ভূমিকাঃ অন্য সবার মত আমারও ট্রেকের অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছিল সান্দাকফু আর ফালুট ট্রেকের সাথে। সেখানেই আমাদের পঞ্চপান্ডবের এক হওয়া। আমাদের মধ্যে একজন অনিয়মিত হলেও আমরা বাকি চারজন প্রতি বছর একটা ট্রেকে একবার একসাথে হবই। এটা আমাদের একটা কমিটমেন্ট হয়ে গেছে। সারা ভারতে যারা ট্রেক করেন সান্দাকফু ছাড়াও রূপকুন্ড, রূপিন, গোয়েচালা আর তপোবন এই কয়টি ট্রেক অন্তত না করলে ট্রেকারেরা ঠিক জাতে ওঠেন না। আর শুনেছি রূপকুন্ড করতে পারলে নাকি লোকেরা বলে, ও আপনি রূপকুন্ড করেছেন তাহলে অমুক ট্রেক তো আপনার কাছে কোনো ব্যাপারই না।
তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম বিড়ালকে প্রথম রাতেই মেরে রাখতে হবে। আর দেরি না করে বেশি বয়স বাড়ার আগেই রূপকুন্ড ট্রেকটা করে ফেলতে হবে। তাই আমরা চারজন মিলে প্ল্যানিং করে সময় বের করে রূপকুন্ডের জন্য প্রস্তুত হলাম।
দু-বছর আগেই ঠিক করেছিলাম রূপকুন্ড যাব। MCI -এর চক্করে পড়ে যাত্রা বাতিল করতে হয়েছিল। এবার তাই শত বাধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করে আমরা ২২ মে বেরিয়ে পড়লাম। ইন্ডিগোর ফ্লাইটে দিল্লি। দিল্লি থেকে রানিক্ষেত এক্সপ্রেস করে ২৩ মে পৌঁছলাম কাঠগোদাম স্টেশনে।
২৩/০৫/২০১৬
ভোরবেলার আধো অন্ধকারে কাঠগোদাম স্টেশনে নামলাম। স্টেশনটা নতুন করে বানানো হয়েছে। ঝাঁ-চকচক একটা ব্যাপার আছে। ওয়েটিং রুমগুলো নতুন। টয়লেটগুলো এখনো সেরকম নোংরা হয় নি। গতকালের দিল্লির গরমে আমদের অবস্থা কাহিল ছিল। সকালে টয়লেট করে, দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে গাড়িতে উঠে বসলাম।
আমরা এবার ট্রেক দ্য হিমালয়াস বা সংক্ষেপে টি.টি.এইচ. এর সাথে যাচ্ছি। আমাদের চারজনের জন্য গাড়ি আলাদা করে বুক করা ছিল। গাড়ি ছাড়তেই শুরু হল বৃষ্টি। চারিদিক কালো করে বৃষ্টি। পাহাড়ি পাকদন্ডী বেয়ে গাড়ি ঢিমেতালে চলতে শুরু করল।
আজ আমরা যাব লোহাজং। অনেক দূরের পথ। দশ থেকে বারো ঘন্টা তো লাগবেই। ভীমতাল ছাড়িয়ে গাড়ি চলল আলমোড়া। রাস্তা খুব সুন্দর। কুমায়ুনের পাহাড় সবুজ। গাছে মোড়া। রাস্তায় তাই ধস নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কিছু গাছ পড়ে আছে। সেগুলোকে লোকে কেটে রাস্তা থেকে সরিয়ে রেখেছে। গাড়ি চলায় যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
আলমোড়া বিরাট পাহাড়ি জনপদ। পাহাড়ের ঢালে গায়েগায়ে বাড়ি, হোটেল, অফিস-কাছারি, ব্যাঙ্ক। তবে প্রচুর বন-জঙ্গল, চওড়া রাস্তা, পাহাড়ি উপত্যকাও আছে। উমাপ্রসাদের লেখায় পড়েছি উনি মানস সরোবর যাবার সময় আলমোড়া থেকে হাঁটা শুরু করেছিলেন। তবে সেদিনের আলমোড়া আর আজকের আলমোড়ার নিশ্চই আকাশ-পাতাল ফারাক।
পাহাড় তো আর পালটায় না। পাহাড়ের উপর মানুষের অধিকার পালটে যায়। আমরা তাই চলেছি আরও উঁচুতে। পাহাড় এখনও যেখানে মোটর গাড়ির কবলে পড়ে নি। রাস্তা মানে পায়ে চলা রাস্তা। ঘোড়া খচ্চর চলা রাস্তা। পিচের প্রলেপ এখনো পড়ে নি।
আলমোড়া থেকে বিনসারের রাস্তা চলে গেছে। বিনসারে একদিন আসতে হবে। এবার রাস্তাটাই দেখে গেলাম। গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে কৌশানি পৌঁছাল। কৌশানিতেই উত্তরাখন্ডের বেশ কিছু চায়ের বাগান। গাড়ি দাঁড়াল দুপুরের খাবার জন্য। খাবার পরে কৌশানি ছাড়িয়ে গাড়ি চলতে লাগল।
আমাদের ড্রাইভারের শরীর বিশেষ ভাল ছিল না। বুকে ব্যাথা করছিল। গাড়ি আস্তে চালাচ্ছিল। মাঝে একটা শর্টকাট নিয়ে মাটির রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে গাড়ি আবার পিচের রাস্তায় উঠল।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছিল যে কোন সময় বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। গোয়ালদাম পার হয়ে গেল। সামনে দেওল। ছোট জনপদ। এখান থেকে লোহাজং প্রায় ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। অনির্বাণ বলল ওর বাবা আগে যখন রূপকুন্ডে এসেছিলেন তখন দেওল থেকে হাঁটা শুরু করতে হত। সে অনেক বছর আগের ব্যাপার।
