সহাবস্থান মালিকানার চাবি নয় কখনোই। এই যে কথায়-কথায় আমাকে হাওয়াকল প্রকাশনার কর্ণধার বা একজন বলা হয়, আমার পছন্দ হয় না। কেনই বা হবে? আমার নিজস্ব প্রকাশন সংস্থা আছে তো! শাম্ভবী দ্য থার্ড আই ইমপ্রিন্ট। সংক্ষেপে শাম্ভবী ইমপ্রিন্ট বা শুধুই “শাম্ভবী”। হ্যাঁ, প্রায় চার বছর হল আমাদের আর হাওয়াকল প্রকাশনার ঠিকানা এক। সমস্ত কাজকর্ম একই জায়গায়, একইভাবে করা হচ্ছে। কিন্তু মালিকানা হস্তান্তর বা পরিবর্তনের কোনও প্রয়োজন বা তাগিদ অনুভব করিনি। করেনি বিতান চক্রবর্তীও। যার হাতে তৈরি হাওয়াকল সংস্থাটি এক দশক পূর্ণ করেছে।
সরকারি চাকরির একটা মায়া আছে, জানেন তো? মোটা বেতন, নিশ্চিন্ততা, অবসর গ্রহণের পর বাঁধা পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ড ফান্ড ইত্যাদি। চাকরিটা তাই ছাড়তে পারিনি আজও। খাতায় কলমে শাম্ভবীর মালিক আমি নই; মালকিন আমার স্ত্রী, ভাস্বতী। আমি আছি সহায়ক হিসেবে। শাম্ভবী-প্রকাশিত বইগুলোতে আমার নাম পাবেন না। সরকারি চাকরি করি, অথবা মালকিন আমার স্ত্রী বলে আমার নাম নেই এমনটাও নয়। সত্যি কথাটা হল, আমি কোনোকালেই প্রকাশক হতে চাইনি। আজও ইচ্ছে নেই, এক্কেবারে নেই। কেন থাকবে?
ডাক্তার লেখালিখি করে শখ মেটান, সময় কাটান এ-পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ডাক্তার-কাম-প্রকাশক এই তকমায় আমার ঘোরতর আপত্তি। আর শুনুন, প্রকাশক-কাম-লেখক যখন মার্কেটে বই বিক্রি করতে নামেন, তখন তার লেখক সত্তা ক্ষয় হয়ে যায়। কোন কালে কী হয়েছে সে-সব উদাহরণ দেবেন না; এখন কী হয় সেটা আমার থেকে জেনে নিন। কারণ, এ-অভিজ্ঞতা আমার, পরের ঝাল খেয়ে বলছি না।
একটা ঘটনা বলি। নিয়মিতভাবেই কলকাতা বইমেলায় শাম্ভবী-র স্টল থাকে। অবধারিতভাবে সঙ্গে থাকে হাওয়াকল। কাউন্টারে আমি আর বিতান। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আমাদের লেখা বইগুলোও থাকে। আর সে-সব বইয়ের পেছনের মলাটে আমাদের ছবি। ক্রেতা বই উলটে পালটে যেই না আমাদের ছবি দেখলেন, ব্যস! “এটা আপনার বই না?” না-ই বা বলি কীভাবে? হাসিমুখে আরও কয়েকবার বইটা দেখে না কিনেই চলে গেলেন ক্রেতা। চুপিচুপি সঙ্গীকে বললেন, “নিজেদেরই বই বিক্রি করছে!” এই ঘটনা একবার নয়, অনেকবার অনেকভাবে হয়েছে। আমাদেরই সামনে। দু-বছর হল শপথ করেছি, আমাদের বইতে না থাকবে আমাদের ছবি, না থাকবে বায়ো।
কিছুদিন আগের ঘটনা। জনৈক কবিকে সুবোধদা (সুবোধ সরকার) বায়ো পাঠাতে বলেছিলেন। সে নিয়ে কী-ই না খিল্লি হল ফেসবুকে। “কবির থেকে বায়ো চাওয়ার মানে কী?” “কবিকে কি চাকরি দেওয়া হবে?” কত কথা, কত দেমাক! অথচ বইয়ের পেছনের মলাটে বা জায়গা বুঝে লেখকের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী গুঁজে দেওয়া হয় না কি? “বায়ো” বললেই দোষ? বায়ো মানেই চাকরির দরখাস্ত? বাঙালি কবিরা কবে নিজেদের আপডেট করবেন, বলতে পারেন?
অভিযোগ জানাচ্ছি না, ভুল বুঝবেন না আমাকে। প্রকাশনার কাজকর্ম করি বলে কিছু ক্ষোভ তো জমা হবেই। “হবেই” বলছি কেন? শুনুন, প্রকাশক বা তাঁর সহায়ক হিসেবে আমাদের সমস্ত লেখক বা কবিদের মন রাখতে পেরেছি কি? পারিনি তো। যাঁদের ক্ষেত্রে পারিনি তাঁদেরও তো ক্ষোভ আছে আমার বা আমাদের ওপর। তাহলে যে-সব লেখক বা কবি আমাদের মন রাখতে পারেননি তাঁদের জন্য এতটুকু ক্ষোভ কি বরাদ্দ করতে নেই? আলবাত আছে!
প্রথম প্রথম লেখক-কবিদের থেকে টাকা নিয়েই বই করতাম। মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম হয়নি, তা নয়। একটা-দুটো বই নিজের খরচেও করেছি। শাম্ভবী প্রথমদিকে সেল্ফ পাবলিশিং করত। লেখক বা কবিদের সঙ্গে সমঝোতা হত, ক-টা বই দেবো, ক-টা বই নিজের কাছে রাখব, বিক্রি করব… সব কিছুর লিখিত বা অলিখিত চুক্তিপত্র হত। ভেবে দেখলাম ভুল করছি। হাত পেতে টাকা নেওয়া মানেই অপরপক্ষকে মাথায় তুলে রাখতে হবে। একটাই তো মাথা আমার।
প্রায় চার বছর হতে চলল শাম্ভবী বলুন বা হাওয়াকল, নিজেদের বাজেট থেকেই বই করছে। কাউকেই আর মাথায় তোলার প্রয়োজন হচ্ছে না। তোয়াজ করতে হচ্ছে না। “কাউকে বলবেন না প্লিজ কত টাকা নিয়েছে প্রকাশক” অথবা “আমার আপনার সমঝোতা যেন পাঁচকান না হয়” এ-সবও বলতে হচ্ছে না। এখন পাণ্ডুলিপি জমা দিতে বলি; মাস তিনেকের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয় বইটা করা হচ্ছে কিনা। পছন্দ না হলে লেখক বা কবি মন খারাপ করেন, কখনো-বা দু-পাঁচ কথা শুনিয়ে দেন। “আমার লেখা দেশ-এ প্রকাশিত হয়েছে” ইত্যাদি। আমার মুখ ভালো নয়, এমনটাই জনরব। কাজেই, আমি উত্তরে কী বলি, সেটা আর খোলসা করছি না।
কাউকে আর ধরে-বেঁধে নিয়ে আসতে চাই না আজকাল। একদম আনি না, একথাও বলব না। ব্যবসা যখন বিজনেস মাইন্ডেড না হয়ে কী উপায়? কিন্তু ওই যে বললাম, প্রকাশক হওয়ার বাসনা ছিল না কখনো, আজও নেই। খুব বেশি কমপ্রোমাইজের রাস্তায় হাঁটি না তাই। সোজা কথাটা শুনুন, আপনার বই আমাকে স্বর্গের সিঁড়ি দেবে না। কোটিপতিও করবে না। না আছে পারমার্থিক উন্নতি, না আর্থিক কৌলিন্যের সুযোগ। তাহলে কেনই বা নিজের তৈরি করা ফ্রেম থেকে বেরিয়ে লোকের বই ছাপব?
কেউ কেউ দীর্ঘ ফিরিস্তি ধরিয়ে দেন। তাঁর বই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রমোশন করা হয়। বুক লঞ্চ, রিভিউ, বিভিন্ন দোকানে বই রাখতে হবে, এমন কত কী! কিন্তু করব কেন? উত্তরে অনেকেই বলেন, “এ-সব তো প্রকাশকেরই কাজ। প্রকাশকেরই দায়িত্ব!” বিনে পয়সায় বই ছাপিয়ে টাপিয়ে দিলাম, এ-পর্যন্ত ঠিক আছে। বাকি কাজগুলো লেখক করবেন না কেন? ক-টা কবিতা লিখে, গল্প বা উপন্যাস লিখে কে কার মাথা কিনে নিয়েছে? আর হ্যাঁ, বিনে পয়সায় বই ছাপিয়ে দিয়ে প্রকাশক কিন্তু মাথা বিকিয়ে দেননি যে তাঁকে লেখকের সমস্ত আবদার মানতে হবে। মশাই, আবদারেরও লিমিট থাকে!
দেখতে দেখতে ছ-বছর কেটে গেল। শাম্ভবী এখন অনেকটাই পরিণত। আর এই ম্যাচিউরিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই। দুটো বইয়ের কথা বলতেই হয়। এক, এ-দেশে লেখা প্রথম ইংরেজি নাটক। দুই, এ-দেশে লেখা প্রথম ইংরেজি ফিকশন। এ-দুটো বই নতুনভাবে (দীর্ঘ ভূমিকা ও টীকাসহ) প্রকাশ করেছে শাম্ভবী। গর্বিত হই যখন খবর পাই দ্বিতীয় বইটি বিশ্বভারতীতে ইংরেজি স্নাতকোত্তর স্তরে পাঠ্য করা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি প্রথমও জড়িয়ে আছে শাম্ভবীর সঙ্গে। যেমন ধরুন, কবি বল্লরী সেন-এর প্রথম ইংরেজি কবিতার বই, কবি অনন্যা চ্যাটার্জির প্রথম কবিতাবই, অধ্যাপক মুন্সী ইউনুসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ডাক্তার ইন্দ্রনীল আইচের প্রথম বই (নন-ফিকশন)।
নতুন বইয়ের প্রমোশনাল ক্যামপেইনিং-এ আমি বিশ্বাস করি। বইপাড়াতে কী কী বই এলো, পাঠককে জানাতে হয়। কে জানাবে, প্রকাশক না লেখক, এই তর্কে না গিয়ে জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হোক। শুরু করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই? তাহলে আরও একটু দৌড়োতে বলব। মানুন চাই না মানুন, সর্বভারতীয় স্তরে, বিশেষত কবিতায়, শাম্ভবী বা হাওয়াকল-কে বুক প্রোমোশনের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।