আনন্দ সিনেমা হলের মুখের উল্টোদিকে, চোরাই জুতো বিক্রির গুটিয়ে থাকা দোকানগুলোর চোখের সামনে একটা কুণ্ডলী- সোৎসাহে ঝুঁকে পড়ে, বিবেচনাপ্রসূত হয়েই আশপাশের সন্দেহজনক পরিবেশ কুণ্ডলীটাকে একটা দুর্বোধ্য বৃত্ত হয়ে উঠতে যথাসম্ভব সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বৃত্তটার ঘনত্ব ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ছে তাপমাত্রাও, পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করতে নিঃশ্বাসের চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কি-ই বা আছে? তবে ঘটনাটা ঠিক কী, তা আন্দাজের আওতায় পড়ছে না এখনও।
‘কিছু বুঝতে পারছেন?’ বৃত্তটাকে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে সাহায্য করর একজোড়া বাটা স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলহাতা শার্টের পকেট। পকেটের কাছে টাকা নেই, আছে একটি বলপয়েন্ট পেন, পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য সমস্ত মনোযোগ বিনিয়োগ করার ব্যাপারে সেই পেনটি স্থিরচিত্ত।
‘একেবারেই যে বুঝতে পারছি না তা নয়, কিন্তু এই অল্প বোঝার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। আপনার কি মনে হয়?’ মিথ্যা ওয়ারেন্টটির নোটিশ বুকে ঝুলিয়ে রাখা স্যান্ডেলটি বলে ওঠে, নিজের কথাগুলোকেই নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না সে, বিধায় আশপাশের মুখগুলোর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়।
‘এটা একটা মশা।’ স্যান্ডেলের পাশেই জায়গা করে নেয়া আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর বাদামের খোসা সহসা বলে ওঠেন।
‘মশা?’ আঁতকে ওঠেন স্যান্ডেল।
‘হ্যাঁ, আবার ডাইনোসর হতেও পারে, অথবা শেয়ার মার্কেটের ছায়াও হতে পারে…’
‘কি বলেন? একে দেখতে তো একেবারে কর্কট আক্রান্ত পৃথিবীর মানচিত্র বলে মনে হচ্ছে।’ আবার মুখ খুলেন পকেট।
‘4G-র কল্যাণে এমন দেখাচ্ছে?’ স্যান্ডেলের ভাব দেখলে মনে হয় সে একজন পাক্কা বুদ্ধিজীবী।
‘4G, ইয়েস, ইয়েস।’ বাদামের খোসার চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস ঝলমল করছে।
‘ব্যাড কর্পোরেট গভর্নেন্সের বিকাশমান ছায়া বলেই মনে হচ্ছে আমার।’ শার্ট এবং স্যান্ডেলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ চশমা কথাগুলো বলেই চুপ করে গেলেন, মনে হচ্ছে মতামত নয়, ফলাফল ঘোষণা করছেন তিনি।
‘আরে না, এ হলো হাতির দাঁতের ছায়া। আমি নিশ্চিত, আমার বড়দাদার- সেই ব্রিটিশ আমলের কথা; একটা হাতি ছিল। বড়দাদা প্রত্যেক বছর জাহাজে করে হাতিটিকে বিলেত নিয়ে যেতেন, সেখানের রাজদরবারে হাতিটির দাঁত কেটে নেয়া হতো। রানী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন এবং ফিরতি জাহাজে পাঠিয়ে দিতেন দেশে।’ জটলার পাশেই পড়ে থাকা আধাপোড়া একটা সিগারেট মাথা উঁচিয়ে বলে উঠলো।
‘তাই নাকি? রানী ভিক্টোরিয়ার সাথে নিশ্চয় আপনার দাদার সেলফি আছে? দেখাবেন?’ ভিড় ঠেলে কথাগুলো বলল মাথা থেঁতলানো একটা দাঁত। ব্রাশ না করার ফলে দাঁতের মুখ কালচে হয়ে গেছে, গন্ধও বেরুচ্ছে ভুরভুর করে।
‘আরে না, এ হচ্ছে গুম হয়ে যাওয়া ভাতের লোকমার ছায়া।’ চুপসে থাকা একটা পলিথিনের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এলো শব্দগুলো, ‘মুখ বন্ধ রাখুন আপনি, কি বিচ্ছিরি গন্ধ।’
‘হ্যাঁ, ছায়া, ছায়া, কালো ছায়া মানেই ব্যাড কর্পোরেট গভরনেন্স।’ নিজের চোখে ভিড় করা ধোঁয়া আর কুয়াশা মুছে নিতে নিতে বললেন চশমাটি।
চারিদিকে থকথকে ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততার ধার ঘেঁষে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটি ছায়া। ছায়াটিকে ঘিরে রয়েছে বেশ কিছু কৌতূহলী চরিত্র, সদ্য সিনেমা ভাঙা দর্শকের মতো মনে হচ্ছে কৌতূহলের দলাটাকে। অবশ্য সেই কৌতূহলের দলার দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ফার্মগেটের। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে, কখনও মহাখালীর দিকে কখনও বা শাহবাগের দিকে। পরিস্থিতির ঘড়ি থেকেই পালিয়ে যাচ্ছে সময়। আসলে ব্যস্ততার দুই চোখ ইদানীং দুই রকমের জিনিস দেখছে। এটাই চলতি ট্রেণ্ড।
‘এক চোখ ধর্মের তো আরেক চোখ মাতালের। এক চোখ ব্যবসার তো আরেক চোখ ডাকাতির।’ সদ্য নিঃসৃত হলদেটে ঘন কফ নিজেকে অবজ্ঞা করার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠল কথাগুলো। সকলেই তার দিকে তাকাতে বাধ্য হলো, তাকিয়েই পুনরায় চোখ ফেললো উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছায়াটির দিকে, বাদামের খোসা বলল, ‘ট্রেণ্ড হলো ঘোড়া, আরবের রেসের ঘোড়া- যেগুলোর পিঠে বসে আছে এদেশের জকি।’
‘হ্যাঁ, আপনি কি যেন বলছিলেন? ব্যা-ড-ক-র-র-পো-রে-ট-গ-ভ-র-নে-ন-স।’ একটা সাদা পাজামার ক্ষীণ পা বিভ্রান্তি আড়াল করতে করে বললেন কথাগুলো।
‘নো রিফিউজাল নো অনার।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী শেষ হবার পরও চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া প্রফেসরের ভঙ্গিতে কথা বলছেন চশমা।
‘ফোন কোম্পানিগুলোর কথা বলছেন তো- মানে ওরা বদ কর্পোরাল গভরমেন্ট? এতক্ষণে বুঝেছি।’ সিগারেটের পোড়া অংশ বলে ওঠে।
‘নিজেকে শিক্ষিত করে তুলুন। কথাটা বদ কর্পোরাল গভরমেন্ট নয়, ব্যাড কর্পোরেট গভরনেন্স। হিসেব করে দেখেছেন প্রতিদিন কত মুখ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম?’ চশমার চোখে ঘষা খাওয়া লেন্স; অল্প দেখছেন তিনি কিন্তু বলার জন্য চোখ লাগে না একথা তিনি বুঝে গেছেন বহু পূর্বেই।
‘পশ্চিম মানে কেবলা? আমি আগামী বছর যাচ্ছি।’ হঠাৎ জটলার পাশেই বসে থাকা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া হাফ লিটারের পেপসির বোতল বলে উঠে।
‘ভোকাল কর্ড আপনার, শ্রবণেন্দ্রিয় আপনার, ইনফ্যাক্ট সবকিছুই আপনার, আবার দেখুন টাকাও কাটছে আপনার, অথচ আপনি আঙুল হারাচ্ছেন, ভাবতে পারেন?’
‘কি যেন বলছিলেন, নো রিফিউজাল নো অনার? এটা আপনার কথা?’
‘না, না। কোন এক ইকোনমিস্ট বলেছিলেন, নামটা মনে করতে পারছি না।’
‘না, পশ্চিম মানে বিদেশ। পশ্চিম মানে প্রতিবেশী।’
‘দেখছেন আমাদের বুঝের কতো কমতি! আমাদের গ্রামের বাড়ির পশ্চিমে মাতবর বাড়ি, মাতবর আমাদের জমি দখল করে ঘর তুলেছে, তার অর্থ পশ্চিম মানে মাতবর। এতে কিন্তু একটা লাভ হয়েছে- মাতবরই মানেই বিদেশ। আমরা বিদেশের প্রতিবেশী, প্রতিবেশী যদি বিদেশ হয় তাহলে একটু আধটু ছাড় দিতেই হয়, হয় না?’ পাজামার পা একটু বাড়তি আত্মবিশ্বাস সংগ্রহ করেন।
‘তুমি আমার বালটা জানো। সাওয়ার পাজামা, চুপ কর বোকাচোদা।’ এতক্ষণ কিছু না বলে মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকা মোটা মানিব্যাগ খাক খাক করে হাসতে হাসতে বলে ওঠে।
‘আপনার এতো লাগে কেন? মানিব্যাগ সাহেব? শরীর গরম নাকি? আসবেন? ঠাণ্ডা করে দেবো!’ ভ্রাম্যমাণ পতিতার দিক থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণ ভুরু নাচিয়ে বলে, বলেই এগিয়ে যায় পতিত অন্ধকারের আড়ালে।
‘ছায়াটা আসলে ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত এবেলের ভাই কেইনের, যে তার নিজ ভাইকে হত্যা করেছিল। এবং সেটাও নারীকে কেন্দ্র করেই।’
‘মানে হাবিলের ভাই কাবিল? তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন পৃথিবীতে পুরুষের মধ্যে সংঘাতের শুরু হয় নারীকে পাওয়া না পাওয়া থেকে?’
‘হ্যাঁ। হাবিলের জন্য নির্ধারিত নারী ছিল অধিক সুন্দরী, কাবিলের জন্য নির্ধারিত নারী ছিল অপেক্ষাকৃত কম সুন্দরী। কাবিল কিছুতেই এটা মেনে নিতে চায়নি এবং সুন্দরী নারীকে পাবার জন্যই হাবিলকে নৃশংসভাবে খুন করে।’
‘শালার মেয়ে মানুষই যত ঝামেলার মূল।’ বাদামের খোসার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
‘জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা না বলা ভালো। আমরা ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে কথা বলতে পারি না?’
‘ওটা তো একটা বাল।’
‘বাল মানে? বাল মানে মাদারচোদ।’
‘নো রিফিউজাল, নো অনার।’
‘মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, খাদি পরতে আহ্বান জানিয়েছিলেন গান্ধীজী; সেই ব্যাপারটা সঠিক ছিল?’
‘পাজামা, আপনি একটু বেশী বকছেন, থাকুন তো।’ আধাপোড়া বেনসন হুঙ্কারের ভঙ্গিতে বলে।
‘কিন্তু এই ছায়াটা কিসের?’
‘এটা সম্ভবত নেতাজী’র টুপির!’ বৃদ্ধ চশমা বলে ওঠেন, ‘আবার ক্ষুদিরামের ফাঁসির দড়ির ছায়ার মতোও মনে হচ্ছে।’
‘আপনি না হাতির দাঁতের কথা বলছিলেন? ইংলণ্ডের রানীর কথাও বলছিলেন, সমস্যা কি হলো জানেন, রানীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে খুব। অবশ্য একে সমস্যা হিসেবে না দেখে বরং…’
‘না সম্ভবত এটা এন্টিমিশাইলের ছায়া।’
‘মানে জর্মনরা যেটা বানিয়েছিল?’
‘আমার কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে আফগানিস্থানে হরহামেশা ঘটে আত্মঘাতী হামলার ছায়া, আবার কনডমের ছায়াও মনে হচ্ছে।’
‘কিন্তু শেষ রক্ষা তো হয় না…’ পতিতার শরীরের ঘ্রাণ হঠাৎ উদয় হয়, এসেই ঘেঁষে দাঁড়ায় মোটা মানিব্যাগের পাশে, ‘এ ছায়াটা হল, জি-৮ এর।’ বলেই শরীর দুলিয়ে এগিয়ে যায় চক্রাবক্রা লাঠির খোঁজে।
সকলেই স্তম্ভিত হয়। শ্বাস নেয়া ভুলে যায় পুরো পরিবেশ। ‘জি-৮’ কেউ কিছুই বুঝতে পারে না। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছায়াটির দিক থেকে কৌতূহল সরে যায় পতিতার শরীরের ঘ্রাণ অভিমুখে। পরক্ষণেই সকলে দৃষ্টি ফেরায় বৃদ্ধ চশমার দিকে।
‘নো রিফিউজাল নো অনার’ চশমা বলে উঠলেন, ‘জি- ৮, তাই তো? ঘাবড়াবার কিছু নেই। আরেকটু গাঢ় হয়ে ঘিরে ধরুন ছায়াটাকে, এরপর ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করছি।’
সকলকেই বেশ এটেনটিভ হয়ে ওঠে, মনে হচ্ছে ইয়েমেনের দূর্ভিক্ষ বিষয়ে কথা বলবে জাতিসঙ্ঘের লাউদ স্পীকার। হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো একটি বহুতল এরোপ্লেন। ‘বুঝেছি, বুঝে গেছি, জি-৮ মানে ওই প্লেনের গুয়া…’ বলে ওঠে বাদামের খোসা।
‘কি যা তা বলছেন?’ সিগারেটের পোড়া অংশ মুখ খোলে এবার, ‘মাননীয় চশমা, কি যেন বলতে চাইছিলেন আপনি?’
‘বাদ দিন। কিন্তু কালো ছায়াটা কিসের?’
সকলের সম্মুখেই কালো ছায়াটি একটু একটু করে সরে যেতে থাকে, সাথে সাথে সরে যায় ছায়াটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গাঢ় বৃত্তটি। ছায়াটি এক সময় এসে দাঁড়ায় বিজয় সরণীর মোড়ে, সাথে আসে বাটা স্যান্ডেলের ডান পাটি, ফুলহাতা শার্টের পকেট, বাদামের খোসা, বৃদ্ধ চশমা, আধাপোড়া একটা সিগারেট, মাথা থেঁতলানো একটা দাঁত, হলদেটে ঘন কফ, পাজামার ক্ষীণ পা, হাফ লিটারের পেপসির বোতল, মোটা মানিব্যাগ, পতিতার শরীরের ঘ্রাণ।
এখানেও বেশীক্ষণ স্থির হতে পারে না ছায়াটি এবং একে ঘিরে থাকা জটলা। এমন ব্যস্ত এবং মহা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে না সামান্য একটা ছায়া, আর একে ঘিরে থাকা জটলা যেকোনো সময় ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ছায়াটা শাহবাগের দিকে এগুতে থাকে। ছায়াটাকে ঘিরে জড় হতে থাকে উড়নচণ্ডী ধুলোবালি, বেগানা বাতাস, ফেলে দেয়া চুইংগাম, আইসক্রিমের কাঠি, রেস্তোরাঁর পচা খাবার, পরিত্যক্ত ঝাঁটা, পুরানো অন্তর্বাস, উপচে পড়া স্যুয়ারেজ।
সকলের একই জিজ্ঞাসা, ছায়াটি কিসের?
সকলকে অবাক করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায় ছায়াটি। বলে, ‘আমি জনতা নই…’