কী সুন্দর নাম স্টেশনটার! কুন্তীঘাট! একটা নদী বয়ে যাচ্ছে গা ঘেঁষে। নদীতে ঘাট, ঘাটে বাঁধা নৌকো। এখানে নেমে পড়লে হয়। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি পৃথিবীর সব স্টেশনে নেমে পড়া যায়? সৃষ্টিধর যাচ্ছে এখন সমুদ্রগড়। পিসতুতো ভাইয়ের বাড়ি। সেখান থেকে নবদ্বীপ যাবে। ভাঙ্গা রাস দেখতে। ট্রেন চলতে শুরু করল। সৃষ্টিধরের হঠাৎ কী যে হল, একে ধাক্কা দিয়ে, ওকে গুঁতিয়ে সে নেমেই পড়ল কুন্তীঘাট।
তার যদিও যাওয়ার কথা সমুদ্রগড়। সেখান থেকে নবদ্বীপ গিয়ে ভাঙ্গা রাস দেখবে, কিন্তু তার বয়সী একটা লোক ভাঙ্গা রাস দেখতে ভায়ের বাড়ি যাচ্ছে- এটা কেউ ভালভাবে নেবে না। তাই সে তার যাওয়াটাকে একটা কেজো মোড়কে মুড়েছে। সঙ্গে করে অল্প কিছু টাকা এনেছে, ভায়ের সঙ্গে কাল হাটে গিয়ে কয়েকখানা শাড়ি কিনবে, তারপর সেগুলো বড়বাজারে দুলাল সাহার গদিতে বেচবে, বাড়িতে বৌ আর মাকে সেইরকমই বলে এসেছে সৃষ্টিধর। মা বলেছিল আজ তার চোখটা দেখিয়ে নিয়ে আসতে। বৌ বলেছিল ছেলের ইস্কুলে গার্জেন্স মিটিং এ যেতে। সৃষ্টিধর দুজনকেই বোঝাতে পেরেছে এইসব কাজের চেয়ে তার কাজটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাতে সংসারে দুটো পয়সা আসবে। শাড়ির ফল লাগাতে লাগাতে মা চুপ করে শুনেছে সে কথা, বৌ এক্টুখানি থমকে থাকার পর আবার ঘরররর করে সেলাই মেশিন চালাতে শুরু করেছে।
সৃষ্টিধর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই ঘরররর আওয়াজটা শুনতে পেল যেন। সে এদিক ওদিক তাকাল। নদীতে তো ভুটভুটি চলছে না। ঘাটে একটা নৌকো বাঁধা আছে, নদীতে আর একটা ভাসছে। আওয়াজটা তাহলে কোথা থেকে আসছে? সে পেছনে তাকিয়ে দেখল নদীর ধারে বট-অশত্থ জড়াজড়ি করে আছে। তার ডালে একটা পেল্লায় ঘুড়ি আটকেছে। সেটাতেই বাতাস বেঁধে ঘরররর আওয়াজ হচ্ছে। সৃষ্টিধরের মা বৌ এমনিতে খুব লক্ষ্মী। কোথাও বেরোনর আগে জোর করে ভাত খাইয়ে দেবেই। আজ সৃষ্টিধর খেয়ে এসেছে ডাঁটা দেওয়া মাসকলাইয়ের ডাল, গন্ধপাতার বড়া আর সোয়াবিনের রসা। আগে সোয়াবিন তার ভালো লাগত না। কিন্তু বৌ তাকে বুঝিয়েছে কম পয়সায় এমন প্রোটিন আর হয় না। তার মা যত বুড়ো হচ্ছে, রান্নার হাত তত খুলছে। কিন্তু এখন প্রায় একটা বাজে, সৃষ্টিধরের সে ভাত কখন হজম হয়ে গেছে। তার ওপর শিয়ালদায় ট্রেনে উঠতে যা ধস্তাধস্তি করতে হল। কলকাতা থেকে এত লোক নবদ্বীপের ভাঙা রাস দেখতে যায়, তার ধারণা ছিল না। সে মারপিট করে উঠে একটা সিটে বসতে যেতেই, একটা ছেলে গোটা সিটে গামছা বিছিয়ে দিল। সে, তার বৌ, দুই ছেলে, শ্বশুর শাশুড়ি সব চলেছে নবদ্বীপে, সেখানে শালির বাড়ি উঠবে। গলার শির খিঁচিয়ে বিস্তর চেঁচামেচির পর সৃষ্টিধর কোনরকমে একটু বসতে পেল। তাও একেবারে ধারে, শরীরের অর্ধেক বেরিয়ে রইল। গায়ের ওপর একটা খান্ডার মেয়েছেলে সেঁটে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ কাঁই কাঁই করে নব্দবীপে যে বাড়িতে গিয়ে উঠবে, তার এলাহি ঘরদোরের বর্ণনা দিয়ে গেল। কাঁধের ওপর আর এক মহিলা ব্যাগ রেখেছে, কারণ ওপরের তাক আর মেঝেতে আর রাখার জায়গা নেই। এইভাবে নট নড়নচড়ন হয়ে চার ঘণ্টার রাস্তা যাওয়া যায়? অন্যসময় হলে সৃষ্টিধর উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটিকে বসতে দিত। কিন্তু উঠে দাঁড়াবেই বা কোথায়? তাছাড়া আজকাল বেশিক্ষণ দাঁড়ালে কোমর থেকে পায়ের পাতা অব্দি একটা বিশ্রী যন্ত্রণা হয় তার।
নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিধর কোমরটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কোমর, ঘাড়, মাজা সব টনটন করছে। সেইসঙ্গে পেয়েছে ভয়ানক খিদে। আজ ট্রেনে এত ভিড় ছিল যে একটা হকার পর্যন্ত উঠতে পারেনি। নইলে এ লাইনে দিলখুশ, কচু ভাজা থেকে শুরু করে মিস্টি, শিঙ্গাড়া কী না পাওয়া যায়। সৃষ্টিধর চারদিকে তাকিয়ে দেখল কোন দোকানপাট আছে কিনা। একটা ঝুপড়িতে কয়েকটা বিস্কুটের বয়াম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সব শুনশান। সামনের বাঁশের মাচায় সম্ভবত দোকানদার চোখ গামছায় ঢেকে ঘুমোচ্ছে। পুরো দৃশ্যটির মধ্যে এমন এক নির্জনতা আছে যে দেখে খুব ভালো লাগল সৃষ্টিধরের। ঘাটে বাঁধা নৌকোটির মাঝিও ঘুমোচ্ছে। নদীর ধারে একটি শিশু ভাঙা কলসির কানা দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে একমনে খেলছে, কিন্তু সে খেলাও নিঃশব্দে ঘটে চলেছে। দূরে একটি কুটিরের সামনের পইঠেয় বসে একটি বৌ একমনে চুল আঁচড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে কাঁকুইটি চোখের সামনে এনে দেখছে আর দুই দাঁড়ার মাঝখান থেকে উকুন টেনে টেনে বার করে করে মারছে। চারদিক এত নিস্তব্ধ যে তার উকুন মারার ‘কুট’ শব্দও এখান থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সৃষ্টিধর। ‘কুট’ আর কাটা ঘুড়ির ঘরররর – এই দুটি শব্দ ছাড়া চরাচরে আর কোন শব্দ নেই। সৃষ্টিধর ভাবল ঘুড়িটা আর কতদিন নদীর এই হাওয়ার মুখে টিকে থাকবে। অবশ্য এটা পুরো ছিঁড়ে যাবার আগেই, নতুন একটা ঘুড়ি এসে আটকে থাকবে ঠিক।
সৃষ্টিধর তার কাঁধের ঝোলায় হাত ঢোকাল। জল খাবে। আসার সময় দেখেছে বৌ একটা জলের বোতল ঢুকিয়ে দিয়েছে। বোতল বার করতে গিয়ে হাতে একটা প্লাস্টিক খচমচ করে উঠল। এটা আবার কী? বার করে দেখল কাঁচকাগজের মধ্যে কাগজ দিয়ে মোড়া চারটে রুটি, যাদের বুকে লুকোনো ভেন্ডি ভাজা আর পটল ভাজা। সৃষ্টিধরের চোখে জল এল অমনি।
তার বৌ আজ মাকে নিয়ে চোখের ডাক্তারখানায় যাবে। বিশাল লাইন পড়ে। লাইনে মাকে বসিয়ে, নম্বর নিয়ে সে যাবে ছেলের ইস্কুলের মিটিং এ। ছেলের মাথা ভালো কিন্তু বড় ছটফটে। ওর নামে আন্টিদের এক রাশ নালিশ। সেসব চুপচাপ শুনে সে আবার আসবে ডঃ সুজয় চ্যাটার্জির চেম্বারে। ততক্ষণে যদি ডাক আসে তো ভালো। নইলে বসে থাকবে ঠায়। তারপর শাশুড়ি আর ছেলেকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। শুধু তার জন্যে আজ তার বৌয়ের মেশিন বন্ধ থাকবে। একবেলার রোজগার নষ্ট। রুটি খেতে খেতে তার গলায় আটকে যায়। এক ঢোক জল খায় সে। একবার ভাবে একটা রুটি বাচ্চাটার হাতে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু বাচ্চাটার খেলার মগ্নতা দেখে দেয় না। ভিখারি বালক কখনো তার খেলায় এত ডুবে থাকতে পারে না।
ঘড়ি দেখে সৃষ্টিধর। এতক্ষণে সমুদ্রগড়ে পৌঁছে ভায়ের বউয়ের বাড়া ভাত খাবার কথা তার। এমন অকাজের অতিথিকে কেউ ভালবেসে ভাত বেড়ে দেয় না, কিন্তু পিসি এখনও বেঁচে আছে বলে ও বাড়ির দরজা এখনও বন্ধ হয়নি সৃষ্টিধরের সামনে। গিয়ে দু-তিনদিন কাটিয়ে দিতে পারে দিব্যি। ব্যবসাঘরের মেঝেতে পুরু গদির ওপর বিছানা পাতা। সারা ঘরের দেওয়াল জুড়ে শো কেস ভর্তি শাড়ি আর মোটা মোটা খাতা । সৃষ্টিধর গেলে ওখানেই শোয়ার ব্যবস্থা হয়। ঘুমোনর আগে অব্দি পিসি বকবক করে। এ বাড়িতে কেউ পিসির সঙ্গে কথা বলে না, সৃষ্টিধর লক্ষ্য করেছে। সেই হিসেবে তার যাওয়ার একটা সার্থকতা আছে। তবে সেটা বউয়ের একবেলার রোজকার বন্ধ না করে গেলেই ভালো হত বোধ হয়।
বুকের মধ্যে খচখচানিটা যায় না সৃষ্টিধরের। এই বুড়ো বয়সে তার ভাঙা রাস দেখার শখ জাগল কেন? এলই যখন ছেলেটাকে তো আনতে পারত। নিয়ে এলে এই নদীটাও দেখতে পেত। বেশ নদী। নাম মনে হয় কুন্তী। কুন্তী নামের মেয়েরা খুব দুখী হয়। নদীটাও কি খুব দুখী? নদীর বুকে সবাই দুঃখ ঢালতে আসে। নদী কখনো নিজের দুঃখের কথা কাউকে বলে না। বললে সৃষ্টিধর শুনতে পারত। পৃথিবীতে তার মতো হাতে সময় আর কার আছে?
চাকরিবাকরির চেষ্টা করতে করতে একদিন সে চেষ্টার শেষ হয়, তখন বিফল মানুষ টুকটাক ব্যবসাপাতির চেষ্টা করে। সৃষ্টিধর সে দুটো ঘাটই পেরিয়ে এসেছে। তার চেনাশোনা মানুষেরা জেনে গেছে সৃষ্টিধর যেমন কোন চাকরি যোগাড় করতে পারেনি, তেমনি কোন ব্যবসাও তার দ্বারা হবে না। আশ্চর্যের কথা, এর পরেও সংসারে বা সমাজে সে হেলাফেলার লোক হয়ে যায়নি। হলে কি বৌ জলের বোতল, রুটি ব্যাগে ঢুকিয়ে দিত? আসলে সৃষ্টিধর এমন একটা কাজ পারে, যেটা আর কেউ পারে না। সে, লোক যেটা খুঁজছে, সেটার কাছে তাকে পৌঁছে দিতে পারে। কেউ মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজছে, কেউ বাগানে বাহার করার জন্যে চিনা ঘাস খুঁজছে, কেউ তার পুরনো গাড়িটা ভালো দামে বেচতে চায়, কেউ নতুন দামি গাড়ির জন্যে বিশ্বস্ত ড্রাইভার খুঁজছে- সৃষ্টিধর এই যোগাযোগগুলো ঘটিয়ে দেয়। তার বিশেষত্ব হল, সে এইসব করে কারো কাছে কিছু চায় না, কিন্তু কেউই তাকে খালি হাতে বিদায় করে না। বরং চেয়ে যা পেত, আনেক সময় তার বেশিই পায় সৃষ্টিধর। তার কথা হল, টাকার জন্যে হ্যাংলামি করতে গেলে অনেক সময় টাকার চেয়ে দামি জিনিস ছাড়তে হয়। এই যে কলকাতার ঢাকুরিয়ার মতো জায়গায় তারা থাকতে পাচ্ছে, হলই বা মেঝের চল্টা ওঠা, আলো-বাতাস না ঢোকা ঘর, এদিকে ট্রেন লাইন, ওদিকে ঢাকুরিয়া ব্রিজ, বাস রাস্তা- এমন জায়গা, পয়সা ফেললেই কি সবাই পায়? এটা সৃষ্টিধর পেয়েছে নামমাত্র ভাড়ায়, এক বুড়িকে তার বহুদিনের পুরোন অর্শের অব্যর্থ ওষুধ যোগাড় করে দিয়ে। ছেলেকে ভালো ইস্কুলে ভর্তি করানো বউয়ের সেলাই মেশিনের সাধ্য ছিল না। সেও সৃষ্টিধরের কীর্তি। আর ওই সেলাই মেশিনটা তো… এরকমভাবে বললে তার কীর্তির এমন অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে শুধু তার সংসারে নয়, আরো অনেকের সংসারে। এই যে সমুদ্রগড় চলেছে সৃষ্টিধর, বছরে দু-তিনবার গিয়ে লোকের আতিথ্য নেওয়া কি আজকের দিনে সোজা কথা? বাবা-মাই ছেলেপিলের জন্যে মাগনা কিছু করে না, এ তো দূর সম্পর্কের আত্মীয়! সেখানে সৃষ্টিধর গেলে শুধু পিসির নিঃসঙ্গতা কাটে না, পিসতুতো ভাইয়ের বউটিও তার কাছে ঋণী। তার বহুবছর আগেকার প্রেমিকের কাছে থেকে যাওয়া কিছু চিঠি ও ছবি উদ্ধার করে সে তাকে লোকলজ্জা ও সংসার ভাঙার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সেই কারণে, সৃষ্টিধর গেলে বউটি একটু সিঁটিয়ে থাকে বটে, কিন্তু দুবেলা ভাতের থালা যত্নে সাজিয়ে সামনে ধরে।
চিঠি আর ছবি উদ্ধার কি পয়সা দিয়ে হয়েছে? পয়সা দিয়ে দুনিয়ায় সব পাওয়া যায় না-সৃষ্টিধরের এই তত্ত্বটি এইক্ষেত্রে আরেকবার প্রমাণিত। ভাইবউয়ের পুরোন প্রেমিকটি থাকে কাছেই , ধাত্রীগ্রামে। বিয়ে থা করেছে, দুটি সন্তান আছে তার। ছেলেটির জন্ম থেকেই হার্টে সমস্যা। এদিকে পাড়াগাঁয় থাকে, হিন্দি, ইংরেজি কিছুই জানে না, বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করার মতো অর্থ থাকলেও একা যাবার সাহস নেই তার। সৃষ্টিধর তাকে এমন লোক ফিট করে দিল, যে তিনমাস তাদের সঙ্গে ভেলোর থেকে সব ব্যবস্থা করে দিল। সেখানে অপারেশনের পর ছেলে অনেক সুস্থ। চিঠি আর ছবি তো ফেরত পেলই, লোকটি সারাজীবনের মতো কেনা হয়ে গেল সৃষ্টিধরের।
সৃষ্টিধরের কিন্তু মোবাইল নেই। বাড়িতে বউয়ের কাছে একটা আছে বটে, সেটার ব্যবহার অনেকটা ল্যান্ড ফোনের মতো। এইসময়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলহীন একটা লোক কীভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে যাচ্ছে? সৃষ্টিধর নাকি টের পায়। দুঃখী মানুষেরা তাকে মনের মধ্যে ডাক পাঠায়। যেমন এই নদীটা পাঠিয়েছে। রেলব্রিজের ওপর থেকে এই নদীটাকে সে অনেকবার দেখেছে। রোগাসোগা কিশোরীর মতো একটা নদী। এতদিনের মধ্যে আজি তার নেমে পড়ার ইচ্ছে হল। এ লাইনে সে বহুবার যাতায়াত করেছে। কিন্তু যেন এই প্রথমবার তার চোখে পড়ল কুন্তীঘাট বলে একটা স্টেশন আছে। কুন্তী তার কাছে চিরদুঃখী একটা চরিত্র। আর দুঃখী মানুষ তাকে বরাবর আকর্ষণ করে।
রুটি চারটে খেয়ে তার শরীর বেশ ঠান্ডা হয়েছে। চারটে নাগাদ এখান দিয়ে একটা ট্রেন যাবে, সে ঠিক করল সেটা ধরে সমুদ্রগড় যাবে। ভাঙা রাস দেখার তার দরকার নেই। ছেলেকে বাদ দিয়ে এমন আমোদ তার পক্ষে অনুচিত। কাল সকালে ভাইয়ের সঙ্গে হাটে গিয়ে কয়েকটা শাড়ি সে অবশ্যই কিনবে।
বট-অশ্বত্থের তলায় গামছা পেতে সে শুয়ে পড়ল। গামছাটা তার ব্যাগেই ছিল। নদী তার একদম পাশ দিয়ে বইছে। ইচ্ছে করলেই সে নদীর কাঁধে হাত রাখতে পারে কিংবা তার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিতে পারে।
সে জিজ্ঞেস করল , নদী, তোমার কীসের দুঃখ?
কোনও উত্তর এল না স্বাভাবিক ভাবেই।
আচ্ছা কী পেলে তুমি খুশি হও?
এবার কোন উত্তর এল না। শুধু ঝপাং করে একটা শব্দ হল। বাচ্চাটা যে ভাঙা কলসির কানা দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল সেটা জলে ছুঁড়ে ফেলেছে। তার মানে খেলা শেষ। খেলা শেষ হল কেন? কারণ কাঁকুই দিয়ে উকুন বাছা মেয়েটি তাকে ডাকছে ‘অ্যাই গোকুল ভাত খাবি আয়’ । সৃষ্টিধরের মনে হল ডাকার মতো কেউ থাকলে কারো কোন দুঃখ থাকার কথা নয়। নদীকে কি কেউ ডাকে? হ্যাঁ ঠিক, সমুদ্র।
তাই তো, সেই যে কবি মাইকেল লিখেছেন
‘প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারিরূপ কর তুমি।’
নদীকে তো সমুদ্রকে জলের খাজনা দিতে হয়। এ বেচারি কীভাবে সাগরে পৌছবে? অজপাড়াগাঁর ছোট নদী একটা!
সৃষ্টিধর তাকে জিজ্ঞাসা করে
-তুমি কি সমুদ্রে যেতে চাও?
নদী এবারো কোনও উত্তর দেয় না। সে, তার ঘাটে বাঁধা নৌকো, ঘুমন্ত মাঝি আর দুপুরের আকাশের মতো উদাসীন বইতে থাকে।
গোকুল নামের বালকটি মায়ের ডাকে খেতে যায়, নদীর পাড়ে এখন একা সৃষ্টিধর। সে তার গামছাখানি পাট করে ব্যাগে ঢোকায়। রুটি রাখার কাঁচ কাগজটি সযত্নে মুড়ে রাখে। এ মহাবিশ্বে কিছুই ফেলনা নয়। হঠাৎ দেখে কাঁচকাগজের মধ্যে আর একটা তেলছোপ লাগা কাগজ। সে ওটা বার করে আনে। ওহ, এতে তো রুটি আর ভাজি মুড়ে দিয়েছিল বৌ। লাইনটানা কাগজে নীল জেল পেনে লেখা কচি হাতের অক্ষর দেখে তার কৌতূহল হয়। বউয়ের কাণ্ড, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ছেলের খাতা থেকে ছিঁড়ে দিয়েছে। অবশ্য তারিখ দেখে বোঝে এটা আগের ক্লাসের খাতা।
‘তোমার দেখা সমুদ্র শহর’ ৮ থেকে ১০ লাইন লিখতে বলা রচনায় একটি বাক্যই লিখেছে ছেলে। ‘আমি জীবনে কোন সমুদ্র দেখিনি।‘ লিখে আবার নিজেই কেটে দিয়েছে। নিশ্চয়ই এটা জমা দেয়নি। ওর মা বানিয়ে বানিয়ে কিছু লিখে দিয়েছে। কেটে দেওয়া লাইনটা চাবুকের মতো সৃষ্টিধরের মুখে এসে লাগল।
সৃষ্টিধর ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ল। তার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। এই জল তো মাটিই শুষে নেবে। নদী পর্যন্ত পৌঁছবে না।
সৃষ্টিধর দেখে কুটিরটিও ভরাপেট মা-ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আস্তে আস্তে কুন্তীঘাট স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে নদীটাকে দেখা যাচ্ছে, তবে তাকে দুঃখী ভাবার সাহস আর সৃষ্টিধরের নেই।
সে টিকিট কাউনটারে গিয়ে ঢাকুরিয়ার টিকিট কাটে। ট্রেনের এখনও অনেক দেরি। বাড়ি পৌঁছতে মেলা রাত হয়ে যাবে। এত রাতে পৌঁছে সে বৌ বা মায়ের কোন কাজেই লাগবে না। না লাগুক, ছেলেটাকে বুকে চেপে ঘুমোতে তো পারবে। গভীর রাতে সমুদ্র গর্জনের মতো বউয়ের সেলাই মেশিনের ঘরররর শব্দ ওদের ঘুমের ওপর আছড়ে পড়বে। অন্ধকার ঘরে তা অস্পষ্ট শুনে ছেলেকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরবে সৃষ্টিধর।