নরেশ জানা

ভগীরথ

 

১.

 

মশাটার দিকে ভাল করে তাকাল সৃজিত,  তারপর মশারির দিকে আর তারপর প্লাগে গোঁজা মসকুইটো অয়েলের দিকে এবং দেখল প্লাগ অন রয়েছে, ঘাতক রাসায়নিকের মিষ্টি জুঁই গন্ধে ঘর ম ম করছে। মশারিতে কোথাও ফুটো নেই! তাহলে কোত্থেকে এল এই লস্কর-ই-তৈবা? বাইরে অঝোরে বৃষ্টি চলছে।  জুন জুলাইয়ের মাথা খেয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আগষ্টের বারো তারিখ। আজ এখন চোদ্দোর মধ্য রাত, রাত কাবারেই স্বাধীনতা দিবস। এরমধ্যে এই সশস্ত্র জঙ্গি তার ফর্সা থাইয়ের ওপর এলওসি কার্গিলের সেনাদের মত মাটি কামড়ে বসে রয়েছে।

একে স্ত্রী মশা তায় গর্ভবতী! পেট ভর্তি লার্ভা নিয়ে প্রসবের আর্তি। রক্ত চুষে ফুলে ফেঁপে ঢোল, নড়তে চড়তে পারছেনা। মধ্যরাতে ডেঙ্গি নিশ্চিত নয়, তাহলে এ্যানোফিলিস নাকি কিউলেক্স? কবে কোন ছোটবেলায় জীবন বিজ্ঞানের বইয়ের পাতায় সে সবের সচিত্র বিবরণ ছিল।

ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর নয়, সিরাজখালি । হোসেনখালি  মহকুমার সাতটি ব্লকের একটি ব্লকের সদরদপ্তর। সাবেক সরকারের লক্ষ্য ছিল নাকি শহরকে গ্রাম অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার। আর সে কারণেই গঞ্জ থেকে, ছোটখাটো শহর থেকে, বাস টার্মিনাস কিংবা রেল স্টেশন থেকে দুরে দুরে করা হল প্রশাসনিক অফিস। অফিসের সাথে বিদ্যুৎ যাবে, রাস্তা যাবে, যানবাহন, দোকানপাট যাবে সেই দূরে আর এভাবেই আরও একটা গঞ্জ বা মিনি শহর গড়ে উঠবে। সে সব হয়ত হয়েছে বা হচ্ছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, দোকানপাট হয়েছে এমনকি দুচারটে বাস ট্রেকার চলছে, কিন্তু এঁদো পুকুর গুলো যাবে কোথায়?  গ্রাম আর শহরের মাঝখানে সেগুলো যেন এলওসি কার্গিল হয়ে বসে রয়েছে আর মশাগুলো যেন লস্কর-ই-তৈবা অথবা জৈশ-ই-মহম্মদের দল । মশারির কোথাও কোনও ফুটো নেই অথচ রোজই একটা না একটা ঢুকে পড়ছে। অনেক গভীর অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণের পর মশাদের বর্ডার টপকানোর সেই স্ক্রলিং টাও দেখেছে সৃজিত। একটা মশা মশারির ওপারে বসে। ঠিক বেছে নিয়েছে নাইলনের সুতো সরে যাওয়া অংশ। অন্য মশাগুলো তাকে ঠেলছে ভেতরের দিকে। ঠিক যেন রেললাইন প্রতিস্থাপনকারী মজুরদের মত মনে মনে তারা বলে চলেছে, হেইসা মারো, জোরসে মার, আউর জোরে…..

নিম্ন চাপের বৃষ্টি।  বাইরে অঝোরে ঝরছে বটে, ঘরে গরমের শেষ নেই। দুদিন প্রায় অঝোরে ঝরছে, গুম গুম করে ফেটে পড়ছে মেঘ। বর্ষাকালের সমস্ত ডেফিসিট মিটিয়ে দিচ্ছে। কানায় কানায় পূর্ণ হতে বসেছে খাল বিল মায় বড়সড় দিঘি। অবশ্য খাল বলতে এ অঞ্চলে একটাই, এখান থেকে ১৫ কিলোমিটার দুরে। এলাকার লোকে বলে ল্যাংটা খাল। অদ্ভুত নাম, শুনে হেসে ফেলেছিল সে। তবে বড়বাবু মানে তার অফিসের হেড ক্লার্ক অবিনাশ পাকড়াশি বলেছিলেন, “এরকম খাল আপনি দু’দশটা গ্রামের মধ্যে একটা করে পেয়ে যাবেন স্যার। এ খালের দু’পাশে পাড় নেই, একেবারে জমির সমতলে থাকে। পাড় নেই,  তাই ল্যাংটা। খুবই গভীর আর আঁকাবাঁকা। গরমকালে শুকনো অথচ বর্ষায় টে-টম্বুর, খরস্রোতা। ছাগল, কুকুর এমনকি বেখেয়াল হলে মানুষ অবধি ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়।” একটু হেসে অবিনাশ পাকড়াশি আরও বলেন, “অমন নামের আরও একটা অর্থ আছে স্যার, তখন তো আর ব্রীজ কালভার্ট ছিল না! কোথাও কোথাও বাঁশের সাঁকো থাকলেও ওই খালের জলের তোড়ে সে সব ভেসে যেত। মানুষকে খাল পেরুতে হত জামা কাপড় খুলে মাথার ওপরে তুলে। যেহেতু প্রায় ল্যাংটা হয়েই পেরুতে হত তাই নাকি অমন নাম।”

তো সেই খালের ওপর চওড়া একটা  ব্রীজ নবাবগঞ্জ বিডিও এলাকায় পড়ে। হোসেনখালি যাওয়ার সময় ব্রীজটা সৃজিত বেশ কয়েকবার দেখেছে। তার এলাকায় খালটির একটি ক্ষুদ্র অংশের ওপর বছর খানেক আগে নাকি একটা চওড়া কালভার্ট রয়েছে, ট্রেকার ইত্যাদি ছোট গাড়ি যাতায়াত করে। ও রাস্তা তার  এখনও দেখা হয়নি। খবর মিলেছে নবাবগঞ্জের ব্রিজটার অবস্থা খারাপ। দুদিনের বৃষ্টিতে ২০ বছর আগে তৈরি সেই ব্রীজের তলার মাটি সরছে।

তীব্র ভ্যাপসা গরম, তাই স্যান্ডো গেঞ্জি আর বারমুডা পরেই শুয়েছিল। কাজের মহিলা আসে সকাল আটটায়, তার আগেই পাজামা গলিয়ে নেবে। এত বৃষ্টিতেও কামাই নেই মহিলার। কামাই করার উপায়ও নেই, বিডিও সাহেব বলে কথা! তাছাড়া গত তিনমাসে নিজেকে সে বুঝিয়ে দিয়েছে, ফাঁকিবাজি একদম বরদাস্ত নয়। বিডিও অফিসের কম্পাউন্ডের মধ্যেই মহিলার স্বামীর পান সিগারেট দোকান। তেমন হলে সব সমেত উৎখাত হয়ে যেতে পারে।

ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে, মশারির মধ্যে থেকে সেই বাতাস গায়ে লাগছেও তার। মশাটা কিন্তু স্থির হয়ে বসেই। টর্চের আলো আড় ভাবে ফেলল সন্ত্রাসির গায়ে। ভাল করে দেখল, কালো পেটের তলা দিয়ে ফুটে উঠেছে লালচে ফোলা ভাব। তারই রক্ত! তৃপ্ত মশার আর ওড়ার ক্ষমতা নেই, ডানা দুটো শরীরের ভার নিতে পারবে না। এরপর হেঁটে হেঁটে মশাটা মশারির কিনারায় চলে যাবে আর সুযোগ বুঝে টুপ করে খসে পড়বে বিছানা থেকে। তারপর সময়ের সাথে একটু হালকা হয়ে ডানা মেলে উড়ে যাবে কোনও পুকুরে। সেখানে সে ছড়িয়ে দেবে লাখ লাখ লার্ভা। এত পুকুর এখানে যে প্রতিদিন সহস্র কোটি কোটি মশার জন্ম হয়। ম্যালেরিয়া, ফ্যালসিফেরামে লোক মরে, তবুও লোক একটা পুকুর ছেড়ে কথা বলে না। তার টেবিলে মাসে তিনটি করে চিঠি এসে পড়ে থাকে, পাঁচটি শব্দবন্ধ গাঁথা। একটাই কথা, ‘স্যার গরীবের পুকুরটা একটু দেখবেন!’  কারও নাম লেখা নেই, কোন পুকুর , কোন গ্রাম কিচ্ছু লেখা নেই শুধু আহত পাখির মত ডানা ছেঁড়া একটি বাদামি খামের ভেতর ওইটুকু করুণ আকুতি। কোনও পাগলের কাজ বলে একসময় বিষয়টা আর দেখে না সে। যদিও অমনি আরেকটা পুকুর নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। অবশ্য এ পুকুরের নাম ঠিকানা আছে,  চুয়াখালির মাঝি  পাড়ার ২২ ঘরের চার বিঘার পুকুর।

আগের চিঠিটা যদি সত্যি হয় তবে সেটা ব্যক্তিগত কারও পুকুর। কারণ প্রতিটা চিঠিতে একটাই কথা, গরীবের পুকুর। আর চুয়াখালির এই পুকুরটা সমষ্টিগত, ২২টি মালিকানা। চিঠির পুকুরটার যদি সত্যি অস্তিত্ব থাকে আর তার যদি সমস্যা থাকে  তবে সেটা সাম্প্রতিক, কারন চিঠিগুলো এই তিনমাসে, সে জয়েন করার ১মাস পর থেকেই আসছে। অন্যদিকে অন্যপুকুরটির সমস্যা আগের বিডিও তার ঘাড়ে চাপিয়ে গেছেন। যদিও খুব সমস্যা কিছু নেই এখন। মাস্টাররোল ধরে ধরে শ্রমিকদের স্বাক্ষ্য হয়ে গেছে, সবার অ্যাকাউন্টের হিসাব মিলিয়ে অডিট মিলে গেছে, বেনিফিসিয়ারিদেরও কোথাও কোনও আপত্তি নেই। এসব আগের বিডিওই করে গেছেন। কাজ বলতে শুধু পুকুরের কাছে গিয়ে মাপজোক করে একটা রিপোর্ট দেওয়া। গত তিনমাসে সেটা করা হয়নি। হয়নি মানে এমনটা নয় যে সে চেষ্টা করেনি, কিন্তু ওই যে! ইলেকশন আর্জেন্ট ডিউটি, ডেভলপমেন্ট অফিসারদের কালঘাম ছুটছে, লোক কম, প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির সময় হয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ইদানিং তাগাদা বাড়ছে। কমপ্লেন হয়েছিল ডিএমের কাছে, ডিএম পাঠিয়েছেন এসডিও কে আর এসডিও তাকে। ১০০ দিনের কাজের তদারকিতে আসছে কেন্দ্রীয় সরকারের দল, নবান্ন তাড়াতাড়ি রিপোর্ট চাইছে। আজ কাল হয়েই যাচ্ছিল, বাদ সাধল বৃষ্টি। অন্য পুকুরটা নিয়ে তাড়া নেই, সিম্পল অনুরোধ, গরীবের পুকুরটা দেখার কিন্তু কি পুকুর , কোন গ্রাম উল্লেখ নেই তবুও একটা কোথাও যেন বিষয়টা ভাবায় সৃজিতকে, তিন মাসে ন’টা চিঠি! শুধুই পাগলামি করছে কেউ?

মশাটার দিকে আবার চোখ পড়ে তার। ডানায় ছিট ছিট দাগ, এতক্ষনে তার মনে পড়ল জীবন বিজ্ঞানের পাতায় মশার ছবির কথা। নির্ঘাৎ এ্যানোফিলিস, যার অর্থ ম্যালেরিয়া। এই এলাকায় ফ্যালসিফেরামের রেকর্ড আছে কি ? ম্যানেনজাইটিস কিংবা এনসেফেলাইটিস! মশাগুলোর জন্ম আশেপাশের এই সব ছোট বড় ডজন ডজন পুকুরের। এত পুকুর এই এলাকায়, তবুও একটা পুকুর চুরি হলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?   মহাভারতের কথা মনে পড়তেই সে ভাবল, আচ্ছা ,  মহাভারতের যুগে মশা ছিল কি ? বিষয়টা একবার জগন্নাথ সামন্তকে জিজ্ঞাস করলে হত ! জগন্নাথ সামন্ত তার গাড়ির চালক , মহাভারত নিয়েই পড়ে থাকে সর্বক্ষণ । সব কথাতেই মহাভারতের রেফারেন্স দেওয়া চাই । ভাবতে ভাবতে চটাস করে একটা চাঁটি মারে সে, থাইটা চিন চিন করে সামান্য, মশাটা চেপ্টে যায়। সন্ত্রাসের রক্ত তার উরুতে ছড়ায়। একটা তৃপ্তি আসে মনে, খতম তৈবা কিংবা মহম্মদের দল। হঠাৎই সেলফোনটা বেজে ওঠে।

 

২.

 

একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে তার চোখে মুখে। এত রাতে আবার কে ? রাতে ফোন করা যাবে না তাকে এমনটা নয়, ২৪ ঘন্টা গুণিতক ৭ দিন কাজ তাদের। ছুটিতে থাকলে আলাদা, নচেৎ দিন রাতে ফারাক নেই। বিছানায় মোবাইল নিয়ে শোয় না সৃজিত, একটু দুরে চার্জারে লাগানো থাকে। বেড ল্যাম্প জ্বেলে মশারি তুলে বাইরে যায়। পাওয়ার গ্লাসটা চোখে লাগিয়ে নামটা পড়ার আগেই সৃজিত থেকে সৃজিত রায়, বিডিও সিরাজখালি  হয়ে ওঠে। সেল ফোনে চোখ রাখে, কোনও নম্বর নাকি নাম ? দেখতে পায় সভাপতি আকিঞ্চন মাইতি। মুখ থেকে বিরক্তি চলে যায়, নিশ্চই গুরুত্বপুর্ণ কোনও কথা! ঝড়বৃষ্টিতে কোনও বড়সড় ক্যালামিটি হল নাকি ? দেওয়াল চাপা পড়ে দু’ দশজনের মৃত্যু ?

সে অর্থে বেশ কাজেরই লোক আকিঞ্চন মাইতি। বিডিও হিসাবে কোনও জায়গায় গিয়ে কাজ করতে গেলে আগে যেটা বোঝা উচিৎ তা হল এলাকার ভূগোল। আবার শুধু ভুগোল জানার জন্য তুমি এলাকায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়বে সেটাও হয় না। বিডিওদের প্রশাসনিক আর অফিসিয়াল কাজটা এতটাই চাপের যে আলাদা করে এলাকার ভুগোল দেখা হয় না। কাজের সুত্রে গিয়ে যতটুকু বোঝার। ১৩টা গ্রামপঞ্চায়েত নিয়ে তার এলাকা। যা এই হোসেনখালি মহকুমা কেন জেলার মধ্যেই সর্ববৃহৎ ভূখন্ড। এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করে চলেছে এই আকিঞ্চন মাইতি। মাত্র ৩ মাস হল সে এসেছে, এত তাড়াতাড়ি এলাকার সবটা বোঝা যায় না। ফোন ধরেই সে বলল, বলুন সভাপতি সাহেব ।

ও পাশ থেকে কথাটা শুনেই আকাশ থেকে পড়ল সে। বলল, “কাল ? কাল কী করে হবে ? এই বৃষ্টিতে, জলকাদায় চুয়াখালি যাওয়া যায় ? তাছাড়া সকালে ফ্ল্যাগ হয়েস্টিং করেই সব স্টাফ বাড়ি চলে যাবে। না না, আপনি অন্য দিন করুন।”

ওপাশ থেকে কিছু কথা। সৃজিত বলল, “না, ঠিক আছে, বৃষ্টি থেমে যাবে, মোরাম রাস্তা সবই বুঝলাম কিন্তু স্টাফ কোথায় পাব ? পুকুরের মাপজোক করতে লোক লাগবে তো? একমাত্র ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ থাকবে না। ফ্ল্যাগ হয়েস্টিং করেই পালাবে। হ্যাঁ, বুঝলাম, ১৭তারিখ। আরে আপনার যেমন সভাধিপতির চাপ রয়েছে আমারও তেমন ডিএমের প্রেসার আছে, কিন্তু তা বলে….ও আচ্ছা, প্রধান সাহেব, ওনার স্টাফ থাকবে। আচ্ছা করুন, তাহলে ১২টায় বেরুবো..আমার আবার এসডিও সাহেবের ওখানে বিকালে যেতেই হবে..ওখান থেকেই যাওয়া যাবে বলছেন, কালভার্ট আছে ? গাড়ি, আমাদের  মানে স্করপিও… আচ্ছা তাই করুন।” ফোনটা কেটে দেয়। ঘুমটা আবার কেটে গেল। এই এক পুকুর নিয়ে পড়া গেছে। আজ তিনমাস ধরে বলে বলে যাদের সময় হল না, আজ সভাপতিকে পাওয়া যায় তো কাল প্রধানকে পাওয়া যায় না, প্রধান যদিও বা সময় দেয় তো সভাপতির দলীয় কর্মসুচী। আর এখন বলছে কালই করতে পারলে ভাল!

না, আপত্তি নেই সৃজিতের, থাকার কথাও নয়। এতদিনের একটা ঝুলে থাকা ঝামেলা মিটে যাবে সেটা ঠিকই আছে, কিন্ত….। ওই একটা কিন্তু তাকে খোঁচাতে থাকে। কাল বিকালে এসডিও সাহেবের বাংলোতে একটা পার্টি রয়েছে। সেখানে সাতটা ব্লকেরই বিডিও আসবে। এই পান্ডববর্জিত, নির্বান্ধব দেশে ওই পার্টিটা তাদের কাছে অক্সিজেন। এসডিও সাহেব এটা বোঝেন বলেই কারণে অথবা কারণ ছাড়াই একটা কারণ তৈরি করে পার্টি দেন। সবাই মিলে একবেলার একটু হৈচৈ। জেলা শহর থেকে খাবার দাবার আর বেশ কিছু দামি পানীয়। যদিও সবকিছুকে ছাড়িয়ে থাকে কৃষ্ণা বসু রায়ের উপস্থিতি, ললিতপুরের বিডিও। সৃজিত মজা করে যাকে ‘শ্রীমতি ললিতপুর’ বলে থাকে। পাশাপাশি জমে যায় নবাবগঞ্জের বিডিও অরিন্দম হাজরা থাকলে। কৃষ্ণার মাত্র তিনবছর হল বিডিওর মেয়াদ, ললিতপুর তার প্রথম পোস্টিং। মাত্র ৯টি জিপি নিয়ে ছোট্ট একটা ব্লক। অরিন্দমের চার বছর চলছে আর তার পাঁচ। তেমন তেমন হলে সামনের বছর না হলেও আর দুবছরের মাথায় সে ডিএম ডিসি বা ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হয়ে জেলা সদরে চলে যাবে।

সভাপতির সঙ্গে কথা হল চুয়াখালি হয়েই সে চলে যাবে হোসেনখালি, এসডিও সাহেবের বাংলোতে। সব কাজ ঠিকঠাক মিটে গেলে বিকাল ৪টা নাগাদ পৌঁছে যাবে সে। অবশ্য ভালই হল চুয়াখালি জায়গাটা দেখা হয়ে যাবে তার, ওদিকটায় একবারও যাওয়া হয়নি। আর সভাপতি যা বলল তাতে ল্যাংটা খালের ওপর নবাবগঞ্জের ব্রীজটার অবস্থা নাকি খুবই খারাপ, ভেঙে পড়তে পারে। সেদিক থেকে চুয়াখালি জি.পির কালভার্ট অনেক বেটার। হাই তোলে সৃজিত, ঘুম আসছে এবার। আর ঘুমের মধ্যে গোলাপী গাউন পরা একটি মেয়ে নেমে আসে পরীর মত। ভাবতে থাকে সৃজিত, সেদিন কি কৃষ্ণা বসু রায়, শ্রীমতী ললিতপুর গোলাপী গাউনই পরেছিল ?

 

 

৩.

 

সিরাজখালি থেকে ১৩ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে ‘চুয়াখালি নির্মল গ্রামপঞ্চায়েতে আপনাকে স্বাগত’ বোর্ডটা দেখল সৃজিত। ২ কিলোমিটার আগে থেকেই হালকা শুরু হওয়া জঙ্গল এখন অনেকটাই ঘন। তারই মাঝখান দিয়ে খাঁজ কেটে বেরিয়ে যাওয়া লাল রাস্তা অবলীলায় পেরিয়ে যাচ্ছে তার গাড়ির ড্রাইভার জগন্নাথ সামন্ত। গত কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টির লেশমাত্র নেই যেন। রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলের দাগ কিন্ত ঝকঝকে কঠিন রাস্তা। জলের স্রোত বয়ে গিয়ে পাশের ঘাসগুলোর মরা অংশ, আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে। তাই তারা সবুজ গালিচা বিছিয়ে। গাছের ধোয়া পাতা সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে।

একটা ব্লকের মধ্যেই এই তীব্র ভূমি বৈচিত্র তাকে অবাক করে। সে যেখানে থাকে সিরাজখালির ব্লক অফিস কাম তার কোয়ার্টার, এঁটেল মাটি অধ্যুষিত জল কাদা প্যাচ প্যাচে অথচ এই জায়গা ঠিক তার উল্টো। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেও পায়ে এক ফোঁটা মাটিও লাগবে বলে তার মনে হল না। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়।

এলাকায় খুব বেশি ঘর বাড়ি নজরে পড়ে না, অনেকদূর ছাড়া ছাড়া হয়ত এক সঙ্গে চার পাঁচ খানা বাড়ি। তবে জঙ্গল পথ, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই খুব বেশি জোরে গাড়ি চলে না। আরও আধঘন্টা পরে একটা উঁচু জায়গায় উঠে গাড়িটা থামায় জগন্নাথ সামন্ত। হৈ হৈ করে ছুটে আসে কতগুলো লোক। জগন্নাথ সামন্ত বলে, “স্যার এটাই চুয়াখালি জেলেপাড়া, ওই যে পুকুরটা।” সৃজিত নামে গাড়ি থেকে, সামনে দাঁড়ানো দাঁত কেলানো লোকটাকে চিনতে পারে সৃজিত, চুয়াখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, গত তিনমাস ধরে যার সময় হচ্ছিল না এই এনকোয়ারিতে সময় দেওয়ার।

পুকুরটার পাড়ে ভিড় ভেঙে পড়েছে বলা যায়। ছোট ছেলেমেয়ের দল যেন বেশ একটা মজার জিনিস পেয়েছে। এক সঙ্গে অনেক বড় বড় মানু্ষের দল তাদের পাড়ায়। বুড়োরা নির্বিকার অথচ বেশ কৌতূহলি চোখে দুর থেকে দেখছে। সৃজিতকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান এগিয়ে গেল, একটু দুরে দাঁড়িয়ে থাকা সভাপতি আকিঞ্চন মাইতির দিকে।

কেসটা পুকুর চুরির। ১০০দিনের কাজে ১০লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই জেলে পাড়ার চার বিঘা পুকুরের যে সংস্কার হয়েছিল তাতে নাকি ১লক্ষ টাকাও খরচ হয়নি। অভিযোগ আরও যে মানু্ষের পরিবর্তে মেশিন লাগিয়ে কাজ করা হয়েছে। আগের বিডিও যদিও মেশিনতত্ব খারিজ করে দেখিয়ে গেছেন যে ২০০০ ম্যানডেজ ছিল। মাস্টার রোল আর পুকুর কেটেছে এমন প্রায় ১০০জনের সাক্ষ্যও নেওয়া হয়েছে। এখন খালি বুঝে নেওয়া পুকুরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর গভীরতাটুকু ঠিকঠাক আছে কিনা।

কাজটা এতদিনে হয়ে যেত কিন্তু সভাপতি আর প্রধানের সময়ের মিল হচ্ছিল না। আজ একে পাওয়া যায় তো ওকে মেলে না, আবার ও যদিও মেলে এর মিটিং। ওদিকে এসডিও সাহেবের তাড়া এসেই যাচ্ছিল। এসডিওর দোষ নেই কারণ তাঁর মাথার ওপরে ডিএমের চাপ। ডিএম স্পেশাল নোট দিয়েছেন কমপ্লেনের ওপর। তাতে বলা রয়েছে কমপ্লেনারের নাম যাতে কেউই জানতে না পারে কারণ তাতে তার প্রাণনাশেরও আশঙ্কা রয়েছে। বিডিওর কাছেও অবশ্য নাম ধাম ঢেকেই কমপ্লেন কপি পাঠানো হয়েছে কারন ডিএমের ধারণা বিডিওকে ঘিরে রাখে ক্ষমতাসীন সভাপতির দলবল। শেষমেশ সেই  সভাপতি জোর উদ্যোগ নিয়েছে, ১৫ই আগষ্ট, তা সত্ত্বেও প্রধানকে হুইপ দিয়ে বলেছে গোটা অফিস যেন হাজির থাকে। যতই হোক দায়িত্বটা প্রধানের।

দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ মাপ নিয়ে দেখা গেল সব ঠিকঠাক। কোথাও বেশি আছে কিন্ত এক ইঞ্চিও কম নেই। সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ, জব অ্যাসিস্ট্যান্ট, প্রধানের মুখে চওড়া হাসি। সৃজিতের গোমড়া মুখেও একটু রিলিফ।

এবার গভীরতা মাপার পালা। কে নামবে পুকুরে ? যে সে নামলে হবে না, সরকারি তদন্ত বলে কথা অতএব সরকারি লোক চাই, সরকারি উইটনেস হবে সে। কিন্ত দেখা গেল অর্ধেক লোকই সাঁতার জানে না, আবার যারা জানে তাদের অনেকেই ঠান্ডা লাগিয়ে বসে রয়েছে। বাকিরা আবার জামা কাপড় খুলে জলে নামতে রাজি নয়। সৃজিত ফাঁপরে পড়ল। নিজেও সাঁতার জানে না।  জানলে হয়ত নেমে পড়ত, ডিএম সাহেবের কড়া নির্দেশ দেওয়া নোটটা চোখের সামনে ভাসছে, ‘আই.ও শ্যুড হ্যাভ টু এপিয়ার বিফোর সেন্ট্রাল টিম।’ তদন্তকারী আধিকারিককে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলের মুখোমুখি হতে হতে পারে। সৃজিত সভাপতির দিকে তাকাল। সভাপতি বলল, “স্যার, আমার পিওন তো সরকারি কর্মী, ওকে নামাই না কেন?” সৃজিত যেন হাতে চাঁদ পায়। কিন্ত পিওন বলল, “স্যার আমি তো সাঁতার জানি না।” সভাপতি বলল, “কুছ পরোয়া নেই। তোমার কোমরে দড়ি বেঁধে দিচ্ছি, সেরকম হলে টেনে তুলব।” নিমরাজি পিওন আন্ডারওয়ার আর কোমরে দড়ি পরে পুকুরে নামল। পুকুর পাড়ের বাচ্চাগুলো খুব জোরে হেসে উঠল, এমন অদ্ভুত চানের দৃশ্য তারা আগে কখনও দেখেনি। পিওন মনে মনে বলে উঠল, শালা হতচ্ছাড়ার দল!

প্রথমে গোড়ালি, ফুট তিনেক এগুতেই হাঁটু এবং ফুট সাতেক যেতেই উরু ছুঁয়ে ফেলল জল। আর একটু এগুতেই কোমরের দড়ি জলে ঢাকা পড়ে গেল। পুকুরের মাঝখানে যাওয়ার একটু আগেই জল বুক পর্যন্ত এল, তারপর গলা। “স্যার আর এগুবো? দড়িটা ভাল করে ধরবেন কিন্তু, আমি ডুব দিয়ে হাত তুলে দেখাব।” এখন কি করা যায় ? সৃজিত আবারও সভাপতির দিকে তাকায়। সভাপতি আকিঞ্চন মাইতি একটু কিন্ত কিন্তু করে  বলে, ”অন্য কিছু নয় স্যার, দড়িটা তো বাঁধাই আছে, সে ব্যাটাকে টেনে তুলে নেওয়া যাবে। সমস্যা হচ্ছে,  মানে ধরুন ডুব দিতে গিয়ে জল খেয়ে… ইয়ে আপনার শ্বাসনালীতে জল ঢুকে… দম টম আটকে হার্ট ফার্ট ব্লক ফ্লক হয়ে যায় তো মুশকিল।”

“না না, আপনি উঠে আসুন।” সৃজিত আঁতকে ওঠে।

“কিছু হবে না স্যার, মাঝ পুকুরটা একবার দেখে নিন, বলা তো যায় না শালা সুপারভাইজাররা অনেক সময় মেরে ফাঁক করে দেয়…” পিওন ওই অবস্থাতেই বলল।

১০০ দিনের কাজের সুপারভাইজার সাধারণভাবে শাসক দলের লোকেরাই হয়ে থাকে, ভারি কাজ করতে হয় না, দু চারটে ম্যানডেজ এদিক ওদিকও করা যায়। সে পাশেই ছিল। পিওনের কথা গায়ে লাগল তার। চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ আরও একটু ভেতরের দিকে যান, আমরা তো আছিই , টেনে তুলব। এক ইঞ্চি কম হলে জেলে যাব। সব পয়সা সুদ সমেত ফেরৎ দেব।” গলাটা যেন ধরে আসে তার।

“না না, চলে আসুন , আর যেতে হবে না। যত সব বোগাস কমপ্লেন।” সৃজিত ফাইলটা বন্ধ করে। পিওন ঠিক যেমন করে জলে নেমে ছিল তেমন করেই উঠে আসে। গলা, বুক, কোমর , উরু,  অবেশেষে গোড়ালি দিয়ে জল নামে তার।

“স্যার, যদি অনুমতি দেন তবে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই, সব ইয়ে মানে ভিজে গেছে কিনা!” শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকা আন্ডারওয়ার নিয়ে পিওন বলল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি যান। কাল অবশ্যই সকাল সকাল আসবেন, রিপোর্টে আপনার সই লাগবে।” সৃজিত ছেড়ে দিল পিওনকে। সভাপতি পিঠ চাপড়ে দেয় পিওনের।

পুরো বিষয়টা মিটে গেছিল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই। সভাপতির সঙ্গে টুকটাক কথা বলে ফাইলটা হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল সৃজিত।  জগন্নাথ সামন্ত গাড়ি স্টার্ট করল। রিলাক্সড সৃজিতের মনে আবার ভেসে উঠল কৃষ্ণা বসু রায়ের মুখ।

কিছুটা গিয়ে বাঁক পেরিয়ে গাড়িটা পাশ কাটাল একটা মোটর বাইককে। সৃজিত দেখল সেই জব অ্যাসিস্ট্যাণ্ট বাইক চালাচ্ছে, পেছনে সভাপতির পিওন। হাসতে হাসতে কী সব কথা বলছে।

জগন্নাথ সামন্ত মুচকি হেসে বলল, “কন্দুতারন হালদার।” সৃজিত অবাক হল। বলল, “কী বললেন? জগন্নাথ সামন্ত বললেন, “ওই পিওনের নাম স্যার, আমরা ওকে কন্দুতারন নামে ডাকতাম।”

“এমন অদ্ভুত নাম হয় নাকি?” সৃজিত প্রশ্ন করে।

” হয় কিনা জানি না স্যার, তবে আমাদের পণ্ডিত মশাই এই নামটা দিয়েছিলেন।”

“হঠাৎ এমন নামের কারণ? এরমধ্যেও মহাভারত আছে নাকি?” সৃজিত গল্পের গন্ধ পায়।

“আছে স্যার । বলতে পারেন ওই পণ্ডিত স্যারই আমাকে মহাভারতের নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এই যে স্যার এখন সিন্ধু সিন্ধু করে দেশ তোলপাড় হচ্ছে। মানে ওই যে মেয়েটি দেশের জন্য সোনার মেডেল আনল আরকি! তো এই সিন্ধু নামটা আমরা আজ থেকে তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগেই শুনেছি।” জগন্নাথ সামন্ত যেন চালকের আসনে একটু নড়ে চড়ে জম্পেশ হয়ে বসল। রাস্তার দিকেই চোখ রেখে বলতে শুরু করল, আমাদের হাইস্কুলের নাম টিয়াখালি মুকুন্দগঞ্জ হাইস্কুল। এই খালি আর গঞ্জ এই দুই বিচিত্র সংমিশ্রণ আপনি শুধুই এখানে দেখতে পারবেন। অন্য কোথাও নামের শেষে হয় খালি, নয় গঞ্জ। এখানকার মানুষ জলকাদা এঁটেল মাটি অধ্যুষিত এলাকাকে খালি আর ডাহি এলাকাকে গঞ্জ বলে। আপনার মনে হবে চুয়াখালি তো ডাহি এলাকা। আসলে তা’ নয় চুয়াখালির বিস্তীর্ণ এলাকাই এঁটেল কালো মাটি। শুধু এই এলাকাটাই…

“আপনি স্কুলের কথা বলছিলেন।” সৃজিত বাধা দেয়। জগন্নাথ সামন্ত সব কিছু ছড়িয়ে বলতে ভালবাসে তাই…

“হ্যাঁ স্যার স্কুল, মানে টিয়াখালি মুকুন্দগঞ্জ হাইস্কুল। জায়গাটায় মালভূমির রেশ শেষ হয়ে এঁটেল মাটির দেশ শুরু। লালমাটির রেশটুকু রয়ে গেছে। সিন্ধু নামটা আধুনিক কিনা জানিনা তবে সিন্ধু নামটা আমরা সেই স্কুলে গিয়েই পেলাম। একটি ছেলে আমাদের স্কুলে পড়তে এল যার নাম সিন্ধু তারন হালদার।”

“কিন্ত আপনি বললেন কন্দু না কি একটা?” সৃজিত বলে।

“পোড়া বাংলাদেশ স্যার। বাপ মায়ের দেওয়া নাম অবিকৃত থাকার উপায় নেই। গঞ্জ এলাকা যেমন ডাহি, খালি এলাকায় তেমনই ফি বছর বন্যা। ল্যাংটা খালের জল ডুবিয়ে দেয় ভিটে মাটি, চাষের জমি। দুর্দশার অন্ত নেই। এমনই এক বন্যার সময় নাকি জন্ম হয়েছিল তার। গল্পটা সেই বলেছিল আমাদের। সেবার বন্যা হলেও বেঁচে গেছিল তাদের বাড়ি, জমি, ক্ষেত। বাপ মা তাই আদর করে নাম রাখল সিন্ধুতারন।”

“আপনি মহাভারতের গল্পটা বলুন”, সৃজিত তাড়া দেয়।

“বলছি স্যার, আমাদের টিয়াখালি মুকুন্দগঞ্জ হাইস্কুলের বাংলা স্যারের দৌলতে অজ পাড়াগাঁয়ে একটি আধুনিক খেলার প্রচলন হয়েছিল, ক্রিকেট। যেহেতু লালমাটির কিছুটা আভাস ছিল তাই ভাল পিচ তৈরি করা যেত, আর একদল ছেলে প্রায় সারা বছরই ক্রিকেট খেলতাম। বাংলার স্যার আমাদের ডিউসেই ক্রিকেট খেলা শিখিয়ে ছিলেন। তো মাঝে মধ্যে ওই বলটা মাঠের পাশে একটা কুয়োর মধ্যে গিয়ে পড়ত। ডিউজ বেশিক্ষন জলে থাকলে ভারি হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। কিন্ত কী আর করা যাবে? একজনকে কুয়োর সামনেই রাখা হত কিন্তু তারপরও মাঝে মধ্যে পড়ে যায়। সেই সময় সিন্ধুর অদ্ভুত গুণটার কথা জানলাম আমরা। কুয়োর দড়িটা অনেকে মিলে টেনে ধরতাম আমরা। সিন্ধু সেই দড়ি ধরে অবলীলায় কুয়োয় নেমে যেত এবং বল নিয়ে ওই একই ভাবে উঠে আসত। সবচেয়ে বড় কথা অনেক সময় ডিউসটা কুয়োর তলায় গিয়ে পাঁকে আটকে যেত। সিন্ধু অনায়াসে ডুব দিয়ে তাও তুলে আনত। এরকম একজন পরিত্রাতা পেয়ে আমরা দারুণ খুশি। বলি, সার্থক তোর সিন্ধু তারন নাম, সমুদ্র না হোক কুয়োকে জয় করেছিস তুই।”

“সে না’হয় হল কিন্তু কন্দু , পণ্ডিত মশাই, মহাভারত!” সৃজিত যেন গল্পটাকে দ্রুত ছুঁতে চায়।

“আসলে কন্দু তারন নয় স্যার, আমরা ওটা সংক্ষেপ করে বলতাম। পণ্ডিত স্যার বলতেন, কন্দুক তারন। সমস্ত স্কুলেই বোধহয় বাংলা আর সংস্কৃত স্যারের মধ্যে একটা ইগোর ফাইট থাকে। আমাদের স্কুলেও ছিল।

আমাদের স্কুলে ক্রিকেট চালু হওয়ার পর আমরা বেশ গর্ব অনুভব করি। বাংলা স্যার বলতেন গোটা হোসেনখালি মহকুমা তো দুরের কথা এই জেলার পাঁচটা স্কুলেও ক্রিকেট পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আমাদের ব্যাট, ডিউস আসে কোলকাতা থেকে। বাংলার স্যার পণ্ডিত স্যারের চেয়ে বয়েসে ছোট। পণ্ডিত স্যারকে শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। কিন্তু তবুও মাঝে মধ্যে লেগেও যেত। তো এরকমই একদিন ক্রিকেট খেলা প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বাংলার স্যার বললেন, ক্রিকেট আসলে ইংরেজদের খেলা যা থেকে আমাদের দেশে প্রচলন হয়। পণ্ডিত স্যার আপত্তি করে বললেন, ক্রিকেট আদৌ বিদেশি খেলা নয়। এটা আমাদের দেশে হাজার হাজার বছর আগেও খেলা হত, এমনকি আর্যদের আগেও। ব্যস, লেগে গেল তর্ক।

দুই স্যারের তর্কটা আমরা বেশ উপভোগ করতাম। এই যে আপনি যেমন একটা গল্প খুঁজছেন স্যার, আমরাও খুঁজতুম। পণ্ডিত স্যার বললেন, হস্তিনাপুরের কৌরব এবং পাণ্ডবরা ছোট বেলায় যে সব খেলা করত তার মধ্যে ক্রিকেটও ছিল।

বাংলা স্যার হো হো করে হেসে উঠে বললেন মহাভারতে ক্রিকেট? কুলোবী দা আপনি এবার তো রামায়ণে ব্যাডমিন্টন ঢোকাবেন!

রাগে লাল হয়ে হারান কুলোবী  মানে আমাদের পণ্ডিত স্যার বললেন, পূর্ণেন্দু তুমি অর্বাচীন, তাই না জেনেই তর্ক করছ। মহাভারতে কন্দুক ক্রীড়া আছে। মুদগল বা মুগুর  সাহায্য নিয়ে তা খেলা হত। কন্দুক হল ভাঁটা বা বল। সে যুগে কাঠেরই তৈরি তোমাদের এই ডিউসের মতই খানিকটা। একদলের এক সদস্য মুগুর নিয়ে দাঁড়াত আর অন্যদলের এক সদস্য কন্দুক ছুঁড়ত। যে মুগুর নিয়ে দাঁড়াত সে ওই কন্দুক প্রতিহত করত। যতবার প্রতিহত করত দলে তত মান যুক্ত হত। প্রতিহত করতে না পারলেই তোমাদের ভাষায় সে হাউজ দ্যাট। তখন দলের অন্য সদস্য আসত। এই ভাবে একদলের মোট মানের সঙ্গে   অন্যদলের মোট মান তুলনা করে জয় পরাজয় নির্ধারিত হত। বুঝলে উজবুক। তবে হ্যাঁ, রান নেওয়ার কোনও প্রথা ছিল না আর উইকেট ছিল না। বল না ঠেকাতে পারলেই আউট আর ঠেকাতে পারলে একটি মান বা পয়েন্ট, বুঝলে পূর্ণেন্দু!” পণ্ডিত স্যার বিজ্ঞের হাসি হাসলেন।

পূর্ণেন্দু রায় মানে আমাদের বাংলা স্যার বললেন,

“আপনি এমন আজগুবি কথা কোথায় পেলেন কুলোবীদা? মুল মহাভারত আমিও পড়েছি, সেখানে এমন কথা লেখা নেই।”

পণ্ডিত স্যার বললেন, “সে তুমি পড়েছ আমি জানি, কিন্তু তুমি এটা কি জানো যে মহাভারতকার যে কথা বলেছেন তার সবটাই লিপিবদ্ধ নয়। মহাভারতের বহু অংশ একেক জায়গায় একেক রকম। তুমি কাশীরাম দাস পড়, কন্দুক ক্রীড়া পাবে। ভীমের মুগুরে এই কন্দুক একবার গিয়ে একটি কুয়োর মধ্যে পড়ে। সেই কন্দুক কুশবিদ্ধ করে তুলে আনেন দ্রোণ এবং তাঁর সেই অদ্ভুত প্রতিভা জানার পর ভীষ্ম তাঁকে কুরুকুমারদের অস্ত্র শিক্ষার আচার্য হিসাবে নিযুক্ত করেন। আরও একটা কথা জেনে রাখ এই ক্রীড়া কুরুকুমারদের শিখিয়ে ছিলেন একলব্য। বনের উপজাতিদের কাছ থেকেই আর্যদের মধ্যে এই খেলার প্রচলন হয়।”

জগন্নাথ সামন্তর গল্পের মধ্যেই ধীরে ধীরে গাড়িটা ঢুকে পড়ছিল হোসেনখালির মহকুমা শহরে। হাতের স্টিয়ারিংটা তাই শক্ত করে সামন্ত বলে উঠল, “সেই থেকেই পণ্ডিত স্যার সিন্ধু তারনকে কন্দুক তারন বলতে শুরু করে যা কিনা আমরা ছোট করে কন্দু তারন বলতাম।”

সৃজিত বলল, “আজ তাকে দেখে কি আপনার পুরোনো দিনের স্মৃতি মনে পড়ে গেল?”

-“না স্যার, স্মৃতি তো আছেই, কিন্তু অবাক হয়েছি অন্য কারণে। ভাবছি জলের তলায় ডুব দিয়ে ডিউস তুলে আনা দক্ষ সাঁতারু সিন্ধু তারন সাঁতার ভুলে গেল কি করে?”

“মানে!” সৃজিত অবাক হয়।

-“কী জানি স্যার, কোথাও যেন শুনেছিলাম সাইকেল আর সাঁতার একবার শিখলে মানুষ ভোলে না।”

গাড়ি এসডিও সাহেবের বাংলোর ক্যাম্পাসের ভেতর ঢুকে পড়ে। সৃজিত কিছু একটা বলতে গেছিল তার আগেই জগন্নাথ সামন্ত বলে, “ম্যাডাম আসছেন স্যার।”

সৃজিত দেখল কৃষ্ণা বসু রায়কে নিয়ে ম্যাডাম মুখার্জী তাকেই আপ্যায়ন করতে আসছেন। সে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামল। নামল বটে কিন্ত জগন্নাথ সামন্তর কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল, সাইকেল আর সাঁতার …

 

 

৪.

 

চুয়াখালি হয়েই যেতে হবে তাদের। নবাবগঞ্জের ব্রিজ কখন ঠিক হবে, আদৌ ঠিক হবে কিনা কেউ জানে না। মেঘ কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হালকা একটা বাতাস ভেড়ার পালের মত তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাদা মেঘের দলকে। ধবধবে জ্যোৎস্নায় আলাদা আলাদা করে চেনা যায় শাল আর সেগুনের পাতা। সেই ভ্যাপসা গরম কেটে ফুরফুরে বাতাস। সৃজিতের মনটাও বেশ ঝরঝরে হয়ে আছে। ব্যাংকক  থেকে আনা থাই টিচার্স! চার পেগ নিয়েছিল সে। আরও নিলে হত কিন্তু শ্রীমতী ললিতপুর থাকায় সেটা হল না। শ্রীমতি ললিতপুর অবশ্য তার দেওয়া নাম। যে নামে কপট ভ্রু ভঙ্গিমা ছুঁড়ে দেয় কৃষ্ণা বসু রায়, বিডিও ললিতপুর। শ্রীমতী কেন ? মরালীর মত গ্রীবা উঁচিয়ে প্রশ্ন করে। বয়সে তার থেকে ছোট তবুও প্রশ্রয়িত চোখ। পাশ থেকে উসকে দেন ম্যাডাম মুখার্জী, এসডিও সাহেবের স্ত্রী – “হ্যাঁ, সৃজিত এটা কিন্ত ঠিক নয়, একজন অনুঢ়াকে তুমি শ্রীমতী বলতে পারো না।”

ম্যাডাম মুখার্জী তাকে, কৃষ্ণাকে আর নবাবগঞ্জের বিডিও অরিন্দম হাজরাকে তুমিই সম্বোধন করেন। বাকি চার বিডিওই বেশ বড়, একজন আবার এসডিও সাহেবের চেয়েও বয়সে বড়। তাঁদের ম্যাডাম বাবু আর আপনিই সম্বোধন করেন।

চারজন বয়স্ক বিডিওকে নিয়ে এসডিও সাহেব বরাবরই শেষের দিকটায়  সরে পড়েন। তাস বিছিয়ে ফিস খেলতে বসে যান। বাগানের আরেকটা দিকে সে , অরিন্দম হাজরা  আর কৃষ্ণা সঙ্গে  ম্যাডাম মুখার্জী। পকোড়া,ফিস ফ্রাই, ফিংগার চিপস বাড়িয়ে দেন, সঙ্গে  কৃষ্ণাও। কখনও কখনও ম্যাডাম আবার, “যাই বুড়োগুলোকে দিয়ে আসি” বলে চলে যান। তখন আমি সে ও সখা সেজে তারা তিনজন বসে থাকে।

আজ অবশ্য অরিন্দমকে ছুটতে হয়েছে আগে। অরিন্দম এসে পৌঁছানোর পরেই খবর এসেছে নবাবগঞ্জের সেতু কোলাপ্স করেছে, দুটো ক্যাজুয়ালটি হয়েছে। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে জনতা । তারা নাকি জানিয়েছে দু’ বছর আগে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সারানো সেতুটা মামুলি কাজ আর নীল সাদা রং করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ২ বছর আগে অরিন্দম ছিল না। ঘটনার খবর পেয়েই অরিন্দম ছোটে আর তার আগে এসডিও সাহেবের সঙ্গে  তার একটা কথা কাটাকাটি হচ্ছিল । । এসডিও সাহেব বারবার বলছিলেন, “বি কুল হাজরা, ডোন্ট মেক হারি…”

সৃজিত জানে অরিন্দম হাজরাকে বেশ প্রশ্রয়ের চোখে দেখে এসডিও সাহেব। কোথাও যেন আলাদা একটা দুর্বলতা আছে।

সন্ধ্যা গড়াতেই বললেন, “কৃষ্ণা একটা গান কর।” অরিন্দম উঠে যাচ্ছিল গেটের দিকে। এসডিও সাহেব বললেন, “আরে হাজরা গানটা শুনেই যাও, তুমি না যাওয়া অবধি পুলিশ ঠিক সামলে নেবে । আমি এসডিপিওকে বলে দিয়েছি।” অদ্ভুত মানুষ এই এসডিও সাহেব। মুহূর্তে মুহূর্তে কেমন আচরন বদলে যায় !  পার্টি শুরুর আগে সৃজিতকে বেশ কড়া গলায় বলেছিলেন, “কালকের মধ্যেই আমার পুকুরের এনকোয়ারি রিপোর্ট চাই। ওদিকে ডিএম আর সভাধিপতির লাগে লাগে অবস্থা এই পুকুর নিয়ে আর তুমি তিনমাস ধরে…”

“আমার এনকোয়ারি শেষ স্যার। বললে, আজই আমি বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে পুরো ফাইল রেডি করে দিয়ে যেতে পারি।” মনে মনে সভাপতিকে ধন্যবাদ দেয় সে। তিনিই জোর করেছিলেন বলেই না আজ মুখ রক্ষা হল। আর বড়বাবু এই শহরেই থাকে, বললে এখুনি হাজির হয়ে যাবে। তাই গলায় জোর পায় সৃজিত।

“এনকোয়ারি কমপ্লিট! গুড। না, না আজ নয়। কালই পাঠিয়ে দিও। ৬টা বেজে গেল এখন বরং পার্টি শুরু হোক।” গলে যান মানুষটা। হাঁক পাড়েন, “সুজাতা, সুজাতা! কোথায় গেলে তোমরা? ছেলেরা খাওয়া দাওয়া করে ফিরবে কখন?”

সৃজিত লক্ষ্য করে যে মানুষটা এনকোয়ারি নিয়ে এতটাই উদ্বেগে ছিলেন, সেটা হয়ে গেছে শুনে খুব বেশি উৎফুল্ল হলেন না বরং বিষয়টা এড়িয়ে যেতেই যেন তাড়াতাড়ি পার্টি শুরু করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।  সুজাতা, মানে মুখার্জী ম্যাডাম কৃষ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে  আসেন। সঙ্গে বেয়ারারা। খাবারদাবার, পাকোড়া, নামকিন, আর টিচার্স, অ্যাবসোলেট, ব্ল্যাক ডগ…

সবাই প্রায় দু-পেগ নেওয়ার পর এসডিও সাহেব ওই চার বিডিওকে নিয়ে দূরে যেতে চায়। বেয়ারারা একটু দুরে, কোণের দিকে টেবিল লাগায়। ম্যাডাম চোখ কুঁচকে সাহেবের দিকে তাকান। সাহেব “না না, সেজন্য নয়, একটু খেলব। আমরা বুড়োরা এদের মধ্যে, না কি বল পাত্র ? আরে না বাবা, আর খাব না।” বলেই আবদার করে বসলেন, “কৃষ্ণা, একটা গান ধর।”

দু-পেগ নিয়ে অরিন্দম চলে যাচ্ছে গেটের বাইরে গাড়ির দিকে। সকাল ১১টার পর আর বৃষ্টি হয়নি, ঝকঝকে আকাশ, তারা দেখা যাচ্ছে যদিও ভরা জ্যোৎস্নার কাছে আজ তারা ম্লান। এসডিও সাহেব আবারও বললেন, “আরে হাজরা, দাঁড়িয়ে যাও না, গানটা শুনে যাও।” কৃষ্ণা গান শুরু করে, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…’

সৃজিত দেখতে পায় অরিন্দমের গতি একটু শ্লথ হয়ে যায়। গানটা শেষ হতে না হতে অরিন্দম মিলিয়ে যায়। কোথাও কি কোনও বিষণ্ণতা? অরিন্দম কি কোনও বেদনা বয়ে চলে গেল ? কৃষ্ণা কি গানের ভেতর দিয়ে কাঁদছিল? ম্যাডাম আবার চলে গেলেন ‘বুড়োগুলোকে দেখে আসি’ বলে। চতুর্থ পেগ শেষ করে আরেকটা নিতে যাচ্ছিল সে কিন্তু নরম হাতটা এসে পড়ল তার হাতে, নরম মোমের মত ঝরে পড়া একটা গলা বলল, “আর না প্লিজ!”

এরপর একসময় সবাই উঠে পড়েছিল। ঘড় ঘড় করে উঠল ৫ বিডিওর গাড়ি। অরিন্দম চলে গেছে, কৃষ্ণা আজ থেকে যাবে এখানেই। বরাবরই এটাই হয়, পার্টির শেষে কৃষ্ণা থেকে যায়, ফেরে পরের দিন সকালে। ওর অফিস ললিতপুর, এখান থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ম্যাডাম মুখার্জী ওকে রাতে ছাড়েন না। সৃজিত ভাবে, সেও যদি থেকে যেতে পারত!

রাত ৯টায় পার্টি শেষ হয়েছিল। পার্টি শেষ, মানে শেষ। এরপর আর কেউ কাউকে বহন করে না। এসডিও সাহেব অগ্নিবেশ মুখার্জী হয়ে যান, এসডিও সাহেবের প্রিয় হাজরা তখন অরিন্দম হাজরা।  সেও হয়ে যায় সৃজিত রায়। সবাই তখন আবার এসডিও, বিডিও। খালি পার্টি চলাকালীন পোশাক বদলে নাইট গাউন পরে আসা শ্রীমতী ললিতপুর তখন কৃষ্ণা বসু রায় হয়ে যায় কিনা সৃজিত বুঝতে পারে না। নরম আর মোহময়ী আলো ছড়িয়ে দুই অসমবয়সিনী নরম পানীয়ের গ্লাস নিয়ে বসে থাকে আর তাদের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে কি সব কথা বলে, হাসে। অদ্ভুত সেই হাসি।

এক আধবার চড়ে যায় নেশাটা, প্রগলভ হতে ইচ্ছা করে। মনে হয় গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ”আচ্ছা শ্রীমতি ললিতপুর, মনে কর যদি তোমার সঙ্গে  আমার বিয়ে হল, তখন তুমি তোমার নাম কীভাবে লিখবে ? শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু রায় রায় ?” না, জিজ্ঞাসা করা হয়নি, জিজ্ঞাস করা যায় না। একবার বোধহয় জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল সে, ঠিক মনে পড়ে না। সেদিন একটু চড়ে গেছিল। নাজিমগঞ্জের বিডিওর ফেয়ারওয়েল পার্টি। সে বিডিও আবার গ্যাসটাইটিসের পেশেন্ট। মাল তো দুরের কথা, তেলঝাল রান্নাই খায় না। কৃষ্ণাকে নিয়ে ম্যাডাম মুখার্জী নিজের কিচেনে কিছু বানাতে গেছিলেন। জল খাওয়ার নাম করে সেও সটান সেখানে। ম্যাডাম নেই, কৃষ্ণা একা। সে বিড়বিড় করে কিছু বলেছিল বোধহয় কিন্ত একটা ছায়া দেখে সরে পড়েছিল। কৃষ্ণা কি প্রত্যুত্তরে কিছু বলেছিল? কে জানে?

শাল আর সেগুনের ফাঁক গলে গলে মাঝে মাঝে চাঁদ উঠছে আর নামছে। আসলে চাঁদ নয়, গাড়িটাই। একটু এবড়োখেবড়ো রাস্তা, স্টিয়ারিংয়ের ওপর স্থিতধী জগন্নাথ সামন্ত, তার ড্রাইভার।  বয়স ৫৫-র গায়ে। ১৮ বছর সিরাজগঞ্জের বিডিওর গাড়ি চালাচ্ছে সে। কোথাও একটুও কালো দাগ নেই তার চালক জীবনে। যেন ঋষির মত ধ্যানস্থ হয়ে গাড়ি চালায় সে। অবলীলায় ঘুমিয়ে পড়া যায় কিন্ত ঘুমোতে দেয় না সে নিজেই। কুন্ঠিত গলায় সতর্ক করে বলে, “গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে যারা মারা যায় তার ৯৫ ভাগই স্রেফ ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। আপনি দেখবেন স্যার, চোখের সামনে দুর্ঘটনা ঘটতে দেখলে মানু্ষের মধ্যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা চলে আসে নিজেকে বাঁচানোর, ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও না কৌশলে সে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। ঘুমিয়ে পড়লে এটা হয় না। চুপচাপ মরে যেতে হয়।”

এরপর আর ঘুম আসে না। এভাবেই একদিন তার ঘুম তাড়িয়ে দিয়েছিল জগন্নাথ সামন্ত। তারপর থেকে সে গাড়িতে ঘুমোতে পারে না।

বিচিত্র মানুষ এই জগন্নাথ সামন্ত। একটু সময় পেলেই মহাভারত খুলে পড়তে শুরু করে। গাড়ির মধ্যেই রাখা থাকে চামড়ায় বাঁধা ঢাউস বইটা। মিটিং, সেমিনার চলাকালীন যখন অন্য ড্রাইভার গালগল্প বা মোবাইল করে চলেছে জগন্নাথ সামন্ত তখন বই খুলে নিজের আসনে বসে ধ্যানমগ্ন। আবার তাকে আসতে দেখলেই বই গুছিয়ে বাইরে নেমে দরজা খুলে টানটান হয়ে দাঁড়ায়।

ড্রাইভারদের আচার আচরণ নিয়ে কৌতুহল না থাকাই ভাল, আর থাকলেও তা প্রকাশ না করা আরও ভাল। তবুও একদিন বলেই ফেলেছিল, “মোটামুটি আর কতদিন লাগবে আপনার ওটা শেষ করতে?”

নতুন বিডিওর এ হেন প্রশ্নে চমকেই উঠেছিল জগন্নাথ সামন্ত। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের কোনও খোঁচা আছে নাকি বোঝার চেষ্টা করেছিল। “না মানে আপনার কি কোনো অসুবিধা আছে স্যার ? তাহলে না’হয় পড়ব না।” জগন্নাথ সামন্ত কিন্ত কিন্তু করে।

“আরে না না, অসুবিধার কী আছে? এমনই জানতে চাইছিলাম। এতবড় বই! কতদিন লাগে, একটা ধারনা পেতে চাইছিলাম আর কি!” সৃজিত পরিবেশটা হালকা করে।

“সেটা স্যার নির্ভর করে কেমন সময় পাওয়া যায় তার ওপর। বাড়িতে তো আর পড়ি না মানে পড়া হয় না। তবুও বছর খানেক লেগে যায় স্যার। বছর দশেক আগে কিনেছিলাম চারবার পড়ার পর ছিঁড়ে গেল তখন বাঁধিয়ে আনলাম তারপর আরও তিনবার…”

“মানে? সৃজিত বলে, আপনি কতবার পড়েছেন?”

“এই নিয়ে সাতবার। শেষ হলে কয়েকদিন বাদ দিয়ে আবার শুরু করি। অন্য কোনও বই পড়ি না।”

“একটাই বই নিয়ে আপনি…!”  সৃজিত অবাক হয়।

“বই নয় স্যার, মহাভারত। যতবার পড়ি মনে হয় ঠিক পড়া হল না।” জগন্নাথ সামন্ত লাজুক হয়।

“ওই যুদ্ধটুদ্ধর মাঝে আপনি কী পান?”

“যুদ্ধ? যুদ্ধ কোথায় স্যার। ওটা তো সামান্য একটা জায়গা। বাকি জায়গাগুলো দেখুন!”

“যেমন?” সৃজিতের কৌতুহল বাড়ে।

“যেমন কিছু নেই স্যার। ১৮টা পর্ব। যুদ্ধ ছাড়াও অনেক কিছুই আছে। অনুশাসন পর্বের কথাই ধরুন। সংসার থেকে রাষ্ট্র এমনকি বিডিও অফিস চালানোর নির্দেশিকা পেলেও পাওয়া যেতে পারে।”

“বলেন কী!” সৃজিত হাসে, “বিডিও অফিস! মানে আপনি বলছেন ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস…”

“না স্যার, ঠিক তা নয়। মহামতি ভীষ্ম মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিচ্ছেন রাজ্য পরিচালনার। রাজ্য চালনায় কে বন্ধু হতে পারে কে নয়, কোথায় লঘু শাস্তি কোথায় আবার গুরুদণ্ড দিতে হয়। প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায়ের রীতি। এসবের মধ্যেই অনেক বিষয় মনে হয় আজও প্রযোজ্য।”

সৃজিত থমকে গেছিল সেদিন। বিসিএস ক্র্যাক করার পর ট্রেনিং পিরিয়ডে তাদের রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, বাইবেল পড়তে বলা হত। কিছু কিছু পড়াও হয়েছিল। একজন রিটায়ার্ড আইএএস আসতেন ট্রেনিং দিতে। বলতেন – শুধুই ইন্ডিয়ান পেনাল কোড আর ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস পড়ে কিছু হবে না, ভারতীয় জনজীবনের সংবন্ধন আরও গভীরে। মনে রাখবেন, এদেশে ইংরেজরা আসার আগে, মোঘলরা আসার আগে এমনকি আর্যরা আসার আগেও আইন ছিল, প্রশাসন ছিল, দণ্ডবিধান ছিল।

সেই ভদ্রলোক বলতেন – ডায়লগ এন্ড ডায়লগ। জেণ্টেলমেন, মধ্যভারতের নর্মদা উপত্যকা, তাপ্তি উপত্যকার গহন অরণ্য আর পর্বতবেষ্টিত এলাকায় আজও এমন উপজাতি আছে যারা একটা সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন ডায়লগ চালিয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া, চাষাবাদ, শিকার কিছুই বাদ পড়ে না কিন্ত দিনের শেষে আবার শুরু হয় ডায়লগ। সবাই বলে, সবাই শোনে। আলোচনা চলতে চলতে যখন কোনও বিষয়ে সবাই একমত হয় তখন হয় সিদ্ধান্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, সর্বসম্মত। চাপিয়ে দেওয়া নয়, আত্মীকরণ।

আত্মমগ্ন ঋষির মত মানুষটা বলেই চলেছেন – অথচ মহাভারতের যুগে এদের রাক্ষস বলা হত! আবার মহাভারতকার এদের উপেক্ষা করেননি। ভীষ্মের অনুশাসন পর্বে বলা হচ্ছে ডায়লগের কথা। জেণ্টেলমেন, মনে রাখবেন যে আইন আর অনুশাসন শিখে আপনরা বিডিও এসডিও ডিএম কিংবা আরও বড় পদে যাচ্ছেন সেই আইন আর অনুশাসনই সব নয় তার বাইরেও অনেক আইন আর অনুশাসন রয়েছে…

সেদিন থেকে জগন্নাথ সামন্তর প্রতি একটা আলাদা জায়গা তৈরি হয়েছে সৃজিতের। কথা আর বেশি বাড়ায়নি সে। কথার শেষের দিকে জগন্নাথ সামন্তর আরও একটা কথা তার মাথায় থেকে গেছিল। সামন্ত বলেছিল, “মহাভারত থেকে আরও একটা বড় জিনিস পাওয়া যায় স্যার, সেটা হল মানব চরিত্র। ভাল করে দেখবেন মহাভারতের চরিত্ররা যেন হেঁটে চলে বেড়ায় আমাদের চারপাশে।”

সৃজিত কৌতুক করে বলেছিল, “আপনি কি দুর্যোধন,যুধিষ্ঠিরদেরও দেখতে পান সামন্ত মশাই?”

“না স্যার, তাঁদের পাইনি। তবে তাঁরাই তো সব নন। ওই যুদ্ধ পর্বর মত তাঁরাও খুবই কম অংশ। তার বাইরেও শত শত চরিত্র রয়েছে, তাই না? যেমন ধরুন পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র কিংবা…”

কথাটা আর এগোয়নি সেদিন।  কী একটা জরুরি ফোন এসে গেছিল তার। পরে সেও আর বিষয়টা নিয়ে কথা তোলেনি। তবে একটা জিনিস সে বোঝে যে জগন্নাথ সামন্ত সেই চরিত্রগুলো খুঁজে বেড়ায়। একেকবার সৃজিতের জানতে ইচ্ছা করে তার মধ্যে জগন্নাথ সামন্ত কোনও মহাভারতের চরিত্রকে খুঁজে পায় কিনা।

দেখতে দেখতে চুয়াখালির কালভার্টটা পেরিয়ে গেল তারা। গরম কেটে যাওয়ায় এসি বন্ধ করে গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়েছিল সে, তাই খালের তলায় জলের গর্জনটা টের পেল। আপার ক্ল্যচমেন্টের জল এখনও নামছে। নবাবগঞ্জের সেতুর কি হল কে জানে ? অরিন্দম কি কোয়ার্টারে ফিরল নাকি এখনও সেতুর কাছে দাঁড়িয়ে? যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ শুরু হয়েছে  বলছিল। সেতুটা ভেসে বিছিন্ন হয়ে গেছে নবাবগঞ্জ। কব্জি উল্টে ঘড়িটা দেখল, ১০টা বাজে। এখনও ঘন্টা খানেক। চোখটা বন্ধ হতে চায় কিন্ত জগন্নাথ সমান্তর সাবধানবাণী মনে পড়ে যায়। পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে লাইটার জ্বালায়। মনে মনে ভাবে, মহাভারতের যুগে লোকে কি ধূমপান করত? ভাবার চেষ্টা করে সোমরস টস ছিল বটে কিন্ত ধূমপান? না, মনে পড়ে না।

 

৫.

 

খোলা জানলা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস বাঁদিক থেকে ঢুকে সৃজিতকে ছুঁয়ে ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মোরাম রাস্তায় এসে পড়েছে তারা। রাস্তাটা সেই পুকুরের একটি পাড় ধরে উঠে আবার নেমে সমতলে চলে গেছে। এই এলাকায় ঘরবাড়ি কম। ঘন বসতি নেই বললেই চলে। জঙ্গলও কিছুটা হালকা এখানে। সে এই রাস্তা দিয়ে আজই প্রথম এসেছে। তখন দিনের আলো ছিল, এখন চাঁদের আলোতে সম্পূর্ণ আলাদা লাগছে জায়গাটাকে। একটা উঁচু জায়গায় উঠল যেন গাড়িটা আর উঠেই একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।  কী হল? ডান দিকে একটা পুকুর। আরে, এতো সেই পুকুরটাই! সৃজিত চিনতে পারল। জগন্নাথ সামন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে পুকুরের দিকে মাথা বাড়িয়ে কী যেন দেখছে! কী হয়েছে সামন্ত মশাই? সৃজিত জিজ্ঞাসা করে।

“স্যার, একটা লোক। মনে হয় পুকুরে ডুবে যাচ্ছে।”

“হোয়াট ননসেন্স!” সৃজিত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামে। জগন্নাথ সামন্তও।

“ওহ গড, লোকটা সত্যি পুকুরে ডুবে যাচ্ছে যে! কী করা যায়, সামন্ত মশাই?” সৃজিত অস্থির।

“দাঁড়ান স্যার, দেখছি। জগন্নাথ সামন্ত পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়। পিছনে সৃজিতও। তার প্রচুর টেনশন হচ্ছে। লোকটা পুকুরের মাঝখানে যে! পুকুরের একপাশে কয়েকটা গাছ, সেদিকে যাচ্ছে জগন্নাথ সামন্ত । কী আশ্চর্য! সেখানে যেন কয়েকটা ছায়ামূর্তি নড়াচড়া করে। জগন্নাথ এগুতেই দুটো লোক বেরিয়ে আসে। সৃজিত অবাক হয়ে যায়। কারা এরা? চোর ডাকাত নাকি আরও বড় কোনও…

” কী হয়েছে সাগর? পুকুরে কে?” জগন্নাথ সামন্ত আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করে।

জগন্নাথ সামন্ত এদেরকে চেনে? সৃজিত অবাক হয়। পরক্ষণেই ভাবে, না চেনার কী আছে! সে তো এই ব্লকেরই মানুষ। তার ওপর ১৮ বছর গাড়ি চালাচ্ছে বিডিওর।

এগিয়ে আসা সাগর নামের আগন্তুক বলে, “ভগীরথ কাকা, বাবু। সকাল থেকে আগলে আগলেই রেখেছিলাম কিন্তু রেতে ফাঁক পেতেই নেম্যে পড়েছেন। উই দেখেননা কেম্যন নাপে চলেইছেন।”

“কিন্তু, ও যে ভাল হয়ে গেছিল। কালই তো…” কী যেন একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল জগন্নাথ সামন্ত।

অন্য লোকটা এগিয়ে এসে বলে, “ভালই তো ছিল বাবু। আজই ওই পুকুর নাপনের পর থিক্যেই আবার মাথাটা বিগড়াইছে।”

সৃজিত কিছুই বুঝছে না। শুধু এইটুকুই বুঝতে পারছে লোকটা পাগল আর পুকুর মাপছে। একটা গুনগুন আওয়াজ আসছে পুকুরের দিক থেকে। জগন্নাথ সামন্ত সৃজিতকে নিয়ে নেমে যায় সেদিকেই। পেছনে লোকদুটোও। জগন্নাথ ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে লোকটার কথা। সে বলছে, ”আর একটু নামব স্যার, এই দেখুন আমার কোমর কিন্ত ডুবে গেল! আমার বুক পর্যন্ত জল স্যার । এবার আমি ডুব দিয়ে হাত উপরে তুলব স্যার ? ভাল করে দড়িটা ধরবেন স্যার।” সৃজিতের মনে পড়ে সকালে এমনটাই বলছিল সভাপতির পিওন।

জগন্নাথ সামন্ত এবার ভারী গলায় ডাকে, “ভগীরথদা!” লোকটা যেন অবাক হয়ে পাড়ের দিকে তাকায়। আবার সামন্তর ভারী গলা, “উঠে এসো ওপরে।” কী আশ্চর্য! লোকটা বাধ্য ছেলের মত উঠে আসে। জগন্নাথ সামন্তর কাছে এসে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। “এমন কর কেন?” তার হাতটা ধরে জগন্নাথ সামন্ত যেন কঁকিয়ে ওঠে। লোকটা কি এক অদ্ভুত অসহায়তা আর ক্রোধে সেই  হাত ছাড়িয়ে পাড়ের দিকে উঠে যায়। জগন্নাথ সামন্ত সাগর নামক যুবকটিকে বলে, “বাড়ি নিয়ে যা। কাল ভোরেই শহরে নিয়ে চলে যাবি। আর যেন এখানে না আসে।” সৃজিত কিছু বলতে চায়, জগন্নাথ সামন্ত থামিয়ে বলে, “এখানে নয় স্যার, গাড়িতে চলুন। অন্য কেউ দেখলে সমস্যা হবে।” সঙ্গের অন্য লোকটিকে বলে, “তুইও আয় আমাদের সাথে।”

পরের ঘটনাটা জগন্নাথ সামন্তর মুখে শোনা সৃজিতের। জ্যোৎস্না তখন পড়ে গেছে। তিন ঘড়ি আলো ঝরিয়ে চাঁদ অস্তমিত। গাড়ির মধ্যেই তারা বসেছিল। সৃজিত, সেই লোকটা যে কিনা ভগীরথ মণ্ডলের ভাই বলে পরে জেনেছিল সৃজিত, সাগর ফিরে এসেছিল ভগীরথকে ঘরে রেখে আর চালকের জায়গায় জগন্নাথ সামন্ত।

এই লালমাটি আর  জঙ্গল বেষ্টিত এলাকায় পুকুরটা খাস, ২২ টি জেলে পরিবারের নামেই পাট্টা। জমিদারির সময়ে জনগণের জন্য ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণকে পেটে ভাতে খাটিয়ে এই পুকুর কাটিয়েছিল জমিদারেরা। যেমন সব জমিদাররাই করত। জমিদারি চলে গেলেও পুকুরটি দখলে রাখতে মরিয়া ছিল জমিদারের অধঃস্তন পুরুষরা। সত্তরের দশকের গোড়ায় পুকুরের দখল নিয়ে একটা বড়সড় সংঘর্ষ হয় জমিদারদের সেই অধঃস্তন পুরুষ,  তাদের লোকজনদের সঙ্গে  এখানকার জেলে পরিবারগুলির। সেই সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছিল তখন সদ্য যুবক হয়ে ওঠা ভগীরথ। তার মাথার আঘাত এতটাই জোরালো ছিল যে সাত মাস কলকাতার কোনও এক স্নায়ু হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। পরে সরকারের বদল হয়। অপারেশন বর্গায় পুকুরের দখল পায় জেলে পরিবারগুলি। এই পুকুরে চাষ করা মাছ তাদের আয়ের অন্যতম উৎস।

পরের ঘটনাটি হাল আমলের, বছর সাতেক আগের। এক সন্ধ্যা বেলায় ব্লক অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসেছিল ভগীরথ। সেই সময় লাঠিসোটা নিয়ে ভগীরথকে আক্রমণ করে কিছু মানুষ। কারণটা সঠিক জানা যায়নি তবে এটুকু বোঝা গেছিল যে সরকার পরিবর্তনের সেই বাজারেও জেলে পাড়ার ভোট পায়নি সরকারি দল। সেই সময় দ্বিতীয় বারের জন্য খুলিটা দু’ফাঁক হয়ে যায় ভগীরথ মণ্ডলের। প্রাণে বাঁচলেও মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। কখনও দিব্যি সুস্থ হয়ে যেত আবার কখনও এই অদ্ভুত আচরণ।

ঘটনা প্রবাহ শোনার পর সৃজিত বলল, “আপনারা তাহলে বলছেন, পুকুরটা কাটাই হয়নি!”

“হয়েছিল স্যার, জেসিপি দিয়ে। কয়েক ফুট মাত্র।” ভগীরথের ভাই বলে।

“কিন্তু ১০০ দিনের কাজে তো জেসিপি নামানো যায় না! সাড়ে চারশ মানুষ কাজ করেছে, কয়েক হাজার ম্যান-ডেস। তারা নিজেরা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছে। প্রায় ১০ লক্ষ টাকার কাজ। এসব আগের বিডিও সাহেব আমাকে মাস্টার রোল বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন”  সৃজিত বলল।

“গ্রামের সমস্ত জবকার্ড হোল্ডারের ব্যাঙ্কের পাশবই আর সই করা টাকা তুলার স্লিপ যে তাদ্যেরই কাছে থাকে আইজ্ঞে।”

“মানে? এই পুরো লাখ লাখ টাকাই…ও মাই গড! কিন্তু আজ যখন সকালে আমরা পুকুর মাপছিলাম তখন আপনারা সবাই ছিলেন। তখন বলেননি কেন?” সৃজিত ঝাঁজিয়ে ওঠে। “আপনারও  দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।”

লোক দুটো চুপ করে থাকে। জগন্নাথ সামন্ত বলে, “এই পুকুরটার এটা দ্বিতীয়বারের সংস্কারের কাজ স্যার। প্রথমবারও এই একই জিনিস হয়েছিল। সেই চুরির কমপ্লেন বিডিও অফিসে করে আসার পরই ভগীরথ মণ্ডলকে মারার চেষ্টা করা হয়। এরপর আর কে প্রতিবাদ করবে!”

“আমরা কিছু কইলেই, আমদের হার্মাদ বলে দেগ্যে দিয়ে এমন পিটবে যে…” ভগীরথের ভাই কেঁদে ফেলে। দাদাকেও তো ওরা হার্মাদ হার্মাদ বলে ছুটাইল, লোকরাও ছুটল হার্মাদ হার্মাদ বলে। তারপর সে কী বেদম মার!”

“পুলিশে জানাওনি?” সৃজিত তুমিই বলে ফেলে।

“পুলিশে গেলে পুলিশ বলে, তরা শালা হার্মাদই, তোদের মারাই উচিত। বেশি লাফালে এমন কেস ঠুকব যে, পুকুর তো দূরের কথা, ঘরেই থাকতে পারবি না।”

ওদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা আবার চলতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয়বার আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছিল সৃজিত। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “সামন্তবাবু, আমার টেবিলে চিঠিগুলো কী আপনি রেখে আসতেন?”

জগন্নাথ সামন্ত উত্তর দেয় না। সৃজিত বলে, “বেশ, কিন্তু এটা বলবেন কেন ওই চিঠিতে বারবার গরীবদের পুকুর না বলে গরীবের পুকুর বলা হয়েছিল?”

“ভয় ছিল স্যার।” নীরবতা ভাঙে সামন্ত, “বিডিও অফিস ঘুঘুর বাসা। গরীবের জায়গায় গরীবদের লিখলে সবাই ঠিক বুঝে যেত যে কোন পুকুরের কথা বলা হচ্ছে আর কারা কমপ্লেনটা করছে। কিন্তু আপনি স্যার একটা জিনিস খেয়াল করেননি, প্রত্যেকটা চিঠিই আলাদা আলাদা মানু্ষের লেখা ছিল।”

“তার মানে?”  সৃজিত বিস্মিত।

“বহুবচন স্যার। যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে এই আবেদন অনেকে মিলে করছে। সবই ভগীরথদার পরিকল্পনা। পোড় খাওয়া নেতা স্যার। ভগীরথদার কথাতেই  এসডিও সাহেবের অনুরোধে ডিএম সাহেব কমপ্লেনারারের নাম ঢেকে দিয়ে কমপ্লেনটা আপনার কাছে এনকোয়ারির জন্য পাঠিয়েছিলেন।”

“এসডিও সাহেব এই ভগীরথ মণ্ডলকে চেনেন?”

“হ্যাঁ স্যার, অনেক আগে থেকেই। উনি বছর ১৫ আগে আমাদেরই ব্লকের বিডিও ছিলেন। এলাকার নাড়ি নক্ষত্র তাঁর চেনা। উনি জানতেন একবার জানতে পারলে গোটা জেলে পাড়াই উচ্ছেদ হয়ে যাবে এখান থেকে। সেই জমিদারদের লোকেরাই তো এখন পঞ্চায়েত থেকে বিডিও অফিস ঘিরে রেখেছে স্যার।”

 

৬.

 

না, মাননীয় পাঠক এবং মাননীয়া পাঠিকাবৃন্দ, আর আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। আমি জানি এক অখ্যাত সিরাজখালি ব্লকের অখ্যাত জেলেপাড়া আর ততোধিক অখ্যাত একটা পুকুরকে নিয়ে এ গল্প যতদূর বোনার তার চেয়ে একটু বেশিই বলে ফেলা হয়েছে। কোনো এক হার্মাদ ভগীরথ মণ্ডল আর জমিদারের উত্তরপুরুষদের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে থাকা একটা পুকুর, তাও আবার চাঁদ ডুবে যাওয়ায় সে পুকুর এখন আর ভালো করে দেখাও যায় না। সমস্যা হল হোসেনখালির এসডিও এখনও জেগে। আর অন্যদিকে সন্ত্রাসী মশা কিংবা শ্রীমতী ললিতপুরের পরিবর্তে সৃজিত রায় আজ অন্য চিন্তায় মশগুল। রাত প্রায় ২টা। এত রাতে এই দু’জন কী করছে, একটু উঁকি দিয়ে দেখে গল্পটা এ’ভাবে শেষ করা যেতে পারে –

অগ্নিবেশ মুখার্জীর নিজস্ব এক চিলতে রুমটিতে  আলো জ্বলছে। পাশের ঘরে কৃষ্ণা বসু রায় অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। তখুনি তার পাশ থেকে উঠে এলেন সুজাতা। প্যাসেজের ভেতর দিয়ে বাথরুমের দিকে এগুতে গিয়ে নজরে পড়ল ধ্যানমগ্ন ঋষির মত বসে আছেন তাঁর স্বামী। দরজা ভেজানো ছিল, আলতো স্পর্শ করতেই খুলে গেল। সুজাতা সেই ঘরের ভেতরে পা রাখতেই পেছন ফিরলেন অগ্নিবেশ, যেন মাথার পেছনেও চোখ রয়েছে তাঁর। স্বামীর এই অদ্ভুত শব্দ কাতরতা সুজাতা জানেন,  তাই অবাক হলেন না। মৃদু হেসে পাশে দাঁড়ালেন।

“ঘুমোওনি এখনও? পোশাক বদলাওনি?”  অগ্নিবেশ অবাক হলেন, সিফন জর্জেটের শাড়িটা এখনও পরে সুজাতা।

“শাড়িটা আর ছাড়া হয়নি, যা ক্লান্ত লাগছিল। শুয়েই পড়েছিলাম, চোখটাও লেগে গেছিল বোধহয়। তোমার একটা ফোন এল মনে হল, ঘুমটা ভেঙে গেল।”

কথাটার মধ্যে উত্তরের পাশাপাশি একটা প্রশ্নও ছিল। প্রশ্নটা হল কার ফোন? কিন্ত সুজাতা কখনও এসব প্রশ্ন করেন না। অগ্নিবেশও এড়িয়ে যান বিষয়টি। বরং অন্য একটি প্রশ্ন করেন সুজাতাকে, “তোমাকে আজকাল পার্টিতে গাউন পরতে দেখি না!”

সুজাতা মৃদু হাসেন। বলেন, “উরিব্বাস, এসডিও সাহেবের সে সবও লক্ষ্য রাখা হয়েছে! বুড়ো হয়েছি মশাই, ছেলে ছোকরাদের সামনে এখন আর গাউন টাউন আর পরা যায়?”

অগ্নিবেশ হাসেন, বুঝতে পারেন প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছেন সুজাতা। মজা করে বলেন, “মাত্র চারমাসেই বুড়িয়ে গেলে বুঝি। তমাল গুপ্তর ফেয়ারওয়েলের দিনও…”

হাসতে হাসতে হার মানেন সুজাতা, “তুমি তাও মনে রেখেছ? আসলে ওই দিনই তো ঘটল ঘটনাটা।”

“কীরকম?” অগ্নিবেশ চশমাটা খুলে রাখেন।

“আর বোলো না, তোমাদের তমাল গুপ্তর জন্য একটু স্টু বানাতে কিচেনে গেলাম। সঙ্গে  কৃষ্ণাও ছিল। ভাবলাম গুপ্ত বেচারা পেটের রুগী, এমনি জল না দিয়ে বরং পিউরিফায়েড ওয়াটার দিয়েই বানাই। কৃষ্ণাকে বললাম আমার রুম থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে আসতে। ও গেছে, আমি ইনগ্রেডিয়েন্টসগুলো নাড়াচাড়া করছি। এমন সময় পেছন থেকে এসে কেউ বলল – এক্সকিউজ মি শ্রীমতী ললিতপুর! একটা প্রশ্ন ছিল, যদি আমার সঙ্গে  আপনার বিয়ে হয় তবে আপনি কী পদবী লিখবেন? কৃষ্ণা বসু রায় রায়?”

“ইন্টারেস্টিং!” অগ্নিবেশ মিট মিট করে হাসেন। “তারপর?”

“আমি একটু দুষ্টুমি করে জবাব দিলাম, না। কৃষ্ণা রায় বসু রায়। আর ঠিক সেই সময় কৃষ্ণাও আসছিল। তাকে আমি ভেবে সৃজিত যা পালাল…” হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন সুজাতা। তারপর হাসি থামিয়ে বলেন, “এরপর আর গাউন পরা যায় ? তবে যাই বল বাপু, তোমাদের সৃজিত রায় আর অরিন্দম হাজরা দুজনেই বেশ রোমান্টিক।”

অগ্নিবেশ মৃদু হেসে বলেন, “আর তোমার কৃষ্ণা? সে রোমান্টিক নয়, মনে ধরেছে নাকি দুটোর একটাকে?”

“কী জানি! ঠিক বুঝতে পারি না আজকালকার মেয়েদের। এত চাপা!”

“আজকাল কেন বলছ, কোনও কালেই কি জানা যায়?” অগ্নিবেশ মজা করেন যেন।

“হুঁ, তাই বুঝি? আজও জানা শোনার বাইরেই রয়ে গেলাম বলছ!” সুজাতা যেন উদাস হয়ে যান।

“আরে বাদ দাও, মজা করছিলাম। তা তোমার রোমান্টিক জুটি দুটি শুধুই রোমান্টিক নয় বিপ্লবীও বটে।”

“মানে?” সুজাতা স্বামীর দিকে তাকান ।

“মানে পরিস্থিতি খুব জটিল মহারাণী।” খুব ঘনিষ্ঠ গলায় সুজাতাকে এভাবেই সম্বোধন করেন অগ্নিবেশ। এক নম্বর মানে হল, আজ সন্ধ্যাবেলায়,  মানে এখান থেকে যাওয়ার পরেই বিখ্যাত ঠিকাদার এবং নেতা অমরেশ চৌধুরীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে অরিন্দম।

“অমরেশ চৌধুরী! মানে তোমাদের নবাবগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির ভাই? তাই তুমি তখন পার্টিতে অমন চিন্তিত হয়ে পড়লে?”

“হ্যাঁ। এফআইআর করার পারমিশন চাইল অরিন্দম। দিয়েই দিলাম বুঝলে, ডিএম সাহেব একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন। তাঁকে বোঝালাম।”

“আর তোমার দ্বিতীয়টি কী?” সুজাতা স্বামীর ওপর ঝুঁকে পড়েন।

“দ্বিতীয় ওই তোমার ফোনটা, যেটায় তোমার ঘুম ভাঙল। সৃজিত গাধাটা ফোন করে জানালো যে,  সে পুকুরের এনকোয়ারিটা ক্যানসেল করছে। পুকুরের জল কমলে আবার ফ্রেশ করে এনকোয়ারি করবে।”

“হুম ! এসডিও সাহেবের তাহলে ভালই সমস্যা বাড়ল।” সুজাতা হাসলেন।

“সমস্যা বলে সমস্যা গিন্নি, দুটো মিলে ডোবালো আমাকে। কাল সব হোমড়া চোমড়ারা হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমার অফিসে। ডিএম সাহেব বলেই দিয়েছেন, সব আমাকেই সামলাতে হবে, উনি কোনও দায়িত্ব নেবেন না।”

“এবার সুজাতা খিল খিল করে হেসে ফেললেন, দুজন মিলে এসডিও সাহেবকে ডোবালো নাকি সাহেব নিজেও ডুবতে চেয়েছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় সৃজিত যখন বলল, এনকোয়ারি কমপ্লিট তখন অমন দম মেরে গেলেন যে বড়!”

“আর পারা যাচ্ছে না গিন্নি, এত লুট, এত চুরি! মনে হচ্ছিল এবার দাঁড়ি টানা দরকার। পেয়ে গেলাম দুটো বাঘের বাচ্চাকে । ভাবলাম একবার শুরুই করা যাক।” একটা যেন দীর্ঘশ্বাস পড়ে অগ্নিবেশের।

“আর পরিণতি? ওই দুটো বাচ্চা ছেলে, ওদের ক্যারিয়ার!” সুজাতা চিন্তিত হন।

“ঝুঁকি তো নিতেই হবে। উত্তরবঙ্গ, না হয় সুন্দরবনের জঙ্গলে কোথাও ট্রান্সফার হবে নয়ত ক্ম্পালসারি ওয়েটিং। আলোচনা করেছি ওদের সাথে। শুনে ওরা কি বলল জানো?”

” কী?” সুজাতা উন্মুখ হন।

“রায় কিছুই বলেনি, হাজরা বলল, আর নতুন করে কী জঙ্গলে পাঠাবে স্যার? পুরোটাই তো জঙ্গল। এখন কী এমন ভালো আছি!”

ওদিকে ঘুম নেই সৃজিতের। ফেরার সময় জগন্নাথ সামন্তর বলা কথাগুলো আবার মনে পড়ছে। জেলেপাড়া ছাড়িয়ে গাড়ি ফিরছিল তার কোয়ার্টার অভিমুখেই। আচমকাই প্রশ্নটা করেছিল সামন্ত, “আপনার কী মনে হয় স্যার, ভগীরথ কি সত্যি গঙ্গা এনেছিলেন?”

অন্যমনস্কতায় ডুবে ছিল সৃজিত। প্রশ্নটায় ঠিক ঢুকতে পারলো না সে। হোঁচট খেয়ে বলল, “ভগীরথ, গঙ্গা, আমি ঠিক…”

“আমি মহাভারতের ভগীরথের কথা বলছি স্যার। অবশ্য মহাভারতের বনপর্বের মত রামায়ণেও ভগীরথের কথা আছে। ওই অতবড় গঙ্গাকে, ত্রিধারাকে তিনি মর্ত্যে নিয়ে এলেন! এটা হতে পারে?”

“সেরকমই তো লেখা রয়েছে।” সৃজিত বলেছিল।

“আমার কিন্তু অন্য একটা সম্ভাবনার কথা মনে হয়।”

“কী রকম?”

“মনে হয় নদীটা আগে থেকেই ছিল। ঠিক যেমনটা বইছে, সেরকমই বরাবর বয়ে এসেছে। আসলে যেটা ছিলনা তা’হল ব্যবহারের অধিকার।”

“মানে? নদী ছিল, ব্যবহারের অধিকার ছিল না!”

“ঠিক তাই স্যার। যেমন ধরুন শুরুতে ব্রহ্মা, শিব প্রভৃতিদের সঙ্গে  ভগীরথের কথা চলছে গঙ্গাকে আনার ব্যাপারে। এটাকে ডায়লগ বা কনভারসেশন বলা যেতে পারে, আলোচনা। আবার মহাভারতে বলা হয়েছে কখনও জন্হূ আবার কখনও কপিল মুনির সাথে ভগীরথের এই নদী নিয়ে সংঘাত হয়েছে। এরা নদীকে আনার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছেন, মিষ্টি জলের ভাগ নিজেদের গোষ্ঠীর করায়ত্ত করে রাখতে চেয়েছেন অন্যদিকে ষাট সহস্র পূর্বপুরুষকে মুক্তি দিতে মানে আমজনতাকে সেই জলের ভাগ পাইয়ে দিতে, তাদের কৃষিকাজ আর জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাতে ভগীরথ লড়াই করে শেষ অবধি জয়ী হয়েছিলেন।”

হয়ত ঠিক, হয়ত ভুল। তবুও জগন্নাথ সামন্তর কথাগুলো, তার ভাবনা ভালো লেগেছিল সৃজিতের। সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আরেকবার সেল ফোনটা হাতে তুলে নিল সৃজিত। একবার জগন্নাথ সামন্তকে ফোন করা দরকার। জেলেপাড়া থেকে ভগীরথ মণ্ডলকে তুলে শহরে পৌঁছে দিতে সে তার নিজের গাড়িটাই পাঠিয়েছে। জগন্নাথ সামন্ত কতদূর গেল জানা দরকার। যতদিন না সুস্থ হয়ে ভগীরথ মণ্ডল ফিরে আসে, এনকোয়ারি বন্ধ। একটা চিঠি লিখতে বসল সৃজিত, এসডিও সাহেবের কাছ থেকে আরও কিছুটা সময় চেয়ে নিতে হবে।

Facebook Comments

Related posts

One Thought to “ভগীরথ”

  1. যজ্ঞেশ্বর জানা

    অসাধারণ! অপার প্রসন্নতা এনে দেয় কাহিনীর প্রতিটি লাইন। বিজ্ঞান, মহাভারত, রাজনীতি, দুর্নীতিকে ঘিরে আবর্তিত কাহিনী। শুরুর খানিক বাদেই চূড়ান্ত বিষয়বস্তুর আভাস।
    👇
    👇
    ঠিক যেন রেললাইন প্রতিস্থাপনকারী মজুরদের মত মনে মনে তারা বলে চলেছে, হেইসা মারো, জোরসে মার, আউর জোরে…..

Leave a Comment