রাহুল পুরকায়স্থ

রাহুল পুরকায়স্থ’র সঙ্গে আলাপবিস্তার

( এটি কোন প্রথামাফিক সাক্ষাৎকার নয়। একদিন এক বিরামহীন আড্ডায় রাহুল পুরকায়স্থের সঙ্গে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরের শাখা প্রশাখায় আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। শুধু কবিতার শর্তে। দীর্ঘতম সেই আড্ডার এটি ১ম পর্ব। )

 

রাহুল পুরকায়স্থঃ  ক’দিন আগে একটা মজার কাজ করেছিলাম, বুঝলি, শক্তিদার একটা লেখা নিয়ে। লেখাটা কার, ২৩ জনকে আমি ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শুধুমাত্র সুবোধ সরকার বললেন যে এটা শক্তি হলেও হতে পারে। সেখানে নামকরা সব তরুণ  কবি, অধ্যাপক, পাঠক আবৃত্তিকাররা ছিলেন। শক্তিদা’র আমরা ‘তোমায় পড়লো মনে’ এই সমস্তই পড়ি। পুরো শক্তিকে পড়ি না। এইসব লেখা কোথাও পাঠ্যও না। পড়া দরকার। একজায়গায় দেখছিলাম কী ইন্টারেস্টিং হাটের বর্ণনা দিচ্ছেনঃ

চাতালে বসেছে হাট, দেখে মনে হবে

শর্করামন্ডের টানে ছুটেছে মানুষ সারিবদ্ধ পিঁপড়ের মতন

বাগানের বল্মীকস্তুপ ভেঙে ভেঙে ছুটেছে বাল্মিকী

হাটে যাবে, সপ্তাহের হাট

ছদিনের ধান ভেঙে চাল করা আলোর মতো এই হাট

ছদিনের ধান ভেঙে কায়ক্লেশে ভাতের মতন এই হাট

বন্দীর জানলার মতো হাতছানিময়, খোলা খাঁচা নিয়ে পাখি যেমন বিমূঢ়

মানুষও বিমূঢ় হয় ছ ছদিন ভেবে, অতটুকু মুক্তি পেলে কীভাবে সামলাবে

একসময় সন্ধ্যা নেমে আসে, মাদলের স্খলিত কাঠি প্রতিধ্বনি তোলে আকাশে বাতাসে

……………

কী বর্ণনা! মানুষের হাটের সঙ্গে তার ক্ষুধা…

অনিমিখ পাত্রঃ  হ্যাঁ, ছ’দিনের পরে ওই যে মুক্তি …

রাহুলঃ  এই হলো বহড়ুর শক্তি। গ্রামের মানুষ একদম।

আমার জীবনে শক্তিদার একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে,জানিস তো! তখন বেলঘরিয়ার ওইদিকে একটা বাড়িতে থাকতাম। বাবা সবে মারা গেছেন। ভাঙা দরজা ছিল, একদিন সকালে দরজা খুলে দেখি শক্তিদা। পেছনে একটা ছেলে, আমার ক্লাসমেট ছিল, অটো চালায় – তার দু’হাতে দুটো নারকেল। শক্তিদা বললেন, ‘রাহুল কে?’ আমি বললাম, ‘আমি’। শক্তিদাঃ ‘ধ্যুস!’ ‘হ্যাঁ, আমিই’। ছেলেটা তখন বললো, ‘হ্যাঁ, ওইই তো রাহুল’। সে বললো, ‘আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়’। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, চিনি তো!’ বললেন, ‘ভিতরে বসতে বললে না?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আসুন’। তখন ছোট্ট একটা ঘর ছিল, বাইরে একটা তক্তপোষ ছিল। সেখানে বসেন। মা আসে, তাকে প্রণাম করেন। মা’কে একটা নারকেল দেন। বলেন, ‘এটা আপনার জন্য’। তারপর মা চা করে দেয়, চা খান। তারপরে বলেন যে, ‘আমি একটু রাহুলকে নিয়ে বেরোই।‘ তখন আমি মদ-টদ খাই না। অটো করে যশোর রোড এসে বাসে করে আমরা গেলাম লেহেঙ্গাবাগানের উল্টোদিকে। ওখানে একটা দোকানে ঢুকে বললেন যে, ‘রসিক, দে!’ রসিক বাংলা বের করলো। আমি কোল্ড ড্রিংক খেলাম আর মুর্গী খেলাম। উনি প্রায় দু’বোতল বাংলা খেলেন। দুপুর দেড়টা দুটো হবে, একটু টলছেন। রাস্তা পার হয়ে একটা গলিতে ঢুকে একটা বাড়ি দেখালেন। বললেন, ‘ এই বাড়িতে আমি মা’র সঙ্গে থাকতাম’। মা ব্যাপারটা শক্তির খুব ভয়ঙ্কররকম… দেখা হ’লেই আমার মা’র কথা জিজ্ঞেস করতেন, ‘মাসিমা কেমন আছেন?’ মা ওঁর কাছে একটা বিরাট ব্যাপার। চোখে জল চলে এসেছিল, দেখাচ্ছেন, ওই যে বাড়িটা… মায়ের সঙ্গে থাকতাম।

তো, যেটা বলছিলাম, জানো, ভালো করে বাছলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও একটা ভালো চারফর্মার কবিতার বই হতে পারে। হয়তো সেভাবে আমরা পড়িইনি কোনোদিন। এইগুলো কেউ যদি করতে পারতেন!

এখন যারা লিখতে আসেন অনেকে অরুণ মিত্রের নাম জানেন না। উনি তো এই সেদিনের।

সঙ্ঘমিত্রা হালদারঃ   অমিয় চক্রবর্তীও … অরুণকুমার সরকার …

রাহুলঃ   অরুণকুমার সরকার তো খুব রোমান্টিক এবং ওঁর মধ্যে জনপ্রিয়তার সমস্ত উপাদান ছিল। ফলে, আমাদের লেখাও কেউ পড়বে না।

অনিমিখঃ   হুম। সমসময়ে আমরা ভাবি যে আমরা হয়তো চিরকাল থেকে যাবো! তা তো নয়!

রাহুলঃ   দ্বিতীয় কথা, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমার সমসময়ের কবি মনে হয়। দশ বছরের তো না, এটা একটা একশো বছরের স্প্যান। ফলে, আমরা সমসময়ের লেখাই পড়ছি না।

অনিমিখঃ  মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন না যে, ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে তোমার বইকে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করো। যদি তার মধ্যে সত্যিই কিছু থেকে থাকে তো লোকে খুঁজে নিয়ে পড়বে। কিন্তু সেটাও বা কতটা সত্যি? আমরা কতো বছরের পুরনো লেখা এমন পড়ি?

রাহুলঃ  আসলে আমরা খুঁজি না। আমাকে একজন বই পাঠালো ‘এক রহস্যময়ীর গুপ্তকথা’। আগেকার দিনে গুপ্তকথাগুলি লোককে খুব টানতো…

সঙ্ঘমিত্রাঃ  এটা একটা বিশেষ ঘরাণার …

রাহুলঃ  হ্যাঁ, তো বইটা আমি পেলাম, আমি কিন্তু খুঁজিনি। পড়তে গিয়ে দেখলাম, আমি আটকা পড়ে গেছি। তার ভাষা তার এক্সপ্রেশন! প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বলে একজন, তিনি একটু বেশি পরিচিত, তিনি ‘দারোগার দপ্তর’ বলে একটি পত্রিকা করতেন। প্রত্যেক মাসে বেরোতো, তার পত্রিকাতে একটাই উপন্যাস। একটা উপন্যাসের নাম ধরো ‘দীর্ঘকেশী’। তার তলায় লেখা হতো ‘অর্থাৎ দীর্ঘকেশযুক্ত মহিলাদের বিভ্রান্তির কারণ’। এইরকম আর কী! আজ থেকে ধরো দেড়শো বছর আগে লেখা কোনো উপন্যাস, কিন্তু সেখানে পাঠক একটা চরিত্র – ‘পাঠক, আপনার মনে আছে তো সেই হরিদাসীর কথা আমি আগে লিখিয়াছি? সেই হরিদাসীকেই এখন আমি ওইখানে দেখিতেছি’। এই পাঠককে সাব্যস্ত করা তো এখন উত্তরাধুনিক চর্চার একটা অন্যতম মূল বিষয়।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  আমরা বঙ্কিম-এও পাই এই পাঠক’কে সম্বোধন করে লেখার ব্যাপারটা। এবং আর একটা মজার ব্যাপার হ’ল, বঙ্কিম অনেকসময় পাঠকের রুচি ইত্যদির উপর ভিত্তি করে…

রাহুলঃ  আমাদের বাংলা উপন্যাসের বা প্রাচীন গদ্যসাহিত্যের একটা অন্যতম বিষয় ছিল নীতিজ্ঞান বিতরণ করা। নীতিশিক্ষামূলক লেখালিখি। কবিতার ক্ষেত্রে তো আমার খুবই মনে হয় যে একজন কবি যদি সামাজিক বিবেক হন তো খুবই সমস্যা! রবীন্দ্রনাথকেও তো সামাজিক বিবেকের জোব্বা টা পরানো হয়েছিল।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  বরং গানে উনি অনেক বেশি নিজের কথাটা বলতে পেরেছেন। বা কিছু প্রবন্ধে।

রাহুলঃ  হ্যাঁ, ওখানে তো উনি নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। ওর প্রবন্ধ আছে অনেক … নীতিশিক্ষামূলক। এই জোব্বাটা খুব চাপের বিষয় কিন্তু। ফলে বারবার বলি যে, কবিতার তো জন্ম হয় একটা শূন্যতা থেকে। শেষ হয় গিয়ে একটা অর্থহীনতায়। কিন্তু ওই ধরণের লেখায় সেই অবকাশটা আর পাওয়া যায় না। আমাকে সবসময় একটা মেসেজ দিতে হবে…ধরো, উন্নয়নমূলক, শুভবুদ্ধি জাগ্রত করবে… এই জাতীয়। তাহলে তো বক্তৃতা লিখলেই হয়!

অনিমিখঃ  পরবর্তীকালে তথাকথিত ‘প্রতিবাদী কবিতা’ ধারাটাও সেই ট্রাডিশনই বহন করেছে?

রাহুলঃ  অনেকসময় করেওনি। ধরো, বাংলায় এরকম প্রতিবাদী এবং প্রেমের কবিতা কম আছে – বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চারলাইনের একটা কবিতা –

একটি মেয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে যন্ত্রণায়

বিবর্ণ তার নয়ন দুটি, কিন্তু বড়ো মিঠে

একটি ছেলে জানে না তাই অঘোর নিদ্রা যায়

জানলে পরে থাকতো এখন পঙ্খীরাজের পিঠে

সঙ্ঘমিত্রাঃ  অসাধারণ !

রাহুলঃ  এই প্রতিবাদের কিন্তু ‘বিবেক’ নেই। ‘বিবেক’ তো যাত্রাপালায় থাকে—জাগো গো ভগিনী…  এই যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘প্রভাস’ নামে একটা কবিতা লিখেছেন সেখানে কিন্তু ‘জাগো গো ভগিনী’ নেই। তখন কমিউনিস্ট পার্টি বলে একটা বেদম পার্টি ছিল। তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রকাশ্যে ছিল আরও। বীরেন্দ্র লিখছেন – মহাভারতের যদুবংশ যখন ধ্বংস হচ্ছে – শেষ লাইনগুলো এরকম –

তোমরা ফিরে যাও, কোথায় দ্বারকায় নারীর দেহমদে পশুরা লুব্ধ

কোথায় শিশুকেও জ্যান্ত ছিঁড়ে খায় আহত নেকড়েরা এমনই যুদ্ধ

কী হবে ঘুম থেকে সে দেশে হেঁটে এলে

সুদর্শন আমি দিয়েছি ছুঁড়ে ফেলে

এখানে এই ঘাসে হৃদয় ঢেকে নিয়ে

ঘুচাব দ্বন্দ্বের জয়ের ক্লান্তি

বলো না কথা পাখি, আস্তে ঝরো ফুল

ঘুমের রাত আসে শান্তি শান্তি

 

  • এই যে ‘জয়ের ক্লান্তি’, এইখান থেকে একটা দর্শন তৈরি হচ্ছে।

অনিমিখঃ  যে নির্ভার ভাষাটা ব্যবহার করছেন… জয়ের ক্লান্তি…তারপরে ওই যে ‘আস্তে ঝরো ফুল’ …

রাহুলঃ  এবং তুমি লক্ষ্য করো এর মধ্যে কোথাও নীতিজ্ঞান ব্যাপারটা নেই। আমাদের পরবর্তী কবিতা আস্তে আস্তে ডাইলুট হয়ে গেল তো … এখন প্রতিবাদী কবিতা পড়লে হাসি পায়!

সঙ্ঘমিত্রাঃ  তাতে কি সবসময় কবিতা থাকে?

রাহুলঃ  কবিতা থাকে না। মিথ্যাচার থাকে। নন্দীগ্রামের সময় সিপিএম যা করেছে আমি তাকে সমর্থন করি না। কিন্তু নন্দীগ্রামপন্থীরা যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, যাদের বই বেরিয়েছিল… পা ছিঁড়ে নেওয়া হলো হাত ছিঁড়ে নেওয়া হলো… মিথ্যে কথা ! আবৃত্তিকারেরা মঞ্চে গলা কাঁপিয়ে করে হাততালি পেয়েছেন। সব মিথ্যা। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে। তার চেয়েও বড়ো কথা, এই যে প্রতিনিয়ত খেতে পাওয়া-না-পাওয়ার একটা আন্দোলন – তার সঙ্গে তাদের কোথাও কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তাদের হচ্ছে ইস্যুভিত্তিক বিবেক।

অনিমিখঃ  এইখানে একটা কথা বলি। তখন আমরা অ্যাকটিভ ছিলাম এ ব্যাপারে। স্বাক্ষরসংগ্রহ বা ওইধরণের একটা কাজ করছিলাম। মনে আছে। তখন কফি হাউসে শম্ভু রক্ষিত নিয়মিত আসতেন, এখন আর বয়সের কারণে আসতে পারেন না। শম্ভুদার সঙ্গে আমার খুব ভালো পরিচয় ছিল। শম্ভুদাকে গিয়ে সঙ্ঘমিত্রা বলেছে, উনি খুব তীব্র রিয়াক্ট করেছেন। ‘ তুমি জানো, ধান থেকে কীভাবে চাল হয়?’

রাহুলঃ  এই সই সংগ্রহ হচ্ছে বাঙালীর আরেকটা বুজরুকি। বিপুল চক্রবর্তী’র একটা ছড়া আছে – ‘আমরা হই হই করেছি / এই করেছি ওই করেছি/  প্রতিবাদের পদ্য নিয়ে মস্ত একটা বই করেছি/ প্রতিবাদীর তালিকাতে শঙ্খ ঘোষের নামের পাশে নিজের নাম সই করেছি’। একটা সই করে, একটা মিছিলে হেঁটে আমার কর্তব্য শেষ! আমার সামাজিক প্রতিপত্তি স্থাপনের জন্য আমার লাশের প্রয়োজন হয়। আমি এমন বামন যে সেই লাশগুলোর ওপর আমাকে উঠতে হয়। মণিভূষণ ভট্টাচার্য যে বোধ যে সংগ্রামের ভেতর থেকে কবিতা লিখতেন … রেল ইয়ার্ডের পাশে তার বাড়ি ছিল… মাস্তানেরা দৌড়চ্ছে…সে সব তার লেখায় উঠে আসছে। সেই মানুষই যখন লিখছেন – ‘কী হবে আর পাতা উলটে শঙ্খ ঘোষ বা হার্ট ক্রেন এর / ভারতবর্ষ রেসের মাঠ, মুৎসুদ্দি বেনের/ খবর হতে পারিনি তাই, অভিমানে আঙুল ফোলাই/ এখন শুধু গদ্য পড়ি ফ্রন্টিয়ারে সমর সেনের’।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  একটা বার্তা আছে …

রাহুলঃ   সেই বার্তাটা কিন্তু তোমাকে জ্ঞান দেওয়া নয়। আমাকে নিয়ে লেখা। আমার দিকে। সময়টা এমন পালটে গেছে না! আমার মনে হয়, এখন প্রতিবাদ বিষয়টাই কেমন স্ববিরোধী। এটাও হয়তো আধুনিকতার লক্ষণ।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  কিন্তু রাহুলদা… কোথাও কোথাও হয়তো এই প্রতিবাদ তাৎক্ষণিকতার বশবর্তী। কিন্তু এর তো দরকারও আছে…

রাহুলঃ  অবশ্যই আছে। কিন্তু কবিতা লিখে আদৌ প্রতিবাদ হয় কিনা আমার সন্দেহ আছে। বিপ্লব হয় না। কিচ্ছু হয় না।

অনিমিখঃ  কখনো কখনো কবিতা কোনো আন্দোলনে স্লোগানের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।

রাহুলঃ  হ্যাঁ। একটা ইন্ধন জোগাতে পারে। কিন্তু বাঙালিদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেগে দেওয়া হয় – ‘প্রগতিশীল কবি’- প্রগতিশীল কবি আবার কী ? শক্তিদার এই যে কবিতাটা পড়লাম … ছ’দিনের পর এই হাট বসে… একজন ওঁরাওঁ যুবক কাঁদছে… ধান ভেঙে চালের আলোর মত এই হাট … এরমধ্যেও কোথাও প্রতিবাদ তো আছে !

প্রতিবাদটা না ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। তোমার চোখের জল যদি আমি বুঝতে পারি, তোমাকে আলাদা করে চিৎকার করে কিছু বলতে হয় না।

অনিমিখঃ  কিন্তু রাহুলদা, ধরো, প্রকট ঘটনাবলীকে জড়িয়ে যে সমাজনৈতিক রাজনৈতিক কবিতা লেখা হচ্ছে সে সব বাদ দিলাম। কিন্তু কবিরা যে দুঃখ বেদনা, হুতাশ প্রকাশ করে থাকেন লেখায় সেগুলোও তো তাহলে মিথ্যে হয়ে যায়। তুমি যে প্রতিবাদকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেবার কথা বলছো সেই অর্থে যদি ধরি। হয়তো ঠিক ততটাই দুঃখ আমার হয় না, কিন্তু আমি আমার কবিতায় দুঃখবিলাস এনে ফেলি…

রাহুলঃ  আমার মনে হয় কী জানো তো, কবি এবং গণিকা এক। একজন গণিকা না খুব সুন্দর করে সেজেগুজে বসেন, যাতে বাবুরা তার ঘরে ঢোকে। একজন কবির কাছে সেরকম তার জীবনচর্যা। সেখানে যদি সে সৎ থাকতে পারে তাহলে কবিতা নামক বাবুটি তাকে খুঁজে নেয়।

কবিতা তো হয়, তাকে লেখা যায় না আলাদা করে। আমি আজকে সঙ্ঘমিত্রাকে নিয়ে কবিতা লিখবো – এরকম তো হতে পারে না। লিখতে পারি যদি সেটা আমার স্নায়ুতে এসে কোনোভাবে মেশে। তা নাহলে…

অনিমিখঃ  তুমি তাহলে কোনোদিনই ‘আজকে আমি কবিতা লিখবো’ – এইভাবে বসো নি?

রাহুলঃ  না। কেউ হয়তো বলেছে আজকের মধ্যে কবিতা দিতে হবে, তখন বসি… কিন্তু সেগুলো হয় না কিছু!

এখন আমার আবার মনে হয়, যে ইমেজ থেকেও কবিতা তৈরি হয়। ফলে একজন কবি তার মৌলিকতা এই অর্থে হারিয়ে ফেলে যে, সে কিন্তু একজন মৌলিক দর্শক নয়। মৌলিক পাঠক নয়। মৌলিক প্রেমিকও নয়। সে না, সব জায়গা থেকে তার পুঁজিটা আহরণ করে। সে যখন সঙ্গম করে দেখে তার পার্টনারের অভিব্যক্তিটা কী! সেখান থেকে সে তার লেখার কিছু পায় কিনা। তার একটা ডিপার্চার হয়। এটাই একজন শিল্পীর সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য।

অনিমিখঃ  আমরা খুব বলতাম যে, কবি হল একজন বিজনেসম্যান এর মতো। সে খালি ধান্দা খোঁজে। লাভ দেখতে চায়। সবকিছুর মধ্য থেকে সে খালি একটা কবিতা বার করে আনবে… সেই অর্থে কবি একজন খুব শঠ ব্যক্তি।

সঙ্ঘমিত্রাঃ   হ্যাঁ, রসদ নিয়ে নেওয়ার পর সেটা তার কাছে ছিবড়ে।

রাহুলঃ  হ্যাঁ। একটা সিনেমা দেখতে গেছিলাম, প্রেমিক প্রেমিকা আদর করতে করতে একটা নদীর তলায় চলে গেল… তারপর দুটো পোড়া দেহ উঠে এল। ওটা না আমার মাথায় কাজ করতে শুরু করলো। তারপরে আমি হল থেকে বেরিয়ে গেলাম, নইলে ওটা নষ্ট হয়ে যাবে। ওটা আমার ওইদিনের আহরণ। ধরো, একটা ছবি আমার সামনে। এখন আমি যদি মদ খেয়ে সেটা দেখতে যাই তাহলে একরকমভাবে আমার সামনে আসবে। মদ না খেলে আরেকরকম। বাড়িতে বউ এর সঙ্গে ঝগড়া করে গেলে আরেকরকম। আসলে আমার আর ছবির মধ্যবর্তী যে অঞ্চল – এটাই ওই ছবির বোধের জায়গা। ছবিটা নিজে একটা উপলক্ষ্য মাত্র।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  আমি আরেকভাবে বলি। তোমার কবিতা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তোমার নিজের ভেতরকার একটা স্টেট অফ মাইন্ড আছে। তার সঙ্গে বাইরের নিরন্তর সংঘর্ষ হচ্ছে। এর ফলে আপনাআপনি একটা রসায়ন তৈরি হয়। কবিতার জার্নিটা ঠিক এইখান থেকে শুরু হয়— যা নেই, তার দিকে।

রাহুলঃ  হ্যাঁ, মন যে কোথায় যায় কেউ জানে না। যখন কবিতা লিখি তখন একরকম, লেখা শেষ হবার পর কবিতাটা আমার কাছে একটা ধাঁধার মতো। আমি তখন কবিতাটা পড়তে শুরু করি, কবিতাও আমাকে পড়ে।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  একটা উভমুখী যাত্রা।

রাহুলঃ  নারীশরীরের মতো। যে মুহূর্তে তার রহস্য শেষ হয়ে যায়, তাকে আমরা বাতিল করে দিই।

ছবি আঁকার মতো। একটা রেখা টানলে, সেটা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে তুমি জানো না। সেরকম, শব্দও তোমাকে টেনে নিয়ে যায়। এমন একটা চিত্রকল্প তুমি তৈরি করলে যেটা হয়তো তোমার অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু চিত্রকল্পটা রচিত হলো তো!

অনিমিখঃ  হ্যাঁ, শব্দের নিজস্ব জোর আছে।

রাহুলঃ  ভূমেন্দ্র গুহ’র দুটো গুরুত্বপূর্ণ বই আছে – ‘যম’ আর ‘ঋতুচক্র’। দেখবে সেখানে একটা ভাষা তোমাকে টানছে। স্মৃতি…স্মৃতি…স্মৃতি তো একটা বিরাট ব্যাপার! যার স্মৃতি নেই তার কিছু নেই। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দেখা যায়, এতোদিন যা কবিতা লিখে এসেছি, তাতে, বিরাট অংশে স্মৃতি কাজ করেছে।

অনিমিখঃ  যত সময় গড়ায়… যে যে সময়কাল আমরা ছেড়ে আসি… তত তার সঙ্গে তো দূরত্ব বাড়ে! একসময় ওই পুরনো আমিটা যে আমিই সেটা যেন নিজেকেও আর বিশ্বাস করানো যায় না। তখন সেই দুটো আমি’র ভিতরে বোধহয় অন্য কোনো উপায়ে একটা কথাবার্তার চেষ্টা হয়। ছোটোবেলার ছবি দেখলে তোমার কী মনে হয়?

রাহুলঃ  দেখলে প্রথমে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয় মনের মধ্যে। তারপরে সন্দেহ হয় একটা।

অনিমিখঃ  কিন্তু মাথার মধ্যে ডিভিডির মতো স্মৃতিগুলো তো আছে …

রাহুলঃ  ক্লাস টেনে পড়ার সময় এক মাস্টারমশাই আমাকে খুব মেরেছিলেন। আমি বড়ো বড়ো চোখ করে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। তিনি আমার বাবাকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলে খুব ফেরোশাস!’ আবার আমাদের এই কলোনির স্কুলের এক মাস্টারমশাই ছিলেন, অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দেখলেই ভক্তি হতো। তাঁর কাছে আমি বিভিন্নভাবে ঋণী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব মেধাবী ছাত্র। খুব সুপুরুষ, মিথ ছিল নাকি এক মহাগায়িকার প্রেমিক ছিলেন। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন, হাতে ছাতা নিয়ে শেয়ালদা সাউথ সেকশন দিয়ে আসতেন। আমার এই আলমারির বইগুলি সব স্যার এর দেওয়া। উনি ছিলেন অ্যান্টি-কমিউনিস্ট। কিন্তু এরকম মার্ক্সিয়ান লিটারেচার পড়া লোক আমি খুব কম দেখেছি। দাগিয়ে দাগিয়ে পড়তেন। সারা সপ্তাহ ধরে একটা বিষয়কে জারিত করতেন। তারপর রোববার দিন হয়তো সন্ধেবেলা এসে বললেন, ‘চ’, আজকে এইটা নিয়ে কথা হোক’। তারপর তর্ক করতে করতে একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হতো। এই তর্কটা যতক্ষণ বজায় থাকবে ততক্ষণ তুমি বেঁচে আছো। কবিতার মধ্যেও একরকম তর্ক থাকে। স্ববিরোধিতা থাকে। হয়তো একটা অর্থহীন দিকে চলে গেল। কিন্তু এই অর্থহীনতারও যে একটা অর্থ হতে পারে কবিতা তোমাকে দেখায়, ছবি তোমাকে দেখায়। অনেকসময় সুর দেখায়।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  সুরের একদম স্বতন্ত্র একটা ভাষা আছে। যেখানে হয়ত আর কেউ পৌঁছতে পারে না।

আচ্ছা, তুমি তো ঘটনাপ্রধান বা বর্ণনাপ্রধান কিছু লেখো নি সেভাবে…

রাহুলঃ  লিখি না নয়। আমার কাছে ওইভাবে আসে না। আমি শঙ্খবাবুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি যাই কবিতা লিখি সব একরকম হয়ে যায় কেন? শঙ্খবাবু বলেছিলেন, ‘লেখো। লেখা তো আর স্টাইলিশ প্যান্ট না, যে আজকে ড্রেনপাইপ কালকে বেলবটম’। অনেক অগ্রজ কবিরা বলেন যে অমুকে বিভিন্নরকমভাবে কবিতা লেখেন। এটা আমি এখনো ধরতে পারি না। অনেকরকম সনেট লেখা যেতে পারে।

অনিমিখঃ  এটা কিন্তু হতেই পারে। যার মনোগঠন যেরকম সেরকমভাবেই হয়তো …

রাহুলঃ  দেখো, কবিতা কীভাবে হবে সেটা তুমিও জানো না, আমিও জানি না। তুমি সনেট লিখতে পারো বা গদ্যকবিতা লিখতে পারো। কিন্তু তুমি যদি সচেতনভাবে সেখানে ঢোকো তাহলে আমার সন্দেহ হয়। এটা কি ট্রাপিজের খেলা? যে দ্যাখো, আমি এটাও দেখিয়ে দিলাম! উৎপলকুমার বসু বিভিন্নরকম কবিতা লিখেছেন। কিন্তু কোনো কবিতায় ওরকম প্রকটভাবে খেলা দেখাচ্ছেন বলে মনে হবে না। উৎপলদার সঙ্গে যারা মিশেছি তারা জানি, উনি খুব প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন। তার ভাষা, তার হাঁটার ভঙ্গী, সেলাই করার কায়দা – এগুলি লক্ষ্য করতেন। ফলে খুব ডিটেলিং এর কাজ…হয়তো একটা চারলাইনের লেখা… রাক্ষস কবিতাটা… পঞ্চাশ অবধি যারা কবিতা লিখে এসেছেন, আমার মনে হয় যে, একমাত্র উৎপলকুমারের মধ্যেই এই ডিটেলিং দেখা যায়।

অনিমিখঃ  আমার তো মনে হয়, এখনো উনি অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকা কবি। এমনকি শেষ বয়সের লেখা দেখো … ‘পিয়া মন ভাবে’ ..

রাহুলঃ  হ্যাঁ, সে তো আরও ইন্টারেস্টিং। একজন কবির জীবন হল রাবণ অপহৃত সীতার মতো। সে অলঙ্কার ত্যাগ করতে করতে যায়। সেই অলঙ্কারকে ধরে ধরে পাঠক রামচন্দ্র কবির কাছে পৌঁছয়। সত্যিকারের প্রত্যেক কবিই যত বয়স বাড়ে, অলঙ্কার খসিয়ে যান। তখন তিনি কথা বলেন। উৎপলকুমার তখন একটা আপাত সহজিয়া রাস্তা দেখাচ্ছেন … আমি পথ হারিয়ে ফেলছি… ধরতে পারছি না…

সঙ্ঘমিত্রাঃ একদম। হুয়ান র‍্যামোন হিমেনিথও তাঁর বিখ্যাত একটি কবিতায় ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন। অলংকার খসিয়ে নিরাভরণ হওয়ার কথা। তোমার ‘নিদ্রিত দর্পণে যা দেখি’ তেও এই জিনিষটাই পেয়েছি …

রাহুলঃ  এই যে আমি পথ হারিয়ে ফেলছি… দূরে কিন্তু একটা রেখা আছে। মহাভারতে বর্ণনা আছে, দূরে আকাশ থেকে গলন্ত মাংসপিন্ড পড়ছে। এইধরণের ইমেজ উৎপলকুমারের মধ্যেও আছে। এখানে কিন্তু একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।

ওই বাঙালি কবিদের মতো সামাজিক বিবেক নয়। তাঁরা তো সভাপতিত্ব করেন, ফিতে কাটেন, পেজ থ্রি তে ছবি ছাপেন। তাঁরা ভুলে যান যে তাদের কাজ কবিতা লেখা।

অনিমিখঃ  রাহুলদা, ধরে নিচ্ছি যে পাঠকমাত্রেই কবি। কবিতা লেখেন না এরকম পাঠকের অস্তিত্ব নেই ধরেই আমরা কথা বলবো…

রাহুলঃ  এখানে একটা কথা বলার আছে আমার। কোনো পাঠক যদি নাও থাকতো না, কবি কবিতা নিজের জন্যই লিখতো।

আমার মনে হয় প্রত্যেকটা জিনিষের সঙ্গে ক্ষুধার সম্পর্ক আছে। ধরো, যিনি কালীমূর্তি ভেবেছিলেন তিনি ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য ভেবেছিলেন। স্বপ্নে দেখা দেওয়া-টেওয়া ঢপের কথা। তিনি ভেবেছিলেন, আমাকে কিছু একটা করে খেতে হবে। তাই দেবদেবী মূর্তি তৈরি হল। তারপরে দেখলো এটাকে কীভাবে গ্রহণীয় করা যায়। তাহলে আমাকে মন্ত্র লিখতে হবে। আমি কবিতা লিখলাম। ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য লিখছি। আরও বিস্তার হতে হতে একটা সমর্পণের পরিমন্ডল তৈরি হল। ফলে, শ্যামাসঙ্গীত লেখা হল। শ্যামাসঙ্গীত মনের ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য লেখা। শ্যামাসঙ্গীত আর প্রেমের গানে পার্থক্য নেই কোথাও।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  যেমন প্রেম আর পূজা পর্যায়ে নেই…

রাহুলঃ  এবং যত তোমার প্রেম বাড়বে সন্দেহও বাড়বে। ভাবো, কমলাকান্ত প্রশ্ন করছেন, ‘ব্রহ্মান্ড ছিল না যখন মুন্ডমালা কোথায় পেলি!’ তো, এই শাক্তপদাবলী…শ্যামাসঙ্গীত…এগুলির মধ্যে ভীষণভাবে কবিতা রয়েছে। উৎপল খুব লৌকিকভাবে সেই উপাদানগুলোকে ব্যবহার করেছেন। একজন শিক্ষিত মানুষ লিখছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কিছুই জানেন না। অথচ বিরাট একটা শিক্ষা লুকিয়ে আছে।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  সেই শিক্ষাটা দেখা যায় না, কিন্তু ভেতরে আছে।

অনিমিখঃ  কিন্তু উৎপলের এক একটা বই একেকরকম। যেমন নাইটস্কুল একরকম, চৈত্রে রচিত কবিতা আরেকরকম …

রাহুলঃ  কিন্তু কব্জির জোর দেখানোর জন্য নয়। আজ একটা বই বাঙালভাষায় লিখলাম, এরকম নয়। আমার মনে আছে,  ‘নাইট স্কুল’ ছেপেছিল গান্ধার। প্রচ্ছদে নাইট স্কুল কথাটা উৎপলদা বাঁহাতে লিখেছিলেন।

সঙ্ঘমিত্রাঃ না… তা কেন! এরকম তো হতেই পারে—এক একরকম অভিঘাতে অভিজ্ঞতায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক তার কাছে ধরা দিল! আর উৎপলের সে প্রচ্ছদ আমরা দেখিনি।

রাহুলঃ  একটা কাব্যগ্রন্থ শুরু হয় তার প্রচ্ছদ থেকে। উৎসর্গপত্র খুব জরুরি। তুমি এমন একটা লোককে উৎসর্গ করলে যে লোকটা হারামি। তখন পড়তে গিয়ে বইটার ওপর শ্রদ্ধা চলে যাবে।

উৎপলদা শেষের দিকে কবিতার নাম দিতেন না। ১,২,৩ …এরকম করে লিখতেন। আমার নিজেরও মনে হয়, কবিতার নাম কবিতাটাকে আবদ্ধ করে দেয়। যদি আমি ‘সন্ধ্যা’ নাম দিই তো কবিতাটার মধ্যে সন্ধ্যা খুঁজবো।

অনিমিখঃ  সামান্য কিছু কবিতাতে নাম দিতে হয়।

রাহুলঃ  হ্যাঁ, কমিউনিকেশনের জন্য। কিন্তু অধিকাংশ কবিতাই আবদ্ধ হয়ে যায়। এখান থেকেই, কবিতার আদৌ কোনো সামাজিক ভূমিকা আছে কিনা সে বিষয়ে আমার চূড়ান্ত সন্দেহ হয়। আমি কবিতা না লিখলে কারো কিচ্ছু এসে যায় না। শিল্প বেশির ভাগ সময়ই ব্যর্থ মানুষরা করেন। নিজের হেরে যাওয়া লুকনোর জন্য লিখি।

অনিমিখঃ  এইটা কি খুব চিরাচরিত একটা ধারণা নয়? ধরা যাক, একটা খুব মৌলিক হেরে যাওয়ার জায়গা থেকে কেউ শিল্পে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরে তিনি শিল্প করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এবং তিনি সেই সমান মাপের তীব্রতা ধরে রেখেছেন। তার শেষজীবনের কাজও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে হারিয়ে যান, তাদের কথা আমি বলছি না। মার্কেজ এর কথা ধরো।

রাহুলঃ  মার্কেজ কিন্তু শেষ অবধিও ওই পুরনো মার্কেজেই বিলং করেন। যখন তিনি তার গণিকাদের নিয়ে লেখেন, তিনি কিন্তু ওই টাকাওলা মার্কেজ নন। একটা ফতুর লোক।

যেমন ধরো, আমি মনে করি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক গদ্যকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি তো টাকাপয়সাওলা লোক ছিলেন না। তারপর, মতি নন্দী। জীবনের অভিজ্ঞতাটা কিন্তু প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা। ধরো, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বর্ণময় জীবন নিয়েও উপন্যাস লেখা হতে পারে। কিন্তু বাংলাতে একটা নির্মল বর্মা পাওয়া মুশকিল আছে। উনি যখন লেখেন, অন্য একটা দর্শনের জগত তৈরি হয়। আমরা বেশির ভাগই কবিতায় গদ্যে কাহিনি লিখি। এইটা মুশকিল। সে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যায় না।

ধরো, একটা দৃশ্য দেখে আমার মনে অনিমিখের বা সঙ্ঘমিত্রা বা জয় গোস্বামীর একটা লাইন এল। তখন আমি সম্পৃক্ত হবো। কিন্তু যখন আমি কোথাও কোনো আশ্রয় পাবো না, তখন আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করবো। তখন আমি ফাঁকা মানুষ। তুমি যতই পন্ডিত হও, শূন্য না হলে তুমি কবিতা লিখতে পারবে না কিন্তু! এটা উৎপলকুমার বসুর কবিতা পড়লে বোঝা যায়। উৎপলদা অত্যন্ত পড়াশোনা করতেন, বিচিত্র বিষয়ে।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  কিন্তু সেগুলো ভুলে যেতেও পারতেন।

রাহুলঃ  না ভুললে পরে তো শুধু উগরে দেওয়া হতো।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  তাহলে একটা কথা বলি, রাহুলদা। তোমার পাঠক পেলে ভালো লাগে না?

রাহুলঃ  হ্যাঁ, ভালো লাগে। কিন্তু বেশি পাঠক হয়ে গেলে সমস্যা হয় আমার। বহুদিন আগে একটা মজার গোলটেবিল হয়েছিল, মল্লিকা-সুবোধদা-জয়দেব আর আমার। মল্লিকা খুব চেপে ধরেছিল, আমি বলেছিলাম আমার দশজন পাঠক ভালো। একশোজন পাঠক হলে আমি নিজেকে সন্দেহ করবো। আমি সেটা এখনো বিশ্বাস করি। এখন তো চারপাশে প্রচুর মঞ্চসফল কবি আছেন।

মঞ্চের ক্ষেত্রে, মানুষটাই তো তখন পালটে যাচ্ছে। সে তো তখন বিনোদনশিল্পী। কবি তো কখনো বিনোদনশিল্পী হতে পারেন না! কবিতার আনন্দটাও যন্ত্রণার। শক্তির ‘আনন্দভৈরবী’ – ‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি’। এই যে আনন্দ, তা কবির যন্ত্রণা নিংড়ে বেরিয়ে আসা। যখনই হাততালিতে হল ফেটে পড়ছে…

সঙ্ঘমিত্রাঃ  একটা উচ্চকিত ব্যাপার তৈরি হচ্ছে…

রাহুলঃ  হ্যাঁ। শক্তিদার কিছু পাঁচ মাত্রার কবিতা, ভালো কবিতা কিন্তু, কাঁপিয়ে দেয়। ফলে, শক্তিদা আনন্দভৈরবী, অবনী বাড়ি আছো – এইসব পড়তো আর হাততালি পড়তো। শক্তিদা’র প্রচুর ভালো লেখা আছে যেদিকে আমরা নজরই দিই নি!

অনিমিখঃ  রাহুলদা, এটা কি মনে হয় না যে পাঠকের গ্রহণক্ষমতার ওপর নির্ভর করে? মানে তার মনোগঠন, পড়াশোনা, জীবনযাপন অনুযায়ী একজন পাঠক তৈরি হন। লেখায় যত গভীরতা ও ঘনত্ব বেশি হয়, তত কম লোকে নেয়। এখন শক্তির মতো বা উৎপলকুমারের মতো দু একজন কবি থাকেন যাদের লেখা ওই ঘনত্বের হলেও তাদের বহিরাঙ্গের এমন একটা চলন থাকে যে তারা আরও একটু বেশি পরিধির পাঠককে কাছে টানে…

রাহুলঃ  আমি কমিউনিজমে বিশ্বাসী। সারা পৃথিবী উলটে গেলেও আমি মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করবো। কিন্তু আমার এটাও মনে হয়, মার্ক্সবাদ চর্চা আমাদের সাহিত্যের ক্ষতি করেছে।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  শুধু আমাদের কেন, পৃথিবীর সাহিত্যে আরও অনেক এরকম উদাহরণ আছে…

রাহুলঃ  হ্যাঁ। ফলে কবিতার নামে একধরণের উচ্চকিত স্লোগান লেখা হয়েছে। জ্ঞান দিতে হয়েছে। ফলে আমরা দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখককেও হারিয়েছি।

অনিমিখঃ  মার্ক্সবাদি স্কুল অফ থট বলে তো ক্রিটিসিজমের একটা ধারাই আছে…

রাহুলঃ  এই মঞ্চসফল কবিতার পেছনে মার্ক্সবাদ চর্চার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। যেমন রাম বসু। ভালো লেখাগুলো চাপা পড়ে গেছে… ওই পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে… ওইটাই পড়তে হবে… আমরা সলিল চৌধুরিকেও কবি বানিয়ে ফেলেছি! সলিলদা ‘চাবি’ লিখে ফেললেন। আমরা খুব হাততালি দিলাম। অমিতাভ দাশগুপ্ত। আমার খুব কাছের মানুষ। শ্রদ্ধেয় মানুষ। অমিতাভদা’র বেশ কিছু ভালো লেখা আছে। কিন্তু তার লেখার মধ্যে খুব নাটক থাকতো। মিছিলে পড়তে হবে যে!

সঙ্ঘমিত্রাঃ  বরং তুলনামূলকভাবে ওঁর গদ্য অনেক মুক্ত…

রাহুলঃ  ওঁর আত্মজীবনী আছে একটা, অসামান্য।

সঙ্ঘমিত্রাঃ  খুব সম্ভবত নামটা – সবুজ ভায়োলেট, ওঁর আত্মজীবনী। ‘ক্যানেস্তারা’ পত্রিকা ছেপেছিল। কিংবা খবরের কাগজে ওঁর সম্পাদকীয় লেখাগুলো। বুধবার করে লিখতেন, সংবাদ প্রতিদিনে। শুধু ওঁর লেখাটাই পড়তাম সেখানে।

রাহুলঃ  কিন্তু সেই লোকটাই মিছিলে মিটিঙে কবিতা পড়তে হবে বলে লিখছেন… তার সামনে হাজার হাজার লোক… তখন তাদেরকে অ্যাড্রেস করতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় তো এরকম ছিল না! শক্তিদা’র অনেক লেখার ভেতরেও তো ঢুকে আছে – ‘ছেলেটি বিপ্লব চেয়ে দোষী’ কিংবা ‘ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে/ মানুষ ছিল নরম, কেটে ছড়িয়ে দিতে পারতো’। এর মধ্যে প্রতিবাদ আছে তো! কান্না আছে। কিন্তু সেজন্য তো চিৎকার করে নাটকীয় ভাবে কিছু বলতে হচ্ছে না।

একেকজন কবির একেকরকম যাত্রাপথ থাকে। আমার কাছে শক্তিদা অনেক বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠেছেন, কারণ ‘ছেলেটি বিপ্লব চেয়ে দোষী’ – এই লাইনটা রক্তে মিশে যায়।

সুবোধদা’র জন্মদিনের একটা অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, সুবোধদা এখন যে কবিতা লেখেন সে কবিতা আমার নয়। কিন্তু আমার নয় বলে তো কিছু যায় আসে না। হাজার হাজার মানুষ সুবোধদা’র কবিতা পড়ে হাততালি দেয়। এই হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আমার একটা বিচ্ছিন্নতা আছে।

সুবোধ সরকারের কবিতার সামাজিক মূল্য আছে। ‘মণিপুরের মা’ প্রচুর লোক বলে, আমি শুনেছি। সুবোধদা’কে তো মৃদুল দাশগুপ্ত ‘চারণ কবি’ আখ্যাও দিয়েছেন। আমি এমনও দেখেছি, একজনের বাড়িতে তিনটে বই – রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুবোধ সরকার। সেটাকে তো অস্বীকার করতে পারছি না! কিন্তু ‘ঋক্ষ মেষ কথা’র সুবোধ সরকারের সঙ্গে এই সুবোধ সরকারের তফাত আছে।

সুবোধদা রমেন্দ্রকুমারের কবিতা একটার পর একটা মুখস্থ বলে দেবে। লোকটা মন দিয়ে সেই কবিতা পড়েছে, ভালোবেসেছে। কিন্তু এখন অনেককে দেখি, অরুণ মিত্রের নামই শোনে নি। আমাদের কোথাও দায়িত্ব ছিল কবিতা পড়ানোর, সেটা আমরা পালন করিনি। এমনভাবে কবিতা সিলেবাসে ঢোকানো উচিত যে ক্লাস ওয়ান টু থেকেই আস্তে আস্তে একটা ছেলে বা মেয়ের কবিতাবোধ তৈরি হতে থাকে। আমার তো মনে হয়, এক এক জন কবিকে আলাদা করে পড়ানো উচিত। অরুণ মিত্র’র ওপরে একটা পেপার থাকবে। বিষ্ণু দে কে তো লোকজন ভুলেই যাবে! এগুলো খুব আতঙ্কের কারণ।

আমার সঙ্গে জয়দেবের খুব তর্ক হতো। আমি বলতাম, মার্ক্সসাহেব যা লিখেছেন সেটা ব্যাখ্যা করা একজন কবির কাজ নয়। জয়দেব খুব শক্তিশালী লেখক ছিল। কিন্তু ওই মার্ক্সসাহেব কী বলেছেন সেই চিন্তাটা যদি না থাকতো… কিন্তু আবার দ্বন্দ্বও তো ছিল… যখন ডাইরি পড়ছি … তখন অন্য জয়দেব !

 

(ক্রমশঃ)

Facebook Comments

Related posts

6 Thoughts to “রাহুল পুরকায়স্থ’র সঙ্গে আলাপবিস্তার”

  1. Anirban Jyoti Debnath

    গতিময় এবং আবশ্যিক আলাপচারিতা।

  2. সুমনা সান্যাল

    রাহুল পুরকায়স্থর সঙ্গে এই আলাপচারিতা পড়া,তাঁর কবিতাভাবনা অন্তত কিছুটাও স্পর্শ করার এই যে সুযোগ পেলাম, এ এক অসামান্য অভিজ্ঞতা

  3. Hindol Bhattacharjee

    অত্যন্ত মূল্যবান>>>>

  4. nirmalya mukhopadhyay

    এই প্রজন্মের দুই সমর্থ কবি এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন।
    রাহুলদার কথা আর কী বলি,বরাবরের মতো তিনি অকপট,
    সাহসী,গভীর এবং প্রাঞ্জল
    দুনিয়াদারি অবশ্যই এ কথোপকথন -এর জন্য ধন্যবাদার্হ হবেন।

  5. এমন আলাপচারিতাই তো চাই….

  6. দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম

    এই সাক্ষাৎকারটা এই ওয়েবসাইটটিতে প্রথম মুগ্ধতা দিয়েছিলো। জানাতে হয়।

Leave a Comment