‘তোমরা আজকালকার ছেলেপুলেরা ভাবো বটে যে তুড়ি মেরে সব কাজই হাসিল করে ফেলা যায়, তবে বিশ্বাস করো আর নাই করো জানবে মূর্তি ভাঙ্গা মোটে সোজা কথা নয়।’
গোলাম সাইদি তার অশক্ত, কাঁপা কাঁপা হাত আর ধূমায়িত চায়ের কাপ সহ ফ্রেমে ঢুকে পড়েন। ডিরেক্টর ছোঁড়া ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ভাবে বটে, ‘বয়েসের গাছ পাথর’ না থাকার বাগধারা এর চে সার্থক প্রয়োগ হয়ে তার সামনাসামনি এভাবে সশরীরে এসে দাঁড়ায়নি কখনো, এই আপাত অভিব্যক্তিহীন, বলিরেখাময় অতিবৃদ্ধ জনৈক গোলাম সাইদি, যাকে অনায়াসে গত শতাব্দীর কোনো ফারসি কবি অথবা আরো অনেকদূর পিছিয়ে আগুনের ঐশী জ্ঞানলব্ধ স্বয়ং জরাথ্রুষ্ঠ ভেবে নিতেও ক্ষতি নেই, লোনলি প্ল্যানেটের ফ্রেম যাকে তজরিশ বাজারে টুরিস্টদের জন্য নিপুণ ভাবে সাজানো গোছানো ফর্শের দোকানের বাইরে এই স্বচ্ছ, ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে, এই সশ্রু-গুম্ফময় নির্লিপ্তি সহ ধরে ফেলতে পারলে অনায়াসে বিনা সম্পাদনায় গাইড বুকের প্রচ্ছদে ছাপিয়ে দিতে পারতো, সেই গোলাম সাইদি যে অবিশ্বাস্য শোনালেও, অন্তত জনশ্রুতি অনুসারে…
-কিন্তু এ কথা কি সত্যি যে আপনি এককালে মূর্তি ভাঙায় রীতিমতো বিশেষজ্ঞ ছিলেন? এমনকী লোকে তো বলে, আশেপাশের সব গ্রাম, এমনকী গোটা শাহরেস্তান খুঁজলেও আপনার মত নিখুঁত হাত খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিলো?
-ওসব খোঁজাখুঁজির গল্প জানি না। তবে বিশেষজ্ঞ বললে বিশেষজ্ঞ, শিল্পী বললে শিল্পী, ইনকিলাবি বললে ইনকিলাবি…সেসব বেড়ে দিন ছিলো বটে!
বৃদ্ধের ধূসর চোখে হাল্কা ঢেউ খেলে যায়। ডিরেক্টর তৎক্ষণাৎ ক্যামেরা হাল্কা টিল্ট করে ওই তাৎক্ষনিক গতিময়তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে আর ফ্রেম থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞাসা করে
-তা কীভাবে শুরু হলো সেসব দিন?
-কীভাবে হয় শুরু? আর পাঁচজনের মতই! ওই ৫৩ নাগাদই। কতই বা বয়েস তখন আমার, বড়জোর আট কি নয়। রেডিওতে বললো প্রধানমন্ত্রী মোসাদি গ্রেপ্তার। বললো দেশে আর গণতন্ত্র টন্ত্র নেই। আর তার কদিনের মধ্যেই শুনি মহম্মদ রেজা, সে নাকি ব্যাটা শাহ, আবার শুধু শাহ তো নয়, ‘শাহেনশাহ’, খরগোশের কলিজা চেপে ইউরোপ পালিয়েছে! এই শুনেই আব্বু চোয়াল শক্ত করে আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললো-‘চল ব্যাটা!’ মনে হয় এই য্যানো সেদিনের ঘটনা! রাস্তায় পিলপিল করছে লোক। রাগে ফুঁসছে সব্বাই। একদম পাড়ার মোড়েই রেজা শাহের যে মূর্তিটা বসানো ছিলো, সবার সব রাগ গিয়ে পড়লো সেই মূর্তির ওপর। আব্বুই তো লাফ মেরে বেদীতে উঠে মূর্তির কোমরে দড়ি বেঁধেছিলো! আর মহম্মদ রেজার নাক, পাহলভি বংশের ওই মার্কামারা টিকালো নাক, সেসব কিন্তু খাঁটি ব্রোঞ্জের মনুমেন্ট, এখনকার মত ভেজাল মালমশলা নয়, বেলে মাটিতে সজোড়ে আছড়ে সে নাক প্রায় ইঞ্চি দুই গর্ত করে যখন ঢুকে পড়েছে মাটির নীচে, লোকের কী নাচ! নাচতে নাচতে আমাকে একবার এ ঘাড়ে তোলে তো আরেকবার ও! জনসমুদ্রের মাথায় চড়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ভাসতে ভাসতে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা আমি, কিন্তু ভীড়ের ফূর্তি তো ছোঁয়াচে, সে যে কী এক বিষম ফূর্তি! য্যানো পা, তলপেট, বুক বেয়ে ঝমঝম স্টীম ইঞ্জিন হয়ে সটাং মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে! ও নেশা একবার যাকে ছোঁয় সে কি আর বাকি জীবন শান্তিতে কাটাতে পারে? তো ওই শুরু। আব্বুর কোটের কোণা খামচে। প্রথমে পাড়ায়, তারপর বেপাড়ায়, দেখতে দেখতে গোটা বাখ্শে আর শাহেনশার একটা মূর্তিও আস্ত রইলো না।
বৃদ্ধ থামেন। পরিতৃপ্ত একটা চুমুক মারেন চায়ে। ফ্রেমে ধরা পড়ে যাওয়ার মত প্রশান্তি। কিসসাওয়ালার প্রাথমিক টোপ স্ফীতচক্ষু বেবাক শ্রোতার গিলে নেওয়ার পরে নেমে আসা প্রশান্তি। আর ডিরেক্টর, সেও তো কিসসা বেঁধে ফেলতেই খুঁজে খুঁজে এসেছে এতদূর! আর সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই কথক যখন কিসসার সুতোর রাশ খানিক দূর ছেড়ে দিয়ে লাটাইকে হাল্কা বেঁধে মাঞ্জার ধার পরখ করে নিতে চান, বুঝে নিতে চান এ কিসসা আদৌ উড়বে তো?-তখন অধৈর্য শ্রোতা কৈশোরের যে ভাষায় ‘আর তারপর? তারপর??’ জিজ্ঞাসা করে, আর কথক বোঝেন আজ এ কিসসা শুধু উড়বে না, কায়দা করে লাটাইবাজিটুকু অক্ষুন্ন রাখতে পারলে কল্পনার আকাশে ডিগবাজিও খাবে, ঠিক সেই অশ্রুত অথচ রক্তের মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা ভাষায় সদ্য তিরিশের যুবক ডিরেক্টর গোলাম সাইদিকে জিজ্ঞাসা করে-
-এত এত মূর্তি সাফ হয়ে গ্যালো! ধড়পাকড় হয়নি সেবার?
গোলাম সাইদির ঠোঁটে এই প্রথমবারের মত হাসির রেখা দ্যাখা যায়।
-হুরর! কীসের ধরপাকড়! শাহ নিজেই টাল সামলাতে না পেড়ে চম্পট দিয়েছে! দেশে আইন কানুন বলে আর নেই কিছু। আর্মি তেহরান সামলাবে না গোটা দেশ? দাদা চাচাদের তো অনেক বড়বয়েস অবধিও বুকপকেটে মোসাদির ফটো লুকিয়ে ঘুরতে দেখেছি। সে যুগে তো নামটুকু প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতেও ধক লাগতো! এই হলো ভালোবাসা! ওসব ধরপাকড় শুরু হলো ষাটের দশকে। যখন জোরকদমে সাভাকের নজরদারি শুরু হলো।
‘সাভাক’ নামটা উচ্চারণের সাথে সাথেই যুবকের হাত কাঁপে অল্প। যদিও যে নিজে প্রত্যক্ষ করেনি, কিন্তু শাহের গোপন পুলিশের তীক্ষ্ণ চিরুনিতল্লাশ আর অত্যাচার, তারপর রাতের অন্ধকারে বসতির পর বসতি থেকে একের পর টগবগে সব যুবাদের বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর তারপর যুবা থেকে প্রৌঢ় ক্রমে বৃদ্ধ, জলজ্যান্ত, শ্বাস নেওয়া, হেঁটেচলে বেড়ানো জ্যান্ত কতগুলো মানুষের, রাজনীতি, অপরাধ নির্বিশেষে একদিন হঠাৎই ‘নেই’ হয়ে যাওয়া, একটা গোটা জাতির অভিধান থেকে উবে যাওয়া ‘নিরাপত্তা’ শব্দটার মতই…এ ইতিহাস দশকের পর দশক পেরিয়ে তার গায়েও এসে আছড়ে পড়ে আর তার প্রতিঘাতে সেও ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেনা। যে দেশের আত্মা কারবালা প্রান্তরের স্মৃতি আজো সযত্নে দগদগে ঘায়ের মত নিজের শরীরে লালন করে চলে য্যানো তা জন্ম জড়ুল, য্যানো তা শনাক্তকরণের উল্কি-সে শহীদকে ভোলে না, ভুলতে দেয় না! কাজেই সরকারি হিসেবেই সাভাকের তরুণতম রাজনৈতিক বন্দীটির বয়েস যখন বিশ্বাসযোগ্যতার শেষতম সীমানা অতিক্রম করে সাড়ে চারে এসে ঠ্যাকে, সাড়ে চার বছরের ওই শিশুর টলটলে মুখ মনে রেখেও সে যদি আজ স্থির থাকতে পারতো তাহলে বেঁচে যেত। ডাংকি পথ বেয়ে তুরস্কে পালিয়ে যাওয়ার মত রেস্তর অভাব তো তার ছিলোনা কখনোই! তার বন্ধুবান্ধব, সমসাময়িক সাংস্কৃতিক কর্মী প্রায় সকলেই তো দেশছাড়া! স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছেয়, বাধ্যত…! সে কি দ্যাখেনি বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি বিস্তৃত হতে হতে সীমান্তের গাঢ়তম অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে ঠিক এমতাবস্থায় অসংখ্য জোনাকি অধিকৃত মহীরুহের মত ঝলমল করছে সীমান্তবর্তী শহর? মুক্ত শহর? সে কি শোনেনি তার লোকাল গাইড অনুনয়ের সুরে তাকে সাহস জোগাচ্ছে- ‘সেরেফ দশ পা স্যার! দশ পা হেঁটে গেলেই আপনি দেশের বাইরে!’ কী আছে তার দেশের বাইরে? ইস্তানবুল হয়ে বুখারেস্ট, বুদাপেস্ট, ভিয়েনা মিউনিখ হয়ে প্যারিস…কতটুকুই বা রাস্তা! বন্ধু পরিচালক, বান্ধবী কবি- সকলে কতবার ডেকেছে তাকে! ‘বোকামো করিস না। শুধু বোকামোই না, সুইসাইড! জার্মানি ছেড়ে পালান নি আইনস্টাইন?? একদম শেষবেলায় ফ্রয়েডকে উদ্ধার করে আনেনি ওরা?? অন্তত সিনেমাটা তো বানাতে পারবি!’…চালু যুক্তি। একাধিকবার শোনা। একাধিকবার মনে মনে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া থেকে পালটা সিদ্ধান্তে পৌছনোর অ্যাবাউট টার্ন। আর সমস্ত সংলাপ প্রলাপের শেষে যখন কাষ্ঠ হেসে সে উইটম্যানের লাইন আউড়েছে, কারণ নিজস্ব যুক্তি আর আবেগের টাগ অফ ওয়্যারে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পর অন্যের উচ্চারণের পিছনে লুকোনো ছাড়া উপায় থাকে না-’Do I contradict myself?/Very well then I contradict myself’’, বন্ধুরা খিস্তি মেরে ফোন কেটে দিয়েছে। আর সে বোঝাতে পারেনি, হয়তো তার মাতৃভাষায় ‘survivor’s guilt’ শব্দবন্ধদ্বয়ের আক্ষরিক অনুবাদ হয়না বলে, বা হয়তো উচ্চারণের সাথে সাথেই বস্তুনিষ্ঠ মান্যতা পেয়ে ওই শব্দগুলো আর কোনো পরিস্থিতিতেই তার পিছু ছাড়বেনা এমন ভয়ে…!
হ্যাঁ ভয় তো বটেই। আদি, অকৃত্রিম ভয়! কারণ যেবার তুমাজ সালেহীকে ওরা মৃত্যুদণ্ড দিলো, বছর বাইশের ছেলেটা দিনে কারখানায় কাজ করে রাতে র্যাপ গাইতো, জান্তব, ঘেন্না রক্ত মাখা ভাতের পিণ্ডর মত উগড়ে দেওয়া ওসব গানের স্তবক, যে স্তবকগুলোয় সে সরাসরি তার আর তার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের শ্রেণীচরিত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলো, যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গ্যাছে পালিয়ে যাওয়ার মত সামর্থ্যটুকু ছিলো বলেই, সেবারই সে সস্তার অ্যানড্রয়েডে রেকর্ড করা সেভেন টুয়েন্টিপির রেজোলিউশনে দেখেছিলো কোনো এক নির্মীয়মান বাড়ীর ছাদে তুমাজ সালেহী তার গোটা শরীরকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে হতাশা নয়, শুধুই রাগের গান গাইছে আর প্রেক্ষাপটে তেহরানের ঘোলাটে আকাশ আর ছাইছাই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের সারি য্যানো আশঙ্কায় থম মেরে আছে আর তুমাজ সালেহী ঠিক তার চোখে চোখ ফেলে বলছে- ‘তুমি যদি কথা না বলো, তাহলে তোমারো হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে!’ এ গল্প সে তার প্রবাসী বন্ধুদের বলেনি, কারণ সে তো এও দেখেছে নিউ মেহিকোর ওয়ালমার্টের পার্কিং লটে মধ্যবয়সী এক সাদা চামড়ার মহিলা মুখে থুতু তুলে ইরানী ইমিগ্রেন্টকে বলছে- ‘গো ব্যাক টু ওয়্যার ইউ কেম ফ্রম! উই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ! দিস ইজ নট ইয়োর কান্ট্রি!’ তাই লোকাল গাইডের শত অনুনয় বিনয়ের পরও সে নো ম্যানস ল্যান্ডের দশ পা পেরোতে পারে না। দেশ কি শুধু একটা ভূখন্ড? দেশ কি শুধু মানুষ? তাহলে কোন মানুষ? যে রয়ে গ্যালো না যে রইলো না?-সে বন্ধুদের এ প্রশ্নগুলোর উত্তরও জানে না। সে শুধু জানে প্যারিস, মিউনিখ, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, বুখারেস্ট হয়ে যে পথ ইস্তানবুলে এসে পৌছয় সে পথ আদতে দূর্ভাগ্য বয়ে এনেছে আর এই পথেরই মাঝামাঝি কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠের অজ্ঞাতসারে তার উপমহাদেশে ভবিষ্যতের সংজ্ঞা বদলে গ্যাছে ( কে বলেছিলেন? এমিল চোরান?- ‘Happiness ends in Vienna’)। সে শুধু জানে ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে কারবালার আলী আল-আসগর ইবন হোসেইন আর ২০২২র তেহরানের তুমাজ সালেহীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই আর চোখ ঝলসে দেওয়া সাদা বালির এই ভূখণ্ডে, কিসসা বললে কিসসা, রিপোর্ট বললে রিপোর্ট; লিপিবদ্ধকরণের দায় সে রক্তে নিয়ে জন্মেছে, হাফিজের মত করে হোক, ফেরদৌসীর মত করে হোক বা সাদেক হেদায়তের মত, সে কিসসা সালেহীর হোক অথবা এই সুপ্রাচীন চিনার বৃক্ষের মত অতিবৃদ্ধ গোলাম সাইদীর … তার কাছে দেশ বলতে ওই ওটুকুই!
আর গোলাম সাইদী তার সামনে ততক্ষণে নড়েচড়ে উঠে চায়ের ফাঁকা কাপ নিঃশব্দে নামিয়ে রাখছেন মেঝেতে তারপর আনমনে স্মৃতি হাতড়ে বলে উঠছেন-
-আসল লুকোচুরি শুরু হলো ওই ৬৩ তে। শেষবার পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার পর মহম্মদ রেজা যখন দেশে ফিরলো, দেখলো রাস্তাঘাটে পাহলভিদের আর একটা সৌধও আস্ত নেই, কিন্তু তদ্দিনে বিক্ষোভ টিক্ষোভ শান্ত। শাহ তখন দ্বিগুণ উৎসাহে আবার মূর্তি বসানো শুরু করলো। নিজের মূর্তি, নিজের বাপের মূর্তি। যত না মূর্তি উপড়ানো হয়েছিলো তার দ্বিগুণ তিনগুণ মূর্তি আর স্মৃতিসৌধে দেশ ভরে গ্যালো। পাড়ার মোড়ে মোড়ে ফেস্টুন, পতাকা! বিলবোর্ডে শাহের মুখ! এমন কোনো বড়রাস্তা, রাস্তা, গলি বাকি রইলো না যেখানে শাহের মুখ জ্বলজ্বল করছে না। খোদার পরেই শাহ। শাহ গোটা দেশকে পিতৃস্নেহে দেখছেন। ও মুখ না দেখে ঘরের বাইরে বেড়োনোর জো নেই। আর তদ্দিনে সাভাক বেশ গায়েগতরে বেড়ে উঠেছে। সর্বত্র আড়ি পাতছে। নজর রাখছে। শাহের বিরূদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণের উপায় নেই। এমনকি মসজিদেও না! কোন সাভাক খোচর কোথায় আড়ি পেতে বসে আছে কেউ জানে না! যাকে দোস্ত ভেবে হাল্কা চালে দুটো ঠাট্টা করলে, হয়তো মুখ ফসকে বলেই ফেললে, প্রজাদের মন পেতে চতুর্দিকে নিজের ছবি সাঁটানোর কথা তো কস্মিনকালেও শুনিনি, ব্যাস! কপাল ভালো থাকলে পুলিশে তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারবে, কপাল খারাপ থাকলে তুমি নিঁখোজ। হামজায় কাঁদবে। ছেলে গিয়ে দপ্তরে দপ্তরে ধর্ণা দিতে দিতে শেষটায় ধমক খেয়ে ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু কবর দেওয়ার মত অবশেষটুকুও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপর ধরো শাহের ওই পার্টি। রাস্তাখিজ পার্টি। তো আইনি রাজনৈতিক দল বলতে ওই একটিই। সব্বাই পার্টি মেম্বার। হ্যাঁ, আমিও তাই ছিলাম! তলে তলে যারা শাহকে সহ্য করতে পারতো না, কলেজের ছোঁড়া বলো, আন্ডারগ্রাউন্ড লাল পার্টির লোক বলো অথবা আয়তোল্লাহ…মেম্বারশিপ বাধ্যতামূলক। ওই পার্টি লিফলেটেই তো বড় বড় হরফে ছাপা থাকতো- যারা যারা রাস্তাখিজ পার্টির সদস্য নয় তারা সব্বাই দেশের শত্রু। বিশ্বাস না হলে কাগজ টাগজ ঘেঁটে দেখে নিও, তোমাদের তো আজকাল ইন্টারনেটে অনেক উপায় আছে। আমাদের তো ওই একখানা খবরের কাগজ, তাও শাহেনশাহরই, আর রেডিও বলতে ওই একটাই সরকারি চ্যানেল-বিকেলের দিকটায় শের-শায়রীর প্রোগ্রাম হতো, সেসব আজব শের! কোনোটায় বলছে শাহেনশাহ যেখানেই দৃষ্টি ফেলেন সেখানেই গুলিস্তান, কোনোটায় বলছে দস্ত-এ-খবিরের মরুভূমিতে যেখানেই শাহের দুই পা পড়ে সেখানেই কেরামতি ফোয়ারা জন্মায়! এসব কিন্তু ঠাট্টা ভেবো না। ভুলেও ঠাট্টা ভেবেছো আর তুমি গরাদের পিছনে। এসব হরেক কিসিমের গা জোয়ারির ভিতর দিয়েই বছর গড়ায়। এই করে করেই ৬৩। সেবার খোমেইনিকে দেশছাড়া হতে হয়েছে। লোকে ফুঁসছে রীতিমতো। কিন্তু গণহারে ধরপাকড়, গুলিগোলা চলছে। এরম পরিস্থিতিতে মূর্তি ভাঙা সোজা কথা নয়।
গোলাম সাইদী একবার থেমে তার শুষ্ক ঠোঁটে হয়তো বা নিজের অজান্তেই একবার জিভ বুলিয়ে নেন। পরিচালক এবার আর আড়াল রাখতে পারেনা। প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতই জিজ্ঞাসা করে ফেলে-
-তারপর? তারপর কী হলো?
-সে এক আজীব খেলা! তদ্দিনে আব্বু চোখ বুজেছে। আমি জোয়ান হয়েছি। পাড়ায় আবার আমার ক’জন শাকরেদও জুটে গ্যাছে। আমরা তখন বেশীরাত, ভোররাত এমন সময়ে মূর্তি গুলো উপড়ে আসতাম। কিন্তু শাহ কী থামে! আমরা একটা ভাঙি, সে তিনটে বসায়। পাঁচটা ভাঙলে, দশটা! য্যানো প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু মারণ প্রতিযোগিতা। কারণ আমরা যাই করছি লুকিয়ে করছি। আর ওই দড়ি, যে সে দড়ি নয়। এ কাজে সবরকম দড়ি চলবে না। জাহাজে যেসব কাছি ব্যবহার করা হয় সে জিনিস। সিসল গাছের বাকল দিয়ে বানানো, ইয়ামোটা আর ত্যামন শক্ত! ও দড়ির মুখে বিশেষ রকমের আঙটা… সে কায়দাও আমিই বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছিলাম, ওসব সমেত পুলিশের হাতে ধরা পড়ার মানে বোঝো? সোজা ফায়ারিং স্কোয়াড! তো দিনের বেলা বাজারে আমাদেরই এক বন্ধু দড়ির দোকানী, তার গুদামে লুকিয়ে রাখতাম। সেও মহা বিপদের কাজ। কারণ সাভাকের কান ভাঙিয়ে নিজের আখের গোছানো লোকেরও তো অভাব ছিলো না! নইলে কি আর এমনি এমনি সাভাকের একশো জোড়া চোখ আর কান?? তো এতরকম কথা মাথায় রেখে, রীতিমতো আঁক কষে ও কাজ করতে হোতো। আর ওই যে বললাম, একটা মূর্তি উপড়ানো গ্যালো। এবার ধরো শাহের নেক নজরে পড়বার জন্য মাঝারি বড়লোক টড়লোক সব তো লাইন দিয়েই রয়েছে, তখন লাইনে টপকানোর হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। হয়তো তিনজন ভুঁইফোর একই বাজারের তিন প্রান্তে তিনটে নতুন মূর্তি তুলে দিলো। কে আগে মূর্তি তুলবে সে নিয়েও রেস চলছে! তবে কি, ওসব বিনা টেন্ডারে, হরবরিয়ে তোলা মূর্তি…অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সস্তার কাঁচামাল, এটা সেটা ভেজাল মিশিয়ে বানানো। ওগুলো উপড়াতেও বেগ পেতে হতো না বিশেষ। তবু এক এক সময় মনে হত, ইয়া খুদা এভাবে কদ্দিন চলবে! মনে হত হাল ছেড়ে দিই। এই কজন মিলে কটা আর মূর্তি ভাঙবো? এক এক রাতের শেষে দড়ি টেনে টেনে দুই তালু দগদগে ফোস্কায় ভরে যেতো। ভালো করে খেতে অবধি পারতাম না ও অবস্থায়। তাও শেষ অবধি কিন্তু টিকে গেছিলাম!
গোলাম সাইদি এই প্রথম পরিতৃপ্তির হাসি হাসেন আর ক্যামেরার দিকে অতি ধীরে নিজের দুই তালু মেলে দেন; রোদে পোড়া মাটির মত তামাটে রঙের, ভূর্য্যপত্রের মত দোমড়ানো কোচকানো চামড়ার ঢেউগুলোর মধ্যে য্যানো এখনো অতীতের দগদগে ফোসকা আজো টুনিবাতির মত জ্বলে উঠবে! দাড়ি গোঁফের আড়ালের বাইরে তার মুখমণ্ডলের যেটুকু যা বলিরেখা তাও য্যানো ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তার কিসসার শেষটুকু তো ওই টিকে যাওয়া নিয়েই! হাজার পথ ঘুরে শেষে য্যানো এই বিন্দুটিতেই তিনি স্থিত হতে চেয়েছিলেন।
-আর ৭৯?
বৃদ্ধকে এই প্রথম য্যানো ফ্রেমে খানিক অস্বস্তিতে দ্যাখা যায়। প্রথমটায় চুপ করে থাকেন।
-আপনার নিশ্চই তদ্দিনে বেশ নামডাক হয়ে গ্যাছে!
য্যানো সুদূর থেকে অনতিদূরের অতীতের কাছে ফিরে আসা নিতান্তই কষ্টকর, য্যানো স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে এমন এক নিভু স্বরে বৃদ্ধ বিড়বিড় করেন-
-আসলে সে সময়ে সবকিছু এতটাই তালগোল পাকিয়ে গেছিলো। এত বার গুলি চললো। এত এত শহীদ! সে শহীদের জানাজায় যে শোকমিছিল, সে মিছিলও য্যানো বিপজ্জনক! সে মিছিলেও গুলি! আবারো অসংখ্য শহীদ। আবার শোকমিছিল। সবারই বোধয় সেবার একরকম রোখই চেপে গেছিলো। তখন আমি নিজেই এক ছেলের বাপ। আব্বুর মতই ওকে মিছিলে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলাম। আর সেই যে মিছিলের নেশা! যার খুনে একবার মিশবে সে আর জন্মে থামবে না! কিন্তু আগেই বলেছি, মূর্তি ভাঙা সোজা নয়। এসব শাহেনশাহ, সাভাক, আয়াতোল্লাহর বাইরেও তো এক জগত আছে, আর সেখানে খোদা ছাড়া কারো নিয়ম খাটে না। এই যে এত শত মূর্তি, শাহেনশাহর দম্ভ বলো, দেশের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া বোঝা বলো, এসবের বাইরেও তো ভাবতে হয় আখেরে এ মূর্তি কী দিয়ে গড়া। ফাঁপা না ভরাট। ব্রোঞ্জ না গ্র্যানাইট। ভাবতে হয় ওই শরীরের কোথায় আঙটা গুঁজে টান মারলে সবচেয়ে কম গায়ের জোর লাগিয়ে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সেটাকে উপড়ানো যাবে। কিন্তু পাথর যখন গড়ায়, সে তো খোদার নিয়মে গড়ায়। সে নিয়মে তোমার আমার হাত নেই। অভিজ্ঞতায় মাপা যায় শুধু। নইলে কাঁচা হাতে পাথড় উপড়ে ফেলতে গেলে যারা দড়ি ধরে টানছে সে পাথর তার সবটুকু ভরবেগ নিয়ে এসে তাদেরই পিষে দেবে। সেবার কম দূর্ঘটনা ঘটেনি। ওমে, ইস্পাহানে, তেহরানে-কম বেশী সর্বত্র। কোথাও চারজন, কোথাও ছজন… মূর্তি উপড়ে ফেলতে গিয়েই শহীদ হয়ে গ্যালো। তা সত্ত্বেও, শাহ যেদিন গদি ছাড়লো সেদিনের যে জুলুস আর যা রোশনাই-ওমনটা বোধয় এদেশের লোকে ওর আগে বা পড়ে, কখনোই দ্যাখে নি। বাপ ব্যাটায় মিলে সবার সাথে রাস্তায় তালে তালে কতই না নেচেছিলাম! হাঁফ না ধরা পর্যন্ত! খানিক জিরিয়ে নিয়ে ফের নতুন উদ্যমে নাচ। কিন্তু তারপর বছর দু তিনেকের মধ্যে এতকিছু ঘটে গ্যালো…হয়তো কেউ সেভাবে ভাবেনি, আঁক কষে দ্যাখে নি…ভাঙার পর কী কী করে ফেলা উচিত। ইনকিলাব তো এলো, কিন্তু তাকে বাঁধা গ্যালো কই!
এতক্ষণে সূর্য পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়ার মুখে। গোলাম সাইদির সেই আপাত অভিব্যক্তিহীন মুখে গলন্ত সোনার মত রোদের ছিটে লেগে থাকে। আর হঠাৎই চরাচর মুখরিত করে মাগরিবের আজানের ডাক ভেসে আসে। বড় অনৈসর্গিক শান্তির সে ডাক। য্যানো আম্মার বুকের ওম আর জুঁই ফুলের সুবাস মেশানো। আর সূর্যাস্তের সেই ঐশী আলোয়, বৃদ্ধাশ্রমের কোর্টইয়ার্ডের উদ্যান, মুহূর্তেই যার ডালিম, নাশপাতি, তুঁত, আপেল, উইলো সহ অসংখ্য নাম না জানা গুল্ম আর লতা, আর ঠিক সে উদ্যানের কেন্দ্রে বাঁধানো গোল জলাধারের টলটলে জল আর নিখুঁত চতুর্ভাজাকার উদ্যানের সেই অভ্রান্ত চারটি দিক যারা কয়েক হাজার বছরের দস্তুর মেনে ক্রমান্বয়ে পৃথিবী, আকাশ, জল আর ঈশ্বরকে প্রতিফলিত করে-এরা প্রত্যেকে একে অন্যের ছায়া আর আলোর সাথে মিশে গিয়ে অবিকল ইডেন অথবা সাইরাসের জাদু উদ্যান….অন্তত কল্পনায় এমনটা মোটেই কষ্টকর নয়! আর প্রায় মোহগ্রস্তের মত ডিরেক্টর তার ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে নেয় কেননা জন্নতের সব রঙকে এখনো যন্ত্রবন্দী করা সম্ভব নয়। আর সে দ্যাখে, গোলাম সাইদি, যাকে অনায়াসে গত শতাব্দীর কোনো ফারসি কবি অথবা আরো অনেকদূর পিছিয়ে আগুনের ঐশী জ্ঞানলব্ধ স্বয়ং জরাথ্রুষ্ঠ ভেবে নিতেও ক্ষতি নেই, তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর উপক্রম করছেন। আজানের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে খানিক গলা তুলে প্রশ্ন করে ফেলে-
-আর আপনার ছেলে?
গোলাম সাইদী ধীরপায়ে ততক্ষণে অন্তঃপুরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন। যুবকের দিকে একবারো সোজাসুজি না তাকিয়ে ফিরে যেতে যেতেই এক বিন্দু গলার স্বরকে বিকৃত না করেই ভাবলেশহীন কন্ঠে তিনি উত্তর দেন-
-মিছিলের নেশার কথা বলেছিলাম না? ও নেশা রক্তে লাগলে তাকে আর বেঁধে রাখা যায় না। সে লালপার্টি করতো। ৮৪ র পর আর চোখে দেখিনি।
হতভম্ব যুবক দ্যাখে, সামান্য ঝুঁকে, অতি ধীরলয়ে বাগান পেরিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর শেষ উচ্ছেদশিল্পী, লোনলি প্ল্যানেটের ফ্রেম যাকে তজরিশ বাজারে টুরিস্টদের জন্য নিপুণ ভাবে সাজানো গোছানো ফর্শের দোকানের বাইরে স্বচ্ছ, ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে, সশ্রু-গুম্ফময় নির্লিপ্তি সহ ধরে ফেলতে পারলে অনায়াসে বিনা সম্পাদনায় গাইড বুকের প্রচ্ছদে ছাপিয়ে দিতে পারতো, বড় অন্তরঙ্গ ভাবে যিনি জানেন মূর্তি ভাঙাও মূর্তি গড়ার চেয়ে কোনো অংশে কম যত্ন দাবী করে না!