গৌতম বসু

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর প্রচ্ছন্ন স্বদেশ

দেশ এক দিকে, এবং তার বিপরীত প্রান্তে, বিপক্ষেও বলা যায়, রাষ্ট্র; ব্যক্তি তথা লেখক বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ভাবনায়, সত্তা দু’টি একে অপরের থেকে বহু দূরে চ’লে গেছিল ব’লেই প্রায় সারা জীবন জুড়ে তিনি এতটা সন্তাপ ভোগ করলেন। ‘মাটি’ শব্দটি বিশেষ প্রিয় ছিল তাঁর, কিন্তু তাঁর কবিতার পাঠক বিলক্ষণ জানেন, শব্দটি ব্যবহার ক’রে কেবল মাটিকে চিহ্নিত করতে তিনি চান নি, এ-মাটি যতটা মাটি ততটাই আকাশ, ততটাই নদী, ততটাই মহানগরীর ফুটপাথে মলিন কাঁথার ’পরে ঘুমিয়ে-পড়া পথশিশু। এ-সমস্তই তাঁর মনের মধ্যেই রয়ে গেছিল শেষ পর্যন্ত, ক্রমে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, দেশ যাকে আপন ক’রে নিতে চায়, রাষ্ট্র তাকেই দূরে সরিয়ে রাখতে উদগ্রীব। রাষ্ট্রকে তিনি ক্ষমা করতে পারেন নি, এবং, যা আরও গুরুত্বপূর্ণ, ‘ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা’ লিখেছিলেন ব’লে নিজেকে ক্ষমা করাও তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। তাঁর যৌবনকালে এমনটি ছিল না ; অনেকদিন পর্যন্ত, অনুমান হয়, পাঁচের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, উদ্দীপনার স্পষ্ট চিহ্ন তাঁর লেখায় লক্ষ করা যায়। পাহাড়ের উচ্চতার সমান বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রকে যে সংশোধন করা সম্ভব, সেই বার্তা ‘বেকার জীবনের পাঁচালি’ [কাব্যপুস্তিকা: ‘উলুখড়ের কবিতা’(১৩৬১/১৯৫৪)] প্রভৃতি কবিতার বেপরোয়া মনোভাবের মধ্য থেকে উঠে এসেছে। কবির এবং সেই সঙ্গে তাঁর পাঠকদেরও দুর্ভাগ্য, বাস্তবজগতের বিপরীতমুখী ও বহুগুণ বলশালী স্রোতের মুখে প’ড়ে তাঁর লেখার তরণীও অক্ষত থাকে নি। গোবিন্দচন্দ্র দাস-কে (১৮৫৪/৫৫-১৯১৮)বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদিত একটি কবিতাতেও [‘তোমার স্বপ্নের মঠ’/কাব্যপুস্তিকা: ‘মৃত্যূত্তীর্ণ’ (১৩৬২/১৯৫৫)] কবির আলোকিত মন দেখতে পাওয়া যায়, যা ধীরে-ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে নিম্নগামী, প্রবল জলস্রোতে বিপর্যস্ত। তাঁর দৃপ্তস্বভাবের মধ্যেই, কোথা হতে কে জানে, রাষ্ট্রের কল্যাণকামনা বিষয়ে অনাস্থা আর হতাশার কালো ছায়া এই সময় তাঁকে ঘিরে ধরতে শুরু করে। বিপরীতমুখী ভাবাবেগটি প্রথমে তত তীব্র ছিল না, দেখা দেবার পরেই অন্তরালে চ’লে যেত, সেইজন্য তাঁর লেখা বিষণ্ণ হলেও তখনও সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় নি। কবিতাপাঠকের নজরের আড়ালে চ’লে যাওয়া একটি কবিতায় তিনি লিখছেন:

চকমকি

কী হবে আগুন জ্বেলে,
বরফ-হৃদয়ে সান্নিধ্যে কি লাভ বলো!
নাও, খুলে নাও বাহুবন্ধন ছেলে;
মেয়ে, ঘরে ফিরে চলো।

কী হবে মেঘের সন্ধ্যায়
দেহের আগুনে প্রেমের মশাল বানিয়ে?
পাথর শরীরে পাথরের তাপ মুছে যাবে রাতের ঝরনায়;
কী হবে তা হলে মাদলের সুরে ঋতুবদলের মিথ্যে খবর জানিয়ে?
নাও, খুলে নাও বাহুবন্ধন ছেলে;
মেয়ে, ঘরে ফিরে চলো।
উত্তুরে হাওয়া তুষার ছুঁড়ছে, দাদারিয়া-গান ভোলো!

[ কাব্যগ্রন্থ : ‘লখিন্দর’( ১৩৬৩/১৯৫৬)]

দেশের পরিস্থিতি যত উদ্ভট, সমাজের পরিবেশ যত প্রতিকূল, কবির নিজের ভাষায় ‘সময় নিষ্ঠুর’ হয়েছে, কবির অন্তরস্থ ভাঙন তত তরান্বিত হয়েছে। সাধারণ ভাবে আমরা তাঁর বিভিন্ন সময়ের কবিতা একসঙ্গে প’ড়ে থাকি ব’লে আমাদের দৃষ্টিতে তাঁর মনের রঙবদল ধরা পড়ে না। এই ধরনের পাঠের পরিবর্তে তাঁকে যদি ‘গ্রহচ্যুত’ (১৩৪৯/১৯৪২) থেকে শুরু ক’রে ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’(১৯৮৫) পর্যন্ত অনুসরণ করি, অথবা ক্রম উল্টে নিয়ে ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ থেকে শুরু ক’রে ‘গ্রহচ্যুত’-র যুগপৎ সরল ও উচ্চশিখরে চড়ার প্রয়াস পাই, তাহলে দেখা যেতে পারে, এই বিবর্তন কত সহজে ফুটে রয়েছে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর অন্তর্জীবনে কেবল একটিই খুঁটি ছিল: মূল্যবোধ, তাঁর কাব্যভাবনা, সাম্যবাদের প্রতি তাঁর অনুগত্য, দূঃখী মানুষ এবং পশুপাখি এবং গাছপালা এবং ফুলফলের প্রতি তাঁর অনির্বাণ প্রেম, তাঁর ক্রোধাগ্নি এবং তাঁর অশ্রুস্নান, অবিবেচনাপ্রসূত তাঁর সাহস এবং দুর্গপ্রাকার সমান তাঁর সহ্যশক্তি, সমস্তই ওই অদৃশ্য খুঁটিটি ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। খুঁটিখানা সামান্য শিথিল হত যদি, তাঁর লেখার বাঁকও অন্যরকম হত। কবিতা-বিষয়ক গদ্যরচনায় অথবা বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বাঙলার তথা বিদেশের কবিদের নামোল্লেখ ক’রে তাঁদের প্রতি ঋণস্বীকার করেছেন, সে-তালিকায় উইলিয়ম ব্লেক গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হন নি, অথচ এই কবির সঙ্গেই তাঁর লেখার আশ্চর্য সাদৃশ্য। ব্লেক-এর ছোট-ছোট মর্মভেদী কবিতাগুলি পড়লেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর খর্বাকৃতি লেখাগুলি ― অনুজ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যাদের নাম রেখেছেন ইষদায়ত ― সেই ইষদায়ত রচনাগুলি দপ্‌ ক’রে জ্ব’লে ওঠে, মনে প’ড়ে যায় সামাজিক নিষ্ঠুরতা দেখলে উইলিয়ম ব্লেক এবং বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উভয়ই, কীভাবে যাতনায় ছটফট করতেন। আমরা আরও না ভেবে পারি না, ব্লেক-এর বিশ্বখ্যাত বইদুটির শিরোনাম, ‘সঙ্‌স অফ ইনোসেন্স’ ও ‘সঙ্‌স অফ এক্সপিরিয়ন্স’ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর যাত্রাপথের এক নিখুঁত ধারাবিবরণী।

১৩৬৫/১৯৫৮-তে প্রথম প্রকাশিত ‘জাতক’ শীর্ষক কাব্যপুস্তিকা থেকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর নিজস্ব ‘সঙ্‌স অফ এক্সপিরিয়ন্স’ শুরু হয়। এই প্রথম আমরা লক্ষ করলাম, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাই, তাঁর ভাবনায় হয়ে উঠেছে মানবতাবিরোধী এক সৌধ, কবির শত্রুপক্ষ। এই আস্থালোপের পরেও তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর জীবিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর মনোভাবের কিছুমাত্র রূপান্তর দেখা যায় নি। এই সময় থেকেই তাঁর লেখায় আরও একটি মাত্রা যুক্ত হয়, যা, এমন কি ব্লেক-এর কবিতাতেও নেই, অপরাধবোধ ও আত্মধিক্কার। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর নবার্জিত নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মাত্রা ও আত্মধিক্কারের প্রবল ভাবাবেগ সম্বলিত একটি ক’রে কবিতা আজকের পাঠকের জন্য তুলে ধরা যেতে পারে।

মুখ তোলো, আমার প্রেমিক

চারদিকে কুয়াশা, আমি হৃদয়ের কান্নার তিমিরে
আর যেতে পারি না। আমি চেতনার মহানিশা ছিঁড়ে
ঘুমের স্বপ্নের মুখ আনতে পারলাম না, প্রেমিক
তুমি মুখ তোলো! অবচেতনার প্রেমে চতুর্দিক
আলো হোক। তোমার মুখশ্রী থেকে জ্বেলে নেব আনন্দ আমার।

কিন্তু মূর্তি নিরুত্তর, কালো পাথরের অন্ধকার ।।

[ কাব্যপুস্তিকা : ‘জাতক’( ১৩৬৫/১৯৫৮)]

কবিতা পরিষদের ‘বইমেলা’য়

আমরা সবাই চাঁদের আলোয় বামন
ব’সে আছি অনন্ত ইথারের
একটি বিন্দু কোটিতে ভাগ ক’রে
এই পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ;
এবং ক’জন মার্কাস স্কোয়ারে

আমরা সবাই ক্ষুদ্র ইতর বামন
চাঁদের আলোয় যে যার মুখ দেখে
অন্য সময় মাথার চুল ছিঁড়ি
আয়না ভাঙি; তবু এখন অবাক
ঘাসের ওপর মার্কাস স্কোয়ারে।

কবিতা শুধু কবিতা চারদিকে
যেন জীবন এখন কালপুরুষ
সপ্তর্ষির চেতনা : যেন চুমা
ইতর মুখে চোখে,ইতর বুকে;
আধফোটা এই মার্কাস স্কোয়ারে।

[ কাব্যগ্রন্থ : ‘সভা ভেঙে গেলে’( ১৩৭১/১৯৬৪)]

মার্চ ১৯৭০-এ প্রখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ‘ভারবি’, ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশ করেন, যেখানে ১৩৭৫/১৯৬৮ পর্যন্ত প্রকাশিত সব কাব্যগ্রন্থ/কাব্যপুস্তিকা থেকে নির্বাচিত লেখা সঙ্কলনভুক্ত করা হয়। এই সঙ্কলনের প্রকাশ উপলক্ষে রচিত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ভুমিকা পড়লে বোঝা যায়, পঞ্চাশ বছর বয়সের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছনো কবি, তাঁর প্রথম যৌবনের কবিতাকে ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ আখ্যা দিয়ে মনে–মনে বর্জন করেছেন। আমাদের আরও মনে প’ড়ে যায়, মহানগরী কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রত্যেকটি জেলা, তখন পুলিশের অত্যাচারে এবং ভাতৃনিধনের আগুনে জ্বলছে; হাতবোমা, পিস্তল, পাইপগান ও থানার লক-আপের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে বাঙলার তরুণসমাজের ভাগ্যলিখন, ঘরের ছেলে ঘরে না-ফেরা পর্যন্ত বাড়ির মেয়েরা কালো মুখে বাড়ির জানালার শিক ধ’রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সেই সন্ধিক্ষণে উপস্থিত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর সমস্ত ‘সঙ্‌স অফ ইনোসেন্স’ অস্বীকার করছেন, কিন্তু মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েও, শেষ পর্যন্ত যেন কোনও-এক অজ্ঞাত সঙ্কেত পেয়ে নিজের অস্তিত্ব থেকে সে-কবিতাগুলি ঝেড়ে ফেলতেও পারছেন না। তিনি লিখছেন:

‘ যেহেতু পূর্বরাগ তারুণ্য এবং প্রথম যৌবনের ধর্ম, সেই কারণে বর্তমান কাব্যগ্রন্থের আরম্ভ হয়েছে ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-র ধর্মীয় উপাসনা দিয়ে। নতুবা, ঐ গ্রন্থের প্রকাশকাল মনে রাখলে, কাজটি নিয়ম-বহির্ভূত।

যাঁরা লক্ষ করেছেন, ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-র বেশ কিছু কবিতা ইতিপূর্বে ‘রাণুর জন্য’ অথবা ‘লখিন্দর’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে, প্রশ্ন রাখতে পারেন, আমি কি একাধিক নিয়ম লঙ্ঘন করছি না? আমার কৈফিয়ৎ, কবিতাগুলি ভিন্ন গ্রন্থের অন্তর্গত হলেও, একই সময়ের রচনা। তাদের পুনরায় একত্রে মেশানোর যে ত্রুটি, সে জন্য এই সকল কবিতার ধর্মীয় উন্মাদনাই দায়ী, আমি নই। …

১৮ জানুয়ারি, ১৯৭০ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’

আত্মধিক্কারের এটিও এক পন্থা!

।। ২ ।।

পাঁচের দশকের শেষ প্রান্তে ‘জাতক’(১৩৬৫/১৯৫৮)কাব্যপুস্তিকার ভিতর দিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিজীবনের যুগপৎ অন্ধকারতম ও উর্বরতম পর্যায়ে প্রবেশ করেছিলেন, আমাদের এই অনুমান যদি ভ্রান্ত না হয়, তা হলে, এক রকম নিশ্চিত রূপেই এ-প্রস্তাব রাখা যায়, এ-পর্যায় কেবল উর্বরতম নয়, দীর্ঘতমও। তাঁর ব্যক্তিগত পরিভাষা ― ‘প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’ ― এই সংকটকালেই তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন এবং সেই প্রচ্ছন্ন স্বদেশ থেকে একের পর এক বই ― ‘ সভা ভেঙে গেলে’, ‘মুখে যদি রক্ত ওঠে’,‘ ভিসা অফিসের সামনে’, ‘মহাদেবের দুয়ার’, ‘রাত্রি শিবরাত্রি’, ‘ওরা যতই চক্ষু রাঙায়’, ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে’, আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা’ প্রভৃতি ― অবিরাম ধারায় তিনি নিক্ষেপ ক’রে গেছেন রাষ্ট্রশক্তির দম্ভস্ফীত মুখের উপর। নিষ্ফল প্রয়াস? নিষ্ফল অবশ্যই, কারণ, কে না জানে, জন্মশত্রু তো দূরের প্রতিপক্ষ, কবিতা একটা শ্যামাপোকাকেও মারতে পারে না, কবিতা মানুষকে বাঁচায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সত্যই সিদ্ধিলাভ করলেন কি না, তা স্পষ্ট বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে, কবির ভিতরে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা থেকে নির্গত চোখ জ্বালা-করা যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী প্রথমে দেখা যায় সেটা তাঁর বাইরের আকার মাত্র। আসল কাজটি তাঁর এখানে নয়, ওখানে হয়ে চলেছে, প্রচ্ছন্ন স্বদেশের ধানক্ষেতে; আগুনের কৃষিকাজে ঘাম ঝরিয়ে-ঝরিয়ে যেখানে তাঁর পিঠ বেঁকে গেছে। কী প্রয়োজন এই কৃচ্ছ্রসাধনের, এই আপোষহীনতার, এই আত্মোৎসর্গের? নঞর্থক ব্যবহারে যে শব্দ দু’টি তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন ― ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ ― সে–দু’টি শব্দই যেন নতুন ব্যঞ্জনাসহ আমাদের কাছে ফিরে আসে, ধর্মীয় উন্মাদনা, ‘sacred madness’! সিদ্ধিলাভ বলতে এতটুকু, অথবা সোজা ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে, এতটাই; না হলে, এমনটি হত না যে, জীবনাবসানের পঁয়ত্রিশ বছর পর তাঁর রচনাকর্ম স্মরণ করছেন সেই সব কবিতাপাঠকেরা যাঁরা একদা বইপাড়ার রাস্তায় তাঁকে সেনাপতির দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে যেতে দেখতেন, আবার, স্মরণ করছেন তাঁরাও, যাঁরা তাঁকে চোখেও দেখেন নি।

এই পর্যায়ের কবিতা বহুবার আলোচিত হয়ে গেছে, আমরা এখনই কোনও ভাবনাসূত্র যোগ করতে পারছি না। আমরা ভাবি, একজন যোদ্ধার দায়িত্ব কখনও ফুরবার নয়, তবু তাঁর জীবনে একটা সময় আসেই যখন অস্ত্রখানা নামিয়ে রাখা ছাড়া আর-কোনও বিকল্প তাঁর সামনে থাকে না। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে জীবনে মাত্র একবারই নিজের অস্ত্র নামিয়ে মাথা নিচু ক’রে দাঁড়াতে হয়েছিল, নিজের রোগভোগের কাছে তিনি সসম্ভ্রমে নতিস্বীকার করেছিলেন। তৃতীয় তথা অন্তিমপর্বে মাত্র দু’টি বই আমরা পাই, ‘অথচ ভারতবর্ষ তাদের’ (প্রথম প্রকাশ: মাঘ ১৩৯১/জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫)এবং মরণোত্তর কাব্যগ্রন্থ ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ (প্রথম প্রকাশ: ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫)। অসুস্থতার মধ্যেই, প্রিয়জনদের সহায়তা নিয়ে প্রথম বইটির পাণ্ডুলিপি তিনি নিজেই সাজিয়েছিলেন, মৃত্যুর দু’মাসের মধ্যে প্রকাশিত দ্বিতীয় বইটির পাণ্ডুলিপির পুরোটাই তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা সাজিয়ে দিয়েছেন। এই লেখাগুলিতে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একইসঙ্গে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত; পূর্বপরিচিত কবি এখানে অনুপস্থিত, কারণ ক্রোধ, যা তাঁর কবিতার প্রধান ভাব, এখানে বিরল, আবার তিনি উপস্থিতও বটে, কারণ, তাঁর উদ্বেগের ক্ষেত্র অপরিবর্তিত। দেওয়ালের জঙ্গল অকস্মাৎ শূন্যে মিলিয়ে গিয়ে উন্মুক্ত প্রান্তর ভেসে উঠলে মন যেমন দু’ধারে ছড়িয়ে পড়ে, ফাঁকা ঘরে নিজের কণ্ঠস্বর যেমন হঠাৎ অচেনা বোধ হয়, এই লেখাগুলিও যেন তাই। বিশেষ ক’রে নবীন পাঠকের কথা ভেবে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর জীবনের শেষ দেড়-দুই বছরে রচিত কয়েকটি নির্ভার লেখা আমরা বিনা মন্তব্যে তুলে ধরলাম। সাধারণ ভাবে, লেখা-বিষয়ে মন্তব্য করা পাঠকের অধিকার-বহির্ভূত কাজ না হলেও, কখনও-কখনও তা প্রয়োগ করতে দ্বিধা জন্মায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বগতোক্তিপ্রবণ লেখক ছিলেন না। তাঁর বাক্যালাপের ওধারে, শত্রু অথবা সমব্যথী, কেউ-না-কেউ থাকতেনই। অন্তিম পর্বের লেখায় এর একটা ব্যতিক্রম আমরা লক্ষ করি; চিন্তার জাল তিনি বিছিয়ে দিচ্ছেন না, নিজের ভিতরের অন্য-আমির সঙ্গে বিচারও করছেন না, যা কিছু বলছেন তা ইত্যবসরে ভাবা হয়ে গেছে, কেবল যে মীমাংসাসূত্রটুকু এতদিন ব্যক্ত করা হয় নি, তা-ই যেন একে-একে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু, কে শুনছেন কবির কথাগুলি? হাসপাতালের অশেষ দালান? অনাগত দিনের পাঠক? কার্নিশে ব’সে থাকা ভাবগম্ভীর কাক? আমরা জানি না। যাঁর স্বদেশ প্রচ্ছন্ন, তাঁর শ্রোতাও প্রচ্ছন্ন হবেন, এতে আশ্চর্য হবার কীই-বা আছে! এই কারণবশত, এর আধিক-কিছু আমরা বলতেও পারছি না। নিম্নোদ্ধৃত এগারোটি কবিতার মধ্যে ‘ঘোড়া’ শীর্ষক লেখাটি অপেক্ষাকৃত পুরানো হলেও, অন্তিম বই দু’টির কোনওটিতেই গ্রন্থিত হয় নি। অন্য সব ক’টি রচনা ১৯৮৫-তে প্রকাশিত দু’টি বই থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর অকৃত্রিম বন্ধু সত্যপ্রিয় ঘোষ একবার কবির স্বভাব সম্পর্কে অদ্ভুত, বিমূর্ত, প্রায় দুর্বোধ্য, কিন্তু নিশ্চিতরূপে প্রগাঢ় একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বীরেন জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, কর্মসূত্রে ক্ষত্রিয়, এবং ধর্মবোধে শূদ্র। দীর্ঘ দিন ধ’রে আমরা কখনও ক্ষত্রিয় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কখনও শূদ্র বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা পড়লাম। শেষ জীবনে তিনি কি তবে সৈনিকবেশ আর কাঙালবেশ পরিত্যাগ ক’রে দ্রষ্টার বেশ ধারণ করেছিলেন?

১.
ঘোড়া

হাঁটে না সে, ওড়ে।

মাটিতে পা, কিন্তু তার সমস্ত শরীর
বাতাসের সঙ্গী। তার ডানা নেই,
তবু তার চলায় পাখির গান।

সে ঘুমায় দাঁড়িয়ে, যেভাবে
পাখিরা ঘুমায়।

১৫ মে, ১৯৮৩

‘অথচ ভারতবর্ষ তাদের’ থেকে গৃহীত

২.
সেই রাত্রি

জ্বলন্ত উনুনের মতো
সেই রাত্রি
পৃথিবীকে মনে হচ্ছিল
আগুনের ভিতর
চিৎ হয়ে সাঁতার কাটছে।

দূরের আকাশে অসংখ্য গ্রহ আর নক্ষত্র
তারা কথা বলছিল চোখ দিয়ে, যাতে কোনো শব্দ না হয়।

এক সময় সব কথা শেষ হয়ে গেল
পৃথিবীর আর কোনো চিহ্ন রইল না।

২১ জুন, ১৯৮৪

৩.
যোদ্ধার হৃদয় ব’লে কিছু নেই

যোদ্ধার হৃদয় ব’লে কিছু নেই?
নেই পিছুটান?
যেখানে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে, শিশু-কোলে
মানবী ছায়ার মতো ― শীর্ণ, প্রতীক্ষায় …
বন্দুকের নল ছাড়া তার চোখে আর কোনো স্বপ্ন নেই?

জুন, ১৯৮৪

৪.
মহামানব

আগে তার পা ছিল মাটিতে
এখন তার মাথা আকাশে

যে আকাশ দা ভিঞ্চির
অথবা গ্যালেলিওর
আকাশ নয়

এ আকাশে সে ছাড়া
আর কোনো নক্ষত্র নেই

আগে তার পা ছিল মাটিতে
এখন মাটি থেকে সে অনেক দূরে

সক্রেতিস
কোপার্নিকাস
অথবা স্পার্টাকাস
এসব নাম তাকে আর ছুঁতে পারে না

সে এখন
তাদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে।

তার শুধু একটাই ভয়
তার পোশাকটা যেন ময়লা না হয়
যেন বাতাসে ছিঁড়ে না যায়।

অনেক কষ্টে
সে আকাশে ওঠার
এই পোশাক বানিয়েছে।

৩০ জুলাই, ১৯৮৪

৫.
কবি স্বপ্ন বানায়

কবি স্বপ্ন বানায়, ভিক্ষুকদের রাজা করে
কিন্তু তার নিজের ভিক্ষাপাত্রটিকে
সে পারে না আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে।

সে জন্য তার বেদনাবোধ থেকে যায়
যা তার কবিতাকে শান্তিতে স্বপ্ন দেখতে দেয় না।

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪

‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ থেকে গৃহীত

৬.
মানুষকে পৃথিবীর

মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু জেনে
একদিন চারদিকে চীনের প্রাচীর গড়া হয়েছিল।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন্ধু তাহলে কে?
বহু শতাব্দীর তপস্যায় পরিশুদ্ধ,
শুভ। কী অবাক! সেও তো মানুষ।

ক্রমেই প্রাচীরগুলি ভেঙে যাচ্ছে, তৈরী
হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষের রাস্তা।

২৯ অক্টোবর, ১৯৮৪

৭.
ধুলো

চোখে পড়েছে ধুলো
এমন ধুলো, জলেও যার বেহায়াপনা যায় না।
কবি কি তাই এই পৃথিবীর প্রতি এমন ক্রুদ্ধ?

কবি! তোমার দুর্ভাগ্য, আমাদেরও দুর্ভাগ্য,
ধুলোর সঙ্গে লড়াই করতে করতেই আমাদের
দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা আসবে।

৩ বৈশাখ, ১৩৯২

৮.
হাসপাতালে

প্রায় রোজই
কানে আসতো কান্নার শব্দ।

আমাদের সহ্য হয়ে গিয়েছিল।

মানুষ কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে মাথা খুঁড়ছে
আমরা তখন কিচেনে ব’সে আর-এক বাটি ডাল বা
তরকারি চেয়ে নিচ্ছি।
অথবা সেই বন্ধুটিকে আমাদের সর্বান্তঃকরণে শুভেচ্ছা
জানাচ্ছি, যিনি সুস্থ হয়ে এখনই বাড়ি
ফিরে যাবেন।

এ সব খুব কাছাকাছি ঘটনা। এখানে জীবন আর মৃত্যু
যেন পরস্পরের হাতে হাত রেখে বুঝতে চেষ্টা
করছে সব মানুষের পায়ে-চলার
রাস্তা এক রকমের নয় ―
কেন একজনের জীবন পাঁচ বছরেই শেষ হয়ে
যায়, আর একজন
সত্তর বছরের বৃদ্ধ
মরতে মরতে আবার বেঁচে ওঠে, যদিও পৃথিবীটাকে
তার আর কিছুই দেওয়ার নেই।

৪ বৈশাখ, ১৩৯২

৯.
শ্লোক

পুণ্যবানেরা রচনা করেন সেইসব আশ্চর্য শ্লোক
যাঁরা শোনেন, তাঁরাই ধন্য হন।

পুণ্য কুড়ানো আর পুণ্য বিলানো
দুটো ইচ্ছেই যৌবনে আমাদের চোখে রুমাল দিয়ে
ঘোরাতো,
কিন্তু সেটাই ছিল আমাদের জীবনের সেরা সময়।

২০ এপ্রিল, ১৯৮৫

১০.
এই আগুন তুমি

এত তাড়াতাড়ি তুমি বদলে গেলে?
আমরা অবাক হবো তারও সময় তুমি দিলে না!
তুমি নিলে না ভক্তদের হাততালি! বরং তোমার
চোখের কোণে
এখন ঝড়ের আগুন! এই আগুন তুমি কোথায়
পেলে
চিরদিনের ভালমানুষ?

এপ্রিল, ১৯৮৫

১১.
রোগশয্যায় – এক

‘He is not certain who he was, it seemed
as though he is not himself’

কে আমি? যে-নামে ওরা ডাকে সে তো আমি নই
কিংবা সে আরেক আমি, আমার পোশাক প’রে দিব্যি
রাস্তা হাঁটে, গান গায়।
আমি বুঝতে পারি, কোথাও একটা মস্ত ভুল থেকে যাচ্ছে,
থেকে যায়
যেভাবে বুকের মধ্যে থাকে ভুল কথা, ভুল গান,
ভুল মানবজনম।

৬ মে, ১৯৮৫

এই কবিতাটি রচিত হবার দু’মাসের মাথায়, ১১ জুলাই, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর জীবনাবসান হয়।

ঋণস্বীকার :

১. বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, প্রথম খণ্ড, গ্রন্থবিতান সংস্করণ (১৯৭৭)
২. বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি সংস্করণ (১৯৭০)
৩. বীরেন্দ্র সমগ্র, খণ্ড দুই, অনুষ্টুপ সংস্করণ, সম্পাদনা- সব্যসাচী দেব (২০১০)
৪. বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা,, তৃতীয় খণ্ড গ্রন্থবিতান সংস্করণ (১৯৮২)
৫. অথচ ভারতবর্ষ তাদের, সহজিয়া সংস্করণ (২০১৮)
৬. অফুরন্ত জীবনের মিছিল, কথাশিল্প সংস্করণ (১৯৮৫)
৭. শতভিষা, বর্ষ ৩২, সংখ্যা ৫১, ১৩৯০, সম্পাদনা- মৃণাল দত্ত
৮. প্রভাস, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যা, ২০১৫, সম্পাদনা- মিত্রা চট্টোপাধ্যায়

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment