শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকৃত বহুরৈখিক ভাষা চরাচরঃ শূন্য দশক

২১ শতকের প্রথম দশক বা ২১ঃ ০ বা শূন্য দশক নিয়ে এই উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষত বাংলা ভাষার নিরিখে ভাবতে বসলে প্রথম যে কথাটা মনে আসে সেটা হল তার পূর্বশর্তহীনতা। এই সেই দশক যে তার দু একটি মিসিং লিঙ্ক ছাড়া তার ভাষাকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে নিয়েছে। এই সেই দশক যেখানে বাংলাভাষা তার বিভাজিত ভূখণ্ডে সামগ্রিকভাবে দুটি ভাষার প্রবর্তন ঘটিয়েছে। এই পরিবর্তনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক উপাদান হয়ত সমাজতাত্ত্বিকের কাজ। কিন্তু কবিতার পরিবর্তনগুলোকে দেখা আমাদের কাজের এক্তিয়ার। 

প্রেক্ষিত 
নব্বই দশকের বাংলা কবিতার যে প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ছান্দিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখা, বা বলা যায় ভাবপ্রধান বাংলা কবিতার এক প্রবর্ধন, তা শূন্য দশকে এসে বেশ খানিকটা বদলে যায়। আমরা লক্ষ্য করি লিরিক প্রধান বাংলা কবিতার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি সূচিত হয়েছে। হয়ত নব্বই দশকের লেখা থেকে নিজেদের আলাদা করার তাগিদ থেকেই এই উত্তর। হয়ত সত্তর দশকের ছায়ায় লালিত বাংলা কবিতার পাঠাভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করার এক সচেতন প্রচেষ্টা। যেখানে নব্বই দশকের সংকলন করতে গিয়ে সম্পাদক সে দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল, সেখানে শূন্য দশকের সম্পাদককে ঘাঁটতে হবে নির্মাণের ইতিহাস। যেখানে নব্বই দশকের কবি খুঁজে বেড়িয়েছেন গল্প বলার ছান্দিক দক্ষতা, সেখানে শূন্য দশকের কবি খুঁজেছেন ভাষা প্রকরণ। হয়ত এর পিছনে কাজ করেছে এক গভীর সত্য যে কবিতা আর জনপ্রিয় হয় না। কবি আর চটুল মনোরঞ্জন করবেন না। আর এই কাজে শূন্য দশক অনেকাংশই তাদের শিকড় পেয়েছে আশির দশকের নতুন কবিতা আন্দোলনে। 

শূন্য দশক 
এই দশক এক সম্পূর্ণ নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটের চিহ্ন বহন করে। বিশ্বায়ন ইত্যাদির প্রভাব ছাড়াও এই দশকের কবিরা সচেতন বাংলা কবিতার বিশ শতকের প্রায় সামগ্রিক প্রবাহের বাইরে যাবার ব্যাপারে। এই দশকের কবিরা জানেন কিভাবে আগের দশক ব্যবস্থা এবং বিশ শতকের সামগ্রিক কবিতামালা তারা জানেন কিভাবে ভাষার সমস্ত প্রচলন এবং প্রচলিত সম্ভাবনা কবিতার হাতে নিঃশেষিত হয়ে গেছে। এরা চেনেন প্রচলিত ভালো কবিতার ধারা। এরা জানেন কিভাবে ভালো কবিতা লিখতে গিয়ে বাংলা কবিতা এক স্থির পুকুরের দিকে চলে গেছে। এমনকি এও জানেন আঙ্গিক নিয়ে বাংলা কবিতা ততটা সচেতন নয় বাংলা কবিতা মূল ভাব নির্ভর। বাঙালি জাতি গুঢ় তত্ত্ব চায় না, সে চায় নিবিড় গান। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং লালন ফকির তত্ত্বের  কথা বলেছেন গানে। এই অবস্থায় একুশ শতকের কবির সামনে তার ” শুদ্ধ পাঠক”- হীনতা এক চ্যালেঞ্জ। যেখানে নব্বই দশক মূলত খুঁজে চলেছিল পাঠক, এমন কি জনপ্রিয় হবার জন্য দেখা গিয়েছিল কবিতা পত্রিকার সঙ্গে শেভিং ক্রিমের শ্যাশে বিনামূল্যে বিতরণ, সেখানে একুশ শতক পড়ার পরে দেখা গেল বা হয়ত কেউ কেউ বুঝলেন কবিতা গণ মনোরঞ্জনের বিষয় নয়। অথবা এমন কিছু ঘটল যা দিয়ে এ দশক নির্মিতির এক নিবিড় খেলার দিকে এগিয়ে গেল যা বাংলার কবিতার পক্ষে নতুন। হয়ত বা এই নতুন বাংলা কবিতার অভিজ্ঞ পাঠকের সামনে খানিকটা aporia বা সংশয়ের উদ্রেক ঘটিয়েছে। 

কয়েকটি প্রবণতা 
যদি ধরে নিই ভাবপ্রধান বাংলা কবিতা এই দশকের কবিতার প্রস্থানভূমি, তাহলে এই দশকের ভিত্তি ধরে নিতে হবে শব্দ ও ধ্বনি। কিন্তু এই দশকের কবিতা হয়ত এত সহজে কোনও দ্বিমূলকে মেনে নেয় না। এঁরা টেনে আনেন (অনেক সময়) পুরনো দিক এবং তাকে নিজেদের ভাষায় প্রতিষ্ঠা করেন। “অস্থির সময়” এই শব্দবন্ধটি ৭০ দশক থেকে অতি ব্যবহৃত। কিন্তু ২১ শতকের মত দিশাহীন অস্থির সময় মানব জাতির ইতিহাসে খুব কম এসেছে। এই সেই মতাদর্শোত্তর সময়। এই সেই বাজারের সময়। যে বাজার দাম জানে, মূল্য জানে না। অথচ এই বাজারে কবিতার কোনও জায়গা নেই। সে বিক্রি হয় না। নব্বই দশক যখন নিজেকে বাজারে প্রতিষ্ঠা দিতে ব্যগ্র, তখন শূন্য তার প্রস্তুতি নিচ্ছে হিংস্র এই সময়ের মোকাবিলায় এক চূড়ান্ত অস্বীকারে। যখন অরিত্র সান্যাল লেখেন ” কে কবিকে মৃত ঘোষণা করবে? কে?/ কততম সংস্করণ?/ টেবিল বরাবর বয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ কৃষি প্রধান মাঠের শ্বাস। এক শান্ত দেহ ঘিরে আত্মীয়রা বিজন আকুল” তখন একই সঙ্গে আসে এক শিখে নেওয়া বিদ্যার প্রতি প্রশ্ন এবং এক নতুন সময়ের দিকে (কৃষি থেকে শিল্প?) যেতে চাওয়া। কী সেই নতুন সময়?  কবি আর সামাজিক ভাবে কোনও বিরাট দলের নেতা নন বরং তাঁকে অনেক বেশি করে মিশে থাকতে হবে সাধারণ্যে। যেখানে হয়ত নব্বই লিখত “টেবিল বরাবর বয়েই চলে যায় কৃষি প্রধানের মাঠ শ্বাস/ বসেই থাকা কাজ আত্মীয়তাদের আকুল হয়ে থাকা ঘাস”। প্যারোডি নয়, নব্বই এর এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে এক সম্পাদক চিহ্নিত করেছিলেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল। সেখান থেকে পশ্চিম বাংলার  কবিতার সরে আসা, তার বাক্স বাজানো জনমোহিনী ছন্দ থেকে বেরিয়ে এক আপাত বিদিশায় যাওয়া এটাই শূন্য দশক। তাদের এক স্থির বিষয় ভিত্তিক কবিতা থেকে মুক্তি। যখন অনিমিখ পাত্র লেখেন ” দেখছি, আমার জুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে/ ছায়া হয়ে উঠছে পারদময় আর/ কোথাও থাকা হচ্ছে না আমার” তখন দেখি আমাদের বাংলার বাংলাভাষা তার প্রচলিত অলংকার ছেড়ে এক অন্য ভাষা নির্মিতির দিকে ঝুঁকছে। যে নির্মিতি গীতল বাংলা কবিতার বাইরে। প্রথম থেকেই এই কবিদের লেখা আমাদের খানিক সন্দেহের উদ্রেক করে। চিত্রকল্পের ধারণা পালিত বাংলা কবিতায় এ যেন এক ধরণের আক্রমণ। অথচ বাংলা কবিতা কি এমন কোনও প্রবণতা দেখেনি আগে? হ্যাঁ দেখেছে। কিন্তু অবজ্ঞা করেছে। ৮০ র দশকের কবিদের একটা অংশ যখন নতুন কবিতা আন্দোলন করলেন তাকে আমরা ধুর সে আবার কী গোছের কথা বলে সরিয়ে দিয়েছি। অস্বীকার করতে চেয়েছি। শূন্য দশকের কবিরা এসে সেখান থেকেই নিলেন নিজেদের প্রথম শিকড়। যদিও নতুন কবিতা মূলত একধরণের লিরিক প্রবণতা ( এ নিয়ে পরেই লিখছি), কিন্তু তাঁদের অন্বয় ও অন্যান্য বাক্য প্রবণতাকে নিজেদের মত করে দেখলেন এই কবিরা। এক শব্দ নির্ভর কবিতা-প্রবণতাকে ব্যবহার করলেন অস্ত্র হিসেবে, তাঁদের না-গীতল কবিতা জগতে। বিষয় ভিত্তিক, ইস্যু ভিত্তিক কবিতার দিশা জগৎ থেকে অন্য এক বিদিশায়। এঁদের ভাষা আপাত সরল। কিন্তু এঁদের স্তবক বিন্যাস আমাদের অভ্যস্ত পাঠজগতের নয়। এঁদের কবিতা থেকে কোনও কাহিনির আদল পাওয়া যায় না। তাই এক ধরণের দূরত্ব। এই নতুন কবিতা থেকে রস টানা আরেক কবির নাম এখানে উল্লেখ করা দরকার তিনি ইন্দ্রনীল ঘোষ। অনিমিখ পাত্রের যে কোনও নাম বা অরিত্র সান্যালের আজ কারও জন্মদিন নয়, এইসব বইয়ের সঙ্গে তাঁর জুলাইওয়ালা মনে পড়বে আমাদের, একই প্রস্থানভূমি থেকে নির্গত এক প্রতি-বিন্দু হিসেবে। এঁর প্রবণতা সুন্দর লাইনের প্রতি। অনুভূতির প্রতি। অথচ কোথাও যেন আমাদের প্রচলিত আস্ত কবিতার শরীর ধরা পড়ে না। পড়ে কিছু টুকরো। যে টুকরো এঁরা সচেতনভাবে নির্মাণ করেন। যেমন করেন নীলাব্জ চক্রবর্তী এবং তাঁর প্রচ্ছদ শিল্পীর ভূমিকায়। 

যদিও অনিমিখ বা অরিত্র তাঁদের পরবর্তী কবিতায় অনেকটাই শব্দ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে কোথাও একটা ভাবভিত্তিক বাংলা কবিতার সঙ্গে সংযোগের রাস্তা খুঁজছেন কিন্তু শূন্য দশকে যখন তাঁদের লেখার শুরু সেখান থেকে নেওয়া তাঁদের টুকরো প্রবণতা থেকে যায় জন্মদাগের মত। 

আর এখানেই মনে আসবে শৈবাল সরকার, জিৎ মুখোপাধ্যায়, এবং হিমালয় জানার কথা, এঁদের প্রস্থানভূমি নতুন কবিতা নয়। জিতের সন্ধ্যার সারিন্দা বা শৈবালের একুশ নম্বর ভালো থাকা বা হিমালয়ের ভূতের শহর থেকে  আমাদের পক্ষে ততটা নতুনজাত দুরত্ব রচনা না করলেও তাঁরা কোথাও একটা যোগসূত্র রচনা করেছেন সমকালীন পশ্চিম বাংলার কবিতায়। তাঁদের কবিতা জানে নতুন ভাষার চেহারা। জানে কীভাবে ইতিহাসে অন্য কবিদের হাতের কুশলী মুনশিয়ানায় কত কিছু ব্যবহৃত হতে হতে শুয়োরের মাংস হয়ে গেছে। মনে আসবে পলাশ দে বা ঋপণ আর্যর কথা।  মনে আসবে সব্যসাচী সান্যাল ও সোমনাথ সেনের কথা। এঁদের লেখা গভীরতর ভাবনার দিকে যায়। থেকে যায় রাজদীপ রায়, সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত কর বিশ্বাস, অর্ণব রায়, রাজর্ষি দাশ ভৌমিক, অরিন্দম রায়ের কথা। থেকে যায় দেবর্ষি সরকারের কথা। আসবে নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। আর অবশ্যই আসবে অভিমন্যু মাহাতোর কথা। যেখানে নির্বাণ বা দেবর্ষি বাংলা কবিতার মূলধারার কাছকাছি থেকেও নিজস্ব কল্পদুনিয়া নির্মাণে দক্ষতা দেখিয়েছেন সেখানে অভিমন্যু এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত। তাঁর দুনিয়া আমাদের সামনে একুশ শতকের গ্রামের উত্তর শহরের প্রতি। 

এই সেই দশক, যখন বোধহয় বাংলা কবিতায় প্রথম বার মেয়েরা কবিতা লিখতে পারে না গোছের মৌলবাদী ফতোয়াগুলি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, যখন অন্ততঃ প্রকাশ্যে ছাপা পাতায় অগ্রজ পুরুষ কবিরা এ কথা বলতে সাহস পান না। এই সেই দশক যেখানে কবিতা সিংহ, দেবারতি মিত্র দের হাতে তৈরি বাংলা কবিতার নারীবিশ্ব (প্রতি-দুনিয়া বলা উচিত?) স্বাধীন ভাবে নিঃশ্বাস নিল। যখন প্রথম বার সঙ্ঘমিত্রা হালদার বা দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর লেখা পড়ি তখন সে বিশ্বাস গাঢ়তর হয়। এঁদের কবিতায় বাংলা কবিতার স্বভাবজাত ভাবের সঙ্গে মিশেছে কুশলি নির্মাণ।  এঁদেরও কবিতা চলন শুরু ভাষা থেকে ভাবে। যেমন সঙ্ঘমিত্রা বলেন “বাক্যের পাড়ায় এসে দেখি আমি রটে আছে”। এখানে কবিতার এক একক বাক্যকে নিয়ে আসা হল সরাসরি। এসে গেল কবিতার চিরকালীন আমি। দোলনচাঁপার কবিতায় আসে নতুন ধরণের শব্দ তৈরির একটা প্রবণতা। তবে মনে আসবে ক্রমশ গভীরতর সহজের দিকে যেতে চাওয়া দীপান্বিতা সরকার বা অনুরাধা বিশ্বাসের কথা। দীপান্বিতা যখন লেখেন “মৃত্যুর আগে আগে থাকা বা না-থাকায় কী যায় আসে” বা অনুরাধা লেখেন “দুটি মহতী মাছ মৈথিলী আলপনার মত পরস্পরকে ঘিরে রয়েছে” তখন নিশ্চত হওয়া যায় লিঙ্গনির্মাণের খেলার বাইরে বেরিয়ে আসছে বাংলা কবিতা।  আসবে, ঐত্রেয়ী সরকারের কথা। আর আসবে অবশ্যই রাকা দাশগুপ্তের কথা। এঁরা বাংলা কবিতার আদি ধারার সঙ্গে নতুন শতকের যোগসূত্র। এঁদের কারুর লেখাতেই বিপ্লবী জঙ্গিপনা নেই। হয়তবা সময়ের প্রেক্ষিতে তা জরুরিও নয়।  কিন্তু আছে ভাষার ধারালো হাতিয়ার। এঁদের লেখা অন্তর্মুখি তো বটেই, এঁদের লেখা নতুন করে ভাষার চোরাটান ধরতে সক্ষম। যেখানে দ্বীপান্বিতা বা রাকা বাংলা কবিতার গীতল ধারাটির প্রতি পক্ষপাত-গুণী, সেখানে সঙ্ঘমিত্রা বা দোলনচাঁপা মন দেন নিবিড় “অন্যের” নির্মাণে। 

জাতিসত্ত্বা ও ভাষা বিবর্তন 
আর এই আচমকা ছড়িয়ে পড়া সময় ও তার অজস্র প্রবণতা দেখতে গিয়ে একটা কথা ফিরে আসছে মাথায়, এই প্রবণতা আমার জানা ইস্পানো কবিতাতেও দেখা যায়। এ এক অদ্ভুত সময় যখন না আছে পার্টির ফতোয়া না আছে বাজার নামক এক আকারহীন দৈত্যকে সেলাম ঠোকার দায়। এই সেই সময় যখন হয়ত কবিতার পাঠক নিয়ে হা-হুতাশ না করে তার যে আসল কাজ, অর্থাৎ ভাষাকে নতুন পথে উশকে দেওয়া, তাতে আরও বেশি করে মন দেওয়ার। অর্থাৎ কবিদের সামনে হয়ত এখন নতুন উদ্ভাবনি পথে কবিতাকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ। আর এই সূত্রেই আসে জাতিসত্ত্বার কথা। ভাষা বিবর্তনের কথা। বাংলা এবং স্প্যানিশ উভয় ভাষাতেই দেখি এই দিক। একদিকে যেমন পশ্চিম বাংলার থেকে বাংলাদেশের কবিতা একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে, তেমনি গেছে স্পেনের থেকে লাতিন আমেরিকার কবিতা। আবার লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে দেশগত পরিচয় নির্মাণের আরেক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেটা দেখা যায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গের কবিতা এক অদ্ভুত আত্মতুষ্টিতে ভুগে জনগণমনরঞ্জনের দিকে ঝুঁকতে চাইছিল তা এই শূন্য দশকে এসে কেটে গেছে। শূন্য দশকের এক প্রধান দিকচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বিমূর্ততা। সে বেরিয়ে এসেছে বাক্য গঠনের তথাকথিত কাব্যিক ভঙ্গি থেকে। যেমন আমাদের চারপাশে বেড়েছে অপশানের সংখ্যা, তেমনই কবিতা তার অঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে সেই অনিশ্চয়তা।এবং আশ্চর্য রকমের একটা বাঁক নিয়েছে এই সময়, দেখা যাচ্ছে প্রধান কবিদের লেখা আর আবৃত্তিযোগ্য নয়। সমসাময়িক কবিতার নাটকীয়তা অভিনয়যোগ্য কিনা তা নিয়েএখনও কেউ বিতর্ক করতে পারেন। কিন্তু কবিতা যে আর জনপ্রিয় হবে না তা বার বার বোঝা গেছে। এখন তাই তার সামনে আর একটি কবিতা হয়ে ওঠার দায় নেই। আগেও হয়ত কেউ কেউ লক্ষ্য করেছেন এই দশকের প্রধান একটা প্রবণতা সিরিজ কবিতা। যদিও তারা আকারে ছোট কিন্তু শিরনাম কেন্দ্রীকতা থেকে সে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে কেন্দ্রহীনতার বিদিশায়। আর হয়ত সেই কারণেই, শূন্য দশকের কবিতার প্রতি পাঠকের aporia। এত কালের প্রচলিত কবিতা পাঠের অভ্যাসকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে এই দশক।  একটা ভাবনাবীজকে গল্প না করে, বর্ণনামূলকে হারিয়ে না গিয়ে, সে মেতেছে ভাষা নির্মাণে।  যদিও এখনও এই দশকের প্রতিনিধি কবিদের হাতে (ব্যতিক্রম দোলনচাঁপা চক্রবর্তী) এখনও দীর্ঘ কবিতা বেরিয়ে আসেনি। এই সিরিজ কবিতা বা কবিতার বইয়ের নামকরণের নতুন বিস্তারে সেই অভাব আপাতত পূর্ণ হচ্ছে। এই কেন্দ্রহীনতার প্রধান একটা কারণ কলকাতা কেন্দ্রীকতা থেকে অনেকটাই মুক্তি। যদিও কবিদের অনেকেই কলকাতা নির্ভর কিন্তু তাঁরা অনেকেই আর কলকাতা কেন্দ্রীক ছাপা কাগজ নির্ভর নন। অনেকেই সংবাদপত্র নির্ভর সাহিত্য পত্রিকার উপর খ্যাতিমান হবার দায় থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের লেখা সময়ের দাবিতে অনেকাংশেই আন্তর্জালের প্রকাশ নির্ভর, যা ৭০ দশকের গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্নের এক অনন্ত নতুন বিস্তার। ফলে এই দশকে এসে প্রথমবার আর রাজ্যের রাজধানীবাসী না হওয়ার কোনও আলাদা অসুবিধে নেই। আর সেই হাত ধরেই খুলে যাচ্ছে ভাষা-বৈচিত্র্যের এক নতুন চরাচর। এবং অবশ্যই পাঠকের নতুন বৃত্ত। হয়ত এই সময়ের কবিদের হাত ধরেই মান্য বাংলার বিবর্তন ঘটবে আরও বেশি করে, আর তৈরি হবে (শুরু হয়েও গেছে) বাংলার প্রকৃত বহুরৈখিক ভাষা চরাচর।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment