চন্দন দাস

বাংলা কবিতার স্বাধীন পুরুষ মহাপৃথিবী’র কবি শম্ভু রক্ষিত

একটা গোটা জীবন ছিল কবিতার জন্য উৎসর্গ। শুধু কবিতাকে ভালবেসে পার্থিব সুখকে হেলায় উপেক্ষা করে সুদীর্ঘকাল ধরে নিষ্ঠা ও ধৈর্য্য সহকারে; ঘন্টা বাজিয়ে ছুটন্ত ঢেউয়ের শব্দে বাংলা সাহিত্যে নতুন ভাষা চয়নের মাত্রা যোগ করেছিলেন মহাপৃথিবীর কবি শম্ভু রক্ষিত। তিনি গত ২৯ জুন সকাল আটটায় নিজস্ব বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শুভানুধ্যায়ী, গ্রামবাসী, আত্মীয় পরিজনবেষ্টিত হয়ে পুত্র, জামাতা, এক সাহিত্য সেবকের কাঁধে চেপে মহাপ্রস্থানে চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী কবি শম্ভু রক্ষিত। স্থানীয় চাঁপী-পানা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। 

প্রথাগত শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনদিনই আগ্রহ ছিল না। হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। তাও আবার শেষ করতে পারেননি। জন্ম হাওড়ার মামাবাড়িতে ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট। প্রথম স্কুলজীবন পৈতৃক ভূমি পূর্ব মেদিনীপুরের সুতাহাটা থানার স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে। হাওড়ার স্কুলে পড়ার সময় বাংলার শিক্ষক মহাশয় ব্যোমকেশ লাহার উৎসাহে ‘মা’ নামে দেওয়াল পত্রিকা দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনা করেন। এরপর হাংরি আন্দোলনে মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, শুভ আচার্য, ফাল্গুনী রায়, তুষার রায় প্রমুখ কবিদের সঙ্গে আলাপ হয়। সেই সময় পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তখন বয়স মাত্র ষোলো। কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর হাংরি আন্দোলনের জন্য ‘ব্লুজ’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলা ১৩৭৪ সালে ওই পত্রিকায় একটি সংখ্যায় ৫৩ বছর আগে মাত্র ১৯ বছর বয়সের ‘ভালবাসা সম্পর্কিত নীতি ও বোধের কবিতা’ নজর কাড়ে সাহিত্যমহলে। তাঁর প্রথম কবিতা ছিল ‘আমি বাঁচতে চাই’, সময়টা ছিল ১৯৬৪-৬৫ সাল। হাংরি আন্দোলনে সেই সময়কার কবি-লেখকদের মধ্যে ভাষা ব্যবহারে অশ্লীলতার অভিযোগ থাকলেও শম্ভুদার ভাষা ব্যবহার ছিল সংযত-স্বতন্ত্র।

এরপর ১৯৭০ সাল থেকে ত্রৈমাসিক কবিতাচর্চা ও প্রকাশনার ‘মহাপৃথিবী’ লিটল ম্যাগাজিন সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন। আজ বাংলা সাহিত্যে যা একটা বিরল দৃষ্টান্ত। অথচ শম্ভু রক্ষিতের তেমন কোনো আর্থিক বল নেই। 

পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত শম্ভু রক্ষিত। কিন্তু স্মৃতিশক্তির প্রখরতা অবাক করার মতো। এক নাগাড়ে কবি-সাহিত্যিকদের বাড়ির ঠিকানা সহ নাম অনর্গল বলতে পারেন। আমাকে মহাপৃথিবী’ প্রকাশ ও সম্পাদনা করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তিনি। এখন তা নিয়মিত প্রকাশ হয়। শম্ভুদা কবিতা বাছাই করে দিতেন। শম্ভুদা সহ বাড়ির সকলের একান্তই ইচ্ছা মহাপৃথিবী পঞ্চাশ বছর উদযাপন বিরিঞ্চিবেড়িয়াতে যেন হয়। কবির ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ নিজস্ব বাসভবনে (নন্দায়ন) অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির কবি-লেখক; শম্ভুদাকে সংবর্ধনা জানাতে জড়ো হয়েছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে ‘শব্দগুচ্ছ’র সম্পাদক কবি হাসান আল আব্দুল্লাহ সম্মান জানিয়ে বলেন, সাতচল্লিশ বছর আগে প্রকাশিত ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ আজ বাংলা কাব্য সম্পদভাণ্ডারে মূল্যবান রত্ন। বিরিঞ্চিবেড়াকে তিনি তীর্থভূমি হিসেবে দেখেন। 

২০০৪ সালে ১৭-২৩ মার্চ অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস গ্যালারিতে যে অবিস্মরণীয় চিত্র প্রদর্শনী হয় তা সত্যিই বিরল দৃষ্টান্ত। বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক কালীকৃষ্ণ গুহ-র আন্তরিকতায় প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রবীন মণ্ডলের উদ্যোগে চল্লিশজন বিশিষ্ট চিত্রকরের অঙ্কিত ক্যানভাস যা ভালবাসার উপহার হিসেবে কবি শম্ভু রক্ষিতকে প্রদান – তাকে অর্থমুল্যে পরিমাপ করতে চাওয়া বাতুলতা মাত্র। 

 

শম্ভুদা কবিতাকে দুলিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর কবিতা হল একটি দোলনায় একটি শিশুকে চড়িয়ে দিয়ে ঠেলে দেওয়া। অমনি তাঁর দোলনায় অজস্র পুষ্পবৃষ্টির মতো আপনা থেকেই শব্দ এসে জড়ো হয়। তাঁর বাকপ্রতিমা আপনা থেকে দুলত, দুলে আবার আর একটা বাকপ্রতিমায় একটা স্রোতের মধ্য দিয়ে একটার পর একটায়। এটাই শম্ভুদার কৃতিত্ব।

কাব্য ভাবনার মাটিই যাঁর সর্বস্ব সেই শম্ভুদার কাব্যচর্চা যেন রণক্ষেত্রগুলিতে বিদ্ধ ছিন্নবাহু যোদ্ধার কবিতার শেষ উদাহরণ। এমন একজন কবি-সম্পাদক তাঁর ব্যক্তিজীবনে কোনকিছুর সাফল্যের তোয়াক্কা না করেও কীভাবে এত বছর চালিয়ে যেতে পারেন একটা কবিতার কাগজের সফল পত্রিকা মহাপৃথিবী! তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত কিছু শব্দ ও বাক্য বিন্যাস দেখে মনে হয় তিনি বিদ্যুতের পিঠে বসে মহাকালকে শাসন করেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে প্রবেশ করা দুরূহ ব্যাপার। এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকার ও শুভেচ্ছা বার্তায় কবি জ্যোতির্ময় দত্ত তাই বলেন, “শম্ভু রক্ষিত এমন কোন কবি নন যিনি বড় বড় হলে বক্তৃতা দিয়েছেন। পৃষ্ঠপোষকদের সম্মান পুরস্কার দিয়েছেন বা পেয়েছেন। তিনি এমন মসৃণ কবিতা লিখেছেন যে মন্ত্রীরাও পর্যন্ত বুঝতে পেরেছেন এমন না! তার কবিতা অতি রহস্যময়, দুর্বোধ্য, তার ভাষা বিচিত্র এবং অনন্য। শব্দচয়ন অন্যলোকে। মনে হয় অনেকটা বাংলায় কিন্তু এটা গন্ধর্বদের ভাষাও হতে পারে।” 

তবে এই কয়েক বছর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হওয়ার ফলে উপলব্ধি হয়েছে দু’ভাবে। এক ব্যক্তি শম্ভুদা, দুই কবি শম্ভু রক্ষিত। আমি মনে করি যে যতই বড় মাপের কবি-লেখক হোক না কেন, তাকে আগে দরদী মানবতাবাদী হতে হবে। তারপর কবি-লেখক। মুখ আর মুখোশ এক হবে। শম্ভুদার ভিতর-বাহির মিলেমিশে একাকার। মহাপৃথিবীতে অনেক কবিতা প্রকাশ করতেন। তার এ কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে গিয়ে কোন বাণিজ্যিক প্রলোভন তাঁর আসন টলাতে পারেনি। এই সময়কালের মধ্যে তিনি প্রায় ১৫৫০০ (পনের হাজার পাঁচশ) কবিতা প্রকাশ করেছেন প্রায় ১৫০ (দেড়শ) মত বিখ্যাত লেখক-কবিদের কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশনা থেকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ ভট্টাচার্য, রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী, আলোক সরকার, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূমেন্দ্র গুহ, মানিক চক্রবর্তী, কালীকৃষ্ণ গুহ, অশোক দত্তচৌধুরী প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে বয়েসের ফারাক থাকলেও শম্ভুদা সকলের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতো। তাঁর প্রথম দিকের সাহিত্যবন্ধু ছিলেন নিশীথ ভড়, অমিতাভ গুপ্ত, আলোকজ্যোতি রায় সহ অনেকে।

অশক্ত শরীরে শম্ভুদা বিছানায় দিন কাটাচ্ছিলেন। কয়েক মাস তিনি বাইরে বেরুচ্ছেন না। মারাত্মক দারিদ্র লাঞ্ছিত এই পারমার্থিক কবিজীবন; তাঁর নিজস্ব ভাষায় ক্ষুদে কাগজ ‘মহাপৃথিবী’র জন্য সেইসব প্রিয় কবির দরজায় সাতসকালে হাজির হন, ভিক্ষা চান কবিতা; এই মাধুকরী বৃত্তির কবি আজ গৃহবন্দী। পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে এত গুণগ্রাহী কবিবন্ধুদের নিজ বাড়িতে দেখে তিনি আপ্লুত। তিনি সুস্থবোধ করেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বন্ধুকবি দীপক রায় শম্ভুদার বাড়ি আসেন। দীপক রায় আর শম্ভুদার জন্মসাল আবার একই। দু’বন্ধুর আডডার প্রিয় জায়গা হল আবার রেল লাইনের ধার। দীর্ঘক্ষণ কবিতা বিষয়ক আলোচনার পর শম্ভুদা বন্ধুকে লিখলেন কয়েকটা লাইন। আর এই লেখাটি হল শম্ভুদার কবিজীবনের শেষ লেখা-

“এখানে আকাশ শেষ
এখানে এসো, ওপরে
দেখা যাবে বিন্দু।”

 

১৯৭৫ সালের ২৬ জুন মধ্যরাত থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজীর ইমার্জেন্সি শুরু হয়। রুদ্ধ হয় বাক্ স্বাধীনতা। চালু হয়েছিল সেন্সরশিপ আইন। যে-কোনো লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতে গেলে সেন্সর কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। সেই সময়ের বহু কবি, শিল্পী, সাংবাদিকগণ যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইছেন কিন্তু ছাপার অক্ষরে তা জনসমক্ষে জানাতে ভয় পাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় ২৭ বছরের অকুতোভয় তরুণ লেখক শম্ভুদা প্রতিবাদ করলেন। তিনি বললেন, “কে সরকার? আমরা মানি না এই ফতোয়া।” মানসিকভাবে অস্থির হলেন শঙ্খ ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, জ্যোতির্ময় দত্ত প্রমুখ। তারা ঠিক করলেন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে প্রতিবাদ পত্র পাঠাবেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়েছিল, তাঁরা মনে করলেন প্রতিবাদপত্র পাঠানোর চেয়েও গুরুতর কিছু করতে হবে যাতে সরকার সমস্যায় পড়ে। সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্ত সিদ্ধান্ত নিলেন ‘কলকাতা’ পত্রিকা প্রকাশ করবেন। যেখানে নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কবিতা ছাপা হবে। এই প্রতিবেদককে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, এই কাজের জন্য কারো সহায়তা পাননি, একমাত্র শম্ভু রক্ষিত ছাড়া। জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে নানান লেখা কখনও কলকাতায়, কখনও বারাকপুরে গোপন ছাপাখানায় নিজেই কম্পোজ করে মেশিনে ছাপাতেন শম্ভুদা। সম্পাদক ছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত আর প্রকাশক ও মুদ্রক শম্ভুদা। ‘রাজনীতি’ বিশেষ সংখ্যায় শম্ভুদা সহ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গৌরকিশোর ঘোষ দুটি লেখা আনন্দবাজারের জন্য লিখেছিলেন, কিন্তু সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে সে লেখা ছাপাতে তারা রাজি না হওয়ায় ১৯৭৫ সালের ৩০ শে আগস্ট ‘কলকাতা’ পত্রিকায় বিশেষ রাজনীতি সংখ্যায় শম্ভুদা গৌরকিশোরবাবুর দুটি লেখা ছাপিয়ে কলকাতার গান্ধীমুর্তির পাদদেশে পোস্টার আকারে সেঁটে দিয়ে আসেন। পুলিশের নজরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা তারা বাজেয়াপ্ত করল। শম্ভুদাকে পুলিশ খুঁজতে শুরু করে। বাড়িতে হানা দেয়। লেখাদুটি ছিল ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’, ‘রূপদর্শীয় সোচ্চার চিন্তা এবং পিতার পত্র পুত্রকে’। শম্ভুদা ছদ্মবেশে ছদ্মনাম দীপক সরকার পরিচয়ে কলকাতায় পত্রিকা ছাপার কাজ দেখছেন। পুলিশ শম্ভু রক্ষিত ভেবে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এক বছর ধরে শম্ভুদা আর জ্যোতির্ময় দত্ত আন্ডারগ্রাউণ্ডে। জ্যোতির্ময় দত্ত অজ্ঞাতবাসে থাকতেন। দেবব্রত রায়ের বাড়িতে গোপনে থাকাকালীন শম্ভুদা দেখা করতে গেছেন। পুলিশ পিছু নিল তার। তাড়া খেয়ে জ্যোতির্ময় দত্ত লাফ দেন। আর শম্ভুদা জানালার রড খুলে পালিয়ে যান। কিন্তু পুলিশ শম্ভুদার ফেলে যাওয়া ডাইরি পেয়ে যান। ডায়েরির সূত্র ধরে পুলিশ সোজা মেদিনীপুরের বাড়ি পর্যন্ত খুঁজতে যায়। পিতা নন্দলাল রক্ষিতকেও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। ১৯৭৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত মানুষশিকারী অশোক খাসনবিশের পাতা ফাঁদে শিয়ালদহ স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন শম্ভুদা। অবশ্য এর আগে জ্যোতির্ময় দত্ত ধরা পড়ে বন্দী প্রেসিডেন্সি জেলে। শম্ভুদার উপর চলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। দিল্লিসহ শহরের বিভিন্ন জায়গা টানা ২১ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে প্রথম শ্রেণির রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে ছ’মাস কাটাতে হয়। লেখক প্রিয় বিশ্বাস বলেন, ‘এ পর্যন্ত কবিদের কারাবাসের যে উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে তাতে কবি শম্ভু রক্ষিত ও জোতির্ময় দত্তের নাম সংযোজিত হল।’

১৯৮০ সাল থেকে পাশে পাওয়া (বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামের মেয়ে) সহধর্মিণী অঞ্জলি রক্ষিতের সাহচর্যে সাংসারিক অভাবের তীব্রতর জ্বালা তাকে সেভাবে বিদ্ধ করেনি। অঞ্জলি রক্ষিত এক পুত্র, দুই কন্যা আর সামান্য জলজমিতে চাষের কাজ করে সংসার সামলাতেন আর শম্ভুদা পরম সুখে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন কবিতার ঝোলা নিয়ে। তিনি হলেন আমাদের জাগ্রত চেতনা। শম্ভুদাকে নিয়ে বর্ণের মিছিলে পর্যায়ক্রমে কাজ করেন নিরঞ্জন মিশ্র ২০০১ সাল ৪৮ পাতার, ‘সেই সন্দীপন’ -এর সম্পাদক কাশীনাথ ঘোষ ২০০৮ সাল ৫০ পাতার, ‘শিগক’ সম্পাদক শ্যাম- শান্তি, ২০০৪ সাল ১২ পাতার, “ফিনিক্স’ সম্পাদক গৌতম সাহা ২০১১ সাল ৪৬ পাতার, ‘যুগন্ধর’ সম্পাদক স্বরূপ মণ্ডল ২০১৪ সাল ১৩৬ পাতার, ‘তিতীর্ষু’ সম্পাদক চন্দন দাস, খসড়া সংখ্যা ২০১৭ সাল ২৭২ পাতার। শম্ভুদার উপর তথ্যচিত্র ‘অক্ষরসাধক’ মুক্তি পাওয়ার পর বাংলা সাহিত্য মহল খুশি। শুভেচ্ছা জানান কবি জ্যোতির্ময় দত্ত, অশােক দত্তচৌধুরী, কালীকৃষ্ণ গুহ, জ্যোতির্ময় দাশ, দীপক রায়, অজিত বাইরি, মহর্ষি পত্রী, নিতাই জানা প্রমুখ।

 

মহাপৃথিবী প্রথম প্রকাশ হয় ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের ২৪ বৈশাখ ইংরাজী ১৯৭০ সালের মে মাসে। পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন ‘সিন্ধুসারস’ পত্রিকার সম্পাদক প্রশান্ত দাশ। সেই সময়ে এমন অনেক পত্রিকা আছে যা, কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার পর আবার অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। সেই জায়গায় আপাত নিঃস্ব শম্ভুদা ত্রৈমাসিক কবিতার কাগজ নিয়মিত প্রকাশ করে আসছেন। শেষ পর্যায়ে তিনি অসুস্থ থাকায় সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজের দায়িত্ব আমার উপরে ন্যস্ত করেছিলেন তিনি।

 

অক্ষরের সঙ্গে সহবাস করতে করতেই শম্ভুদা অমৃতসন্ধানের পথ উদ্ধারের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি লিখেছেন-

“রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে
রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে
প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে
রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমসমৃদ্ধ গ্রাম ও শহরের মানুষের শেখায়
‘নিতান্তই দলের একজন লোক’- তাদেরই দুর্দশার হেতু”

 

শম্ভুদা কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও দিন যুক্ত হননি শেষদিন পর্যন্ত। অরাজনৈতিক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কোনও একটি রাজনৈতিক দলের আনুগত্য নিয়ে সুবিধাভোগের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেননি। এখানে তার সততা প্রশ্নাতীত।

“রাজনীতি’ শীর্ষক কবিতায় শম্ভুদা লিখেছেন-

“আমি প্রাপ্ত প্রাপ্ত ছড়ানো নির্জনতাকে গ্রাস করি, ফেটে পড়ি
আমি ঘুরে দাঁড়াই এবং সবকিছুর সরলীকরণ করি আমি এতই জঘন্য যে, কাউকে গ্রাহ্যই করি না।”

 

শত্রুদের মঙ্গল কামনা করে কিভাবে মৃত সঞ্জীবনী খাওয়ানো যায় তা তিনি লিখেছেন। তিনি অনায়াসে বলতে পারেন ‘সঙ্গহীন যাত্রা’ কাব্যগ্রন্থে ‘আমার শত্রুদের জন্য’ শীর্ষক কবিতায়-

“আমি আমার অগণিত শত্রুদের মধ্যে একা, সঙ্গীহীন।
আমি বস্তুত সেই শত্রুদেরই চিনি, যারা আমার বিকৃত গল্প নিয়ে
মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যেতে থাকেন।

… …
বালক, বৃদ্ধ বা যেসব অনুচর,
যারা এখনও আমার শত্রুদের আজ্ঞাবহ হতে পারেনি
আমি তাদেরকে রত্নখচিত ছোরা, প্রাচীর বেষ্টিত ভূমি
এবং একটি করে গৃহদান করেছি।
আমি শহর ছেড়ে দণ্ডকারণ্যের পথে
আমার শত্রুদের জন্য এক বিশ্রামকেন্দ্র গড়েছি পৃথিবীর যে সমস্ত দুর্গম স্থান কারুর দেখা হয়নি
তা আমি আমার শত্রুদের জন্যই দেখেছি।

আমি বরফের দেওয়াল ঘেরা এক ছোট জায়গায় আমার কয়েকজন শত্রুদের মৃত সঞ্জীবনী খাইয়েছিলাম।”

 

বিনয় মজুমদার আর শম্ভুদা – দুজনেই কবিতা লেখা ছাড়া সারাজীবনে আর কিছুই করলেন না। কোনো চাকরি করলেন না শম্ভুদা। তীব্র দারিদ্রের শিকার দুই কবি। বন্ধু দীপক রায় সরকারী সাহায্যের প্রস্তাব দিলেও তা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করেন তিনি। সরকারি সম্মাননা-পুরস্কার তো দুরঅন্ত নাগরিক সম্মানটুকু তাকে দেওয়া হল না। তার জন্য কোন খেদ নেই শম্ভুদার বরং তিনি ভীষণ সুখী, তাঁর এই বয়সে সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈষয়িকীর কদর্যরূপ দেখতে হবে তার জন্য তিনি হয়ত প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁকে হাওড়ার ঠাকুরদাস দত্ত ১ম বাই লেন থেকে হকের সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। এমনকি পৈতৃক এক টুকরো জমিতে আশ্রয়ের জন্য অনেক কষ্টেসৃষ্টে থাকতে হয়েছে কবির পরিবারকে। ফিনিক জ্যোৎস্নায় কখনও রেল লাইন ধরে একা কবিতার মোহর ভর্তি ঝোলা নিয়ে কখনও আবার দীর্ঘ রাজপথে হাঁটতেন শম্ভুদা; নির্বিকার, উদাসীন, অভিমানহীন, অভিযোগহীন, আত্মভোলা অজাতশত্রু এক শব্দের পথিক। প্রিয়তম বন্ধুর প্রতি কবি অজিত বাইরি বলতেই পারেন, “মানুষ যে প্রকৃত অর্থে একা, সেকথা/ জেনেছিলে তুমি, তবু আরও একবার মিলল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ../ ব্যস্ত সবাই যে যার কাজে, চিরদিনের জন্য ছেড়ে যাচ্ছো জেনেও কারও শেষ দর্শনের সময় হল না,../তুমি জেনো -খোঁয়াড়ের স্বার্থপর বন্ধুদের থেকে নিঃসঙ্গ যাত্রা ঢের বেশি কাম্য ছিল।”  

হাংরি জেনারেশন ও জরুরি অবস্থার সময় চিহ্নিত রণক্ষেত্রে ঝনঝনিয়ে ওঠে শম্ভুদার কণ্ঠ আর অস্ত্র। এই অস্ত্র আসলে শব্দ। যা এখনও শম্ভুদার হাতে ঝলসে ওঠে, প্রতিধ্বনিত হয়।

শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’, “প্রিয় ধবনির জন্য কান্না’, ‘রাজনীতি’ উল্লেখযোগ্য। অদ্ভুত সব শব্দের ব্যবহার। দীর্ঘ কবিতার মধ্যে তিনি তার ঘরানা সৃষ্টিতে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারেন। আবার দু-চার লাইনের ছোটো ছোটো কবিতায় যে তিনি দেশকাল পেরিয়ে যেতে পারেন; অন্য কোথাও অন্য কোনখানে, তার চিহ্ন স্পষ্ট।

“তারা সরল আর সাদা, আর আমি কৃষ্ণ
বলরামের ছোট্ট শিশু
সঙ্গে আমি কিছু আনিনি
জপতপ সেরে পড়েছি শুধু মন্ত্র
আর বহু বৎসর ধরে এক পরিচারিকার
হৃদয়ে বাস করছি।”

কবি-সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ তাই অনায়াসে বলতে পারেন, “আপনি সত্যি-সত্যিই এক বিস্ময় কবি। ভ্রুক্ষেপহীনভাবে এত-এতগুলো বছর আপনি কবিতায় জড়িয়ে রইলেন, কিন্তু কোনো গড্ডল-প্রবাহে গা ভাসালেন না। ঝাঁকের কই হতে পারলেন না। প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান করে যাঁরা হেদিয়ে মরেন, প্রতিষ্ঠানের সদর দরজায় দিবারাত্রি কাঙালের মতো বসে থাকেন একটু মধুর লোভে। আপনি কখনও এই উচ্চভিলাষীদের সঙ্গী হলেন না। কত বিপ্লবী কবিকেই তো দেখলাম, একসময় প্রতিষ্ঠানের মুণ্ডপাত করেছেন গায়ে অকাতরে দলা দলা থুতু ছিটিয়ে, তারাই পরে কত সহজে প্রতিষ্ঠানের দাস হয়ে গেলেন। আত্মবিক্রমের কত চকমপ্রদ উপায়ই না তারা উদ্ভাবন করলেন। আর আপনি ? ভিড়, কোলাহল, আলো, চাটুকারিতা, উচ্চাশা, প্রতিষ্ঠানলোভী হ্যাংলা-ক্যাংলাদের বাইরে রয়ে গেছেন বিজয়ীর মত, শিরদাঁড়া টানটান, একা, একক। বাংলা কবিতার এক স্বাধীন পুরুষ।”

 

কৃচ্ছসাধনের আস্ত জীবনটাকেই তিনি বাণী করে তুলতে চেয়েছেন। তার ‘রাজনীতি’ কাব্যগ্রন্থটি (১৯৭৫) তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তর থেকে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের ব্যবস্থাপনায় ছাপা ও প্রকাশ হয় এবং প্রসিদ্ধি লাভ করে। কবি শম্ভু রক্ষিত ভারতে না হয়ে বিশ্বের অন্য কোথাও জন্মগ্রহণ করলে তাঁকে এভাবে এখনও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করতে হত না—তিনি তাঁর কবিতার ভূমণ্ডলে আরও একটু স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারতেন। প্রণত শম্ভুদা আপনার ব্যক্তিত্ব ও কাব্যচর্চার স্পর্ধার কাছে। জন্মান্তরবাদ বলে কিছু যদি থেকে থাকে তবে তা যেন সত্যি হয়। আবার আপনার দেখা যেন পাই। 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment