সৈকত সরকার

মৎস্যপুরাণ

গলির মোড়েই একটা ফুলের দোকান। রোজ সকালে সিধুদা নৈহাটি থেকে আসে ডাউনের ট্রেনে চড়ে। মাথার বোঝাটা নামাতে বেশ কষ্ট হয়। ট্রেনে ওঠার সময় কেউ কেউ ঝাঁকাটা ধরে তুলে দেয়। আবার কখনও লোক পাওয়া যায় না৷ এত দোপাটি, গোলাপ আর রজনীগন্ধার ভার বয়ে চলে সিধুদা। শুধু বুধবার ওর ছুটি। ঐদিন গাঁদা, গোলাপেরও ছুটির দিন। পাড়ার গৃহস্থ বাড়ির নিত্যপুজোর ফুল সেদিন মোল্লার হাট থেকে কিনে আনতে হয়। “মোল্লার হাট” নামটা বহুকাল ধরেই চলে আসছে, তাতে মোল্লা হোক বা মালাকর কারোরই কিছু আসে যায় না।

তিন্নির জ্যামিতি বক্সে একটা মাছের ছবি আঁকা। অনেকটা থ্রিডি কাঠামোর ধরণে৷ ক্লাস ফাইভ থেকে ওটাই ওর প্রিয় বাক্স, প্রিয় রঙ, প্রিয় ছবি। পড়ার টেবিলে নিয়মমাফিক সাজানো থাকে। তিন্নির ভালো নাম শর্বরী৷ জিওগ্রাফির একনিষ্ঠ ছাত্রী। অক্ষরেখা আর দ্রাঘিমার অঙ্ক কষতে কষতে কখন যেন চোখ চলে যায় ছবিটার ওপর৷ একটা হালকা নীলাভ রঙের ওপর ধূসর রঙের একটা মাছ।  এটাকে দেখলেই কোনো দূর অতীতের ঝাপটায় স্মৃতির জল দুলে ওঠে। শর্বরী দেখতে পায় একটা ধূসর হাত এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ঘুম-ঘুম তরল ক্লান্তি তিন্নির পেন পর্যন্ত অবশ করে দেয়৷ একটা মাদলের শব্দ পায় তিন্নি, প্রথমে একটা চন্দনের তিলকের মতো কিছু মনে হয়, তারপরই সেটা বদলে যায় রক্তে। ক্যালেন্ডারের ওপর মা কালীর মূর্তির পায়ের কাছে সে কয়েকটা নরমুণ্ড দেখেছিল৷ অতীতটাকে তিন্নির তেমনই মনে হয়। একটা ঝাঁকরা চুলের লোক, তিন্নির ছোট্ট শরীরে তিলক এঁকে দিচ্ছে,  রক্তের তিলক৷ তিন্নি চিৎকার করছে, আর তালে তালে বেজে উঠছে মাদল৷ কোনো ভক্তিরসে এত লাল থাকে না। তারপর সাদা ন্যাকড়ায় সেসব মুছিয়ে দিচ্ছে । ভয়ে কঁকিয়ে ওঠে তিন্নি৷ মায়ের কপালেও এমন তিলক৷ ঝাঁকড়া মাথা লোকটা প্রায়শই বাড়িতে থাকত। সারাদিন হরির স্মরণ করে তারপর স্বপাক আহার করত সে। মায়ের রান্নাও হত আলাদা৷ তিন্নিকে মাসি রেঁধে দিত। ও আমিষ ছাড়া খেতে পারে না। দুধ বা পনির জাতীয় কিছু দেখলেই ওয়াক তোলে৷ সত্যি কথা বলতে মাকে ঠিক মায়ের মতো মনে হয় না তিন্নির। মা গোপালকে স্নান করায়, নতুন জামা পরিয়ে দেয়, এঁকে দেয় অঙ্গরাগ। কিন্তু তিন্নিকে কোনোদিন কাজলটুকু পরায়নি তার মা। নজর লেগে যাওয়ার ভয় তিন্নির কোনোকালেই নেই, কারণ অনেক লাল নজরের ঘেরাটোপেই কেটেছে তার মেয়েবেলা।

স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই তিন্নি সোনারপুরের এই মেসে চলে আসে। মায়ের আপত্তি করবার মতো কিছু ছিল না, করলেও শুনত না তিন্নি। ও বাড়িটা ওর কাছে বিষের মতো একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল৷ বাইরের ঘরের কালীঠাকুরের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডারটা তিন্নি নিয়ে এসেছে। ওটায় ওর বাবার মৃত্যুর তারিখ লাল কালি দিয়ে গোল পাকানো। এবাড়িতেও তিন্নির কাছে এক কাল্পনিক মানুষ আসে। মাঝরাতে, যখন ওর জ্বরটা বেড়ে যায়, তখনই আসে সেই মূর্তি। কিন্তু খালি হাতে আসে না। কোনোদিন নিয়ে আসে গাছের টব, কোনোদিন লাল-হলুদ হ্যান্ড-মেড পেপার। গতকাল একটা বনসাই হাতে সে এসেছিল৷  এসেই তিন্নিকে বলল –

” শর্বরী, এভাবে আর কতদিন?  এবার একটু সুস্থ হও। এই দ্যাখো আমার হাতে যেটা দেখছ, এটাও একটা প্রকাণ্ড জীবন। আমি তাকে গুটিয়ে রেখেছি।”

” তোমাকে কতবার বলেছি, নক না করে ঘরে ঢুকবে না ”

” কিন্তু সে তো বাইরের লোকের জন্য। আমাকে তো তোমার কাছে প্রায়ই আসতে হয় শর্বরী।  এ নিয়ম এখনও থাকবে?  শব্দ হলেই আমি যে দূরে চলে যাবো”

” তবুও তুমি দরজায় নক করে ঢুকবে। আমার কোনো ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না? ”

” নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু তোমায় অনুরোধ,  আমাকে তুমি এ নিয়মের বাইরেই রাখো। আর তাছাড়া… ”

” তাছাড়া?  কী? ”

” তোমার থাকার বলতে এইমাত্র আমি। তুমি এই ধূসর হাত, তার রোজকার উপহার চিনতে পারো না? ”

” না পারি না, কে তুমি?  ঐ ঝাঁকরা চুলের লোকটার কেউ?  তাহলে আর কখনও এসো না।”

” আমি কোনো মানুষের হয়ে কাজ করি না শর্বরী৷ তুমি জানো এসব উপহার তোমার চেনা…  তোমারই আলো দিয়ে আমি তোমাকেই ভরিয়ে রাখি… ”

– প্রচণ্ড কাঁপুনিতে সারা শরীর কেঁপে ওঠে তিন্নির। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ হয় না। আজও ওষুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। তিন্নি বোধহয় জানে, ওষুধ খেয়ে নিলে প্রতিদিনের উপহার আর এসে পৌঁছবে না৷ হয়তো মিছিমিছি ভুলে যাওয়ার ভান করে….

তিন্নি এখন একটা বিশেষ প্রোজেক্টের জন্য বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামে ক্লাস করতে যায়। ভেতরের সেমিনার রুমেই ক্লাস হয়,  কিন্তু মাঝে মাঝে ডেমন্সট্রেশনের জন্য ওদের নিয়ে আসা হয় মূল কক্ষে। চেয়ারটা পেছনে হেলে যেতেই ওপরের গোল পর্দাটা অন্ধকার হয়ে যায়। তিন্নির মনে হয়, ও সে বাড়ির ছাদে শুয়ে আছে। আকাশ জুড়ে ফুটে উঠছে রাশিচক্রের নানা প্রতীকের ছবি৷ হ্যাঁ, এইতো,  এবার মীন রাশি। সেই সাদা সাদা সরলরেখায় জুড়ে দেওয়া ত্রিমাত্রিক মাছ। ঘন ধূসর আঁশগুলো তিন্নি কল্পনা করে নিচ্ছে।  তারপর তার লেজের ঝটপটানি। সেই মাছ লাফিয়ে চলে আসছে ওর জ্যামিতিবক্সে,  নীল রঙের ঘরে ধূসর রঙের মাছ। একতলা থেকে যেন ও মাদলের শব্দও শুনতে পাচ্ছে। শুরু হয়েছে কীর্তনের মহড়া৷ ঝাঁকরা চুলের একটা জীব দুহাত নাচিয়ে কর্কশ গলায় গান ধরল। সেই গলা, পৈশাচিক রক্ত লেগে থাকা স্বর। সেদিন তিন্নি শুনেছিল – ” কথাটা বলিস না কাউকে৷ নইলে ঐ মাদলের ভেতর।  ” তিন্নি ভাবত মাদলটা বোধহয় কফিনের মতো কিছু, ওর মধ্যে অনেকগুলো জীবনকে বন্ধ করে রেখেছে লোকটা৷ তবেই না অমন জোরালো শব্দ হয়, যন্ত্রণার শব্দ।  গোটা ঘরটায় দমবন্ধকরা ঠাণ্ডা। শনিগ্রহের বলয়গুলো খুব কাছ থেকে দেখলে টুকরো টুকরো পাথরের মতো দেখায়। তিন্নি জানে ওর জীবনটাকে কেউ কখনও টেলিস্কোপে দেখেনি, দেখলেই চোখে পড়ত এমন অজস্র পাথর, অনেক পাহাড়, সেখানে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না।

বাবা বেঁচে থাকতে ওকে একটা  অ্যাকোরিয়াম এনে দিয়েছিল। প্রতিসপ্তাহে একটা করে মাছ এনে দিত, কিন্তু কোনোটাই আর বাঁচত না৷ তিন্নির এখনও মনে হয় ও বাড়ির জলে বিষ আছে। নইলে ঐ ছটফটে প্রাণবন্ত মাছগুলো রাত পেরোতে না পেরোতেই জলে ভেসে ওঠে?  বাবা বলেছিল, “দ্যাখ আমরা যেমন হাওয়াতে নিঃশ্বাস নিই, ওরা নেয় জলে৷ কিন্তু অন্য পরিবেশে এলে এমনিতেই ওরা দুর্বল হয়ে পড়ে।  এতদিনের অভ্যেস “।  তিন্নি জানে, ওবাড়ির জলে,  স্থলে,  দেওয়ালে সর্বত্রই অক্সিজেনের অভাব। ঘুম পেয়ে গেলেও তিন্নির দুচোখের পাতা এক হতে চাইত না। ঝাঁকরা চুলের লোকটার সাথে আরেকটা বেঁটে লোকও বাড়িতে আসা শুরু করেছিল৷ এই লোকটিরও কপালে বৈষ্ণব তিলক কাটা। তিন্নির শরীর যখন ব্যথায়, যন্ত্রণায় চিৎকার করত, তখন এই লোকটাও মাদলের ভয় দেখাত তিন্নিকে। তারপর জামা পড়ে নিয়ে কপালের চন্দনটা এঁকে নিত নতুন করে। ঝাঁকরা চুলের লোকটা তখন মায়ের ঘরে থাকতে শুরু করেছে। দিনভর চলছে কীর্তনের মহড়া। নতুন নতুন বায়না আসছে অনেক। মা তিন্নিকে শেখানোর চেষ্টা করেছিল, তিন্নি একটা গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ মুখস্থও করেছিল খানিকটা –

“আজ হাম কি পেখলু নবদ্বীপচন্দ্র,
করতলে করই বদন অবলম্ব।
পুনঃ পুনঃ গতায়ত করু ঘরপন্থ,
ক্ষণে ক্ষণে ফুলবনে চলই একান্ত৷ “

কিন্তু গাইতে পারত না। মাদল বাজতে শুরু করলেই ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, নিজের জন্য, মাদলের ভেতরে থাকা মানুষগুলোর জন্য।

আজ রাতেও সেই কাল্পনিক মানুষ এসেছে তিন্নির কাছে। আজও নক করতে ভুলে গেছে সে। অথবা ইচ্ছে করেই করেনি। কিন্তু আজ ওর হাতে সেই পুরনো জ্যামিতি বক্স। মানুষটা বলল –

” দ্যাখো শর্বরী, আজ তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা এনেছি৷ তুমি ছেলেবেলায় যেটার থেকে চোখ সরাতে পারতে না… ”

” কেন এনেছ ওটা?  আমার জীবন থেকে ও তো কবেই হারিয়ে গিয়েছিল।”

“লোহা-ভাঙা-টিনা-ভাঙা” হেঁকে যাওয়া একজনকে মা দিয়েছিল ওটা। তিন্নি তখন স্কুলে। বাড়ি ফিরে দেখেছিল তার পড়ার টেবিলে সে বাক্স নেই৷ কাউকে বলেও কোনো লাভ নেই সে বাড়িতে। একজন তিন্নির ত্রিসীমানায় আসে না। আর অন্যরা দরজা বন্ধ করে তিন্নিকে জীবনের পাঠ শেখায়। এই দোলাচলেই হারিয়েছিল ওর প্রিয় মাছ।

” আজ এই মাছের জন্মদিন শর্বরী৷ ওর ধূসর আঁশ এবার খসে যাবে, তখন দেখবে কেমন সোনালি ঝিলিক।  মাছেরা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয় ”

” আমি জানতে চাই না, তুমি ওটা ফিরিয়ে নিয়ে যাও৷ আমার কাছে এলে কোনও মাছ বাঁচবে না, তুমি প্লিজ ওটা নিয়ে যাও ”

” আর কতদিন জলের ভয়ে মাছকে দূরে রাখবে তিন্নি!  ধূসর আঁশ খসানোর সময় এলে তাকে সমুদ্রে যেতে হয়। যে এঁদো পুকুরে তার জন্ম, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে৷ তবে স্মৃতির আঁশগুলোও তো ঝরানোর প্রয়োজন পড়ে!  ”

” তুমি কে বলো তো?  আজ তোমার গলা বড্ড চেনা চেনা লাগছে।

কী হল?

বলো…”

ওপার থেকে কোনো উত্তর এলো না। তিন্নি জানে এ কন্ঠস্বর তার বাবার৷ তবে কি লোকটি হরবোলা?  ক্যালেন্ডারের লাল দাগ দেওয়া তারিখ থেকে এমন শব্দ খুঁটে আনা সহজ কাজ নয়৷ লোকটি কি জাদুকর?  নইলে পা দুটো আজ এত হালকা মনে হচ্ছে কেন শর্বরীর?  কেন ওদুটো জুড়ে গিয়ে একটা পাখনার আকার নিচ্ছে? চোখদুটো জ্বালা করছে ভয়ানকভাবে৷  আঁশটে গন্ধে ভরে গেছে সারা ঘর। আঁশ ঝরিয়ে দেওয়ার সময় এমনই তো হয়,  বলেছিল লোকটা। তবে কি লোকটা কোনো প্রাণীবিদ?

তিন্নির যেন মনে হচ্ছে,  আজ বুধবার। সিধুদা আজ আর ফুলের প্যাকেটটা ঝুলিয়ে যাবে না দরজায়। কারণ, আজ ভোরের ডাউন ট্রেনে কোনো ফুলের ঝাঁকা উঠবে না। আজ বাবার সাথে মোল্লারহাটে যাবে তিন্নি। সকালের পায়রা ওড়া পিচ-ওঠা রাস্তা দিয়ে ওরা দুজনে চলে যাবে। ও আর ওর ক্যালেন্ডারে লাল কালির দাগে রঙিন হয়ে থাকা বাবা।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment