গৌতম বসু

শম্ভু রক্ষিত, শ্রদ্ধাভাজনেষু

 

যতদূর মনে পড়ছে, ইংরাজি ২০১৮-এর  শেষ প্রান্তে শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবাসন হয়। প্রায় একই সময়ে, আরও একটি দুঃসংবাদ আমাদের বিমূঢ় করেছিল, যখন শম্ভু রক্ষিত-কে, আমাদের সকলের শম্ভুদা-কে, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়, চিকিৎসার জন্য পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়া থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। এর কিছুদিন পর, হাওড়ার ঠাকুরদাস দত্ত ফার্স্ট লেনে জন্মগ্রহণ করা শম্ভু রক্ষিত-কে কিঞ্চিৎ সুস্থ শরীরে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিরিঞ্চিবেড়িয়ায়, কিন্তু তখন থেকেই কারুর-কারুর মনে আশঙ্কা জন্মাচ্ছিল, এইবার, এতদিনে, বৃত্ত বুঝি সম্পূর্ণ হতে চলল। অবশেষে, সম্পূর্ণ হল সেই বৃত্ত। বিগত আঠারো মাস ধ’রে তিনি কি তাঁর অনুরাগীদের নিজের মৃত্যুসংবাদের ভার বহন করবার জন্য প্রস্তুত ক’রে তুলতে চাইছিলেন? শম্ভু রক্ষিত-এর অন্তিমপর্বের ভাবলেশহীন মুখটির অন্তরালে যে ভাবনাপ্রবাহ নিরন্তর আন্দোলিত হত, তা শেষ পর্যন্ত, আমাদের অজ্ঞাত রয়ে গেল। শম্ভু রক্ষিত লিখেছেন, ‘তোমার আমার জন্যই তো মৃত্যুর সৃষ্টি হয়েছিল’; লিপিবদ্ধ হওয়ার আগেই লাইনটি যতখানি সত্য ছিল, তাঁর চ’লে যাবার পরেও তা ততটাই অমোঘ হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই, কিন্তু, এটা আমার কাছে কোনও আকস্মিক ঘটনা নয় যে, কাটা-পড়া ঘুড়ির মতো বায়ুস্তরে অনিশ্চিতভাবে ভাবে ভেসে-চলা সার কথাটি, অন্য কেউ নয়, তিনিই, এক লাফে ধ’রে ফেলেছিলেন। কবিতা এই কারণেই অনন্ত রহস্যময়ী; বাইরের আয়োজন যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে ঢাকঢোল বাজে না, সেখানেই, দেখা যায়, কবিতা উথলে উঠছে।

    কার দুই আঙুলের ফাঁকে গজিয়ে উঠবে নতুন কবিতা, আমরা কেউ জানি না। লেখক  নিজেই কখনও-কখনও তা অনুমান করতে পারেন বটে, কিন্তু সে অনুমান মাত্র। এমনও হতে পারে, তিনি অনুভব করলেন যে তাঁর একটি–দু’টি পাঁজর ঠকাং-ঠক্‌ শব্দে মাটিতে প’ড়ে গেল, ওই পর্যন্তই; সেখান থেকে সত্যিই কিছু গ’ড়ে উঠল কি না, তা সম্যক বুঝে-নেওয়া তাঁর পক্ষে  অসম্ভব। খেলা সাঙ্গ হবার পর, একমাত্র পাঠক একদিকের ভাঙন আর তার বিপরীত প্রান্তের সমৃদ্ধির হদিস পেতে পারেন, একমাত্র তিনিই দেখতে পান লেখকের স্থূলজীবন সমাপ্ত হবার পরেও কোন্‌ কাব্যগ্রন্থের ছাতি ওঠা-নামা করছে। সৌভাগ্যের কথা, কখনও-কখনও লেখকের চিত্তেও নির্লিপ্ত এবং লেখকপরিচয়-বর্জিত এক পাঠকসত্তা অবস্থান করেন, এবং সেই অদ্ভুত দ্বৈতসত্তার  জোরে লেখক নিজের রচনার স্থায়িত্ব ও ভঙ্গুরতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা গ’ড়ে তুলতে পারেন। আমার ধারণা, শম্ভু রক্ষিত-এর মধ্যে এই দ্বৈতসত্তা সক্রিয় ছিল, এবং এটিই তাঁর দম্ভবর্জিত আত্মপ্রত্যয়ের উৎসমুখ। একে ঔদাসীন্য নাম দেওয়া যায়, অথবা পরিপার্শ্বের প্রতি প্রবল তাচ্ছিল্যের ভাব, অথবা সংস্কারমুক্তি, অথবা আত্মপ্রত্যয়, এমন কি নিছক অবিবেচনাপ্রসূত ক্ষ্যাপামোও, কিন্তু এ-সবই বিশেষ এক ব্যাধির উপসর্গ; ব্যাধির নাম প্রতিভা।                          

    কিছু-কিছু অস্বচ্ছ বাক্য আমাদের জন্য রেখে গেলেন শম্ভু রক্ষিত, যা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কবিতায়, এবং স্বল্পসংখ্যক গদ্যরচনায়। দীর্ঘ সময় জুড়ে আমি সেগুলির অর্থোদ্ধারের প্রয়াস ক’রে চলেছি; কয়েকটি হেঁয়ালিপ্রতিম উক্তি অবশেষে ধরা দিলেও, অনেকগুলি আজও এমনিই প’ড়ে রয়েছে। তিনি লিখেছেন:

    ‘কবিতা প্রজ্ঞার জ্যোতি ভালবাসায় মোড়া। পরম জগতের সব সুখবোধের উপরে। কবিতা শিষ্টাচারের এক মহান প্রকাশ। কবিতা সৃষ্টি গুটিকয় অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির ন্যায় সঙ্গত সাধনার বিষয়। প্রকাশে তার বিকার ও ব্যর্থতা। কবিতা বিশ্বের তুচ্ছ থেকে মহান আচরণ ধারণ ক’রে আছে। কবি মানে যে নিজের পায়ের কাছে এসে মনুষ্যত্বের রূপান্তর করে। কবিতা বিষয়ের বিস্তার নয়, অবান্তর কোনও নরককল্পনা নয়। সব কিছুর মতো সমস্ত বিশ্বের প্রাপ্য।’                     

    বিদায় জানাবার সময়ে কেউ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, কেউ সচেতনভাবে তা পরিহার ক’রে চলেন। আমি দ্বিতীয় গোষ্ঠীতে রয়ে যেতে চাইলেও, একটি বিবরণ দিয়ে  এইবারের মতো একইসঙ্গে এই প্রথা ভঙ্গ করলাম এবং করলাম না, কারণ এই বিবরণে প্রত্যক্ষ ভাবে শম্ভুদা অনুপস্থিত। কোপাই–এর ধারে এক নির্জন স্থানে পাকা রাস্তাখানা বেঁকে গেছে। বাঁকের ঠিক মুখে একটা চায়ের দোকান, তার সামনের অংশটা রাস্তার সমান-সমান, বাকি অংশ, পিছনের ঢালু জমিতে পোঁতা অনেকগুলো বাঁশের খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোকানঘরের দশ হাত দূরে আমি একবার টিনের পাতে রঙ-করা একটা সাইনবোর্ড দেখেছিলাম, ঠিক সাইনবোর্ড নয়, জনৈক সুবোধ বাউলের স্মৃতির প্রতি নিবেদিত একটি অস্বাক্ষরিত মানপত্র:  

 

‘এইখানে, এই বটতলায় দিঘে-নারায়ণপুরের সুবোধ
বাউল মাঝে-মধ্যে জিরিয়ে নিত। সুবোধ প্যারিসে যায়
নি, নিউ ইয়র্কেও নয়। চিররুগ্ন সুবোধের দৌড় ছিল
শান্তিনিকেতনের কলাভবন ― ঘণ্টাতলা অবধি।
ভারি কষ্ট করে এইটুকু পথ পাড়ি দিত সে।
গত ২৯.১০.২০১৪ তারিখে সুবোধ অনন্তে
পাড়ি দিয়েছে, অকালে। বাউল সুবোধ
মানুষকে সেজদা দিত। আমরা যারা খোকনের
দোকানে নিত্য আসি-যাই, আমরা তাকে সেজদা দিই।’
 

আশেপাশে ব’সে-থাকা মানুষজনের কাছে সুবোধ বাউলের খোঁজখবর নিলাম, কিন্তু, ইত্যবসরে কয়েক বছর অতিবাহিত, তাঁরা কেউই বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। আমার কৌতূহল দোকানীর কানে পৌঁছেছিল বোধহয়, এক হাতে চামচ ধ’রে সশব্দে চিনি গুলতে-গুলতে, অন্য হাতে কালো হয়ে-যাওয়া কমলা রঙের প্লাস্টিকের ছাঁকনি তুলে তিনি ব’লে উঠলেন, ‘ঐ, ঐখানে এসে বসত।’ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি একটি জনশূন্য বেঞ্চি দেখতে পেলাম, প্রখর রোদে পুড়ছে।                                       

 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment