১২.
বিপুল অবাক হয়ে শুনছিল অস্থির মিঞার কথা। অতীন হতবাক। বিপুলের মনে হলো এ সেই অথৈচন্দ্র, হাতিখেদা থেকে বেঁচে আছে এতকাল ধরে। তা না হয়ে হয় না। সুধীন্দ্রর কাহিনি আর অতীনের কাহিনি যেভাবে এক হয়ে যায়, ঠিক সেই ভাবে এর কাহিনি আরো কিছু উপাদান যোগ করে দিল মৈমনশাহী পালায়। অস্থির মিঞা বলছে সেই মেয়ে লীলাবতী না লীলাময়ীর রোষ ছিল খুব। তার মা জননী গারো পাহাড়ের মেয়ে, এই কংস নদীর ধারের এক বামুনের পোলার হাত ধরে নেমে আসে, তার ভিতরে পাহাড় ছিল।
সেই কইন্যা ডাকসিল হস্তী, তুমু ঠিক বলতিস ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
বেঠিক বলব কেন, তারে হস্তী নিয়ে পাহাড়ে চলি যায়, এইটুকুন আমার জানা। অস্থির মিঞা বলে।
এই পালা কেডায় লিখসে ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার।
অস্থির মিঞা তার বাদামী চক্ষু স্থির করে থাকে চন্দ্রকুমারের দিকে। উত্তর দেয় না সঙ্গে সঙ্গে। তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে আছে সকলে। সে সকলের মুখ দেখে ধীরে ধীরে বলে, কোনো এক পালাকার হবে, মুদের ইদেশে তো কবি আর পালাকারের অভাব নাই, কাজ নাই তো কিসসা লেখ, যত কিসসা, তার চেয়ে বেশি কিসসাদার, কবি, একই কিসসা কতরকমে লিখা হইসে, আর হইসে বলেই জানা গেল।
সেই পালাডার নাম কী ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
অস্থিরচন্দ্র বলে, তা জানা নাই, তবে এই রকম হইসিল, হস্তীর বিংহিত শুনি, দুই রাজাকার, খালেক আর মালেক লেজ তুলে তিনদিন ধরে দৌড়ইসিল, আর পাকিরা হাতির পায়ের নিচে মরিসিল কত, তারা সব যেদিক পারে পলাইসিল, তারপরে আর ঢুকে নাই।
লীলাবতীর কী হলো ?
সে তার জননী পাহাড়ে ফিরি গেল, মানে হাতিরা তারে নি গেসে বলে শুনা যায়।
জননী পাহাড় ! অবাক হয়ে বিপুল জিজ্ঞেস করল।
জ্বি, তাইই শুনা যায়, অনেক পাহাড়ের ভিতর জননী পাহাড় রয়েসে, সেখেনে মা জননীর সন্তান ফিরে গেসে, লীলাবতীর বামুন সোয়ামী তারে ঘরে রেখে গণনা করতি গিয়া ফিরে নাই, বামুন বুড়া লক, তার কিসুই সিল না যে যুবতির মন হরণ করতি পারে, বেটাসেলের ঐডা তো থাকতি হবে, নইলে মেয়েমানুষ তার বাধ্য হবে কেন, বুড়ার ঐডা লইট্যা মৎস্য হই গিসিল, খাড়ায় না। বলে অস্থিরচন্দ্র দাঁত বের করে হাসে, শালার বুড়ার শুধু মেয়েমানষির দিকি নজর, তারে কাদায় মুখ খুসে দিলি ঠিক হতো। বিড়বিড় করে মিঞা।
শেষ কথাটা শিহরিত করল বিপুলকে। তার মন বলছে এই বুড়ো সেই হাতিখেদা জোয়ান হাজং অথৈচন্দ্র না হয়ে যায় না। সে কোন দেশে এসে পড়ল ? রূপকথা, পরণকথা এমনি হয় ? এমনি মাটির মতো তা গায়ে লেপ্টে থাকে যুগ যুগান্ত ধরে।
তুমু মিঞা, তুমার নামডা আসলে কী ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
কেনে বলি নাই ? অস্থির মিঞা হেসে বলল।
তুমি অথৈ না অস্থির ? চন্দ্রকুমার ইমতিয়াজ জিজ্ঞেস করে।
যা বলবেন আফনে, অথৈ গাঙ তো অস্থিরই হয় বটে। বলল নদীঘাটের চা দোকানি অস্থির মিঞা।
অথৈ পুষ্করিণী ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার।
কমলা সায়র কি কাউরে স্থির রাখসিল মিঞা ? অস্থিরচন্দ্র জিজ্ঞেস করে, আফনে দুর্গাপুর যাসসেন, কমলা সায়রের কথা নিয্যস জানেন, রানি কমলার কথা, অধরচন্দ্র কবি লিখেসিল তা।
জানি, জানি। বলল বিপুল, কিন্তু আপনি কে , কাদায় মুখ খুসে দেওয়ার কথা বললেন যে।
চা দোকানি বলল,আমি বলসি, কখন বলসি ?
এখন বললেন যে ? বিপুল বলে।
বুড়া হইসি, কখন কী বলি মনে থাকে না। হাসে অস্থির মিঞা।
আমরা লীলাবতীর প্রেমের কথা জানি। বলল ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার।
জ্বি, জানবেন নিশ্চয়, না জেনে হবে কেন, আর এক কাপ করে বেল চা খাবেন ?
বিপুল বলল, দিন, কিন্তু এই কাহিনি কে লিখল তা জানা যাবে না ?
মিঞা বলল, হাওর বাওরের দেশ এইডা, কেউ না কেউ লিখসে, লিখেই যাসসে, মানষের চেয়ে পালাকার বেশি।
অতীন বললেন, লীলাবতীর কথা কেউ লিখে নাই, অথৈচন্দ্রের কথাও না, আমি পথ খুঁজে পাসসিলাম না, কী হবে লীলাবতীর, যৈবন বৃথা গেল !
আপনি মনে করেন এই কাহিনি সত্য ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
সত্যের চেয়েও সত্য। বিড়বিড় করলেন অতীন সরকার, চাপা গলায় বললেন, এর চেয়ে বড় সত্য আর হয় না। আমরা সেই হাজং, হাতিখেদা হাজং পুরুষের সমুখে বসে আছি বিপুলবাবু।
বিপুল বলল , তার রক্তের কেউ ?
না সে। অতীন যেন ঘোরের ভিতর থেকে কথার উত্তর দিলেন।
সে ! কত বছর গেছে , সে, দেড়শো বছর আগের কথা সে সব! বিপুল বলল।
তারও আগের হবে। এর সময় পরিমাপ করবে কে ?
তাহলে এ কে, এই অস্থির মিঞা ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
মৈমনসিংহ গীতিকায় যাদের কথা নেই।
সব কথা তো তারা লিখবেন না, অন্যরাও লিখবেন,তাঁরা লেখেননি বলে আর কেউ লিখছে। বিপুল বলে।
হুঁ, এ হলো হাতিখেদা হাজং অথৈচন্দ্র, যারে লিখা হচ্ছে এখন, চা দুকান করে বসে আছে।অতীন বললেন।
এত বছর কেটে গেছে……। বিপুল কথা শেষ না করতে পেরে চুপ করে যায়।
এ দেশে এমন হয়, কে কোথায় কত বছর নিয়ে বেঁচে আছে পরিমাপ করা যায় না। অতীন বললেন।
বিস্মিত আবেগাপ্লুত বিপুল বলল, আমি এ কোন দেশে এলাম ?
অতীন বললেন, আপনার দেশ, রানি কমলা, মলুয়া, মহুয়া, কাজলরেখা আর অথৈচন্দ্রের দেশ, তবে অথৈচন্দ্রর কথা লিখে নাই কেউ, কুমুদিনী আর রাশিমনি তবু জানে অনেক মানুষ, অথৈরে কেউ জানে না।
বিপুল তখন চাপা গলায় অস্থির মিঞাকে জিজ্ঞেস করল, অথবা জিজ্ঞেস করবে ভাবল, ত্রিলোচন বামুন যখন তালুকদারের বাড়ি গণনা করতে যায়, চিড়া আর সবরি কলা দিয়ে ফলার করে তোমার ছায়ায় বসে, তুমি তারে চিনতে পেরেছিলে মিঞা ?
বাদামি চোখের মণি নিয়ে অস্থির মিঞা তাকিয়েই থাকে। চোখ থেকে যেন তীরের মতো বেরিয়ে আসছে সূর্য রশ্মি। পুড়িয়ে দেবে, বিদ্ধ করে দেবে তাকে। তার মনে হতে লাগল সে কিছু আন্দাজ করতে চাইছে। বিপুলের গা ছমছম করে ওঠে। তাকে চিনতে পারল নাকি অস্থির মিঞা ? সে কে ? কোন টানে এল ফেলে যাওয়া এই দেশে ? সে কি রাজার গোমস্তা, রাজার সিপাই, নাকি মোহনগঞ্জের ভুমধ্যকারী যার বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল পলাতক অথৈ হাজং? অস্থির মিঞা কিছু আন্দাজের চেষ্টা করছিল। ইন্ডিয়ার এই লোকটা এতকাল পরে এখানে ফিরে এল কেন ? কী এর অভিপ্রায় ? থাকে কলকাতা, সে কতদূর ! তাহলে টঙ্ক আদায় করে বেড়াত নাকি এই লোক ? কী নাম ? বিপুইল্যা সোম ? সোম হইসিল সোমেশ্বরী, কেন হইসিল ? এ কি সেই সোম ? গোমস্তা সোম ? এই গোমস্তাই কি সঙ্গে দুই বন্দুকধারী সিপাই নিয়ে টঙ্ক আদায় করে বেড়াত। গণশা হাজং, তিরিশ মন ধান দিবা রাজারে, রাজার ধান রাজার খামারে পৌঁছয় নাই এহনো, চৈত্র মাস যায় যায়, ধান উঠিসে আঘুন মাসে, হেইরে হেই গণশা হাজং, দুনিয়া হাজং, মনা হাজং…। টঙ্কের ধান্য কবে দিবা রাজারে ?
আঁজ্ঞা, ধান হয় নাই, বানায় গিইসে সব, নিজদের পেটে খাওয়ার মতোও ধান্য নাই।
বানা হইবে শুখা হইবে, কিন্তুক ধান্য দিতাই হইবে, জমিন নিয়ার সময় চুক্তি সিল এইডা ?
হুজুর, উপায় নাই। গণশা হাজং বলে।
আইল আশিনারে পানি উভে করল তল।
ক্ষেত কিশ্যি ডুবাইয়া দিল না রইল সম্বল।। * * *
দুর, হাজঙের বিটা, ধান না দিবা তো ধান বিচা টঙ্কা দে। গোমস্তা ধমক দিয়ে উঠল।
এই মতে আশ্বিন গেল, আইল কাত্তিক মাস।
ঘরু শস্য ( সরিষা ) ক্ষেতে নাই, হইল সব্বোনাশ।।
লাগিয়া কাত্তিকের উম গায়ে হইল জ্বর।
বিনোদের ( হাজঙের ) মা কান্দে হইয়া কাতর।। ***
গোমস্তা বলে,
মিথ্যা কহ, মিথ্যা কহ, জিভ খসিয়া যাবে।
টঙ্কের উপর টঙ্ক সুদ, জমিন চলিয়া যাবে।।
কুথায় অথৈ হাজং, চাষা গেল কই ?
কুমরে বাঁধিব দড়া , না করো হৈ চৈ।।
অস্থির মিঞা বলে, আফনে যা খুঁজতি এয়েসেন, সব পাবেন আবার পাবেনও না, কী হবে কিসু বলা যাবে না। বিপুল চুপ করে কথা শুনতে থাকে। অস্থির মিঞা একটু থেমে আবার বলে, যেমন এই গাঙ, তেমনি মুদের পালা, শেষ নাই।
জ্বি, হাঁ, বয়ে চলেসে। বলল চন্দ্রকুমার, ডাক বাঙলোয় বসে আছে কেডা, না, মলুয়া পালার চান্দবিনোদ।
অস্থির মিঞা বলল, আপনারা কি আজ ফেরবেন সার ?
কেন, যদি কাল ফিরি, পরশু ফিরি, কদিন থাকি এখেনে।
আসসা ফিরুন, তবে কুয়ায় ফিরা যদি হয়, সাবধানে ফিরেন, বরং কুয়া কাটলি ফিরেন, এমন কুয়া আগের কালে দেখা দিত, পাহাড় থেকে নেমি আসত। বলল চা দোকানি, তারপর জিজ্ঞেস করল, ঢাকা থেকে আসতিসেন ?
না, নেত্রকোনা। বললেন অতীন।
উনি ইন্ডিয়ার ?
বিপুল বলে, হ্যাঁ, দেখতে এসেছি সায়র।
নেত্রকোনায় সেই চান্দবিনোদ বৈরাগী থাকে, তার গানের গলা খুব ভালো, বলসি তারে পাঠাতি পারবেন, আমরা মলুয়া পালা দেব পোউষ সংকেরান্তির দিনে, নবান্ন হবে হিন্দু মুসলমান মিলে। অস্থির মিঞা বলে, সতের রকম পিঠা হব, আসতি বলেন।
জান না মিঞা সে গায়্ না আর। ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল।
না যদি গায়, পালাডা বেঁচি থাকবে ? বলল অস্থির মিঞা!
ভয় পায় যে, পালার জন্যি ওর বাপ মরিসে। চন্দ্রকুমার বলল।
অস্থির মিঞা বলল, হাতিখেদা হাজঙের দেশ মুদের, যত ডরবেন তত পিছায় যাবে জননী পাহাড়।
বিপুল চুপ করে থাকে। সে বলবে কী ? বলার মতো কিছু নেই। কী খুঁজতে এসেছে জানে না বিপুল। সুধীন্দ্রকে খুঁজতে যে আসেনি তা বুঝতে পারছে এখন। সে কি অতীন নীতিন, দু ভাইকে খুঁজতে এসেছিল, না কি অস্থির মিঞা কিংবা চান্দবিনোদকে ? বকেয়া খাজনার কথা শোনাতে এসেছে নাকি বিপুল ? অকুস্থলে ফিরে এসেছে অপরাধী ? সে কি আমিন, মোহরার, পেশকার, গোমস্তা, মুন্সী, ত’সিলদারের কেউ ? কেউ তো নিশ্চয়। তার এক জেঠা রাজার কাছারিতে কাজ করত। ঠাকুরদাও। তারা অনেক ভূসম্পত্তি করেছিল। বিপুল তা জানে। জানে বাবাও হয়তো তাইই করত। দেশ ভাগ হয়ে গেল। দাঙ্গা লাগল। তারা ইন্ডিয়া চলে গেল সব কিছু ফেলে রেখে। বিপুল কংস নদী পার হতে এসেছিল ? নদী পার হয়েছে, এবার চলল বিরিসিরি হয়ে সোমেশ্বরী গাঙের পারে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের পথে। চুপ করে আছে বিপুল। অতীন এবং চন্দ্রকুমারও। সি,এন, জি চলল হেলেদুলে। কুয়াশা ঠেলে ধীরে ধীরে।
অতীন হাতিখেদা আন্দোলনের কথা বলছিলেন। হাতিখেদা আন্দোলন থামেনি, অনেক দিন পর্যন্ত তা চলেছিল। আসলে হাতিখেদা কাজটিই ছিল বেগার দেওয়া। হাজঙদের স্বার্থ ছিল না হাতি ধরায়। গারো পাহাড়ের বুনো হাতিকে তাড়িয়ে এনে নকল দুর্গের ভিতরে ঢোকাতে গিয়ে কত হাজং মরেছে হাতির পায়ের তলায় পড়ে তার ঠিক নেই। হাজং পুরুষদের পাহাড়ে চলে যেতে হতো বাড়িঘর ছেড়ে। মনা সর্দার মরল হাতি ধরায় না করতে। আগুনে ঘি পড়ল। হাজংরা হাতিখেদার বিরুদ্ধে মনে প্রাণে আন্দোলন গড়ে তুলতে লাগল। তার ফলে বহু পুরুষ ঘরছাড়া হলো, বহুজন রাজার সৈন্যর হাতে ধরা পড়ল। মরল অত্যাচারে। রাজার আয়ের উৎস ছিল হাতি বেচা। রাজা তা বন্ধ করবে কেন ? বরং বাধ্যতামূলক করে দিল। তাতে হাজংরা আরো উগ্র হয়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পাহাড়িয়া গারোরা। রাজার যে হাতি ছিল হাতিশালে, সেই সব হাতির মাহুত ছিল হাজংরাই। রাজার মাহুতরা হাজংদের আন্দোলনে মনে মনে ছিলই। তাদের একজন বীরাই হাজং মনা সর্দারের উপর হাতির পা তুলে দিয়েছিল রাজার আদেশে বন্দুকের গুলির ভয়ে। সেই সব মাহুতরা বিদ্রোহ করল। একদিন অতর্কিতে দুর্গাপুরের বারোয়ারি ময়দানে জমিদার বাহিনীর উপর হাতি লেলিয়ে দেয়। এর ফলে জমিদারের সেনাদের অনেকেই মারা যায় হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে। সুসঙ্গ রাজা ভয়ে নেত্রকোনায় পালিয়ে যায়। বিদ্রোহী হাজংরা চেংনী, আড়াপাড়া, ফারাংপাড়া, ধেনকী, বিজয়পুরের খেদাগুলি ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধ বেঁধে যায় জমিদারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। যুদ্ধ চলতে থাকে। বন্দুকের সামনে টাঙ্গি, তীর ধনুক নিয়ে কতদিন লড়বে হাজংরা ? কত হাজঙের রক্তে ভিজেছে এই মাটি। গোরাচাঁদ হাজঙকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাজবাড়ির ভিতরে পিটিয়েই মেরে দিল। অশান্তি চলছিল। ফলে ব্রিটিশ সরকার মাথা গলায় সুসঙ্গ দুর্গাপুরের হাতি ধরায়। ১৮৭৯ সালে হাতিখেদা আইন আনে মহারানির সরকার।
আপনি কি পালার ভিতরে এসব লিখছেন ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
লিখতে চাইব, পারব কি না জানি না, আমি কবি অধরচন্দ্র নই, চন্দ্রাবতী নই, আমি শুধু এই মাটিতে জন্মেছি মাত্র। বিড়বিড় করে বললেন অতীন সরকার, লিখতে চেষ্টা করব বলতে পারি।
অথৈচন্দ্র পালিয়ে হারিয়ে গেল কেন ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
তারে ফিরানো যেতেই পারে, কিন্তু হাতিখেদা আন্দোলন গিয়ে টঙ্ক প্রথা এল, তাতে মরল লোকে ভুখে আর অভাবে, সে ভুখেই মরত টঙ্ক না শোধ করতে পেরে। বললেন অতীন, আমি তারে নিয়ে কী করব বলুন, তার লীলাবতীরে তার কাছে ফেরান যাবে না, যেত কিন্তু তাতে সে এই দেশ ছেড়ে চলে যেত, এই পরিণতি এক পরিণতি, আসলে আমি তারে নিয়ে কিসুই ঠিক করতি পারতিসিনে।
হয়ে যাবে ঠিক। বিপুল বলল।
আমি জানি হয়ে যাবে, কিন্তু সে-ই চা-দুকানি হয়ে কংস নদীর পাড়ে বসে আছ, এইডা কি হতি পারে ? কথাটা বললেন অতীন অথবা বলেননি। কথাটা বিপুলের মনে এল শুধু। চুপ করে থাকে সে। সে বড় বড় আখ্যান লিখিয়েদের আখ্যান, উপাখ্যান নির্মাণের কথা পড়েছে। তা আসলে এক অনিশ্চয় যাত্রাই হয়ে থাকে। লেখক নিজেই জানেন না কতদূর যাবেন, কী করবেন তাঁর চরিত্রকে নিয়ে, সুতরাং অথৈচন্দ্রকে তার মতো থাকতে দেওয়া ভালো। সে নিজে যে পথে যাবে, লেখকও সেই পথে যাবেন। এই সাবেক মৈমনসিংহের মানুষ ঠিক করবে অথৈকে নিয়ে করবে কী। পূর্ববঙ্গ গীতিকার সবই তো এই মাটি থেকেই জন্মেছে। মাটির পুতুল বানিয়ে তার ভিতরে প্রাণ দান করেছেন পল্লী কবিরা। তাঁরা নিশ্চয় লিখবেন অথৈচন্দ্রর পরিণতি নিয়ে। অতীন তখন ইতিহাস শোনাচ্ছেন। ১৮৭৯ সালে হাতিখেদা আর ধরা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার আইন জারি করল, সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজা এক বছর আইন মেনে কাজ করল, তারপর হাতিখেদা তুলেই দিল। আইনে অনেক বিধি নিষেধ ছিল। তা রাজার মনোমত হয়নি যেমন, তেমনি আইনে এমন কিছু ছিল না যা উপশম করতে পারে হাজংদের উপর অবিচার। কিংবা রাজার নতুন সুবিধা। মহারানির শাসন তখন এদেশে, আইন ছিল এমন,
১। সোমেশ্বরী নদীর পূর্ব পাড় থেকে খাসিয়া হিল পর্যন্ত সুসঙ্গর অধিকার হাতিখেদানর। কোনো অজুহাতেই রাজা নদী পার হয়ে হাতিখেদা করতে পারবে না কিংবা সেখান থেকে হাতি তাড়িয়ে আনতে পারবে না।
২। ৩রা জানুয়ারি থেকে ১৫ই মার্চ অবধি ক্রমাগত হাতি ধরা চলবে, অন্য সময় রাজার সুবিধে হলে হবে।
৩। ন্যূনতম ৬ ফিট, হস্তি শাবক এবং ৮ ফিটের উপরে যে হাতি ধরা পড়বে, তা মহারাজের, মহারানির সরকার সেখানে দাবি জানাবে না।
৪। ৬ ফিট থেকে ৮ ফিট হাতি দু’ভাগে ভাগ হবে, এক ভাগ মহারাজ, আর এক ভাগ মহারানি মানে ব্রিটিশ সরকার। মহারানি যদি চান তবে রাজার হাতিগুলির অর্ধেক কিংবা সমস্ত হাতি প্রতি ফুট একশো টাকা মূল্য দিয়ে কিনে নিতে পারবেন।
ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ ভাবল এবার চাষারা আর হাজংজাতি সুখে বাঁচবে। হাজংজাতির পক্ষে আইন এনেছে মহারানি ভিক্টোরিয়া।
নতুন আইন কিন্তু হাজংদের কোনো সুবিধেই দেয়নি, তা টের পাওয়া গেল ক’দিন বাদে। তাদের ক্ষোভ চলতে লাগল। এরপর ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৪ সালের ১৯শে মে সুসঙ্গ রাজার কাছ থেকে খেদা তৈরির অধিকার নিয়ে নেয়। হাতি ধরা বন্ধ হলো রাজার অধীনে। হাতিখেদাও বন্ধ হলো। বন্ধ হতে রাজার আয় বন্ধ হলো। রাজার চলবে কী করে, খাজনা আদায় করতে হবে অনেক বেশি। রাজার কম বুদ্ধি! রাজার চেয়ে রাজার গোমস্তা, আমিন, মোহরার, তসিলদারের বুদ্ধি আরো বেশি। রাজাকে তারা বুদ্ধি দেয়, জমি সব বিলি হয়ে যাক বিনা নজরানায়।
নজরানা ছাড়া জমি বিলি করে রাজার কী লাভ ? গোমস্তা কি হাজংদের হয়ে কথা বলে ?
আঁজ্ঞে না, আমার নাম মাটিরাম সোম………। বিপুলের মনে কথার জন্ম হয়। মাটিরাম কি নদীরামের বড় ভাই ? তিনি তো সর্বেশ্বর সোম। এক ভাইয়ের ডাক নাম নদী, আর এক ভাই মাটি। কে দিয়েছিল এই নাম তা বিপুল জানে না। সুধীন্দ্রর বাবা জীবেন্দ্র, জীবেন্দ্রর বাবা মহেন্দ্র। তাঁরা রাজ কর্মচারী ছিলেন। বিপুলের মনে হলো তার প্রপিতামহ মহেশ্বর সোম আর রাজায় শলা- পরামর্শ হচ্ছে। সামনে আছেন মহেন্দ্র সোম। তাদের লতায় পাতায় সম্পর্ক। এক সময় একটি গাছেই জন্ম হয়েছিল দুজনের। তারা ভাগ হয়ে হয়ে আলাদা পরিবার।
মহেশ্বর বলল, জমি ফ্রিতে বিলি করে দিন মহারাজ, সঙ্গে শর্ত থাকবে।
মহেন্দ্র বলল, ফ্রিতে নিলে হাজং বেটারা, মুসলমান চাষারা তো বেহেস্ত হাতে পাবে, রাজার কী লাভ ?
মহেশ্বর বলল, ফ্রিতে দিলে সকলে চাষ করতে নেবে, বুঝবে না তারা কোন ফাঁদে পড়সে।
মহেন্দ্র বলে, ফাঁদ আবার কী, চাষ করবে, ফসলের ভাগ দিবে, যা হবে, আদ্দেক আদ্দেক, চাষার বেটারা হারামির হারামি, বছর বছর বলবে বানায় ধান গেসে, খরায় ধান গেসে, হুজুর পারব না ভাগ দিতি।
মহেশ্বর বলে, তা হবে না, জমি দেয়ার সময় চুক্তি করি নিতি হবে, খরা হোক, বানা হোক, তুমারে চুক্তি মানতি হবে, চুক্তির বাইরে যাওয়া চলবেনি, চুক্তি থাকবে এত ধান কিংবা তার মূল্য দিতে হবে।
ধান না হলি চুক্তি কী, বানায় ভাসলে বিটিশ সরকার মকুব করে দেবে খাজনা। মহেন্দ্র বলে।
উঁহু, খাজনার কথা উঠতেসে কেন, নিষ্কর জমির খাজনা হয় ? মহেশ্বর বলে।
নিষ্কর ! খাজনা নাই তো রাজার ঘরে আসবে কী ? মহেন্দ্র জিজ্ঞেস করে।
সুসঙ্গ রাজা তখন নিমীলিত চক্ষে ঘুমিয়ে আছেন না জেগে আছেন তা বোঝা দায়। মহেশ্বর আর মহেন্দ্র দুই গোমস্তার উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। হাতি কেনা বেচা বন্ধ হয়ে রাজার ঘুম গেছে, মহেশ্বর আর মহেন্দ্র এখন কী পরামর্শ দেয়, তাইই দেখার।
মহেশ্বর বলে, নিষ্কর বিলি করলে রাজার নামে শঙ্খধ্বনি হবে, প্রজারা তাদের ক্ষোভ ভুলি যাবে।
কিন্তু আয় হবে কী করে, জমির খাজনা ছাড়া কোন জমিদারি চলে, মহারানিরে খাজনা দিতে হবে তো রাজার, সে টাকা কেডা দেবে ?
মহেশ্বর বলল, হবে হবে, আগে নিষ্কর বিলি হোক।
ব্রিটিশ সরকারের খাজনা চৈত্র মাসের মধ্যে শোধ না করতি পারলি জমিদারি নীলামে ওঠবে।
তখন মহেশ্বর বলল, নিষ্কর বিলি হবে জমি, কিন্তু চুক্তি হবে টঙ্কের, দ্যাখেন আফনে কী হয়, কী হয় না।
১৩.
টংক হলো ধানের পরিবর্তে তার দাম। ধান কড়ারি খাজনা। জমি নিষ্কর বিলি হবে টঙ্কের চুক্তিতে। খাজনাই হলো ফসল। নিষ্কর মানে টাকায় খাজনা দিও না। কিন্তু চাষের খাজনা দিতে হবে ফসলে। ফসল তো নেবে রাজা। না করতে পারবে না কেউ। ফসল বেঁধে দেওয়া হলো। সোয়া একর জমির জন্য দিতে হবে পনের মন। টংক প্রথায় বিনি নজরানায় জমি নিয়ে চাষারা গেল ফেঁসে। খাজনার জমির খাজনা ছিল একর পিছু পাঁচ থেকে সাত টাকা। আর একর পিছু টংকের জমিতে দিতে হবে যে ধান তার দাম সতের টাকা। এ এক অদ্ভুত চুক্তি। সাধারণ খাজনার জমি থেকে এই প্রথায় একর পিছু এগার টাকা বেশি দিতে হবে। বিপুল শুনতে শুনতে, টের পায় মহেশ্বর ছিল অতি ধূর্ত এক গোমস্তা। টংক প্রথায় জমি বিলি করে লাখ টাকার হাতির চেয়েও বেশি আয় করার উপায় বাতলে দিল রাজাকে। রাজা চোখ মেলে তাকালেন। হাত তুললেন, তথাস্তু। রাজা বললেন, তুমি অতঃপর সোমেশ্বরী হইলে। মহেশ্বর সোমেশ্বরী। মহেন্দ্র সোমেশ্বরী। বিপুল টের পায়, তার বাবা নদীরাম সোমেশ্বরী সত্য গোপন করেছেন। কেন সোমেশ্বরী পদবী ব্যবহার করতে গর্ব বোধ করতেন। রাজার দেওয়া পদবী যে। হায় ! সোমেশ্বরীর আসল নাম যে সিমসাং, তা কোনোদিন শোনেনি সে বাবার কাছে।
সি,এন,জি, অটো ড্রাইভার হেলেদুলে যাচ্ছে, না পথ হেলেদুলে যাচ্ছে তা ধরা কঠিন। চালকের নাম হেলাল। হেলালুদ্দিন ফকির। সে কথা বলে কম। বলেই না প্রায়। কিন্তু আচমকা বলল, ই অঞ্চলে জ্বিনে ধরা মানষের সংখ্যা বেশি, তাই তো মাষ্টারমশাই ?
অতীন হাসলেন, বললেন, তোমার কি তাই মনে হয় ?
খুব মনে অয় স্যার, এই যে অস্থৈর্যা, অস্থির মিঞা, ওরে মু চিনি, মুর চাচির খালাতো ভাই, আগডুম বাগডুম কয়েই জেবন কাটায়ে দিসে, ওর ভাই, সুস্থৈর্যা, সুস্থির মিঞা তো কিতাব লিখে, কিতাব যারা লিখে তাদের জ্বিনে ধরে বলেই লিখে, অস্থৈরা বলে আর উয়ার ভাই লিখে, দুটারেই জ্বিনে ধরসে, হুজুরে বারণ করিসে, কিন্তু উয়াদের ভয়-ডর নাই। হেলালুদ্দিন বলল, ফিরার সময় যদি কয়ে যান, ইসব আগডুম বাগডুম কিসসা না কইতে, তবে উয়ারা বাঁচে, কী যে কয় সারা দিন ধইর্যা।
অতীন বললেন, তিনিও তো কিতাব লেখেন, তাঁরেও কি তাহলে জ্বিনে ধরেছে ?
হেলালুদ্দিন বলল, ইডা কি ক’ন স্যার, আফনেরা হইসেন শিক্কিত মানুষ, আফনে আর অস্থৈরা এক হয় না, চাষার পো চাষা থাকাই নিয়ম।
কেডা কইসে ? অতীন জিজ্ঞেস করলেন।
হুজুরে কইসে। হেলালুদ্দিন বলে, মুই তো জানি,
মেঘ ডাকে গুরু গুরু ডাক্যা তুলে পানি।
সকাল কইরা ক্ষেতে যাও আমার যাদুমণি।।
আশমান ছাইল কালা মেঘে দেওয়ায় ডাকে রইয়া।
আর কতকাল থাকবে যাদু ঘরের মাঝে শুইয়া।। * * *
চন্দ্রকুমার বল্লল, মলুয়া, তুই জানস ?
জানি, কিন্তু কইনা, এই যে এহন কইসি, ইটা ঠিক হয় নাই। বলে মুখে কুলুপ আঁটল হেলালুদ্দিন। তারপরে চন্দ্রকুমারের প্রশ্নে একটি কথাও বলল না। বিপুল বাইরে থাকিয়ে থাকে, গ্রামে গ্রামে গঞ্জে গঞ্জে গীতিকথা নিয়ে জন্মাচ্ছে মানুষ মানুষী। বাতাসে কমলা সায়র, মহুয়া, মলুয়ার গান ভেসে আছে কত রঙ নিয়ে। বিপুল রঙ দেখতে পায়। সাত রঙের গান। আহা, বিপুলের চোখে জল এসে যায়। মহেশ্বর সোমের পাপ ধুয়ে যাচ্ছে রঙের প্রলেপে।
আধ কিলো মিটার রাস্তা ভালো তো তিন কিলোমিটার খারাপ। এমনি, গ্রামের গা দিয়ে, মাঠের মধ্য দিয়ে, এঁকে বেঁকে রাস্তা চলেছে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের দিকে। গাঁয়ের বন-বাদাড়, বাঁশবাগান, ঘর-গেরস্থালি, সব ছেয়ে আছে কুয়াশায়। কিছু দেখা যায়, কিছু যায় না। যা দেখা যায় তা যেন অবগুন্ঠন সরিয়ে চোখ মেলেছে গৃহবধূ। বিপুল ভাবছে যে কাহিনি সে আন্দাজ করছে তা কি সত্য ? তাদের জমি ছিল, হাজং চাষায় চষত। তাদের বিলাস ছিল, হাজং চাষায় তার ব্যবস্থা করত। তারা রাজার আমলা-গোমস্তা ছিল, রাজাকে বুদ্ধি দেওয়াই ছিল আমলা গোমস্তার কাজ। সুতরাং টঙ্ক প্রথায় চাষ এল হাতিখেদা বন্ধ হওয়ার পর। বিপুলের পূর্বপুরুষ সোমেশ্বরী হলো। সি,এন,জি, হঠাৎ থেমে যায় চন্দ্রকুমারের কথায়। চন্দ্রকুমার বলল, দাদা, এসে গেসি।
কোথায় এসে গেছে তারা ? কিছু দূর গিয়ে কুয়াশা আরম্ভ হয়েছে। দুদিকেই তা। রাস্তার দুপাশই প্রান্তর কিংবা ধু ধু জমি তা আন্দাজ করা যাচ্ছে কুয়াশার ভিতরেও। ডান জমি বটে, কিন্তু তা প্রায় পতিত, উচ্চাবচ। চড়াইয়ের পর কুয়াশার পর্দা। চন্দ্রকুমার বলল, রানির সায়র। রানির সায়র, কমলা রানির সায়র! কই সায়র? ডান দিকে। তারা নেমে এল সি,এন,জি, থেকে। রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের জমির দিকে যাত্রা করে। যত এগোয় কুয়াশা সরে যায়। তারা দাঁড়ায়। দেখল দীর্ঘ এক উচ্চ মাটির ঘের। বাঁধের মতো। কুয়াশার ওপারেও আছে তা। সেই ঘেরের নিচে চাষ জমি। ঘের বাঁধ বহুদূর ওপারেও। চন্দ্রকুমার বলল, ঐ দূরে দেখুন সোমেশ্বরী নদী।
বিপুল বোঝে সে দাঁড়িয়ে আছে বুঁজে যাওয়া কমলাসায়রের পাড়ে। সেই পাড় ওপারে যেখান দিয়ে ঘুরেছে তারও বহুদূরে নদী আছে। আছে নদীর শাদা বালুরেখা। কুয়াশা কাটলে দেখা যাবে, বলল, চন্দ্রকুমার। বিপুল তাকিয়েই থাকল। দেখতে চায় কুয়াশা ভেদ করে। সেই সোমেশ্বরী নদী। দেখা যায় মনে মনে। দেখা যায় মনশ্চক্ষে। সায়রের গর্ভ ফুট পাঁচেক। রানির সায়র বুঁজে গেছে এত বছরে। সেই যে অনন্ত এক গহ্বর কেটেছিল শত শত মজুর, জল আর ওঠে না, সে যেন ছিল অতিকায় কবর, সহস্র সহস্র মানুষের জন্য কাটা গোর, তারপর রানির আত্মবিসর্জনে জল উঠল, আর কদিন বাদে সেই দিঘি মাঠ হয়ে যাবে। মাঠের নিচে ঘুমিয়ে থাকবেন রানি কমলা তাঁর চোখের জল নিয়ে। তখন একটা লোক, লুঙ্গি আর র্যাপার গায়ে বেরিয়ে এল বাঁদিকে যেখানে সায়র বাঁক নিয়েছে, আর কুয়াশার শুরু হয়েছে সেখান থেকে। সেখানে যে গাছগাছালি আর বাঁশবনের ভিতরে কুয়াশায় ছেয়ে থাকা লুকোন ভিটে, সেই ভিটে থেকে। লোকটা সায়রের পাড় ধরে আসতে থাকে। বিপুল তখন অনুমান করছিল কবি অধরচন্দ্র বর্ণিত সায়রের কথা। জলের ভিতরে জল ঘর। সেখানে থাকেন রাজা। রাজা আর আর শিশু পুত্র রঘুনাথ। দিঘিতে হারিয়ে যাওয়া রানি আসেন মাথার উপরের আকাশ থেকে ভেসে, অগ্নিপাট শাড়ি তাঁর অঙ্গে অঙ্গে পেঁচিয়ে। লোকটা এসে দাঁড়াল তাদের সমুখে, আফনেরা কারা , কোথা থেকে আসতেসেন ?
বিপুল দেখল লোকটার বয়স বছর পঞ্চাশের আশেপাশে। মাথায় চুল নেই। থুতনির নিচে কুচো দাড়ি। পাকা। চোখে চশমা। চশমার নিচে চোখের রেখা আঁকা। না, কটা চক্ষু নয়। কালো তার চোখের মণি। তার কথার জবাব দেয় চন্দ্রকুমার।
জবাব দিতে লোকটা বলল তার নাম আমিরুল বাশার। সে চন্দ্রকুমারকে চেনে। চন্দ্রকুমার হয়তো ভুলে গেছে, এখানে এসেছিল একবার, এই ছ-মাস আগে। চন্দ্রকুমার বলল, সে ছ-মাস আগে আসেনি, বছর দুই বাদে এল। তখন সেই আমিরুল বলল, সে এই সায়রের পাহারাদার। কেডা কহন আসে আর আসে না, তা সে ভালোই জানে। সায়রের কী পাহারা দেয় আমিরুল ? আমিরুল বলে, সায়র যাতে না-পাক না হয় তা দেখা তার কাজ, সায়র অতি পবিত্র।
বিপুল জিজ্ঞেস করল, আপনি কে ?
জ্বি, রানির আদেশে মুর বংশ এই কাজ করে।
রানির আদেশ ? রানি কবে কখন আদেশ দিইসে, তিনি তো সায়রে ডুবে যান। চন্দ্রকুমার বলে।
জ্বি, খোয়াবে আদেশ হইসে, তিন পুরুষ ধরে এই কাজ করে মুর বংশের কেউ না কেউ। বলে লোকটা, সেই আমিরুল বাশার বলল, আসেন রানির সায়র ঘুরে যান, ঘুরতি হয়।
না ঘুরলে ? অতীন জিজ্ঞেস করেন।
ঘুরার কথা কমলারানির কথা, না ঘুরা আফনের কথা, না ঘুরৎ যদি, রানির মনে দুঃখ দিবা, দিতি চাও তো দাও।
অতীন বলল, তাহলে ঘুরি, পাক দিই একবার।
দেন, তায় মঙ্গল হবে, মনোস্কামনা পূরণ হবে। বলল আমিরুল।
একের পিছনে অন্য। প্রথমে অতীন, তারপর চন্দ্রকুমার, তারপর বিপুল। বিপুলের পিছনে আমিরুল। তারা মস্ত দিঘি, কমলা সাগরের পাড়, যা ঢেউ ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে গেছে বৃত্তাকারে, তা পরিক্রমা আরম্ভ করে। কুয়াশার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। উপরে মেঘলা মতো আকাশ নিঝুম হয়ে ভেসে আছে। সূর্যের দেখা নেই। সকালের কুয়াশা মুছে রোদ উঠবে কি না বলা যায় না। এবার কুয়াশা বেশি হচ্ছে। এদেশে এমন হয়। কুয়াশা মানে কুয়াশার ভিতরে কিছু ঘটে যাওয়া।
কী ঘটে যাওয়া ? জিজ্ঞেস করল বিপুল।
আমিরুল বলল, জানিনে স্যার, কিছু হয়তো হবে।
এখন এই সায়রের কোনো রূপই নেই যা ছিল বিপুলের কল্পনায়। সুধীন্দ্রর উপাখ্যানে। সায়রের জল নেই, ঢেউ নেই, অতল নেই, তল নেই। বিপুল অবাক হয়ে মজে গিয়ে প্রায় মুছে যাওয়া দিঘির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। এই মাটির নিচে রানি কমলা ঘুমিয়ে আছেন, না কি ওই আকাশ জুড়ে ভেসে আছেন তিনি, পরনে অগ্নিপাট শাড়ি।
আমিরুল চাপা গলায় বলল, আফনেরে মু চিনিসি।
ঘুরে পেছন ফিরল বিপুল, চশমার ভিতরে যেন প্রাচীন চক্ষু তার দিকে স্পষ্ট চেয়ে আছে, বলল, আফনে তাঁর খুঁজে এইসেন তো ?
আমিই সে, তা কে বলল ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
সবার পিসনে রই গেসেন যে, মুরে যা জিজ্ঞেস করার করেন, কেউ একজন আসপে কলিকাতা থেকে তা আমি ভেবিসিলাম, তিনি তো কলিকাতার মানুষ ছিলেন।
তিনি কবে এসেছিলেন ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
কবে তা বলা যাবে না, তবে এইসিলেন। আমিরুল বলল।
সুধীন্দ্র সোম ?
তা বলতি পারব না, নাম জিগাইনি।
তিনি কোথায় গেলেন ?
আমিরুল বলল, বলতি পারব না, এই সায়রের পাড়ে শুয়ে থাকলেন তিনি।
তাই ? বিপুল দৃশ্যটি কল্পনা করে।
হ্যাঁ তাই, কমলারানি সায়রে ডুবে গেলি, রাজা যেমন পাড়ে শুয়েসিলেন, পুন্নিমের চাঁদ ফুরাল যতদিন, ততদিন, তেমনি। আমিরুল বলল, বসেন দাদাভাই, দুজন ঘুরে আসুন।
ওঁরা অনেক দূর চলে গেছেন। কুয়াশার ভিতরে ঢুকে মুছে গেছেন দৃষ্টি সীমা থেকে। বিপুল সামনের দিকে তাকাতে আমিরুল বলল, ওঁদের যাতি দিন, উঁনারা পিসনে ফেরবেন না, আমরা কথা কই।
বিপুলের মনে হলো আমিরুলের জন্যই এসেছে সে এতদূর। সুধীন্দ্র কি লিখেছেন তাঁর উপাখ্যানে যে রাজা একপক্ষ, পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত শুয়েই থাকলেন সায়রের পাড়ে ? যদি উঠে আসেন রানি। জলদেবতা যদি ফেরত দেন তাঁর গৃহলক্ষ্মীকে। তিনি তো ছিলেন টং ঘরে। কিন্তু আমিরুল বলে, সে তো পরৎ হইল, পুন্নিমে গেল, চাঁদ ক্ষয় পেতি লাগল একটু একটু, অমাবস্যার দিন রাজা নিজয় ডুবতি গেসে পানিতি, কিন্তু হয় নাই, পানি তাঁরে নেয় নাই, অন্ধকারে সায়রের দশা এমনি হই গিসিল মশায়, মুই শুনিসি তাঁর মুখে।
সুধীন্দ্র সোম ? বিপুল আবার জিজ্ঞেস করে।
তা জনিনি, কিন্তু তিনি এইসিলেন এক পুন্নিমের দিন, লম্বা, ময়লা পেন্ট আর জামা, মুখি দাড়ি, দেখলি বুঝা যায় বড় ঘরের মানুষ !
একা একা ?
জ্বি, হেঁটি হেঁটি এইসিলেন, কত পথ হেঁটিসেন, বললেন, সব তাঁর মনে পড়ি যাসসে, রানি কমলার সায়র বুঁজানো যাতে না হয় তাই তাঁর আসা। আমিরুল বলে।
বিপুল মনে মনে বলল, কমলা সায়রে তো আবার আবর্জনা পড়ছে, এতদিনে ভরাট হয়ে গেছে। হায় !
সেদিন মুই দেখি তিনি শুইয়া রইসেন সায়রের পাড়ে, তখন বেলা পড়ি আসতিসে, ঐ যে নিম গাছ দেখতিসেন, ওর নিচয়, রোদের তাতে ছায়া দিইসিল গাছ, মুই গিসি, জিগাইসি, আফনে কেডা, তিনি বললেন, কুমুদিনী, রাশিমনি হারাই গেসে সায়রের পানিতি। বলে চশমা খুলে চোখ মুছে নেয় আমিরুল, তাদের কথা কাউর মনে নাই।
এই খবর কি কেউ জানে না ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
তখন জানা সিল সকলার, এহন জানা নাই বলতি পারেন। বলল আমিরুল।
তা কী করে হয় ? বিস্মিত হয় বিপুল।
জ্বি, তাই হইসে। বলল আমিরুল, চন্দ্রকুমার ইমতিয়াজ কী বলল, সে আসেইনি এহেনে ছ-মাস আগে, অথচ এইসিল তা আমি জানি।
মিথ্যে বলল কেন ? বিপুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
জ্বি, মিথ্যা বলে নাই, ভুলি গিইসে। বলল আমিরুল।
কী করে ভুলে গেল ?
জ্বি, তা বলা যাবে না, কিন্তু তাইই হইসে, কমলারানির সায়রে একটা মানুষ এসা হুইয়ে রইসে, তিনি চখের পানি ফেলতিসেন রানির জন্যি, কিন্তু রানির নাম কুমুদিনী, রাশিমণি, যুদ্ধ করিসিল বিটিশের সঙ্গে, তাঁরে দেখতি লোক আসতিসে বিরিসিরি, বহেরাতলী, দুর্গাপুর থেকে, তিনি হুইয়া আসেন, যেমন বুদ্ধ ভগবান হুইয়া সিল এক বনের ভিতরে, মাথার উপরে পুন্নিমের চাঁদ, চাঁদের ক্ষয় হসসে, তিনিও ক্ষয় হসসেন।
ভগবান বুদ্ধের কথা আপনাকে বলল কে ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
জ্বি, গারো পাহাড়িয়ারা, তারা বলতি লাগল তাদের ভগবান এমনি হুইয়া ছিলেন শাল বনের ভিতর গাছের তলায়। বলল আমিরুল।
তারপর ? বিপুলের কথা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে।
তারপর জানা যায় না। আমিরুল মাথা দোলাতে থাকে, জানা যায় না।
কেন জানা যায় না ? বিপুল জিজ্ঞেস করে, উনি কোথায় গেলেন ?
জ্বি, সায়রে। আমিরুল বলল।
তার মানে ?
জ্বি, সে রাতি সায়রে পানি এসেসিল, সেই পানির শব্দ আমি ঘুম ঘোরে শুনিসি, সে সিল এক অমানিশি, আমি দেখলাম উনি নেমি যাসসেন সায়রের ভিতর, উনি সায়রে চলি গেসেন, উনি কুমুদিনী, রাশিমণি হাজঙের কথা বলতিসিলেন, কুমুদিনী টঙ্ক আন্দোলনে ছিলেন, রাশিমণিরে মারিসিল মিলিটারি, মুর কথা বুঝা যাসসে স্যার ? আমিরুল জিজ্ঞেস করে তাকিয়েই থাকে, যেমন তাকিয়ে ছিল কংস নদীর ধারে অস্থির মিঞা। আহা জ্বিনে ধরা অস্থৈর্যা। জ্বিন কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটাতে পারে।
চুপ করে বুঝতে চেষ্টা করছিল বিপুল। তার মনে হতে থাকে, এই লোকটি, এই আমিরুল বাশার তার অপেক্ষায় ছিল যেন। এই লোকটি তাকে চিনত। আমিরুল বলছে, সেই লোক নিজে নিজে এল, নিজে পানিতে নেমে গেল। আর পানিতে নেমে যেতে সেই লোক সব নিয়ে গেল।
কী নিয়ে গেল ? বিপুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, মাঠ-জমিন, গাছ-গাছালি, সবই তো রয়েছে দেখি।
জ্বি, সকলা সব ভুলে গেল।
তার মানে ? বিপুল বুঝতে পারে না কী বলতে চায় সায়রের পাহারাদার আমিরুল।
জ্বি, তিনি যে এইসিলেন, নিম গাছের নিচয় শুয়ে সিলেন, তা আর কারু মনে নেই, তাঁর সঙ্গে সেই সব কথা পানির ভিতরে চলে গেসে, অথৈ পানির ভিতরে চলি গেসে স্যার, আফনে জিগাস করুন কাউরে, বলতি পারবে না, আফনে শুনসেন তো বাণেশ্বর খবরিয়ার নাতির পুতি চন্নকুমারের কথা, ওই ইমতিয়াজ তো বলল সব ভুলি গিইসে, আবার জিগাস করুন, ওর মনে কিসু নাই। বলে আমিরুল উঠে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে, সায়র ঘোরবেন স্যার ?
চলেন ঘুরি। বিপুল ডাকে আমিরুলকে। আমিরুল মাথা নাড়ে। সে ঘুরবে না। পাড় ধরে সায়র ঘুরলে নাকি তার মাথা ঘোরে। সে রাতে বিশেষ ঘুমোয় না। কেন ঘুমোয় না, না, তার মনে হয় এক একদিন সায়রে পানি আসে। পানির শব্দ তার খুব ভালো লাগে। পানির উপরে বাতাস বইলে খলখল শব্দ হয়। আমিরুল বলে, তার মনে হয় একদিন তিনি উঠে আসবেন পানি থেকে।
বিপুল বলল, আমি চন্দ্রকুমারকে আবার জিজ্ঞেস করব ?
করেন স্যার, মু জিগাস করেসি, কিন্তু সে কিসুই মনে করতি পারে না।
চন্দ্রকুমার ও অতীন ফিরে এলেন। অতীন বললেন, ওপার থেকে নদীটা পরিষ্কার দেখা যায়, আজ কুয়াশায় তেমন দেখা যায়নি, নদী আগে অনেক কাছে ছিল, কুয়াশার দিনাও তখন দেখা যেত, এখন নদী সরে গেসে, একদিন নদী আরো সরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
জ্বি, তাই হয়, কিন্তুক সকলার অজানিতায় গাঙ নিকটেও ফিরে আসে।
আসে ! স্মিত হাসলেন অতীন সরকার।
জ্বি, সবাই যদি ভুলিও যায়, যা হইসিল, তারে না হইসিল করা যায় না, মুছি গেলিও তার থাকার কথা।
বিপুলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আকাশে ভগবান বুদ্ধের মতো চাঁদ, গাছ তলায় শুয়ে আছেন সুধীন্দ্র সোম। কমলা সায়রের নামের সঙ্গে তিনি কুমুদিনী রাশিমণির নামও জুড়ে দিয়ে গেছেন।
(চলবে)