সন্ধ্যের মাথায় মাথায় আমরা লোহাজং-এ পৌঁছে গেলাম। পৌঁছতেই শুরু হয়ে গেল মুষলধারায় বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নামতে নামতেই ভিজে গেলাম। বৃষ্টির সাথে তেড়ে ঠান্ডা নামল। আমাদের ঘরের উপরের কাঁচটা ভাঙ্গা ছিল। সেখান দিয়ে জল আসছিল। মালিকের সাথে একপ্রস্থ বাক্বিতন্ডার পরে ব্যবস্থা হল। আরো দুটো গাড়ি করে বাকি দশজনের দল যখন পৌঁছাল ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে।
ওদের আসার রাস্তায় গাছ ভেঙ্গে পড়ায় বিপত্তি হয়েছিল। আমাদের দলে মোট সতের জন। তারমধ্যে চারজন মেয়ে। বৃন্দা, ভাবনা, অমিতা, সিন্দুর। ভাবনা ছাড়া বাকিরা বিবাহিত। বৃন্দার আবার মেয়েও আছে।
বাকিদের মধ্যে আলপ্রিত আর অনুপ পাঞ্জাবী। হুসেন, ঋষি গুজরাটি। মুম্বাইয়ে থাকে। ওরা ফার্স্ট ইয়ার ইঞ্জিনীয়ারিং এর ছাত্র। সুবোধ, আকাশ, দীপক ব্যাঙ্গালোর আই.টি. সেক্টরে কাজ করে।
সবার সাথে প্রাথমিক আলাপ পরিচয় হল। আমাদের গাইড কামেশ্বর। সঙ্গে আরও দুজন আছে। মদনজি আর পান্ডেজি। ওনারা স্থানীয়। পান্ডেজির নাম আবার “রূপকুন্ড বাবা”। মদনজি ছাড়া আমাদের কুড়িজনের গ্রুপে আমিই সবচেয়ে বড়। আমরা সে পুরনো চার পাপী আবার একসাথে এসেছি। আমাদের মধ্যে আরেকজন বাঙালি অভিরূপ। ওর বাড়ি মধ্যমগ্রাম। ওর বাবা আই সার্জেন। ও ব্যাঙ্গালোরে আই.বি.এম. এ চাকরি করছে। অর্থাৎ ট্রেকিং এর ক্ষেত্রে বাঙালিদের অবহেলা করার কোন জায়গা নেই। বাঙালিরা মোটর গাড়ি করে যেমন ঘুরতে ভালোবাসে পায়ে হেঁটে ঘোরাতেও তাদের উৎসাহের কোন অভাব নেই।
রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা বাইরেই হল। বিকেলের বৃষ্টির পর তেড়ে ঠান্ডা পড়েছিল। কালকে দিল্লির ৪৯ ডিগ্রির পর আজকের পাঁচ কি ছয়। আমি এমনিতেই শীতকাতুরে। হালকা জ্যাকেট গায়েও বেশ শীত করছিল।
খাবারদাবার পর প্রাথমিক আলাপ পরিচয় শেষ হলে ব্রিফিং শুরু হল। রোগা করে চশমা পরা একটি ছেলে পাহাড়ে সার্ভাইভালের ব্যাপারে অনেক উপদেশ দিল। আমি তো আজকাল কিছুই মনে রাখতে পারি না। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর করে বললে আরো কিছু মনে থাকে না। মোদ্দা কথা যেটা বুঝলাম, বেশি করে জল খেতে হবে। ইচ্ছে না করলেও বারবার করে খেতে হবে। ভাল থাকার এটাই প্রধান উপায়।
Acute mountain sickness বা AMS নিয়ে অনেক কথা হল। দশ হাজার ফিটের উপরে গেলেই মাউন্টেন সিকনেস হতে পারে। লোহাজং ৭৬৬২ ফুট। এখানে ওসবের বালাই নেই। তবে উপরে গেলে হতেই পারে। আমি চিরকাল বর্তমান নিয়ে ভাবি। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিই না। তাই ভাবনা বন্ধ করে লেপের তলায় গেলাম। আকাশ পরিষ্কার। লোহাজং-এ কারেন্ট নেই। এরকম বৃষ্টি বাদলের পর এখানে কারেন্ট থাকাটাই আশ্চর্যের। দূরের উঁচু পাহাড়ের উপর ছোট গ্রাম দিদনা। ওখানে আলোর ঝিকিমিকি। সোলার জ্বলছে। কাল আমরা ওই গ্রামেই রাত কাটাব। গাড়ির হ্যাং ওভার এখনো কাটে নি। শুতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এল।
২৪/৫/২০১৬
ভোরবেলা উঠে জ্যাকেট পরতে গিয়ে দেখি চেনটা কেটে গেছে। অনেক দিনের পুরনো জ্যাকেট। তাই ওটার মায়া ত্যাগ করলাম। ভোরের আলোটা খুব সুন্দর। আমাদের ট্রেকার্স হাটটা একটু উঁচুতে। নিচে লোহাজং গ্রাম। পাশ দিয়ে মোটর রাস্তা চলে গেছে ওয়ানের দিকে।
ব্রেকফার্স্ট শেষ করে হাঁটা শুরু হল। KVMN- এর গেস্ট হাউসের পাশে ট্রেকিং এর জিনিসপত্র কেনার দোকান। কেউ কেউ কিছু দরকারি জিনিস কিনল। অনির্বাণ আর সৌগত একটা করে হেড টর্চ কিনল। রাস্তা সোজা চলে গেছে নিচের দিকে। হাঁটা শুরু করলাম। পাথুরে রাস্তা। পাহাড়ি রাস্তায় নামতে ভাল লাগে। কিন্তু ভয় লাগে। নামা মানে আবার উঠতে হবে। শুনেছি দিদনার শেষদিকের চড়াইটা মারাত্মক। প্রথমদিনের চড়াইয়ে কষ্ট বেশি হয়। অনেকটা নেমে একটা ছায়াঘেরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়ালাম। উপর থেকে সরু জলের ধারা নেমে এসেছে। বোতলে জল ভর্তি করে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে লাগল। পঞ্চ না বের করে উপায় নেই। সবাই পঞ্চ পরে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি কমে এল। পঞ্চ খুলে আবার হাঁটা। খানিকটা হাঁটার পরে আমরা খোলা মাঠের মত একটা জায়গায় পৌঁছলাম। বেশ ভাল লাগছিল। দূরে পাহাড়ের উপর ওয়ান গ্রাম দেখা যাচ্ছে। নিচে নেমে ডানদিকে নীলগঙ্গা পার হয়ে আমাদের দিদনা যাবার পথ।
পথে আবার বৃষ্টি শুরু হল। নীলগঙ্গার উপরের ব্রিজ পেরিয়ে আমরা অন্য পাহাড়ের তলায় পৌঁছলাম। তারপর শুরু হল অন্তহীন চড়াই। উঠছি তো উঠছিই। পথে বেশ কিছু রডোডেনড্রন গাছ। অল্প কিছু ফুল। বেশিরভাগ গাছের নামই তো জানি না।
পাখির কিচিরমিচির তো চলছেই। ব্ল্যাক লোরড টিটের একটা ঝাঁক রডোর ঝোপে নাচানাচি করে নেমে গেল নিচে। পিঠে সূর্যের আলো পড়ছে। ঘামে ভিজে গেছে টি-শার্ট। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
বেশ খানিকটা ওঠার পর দিদনা গ্রামে পৌঁছলাম। পাথরের বাড়ি, সিমেন্টে বাঁধানো রাস্তা পেরিয়ে আমরা টি.টি.এইচ.এর ক্যাম্পে পৌঁছলাম। পাথরে গাঁথা দোতলা বাড়ি। আমরা আটজন দোতলার ডর্মেটরিতে উঠে পড়লাম।
বরফঠান্ডা জল পড়ছে কল দিয়ে। কিন্তু আগামি দিনগুলোতে চান করা অসম্ভব। তাই কপাল ঠুকে স্নান করে নিলাম। বাইরে ঠান্ডা কিন্তু চড়া রোদ। কাপড়-জামা ধুয়ে শুকিয়ে নিলাম। ঠান্ডা লাল গুরাসের সরবত দিয়ে গেল। দারুন খেতে। এই প্রথম গুরাসের সরবত খেলাম। সবাই স্ট্রেচিং করছিল। আমিও কিছুক্ষণ করলাম। বেশ ঝরঝরে লাগল।
খানিক পরেই দুপুরের খাওয়া। পেটে ছুঁচোর দৌড়। ঠেসে ভাত খেলাম। সঙ্গে নিকনের ৭০-৩০০ লেন্সটা এনেছিলাম। তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দিদনার গ্রামে কমবেশি দশবারোটা ঘর আছে। পশুপালন আর চাষবাসই প্রধান জীবিকা। একটা ছোট স্কুলও আছে দেখলাম। একটা পনি চরে বেড়াচ্ছে। সাদা লোমশ লেজটা এদিক-ওদিক দোলাচ্ছে। বেশ খানিকটা নিচে নেমে দুই একটা মাঝারি শট পেলাম। একটা ফ্লাওয়ার ব্রেস্টেড ফ্লাওয়ারপেকার অনেকক্ষণ ধরে দূরে বসেছিল। কাছে যেতেই উড়ে পালাল। ওপরে একটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে অনেক্ষণ ধরে। দূরে মাউন্টেন ঈগলও একটানা অনেক্ষণ উড়ে দূরে কোন পাইনের ডালে বসল। সামান্য হাতিয়ার নিয়ে আমার দেখা ছাড়া কোন উপায় নেই।
বিকেলের দিকে ক্যাম্পে ফিরলাম। পায়ে এত ব্যাথা করছিল যে অ্যাক্লাইমেটাইজেশন ওয়াকে আর গেলাম না। জল খেয়ে লেপের ভেতর ঢুকে পড়লাম। সবাই সন্ধ্যেবেলা বনফায়ার করল। আমি আর লেপ থেকে বেরোলাম না। সন্ধ্যে সাতটাতেই ডিনার। খেয়ে আবার শয়ান। বাইরে খুব ঠান্ডা। পাথরের দেয়াল থাকায় আমাদের ঘরটা বেশ গরম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাই নি। ঘুম ভাঙলে দেখি সকাল। চা খেয়ে দিদনা গ্রামের কয়েকটা ছবি তুললাম। ব্রেকফার্স্ট খেয়েই হাঁটা শুরু হল। সঙ্গে লাঞ্চপ্যাক। আজকের গন্তব্য আলি বুগিয়াল (১১,৩১৯ ফুট )। অনেকটা পথ চলতে হবে ওয়াকিং স্টিক ঠকর ঠকর করে হাঁটা শুরু হল।
২৫/০৫/২০১৬
বেশ কিছুটা ওঠার পর একটা সমতল মাঠ এল। চারিদিকে ঘোড়া খচ্চরের বিষ্ঠা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বোঝা গেল ওটা পশুচারণের পথ। উঁচু-উঁচু গাছ। বার্চ, ওয়ালনাট, ম্যাপল। গাছ একেবারেই চিনি না। তবে চিনতে চেষ্টা করছি বললেও ভুল হবে।
অনেক উঁচুতে পাহাড়ের মাথায় গাছের সারি। অনেক… উঁচু। মদনজি বললেন, ওই পাহাড়ের মাথায় পৌঁছুতে হবে। পারব তো? জলটল খেয়ে হাঁটা শুরু হল। শুধু চড়াই আর চড়াই। হৃৎপিন্ড এসে গলার কাছটায় ধুকপুক করছে। বাচ্চা ছেলেরা তুরতুর করে উঠে যাচ্ছে। আমার অবস্থা খারাপ। বয়স যে হচ্ছে বুঝতে পারছি।
ছায়াঘেরা গাছের জঙ্গল। তিরতির জলের রেখার মুখে পাইপ বসানো। কামেশ বলল জল ভরে নিতে। আলির আগে আর জল পাওয়া যাবে না। টুংটাং আওয়াজ কানে এল। মিউল সাবরা আসছেন। আমরা সসম্মানে জায়গা ছেড়ে দিলাম। হেলতে দুলতে চলে গেল।
জঙ্গল আর মাটির রাস্তা দিয়ে অফুরান চড়াই। উঠছি তো উঠছিই। আমি আর সৌগত সবার পেছনে। সামনে আছে দীপক। ওর বড় হয়ে ওঠা গোয়ালদামে। তারপর ব্যাঙ্গালোরের রানার ক্লাবের মেম্বার। পা দুটো পাহাড়ি ছাগলের মত। গল্প করতে করতে হাঁটছে। যেন কিছুই হয় নি। বাড়ির বাগানে হাঁটছে।
অবশেষে চড়াই শেষ হল। সবাই সমতল মাঠের মত অপূর্ব সুন্দর একটা জায়গায় জিরোবার জন্য বসলাম। জল খেলাম। পার্ক খেলাম। আমাদের এই গ্রুপে ব্যাঙ্গালোরের সবাই সেলফি তুলতে সবসময় ব্যস্ত। মনের মত ব্যাকগ্রাউন্ড পেতেই সবাই সেলফি তুলতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়ল।
আকাশে একটা ঈগল অনেকটা নিচে দিয়ে উড়ছে। ক্লান্তিতে ছবি তোলার ইচ্ছেটাও যেন নষ্ট হয়ে গেছে। আবার জঙ্গলের পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বড় চড়াই শেষ। এবার ছোট চড়াই। তাও পায়ে জোর পাচ্ছি না। আস্তে-আস্তে চলছি।
খানিক বাদে আবার একটা সুন্দর বুগিয়ালে বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালাম। সামনে চওড়া খাদ। ওপারে অন্য পাহাড়। এই মাঠ পেরোলেই নাকি আলি বুগিয়াল। যাক প্রায় এসে গেছি। বুগিয়াল মানে ঘেসো মাঠ। যেখানে গাছপালা শেষ হয়ে যায়। আলিতে উঠে দেখলাম নিচে গাছের সারি শেষ হয়ে গেছে। এর ওপরে শুধু ঘাস, পাথর আর বরফ।
পান্ডেজি বলল, কোন কোন বছর আলি থেকেই বরফ শুরু হয়ে যায়। এ বছর বরফ পরে নি। বরফ না পড়তে পারে। তবে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা হাওয়া। হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আলিতে পৌঁছে প্রথম ত্রিশূলকে দেখতে পেলাম। বরফে ঢাকা চূড়া। যাকে বলে অভ্রখচিত। কিছুক্ষণ পরেই মেঘ এসে চূড়াকে ঢেকে দিল।
আলিতে বসে টিফিন প্যাক বের করে খাওয়া সারলাম। যা খিদে পেয়েছিল। শুকনো পরোটাকেই অমৃত বলে মনে হল। খাবার পর গায়ে বেশ জোর এল। আরো আধঘন্টা হাঁটার পরে আলিতে আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছলাম। আজ থেকে তাবু আর স্লিপিং ব্যাগে শোয়া। মাঠে টয়লেট করতে যেতে হবে। কষ্টকর জীবন শুরু হবে।
তাবুর ভেতরটা বেশ গরম। সায়ন্তনের শরীরটা বেশি ভাল নেই। একটু ডিসেন্ট্রি মত হচ্ছে। ও আমার সঙ্গী। আমার পায়ের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে গেছে। নড়তে চড়তেও ইচ্ছে হছে না। স্লিপিং ব্যাগের গরমে ঢুকে শরীরটা একটু তাজা হল।
আজ লাঞ্চ হবে না। বিকেল হয়ে গেছে। পকোরা, চা আর সুপ খেয়ে হাঁটতে বেরোন হল। উঁচু বুগিয়ালে উঠে সূর্যাস্ত দেখলাম। ভেড়াগুলো ফিরে আসছে। ঘোড়া খচ্চরেরা ফিরে আসছে। আমরাও ফিরে এলাম নিচে।
ঠান্ডা জাঁকিয়ে পড়েছে। আবার তাবুর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আমাদের পাশের দুটো তাবুতে পাঁচ-ছয়জন বাঙালি ছেলে এসেছে। সবাই মধ্যবয়স্ক। ওরা নিজেরা লোকাল গাইডদের মাধ্যমে বুকিং করে এসেছে। টেনে সিগারেট খাচ্ছে। বোতলে মালও এনেছে। জমিয়ে ট্রেকিং করছে। তবে আমাদের গ্রুপে মদ খাওয়া বারণ।
সন্ধ্যে সাতটায় ডিনার শেষ করে ঘুম। ট্রেকিং ব্যাগ পিছলে নেমে যাচ্ছে। কান দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। আটকানো যাচ্ছে না। বাইরে তেড়ে বৃষ্টি আর হাওয়া। গভীর হাওয়ার রাত। মনে হচ্ছে তাবুগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পনিগুলো ছুটতে ছুটতে তাবুর পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ভয় হল তাবুগুলো মাড়িয়ে দিয়ে না পালায়। বিপদ কিছু হল না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাই নি।
২৬/০৫/২০১৬
আজকে আমরা যাব পাথরনাচুনী। এর উচ্চতা প্রায় ১১,৮১৮ ফুট। দীপককে বলেছিলাম সকালে ডেকে দিতে। সূর্যোদয় দেখব। ছবি তুলব। দীপক মনে হয় রাতে ঘুমোয় না। আলো ফোটার আগেই ওর ডাক শুনতে পেলাম। স্লিপিং ব্যাগের মায়া কাটিয়ে ক্যামেরা কাঁধে আস্তে আস্তে তাবু থেকে বেরিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সূর্য উঠেছে পাহাড়ের পেছন থেকে। কালকে অতটা লক্ষ্য করি নি। পাহাড়ে আলোর খেলা সেরকম দেখতেই পেলাম না। ছবি তুলে মন ভরল না। বৃন্দা আরও সকাল থেকে DSLR নিয়ে বসে আছে। ও-ও একই রকম হতাশ।
ব্রেকফাস্ট করে হাঁটা শুরু করলাম। আলি বুগিয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। নিচে তাকিয়ে দেখছি গাছের সারি শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে সরু পাথুরে রাস্তা। খুব মৃদু চড়াই। তবু আমি সবার পেছনে খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। কি জানি কী হচ্ছে? এবার হাঁটাটা কিছুতেই জুত হচ্ছে না। আসার আগে একেবারেই ওয়ার্ক আউট করি নি। তার ফল এখন ভুগতে হচ্ছে। রূপকুন্ড খুব একটা সহজ ট্রেক নয়।
বেশ খানিকটা হাঁটার পর বেদিনী বুগিয়ালে পৌঁছলাম। বেদিনীতে ইন্ডিয়া হাইকস তাবু পেতেছে। হালকা কমলা রঙের তাঁবু। বেদিনীটা খুব সুন্দর। সামনেটা ফাঁকা। আপসোস হল এখানে থাকা হল না বলে।
বেদিনীকুন্ড দেখতে পাচ্ছি। কুন্ডে কোন জল নেই। পান্ডেজি বলল, প্রতিবছর কুন্ডে জল থাকে। এ বছরই শুকনো। কতটা সত্যি সন্দেহ আছে। কারণ আমি বেদিনীকুন্ডের যেসব ছবি দেখেছি তাতে কোথাও জল দেখি নি।
কিছু ছবি তুলে আবার হাঁটা শুরু হল। বেশ খানিকটা হাঁটার পর ঘোড়া লোটানি এল। পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পার হলাম। আর দু কিমি হাঁটলেই পাথর নাচুনি। রূপকুন্ডের সমস্ত রাস্তা জুড়েই মিথ আর উপকথা ছড়িয়ে আছে। আমাদের পথে যেতে যেতে বিশ্রামের সময় মদনজি সেসব গল্প করেন।
গনেশজি কৈলু বিনায়কে ব্যাসদেবের মুখনিঃসৃত বাণী থেকেই চতুর্বেদ রচনা করেন। বেদ থেকেই এই জায়গার নাম হয়েছে বেদনী। সারা পথ জুড়েই পার্বতীর শ্বশুরবাড়ি যাবার গল্প। সত্যযুগে মা দক্ষরাজার ঘরে সতী নামে জন্মগ্রহণ করেন। সতী পরমেশ্বরকে নিজের পতি বলে স্বীকার করায় দক্ষ সতীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পারিবারিক মহাযজ্ঞের আয়োজন করে দক্ষরাজ পরমেশ্বরকে আমন্ত্রণ না করায় রাগে, অপমানে, লজ্জায় সতী দেহত্যাগ করেন।
ত্রেতা যুগে পরমেশ্বরী এসেছিলেন জনকের ঘরে। তার নাম ছিল জানকী। দ্বাপরে মা আসেন হিমালয়রাজের ঘরে। বাবা মায়ের আদরের কন্যা ‘উমা’ শঙ্করভগবানকে পতিরূপে বরণ করেন ও কৈলাসে গমন করেন।
কলিযুগে মা পার্বতী টেহরীরাজের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম হয় নন্দা। রাজা স্বপ্নে আগেই সে খবর পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্বপ্নে নিজের মেয়েকে ভেড়ার পিঠে চাপিয়ে যথার্থ মর্যাদায় শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর আদেশ পান।
দৈববাণীর কথা কুমায়ুন ও গাড়োয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। রাজা কিছুতেই তার আদরের নন্দাকে ত্রিশুলি পাহাড়ে পাঠাতে রাজি হচ্ছিলেন না। ক্রমে মারী ও মড়কে দেশ ছেয়ে যায়। অবশেষে প্রজাদের কথা ভেবে রাজা রাজি হন। সমগ্র কুমায়ুন ও গাড়োয়ালে চার শিং ওয়ালা ভেড়ার সন্ধান চালানো হয়। ভেড়া মিলেও যায়। তারপর ভেড়ার পিঠে চাপিয়ে রাজা চোখের জলে মেয়েকে বিদায় দেন। ভেড়া ক্রমে চোখের আড়ালে চলে যায়। এই বেদনাময় ঘটনাকে স্মরণ করে কুমায়ুন ও গাড়োয়ালবাসি ঐ দিনটিকে স্মরণ করেন। ঐ অনুষ্ঠান ‘নন্দাজাত’ নামে খ্যাত।
পার্বতীদেবীর এই যাত্রাপথ ধরেই আমাদের রূপকুন্ড যাবার পথ। ত্রিশূল পর্বতের তিনটি চূড়া ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে বোঝায়। ঐ ত্রিশূল পর্বত মায়ের শ্বশুরবাড়ি। যাত্রাপথে মা তার ঘোড়াগুলোকে এইখান থেকেই ফিরিয়ে দেন। তাই তার নাম হয় ‘ঘোড়ালোটানি’। এর ডানদিকে গভীর গিরিখাত নীচের দিকে নেমে গেছে। গিরিখাত সবুজ ঘাসে ঢাকা। নীচে কয়েকটি তাবু দেখা যাচ্ছে। ওখানে কুমায়ুনের স্থানীয় লোকেরা থাকে। ওরা সারাদিন জরিবুটি সংগ্রহ করে।
স্থানীয়রা মূলত পাহাড়ের গায়ে বিশেষ এক ধরনের পোকার সন্ধান করে। পোকাগুলো প্রচুর টাকা দিয়ে চীনারা কিনে নিয়ে যায়। ওরা ওগুলো দিয়ে ভেষজ ওষুধ তৈরি করে। জরিবুটি সংগ্রহকারীরা এই প্রচন্ড ঠান্ডায় বিপদসঙ্কুল পরিবেশে তাবু খাটিয়ে দিনের পর দিন থাকে।
মেঘের একটা দঙ্গল এসে গিরিখাতকে ঢেকে দিল। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। সম্বিৎ ফিরল। পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। খানিকটা উঠে এবার নেমে আসা। বেশ কিছুটা নীচে নামার পর আমাদের নীল তাবু দেখা গেল। বুঝলাম পাথর নাচুনী এসে গেছে। তাবুর মধ্যে ঢুকে আমি সোজা স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে। বাইরে অনেকে ক্রিকেট খেলতে শুরু করল চিকেন স্টাফ ও পোর্টারদের সাথে। প্রায় ১২০০০ ফুট উচ্চতায় ক্রিকেট ম্যাচ। ভাবা যায়?
বিকেলে স্যুপ খেতে গিয়ে দেখলাম যারা আজ সকালে রূপকুন্ড করে এসেছে তাদের সাথে আমাদের দলের ছেলেরা বিরাট উৎসাহ নিয়ে গল্প করছে। অর্থাৎ আমরা এখন দুটো গ্রুপ। আমরা হলাম ‘রূপকুন্ড যানে বালো’ আর ওরা ‘সামিটবালো’ টিম। ঠান্ডায় হাড় পর্যন্ত কেঁপে যাচ্ছে। তারপর চারিদিক স্যাঁতস্যাঁতে আধো অন্ধকারে ঢাকা। একটু পরপর বৃষ্টি হচ্ছে বলে তাবুর বাইরেটা পেছল। পা টিপে টিপে চলতে হচ্ছে।
অ্যাক্লাইমেটাইজেশান ওয়াকে ওপরে ম্যাগি পয়েন্টে গেলাম। স্থানীয় ছেলেটা দারুন ম্যাগি বানায়। বেশ কয়েক রকম মশলা ব্যবহার করছে। রেসিপিটা অসাধারণ সন্দেহ নেই। সাথে ডবল ডিমের অমলেট। সৌগত এগিটারিয়ান। ডিম দেখলে ওর মাথার ঠিক থাকে না। ম্যাগি পয়েন্টের ওপরে একটা জায়গায় টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে। সবাই বাড়িতে ফোন করছে। আমিও সায়ন্তনের মোবাইল থেকে বউকে ফোন করে নিলাম।
বৃষ্টি থামলে নীচে নামা শুরু করলাম। পাথর পিছল হয়ে গেছে। সাবধানে নেমে এলাম। টেন্টে ফিরে এসে পালস অক্সিমিটার দিয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা চেক করা হল। আমার ৮৩-৮৪% দেখাচ্ছে। পাহাড়ে কিছুটা কম তো হবেই। সত্তরের নীচে থাকলে ওরা আর ওপরে নিয়ে যাবে না। এখান থেকেই বমাল অবতরণ।
রাতে প্রায় কিছুই খেলাম না। খাবার ইচ্ছেটাই নেই। মেজাজটাও বিগড়ে যাচ্ছে। নিজেকে প্রতিনিয়ত গালাগালি করছি, কেন মরতে এত কষ্টের মধ্যে এলাম। এবারই আমার শেষ। আর কোনোদিন আসব না। এটাই সম্ভবত মাউন্টেন সিকনেস। তাও ভাল সবার প্রথমে আমার মেজাজটা বিগড়েছে। অন্য কিছু বিগড়ালে আরও খারাপ হত।
রাতে ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়লেও স্লিপিং ব্যাগের ভেতর আস্তে আস্তে ঘুম এসে গেল। সারা রাতই ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ঘুম হল। কতবার যে ঘুম ভাঙ্গে তার কোন ঠিক নেই। আর নানা রকম স্বপ্ন। অনেকদিন হয়ে গেল। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে।
২৭/০৫/২০১৬
আজ আমরা পাথর নাচুনী থেকে বগুয়াবাসা(১৪,১৮৯ ফুট) যাব। সকালবেলায় আবহাওয়া খুব ভাল। রাতে বৃষ্টি হলেও এখন চারিদিকে সুন্দর রোদ উঠেছে। রোদ ওঠায় ঠান্ডাটা অনেকটা কম। সকালবেলায় দূরে পাহাড়ের ওপর টিসু পেপার নিয়ে সবচেয়ে কঠিন কাজটা করে এসে রওনা দেবার জন্য তৈরি হলাম। আজকে আমরা একটু দেরি করে বের হব।
ওয়াকিটকিতে খবর চালাচালি হয়। কালকের গ্রুপের সাথে বগুয়াবাসাতে যেন আমাদের মোলাকাত না হয়। ওরা রূপকুন্ড ঘুরে বগুয়াবাসাতে বিশ্রাম নিয়ে নীচে রওনা দেবার পর আমরা বগুয়াবাসাতে পৌঁছাব।
আজকে টানা চড়াই। দূর থেকে পথটা দেখা যাচ্ছে। খাড়া উঠে গেছে ওপরে। চার কিমি রাস্তা। তবে উঠতে হবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট। বোঝাই যাচ্ছে কতটা খাড়াই। ওঠা শুরু হল। আর বেলা বাড়তেই আবহাওয়া একটু-একটু করে খারাপ হতে শুরু হল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। জরিবুটি সংগ্রহ করছে এমন একজনের সাথে দেখা হল। ঝোলা থেকে পোকাটা বের করে দেখাল। মরে যাওয়া পোকা অথবা পোকার লার্ভা। এটা যেমন মূল্যবান তেমনি নাকি ভেষজ গুনসম্পন্ন। হিমালয়ের এই উচ্চতাতেই এগুলো পাওয়া যায়। এই মানুষগুলো সারাদিন ধরে এগুলো খুঁজে বেরাচ্ছে। পোকাগুলো খুব দামি হতে পারে, তবে লোকগুলোর গায়ে শতচ্ছিন্ন জ্যাকেট। লভ্যাংশের প্রায় কিছুই ওদের কাছে পৌঁছয় না।
বেশ খানিকটা ওঠার পর কৈলু বিনায়কে পৌঁছলাম। তার আগে তিনটি বড় বড় গর্তের কাছে বসিয়ে মদনজি আমাদের মিথকথা শোনালেন। পার্বতী যখন এই পথ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলেছেন তখন তিনজন অপ্সরা তার মনোরঞ্জনের জন্য এখানে নাচ করতে থাকে। কিন্তু তাদের নাচে দেবী খুশি তো হলেনই না উপরন্তু এইরকম নির্জন স্থানের নির্জনতা ভঙ্গ করার জন্য তাদের পাতালে পাঠালেন। সেই থেকেই এখানে পাশাপাশি তিনটি গর্ত। যদিও স্থানীয়রা অনেকসময় মায়ের এতখানি নির্দয় হবার গল্পে বিশ্বাস করে না।
সে যাই হোক না কেন দীর্ঘদিন ধরে এই পান্ডববর্জিত জায়গায় তিনটি বড় বড় গর্ত দেখে স্বাভাবিকভাবেই লোকের মনে মিথের জন্ম হয়। আমাদের চারজনের মধ্যে সৌগত সবচেয়ে বেশি আস্তিক হলে অনির্বাণ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নাস্তিক। আমি নিজে পেন্ডুলামের মত দুদিকে দোল খাই। তবে স্বীকার করতে কষ্ট নেই যে এই নিরিবিলি মনোরম যায়গায় মিথ, উপকথা কোনোকিছুকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না।
কৈলু বিনায়কে ব্যাসদেবের বাণী শুনে গনেশজি মহাভারত লিপিবদ্ধ করেন। সেই থেকেই এখানে পাথর সাজিয়ে বিনায়কের মন্দির। জুতো খুলে সবাই প্রণাম করল। দক্ষিণা দিল। আমি সেই দলে নেই। দূরে ত্রিশূলকে মেঘে ঢেকে যেতে দেখছিলাম।
কৈলুতে প্রচন্ড ঠান্ডা। হু-হু করে হিমেল হাওয়া বইছে। হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দূরে ত্রিশূল আর নন্দাঘুন্টির ওপর থেকে মেঘ একবার সরে আসছে আবার ঢেকে দিচ্ছে। নীচে বগুয়াবাসা দেখা যাচ্ছে। দেবী এখান থেকে তার সঙ্গী বগুয়া বা বাঘকেও ফিরিয়ে দেন। তাই এই জায়গার নাম বগুয়াবাসা।
নীচের দিকে নামা শুরু হলে ফিরতি পথের সামিট টিমের সাথে শুভেচ্ছাবিনিময় হল। একটি মেয়ে চতুর্দোলায় ফিরছে। হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাস্তাটা পুরোটাই পাথুরে সাথে খুব কাঁদা। বগুয়াবাসা পৌঁছে দেখলাম গনগনে রোদ। সবাই বাইরে বের হয়ে গল্প করছে। একজন কেরালিয়ান মহিলা হাঁটুর প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েও আমাদের সাথে চলেছেন। উনি পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। প্রতি বছর গরমের ছুটিতে ট্রেকিং-এ আসেন। উনি নিজেও জানেন কাল রূপকুন্ড দর্শন ওনার হবে না। তবু এতটা প্তহ আমাদের সাথে হেঁটে এসেছেন। ওই পিছল বরফের রাস্তায় হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। ওনার নিজের কাছে তো বটেই। অন্যদের কাছেও।
কালকে ক্র্যাম্পন পরে উঠতে হবে। খাবার পর সবাইকে ক্র্যাম্পন দেওয়া হল। জুতোর নিচে পরে দেখে নিলাম। রূপকুন্ডের দিন আমাদের গাইডরা আলাদা। ওরা সবাই ছোটখাট পর্বতারোহনের কোর্স করা গাইড। সঙ্গে প্রাক্তন আর্মির কিছু সেনাও আছেন। ওরাই আমাদের কালকে নিয়ে যাবেন।
বিকেল থেকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু হল। রাতে খাবার পর শুরু হল প্রচন্ড তুষারপাত। তাবুর ভেতর থেকে হাত দিয়ে তুষার ঝেড়ে চলেছি। না হয় তাঁবু বেঁকে যাবে। হাতে ঘুমের জন্য কয়েক ঘন্টা মাত্র বাকি। তারপর সারারাত তাঁবু ঝাড়া। চরম বিরক্তিতে বমি বমি পাচ্ছে। স্লিপিং ব্যাগের নিচে শক্ত পাথর। পিঠে ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে ঠান্ডা তো আছেই। মনে হচ্ছে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরই জমে যাব। মেজাজ বিগড়ানি থেকেই বুঝতে পারছি প্রচন্ড রকম এ.এম.এস.-এ আক্রান্ত হয়েছি। মনে মনে একদম ঠিক করে ফেললাম এবারই শেষ আর কোনোদিন ট্রেকে আসব না।
২৮/০৫/২০১৬
সারাটা রাত প্রচন্ড অস্থিরতার মধ্যে কাটল। চোদ্দ হাজার ফিটে রাত্রিবাস যে সাধারণ নয় তা সেদিনই বুঝতে পারলাম। বিশেষ করে প্রথম দিন। প্রচন্ড ঠান্ডায়। তাবুর উপর একটানা তুষারপাত। আর পাথরের ওপর ম্যাট্রেস। তাছাড়া উচ্চতাজনীত কষ্ট তো আছেই।
চারটেতে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ঘুম ভেঙ্গে গেল তার আগেই। ঘুম আদৌ হয়েছিল কিনা সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। অজস্র ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বপ্নে মাথাটা ধরে আছে। বাইরে বের হলাম। আকাশ পরিচ্ছন্ন। চাঁদের আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। তাবুগুলো নুইয়ে আছে বরফে। চারদিক বরফে সাদা। এক অপার্থিব দৃশ্য। পাথরের জমি বরফ আর কাঁদায় পেছল। পা পিছলে গেলে অবধারিত কিছু একটা ভাঙবে। পা টিপে-টিপে টয়লেট টেন্টের দিকে গেলাম। ওটাও ভাঙ্গব ভাঙ্গব করছে। সুবাসে ভেতরটা আমোদিত। কোনমতে কাজ করে বেড়িয়ে এলাম।
সকালে চা খেয়ে ক্র্যাম্পন পরে সবাই তৈরি। ঠিক সাড়ে চারটেতে বের হলাম। মাথায় হেড টর্চ। আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু হল। উঠছি তো উঠছিই। বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটা সহজ নয়। ক্র্যাম্পনে বরফ আটকে যায়। লাঠি দিয়ে ঝেড়ে আবার এগোতে হয়। সরু রাস্তা। পাশাপাশি দুজন যাওয়া সম্ভব নয়। একজন দাঁড়িয়ে পড়লে পেছনের সবাই আটকে পড়বে। তাই দাঁড়ানোর উপায় নেই।
অনেকটা হেঁটে এসছি। কিছুক্ষণ পরে দিকচক্রবাল রঙ্গিন হতে শুরু হল। উপরে দেখা যাচ্ছে রূপকুন্ড। অনেকটা উপরে। শারীরিক সহনশীলতার প্রায় চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। পাশে এক অল্পবয়স্ক গাইড আজেবাজে হিন্দি গান চালিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত করছে। ওকে এমন ধমক লাগালাম যে নিজেই অবাক হয়ে গেছি। সেও মোবাইল বন্ধ করে দিল বাধ্য ছেলের মত। অবশেষে রূপকুন্ডে পৌঁছলাম। কুন্ডটা বরফে ঢাকা। নিচে নেমে যাওয়া বারণ। পাশে কিছু হাড়গোড় পড়ে আছে। এই রূপকুন্ডের জলেই দেবী নন্দা প্রতিবছর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সাজগোজ করে শ্বশুরবাড়ি যান। তাই প্রায় ষোলো হাজার ফুট উচ্চতায় এই কুন্ড হিন্দুদের কাছে খুব পবিত্র।
হাড়গোড় নিয়েও অনেক উপকথা আছে। তবে এখন প্রমাণিত হয়েছে তীর্থযাত্রীদের ওপর হঠাৎ করে ধস নেমে আসাতেই তাদের মৃত্যু হয়। তীর্থযাত্রীরা প্রায় সকলেই কুমায়ুন ও গাড়োয়ালেরই লোক ছিল। বাটিতে করে গরম দালিয়ার পায়েস দেওয়া হল। এই জিনিসটা বেশি খেতে পারি না। তবু খেলাম। বাঁচতে হলে খেতে হবে। উপরে জুনারগলি পাস দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে ত্রিশূলের দারুন ছবি পাওয়া যায়। রাস্তা বরফে ঢাকা আর খাড়া চড়াই। ওরা নিয়ে যাবে না। আমাদেরও আর যাবার ক্ষমতা নেই।
আধঘন্টা পরে নামা শুরু হল। নটা বাজে। রোদে বরফ গলছে। পেছল বরফের ওপর দিয়ে নামা সহজ কাজ নয়। গতি কমে আসছে। বগুয়াবাসা পৌঁছলাম প্রায় বেলা দেড়টায়। প্রচন্ড মাথাব্যাথা শুরু হল। এরকম মাথাব্যাথা আমার সারা জীবনে কোনোদিন হয় নি। ক্যালপল খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরে কমল।
বাইরে আবহাওয়া খুব খারাপ। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাল আর আজ আবহাওয়ার কত পার্থক্য। বিষণ্ণতা চেপে ধরছে। আজ যারা আসছে তাদের জন্য খারাপ লাগছে। অত্যন্ত বাজে পরিবেশে ওদের থাকতে হবে। রওনা দেবার পর তরতর করে নেমে ম্যাগি পয়েন্টে পৌঁছলাম। ম্যাগি অমলেট খেয়ে আবার তাঁবুতে। কালকে পনের কিমি নেমে আবার সভ্যজগতে পৌঁছাব। পথে নীলগঙ্গা পড়বে। পাহাড়ি নদীতে স্নান করতে হবে।
২৯/০৫/২০১৬
আজকে ফেরার দিন। পনের কিমি নামতে হবে একদিনে। সকাল থেকেই মেজাজটা ফুরফুরে। AMS কোথায় উধাও। পরেরবার কোথায় যাব সেই ভাবনাচিন্তা করছি। পাতর নাচুনীকে পেছনে ফেলে হাঁটা শুরু করলাম। আজ বেদীনি হয়ে নামব। খুব তাড়াতাড়ি বেদীনিতে পৌঁছলাম। অনেকক্ষণ ছবিটবি তুলে আবার নামা শুরু হল। বেদীনিকুন্ডের পাশে ভেড়ার পালের সাথে ছবি তুললাম। এবার ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রায় পাতাল প্রবেশের পথ। হুড়মুড় করে নেমে একটা ছোট্ট গ্রামে এলাম। গ্রাম বললে ভুল হবে। একটু সমতল যায়গা। ইন্ডিয়া হাইকসের তাঁবু পাতা। একটা বড় ঘর। চকোলেট, ম্যাগি পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে নীচে নামলাম।
এত তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে পায়ের মাংশপেশিতে টান ধরে যাচ্ছে। অবশেষে নীলগঙ্গা পৌঁছলাম। বরফঠান্ডা জল। কিন্তু স্নান তো আমি করবই। আড়ালে গিয়ে কোমর ডুবিয়ে স্নান করলাম। গত পাঁচদিনের স্নান না করার গ্লানি অনেকটা কমল। রুকস্যাক থেকে জামাকাপড় বের করে রোদে দিলাম। ভেজা গামছা, জাঙ্গিয়া শুকিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। বেশ কিছুটা উঠে ওয়ান গ্রাম। ছবির মত সুন্দর। চারপাশের জমিতে ধাপচাষ করে শষ্য লাগানো হয়েছে। গ্রামের লোকেরা জমিতে কাজ করছে। পথে ছোট বাচ্চাদের চকোলেট বিস্কুট দিলাম।
ওয়ান থেকে অনেকটা নেমে এসে গাড়ি ধরা। গাড়ি লোহাজঙ পৌঁছে দিল। রাতে সবাই মিলে অনেক আনন্দফূর্তি হল। কাল সকালে আবার বেরোতে হবে। দশ ঘন্টার সওয়ারি। রূপকুন্ড শেষ হল। এবার পরের বারের পালা।