রাণা রায়চৌধুরী

ভুতু

‘ভুতু কী করছে দেখতো?’

‘ভুতু সেক্স করছে।’

‘সেক্স করছে মানে?’ অস্মিতাকে প্রশ্ন করেও, অরূপ চুপ করে গেল। অরূপ ব্যাপারটা জানে। 

অরূপ এ ঘর থেকে উঠে ভুতুর ঘরে গেল। যা ভেবে ছিল, ঠিক তাই। ভুতু কাকা অরূপকে দেখে লজ্জা পেল। ‘কি করছিস ভুতু?’ ভুতু বালিশ সরিয়ে ওপাশ ফিরে শুল, বলল ‘এইই হে হে কিছু না’। ভুতু লজ্জা পেয়েছে। প্রতিবারই ভুতু এইরকম লজ্জা পায়। হাসে বোকার মতো। অসহায়ের মতো। যখন ঘরে কেউ থাকে না, ভুতু তখনই বালিশ দিয়ে ওই সব কান্ড করে। অরূপের ভুতুর জন্য খারাপ লাগে। বাইশ বছরের ছেলে, ওর এখন কলেজ পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, আর সে কিনা বালিস নিয়ে এইসব কান্ড করছে। হতাশ অরূপ ভুতুকে একটু আদর করে দেয়। ‘অঙ্ক করবি?’ ‘হ্যাঁ দাও, যোগ দাও, ইংরেজি দাও’। ভুতু খাতা এগিয়ে দেয়। অরূপ লক্ষ্য করে ভুতুর প্যান্ট তখনো উঁচু হয়ে আছে। 

অরূপ বলল, ‘ছবি আঁক, আঁকবি?’ ভুতু, ‘কী আঁকব?’ অরূপ, ‘সিনারি আঁক, পাহাড় নদী, সূর্য, নৌকো’ – তোর যা খুশি আঁক। ভুতু মোম রঙে আঁকতে লাগল সিনারি। ওর মনে অনেক সিন সিনারি আছে। জানে অরূপ, ভুতু দূরের এক দেশ আঁকছে, যেখানে গাছ আর গাছ, চিরসবুজের দেশ যেন, নদীর জলে তার সবুজ ছায়া। ভুতু এইসময় শান্ত নিষ্পাপ এক বালক। বালক? বালকই তো? মানসিক বয়স যার আট। বয়স বাইশ হলেও, ভুতুর মন সেই শিশুর মতো নিষ্পাপ। কিন্তু ওই যে শরীর! ভুতুর শরীরের বয়স – বাইশ। ফলে ওইসব কান্ড করে।

*** ****

ভুতু এক অশান্তি। ভুতু এক মনখারাপের নাম। সেদিন, অস্মিতা বলছিল – রুমকি নাকি (রুমকি অরূপ-অস্মিতার মেয়ে, বয়স এগারো) বলছিল, ‘যে মা জানো, ভুতু দাদা বালিশ নিচে দিয়ে উবুড় হয়ে ওঠানামা করছিল।’ অস্মিতা বেশ চিন্তা নিয়ে অরূপকে একথা বলেছিল। বলেছিল – ‘রুমকিও তো বড় হচ্ছে।’ আর কিছু বলেনি অস্মিতা। ইশারাই কাফি হ্যায়। অরূপ চুপচাপ শুনে এ-ঘর থেকে ও-ঘর, ও-ঘর থেকে এ-ঘর পায়চারি করতে থাকে। ভিতরে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ। পাড়ে আছড়ে পড়ছে। ভুতুর ওপর রাগ হয় তার। মায়া আসে পরে। 

অরূপ অফিস যাওয়ার সময় ট্রেনে ধাক্কাধাক্কি করে ওঠে, ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করে, আবার করেও না, মাঝেমাঝে মনে হয় পোস্টে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাক সে। আর যেন বাড়ি ফিরতে না হয়, যেন ভুতুকে নিয়ে সমস্যার সামনে তাকে আর না পড়তে হয়। যেন কোথাও চিরদিনের মতো হারিয়ে যায় সে। এইরকম মনে হয়, আবার হারিয়ে যাওয়ার দুঃখভরা ইচ্ছে, ভুতুর সমস্যা – এইসব তার মনের কোনো গোপন কোনে নিজে নিজেই হারিয়ে যায়। সে ফিরে আসে আবার বাড়িতে। দেখে ভাইপো ভুতু মায়ের কাছে বায়না করছে, ‘রং কিনে দাও’। ভুতুর মা অরূপের বৌদি, দাদা মারা গেছে অকালে। 

অফিসে সেদিন সিংহ বলছিল, ‘বেলপাতা খাওয়ান, দেখবেন সেক্স ফেক্স সব উধাও, সাধু-সন্ন্যাসীরা খায়।’ বলে খ্যাক খ্যাক করে সিংহ হাসছিল, সিংহ মানে বিল সেকশনের সৈকত সিংহ, লোকের সমস্যায় মজা পায়। ‘সেক্স কন্ট্রোল করা খুব ঝামেলার ব্যাপার। সেক্স। কেন যে ভগবান দিল… সাধুরা তো সেক্স ফেক্স পছন্দ করে না, ধ্যান বিঘ্ন হবে তাই পাহাড়ে জংগলে বেলপাতা খায়, আর ওই বেলপাতাই আবার শিবলিঙ্গের মাথায় দেয় লোকে।’ অরূপ তাকে জিগ্যেস করে নি, তবু সিংহ গায়ে পড়ে বকবক করে যাচ্ছে। অরূপ চুপ করেই ছিল, উত্তর দেয়নি, বিরক্তই লাগছিল তার।

ভুতুকে ছেঁটে ফেলা যাবে না। জীবনে এমন চিরস্থায়ী সমস্যা আসে, যাকে বাদ দেওয়া যায় না। তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভুতু মরে গেলে সে কষ্ট পাবে। ভুতুর অকাল মৃত্যু হোক – অরূপ কি খুব হতাশায়, খুব রাগে, দুঃখে কামনা করেনি? করেছে। সে কথা ভাবলে নিজেকে অপরাধী লাগে। ভুতুর মৃত্যু হোক, মরে যাক, এ-কথা এখনো যে মাঝেমাঝে মাথায় আসে না তা নয়, ‘রুমকি বড় হচ্ছে’ এখনো কানে বাজে। অস্মিতাও কিছু ভুল বলেনি। তবু ভুতু থাকবে না কোনোদিন, একথা সে ভাবতে পারে না। 

****** ***** *******

একটা যুদ্ধ লেগে যাক। অরূপ আর ভুতু দেশের জন্য যুদ্ধে যাক। ভুতুর হাতে মোম রঙের ছবির বদলে, স্কাই মানে আকাশ ডগ মানে কুকুর – এইসবের বদলে বন্দুক। ভুতুর মনে অসীম সাহস, ভুতু আর মানসিক প্রতিবন্ধী নয়, সে দেশ বোঝে বলেই না যুদ্ধে এসেছে। দেশ মানে নদী, পাহাড়, জংগল, অরণ্য, মানুষ- মানুষের ভালোবাসা, প্রেম – একসঙ্গে থাকা – সেই দেশের জন্য ভুতু আর তার কাকা যুদ্ধে এসেছে। 

এক গভীর জংগলে এক জলার ধারে শত্রুপক্ষের একজনের বা দুজনের বা তিনজনের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়েছিল। তাদের কারো চোখ নেই, কারো গলা কাটা, কারো পা নেই হাত নেই, হাতের আঙুলগুলো থ্যাতলানো, মুখ বিকৃত – ভুতু সেই মৃতদেহের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, মৃত্যুকে দেখে সে অবাক, সে ব্যথিতও কিছুটা। কাকা তার পাশে নেই, কাকা অরূপ অন্য অরণ্যে অন্য পাহাড়ে লড়াই করছে। ভুতু একা। হাতে তার বন্দুক। ‘এ বাবা, এরা মরে গেছে!’ রক্ত, লাল রক্ত। ঘাসে মাটিতে রক্ত মিশে গড়িয়ে যাচ্ছে, রক্তের ধারা যেদিকে যাচ্ছে, ভুতুর চোখও সেদিকে গড়াচ্ছে – রক্তের ধারা গড়াতে গড়াতে জলার জলে মিশছে। জলার জল কেমন ছবি আঁকার রঙে পরিণত হচ্ছে, জলার লাল রঙ দেখে তার ছবি আঁকতে ইচ্ছে হল। সে হাতের বন্দুকের দিকে তাকাল, বন্দুক ওই জলার লাল রঙে চুবিয়ে সে ছবি আঁকবে কিনা ভাবছে। কারা যেন তার দিকেই দৌড়ে আসছে। সে ভয় পেল।   

বিপক্ষের যোদ্ধাদের মধ্যে একজনের হাতে রুমকির কচি হাত ধরা। রুমকিকে দেখেই ভুতু চিনতে পারল। ‘বোন’! বোনকে সে অনেকদিন দেখেনি। সেই কবে সে আর কাকা দেশের জন্যে যুদ্ধে এসেছে। বোনের মুখটা সে ভুলে গিয়েছিল। দেখে মনে পড়ল। রুমকি অক্ষত। কিন্তু মুখেচোখে তার ভয়, আতঙ্ক। যদিও বিপক্ষের এক যোদ্ধার হাতে সে এমন করে ধরা যেন, রুমকি তারই মেয়ে, সে এই বালিকাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও রুমকি কাঁদছে। 

রুমকি যখন পড়ত, ভুতু তার বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলে, অস্মিতা রাগ করত। রুমকির পেন্সিল রাবার পেন্সিল কাটার ভুতু নিলে অস্মিতা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিত, এই কেড়ে নিলে ভুতু আরো জেদ ধরত। ভুতু কাউকে খুঁজে পেত না, যাকে সেও পাল্টা অভিযোগ জানাবে – ভুতুর মা ভুতুকেই বকত। কিন্তু রুমকিকে সে ভালবাসত- সেই ভালোবাসা অরূপ বুঝত। সে ভালোবাসা নিখাদ, সে ভালোবাসা নিষ্পাপ। 

সেই রুমকিকে যুদ্ধক্ষেত্রে, ওই জলা জঙ্গলে দেখে ভুতু অবাক। রুমকি কালো হয়ে গেছে। ওরা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহগুলোর কাছে এল। রুমকি বোধহয় তার ভুতুদাদাকে চিনতে পারেনি, বা খেয়াল করেনি। রুমকি ভয়ে আতঙ্কে চুপসে আছে। কাঁদছে, আবার চুপ করে যাচ্ছে। ওরা মানে, ভুতুর বিপক্ষের যোদ্ধারা তাদের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহগুলির কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর সারিবদ্ধভাবে প্রার্থনার ভঙ্গিতে যে গান গাইতে লাগল, তা প্রায় কান্নার মতো করুণ ও বিষাদময়। ভুতু ব্যাপারটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে, তার আট বছর বয়সী বুদ্ধি দিয়ে। সেও খুব ঘাবড়ে আছে, তারও মৃতদেহগুলি দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘কষ্ট হচ্ছে’ – এটা বোঝা যাচ্ছে তার চুপ করে ওইদিকে তাকিয়ে থাকা দেখে, মুখটা মায়া আর করুণায় ভরা। আসলে ভুতুর ‘আমরা-ওড়া’র কোনো বোধই নেই। সে শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষ বোঝে না। এই বন্দুক হাতে যুদ্ধে আসাটা তার কাছে একটা ভ্রমণ বা বেড়াতে আসা বা খেলা। আকাশে ধীরে ধীরে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উঠছে। সন্ধের নির্জনতা নেমে আসছে সেই অজানা অচেনা জলাজঙ্গলের পাহাড় ঘেরা স্থানে। 

ভুতুর এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্যে, এইরকম অসহায়ের মতো মানুষের থ্যাঁতলানো বিকৃত মৃতদেহ যে এসে পড়বে তা সে বুঝতে পারেনি। আসলে এই যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে কেউ ছেড়ে দিয়ে গেছে, যাতে যুদ্ধে সে মরে যায় বা শহীদ হয়। ভুতুর খেলা মানে তো – পাড়ার ছেলেরা যখন ক্রিকেট খেলত – রান নিত – আউট আউট বলে চিৎকার করত – সেই আনন্দের খেলায় সেও অংশগ্রহণ করতে চাইত- কিন্তু পাড়ার ছেলেরা তাকে নিত না। তাই সে ম্লান মুখে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। বাড়ি এসে মাকে বা কাকা অরূপকে বলত, ‘ওরা আমায় খেলতে নিল না’। তা শুনে অরূপের খুব কষ্ট হত। কিন্তু কষ্ট হলেও তার কিছু করার নেই।

ওরা মানে শত্রুপক্ষ, ওদের সহযোদ্ধা-বন্ধু মৃতদেহগুলোকে ঘাস মাটির ওপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে চলল, কোনো অজানা আস্তানায়। ওরা ভুতুকে বিপক্ষের যোদ্ধা হলেও, ভুতুকে কিছু বলেনি বা আক্রমণ করেনি। কিন্তু ওরা ভুতুকে আর রুমকিকেও সঙ্গে নিল। ধীরে গভীর জঙ্গলে ওরা প্রবেশ করছে। আকাশে ম্লান বিবর্ণ চাঁদ। জোনাকির ওড়াউড়ি, থমথমে আকাশ। জঙ্গলের কোনোদিক থেকে কারোর গান ভেসে আসছে, পুরুষ কন্ঠে। পরে একজন নারীও গাইছে সঙ্গে, ভেসে আসছে লতাগুল্মের এবং চাঁদের অল্প আলোর আড়াল থেকে – ‘আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনেএএএ – মন বান্ধিবি কেমনেএএএএ – আমার চোখ বান্ধিবি মুখ বান্ধিবি পরান বান্ধিবি কেমনেএএএ…’ ভুতুর গানটা মনে পড়ল। সে গাইত। সে শুনে শুনে গান তুলতে পারে অবিকল। হয়তো কথা তার একটু জড়ানো, কিন্তু তার গান শুনে কাকা অন্তত, মাঝেমাঝে কাকিমা অস্মিতাও বিহ্বল হয়ে পড়ত। তাতে ভুতুর মাও ঈষৎ গর্ব বোধ করত। সেই গান, অনেকদিন আগেকার গান, এই অজানা জঙ্গলের, থমথমে আলোআঁধারি ও লতাগুল্মের স্তব্ধতা এবং ভয়ার্ত জোনাকির আলো – এইসব ভেদ করে আসছে। 

ভুতুর হঠাৎ অনেকদিন বাদে মনে আনন্দ এলো। সেও গাইতে লাগল। প্রথমে গুনগুন, তারপর অল্প জোরে। বিপক্ষের সৈন্যরা গান শুনে পিছনে তাকাল। ভুতুর গান শুনে তারা প্রথমে একটু অবাকই হল। এই ভাষা, এই বাংলা ভাষা তারা জানে না। তবু ভুতুর মনে হল, ওরা আনন্দ পাচ্ছে। সে উৎসাহ পেয়ে আরেকটু গলা তুলল। অরণ্য জংগল, জঙ্গলের অন্ধকার তাতে নড়ে উঠল। এই প্রকৃতিও তাতে সাড়া দিতে লাগল। আকাশের চাঁদ ভুতুর গান শুনে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জ্যোৎস্না চারিদিকে তার মায়াবি আঁচল পেতে আছে যেন। বিপক্ষের সৈন্যদের পায়ের শব্দ এবং তাদের মৃত সহযোদ্ধাদের টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘষটানির সড়সড় শব্দে, আশপাশের বুনো শিয়াল চলে যাচ্ছে ঝোপের আড়ালে। ভুতুর গান শুনে রুমকিও যেন একটু সাহস পেয়েছে, সে এখন তার ভুতু দাদারই হাত ধরা। একদল যোদ্ধা নয়, একদল মানুষ হেঁটে চলেছে, নিকটেই আছে যেন এইরকম শান্তির সন্ধানে। ভোর হয়ে আসছে। তারা হেঁটেই চলেছে। 

ভুতুর গানে বিপক্ষের সৈন্যারও বাংলা ভাষা না জানলেও তারা গলা মেলানোর চেষ্টা করছে। সামনে একটা সরু অল্পজলের নদী। ভুতু ও সৈন্যদের গানে নদীর ওপর সুরের সেতু তৈরি হল। আকাশ গাছগাছালি বাতাসেও সুরের ক্ষীণ দোলা। রুমকি এইবার হাসছে। আনন্দ পেয়েছে। ভুতুরা বিপক্ষের সৈন্যদের সাথে, সঙ্গে ওই চার-পাঁচটি মৃতদেহও চলেছে সেতুর ওপর দিয়ে। তারা নদী পার হল। গানে গানে ‘আমার হাত বান্ধবি পা বান্ধিবি ইচ্ছা বান্ধিবি কেমনে, পরান বান্ধিবি চোখ বান্ধিবি মুখ বান্ধিবি কেমনে…’ মৃতদেহগুলিও যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। আসলে তারা মরেনি, মারা যায়নি, এই ইহজগত থেকে সাময়িক তারা অন্য কোথাও ভ্রমণে গিয়েছিল, তারা অচৈতন্য হয়েছিল। তাদের চৈতন্যকে ফিরিয়ে আনল ভুতুর মতো নিষ্পাপ, ভাল মনের এক বালকের (বালকই বলা হবে তাকে, যেহেতু তার মানসিক বয়স এখন দশ) গান। তার গান – সুরের সেন্স, উদাত্ত গলা, কথা যদিও ঈষৎ জড়ানো তার। মৃতদের শরীরে গান প্রাণ হয়ে ফিরে আসছে। সকালের উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠল। সূর্য নারকেল গাছ, তাল গাছের মাথা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে উঠছে, মৃতেরা সূর্যের আলোয় সতেজ হয়ে উঠছে। এই সকাল সুন্দর। এই সকাল নতুন সুরের জন্ম দিচ্ছে।  

****    *****   ***** ******  

মাঝে ভুতুর সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল। ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলছিল প্রায়। বাড়ির সবাইকে মারছিল এলোপাথাড়ি। বড়দের গায়ে হাত তুলতে নেই, সেই জ্ঞান তার নেই। তার নার্ভ তাকে হিংস্র করে তুলেছিল। বাড়ির লোক দিশাহারা। অশান্তি। যেন যুদ্ধ লেগেছে বিরাট। শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষের লড়াই। অথচ সবাই নিজের। শত্রু মিত্রটা মানুষ বানায়। এক্ষেত্রে ভুতুর নার্ভ বানিয়েছে – শত্রু মিত্র।  ভুতুর মা তাকে তো মেরে ফেলতে পারেন না। কোনো অষুধেই কাজ হচ্ছিল না। একদিন রাগে দুঃখে অভিমানে, তিনি ছেলেকে এক অজানা স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ভুতু আবার বাড়ি ফিরে এসেছিল।

এইসব ঘটনা অনেকদিন আগের। রুমকি এখন আরো বড় হয়েছে। সে ভুতু দাদাকে খুব ভালোবাসে। সে ক্লাস নাইন। ভুতুদাদাও আশ্চর্যজনক ভাবে, আগের থেকে অনেক সুস্থ শান্ত ভালো। একজন ডাক্তার বলেছিলেন বটে যে, ‘এই পেসেন্ট যত বড় হবে, ততো ভালোর দিকে যাবে, শান্ত হয়ে যাবে…’। এখন সেই ডাক্তারের কথা মনে পড়ে ভুতুর মায়ের। ঠাকুরের কাছে সে কৃতজ্ঞ, ভুতুর মা ঠাকুরকে পুজো দেন না, ধন্যবাদ দেন। ঠাকুর ছাড়া ভুতুর মার আর কোনও গান নেই, আশ্রয় নেই… এইভাবে ভুতুর সঙ্গে ভুতুর মাও বেঁচে আছে। অস্মিতাও এখন ভুতুকে খুব ভালবাসে। রুমকির ভালমন্দের খেয়ালও রাখে এখন ভুতু। মাঝেমাঝে স্কুলের বাস ধরার জন্য, বাস রাস্তা অব্দি এগিয়েও দেয়। বাসে ওঠার আগে সে রুমকিকে বলে সাবধানে যাবি, টা টা।  

অরূপদের বাড়িতে একটা নতুন তুলসি গাছ হয়েছে। নরম শান্ত এক তুলসি গাছ। তার নরম ডালে রোজ সূর্যের আলো এসে তার পাখা মেলে বসে। সূর্যের পাখামেলা আলোকে ভুতুর ফড়িং মনে হয়। সে মনে মনে শিশুও রয়ে গেছে কোথাও। ভুতু সেই শিশু যে সকালের রোদকে এখনো ফড়িং মনে করে।    

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment