শুভদীপ মৈত্র

নীল ক্যাসিডির গাড়ি থেকে নামা যায় না

নীল ক্যাসিডির গাড়িতে একবার উঠলে আর নামা যায় না বুঝিনি তখন । সেই যে একটা গান শুনেছিলাম ছোটবেলায় হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া সেই এক ভূতে পাওয়া হোটেল যাতে ঢোকার রাস্তা আছে কিন্তু বেরনোর উপায় নেই, প্রিজনার অফ ওন ডিভাইস – নীল ক্যাসিডির গাড়ি না ক্যেরুয়াকের কলম যাই হোক না কেন একবার ধরলে ছাড়ন নেই। যদিও ওই যে বললাম বুঝিনি তখন। কুড়ি বাইশ বছরের যুবকের কাছে ‘অন দ্য রোড’ এমন নেশা যা কোনো রিহ্যাব ছাড়াতে পারে না – তাদেরও উপায় জানা নেই।

অথচ বইয়ের মধ্যে ঘর করা নতুন নয়। কলকাতার স্কুলে পড়ে বারুইপুরে থেকে, যে যাতায়াতের দীর্ঘ সময় ও একাকীত্ব তা ভরাট করবে তারাই এ খুব সহজ ব্যাপার – একা কৈশোরে কাল্পনিক পৃথিবী মিশে যাবে, আর তারপর কী করে হেমিংওয়ে, টেড হিউজেস চলে আসে, প্রেমে পড়ে সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টো বা জয় গোঁসাই ঢুকে পড়ে  তারপর কামু বা কাফকা না বুঝেই – স্বাভাবিক বাঙালি যৌবন আসে। তার মধ্যে এক বইমেলায় কেনা বইটা – গাড়িরতলা দিয়ে রাস্তার এক লো অ্যাঙ্গেল শট (তখন জানতাম না অবশ্যি লো হাই এসব), গোলাপি আভার সেই রাস্তার চলমানতা – আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। পেপার-ব্যাক বইটার পিছনে লেখা ছিল ‘অন দ্য রোড সোল্ড আ ট্রিলিয়ন লিভাইজ অ্যান্ড আ মিলিয়ন এসপ্রেসো মেশিন, অ্যান্ড আলসো সেন্ট কাউন্টলেস কিডস অন দ্য রোড’ বারোজের বিখ্যাত উক্তি, কিন্তু বারোজকে জানি না। এই লেখককেও না। তখনও ঝটাঝট গুগলবাবার সিধু জ্যাঠামো ছিল না, জানতে গেলে লাইব্রেরি আর অ্যামেরিকান সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী কাউকে চিনতাম না। এখনো গিনসবার্গকে বাঙালি যদ্দুর চেনে (কৃত্তিবাসী কবিদের দৌলতে?) ক্যেরুয়াককে নয়, স্নাইডার তো আরোই নয়, মজার ব্যাপার স্নাইডার আর গিনসবার্গ এক সময়ে এদেশে পা দিয়েছেনঅথচ বিট নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ নেই, হিপি আর বিট প্রায় এক।

এহেন বই মনে আছে কিছুদিন আলমারি-বন্দি ছিল, ভুলেই গেছিলাম নানা বইয়ের মাঝে। তারপর প্রথম পাঠ, সে অভিজ্ঞতা শুধু তাদের জন্য যারা ওই  বয়সে পড়েছে। গোটা পৃথিবীকে দেখাটা বদলে গেল এক ঝটকায় – সমাজ, জীবন, যাপন সবকিছুকে নতুন চোখে দেখা। এব্ং ওই ‘ইচ’ এর পাল্লায় পড়া। উদযাপন নিয়ে আমার যে হ্যাংলামি তার জন্য হয়তো পুরোপুরি দায়ী ক্যেরুয়াক। নাহলে কী হত, সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা এসব নিয়ে দিব্যি থেকে যেতাম ক্যেরিয়ার নামক কিছুর একটা খোঁজে, সাহিত্য চর্চাও খানিক হত সবদিক বাঁচিয়ে। কিন্তু বারবার দূরছাই ভাল্লাগছে না ব্যস এবার একটা বদল দরকার – এমনটাহত না। ওই যে বন্দী মানুষ আমি, নাকি রাস্তার উপরে থাকার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেল, যেখানে বাড়ি বা রাস্তা বলে আলাদা করে কিছুই হয় না, আসলে সবই স্থাবর আবার সবই জঙ্গম, তুমি যেভাবে দেখতে চাও এই বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা যা তোমায় তীব্রতা দেবে সে কষ্টেরই হোক বা আনন্দের – এর থেকে বড় উদযাপন জীবনে আর নেই।

সল প্যারাডাইজ বা ডিন মরিয়ারটি এত কাছের হয়ে উঠল কেন? বিদেশী কোনো চরিত্রকে এমন মনে হয়নি, রাসকোলনিকভের সঙ্গে আলাপ অসুখের বিছানায় শুয়ে, জেক বা স্যাম হেমিংওয়ের প্যারিসের সব দামালেরা বা পিয়্যের-এর মতো যুদ্ধ ও শান্তিতে  অবিচল কেউ আমাকে এভাবে বদলে দেয়নি। অথচ ওই হিচহাইকিংময় ওই নেশাময় ওই প্রেমময় আমেরিকান বিট জীবন আমাদের খুব সহজ নয় আপাতভাবে ( বুদ্ধদেব বসু সতর্ক করেছিলেন তার জামাইকে এদের সম্পর্কে), তবু কিছু একটা ভিতরের মিল ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষটা খানিক তেমন? না, শুধু তা নয়, সময়টাও তো ছিল তেমনই। নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় বেড়ে ওঠা যেখানে বিশ্বায়নের খোলা হাওয়া বইতে শুরু করেছে আর তার মাঝে শহরতলির এক মধ্যবিত্ত ছেলে নিজেকে খুঁজতে পারছে না সে একই সঙ্গে ওই ব্যবস্থার গিনিপিগ ও ভোক্তা – কাজেই সে খুঁজে পাবে তার ছটফটানির সঙ্গে মিল সল বা ডিন-এর। নব্বইয়ের দশকে যারা এই নতুনের ঝাপটা পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি তাদের কয়েকজন সে আমার বন্ধু জয় বা কবি সোমাভ (যদিও অনেক পরে আলাপ) প্রত্যেকের মধ্যে এই না-থিতু ব্যাপারটা রয়ে গেল।

গোটা পৃথিবীতেই এমন রয়েছে, শুধু আমার দেশে নয়। বাইশ তেইশ বছর বয়সে প্রথম ট্রেক-এ যাচ্ছি, পাড়ার বন্ধু থেকে চায়ের দোকানের কর্মচারী নিয়ে সে এক আজব দল, ট্রেনে আলাপ হল একটি চেক ছেলের সঙ্গে সেও যাচ্ছে পাহাড়ে এবং স্যান্ডো আর হাফ প্যান্ট পরে দাঁত মাজতে মাজতে সে বললে তার এই আসাটা ‘অন দ্য রোড’ পড়ার দৌলতেই। বুঝলাম আমি একা নই, এখনো অনেকেই মজে।

এই সল প্যারাডাইজ বা ডিন মরিয়ারটি এরা ঠিক উনিশ শতকী বোহেমিয়ান নয়, শিল্পের জন্য ঐকিক যাপন চাই তাই ভেবে তারা এমন জীবন বেছে নেয়নি, তারাও তো আমাদের মতো একটা হাই ক্যাপিটালিস্টিক সমাজের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে ছিল। তাই বেছে নিয়েছে মুক্তির উপায় হিসেবে একটা খোঁজ যা ভীষণ শারীরিক এবং মানসিকও। তারা দর্শনের ভিতর ঢুকে দেখতে চেয়েছে, তারা মহাদেশ এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখতে চেয়েছে। তাদের খোঁজে তাই কোনো বাধা নেই – বুদ্ধের দর্শন থেকে বাম রাজনীতি সবের চর্চাই রয়েছে – সলের বন্ধু র‍্যেমি যখন তার জেলখানার মেস থেকে খাবার চুরি করে বা ডিনরা আমেরিকার এপিঠ থেকে ওপিঠ যাওয়ার পথে দোকান থেকে খাবার সিগারেট বিয়ার ঝেঁপে দেয় তা একধরনের অসহায় অবস্থার বিরুদ্ধে, কনভেনশনালিটির বিরুদ্ধে জেহাদ। জাঁ জেনের মতো পবিত্র চোর না হলেও ডিনের বড় হয়ে ওঠা জেলখানা আর লাইব্রেরি আর পুল হল-এ। আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত গণ্ডীর ভিতর হাঁপাতে হাঁপাতে বা সয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারি না, কিন্তু এই প্রত্যাখ্যান আমাদের কাছে নতুন নয়। মুশকিল হল আমাদের প্রত্যাখ্যানের রঙ গেরুয়া। মানে,‘না’ বললে সবকিছুকে,সন্ন্যাস নিতে হবে যেন – শ্রীকান্তর মতো চরিত্রকে আমরা তাই বুঝতে পারি না, বা হয়তো নেশাড়ু হিপস্টার শরৎ চাটুজ্জে একটা মেলোড্রামার আড়ালে ব্যাপারটাকে রেখে দিয়েছেন কিছুটা যাতে সহজপাচ্য হয়।

চরকিবাজি আর বোহেমিয়ানিজম-এর সহজ চশমায় শুধু দেখলে অবশ্য অনেককিছু হারাতে হতে পারে – ‘অন দ্য রোড’ তাই ‘ধর্মা বাম’ ছাড়া পূর্ণ নয়। নীলের সঙ্গে অবিরাম ঘুরে যাওয়া নয় স্নাইডারের জেন বুদ্ধধর্ম ও তার শান্ত সমাহিত হাইকু চর্চা, তার যাপনের বাহুল্যকে বাদ দিয়ে একটা নান্দনিকতা তৈরি খুব খুব জরুরি। উদযাপন কী তা বুঝতে গেলে একইসঙ্গে যাপনের নানা দিক জানতে হয়। শুধুমাত্র রিক্ততার চর্চা দিয়ে হয় না, ও কবির কাজ নয়, লেখকের অভীষ্ট নয় – বরং দুই প্রান্তকে নিজের মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এমনকি তার ব্যর্থতা থেকেও সৃজন সম্ভব। ক্যেরুয়াক থেকে প্রথম আমি বুঝতে পারি সহজে।

অনেক পরে যখন ড্রিমার্স দেখি, সেই বিখ্যাত শেষ দৃশ্য যেখানে তিন বন্ধু প্রায় আত্মহত্যা করতে শুয়ে এমন সময় প্যারিসের রাস্তায় বিশাল মিছিল আর তারাও তাদের ব্যক্তিগত যাপনের ওই ওঠাপড়ার পরও মিশে যাচ্ছে তাতে, মলোটভ ককটেল হাতে প্রতিরোধের যুদ্ধে সামিল হচ্ছে। ষাটের এই যৌবনের বিদ্রোহ সম্ভব বিট মুভমেন্টের জন্যই।

আমাদের সমস্যা হল এই সহজ মিশে যাওয়াটা যে মানুষেরই তা বুঝতে শিখিনি তাই বিটদের নিয়েঅনেক ভুল ধারণা রয়েছে – এমনকি প্রগতি সাহিত্যও এদের পছন্দ করে না, কারণ সদর দফতরে কামান দাগাটা প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করে। আমাদের প্রগতিশীলতার দর্শনও বহুদিন এই প্রতিষ্ঠান তৈরির চক্করে পড়ে রয়েছে। সর্বত্র হাই আর্ট হাই কালচারের বিরুদ্ধে একই রকম কিছু তৈরির চেষ্টা, বিপ্লব বা প্রতিরোধ মানে এক অদ্ভুত বামুনপনা যেখানে মানুষের স্বাভাবিকতার জায়গা নেই সে হাসতে ভালবাসতে উদযাপন করতে পারবে না জীবনকে । সে চেষ্টা জলে গেছে দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু অন দ্য রোডের মুক্তির ডাক এখনো শাশ্বত। সরাসরি মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা যায় এখনো – এ বিশ্বাস রাখা যায়।

এও কি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়নি? আমার এ যৌবনের মুগ্ধতা প্রায়-চল্লিশে পৌঁছে কেন?  সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু হয় কিন্তু চট করে হজমও হয় না। এই পৃথিবীতে বাজার আর ব্র্যান্ড অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তাই জিনস পন্য, তাই ব্রোম্যন্স বলে অদ্ভুত ন্যাকামির কনসেপ্ট তৈরি হয়। তার জন্য অন দ্য রোড দায়ী? কই যখন পড়ি মনে হয় না তো, লোকগুলো আমার মতোই গরীব বা মধ্যবিত্ত, তারা ব্র্যান্ড তৈরি করেনি, জিনসের বাজার করেছে। তারা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ওপেন সেক্সের কথা বলেছে, তারা ব্রোম্যান্স নয় তারা সরাসরি সমকামী বলতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। বুজোর্য়া বাজার সংস্কৃতি তাকে কোনোদিনই তাই হজম করতে পারবে না পুরোপুরি। তার কিছু কিছু জিনিস তারা নেবে, চেষ্টা করবে গুলিয়ে দিতে – তাদের জ্যাজ আর র‍্যাপ প্রেম আজ হয়তো রক ব্যান্ডের হাজার হাজার টাকার টিকিটে বদলে দেবে। কিন্তু কোথাও না কোথাও প্রতিরোধও থাকবে একটা। জ্যাক ক্যেরুয়াককে নীল ক্যাসিডি থুড়ি সল প্যারাডাইজকে ডিন মরিয়ারটি বলবে চলো বেরিয়ে পড়ি, আর কার্লো মার্কস বা অ্যালেন গিনসবার্গ বারোজের মরফিন নেওয়া দেখতে দেখতে শোনাবে কাদিজ। এমনটা ঘটবেই বলে নীল ক্যাসিডির গাড়ি থেকে নামতে পারলাম না আর।

 

অন দ্য রোড

জ্যাক ক্যেরুয়াক

প্রথম প্রকাশ: ১৯৫৭

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment