ঋদ্ধি রিত

বিচ্ছেদ

ট্রেন যখন আলিপুরদুয়ার ষ্টেশনে থামল ঝড়ঝড়িয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরে গাড়ি থাকার কথা। তানবীর তার জিন্সের পকেট থেকে ফোন বার করে ড্রাইভার রামচন্দ্র কে ফোন করলো। গাড়ি বাইরেই আছে, কিন্তু বৃষ্টি না ধরলে তার কাছে পৌঁছতে গেলে তারা কাক ভেজা ভিজবে। অক্টোবরের শেষের দিক, কলকাতার থেকে তাপমাত্রা এখানে বেশ কম। তারসাথে আবার বৃষ্টি। ষ্টেশনের শেডের ভেতরের একটা স্টল থেকে দু’কাপ কফি নিলো কিংশুক আর তানবীর। 

একটু বৃষ্টি ধরতে ষ্টেশনের বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলো দু’জনে। গাড়িটা দুজনের জন্য বেশ বড়, একটা এসইউভি। ড্রাইভার ছাড়াও অনায়াসে ছ’জন বসা যায়। গাড়িতে উঠে ট্রলির চেন খুলে একটা হাতকাটা জ্যাকেট বারকরে টিশার্টের ওপর চাপিয়ে নিলো তানবীর। কিংশুক নিজের মোবাইল বার করে কাউকে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলো, তার চোখের রোদ চশমায় সদ্য স্নান করা এলাকার একটা ছবি ভেসে উঠছে। ফোনের ওপার থেকে উত্তর না পেয়ে মোবাইলটা সে তার পাঞ্জাবির পকেট রেখে সিগারেট বারকরে একটা ঠোঁটের ডগায় লাগিয়ে তানবীরের দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে জিন্সের পকেট থেকে লাইটার বার করে সিগারেট ধরিয়ে আবার জানলার বাইরের সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত হলো। তানবীর সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার বলতো তোর? এই প্রোজেক্টে কি তোর আসার কোন ইচ্ছেই ছিলো না?”

কিংশুক বাইরের তাকিয়েই উত্তর দিলো, “তা কেন? তা ছাড়া আবার তুই আসছিস যখন, তখন এ প্রশ্ন ওঠেই বা কী করে!”

“সেই কলেজের সময় থেকে যে ছেলেটার থেকে সবসময় একটা পজেটিভ ভাইভ আসে, সে কেন এত মনমরা? তোদের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে?” খোঁচা দিলো তানবীর। 

“দেখ আমি তোকে আগেও বলেছি, আমার মনে হয়না সংসদীয় রাজনীতিতে সব ঠিক।” কিংশুক প্রতিবাদ করলো। “তাছাড়া, সংসদীয় রাজনীতিতে হার জিত থাকতেই পারে। আর তোদের মানেটা কি! তুই আবার দক্ষিণাচারি হলি কবে থেকে?”

উত্তরে তানবীর বলল, “আহা! তা কেন? তবে কি বলত, আমার বারবার মনে হয়, মানুষের পালস বুঝতে পারছে না নেতৃত্ব। তুই ভাব এতগুলো কমিউনিটি ক্যান্টিন করে কি লাভ হলো? আম্ফানের সময়ও তো তোরা কম ছুটিসনি? দুটো চব্বিশ পরগণা, মেদিনীপুর, হাওড়া… কোথাও ছুটতে বাদ দিস নি…” 

একটু চুপ থেকে কিংশুক বলল, “ধর, একটা অত্যন্ত সরু গলির বাঁক, তোর হাতে গাড়ির স্টেয়ারিং, পাশ থেকে হাজার জন হাজার কথা বলে তোকে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দেবে, কিন্তু তুই জানিস কি ভাবে গাড়িটা বার করতে হবে, তাই নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে গাড়িটা বার করতে পারবি। তুইই পারবি। যারা পাশ থেকে বলছিল তারা কেউ নয় কিন্তু। এই সময় তোর কি প্রয়োজন বলতো?”

তানবীর জানাল, “নিঃসন্দেহে ধৈর্যই হল মূল কথা”।

“একদমই তাই। তুমি সারা বছর মানুষের পাশে থাকলেই মানুষ তোমার পাশে থাকবে”। একটু থেমে কিংশুক আবার বলল, “ইতিহাস বলছে, উনিশশো বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলোনের সময় কমিউনিস্টরা সেই আন্দোলোনে যোগদান করেনি, তাতে তাদের গ্রহন যোগ্যতাও কমে। কিন্তু তার পরের বছরই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষে কমিউনিস্ট সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পরে, তাতে তাদের গ্রহন যোগ্যতাও আকাশ চুম্বীতে পৌঁছোয়। মানুষের পাশে থেকে কাজ করাটাই আসল রাজনীতি”।

তানবীর আর ঘাঁটালো না। কিন্তু সে এটা বুঝলো, কিংশুকের গুম মেরে যাওয়ার মুল বিষয় রেজাল্ট খারাপ নয়। অন্য কিছু আছে, পরে জানতে হবে, বললে যদি কিংশুক একটু হাল্কা হয়। কারণ একথা সে পায়ই পার্টির নেতাদের মতো বলে থাকে আড্ডার ফাঁকে। তানবীর আজও মনে করে কিংশুক চাইলেই ভালো ভাবে পার্টিটা করতে পারতো, এবং এই সময়ে ভালো নেতাও হয়ে উঠতে পারত। তার এই ভাবনার কারণও আছে, কিংশুক কলেজে পড়ার সময় জিএস ও হয়েছিলো। কিন্তু বাড়ির একরকম প্রেসারেই মাস্টার্স শেষ করেই তাকে চাকরী করতে হয়। চাকরী যোগদানের পর সে আর সরাসরি রাজনীতি করতে চায়নি, কারণ তার মতে রাজনীতি পার্ট টাইম করা সম্ভব নয়। সে তার অভিমত রাখতেই পারে, কিন্তু সরাসরি রাজনীতি সম্ভব নয়। কানে হেড ফোন গোঁজবার সময় রামচন্দ্রকে বলল, “গাড়িটা একটা সিগারেটের দোকানে একটু দাঁড় করিও”।

ঘণ্টা দেড়েক বাদে গাড়ি পৌঁছালো জয়ন্তী নদীর সামনে। কিংশুক গাড়ি থেকে নামার সময় হাতের ঘড়িতে দেখলো এগারোটা কুড়ি। এখানেই কটেজে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পরিবেশ এমন যেন একধাক্কায় বয়স বছর পাঁচ কিংবা তারও বেশী কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি দুটো ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা। ঘর গুলোয় অ্যাসবেস্টারের চাল। দুটি ঘরের সামনে একটা বারান্দা। তারই এক কোনে চারটে প্লাস্টিক চেয়ার ও টেবিল রাখা। মাঝে একটি কাঠের আলগা দরজা, সিঁড়ি দিয়ে উঠে যা ঠেলেই প্রবেশ করতে হয় ঘরে। দুজনে দুটো ঘরে প্রবেশ করলো। আপাতত রামচন্দ্রও তাদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে, পরের দিন সকালে গাড়ি নিয়ে আসবে বলে জানিয়ে গেলো। আজ আর কথাও বেরবে না বলেই স্থির করেছে দু’জনে।  

ইতিমধ্যে কটেজের ম্যানেজার ও রাধুনি বনমালী এসে দুজনের সাথে দেখা করে দুপুরে কি খাবে তা জেনে গেছে। ঘর গুলোর পেছনে একটা আলাদা ছাউনি করা ঘর। সেখানে বনমালী থাকে, তার রান্নার ঘরও সেখানেই। মিনিট পনেরোর মধ্যে দুকাপ কফি নিয়ে এসে সে বাইরের টেবিলে রেখে দুজনকে ডাক দিলো। কিংশুক স্নান সেরে একটা বারমুডা পরে টিশার্টের খুঁটে চোখের চশমার কাঁচ পুঁছতে পুঁছতে এসে বসল একটা চেয়ারে। গোলাকার প্লাসটিকের টেবিলের মাঝে সুন্দর ভাবে সাজানোর জন্য একটা ফুলদানি রাখা আছে, তাতে যদিও এখন কোন ফুলই তার শোভা বিকিরন করছে না। সে আবার মোবাইল বার করে কাউকে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলো, ফোনের ওপার থেকে উত্তর না পেয়ে মোবাইল টেবিলে রাখলো। বারান্দায় বসেই শোনা যাচ্ছে খরস্রোতা জয়ন্তী নদীর বয়ে চলার আওয়াজ। তাদের বারান্দা থেকে নেমেই নুড়ি পাথরের নদী তট, যার ওপর দিয়ে দশ পা হাঁটলেই নদী। নদীর অন্য পাড়ে উঠে গেছে মহাকাল পাহাড়। মেঘ কেটে গেছে আকাশ থেকে। শরতের আকাশে পেঁজা তুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। কিংশুক দেখতে দেখতেই প্রায় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তানবীর এসে টেবিলের ওপর ল্যাপটপটা রাখার শব্দে তার হুঁশ ফিরলো। একবার তার দিকে দেখে কিংশুক বলল, “আমি আমৃত্যু এখানেই থাকতে চাই”। 

তানবীর পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “তুই কি এখানে জমি কিনে বাংলো বানানোর প্ল্যান করছিস! না, সে করতেই পারিস, কিন্তু সরকারি অনুমতিটা… আসলে ঠিক এই জায়গায় সরকার তোকে নিজের বাংলো বানাতে দেবে কি? আচ্ছা সে না হয় আমি দেখে নিচ্ছি, তুই ভাবিস না… শুধু্‌…”

 “শুধু কি?” প্রশ্ন ছুঁড়ল কিংশুক।

“কিছুই না, প্রতি মাসে এসে থাকবো এক সপ্তাহ করে। আর, এই আশা যাওয়ার খরচ টা তুই দিয়ে দিবি” হেসে বলতে বলতেই তানবীর ল্যাপটপ চালু করলো। দুজনে এসেছে তাদের অফিসের প্রোজেক্টে। এই বক্সা-জয়ন্তি বিস্তৃত পাহাড়ি বনভূমি অঞ্চলে কিছু এমন গাছের সন্ধান পাওয়া গেছে যা অত্যন্ত বিরল প্রজাতির। সেই সমস্ত গাছের একটি বিশেষ গুন হলো মাটির বাঁধন কে মজবুত করে। আশা করা হচ্ছে এই গাছ ধসপ্রবণ পাহাড়ি অঞ্চলে বেশী লাগালে হয়তো ধসের প্রবনতা কমবে। সেই সমস্ত গাছের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের স্যাম্পেল সংগ্রহ করাটাই কিংশুক আর তানবীরের প্রধান কাজ এখানে। দিন পাঁচেক তারা এখানেই থাকবে, তারপর ফিরে গিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণের একটা রিপোর্ট তাদের কম্পানিকে দেবে।

তানবীর এই সময় ল্যাপটপে কিছু কাজ করলেও কফি ও গোটা পাঁচেক সিগারেট শেষ করা কিংশুক শুধুই প্রকৃতিকেই অনুভব করে গেলো। নিজের মধ্যেই বারবার শুধু ভাবতে থাকলো, কি অদ্ভুত সুন্দর এই প্রকৃতি, যার সৃষ্টি ও বিনাশ তার নিজের খেয়ালেই সে করে চলে। বর্ষা এলেই এই এঁকে বেঁকে চলা ছোট্ট নদীটাই তার দু-কুল ভাসিয়ে দেয়। আবার সভ্যতা গড়ে ওঠে এই নদীর চড়েই। আচ্ছা বর্ষার ঐ নদীর আর তার পাড়ের বন্ধুত্বের মধ্যে যে চরম সংঘাত ঘটে তারপর তারা আবার কিভাবে এক হয়? কে কাকে দায়ী করে? কেই বা নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থী হয়? কেনই বা অপরজন বারবার ক্ষমা করে দেয়।  

বনমালী আবার উপস্থিত হয়েছে সেখানে, হাতে একটা ট্রে, তাতে দুখান কাঁচের প্লেট, দুটো কাঁচের বড় বাটি, একটায় ধোঁয়া ওঠা ভাত আর অন্যটায় মুরগীর ঝোল, একটা প্লেটে কাঁচা পেঁয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা, একটা ছোট বাটিতে টম্যাটোর চাটনি, অন্য একটা প্লেটে সেঁকা পাঁপড়, জল ভর্তি কাঁচের দুটো গ্লাস ও একটা জলের বোতল। খাবার সময় কিংশুক বনমালীকে নদী পেরিয়ে মহাকাল পাহাড়ে ওঠা যায় কিনা জানতে চাইলে, বনমালী জানায় “তা বাবু, যাওয়াই যায়। তবে ওখানে বড় চিতার উৎপাত,। যেতে চাইলে আমায় বলবেন, আমি ব্যবস্থা করে আপনাদের নিয়ে যাব”।

দুপুরে খাবার পর দুজনেই অল্প ঘুম দিলো। বিকালের দিকে নদীর ধারে গেছিলো। হাতে জুতো নিয়ে খালি পায়ে নদী পার করে দুজনেই মহাকাল পাহাড়ের দিকটায় ঘুরে আসে। জলে পা দিয়েই বোঝা গেছে যেন সদ্য বরফ গলে যাচ্ছে সাজিয়ে রাখা নুড়ি পথের ওপর দিয়ে। এখানে ঝুপ করে অন্ধকার নামে। অন্ধকার নামতেই নদীর ধার থেকে ফিরে তারা গায়ে চাদর চাপিয়ে বাইরের চেয়ারে বসলো। একটু আগেই এখানে কারেন্ট গেছে। বনমালী হারিকেন আর পিঁয়াজি দিতে এসে বলে গেছে এটা রোজকার বিষয়, আলো এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে। তানবীর হারিকেন নিয়ে ঘর থেকে একটা হুইস্কির বোতল এনে টেবিলে রাখে। কিংশুক দেখে মৃদু হেসে দুটো গ্লাস এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এই নিকষ আঁধার কি সুরা পান কেই আমন্ত্রণ জানায়?”

তানবীর গ্লাসে মদ ঢালার সাথেই উত্তর দেয়, “আর কিছু তো চোখেও পড়েনা। শুধু কানে আসছে বয়ে যাওয়া জলধারার শব্দ আর তোর গলার স্বর”। একটা গ্লাস কিংশুককে এগিয়ে দিয়ে সে আবার জানতে চায়, “ভোট তো শেষ, কী বুঝছিস!”

কিংশুক পেগে এক চুমুখ মেরে বলে, “দেখ, so called প্রগতিশীল বাঙালির মধ্যে অচেতন ভাবে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাটা ছিলো। সেটা বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে…”

কিংশুকের কথা শেষ না করতে দিয়েই তানবীর বলল, “তুই কি বঙ্গভঙ্গের কথা বলছিস? হ্যাঁ, সে সময় রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করলেও, তাঁর ছাত্র প্রমথনাথ বিশীর মতো মানুষরাও বঙ্গভঙ্গের সপক্ষে কথা বলে। এরকম প্রমাণ আরো আছে।”

“শুধু তাই বা কেন? এই যে কলকাতার বিরিয়ানির দোকানে লেখা থাকে ‘No Beef’, এই শব্দটাও তো সাম্প্রদায়িক”। কথাটা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে কিংশুক আবার বলল, “এক সময় সমগ্র বাংলায় ঈদও ছিলো বাঙালির প্রধান একটা উৎসব। আজ শুধুই দুর্গা পুজো কেন? তার সাথে আবার ধণতেরস পালন করছে বাঙালি। আমি কোন কিছুকেই adopt করতে বারণ করছি না, কিন্তু নিজের সভ্যতার, নিজের ইতিহাস কে ভুলে যাবে? এখন কটা বাড়িতে নবান্নর সময় পিঠে পুলি হয় বলতো? ভাদ্র মাসে রান্না পুজো হত, তাতে কত রকমের পদ, কতগুলো ভাজা- শাক, আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো, চিচিঙ্গে, কাঁচকলা তো ছেড়ে দে, শসা ভাজা হত। চালকুমড়ো দিয়ে মুসুর ডাল, চালতার টক। সব বাঙালির পাত থেকে হারিয়ে এখন মোমো আর বার্গার”।

“রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি… দাড়ি বুড়ো কি সাদ করে এ লাইন লিখেছিল? অথচ ভাব এই বাংলাতেই চৈতন্য, এই বাংলাতেই লালন”। একটুকরো ক্লেশযুক্ত হাসির সাথে কথাটা শেষ করে পেগে শেষ চুমুক দিয়ে, ফাঁকা গ্লাসটা তানবীর টেবিলে রাখল, কিংশুকও তার দিকে নিজের গ্লাস এগিয়ে দেয়। গ্লাস গুলোয় দ্বিতীয় পেগ ঢালার সময় সে জিজ্ঞেস করলো, “জাক গে, পৌষালীর কি খবর? ভোটের সময় তো রোজই টিভির পর্দায় ছিলো, এখন একটু চাপ কমলো? নাকি নতুন কোন খবর নিয়ে story বানাচ্ছে?”

দ্বিতীয় পেগের গ্লাস হাতে নিয়ে কিংশুক বলল, “জানিনা। শেষ পাঁচ দিন কথা হয়নি”।

“তুই এখানে এসেছিস জানে না?” একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো তানবীর।

“না, পরশু রাতে একবার ফোন করেছিলাম, ধরে নি” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানায় কিংশুক। 

“ওয়াটসঅ্যাপ বা মেসেজও করিস নি?” তানবীর জিজ্ঞেস করলে, উত্তর দিলো না কিংশুক। এতক্ষণে তার মাথায় ঢুকে গেছে কেন এত মনমরা আছে কিংশুক। সে আরেকবার জানতে চায় “আমি কি একবার ফোন করবো?”

মাথা নেড়ে না বলে কিংশুক।

তানবীর আরেকটা কি বলতে যাবে মাঝে ব্যঘাত দিয়ে মোবাইল বেজে উঠল, তার স্ত্রী স্নেহা ফোন করেছে। ফোন ধরে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নদী তটের ওপর পায়চারি করছিলো সে। কিংশুক ওখানেই বসে পণ্ডিত ভীমসেন জোশির একটা ইমন কল্যান চালিয়ে শুনতে শুনতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পেগ শেষ করার সময় অন্ধকারের মতোই তাকে আবার ঘিরে ধরে একাকীত্ব। চতুথ পেগ বানানোর সময় কারেন্ট আসায় সে লন্ঠনটা নিভিয়ে গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল।

ঘরের একপ্রান্তে একটা সিঙ্গেল খাট, পাশে বেড টেবিল। অন্যদিকে আলমারির আর খাটের মাঝখানে দিয়ে বাথরুমে যাবার পথ। ঘরের আরেক কোনে আরেকটা টেবিল। সেখানে একটা টিভি রাখা। চলে কিনা জানা নেই। বিছানায় একটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই ও রাশিয়ান লেখিকা ও বলসেভিক পার্টির কর্মী সিসিলিয়া বোব্রোভাস্কায়ার বই ‘Rank-and-File Bolshevik’ সেই সঙ্গে করে এনেছে। কিংশুক বিছানায় বসে ল্যাপটপ চালু করলো। অফিসের কিছু কাজ করলেও তাতে ঠিক করে মন বসাতে পারলো ন।  আধঘন্টা বাদেই সে তার ল্যাপটপে আবারও পণ্ডিত রবি শঙ্করের বাজানো একটা রাগ-ঝিঁঝোটির একটা মিউজিক পিস বাজালো। এটা ওর খুবই প্রিয়। যখনই খুব মন খারাপ হয়, কিংশুক এর শরণাপন্ন হয়। তাতে একটু শান্তি পায়।  মিউজিক পিস শুনতে শুনতে ল্যাপটপ সরিয়ে খাটে রেখে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে নিজের কবিতার খাতা বারকরে লিখলো,

অকাল বৈশাখীর ঝড়ের মধ্যে বিস্তীর্ণ নদী তটে
কোন এক দিকশূন্যপুরের দিকে হেঁটে চলেছি।
ভুল বসত ট্রিগারে হাত পরে ছিটকে যাওয়া স্বপ্ন
আর কবিতায় জমে থাকা ভালবাসারা 
ভেসে যাচ্ছে খরস্রোতায়।

তোমার রাগ ক্রমশ কুড়ে খাচ্ছে আমায়,
বেদনায়, যন্ত্রণায় ঝাঁঝরা হয়ে চলেছি।
মন্ত্রহীন গানের ভেতর চুল্লীর আগুনে
ছারখার হয়ে চলেছে লজঝরে হৃদয়;
তোমার অভিমান, না বলা কথার আগুনপাহাড়
আকাশ হয়ে ভেঙে পড়ুক আমার মাথায়, পিঠে, ঘাড়ে।

ঘুমের ভেতর আয়তকার প্রেমে তুমি তুলে আনো
হঠাৎ ঝরে যাওয়া জীবনের সংজ্ঞা। 
অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, অসম্পূর্ণ বন্ধুত্বের খোঁজে
এই আকাশে, এই নদীতে, এই বিস্তীর্ণ নদী তটে 
মুক্তির আশায় হাত বোমায় বেঁধে চলি নিজেকে…

রাতে খাবার টেবিলে বসে রুটি আর চিকেন কারী খেতে খেতে কিংশুক জানায়, তার দোষেই পৌষালীর কথা বন্ধ। কদিন বেশ চাপে ছিলো দুজনেই, কিন্তু একদিন ফোন তুলে বেমক্কা তাকে কথা শোনায় কিংশুক, পৌষালীর কোন রকম কথাই সে আমল দেয়নি। ঐ ঘটনার এক ঘন্টার মধ্যে বোধদয় হলে কিংশুক ফোন করে ক্ষমা চায়। কিন্তু ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে। পরদিন ফোন করলে পৌষালীও বেশ রূঢ় ভাবেই কথা শোনায়। তানবীর জানে পৌষালী অত্যন্ত বুঝদার ও শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। কিংশুক নির্ঘাত খুবী খারাপ ভাবে কথা বলেছে, তাই সে ঐ ব্যবহার পেয়েছে। তানবীর হিসাব করে দেখলো, এই ঘটনার পরের দিন থেকেই বাবু কাজে ঠিক ভাবে মন দিচ্ছে না, সবসময় উদাসী হয়ে ভাবছে।

পরদিন সকালে যখন তানবীর কফি শেষ করলো তখন প্রায় দশটা বাজে। রামচন্দ্রও এসে গেছে, তারা বেরোবে। কিংশুকের পাত্তা নেই। ফোন করতে ফোন বেজে যাচ্ছে, বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে তার রিংটোন। ওর দরজা বন্ধ। চার পাঁচ বার দরজায় পর আওয়াজ করবার পর তানবীরের সন্দেহ হলে ছিটকিনি ভেঙে ঘরে ঢোকে। কিংশুক ঘুমচ্ছে বিছানায়, বিছানার পাশের বেড টেবিলে জলের বোতল, মোবাইল, মানিব্যাগ, ঘড়ি, সিগারেটের বাক্স আর তার ওপর রাখা লাইটার। তানবীর কিংশুকের গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে আঁতকে উঠলো, শরীর ঠাণ্ডা। পাশের মোবাইলে লাস্ট ওয়াটসঅ্যাপ পৌষালীর, “Hi Kingshuk, working. If anything urgent please send me a message. Thanks.”। তানবীর এবার নিজের পকেট থেকে মোবাইল বার করে পৌষালীকে ফোন করলো। পৌষালী ফোন ধরে, শান্ত স্বরে বলল, “হ্যাঁ, তানবীর, বলো… ”

তানবীর নিজেকে কোন ভাবে সামলে বলে, “কিংশুক…”

তানবীরের কথা না শেষ করতে দিয়েই পৌষালী বলে, “তানবীর, তুমি তোমার বন্ধুর জন্য ওকালতি করতে ফোন করেছো? আমি জানিনা তোমাকে তোমার বন্ধু ঠিক কি ক বলেছে? কিন্তু একটা জিনিস কি জানত, কেউ তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিনশ চৌঁষট্টি দিন খুব ভালোভাবে কথা বলে তোমার সাথে, কিন্তু একদিন তোমায় একটা থাপ্পড় মারলো সে, সেটা কিন্তু বাকি দিনের জন্য চাপা পরবে না। ওটা থাপ্পড়ই থাকবে”। 

তানবীরের দুচোখ ধরে জলের ধারা নেমে চলেছে, তা সামলে আবার ভাঙ্গা স্বরে বলার চেষ্টা করে, “না, আসলে কিংশুক…”

পৌষালী একটু শান্ত ভাবে বলে, “শোন তানবীর, তোমার মত বন্ধু পাওয়া দুষ্কর। তোমার মত বন্ধু থাকার জন্য এ যাত্রা বেঁচে গেল…”

তানবীর আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্নার সাথে বলল, “পারলাম না এ যাত্রা বাঁচাতে”

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment