শাশ্বতী সরকার

শাশ্বতী সরকারের কবিতাগুচ্ছ

১. 
আজ তুমি আমাকে কী কথা বা মনে করাবে?
কোন কাজ বাকি রয়ে গ্যাছে?
অন্য দেশ, অন্য নগর-গ্রাম, ভুল পিনকোড

আসন্ন সমুদ্রে রাত কাটে, দিনগুলি বেলা হলে দূরে চলে যায়
আরও দূরে নক্ষত্রবীথিটি, বজ্র এসে দাগ কাটল–সে দিবাবসানে
তোমার পিঠের ‘পরে মনে করো নখরাভিঘাত…
চিনেবাদামের খোসা উড়েছে অঢেল, নীলাভ জঙ্গল–তাকে খুঁজে নিতে গেছি
তোমার কোলের কাছে পড়ে আছে হাত, ঢেউয়ে বিক্ষত সেই হাত-কে জাগাও?

এখন, অন্য কোথাও যাওয়া রোদে সাঁতলানো
ভাতের থালার পাশে গেরস্থ ছবিটি
আমার মুখের পাশে চুল
তোমার কাঁধেও গতচুম্বনের জ্বালা, দাগ
আজ তুমি ফের বলো কী মনে করাবে?

 

 

২.
চলে গ্যাছো
এখনও বুঝিনি আমি, কতধানে কত চাল
সকল হিসাবে গরমিল করে একাই এসেছি আজ জলের এ’পারে
আছি, বটের ফলের মতো বিষণ্ণ লাল
এরও বেশি দিতে চাই
ধুলোয় তোমাকে পাব? জলের নরম মনে?
গমরঙা বিকেলে বালিকার ফ্রক হেন মেঘ করে আসে
নদীর এপারে কাঁপে দুগ্ধবতী ধানটির শিষ
পোষমানা এ বিকেল, নিজের ক্ষুধাকে দিই নিজেরই আঙুল
নিজেই নিজেকে বলি খাও,
আরও বেলা হলে, সূর্য গেলে অন্য বাড়ি, আন আঙিনায়
অভিমানে পড়ে থাকি বটের ফলের মতো লাল
কত চালে কতগুলি কালোচাল হয়? কোথায় লুকনো থাকে সতেজ কাঁকর?

 

 

 

৩.
জলকণাগুলি ক্ষুদ্র। তুচ্ছ নয়
একদিন বানান ভোলার দিকে যা্বো, যাবো কি?
দেওয়ালে খুঁজে নেবো পুরনো টিপ
জলের অনেক খেলা ছিল,
কে তুলে দেবে হাতে ফের শামাদান?
কে এসে বসে থাকবে চুপচাপ
বয়ে যেতে দেখবে কিছুক্ষণ

অনেক জলের রাতে তোমাকেই আবিষ্কার করি
নাকছাবি, পুরনো সে টিপ
ছোটো, কিন্তু তুচ্ছ নয়
তোমায় ভাবার অধিকারে

 

 

 

৪.
এখানে অনেকদিন কেটে গেল,
সুখটির গজদাঁতের মিনারে চড়ে
দাঁতের প্রান্ত থেকে ফেলে দেওয়া হল
আত্মজন্মের শাদা, স্তব্ধ হাড়ের পাহাড়

শান্ত, গ্রাম্য অটবীর নিচে বসে কথকঠাকুর
গেয়ে যান তোমার মহিমা
তোমায় ভজলে বেকারের চাকরি হতে পারে
নুলো বাঁশিওয়ালার কাঁধ থেকে দুটো ডানা ঝটপট
আমি এক ভবঘুরে, জানি ঝকঝকে শাদা দাঁতে শাদা মৃত হাড়ের আহার

 

 

 

 

৫.
কোমল অন্ধকারে কোথায় কবে উলটে গ্যাছে রুপোর কৌটোভরা সিঁদুর।

গাছের কাছে কি অন্ধকার থাকে? জলের কাছে?
খেলা ভুল হয়ে যায় সুরঙ্গমা। মৃদু, হ্রস্ব সাঁতারের সাবলীলতার কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে। অথচ পথ জানি না। অন্ধকারই কি পথ?

কেউ নই আমি, সুরঙ্গমা।
তোমার তাবিজখানি খুলে দ্যাখো, শাদা..? অমন শূন্যস্থান, আলোহীন, অতটুকু। পরিশ্রান্ত মানু্ষের কাঁধে নুনের দানার মতো একা

 

 

 

৬.
নিমছায়াফলকাল। ব্যাকুল উঠোনে
খেলা শুরু হয়
নরম ছায়ার মধ্যে গোপনেগোপনে
বিষাদিত হয়ে যেন দেব পুরন্দর
নিমের ফলের মতো
গুঙিয়ে উঠেছেন একা উঠানের ‘পর

যদি কথা শেষ হয়–যদি কথার পরের কথা থাকে, এখনও
তাকে দূর পূর্ণিমায় হঠাৎ কাকের ডাকে খুঁজে পাব?

কবেকার দেখা৷ পুনর্জন্মে আর কোনও স্মৃতি নেই। তোমার চিবুকে ভাঁজ। রাগী ও ঈষৎ ভারী তোমার চোয়াল। আমাকে গিলেছ–শুধু এইটুকু মনে আছে।

পাথারে-পাথারে ফুল, নয়নতারার, আমরা যে চুপ করে থাকি, তা কোন ছন্দের? যে ফুলের নাম নাই, তার নাম নয়নাভিরাম?

চশমা নিতে ভুলে যাই। হাঁটুর উপর সরে যাওয়া জামা ঠিক করে দিতে ইচ্ছে করেনাকো। তবু ভালো লাগে, আমাকে কেমন লাগে ঘুমিয়ে, না জেনেই একদিন মারা পড়ব।

ঘোড়াগুলি জল খায়, তৃষ্ণার্ত প্রান্তরে, তেষ্টাকে না বুঝে তোমার কথার কাছে বুকের সেতুটি, জানি একদিন দ্রুত পায়ে ছুটে চলে যাবে…

 

 

 

 

৭.
কোলাহল থেমে যায়, মাধবীবাগান চুপ করে থাকে কতটা সময়
পূর্ণিমার চাঁদ থেকে তোমার স্নেহের মতো মায়াবিন্দু ঝরে
শীতল তুমিই, প্রাণের উপর
পূর্ণিমার লী-লী রৌদ্রে মাধবীলতা ফুল

যদি ভাবো, একদিন চলে গেছি
এভাবেই যায় শেষ ট্রেন, ছোটো হল্টে স্টেশনমাস্টার রাতে বই পড়ে
হঠাৎ তারার জল, স্বাতী
বইয়ের পাতায়, দেখি নয়নযুগল ফুটে আছে
দূর পশ্চিমে, সেভাবেই, তুমি, জানি আছো

যে আমাকে দ্যাখে একা প্রত্যেক স্বজন, দূরাগত আত্মীয়–আমপাতা ডাল
জলের প্রতি নিবিষ্ট মন ছুঁয়ে থাকে রাতদিন, সকল সময়
বালিহাঁস উড়ে উড়ে চলে গেল,
সব যশ একদিন ঝুরোমাটি হয়,
কবরে মাধবী, তুমি–আকুল আকুল…

 

 

 

 

৮.
মৃত্যু, যে নিজেও একা

সে এসে স্বপ্নে কী দেখাবে

দেখায় দ্বাদশী তিথি

পূর্ণিমার বাকি তিনদিন
পূর্ণিমার বাকি দুইরাত

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment