তখন একটা স্বপ্ন ছিল আমাদের।
’৯২-’৯৩ সালের শীতবিকেলের রাঙামুকুল আলো। আমরা কল্পনা করতাম, না, আমরা স্পষ্ট দেখতে পেতাম, গার্সিয়া মার্কেজের অলীক কোনো শহরে অসম্ভব বৃষ্টি পড়ছে। অসম্ভব আর একটানা। একশো বছর ধরে।
আমরা চারজন সেই বৃষ্টিতে ভিজছি। ভিজতে ভিজতে দিন পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের। ভিজতে ভিজতে রাত কাবার হয়ে যাচ্ছে।
বড় চাকরি না, বড় বাণিজ্য নয়, অর্থ নয়, সফলতা নয় – শুধু এই আধিভৌতিক বর্ষাজলে ভেজার জন্য আমরা বেঁচে থাকবো – ঠিক করেছি।
প্রায়ান্ধকার কলোনিমাঠ। সেখানে ফুটবলের শেষ বাঁশি বেজে গেছে। নিজের প্রতি অভিমানে গোলপোস্টের পায়ের কাছে শুয়ে আছে ফর্সা রোগা গোলকিপার, সে বাড়ি ফিরবে না আজ। পৃথিবী পারাপার করা লোডশেডিঙে, বৃষ্টিতে, কলোনির ভূতগ্রস্থ বাড়িগুলি একে অপরের দিকেচোরা যৌন ইঙ্গিত করছে। আর কে না জানে ইট কাঠ কংক্রিটের নীরব বাড়িঘর মুখর হয়ে ওঠে একমাত্র লোডশেডিঙের অন্ধকারে। আমরা চারজন কলকাতা শাসন নয়, কলকাতায়, আরও গভীর কলকাতায় লীন হয়ে যাবার কথা ভেবেছি। ভাবতে ভাবতে দেখেছি একরাশ গনগনে আগুন দৌড়ে কলোনিমাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। ছুটে কাছে গিয়ে দেখেছি এ তো আগুন নয়, এ তো সমরেশের দিদি। আগুনকে আষ্টেপৃষ্ঠে শরীরে জড়িয়ে চিরতরে কলঙ্ক নেভানোর চেষ্টা করছে। যে সব মেয়েদের ‘অফিস’ শুরু হয় রাত্রি করে তারা আমাদের পেরিয়ে যাদবপুর স্টেশন রোড দূরে ফেলে ট্রেনের অনন্ত হুইশল বেয়ে চলে যাচ্ছে। আর পাড়ায় পাড়ায় ঝর্ণা ঠাকুরের নাচের ইস্কুল শুরু হচ্ছে রমরম করে। বাইরে ভর্তির লাইন পড়েছে। তাঁকে নিয়ে ফোয়ারার মতো হেসে উঠছে মেয়েরা। যাদবপুর মোড়ে ফিরতি পথে হঠাৎ খুব অপ্রত্যাশিতভাবে একজন চিনতে পেরে গেছে বহুবছরের পুরনো অন্য একজনকে আর দ্রুত রাস্তা বদলে নিয়েছে। ‘বাউলমন’ –এর মেল মেন্টাল ওয়ার্ডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনচারজনেরই একটা টিম টানটান উত্তেজনায় চেয়ে আছে উলটো ফুটপাথে মাংসের রক্তাক্ত দোকানের দিকে। আমরাভাবিনি এই পারম্পর্যহীন অকারণ সন্ধেবেলার পর যে সূর্য আসবে তার নির্দয় করুণ বিভায় আবার সকালের কলকাতাকে দেখা যাবে। আসলে সেসময় সেই বয়সে আমাদের চিন্তাকল্পনার বীজের মধ্যে জেগে উঠেছিল মাকোন্দো, কী তীব্রভাবে জেগে উঠেছিল সে! কলোনির রাস্তায় অন্ধকারে পাতাপল্লবের স্তুপের ভেতর আমরা ঘোড়ার কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখতাম। এ আমাদের যৌথস্মৃতি। যৌথস্মৃতির আতঙ্ক বা ‘টেরর অফ শেয়ারড মেমরি’ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয় – আমি আজ যৌথস্মৃতির আনন্দের কথা বলবো। তা যদি বিষাদের দিকে অন্যমনস্কতায় কখনো যেতে চায় আমাকে সাবধান করে দেবেন। এখন অনেকদিন পর মৃত্যু আর উল্লাসের আড়াআড়িভাবে রাখা তরবারির ওপর তার মুখ আমি দেখতে পাই। কিন্তু তখন তো তা ছিল না! তখন তো ওই চারজন স্বপ্নতাড়িত জন্মান্ধের একজন ছিল সে। চামড়ার ওপর সে লিখত। চামড়ার ভাষায় সে লিখত। সে জানত কবিতা অপমান রেকর্ড করবার একটা ধারালো অস্ত্র মাত্র। আর তাতেই সে প্রাণপাত করে শান দিত সন্ধেবেলা।যাদবপুর কফি হাউসের আড্ডায় সে পড়ে শোনাতঃ ‘ম্যাপের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছো তুমি/ তোমার মাথার ওপর মাংসের দোকানের মতো একটা সত্যিকারের সূর্য/ জ্বলছে সারাদিন/ সন্ধেবেলায় তোমার পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ/ যেন তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি কিছুই… হাসপাতালে নিয়মমতো জ্বলে উঠছে হলুদ আলো/ চলছে টেলিভিশন/ একটা অন্ধকার ট্রেন ছুটে যাচ্ছে রাতের পর রাত/ তার জানলাগুলো ভেঙে পড়ছে’।
মনে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ। গোধূলি। সেদিন হয়তো আর মাকোন্দোর অলৌকিক বৃষ্টিপাত নেই। তারায় তারায় সেলাই করে কেউ কালো আকাশটাকে মাথার ওপর টাঙিয়ে দিচ্ছে। সে তার লাল খেরোর খাতা থেকে নীচু হয়ে পড়ে শোনাচ্ছেঃ ‘রেডিও বেজে উঠছে, কাছে, কোথাও-/ এই ম্যালেরিয়া টাইফয়েডের দেশে/ এই কাচের বয়ামের দেশে/ এই কাগজের কুমীরের দেশে/ বেজে উঠছে গান। … মিতু তুমি শোনো গান?/ মিতু তুমি দোকানে আসোনা কেন?/ দোকানদার কষ্ট পায়/ আমাদের জীবনে কোনো উৎসব নেই/ শুধু শোনো গান বেজে ওঠে’।
নীচু হয়ে বলা কথা, প্যাঁচপয়জারহীন বাকতাল্লাহীন আটপৌরে সাধ ও স্বপ্ন। নিতান্ত ঘরোয়া আক্ষেপ ক্ষমতার ফোকাস থেকে বহু দূরে কোনো সীমান্তের কাঁটাতার ঘেঁষা শীতপ্রদেশ জুড়ে বয়ে চলা জীবন –বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে থাকা কাঠের দরজাকে ঘিরে। একটা পরিত্যক্ত জাহাজের জমাট অভিমানকে ঘিরে। টিপের বাক্সের ভেতর মৃত কাচপোকা কিংবা তরমুজক্ষেতের পাশে অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে থাকা মালগাড়িকে ঘিরে, ভিজে বরফের ওপর লেখা অক্ষরকে ঘিরে, ইস্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডের জঙ্গলকে ঘিরে যে জীবনের গভীর বিষণ্ন উদ্যাপন, হিমঠান্ডা মৃত্যুদেশের কার্নিভাল, তাই ছিল তার কবিতার আত্মগত সুর।
আমি শুনতাম আর ভাবতাম আমার সামনে বসে থাকা এই প্রায়সমবয়সী শ্যামলা চাপদাড়িভর্তি কোঁকড়ানো চুলের যুবক। তার মায়াবী দ্বীপের মতো ঠাট্টাস্নিগ্ধ দুটি চোখ, এ নিশ্চয় মানুষ নয়। কেননা একমাত্র ঈশ্বর ও শয়তানই সত্যিকারের কবিতা লিখতে পারে। সভ্যতার ইতিহাসে আজ অবধি মানুষ কোনোদিন কবিতা লেখেনি।
ছেলেটি নিজেও ভাবেনি তার এই কাঁপা কাঁপা সন্দিহান কবিতাগুলি নিয়ে একটি রোগা অপরিণত প্রায়-অসমাপ্ত বই হবে একদিন। বইটির নাম হবে ‘পোকাদের আত্মীয়স্বজন’। কবির নাম বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশক ‘কবিতার কথা’। প্রকাশের বছর বইমেলা ১৯৯৪। আমিও ভাবিনি এই স্নায়ুতোলপাড় তোলা কবিতাসংগ্রহের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়বো আমি। বাপ্পাদিত্য যদি শয়তান হয় আমি কি তবে শয়তানের ছায়া? নাকি ঈশ্বরের অপরপিঠ?
স্মৃতি সততই লোভের। সে বারবার লোভাতুর করেছে আমাকে। এ বই থেকে আরেকটা কবিতা আপনাদের শোনাবার প্রলোভন আমি কিছুতেই এড়াতে পারলাম না।
‘একটা করুণ জলের রেখা গড়িয়ে যাচ্ছে কমলালেবু বাগানের দিকে/ একে কি ভালোবাসা বলবে তুমি? বলবে না কিছুই/ রুমালের মতো হারিয়ে যাবো আমরাও?’/ শুধু আলো জ্বলে ওঠে শোবার ঘরে আলো নিভে যায়/ একে কি ভালোবাসা বলবে তুমি? বলবে বিবাহ?’
কবিতাবই নিয়ে পাঠ্যপুস্তকসুলভ চুলচেরা আলোচনা আমার অশ্লীল ঠেকে। একটা আলো অন্ধকার অভিমানী তীব্রভাবে যৌনসঙ্কেতঠাসা ঠান্ডা ও নরম জগৎ ছিল বাপ্পার। আপাতশান্ত জগৎ। মায়া নয় মায়ার রহস্যে মোড়া। সহৃদয় কিন্তু হৃদয়ের ভিতরে ছুরিকাঘাত। আর অস্বীকার, ছত্রে ছত্রে অস্বীকার, ভয়ার্ত ও ঋজু।
৭ নভেম্বর ২০১৫ তে বাপ্পাদিত্য আকস্মিকভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। তার বইয়ের জন্মের মতো তার মৃত্যুও আমি নিজের চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখি। তবে শোক নয়, তার জন্য আমার শোক হয়নি একপলকও। কেননা কেউ কোনোদিন অন্যের জন্যে শোক পায় না। মৃতব্যক্তির সঙ্গে তার জীবনের যেখানে-যখন-যতটুকু জড়িয়ে থাকা ঠিক সেটুকু অংশের জন্যই শোক তার। বাকি মানুষটা বাদ। বাকি মানুষটা চুলোয় যায়। বাপ্পার জীবনের সাথে আমার জীবনের একীভূত হয়ে যাওয়ার অনন্ত অকারণ সম্ভাবনার আকস্মিক অপমৃত্যু ঘটে গেল ৭ নভেম্বর ২০১৫ তে। স্মৃতিহাতড়ানো ছাড়া আর যে কোনো রাস্তাই খোলা রইল না। তার জন্যই আমার যত কষ্ট যত অশ্রুপাত। রক্তমণির হার আমার সেই আফশোষে রাঙা।
নিয়মিত ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে নিজের লেখালিখিকে ধরে রাখবার জন্য যে কতখানি ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, বাপ্পাদিত্যর এই চটিবইটিই তা প্রমাণ করে দিল। একটা হারিয়ে যাওয়া রুমাল যে এতো তুখোড়ভাবে কবিতার ভরকেন্দ্রে উঠে আসতে পারে তা বাপ্পা করে দেখাল। তার আর একটি বইয়ের (কমিকস কারখানা) ম্যানুসক্রিপ্টটি আমার বারংবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন আর কোনোদিন সেসব লেখা বই হয়ে দুনিয়ার আলো দেখবে কিনা কে জানে!
‘পোকাদের আত্মীয়স্বজন’ বহুদিন হল পাওয়া যায় না। এই বই মূল দৃশ্য নয়, মূল দৃশ্যের অন্তরালের ইনটারোগেশন, হৃদয়ের নীরব নৈরাজ্য। বইটিকে ঘিরে তেমন কোনো উৎসাহ দেখি না কারো মধ্যে। আর নতুন করে ছাপানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। জানি না কী হবে। তবে যতদিন থাকবো এ বইটির মুখোমুখি বসে একে মোকাবিলা করবার দায় যেন আমি নিজে যেচে নিয়েছি।
খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম। লেখা যখন শেষ হয়ে এল তখন চারদিক জুড়ে অকারণে এতো বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠছে কেন? আঙুল কেঁপে উঠছে কেন? আমাদের সমস্ত উৎসব কি তবে এমনই জলের দিকে যাবে?
• পোকাদের আত্মীয়স্বজন * বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় * কবিতার কথা, ২৬ এস নাকতলা লেন, কলকাতা ৪৭ * প্রচ্ছদঃ অভীক ভট্টাচার্য * প্রকাশকালঃ বইমেলা ১৯৯৪।
Amazing! This blog looks just like my old one! It’s on a completely different topic but it has pretty much the
same page layout and design. Outstanding choice of colors!