলছে। টেবিল ফ্যানের হাওয়া নিরন্তর ধাক্কা খাচ্ছে মানুষটির সাদা শার্টের উপর।
এ-পাড়ায় মুঘল আমলেও জলপ্রপাত ছিল না। কিন্তু জলপ্রপাতের শব্দেই ঘুম ভাঙল তার। চোখ খুলল পাখির ডাক শুনে।
বারান্দায় একখানা প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা থাকে। সেই চেয়ারে বসে সে চারদিকে নজরদারি চালাত। এখন সেই চেয়ারে বসে আছে সঞ্জু। বসে বসে পাখির ডাক পাড়ছে। প্রতিবার সেই ডাক শুনে হাসিতে গড়িয়ে যাচ্ছে শম্পা।
সঞ্জু বলছে, ‘গোলা পায়রার ডাক শুনবি? গোলা পায়রা?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ শোনাও’।
সঞ্জু গোলা পায়রার ডাক দিল। তারপর থেমে গিয়ে কিচকিচ করে একটা সুর তুলল, ‘বলতো এইটা কোন পাখি? বলতে পারলে একটা জিনিস পাবি’।
‘কী দেবে?’
‘আগে তো পাখির নামটা বল’।
‘আহ্‌, বলো না কী দেবে’।
‘দেবো দেবো’। সঞ্জু গলায় রহস্য নিয়ে আসে।
‘আচ্ছা বলি তা’লে?’
‘বল। কিন্তু অনলি তিনটে চান্স পাবি’।
‘আচ্ছা। বলছি। শালিখ?’
‘ধুর’।
‘হাঁড়িচাচা?’
‘কোনো মানে হয়? তুই হাঁড়িচাচা দেখেছিস কোনদিন? যাহোক একটা বলে দেলেই হল? আর একটাই চান্স আছে, ব্যাস’।
শম্পা কেস খেয়ে গেছে। সে আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। দু’ সেকেন্ড সবাই চুপ। শুধু আবহসঙ্গীতের মত জলপ্রপাতের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
রতন বারুই আর থাকতে পারল না, ‘শম্পা, এই শম্পা, মোটরটা বন্ধ করবি তো। মাম্পি কোথায়’।
শম্পা যায় কোথা, এক নিঃশ্বাসে ছুটল সুইচ টিপতে।
সঞ্জু এসে বলল, ‘আমি সেই সকালে এসেছি তোমাকে বাথরুমে নিয়ে যাব বলে’।
‘তা এখন দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
‘যা বাবা। এতক্ষণ তো ঘুমোচ্ছিলে’।
‘আমি জেগেই ছিলাম’।
সঞ্জু জিভ কাটল। আর কথা বাড়াল না।

প্রতিদিন সূর্য ওঠে। প্রতিদিন সূর্য অস্ত যায়। মাঝখানে একদিন সূর্য উঠল না। সেকী তুমুল বৃষ্টি! সকাল দশটার আকাশ যেন সন্ধ্যে সাতটা।
তবু সঞ্জুর আসা-যাওয়ায় কামাই নেই। সে রোজ সকালে আসে। রতন বারুইকে পরিষ্কার করিয়ে দেয়। তারপর লুচি আলুরদম খেয়ে তবে বেরোয়।
একদিন, ঠান্ডা হাওয়া বইছে তখন, জঙ্গলের ভেতর হাতি ডেকে উঠল। তারপর বাঘ, সিংহ, কুকুর প্রত্যেকেই এল একে একে।
কিন্তু মাম্পি থাকায় রতন বারুই সেদিন বারান্দার দিকে বিশেষ নজর দিল না।
তাই, হয়ত খুশি হয়ে, সঞ্জু একখানা লাঠি নিয়ে এল। তেল চকচকে লাঠি। এটাতে ভর দিয়ে কিছুটা হাঁটাচলা করা যায়।
ভাইপোর কাছ থেকে এইসব আশা করেনি রতন বারুই। সে তাকে ডেকে বলল, ‘কী বুঝছ?’
‘কী ব্যাপারে?’
‘দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ওদিকের খবর কী?’
সঞ্জু ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সন্দেহজনক’।
‘কীরকম সন্দেহজনক?’
‘বেশ ভাল রকমের’।

কিন্তু দুনিয়া যখন দশদিন ধরে টানা কেঁপে উঠতে থাকে, সেইসময় শুধু যে বাসের টায়ার ফেটে যায় কিংবা ট্রেনের সিগন্যালে দেরিতে আলো জ্বলে তা তো নয়; সেইসময় খবরের পর খবরের পর খবর জুড়ে তৈরি হতে থাকে আশ্চর্য সব খবর।
রতন বারুই তাই সকাল ন’টা থেকে দুপুর অব্দি, দুপুর থেকে বিকেল অব্দি ঠায় বসে থাকে নিউজ চ্যানেলের সামনে।
একটার পর একটা ব্রেকিং নিউজ তার সামনে কাচের গ্লাসের মত ভেঙে পড়ে। সে টুকরোগুলোর উপর সন্তর্পণে নজর রাখে। টুকরোগুলোকে জুড়ে জুড়ে ভগ্নস্তূপ বানায় নিজের মনেই।
এখন আর শুধু সকাল নয়, বিকেলের দিকেও সঞ্জু উঠে আসে দোতলায়।
সেদিন সঞ্জুকে বেশ বিব্রত দেখাল।
‘কী ব্যাপার?’
সঞ্জু একই উত্তর দিল, ‘সন্দেহজনক’।
‘কতটা সন্দেহজনক?’
‘বেশ ভাল রকমের’।
রতন বারুই আর কথা বাড়াল না। গোপনে হিসেব করতে থাকল। তার চোখের সামনে শুধু দোকানঘরটার দরজায় টাঙানো পর্দাটা নড়ে উঠল দুবার।
শম্পার মুখ তবু হাসি হাসি।
‘কী হয়েছে?’
‘এই নাও’। সে ভাড়ার টাকাটা দিয়ে বলল, ‘এবারেও উনি তিন তারিখে ভাড়াটা দিয়ে দিয়েছে’।
রতন বারুই টাকাটা নিল বটে। তবে সে তালুর ভেতর খসখসে মরা চামড়ার উপস্থিতি পেল যেন।

সেদিন মাম্পি বাড়ি ফিরল রাত এগারোটায়। সেদিন ইঁদুর ঢুকেছিল রান্নাঘরে। প্রায় রাত দুটো বাজে তখন, বেসিনের উপর গাছি করা ছিল এঁটো থালাবাসন, সেগুলি ঝনাৎ করে পড়ে গেল মেঝেয়।
কোন হিসেবই মেলেনা রতন বারুই-এর। রান্নাঘরে, আলমারির নিচে, বিষ দেওয়া হয়েছিল। তাতে একটাও ইঁদুর মারা পড়ল না।
শেষে আর থাকতে না পেরে মনের কথাটা উগরে দিল সে।
সঞ্জুকে বলল, ‘এখনও যা অবস্থা, দিন কুড়ি তো শুয়েই থাকতে হবে। তাই কাজটা তোমাকে ছাড়া আর অন্য কাউকে দিতে ভরসা পাচ্ছি না’।
সঞ্জু জল খাচ্ছিল। সে গ্লাসে চুমুক দিল, ‘কী কাজ?’
‘সব ডিটেলস চাই। আই রিপিট, সব ডিটেলস’।
‘পুলিশে জানালে হয় না? খামোকা এইসবে আমরা নিজেদের জড়াচ্ছি কেন?’
‘আমরা না চাইলেও এইসবের মধ্যে জড়িয়ে গেছি। আর পুলিশের কথা বলছ? তা যে ভাবিনি তা নয়। তবে তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। লোকটা উকিল। অন্তত সেই পরিচয়টাই সে আমাদের দিয়েছে। আর যদি এটাই সঠিক হয়, পালটা আমাদের বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিতে ওর দু’মিনিটও লাগবে না’।
‘আর যদি অনুমানটা সঠিক হয়?’
এই প্রশ্নটার জন্য বুঝি রতন বারুই আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সে সরাসরি উত্তর না দিয়ে শম্পাকে ডেকে নিল।
শম্পা কাছে এলে বলল, ‘তোমরা দুজনে মিলে খবরাখবর জোগাড় কর। শুধু একটা কথা মাথায় রেখো, তোমাদের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে’।
শম্পা কিছুই ধরতে পারেনি। সে ভ্যালভ্যাল করে সঞ্জুর দিকে তাকাল। সঞ্জুর মাথায় তখন আরও অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে এক ঢোঁকে গ্লাসটা খালি করে বলল, ‘কাকু এই বলে রাখছি, প্রতিদিন তোমাকে আপডেট দেব। দেখো তোমার সঞ্জু কেমন কাজের ছেলে হয়ে গেছে’।
‘তোমার সঞ্জু’? নিজেকেই প্রশ্নটা করল রতন বারুই। তার চোখকান ঝালাপালা করে উঠল।
তবে এটা সঞ্জুর জন্য নাও হতে পারে। কেননা সেইদিন মুড়ি চিবোতে গিয়ে সে আধখানা কাচালঙ্কা কামড়ে ফেলেছিল।
ভুল জায়গায় কামড় দেওয়া বুদ্ধিমানের লক্ষণ। তা বলে লোক চিনতে ভুল করবে এমন লোক রতন বারুই নয়। সঞ্জু রোজ এসে কিছু না কিছু খবর দিয়ে যায়। এই যেমন, কলিং বেল বেজে উঠল।
‘কে?’
মাম্পি দরজা খুলতে দেখা গেল সঞ্জু একজন অপরিচিতকে নিয়ে হাজির।
সঞ্জু এক্সাইটেড, ‘একদম পাক্কা খবর নিয়ে এসেছি। লোকটা ফ্রড’।
‘কীরকম?’
সঞ্জু সঙ্গের লোকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এই যে আঁখো দেখি হাল’।
‘বলো কী?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এই মান্তুদা চুপ করে আছ কেন, বলো না’।
মান্তুদা চেয়ারে বসতে বসতে জানাল, ‘ভারী অদ্ভুত ব্যাপার বুঝলেন। মাসখানেক আগে একটা কেস নিয়ে লোকটার কাছে গেছিলুম। মানে কোন ক্রিমিনাল কেস নয়, জায়গা জমির মামলা আর কি।গিয়ে দেখি লোকটা মোবাইলে ফেসবুক করছে। করছে তো করছেই। আমার কেসের ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্ট দেখালো না! দু’বার মাথা তুলে শুধু হুঁ হুঁ করল। জাস্ট মনে হল আমি যেন গিয়ে ভুল করে ফেলেছি’।
‘কোন ইন্টারেস্ট দেখালো না?’
‘একদম না। কী অপমান বলুন মশাই! উকিলের কাছে কেউ কি আর এমনি এমনি যায়। গেছি একটা সমস্যা নিয়ে, এদিকে ওনার কোন আগ্রহ নেই! যেন উনি কেস লড়তে এখানে আসেনি। ওনার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে’।
‘অন্য কোন উদ্দেশ্য?’
‘তা নয় তো কী? মাঝখান দিয়ে সঞ্জু ঢুকে পড়ল, লোকটা আমাদের পাড়ায় এসেছে মাস ছয়েক তো হবেই। এটা খুব একটা কম সময় নয়। অথচ এতদিনে ওনার কারোর সঙ্গে কোন মেলামেশা শুরু হল না?রোজ একা একা আসে, দোকান খুলে দু’-তিন ঘণ্টা বসে থাকে, তারপর আবার চলে যায়। এই বাজারে ওনার চলে কী করে? এদিকে ভাড়া মেটাতে তো একদিনও লেট হয় না। যে লোকটার কাছে কেউ আসে না, এলেও যে কেস নিতে চায় না, সেই লোকটা ভাড়া মেটাবার পয়সা পায় কোথা থেকে? আর যদি পসার না জমাতেই চায়, তো দোকানটা ভাড়া নিয়েছে কী উদ্দেশ্যে?’
‘একটা জিনিস এদের মধ্যে কমন’। সঞ্জু শেষ করতেই মান্তুদা যোগ করল।
‘কী?’ সকলেই মান্তুদার দিকে তাকিয়ে।
মান্তুদা কনফিডেন্সের সঙ্গে বলল, ‘যারাই ধরা পড়ছে, তাদের মধ্যে একটা কমন জিনিস ঠিক পাবেন। এরা কেউ-ই পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করে না’।
‘তুমি শিওর?’ রতন বারুই জিজ্ঞেস করল।
‘ওয়ান হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। আপনি নিউজ চ্যানেলগুলো ফলো করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন’।
রতন বারুই শম্পার দিকে তাকাল। শম্পা মান্তুদার দিকে তাকাল। সঞ্জু সারাক্ষণ শম্পার দিকে তাকিয়ে ছিল। মাম্পি সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

প্লাস্টারে পিঁপড়ে ঢুকে গেছিল। তা নিয়ে কেলেঙ্কারি অবস্থা। উল বোনার কাঁটা দিয়ে চুলকোতে গিয়ে প্রায় রক্তারক্তি কান্ড।
তাও সুযোগ বুঝে শম্পা বলল, ‘বাবা আর তো দেরী করা যাচ্ছে না’। রতন বারুই মেয়েকে ডুপ্লিকেট চাবিটা দিয়ে দিল। তার মুখচোখে টেনশান আর যন্ত্রণা কারোর চোখ এড়াল না।
মাম্পি বাবাকে খানিক সান্ত্বনা দিল, ‘এটা ফুল প্রুফ প্ল্যানিং। তুমি আর চিন্তা করো না’।
কথামত সঞ্জু উঠে এল রাত ন’টা নাগাদ। সে বাড়তি কোন ভূমিকা করল না। জানাল, ‘উকিল বাবু দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছে। স্টেশনে মান্তুদাকে রেখেছি। মান্তুদা ওনাকে বাসে চড়া অব্দি ফলো করবে। বাইচান্স যদি ব্যাক করে তো আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দেবে। একদম নো রিস্ক’।
‘মাম্পি কী বলিস?’ রতন বারুই ছোট মেয়ের অ্যাডভাইস চাইল।
‘এটাই রেইকি করার বেস্ট টাইম’।
শম্পা রেডিই ছিল। সে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সঞ্জুর সঙ্গে নিচে নামল।
দোকানঘরটার ভেতরে ঢুকে তারা আবার দরজা বন্ধ করে দিল। লাইট জ্বালাল না সঞ্জু। সে টর্চ এনেছে। সে চারদিকে টর্চের হলুদ আলো ফেলতে লাগল।
টেবিলের উপর দুতিনটি আইনের বই। প্লাগ থেকে ফোনের চার্জার ঝুলছে। ডাস্টবিন থেকেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। শম্পা মেঝেয় দলা পাকানো একটা চিরকুট খুঁজে পেল। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে লোকটা গতকাল এটিএম থেকে পনের হাজার টাকা তুলেছিল।
টেবিলের ড্রয়ারে চাবি লাগান। শম্পা চুলের ক্লিপ দিয়ে বেশ কসরত করল। কিন্তু লক ভাঙল না।
সঞ্জু প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। সে ধপাস করে উকিল বাবুর চেয়ারে বসে পড়ল। শম্পা বলল, ‘প্রতিটা ক্রিমিনাল কিছু না কিছু প্রমাণ ঠিক রেখে দিয়ে যায়’।
তখনি পুরনো খবরের কাগজের তলা থেকে নোটবুকটা আবিষ্কার করল সঞ্জু।
‘দেখি দেখি’। শম্পা লাফিয়ে উঠল। সঞ্জুর হাতে টর্চটা ধরা ছিল। হলুদ আলোয় শম্পার মুখটা ঝলসে উঠল আবার।
যা পাওয়া গেল, তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি।
প্রতিটা পাতায় তারিখ সমেত বাজারের দরদাম লেখা। মাছের দাম থেকে শাকসবজির দাম। শুধু তাই নয়, কয়েকটি পৃষ্ঠায় আবার শ্যামবাজার, বালিগঞ্জ, দমদমের বাজারে কীভাবে একই জিনিসের দাম একই সময়ে হেরফের করছে – তা নথিবদ্ধ করা রয়েছে।
শম্পা বলল, ‘এই দেখো গ্রাফ’।
আধো অন্ধকারে তারা পৃষ্ঠা জুড়ে জটিল জটিল গ্রাফ আঁকা দেখল। পাই চার্ট দেখল। সেই কবে উচ্চমাধ্যমিক পড়বার সময় ক্যালকুলাস শিখেছিল সঞ্জু। এতদিনে সে ভুলেই গেছিল। এখন কয়েকটা চিহ্নকে আবার চিনতে পারল।
‘নোটবুকটা নিয়ে যাব?’
সঞ্জু বারণ করল। সে মোবাইলে প্রতিটা পৃষ্ঠার ছবি তুলে নিল।
শম্পার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিল না। সে ঘামছিল। সঞ্জু তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘সংকেত!’

মোবাইলের ছবিগুলো দেখে সকলেই হতভম্ব।
রতন বারুই নিজের যুক্তিটা ধারাল করতে নিজেই অন্য পথে হাঁটল, ‘এমনও তো হতে পারে এগুলি শুধুই অংক। এর মধ্যে অন্য কিছুর সংকেত নেই’।
‘লোকটা কি ম্যাথামেটিশিয়ান?’ মাম্পি পাল্টা দিল।
‘ম্যাথামেটিশিয়ান হয়ত নয়। কিন্তু এরকমও তো হতে পারে লোকটার হবি অঙ্ক কষা! এখানে ফ্রি টাইম পেলেঅঙ্ক কষে’।
‘আর সেই জন্য ও ঘর ভাড়া নিয়েছে?’
সঞ্জু বলল, ‘পুলিশকে জানালেই তো হয়’।
‘কী জানাবে? লোকটা অঙ্ক করে আর তাই আমাদের সন্দেহ হচ্ছে? এটা জোক্‌স মনে হচ্ছে না?
‘তাহলে করবেটা কী?’ শম্পা সঞ্জুর পাশে এসে দাঁড়াল।
‘যা প্ল্যান ছিল, আমরা সেই অনুযায়ী চলব’। মাম্পি অনড়।
‘তুই কি কনফিডেন্ট? রতন বারুই প্রশ্নটা শেষ করার আগেই মাম্পি জবাব দিয়ে দিল, ‘ট্রাস্ট মি’।

প্ল্যানমাফিক সকালবেলাতেই মাম্পির কলেজের দুজন বন্ধু এসে গেছিল। তারা এসেই ল্যাপটপ খুলে কাজ শুরু করে দিল।
প্রধান সমস্যা দোকানটির অবস্থান। সেটি প্রায় রাস্তার উপরে অবস্থিত। তারওপর পাশেই একটা চায়ের দোকান রয়েছে। সেখানে লোকজনের আসাযাওয়ার বিরাম নেই। প্রথমে ঠিক হয়েছিল চায়ের দোকানের মালিককে কিছুটা হিন্টস দিয়ে রাখা হবে। কিন্তু রতন বারুই তা বাতিল করে দিল। লোকটি এমনিতেই ফিশি ক্যারেক্টার। এর কথা ওকে লাগানো তার ব্যবসার নীতি। অতএব, নো শর্টকাট। ওনলি ওয়েটিং।
সোমদীপ, মাম্পির ক্লাসমেট, ওয়্যারলেস অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে সিরিয়াসলি পড়াশুনা করেছে। সে-ই মেইন। সঙ্গের অমিতাভ তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। তারা সঞ্জুর কাছ থেকে আর একবার ঘরটার বিবরণ ছকে নিল। এইসব কেসে উইদাউট হোম-ওয়ার্ক সাকসেস রেট প্রায় জিরো।
দুপুর সাড়ে বারোটা তখন। সঞ্জু গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিল।
অমিতাভ যাবার আগে মাম্পিকে বলল, ‘ফোনটা রেখে যাচ্ছি। কল এলে রিসিভ কোরো না’।
রতন বারুই টেনশানে জড়োসড়ো। শম্পা ঘরময় পায়চারি করছে। সোমদীপ জানিয়ে দিয়েছে তারা না ফেরা অব্দি কেউ যেন বারান্দায় উঁকি না মারে।

বলে গিয়েছিল ম্যাক্সিমাম আধঘণ্টা লাগবে। কিন্তু কোথায় আধঘণ্টা! ঘণ্টা দুই হতে চলল, তাদের ফেরার নামগন্ধ নেই। সঞ্জু দু’বার আশপাশ দিয়ে হেঁটে এসেছে। ঘরের ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পায়নি সে।
রতন বারুই ঘামতে শুরু করে দিয়েছিল। সে আর কারো কথা শুনতে রাজি নয়। নিজেই লাঠিটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
শম্পার চোখ ছলছল করছে, ‘তুই আমাদের সবাইকে ফাঁসালি’।
মাম্পি মুখ ঘুরিয়ে নিল। ঝগড়া করার সময় এটা নয়।
তিনটে বাজতে চলেছে। আশপাশ এত শুনশান কেন? ঐ দূরে সঞ্জুকে দেখা গেল। সে ওখান থেকে দোকানটার দিকে নজর রাখছে।
তখনি বলেছিলাম পুলিশে খবর দিতে। শম্পা আবার ফিসফিসিয়ে উঠল। মাম্পি একবার তাকাল দিদির দিকে। এবারও কোন কথা বলল না।
তখনি বিকট শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল।
কী হয়েছে? শম্পা বারান্দায় ছুটে গেল। রতন বারুই কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার হাতের লাঠিটা খসে পড়ল মেঝেয়।
মাম্পি কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ততক্ষণে কয়েকজন দোকানটার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করে দিয়েছে। সঞ্জু মাম্পিকে ছুটে আসতে দেখে রাস্তা আটকে দিল।
‘সঞ্জুদা ছাড়ো, ছাড়ো আমাকে’। সে কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিল না।
ঘরের ভেতর থেকে সোমদীপের আওয়াজ পাওয়া গেল বুঝি। মাম্পি চেঁচিয়ে উঠল। এবার দ্বিতীয় বিস্ফোরণ।
এটি বুঝি আগের থেকেও জোরাল। কিন্তু এবারও কোন আগুন নেই, ধোঁয়া নেই। শুধু আওয়াজের তোড়ে মনে হল চারপাশের ভূমি যেন টানা দশদিন ধরে কেঁপে উঠবে এবার।
দোকানটিকে ঘিরে ভিড় জমে উঠছে। কেউ কেউ মোবাইলে রেকর্ডিং শুরু করে দিয়েছে। রতন বারুইকে কোনোমতে ধরে আছে শম্পা। মাম্পিকে আর সামলানো যাচ্ছে না। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। ওরা যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়বে।
কিন্তু তখনও ভূমি কাঁপছে। কারখানার ভোঁ শোনা যাচ্ছে। আর প্রত্যেকেই কী আশ্চর্যরকম ভাবে দেখছে বাজারের দরদাম, শেয়ারের গ্রাফ, পাই চার্ট, ফার্স্ট ব্রাকেড, সেকেন্ড ব্রাকেট, নট ইউক্যুয়ালসটু সব একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে, ঠিক ধোঁয়ার মত, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment