পঙ্কজ চক্রবর্তী

পঙ্কজ চক্রবর্তী’র কবিতাগুচ্ছ

সান্ধ্যভাষার জলস্রোত

১.
বৃথা মানুষের সঙ্গে দিন কাটে । কতদিন তার সাথে দেখা হল জলে ও জঙ্গলে, আশ্চর্য লাইব্রেরির মাথায়। আজ সে একা হাতে বাজার করে। সবুজে সবুজ হয়ে ঘরে ফেরে মাংসময়। রবিবার। রবিবার নয় এমন দিনে ওই তার উচ্চকিত ফেরা…

২.
গান জানো। তবে শোনাও। শ্রোতার চোখ যেন দেখতে পায় দুপুরের জোনাকি। যেন মনে হয় মরু শহরের উটের মালিকের বিষণ্ণতা জলীয় বিষয়। অচেনা হাত এইমাত্র ছুঁয়ে এল কাঁথাবোনা সুর। আমি শীতাতপ গানের মালিক। আমি শ্রোতার চোখ ঘুরিয়ে দিতে পারি ভাঙাচোরা জনতার দিকে

৩.
বার্ধক্যভাতার মতো নেমে আসছে বারোয়ারি সিঁড়ি। শুধু দেখা যায় খালি চোখে এই আঁচল ধূসররক্ষিতা। তোমার উপন্যাস থেকে তুলে নিই প্রিয় অভিধান। যা রইল- রাজকন্যা, লাল নীল শীর্ণ দোকানপাট। কিছু দূরে অনিচ্ছুক, বেশ্যার সন্তানের জন্য নির্মিত সাক্ষরতা স্কুল।

৪.
ওগো দুপুরক্লান্ত, তোমার বিকেল নেই। অনুপস্থিত সব চরিত্র সিরিয়ালে মেতেছে এইবার। দৃশ্যরূপ এই আচ্ছন্নতা ঘরে ঘরে একদিন তুলবে ফসল। পকেট ভর্তি বাল্যহৃদয় খুচরো পয়সার মতো চলে যাবে শ্মশানের দিকে ।প্রতিটি অষ্টম শ্রেণি,অপরাধ, নিজের পৃথিবী ভরছে বেলুনে

৫.
বন্ধুর বাড়ির পিছনেই শত্রুর বাড়ি। আড়চোখে ভেসে যায় জগৎ সংসার। মিথ্যে ফ্রকের ছায়া টেনে আনে অবসন্ন ঘুম। জানলার আলো এসে এ বাড়ির মাদুর ডেকে তোলে। কয়েকদিন মনে হয় বেশ তো পাখির কলরব। তারপর দীর্ঘ জ্বরের অপরাধ। দেখা হল না, তবু পড়ে রইল নাবালক স্তনের সাবান

৬.
বলিনি মহৎ চলচ্চিত্র স্বভাবতই কেন একা। বলিনি তোমার সমস্ত গান আহত পাখির সূর্যাস্ত। এমন সময় পাঁচজন পাঁচ কথা শুনিয়ে যায়। সুতোর ওপার থেকে দেখা বিলুপ্ত এক নদী। নৌকো প্রস্তুত। মাঝি নেই। এই অপেক্ষাটুকু আসলে পাঠকের – যে বোঝেনি সূচক, হিম ডাকঘর — অভিনয় দিয়ে ঢাকা সমস্ত সম্মতি

৭.
বিছানা পাতার ভূমিকা এক লুকোনো দূরত্ব। অথচ তোমার স্তন হাওয়া বাতাসের, নিকটবর্তী। শুধু দুজনের দুঃখের মাঝখানে তথাগত নীল আলমারি। এই দায়ভার নিয়ে নেমে গেছে অন্ধকার সিঁড়ি। ও কি জানে এই পথ অনিচ্ছুক, মুগ্ধতা বিষয়ক ক্লান্ত সেমিনার? সরলরেখার পাশে কতদিন দুখানি যুদ্ধজাহাজ ঘুমিয়ে পড়েছে?

৮.
জটিল রোগের সমাধান রয়েছে হাতের মুঠোয়। স্টেশনের বাথরুম জানে। জানে ব্যাটারি ভ্যানের চালক। সুদূর মফস্বল থেকে যিনি এসেছেন তার চশমায় সূর্যাস্ত মেলেছে দিগন্তের লাল। ঘোর অবিশ্বাস কেঁপে ওঠে। আর তিনি মনে মনে ভাবেন এবার সহজ হবে বালিশের এই অশান্ত তুলোময়তা। অতিকায় গন্ধের ভিতর আমি তোমাকে কুড়িয়ে পেয়েছি। উনবিংশ শতাব্দীর রাজবৈদ্য,উঠতি জ্যোতিষীর গ্রহ রত্নের দোকানের পাশে তোমার তেতোবড়ি, কথা অমৃত সমান।

৯.
যোগেশচন্দ্র বাগল রচিত ‘ডিরোজিও’। অরুণ মিত্রর শ্রেষ্ঠ কবিতা। ‘পুরুষ যখন যৌনকর্মী’ নামক সাম্প্রতিক একটি বই। এইসবের ভীড়ে চাপা পড়েছিল সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা। কতদিন আগে কেনা। এলোমেলো কয়েক পাতার পর পড়া হয়নি। আজ সুযোগ। আজ সিদ্ধেশ্বর সেনের জন্য দশকবিহীন মনখারাপ। আজ ধ্বংসের ভিতর দিয়ে যাত্রা আমাকে পোড়াবে। আমি বুক রিভিউ করতে করতে একদিন ঢুকে পড়েছিলাম প্রবীণ কবির লালার গুহায়। আজ কতদিন পর পাঠক উধাও, একী করুণা করুণাময়, উধাও…

১০.
আমার দুঃখগুলি এক ভারতীয় অতিকায় ছায়া, আমন্ত্রণমূলক। বিকেলের সমস্ত হাওয়া বোঝে আমার অভিসন্ধি বাংলাভাষার মতো, মাতৃস্তন্যকায়া। তুমি মনে করো আমার সংসার নেই। চায়ের দোকানে আমি এক অনুপ্রবেশকারী। কোথাও পৌঁছবে না আমার লুকোনো যৌনতা, ওহে ভাষাচর্চাকারী।সমস্ত লেখার থেকে অনুবাদকের চোখ আমি সরিয়ে রেখেছি…

১১.
সার্থক, এই কথাবার্তায় পিপাসা রয়েছে কোথাও! ঘাটের কিনারে মাছ, এক উভচর বোঝাপড়া। গলি পেরোলেই স্টেশন এবং একটি পেঁপে গাছ সমস্ত দৃশ্যের অধীন। দূরগামী বাসের মাথায় আজ তুলে দিই চায়ের দোকান। আমাকে নিয়ে চল গনগনে কয়লার ব্যবহারসমেত। যেন বলা যায় কিছুই নেই এমন একজন লোক কিছুদিন এখানে থাকবেন। কথার ভিতর সামান্য বিড়বিড় এমন একজন, আপাত বৈশিষ্ট্যহীন, কুয়ো খুঁড়ছেন দিনরাত।

১২.
জগদ্ধাত্রী ইটভাটা থেকে এইমাত্র কয়েকজন মানুষ পেরোলো হাইরোড। বালিভর্তি ট্রাকের নিচে ঝুলছে সস্তার পুরনো হাওয়াই চটি। এবং রাত, নাটকের চরিত্র হিসেবে বুঝে নিচ্ছে ক্লাইম্যাক্স। টোল ট্যাক্সের ছাদে ঘুমোচ্ছে গর্ভবতী দুটি কুকুর।চরিত্র হিসেবে পাগলের দার্শনিক কথায় আমোদ পেয়েছে কিছু রাতের পুলিশ। ভূমিকা নেই তবু ঢুকে পড়েছে দমকল, আপৎকালীন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এই মায়াবী সফরে। সম্ভবত আটের পাতায়।

১৩
ভাতের থালা ছুঁড়তে পারি না বলে সমৃদ্ধ হইনি। প্রতিটি স্মৃতির চোখে কালো দাগ। গাছের নীচে মশাল জ্বেলেছে স্থানীয় আত্মীয়স্বজন। শ্মশানের হাওয়া কাছে, কয়েকটি নিমগাছ এবং দ্রুতগামী ছায়ার পুতুল। রাত বারোটায় শেষ বাস। এই তথ্যটুকু মাথায় রেখে তবে না শোক, শেষ গঙ্গাজল! এখন রাস্তা পেরোতেই ভারি হয়ে আসে মাথা, পুনরুৎপাদিত ঘটনাবিক্রম। শুধু একজন স্কুলপাঠ্য ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নামছে প্রতিদিন নিজের ভিতরে

১৪.
শুধু শূন্যেরই এত মেধা যখন তখন সে ছিঁড়ে দিতে পারে সব কৌশল। বালকের নিঃসঙ্গ দুপুর। খাতার পাতায় প্রতিটি শব্দের ফাঁকে সে রেখেছে সন্ধ্যার অবৈধ আলো। জানালায় মসলিন পর্দার ভূমিকা। একঘর লোকের সামনে তার মুখের সব রেখা দেখে ফেলবে গর্দভের হাসি। যেমন সে দেখেছে মাঝরাতে, দিনেদুপুরে মায়ের জলস্রোতে, স্নানটুকু বাবার অচেনা।

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment