শ্রেয়সী চৌধুরী

শ্রেয়সী চৌধুরী’র কবিতাগুচ্ছ

 

সমস্ত মৃত্যুই রাজনৈতিক, অন্তত আংশিক

 

খুন

এইভাবে কতদিন শুয়ে শুয়ে মায়ের গানের সুরে ঘুমিয়ে পড়িনি
ভাবতে ভাবতে, চোখ খুলে আমার আততায়ীর চোখে চোখ রাখি।
বলি, শান্ত হও, আসতে আসতে শ্বাস, এই তো এভাবে।
আমিও নিশ্বাস ত্যাগ করি।

 

 

গাছ

কী এক দোদুল্যমান, মায়ার মতন নমনীয়,
কী এক চার বেলা ধরে হাওয়ায় দুলেছে,
দুলে দুলে কাকে যেন ডাকে।
জানলার ফাঁক দিয়ে
পড়শির ছেলের গায়ে কাঁটা
কার মৃতদেহ বাঁধা ওইখানে, বাঁধের ওপারে?

 

 

দূর

কে জন পালিয়ে যাচ্ছে ভয়ে,
বারবার হাত ধুচ্ছে, চোখে মুখে জল,
জেনারেল কম্পার্টমেন্ট, বাথরুম
কে যেন ছিলিমে টান দিলো

 

 

মৃত্যুসংবাদ

কার যেন ফোন বেজে ওঠে,
নেপথ্যের রয়েছে লাল টেবিল ল্যাম্প,
সমস্ত গোয়েন্দা গল্পেই যেরকম থাকে।
সামনে রাইটিং প্যাড, মর্গের নম্বর লেখা তাতে।

 

 

শনাক্ত

শক্ত করে ধরে রাখছে হাত,
ঠাণ্ডা হিম, রক্তশূন্য, শুকনো চামড়ার জমি,
হাতে হাতে ঘষছে, তবু, তাকে ছুঁতে পারছে না।
এভাবে তাকিয়ে কেন?
এই ভাবে সোজা হয়ে শুলে
যেন চেনাই যায় না!

 

 

দণ্ড

কারা যেন কোলাহল করে,
মোবাইল চালিয়ে দিয়ে বেপাড়ায় কারা যেন কাটা মেরে খায়,
ঠগের ছেনাল বাছতে গোটা গাঁ-ই জ্যান্ত পোড়াল,
কারা যেন শান্ত কর গোনে,
পরে দিনক্ষণ দেখে একখানা দক্ষযজ্ঞ করে দিলে হবে।

 

 

 

পাইরেটস্ অফ দ্য স্পেস, সিমেন অফ দ্য শিপ্স

১.
ভূতগ্রস্থ জলযান। পতাকা উড়েছে, দুঃস্বপ্নের মত। অমঙ্গল ডেকে আনা বাতাস লেগেছে।
আবহমানের সুর, ক্ষণস্থায়ী মৃত্যু বয়ে যায়, জলে জলে, কেঁপে উঠছে রেশ। কে তুমি অশেষ, কার দীর্ঘশ্বাসে বুজে এলো আজ, তোমারো তো পরিশ্রান্ত চোখ? উহাদের অমঙ্গল হোক। জগত-জননী যেন গর্ভশূন্য, ক্ষীন, সময়ের মত উদাসীন, কি নিশ্চিত গতি তার, কি আড়ম্বরহীন। এসব প্রলয়ে মীনরূপী বিধাতার মৌনী শেষ সম্ভাবনাটুকু তোমার প্রবণতার কাছে এসে বসে, সম্যক হয়েছে। হয়েছে যেন কত না পরিপূর্ণ আজ, যেন সে গভীরে আহা ডেকে নিয়ে গেলো, তোমাকে অতলে।
কে যেন আড়াল থেকে খুলে দিলো দোর।
তুমিও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য, চেপে চলে গেলে দূরে অবচেতনের মহাযান।

 

 

২.
ও তুমি কি দুলে দুলে ভেসে, নাকি তুমি ডুবে ডুবে হেসে খেলে চলে যাচ্ছ পারস্যের দেশে। ভাবছ নতুন কিছু দেখবে বা, নতুন সমাধি দেবে পৃথিবীকে ভাবছ কতনা ব্যবসায়িক লাভ, সদাগর পুত্র তুমি ভারি। তোমার সে বিচক্ষণ মন। কই গেলো? কোথায় ফুরিয়ে যাচ্ছ, জলতলে? ভেসে ওঠো হালকা এ পিঁপড়ের মত, শেখ আজ সমস্ত টিকে থাকা, উদ্বর্তন, অভিযোজন, শেখ বিবর্তন এসো। পারো দেখি, কেমন সাঁতারু তুমি?

 

 

৩.
জেগে উঠে পাতার খেয়ায়, কি সুন্দর পাড়ি দেবে দেশে, দেশান্তর হতে না জানি কতই অভিজ্ঞতাসার তুমি, ঘরে ফিরবার ঢেউয়ে বিচক্ষণ হবে। বিলিতি মুরাল আর যাকিছু সমাধি থেকে খুঁড়ে আনা, গুপ্ত-রতন সব, ফলক, বুদ্ধের বানী, হাড়গোড়, জীবাশ্ম-জবানী। সেসব জবাই গাথা তুমি বুঝি লিখে যাবে তোমার পৌত্রকে, উত্তরাধিকার সূত্রে সে বুঝি পোহাবে রাত আগুনের পাশে, খুঁড়ে পাবে তোমার এসব অবৈধ, অশৌচ, অবসাদগ্রস্ত গুপ্তধন সব, উত্তরাধিকারে ভুলে ফেলে যাওয়া পাপ ও প্রণালী?

 

 

৪.
তোমার দিনলিপির সমস্ত তন্তুতে আজ শুকনো তঞ্চন, রক্তকালশিটে, তোমার ইতিহাসের জলদ, জরৎ এক জরদগব বংশগতির কে নেবে হিসেব, তাও তোমারই রক্ত? কি সুন্দর তোমারদের আর্যার্য বিনিময়, কি সুন্দর ফলকনামা, কি সুন্দর সনাতনী তোমার চলন।

 

 

৫.
পাতায় পাতায় তাকে পুষে রাখো, লেখো আরও ভূর্জ পত্রসব। পুষে রাখ কতনা কেরামতির ভেল, ভানুমতীর খেল। যেভাবে ডাইনি তার এঁদোমেদো ভুত পুষে রাখে। বোতল ভর্তি করে ম্যাজিক ওড়ায়। নিজেই হাততালি দেয়, হাসে, নেচে ওঠে, কেঁদে ফেলে। স্বপ্নের বড়ি খেয়ে ঘুম যায় পূর্বাপর।

 

 

৬.
ঘুমের টোটকা ভাঙে। রিন রিন রিন। ভেঙে পড়া কাঁচের নূপুরে তার দিন। কটি লক্ষ হাজার হাজার দিন বোতলভর্তি হয়ে যায়। সে বোতল কে যেন হারিয়ে ফেলে অতলে, সমুদ্রগর্ভে, ভেঙে পড়া জলদস্যু জাহাজের বিলুপ্ত কোটরে। কে যেন তোমাকে ডাকে সেই গর্ভগৃহে। তুমি কি হালকা করে শিকল আলগা দেবে, ফাঁক করে উঁকি দেবে, কি আছে ভেতরে? কোথা থেকে ভেসে আসছে গান, কোথায় অশরীরীর গলা কাঁপছে, ও কি ও, নিভে যাচ্ছে আলো!

 

 

৭.
কালো এক নৈশব্দে তুমি কি হারিয়ে ফেললে মানচিত্র, ভুলে গেলে, তোমারও তো ছিল ডাঙা, বন্দর-জাহাজঘাটা, তুলোর কারবার, লোহালক্কড়ের বেওসা, সদর বাজারে যত সদাগরি, পিপে পিপে মদ।
নিঃশব্দ জলযান, কে বাজায় দূরে রুদ্রবীণা।

 

 

৮.
হে তাপস তোমারও তো অবকাশ বাড়ি ফিরে আসে। কেউ তো দেখছে না, ভেবে, নিঃসঙ্গ হয়। একা,… একা। বোতলের মন্ত্র পড়ে রাতে। জাহাজ ভেড়ানো ঢেউ ওঠে। চেতনা-বিরল সে যে, বুঝেও বোঝে না, তার কিছু নেই আর, ঘরবাড়ি, শতাব্দী, ইতিহাস। কি সহজ হাসি তার, শোনো, কি সুন্দর, দূর থেকে সহজের গান শোনা যায়।

 

 

৯.
কার মন্ত্র? সহজের, কার সুর? মায়াবী পাতার, কার গান, ঈশ্বরের, কার কথা? আবহমানতা। কার বাদ্য বাজে ওই পরিত্যক্ত দরদালানে? রুদ্রবীণার। অথচ সে অভাবের মত দৃঢ় নয়। চপল চরিতে তার ক্ষুধা-বৃত্তি, ঈর্ষার মত নির্মম। খুনির দৃষ্টির মত শ্যেন তাক, ধারালো, সুস্থিত। এবং প্রেমিকার চীৎকার সম উন্মাদ সে নিশানা।

 

 

১০.
আবর্তনের সম্যক নিয়ম-পত্র, সে জানে না। প্রবর্তনের শুধু জেদ, প্রতিভাবানের উলঙ্গ, অলঙ্ঘ্য এক আলটপকা জুনুন। তার শুধু ইচ্ছে হয়, ওড়ে বেলুনের মত, বাতাসের মত, মহাজাগতিক সব হাউই-এর মত, বায়ুমণ্ডল থেকে দূরে। অমঙ্গল ডেকে আনা পতাকার মত, একদিন, সেও যেন ওড়ে। বোতলে-জিনের মত উড়ে গেলে, আর সে ফিরবে না তার ব্যক্তিগত অবসন্ন ইতিহাসে।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment