অলোকপর্ণা

বুধা

বুধা আমাদের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন দেখায় সূর্যোদয় দেখানোর। বুধা আমাদের খাম্বা থৈবির কাহিনি শোনায় তার আরোপিত ইংরেজি উচ্চারণে। দুপুরের দিকে আমি লেকটার সামনে চুপ করে বসে থাকি চিল ওড়া রোদের গায়ে গা লাগিয়ে। ঘরে অমলেন্দু ঘুমোয়, তাকে বিরক্ত করতে মন চায় না, অথচ একটা রামধনু এমন উঠেছে যে না ডাকলেই নয়। নৈঃশব্দ্য নিয়ে নয় ছয় খেলি, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একবার রামধনু একবার অমলেন্দু দেখি, ডাকার আগেই যদি রামধনু মিলিয়ে যায়? ডাকার আগেই অমলেন্দু ডাকে, “কিছু বলবি?”

আঙুল তুলি আকাশে, রামধনুকে যে রামধনু বলা হয় সেটা ভাবতে সময় লাগে, অমলেন্দু ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে রামধনু দেখে ফেলেছে। আমরা হাসি মুখে রামধনু দেখি। পৃথিবীর সব মানুষ হাসিমুখে রামধনু দেখে। বুধা ছাড়া। বুধা আমাদের ছবি তোলে। শুধু আমাদের ছবি, কখনো রামধনু নিয়ে আমাদের ছবি, কখনো লেকের সামনে আমাদের ছবি। বুধা রামধনু দেখে না অতটা যতটা সে আমাদের দেখে।

হ্রদের জলের গভীরে লুকিয়ে থাকা ড্রাগনের নিঃশ্বাসের আওয়াজ সে কান পেতে শোনে রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।

সে শুকনো মুখে আমাদের জিজ্ঞেস করে, কী উপায়ে তার হোমস্টের কথা সবাইকে জানানো যায়। আমরাই তাকে বুদ্ধি দিই, এই যে এত ছবি, ভিডিও, এগুলোকে কাজে লাগাতে। তার স্ত্রী নির্মলা আমাদের স্থানীয় পোশাক পরতে দেয়। আমরা লেকের ধারে চিল পোড়া রোদে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি, মৎসজীবির টুপি পরে কচুরিপানার মাঝে গিয়ে বসি বাতিল নৌকোয়। বুধা আমাদের অনেক ছবি তুলে দেয়, ভিডিও করে, ভিডিওতে আমাদের ওর অতিথি বলে সম্বোধন করে। বুধার মুখে তখন হাসি থাকে, এমনটাই মনে পড়ে এখন।

বুধা তার কবিতা আমাদের শোনায়, সরল প্রাকৃতিক রূপ বর্ণনা, বিশেষণ পরিপূর্ণ ইংরেজিতে অনুবাদ করা কবিতা। আমরা মাথা নাড়াই। বুধা আরও বই বের করে। সেসব বইতে ওর কবিতা থাকার কথা বলে। আমরা পাতা ওল্টাই। বুধার নাম দেখি না কোথাও। বুধাও খোঁজে আমাদের সঙ্গে। না পেয়ে হাল ছেড়ে দেয়। চুপ করে বসে থাকে মোমের আলোয় লেকের ধারে। চাঁদ ওঠে, সে কিছু বলে না। হাওয়া দেয়, সে চুপ করে লেকের জলে সর্পিল চোখে তাকিয়ে থাকে। আমরা বুধার হয়ে ওর কবিতা খুঁজি অন্ধকারে। একটা সময় পেয়েও যাই। বুধার মুখ দেখে মনে হয়, যেন বড় দেরি করে ফেললাম, ওতে তার আর কোনো আগ্রহ নেই এখন। অমলেন্দু আমার লেখার কথা বলে, আমি অমলেন্দুর ছবির কথা বলি, সিনেমার কথাও। বুধা মাথা নাড়ায়। নির্মলা সর্পিল চোখে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকে। গুনগুন করে গান করে। মাঝে মাঝে খাম্বা থৈবির কথা ওঠে। কে কবে কার বুকে ছুরি মেরেছিল, সেসব কথাও হাওয়ায় উড়ে যায়। বুধা গান গায়, কোজাগরী পূর্ণিমায়, ঘুমন্ত ড্রাগন বুকে পড়ে থাকা লেকটার পারে বসে বুধা আমাদের প্রেমের গান গেয়ে শোনায়। সুরটা চেনা ঠেকে। অমলেন্দু সোল্লাসে বলে ওঠে, “বড়ে আচ্ছে লগতে হ্যায়…- না?”

আমি গলা বাড়িয়ে দিই গানে।

এই পৃথিবী, এই জল, এই রাত। বুধা শুকনো চোখে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকে।

নির্মলা আমাদের মেছো ডাল, মেছো সবজি আর যা কিছু মেছো সব খাওয়াতে চায়। একটা কুকুর বসে থাকে দোরগোড়ায়। নাম জ্যাকি। একটা বেড়াল লাফ দিয়ে রান্নাঘরে যাতায়াত করতে থাকে। নাম মিনু। ব্যাম্বু সুটের গন্ধে চারপাশ র র করে। বুধা তৃপ্তি ভরে খায়। এক থালায় নিজের ছেলেকেও খাইয়ে দেয়। আমরা খেয়েও গিলতে পারি না। বেড়াল আসে যায়। পেট ভরে জল খাই।

ঘরে ফিরে বার্মিজ মশারির মধ্যে বসে বাজার থেকে কিনে আনা নারকেল বিস্কুট খাই দুজনে। মন ভরে। অমলেন্দু ঘুমিয়ে পড়ে তার বিছানায়। আমি বাইরে অন্ধকার পার করে জেগে থাকা হাইড্রো প্রোজেক্টের আলোর দিকে চেয়ে থাকি। এই পৃথিবী, এই জল, এই চাঁদ ভাবি।

মাঝরাতে খুব আওয়াজ হয় বুধাদের ঘরের দিক থেকে। অমলেন্দু বলে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে দিতে। ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে আবিষ্কার করি এই দরজায় একখানা ছিটকিনি ছিলো। বাইরে অন্ধকারে লেকের জল নড়ে ওঠে। জলের নিচের ড্রাগনটা আমাদের মতোই এখন স্বপ্ন দেখছে দিন চার।

সকালে আবার যে কে সেই হাঁস, মুরগি, কচুরিপানা। গাড়িচালক খলিল বলল, বুধার দাদা কাল সারারাত বউ পিটিয়েছে। আমরা টোস্ট, ডিম, কলা খেতে খেতে জঙ্গলে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। বুধা আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল তার মোবাইল ফোন হাতে। লেক পার করে গাড়ি চলছে। লোকালয় পার করে গাড়ি চলছে। খাম্বা থৈবির মূর্তি পার করে গাড়ি চলছে। বাংলাদেশ পার করে গাড়ি ছুটছে, এটুকু সময়ে হুড়মুড়িয়ে যতদূর যাওয়া সম্ভব ততদূর। যাওয়ার পথে বুধার ছেলেকে স্কুল থেকে তোলার জন্য গাড়ি থামান হল। বুধার মুখে তখন হাসি ছিল, এমনটাই মনে পড়ে।

রতনে রতন চেনাল টেলিস্কোপ। মহিলা হরিণ, মহিলা বন, সবকিছু মহিলা। মেয়েরা মেয়েদের সাজাচ্ছে, মেয়েরা মেয়েদের খাচ্ছে, মেয়েরা মেয়েদের বেচে দিচ্ছে মেয়েদেরই বাজারে। নাচতে নাচতে হরিণী পার করে যাচ্ছে ভাসমান জঙ্গল। বুধা আমাদের ছবি তুলল। আমরা হরিণী দেখছি, তার ছবি তুলল। আমরা নৌকোয় চড়লাম, বুধা আমাদের সঙ্গে সেখানেও গিয়ে ছবি তুলল, ভিডিও করল। ভাসমান জঙ্গলে নেমে অমলেন্দু ভেসে বেরাল রিন রিন করে। ফিরল পায়ে জোঁক নিয়ে। বুধা আমাদের পায়ে জল ঢেলে কাদা সাফ করে দিল। বুধা ছবি তুলল আমাদের, জঙ্গল নিয়ে, জঙ্গল ছাড়া। নৌকো নিয়ে, নৌকো ছাড়া। রতন সহ, রতন ছাড়া। রতনকে বললাম আমরা “জঙ্গলে মন রেখে যাচ্ছি। কাল নিতে আসবো।” ফেরার পথে বুধা বুধার ছেলেকে আমাদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলল। বুধার মুখে তখনও হাসি ছিলই, এমনটা মনে পড়ে।

বিকেলে বুধা আমাদের নিয়ে গেল বাঁধের ধারে। অপূর্ব সূর্যের আলোয় অমলেন্দু উচ্ছল। রোদে পিঠ রেখে বসলাম। ফের রামধনু। হচ্ছেটা কী! ছন্নছাড়া সবকিছু। বুধার মুখে তখন হাসি নেই। সে এবার গাড়িচালক খলিলের ছবিও তুলতে আরম্ভ করল। বুধা বাঁধের ধারে ক্যাফো খোলার পরিকল্পনা জানাল আমাদের। সে চাঁদ দেখে চমকাল না। তার বয়স করেছে। বয়স্ক হাসি নিয়ে সে মানুষের মুখ দেখল। আমাদের বয়স আন্দাজ করার নির্ভুল চেষ্টা করল। ভারি উচ্চারণে থেমে থেমে ইংরেজি বলে আমাদের খুশি করার চেষ্টাও সে করল। ফেরার পথে মাংস কেনার জন্য গাড়ি থামান হল।

বুধা টাকা চাইল আমাদের থেকে, তখন তার মুখে হাসি ছিল, এমনটাই মনে পড়ে।

স্থানীয় বিড়ি জোগাড় করা হল। বিড়ির সোজা উলটো বুঝি না, আগুন বুঝি। বায়ু বুঝি। বায়ু রাশির জাতক আগুনকে আঁচ দিতে চাইছে। চাইছে আগুন হোক বেশ দাউ দাউ। অথচ বিড়ি জ্বলতে জ্বলতেও নিভে যাচ্ছে। আগুন উঠছে নামছে, নামছে উঠছে, বারবার ওঠানামা করছে। হাত দিয়ে এত্ত আড়াল করছি, তারপরেও, আগুন এগোচ্ছে পিছোচ্ছে। আগুন কি ভয় পাচ্ছে? আগুন জ্বলতে ভয় পাচ্ছে? আগুন পুড়তে ভয় পাচ্ছে? এর চেয়ে হাস্যকর কিছু কী হতে পারে? অমলেন্দু আর আমি দুজনেই হাহা করে হাসি। আর হাত পুড়িয়ে ফেলি বিড়িতে আগুন ধরাতে গিয়ে। জলের নিচের ঘুম ভাঙা ড্রাগন বিরক্ত হয়।

লেকের ধারে উনুন ধরিয়েছে নির্মলা। আজ আমরাই মাংস বানাব। অমলেন্দু এটা ওটা বলে দেয়, মতনৈক্য হয়। নুন কম, ঝাল বেশি ইত্যাদি। জীবনে তবু মাংস ঝলসে ওঠে। বুধা চাঁদের আলোর নিচে বসে আমাদের রান্না দেখছে, অথচ ভাবছে অন্য কথা। নির্মলা ওর আর বুধার বিয়ের ছবি দেখায়। হাসিখুশি নির্মলা, হাসিখুশি বুধা। লেকের ভিতরের হাসিখুশি ড্রাগন।

মাংস খেয়ে আমরা হাঁটতে বেরোই, অমলেন্দু, আমি, বুধা, নির্মলা। কালপুরুষ সেজে বসে আছে কিছু তারা। অমলেন্দু তার তলোয়ার দেখায়, কালপুরুষের মাথা দেখি। অনেক চেষ্টার পর বোঝা যায় আজীবন উলটো দিক থেকে কালপুরুষ দেখে এসেছি। তলোয়ারকে মাথা ভেবে, সম্ভাষণে মাথা ঝুঁকিয়েছি। আর কোপ পড়েছে গলায়। অমলেন্দু আজ চিনিয়ে দিল কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল।

অনেকক্ষণ পর খেয়াল হল বুধা ছবি তুলছে না আর। বুধা আমাদের এই রাতটা বিনামূল্যে খেতে দিচ্ছে। তার জন্য কোনো শুল্ক আদায় করছে না। মদ্যপ ছেলেদের দল বাইক নিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। আমরা চারজন লেকের ধারে চুপ করে দাঁড়াই। কালপুরুষের নিচে দাঁড়িয়ে শীত করে আমাদের। আমরা ফিরে আসি। চেষ্টা করি ফেরত আসার।

পরদিন ভোরে বুধা আমাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে সে আগে বহুবার গেছে, অথচ প্রশ্ন করলে মিথ্যে বলে। বিভ্রান্ত করে। সে ভাণ করে যেন আমাদের সঙ্গে সে এখানে আসতে পেরে কৃতজ্ঞ। আমরা লেক দেখি উপর থেকে। লেকে ভেসে থাকা মাছ নৌকো দেখি। নৌকোয় চড়বো বললে বুধা আমাদের এক এক করে নৌকোয় চড়ায়। আমরা খেয়াল করি, সে আবার ছবি তুলতে শুরু করেছে। লাল চোখ হাঁস, আমাদের নৌবিহার, পুরাতন ব্রিজ, ইত্যাদির। আমরা বুধাকে ওর প্রাপ্য টাকা পয়সা মিটিয়ে বিদায় করবো ভাবি, অথচ সে আনারস গ্রামেও আমাদের পিছু পিছু আসে। ফোনে ছবি তোলে আমাদের আনারসের জেলি কেনার, স্কোয়াশ কেনার। ভিডিও তোলে ঘন্টা পোকার আওয়াজের। আর প্রতিবার সে ভিডিওতে দাবী করে যে এসব তার হোম স্টে তে থাকলে সহজেই করা সম্ভব। যেন এসব হাতের মোয়া। আমাদের উপদেশ মত এই ভিডিও সে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে চায়, এমন ভাবনার কথাও সে আমাদের জানায়। আমরা তাকে বারণ করি না। অথচ মনে মনে বিরক্ত হই তার এসব কথা শুনে। আমাদের ইচ্ছে হয় তাকে নিষেধ করি আমাদের সঙ্গে আসতে। অথবা বারণ করি আর ছবি বা ভিডিও তুলতে। অথবা ভিডিওতে ওই মিথ্যে দাবীগুলো করতে না করি। অথচ আমরা কেউ কাউকে কিছু বলে উঠতে পারি না।

লেকের নিচের ঘুমন্ত ড্রাগন সব সয়ে সয়ে পাথর হয়ে যায়। জল থেকে মাথা বার করে শ্বাস নেওয়া আর হয় না তার। আমরা ফেরার সময় বুধা আর বুধার ছবিদের মাঝপথে নামিয়ে দিই। খলিল বলে, “বুধাভাই জেনুইন লোক।” আমরা তার সারল্য ভাঙাই না। নির্মলা বা বুধা আমাদের লিখতে বলে লেক নিয়ে, জঙ্গল নিয়ে, হরিণ, ভাসমান দ্বীপ, ঘুমন্ত ড্রাগন, খাম্বা, থৈবি, কালপুরুষ, কে কাকে কবে বুকে ছুরি মেরেছিল সেসব নিয়ে। আমরা কথা দিই যে সব লিখবো। সমস্ত লিখবো। আমরা ফিরে আসি। আর কোনোদিন বুধাকে নিয়ে, নির্মলাকে নিয়ে, লেক, লেকের জল, ড্রাগন, চাঁদ, রামধনু, খাম্বা- থৈবি, তরোয়াল, কালপুরুষ, জঙ্গল, টলমলে হরিণী সম্পর্কে একটা শব্দও লিখি না। বুকে ফুটে থাকা ছুরি নিয়ে আমরা কেবল সবটুকু পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে রেখে দিই। আমাদের মন জঙ্গলে ভেসে থাকে, টলমল করে।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment