অক্ষর যেখানে সতত সচল, দৈনন্দিনের তারে টানটান করে বাঁধা, সেখানেই নিভৃতে বেজে ওঠে তাঁর কবিতা। এক আটপৌরে গৃহস্থের মাঝেও কখনও রান্নাঘর, কখনও বা ছবির অ্যালবাম, কখনও আবার পুরনো পত্রিকার গন্ধ, নীরবতায় মুদ্রিত ষাটের দশকের এই নিভৃতবাসিনীর আত্মকথা। কী নির্ভার অথচ অমোঘ সেই সব কবিতা। পঞ্চাশের দশকের কবিদের ভাষা তখন সুপ্রতিষ্ঠিত, কবিতামঞ্চ সেজে উঠেছে পুরুষ কবিদের সশব্দ উচ্চারণে, তেমন সময়েই দেবারতি মিত্র এলেন তাঁর কবিতার সম্ভার নিয়ে। নারীর ভাষ্যে ফুটে উঠল তার যাপনের নানা সংলাপ, প্রেম-শরীর-যৌনতা যেন কবিতাশরীরে এক নতুন ছন্দ পেল, যেখানে কোনো রাখ-ঢাক নেই, নেই কোনো নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া। প্রেমের অনুভূতি সেখানে যৌনতার নান্দনিক সুতোয় বাঁধা, তিনি লেখেন –
আমার শরীর জড়িয়ে ফুলের যে গাছ উঠেছিল
ঘুরে ঘুরে পাগল স্রোতের মতন অবিরাম
কালকে তোমার সঙ্গে যখন রাত্রি জেগেছিলাম।
কবি দেবারতি মিত্রের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় যোগিয়া বাড়িতে। তখন আমি যাদবপুরে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি গিয়েছিলাম পুনর্মিলন উৎসবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে আর পুনর্মিলন পত্রিকার জন্য তাঁর লেখা সংগ্রহ করতে। দ্বিতীয়বার যোগিয়া বাড়িতে যাই আমার স্নাতকোত্তর স্তরের গবেষণা অভিসন্দর্ভের প্রয়োজনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে। সাক্ষাৎকারের বিষয় ছিল ওঁর কবিতায় রবীন্দ্রপ্রভাব নিয়ে। তবে ফোনে যখন কথা হয়েছিল, তখন আর আলাদা করে সাক্ষাৎকারের বিষয় সম্পর্কে জানানো হয়নি৷ যখন পৌঁছই, দেখি উনি ওনার ইতিপূর্বে নেওয়া নানারকম সাক্ষাৎকারের অংশ গুছিয়ে রেখেছেন আমার জন্য, যদি কোনো প্রয়োজনে লাগে। তবে সামগ্রিক কথোপকথনটিই চলেছিল ঘরোয়া কথোপকথনের আঙ্গিকে। কোনো গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা তাঁর কাছে পাইনি। তিনি অনর্গল বলে চলছিলেন নিজের জীবনের কথা৷ একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন –
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে পড়তে কখন
নিজের অজ্ঞাতসারে চলতে আরম্ভ করে দিই
জানলাবন্ধ ঘরের দেয়ালের বাইরে চলে যাই
বুঝতে পারি না।
আবিষ্ট দুপুর সন্ধ্যাবেলাকার নিস্তব্ধ হ্রদের মতো
বিশাল শান্ত নদীর ধারে আপ্লুত বাতাস
এলোমেলো বকুল শিউলি চাঁপা
বসন্তকালের গাছপালার সতেজ গন্ধ।
আরও অবাক হয়েছিলাম জেনে যে তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চেয়েও গান বেশি পছন্দের। সেকথা অকপটেই বললেন। আর বললেন, “জানো, আমি যদি কবিতা না লিখতাম, তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বেড়াতাম। আমার তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াই, ওঁর গান আরও ছড়িয়ে দিই মানুষের মধ্যে।” রবীন্দ্রনাথ কোনো তত্ত্বের মতো করে তাঁর কাছে ধরা দেননি, ধরা দিয়েছেন সুফি গানের সুরের মতো করে। রবীন্দ্রনাটকের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল ডাকঘর। ইশারার পর্দা ঠেলে তার চরিত্রগুলিকে যেন জীবন্ত দেখতে পেতেন চোখের সামনে। যে রাজাকে দেখা যায় না, অথচ পাওয়া যায় তার আগমন সংবাদ, তার সম্পর্কেই কবির আগ্রহ সর্বাধিক। অমলের মতো করে তিনিও যেন রাজার চিঠির দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকেন। আমায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেবারতি দি বলেছিলেন – “রাজা একটা অনিবার্যতা, রাজা শুধুই মৃত্যু নয়। সবার জীবনেই রাজা একটা অনিবার্য কিছু, তাকে উপেক্ষা করা যায় না।” এ দৃষ্টান্ত পাই তাঁর কবিতার মধ্যেও। ‘ডাকবাক্সে চোখের জল’ কবিতায় তিনি লিখছেন –
পথের ধারে রোগশয্যায় ডাকঘরের সেই অমল
এখন আমি একলা বসে আছি –
কখন চিঠি লিখবে যে সেই রাজা!
দেবারত্রি মিত্র-র কবিতায় কোথাও কোথাও যেন শুনতে পাই এক প্রখর সমাজ আর পরিবারের ঠোকাঠুকি, জীবনের সাথে সংস্কারের সংশ্লেষণ। চিত্রকল্পের আখ্যান খুলে দিয়ে তা থেকে ঝরে পড়ে ভাবনার বীজ। নারী-শরীর আর সমাজ-নির্মিত নারী-শরীরে যে ভেদ, তা একটা শব্দ-পতাকার মতো উড়ে চলে। তিনি লেখেন –
ছায়ার ঘোমটায় মাথা ঢেকে আমি সাঁইত্রিশ বছরের প্রায়-যুবতী মা।
নাড়ি ছিঁড়ে একটুকড়ো পোড়া ফুল ঝরে পড়ে পায়ের তলায়—
ন্যাকড়ার পুঁটুলি খুলে কেন বিচি ছড়াতে গেলাম পৃথিবীতে? দাবানলে শিশু বন পুড়ে যায়, কাকিনীর দেহ পোড়ে কেন? বৃথামাংসে তৃপ্ত হবে কোন্ পশু, অগম্য চন্ডাল!
তাঁর কবিতায় ‘পুরাণ’ এর আদলে সেজে ওঠে ‘ছদ্মপুরাণ’। সামাজিক প্রথা আর সময়ের দ্বন্দ্ব থেকে উঠে বেশ কিছু পুরা-প্রত্নকল্প। তাকে ‘সমাজকল্প’ও হয়তো বা বলা যেতে পারে। ‘অবিদ্যা’ কবিতায় তিনি এক দেবীর অবয়ব নির্মাণ করেন, যা শাস্ত্রবিদিত প্রচলিত দেবীবর্ণনার থেকে স্বতন্ত্র, অথচ সেও এক দেবী। অবিদ্যার চার হাত কাঁচা কষ্টিপাথরে গড়া, উঁচু দাঁত, চোখ ঐষৎ ‘ট্যারচা’। সেই ছদ্মপুরাকল্পলোকে খুঁতো পশুদেরই কেবল বলি দেওয়া হয়। এ দেবীপূজার বিধি অন্য। কবি তাঁর শব্দবুননে বিঁধে চলেন সমাজের প্রথাগত সংস্কারকে, লৌকিক রক্তমাংসের লীলায় যেন রাঙা হয়ে যায় কবিতার বেদি –
কাঁচা কষ্টিপাথরের চার হাত, রাজহাঁসবাসিনী, দাঁত উঁচু, বাম উরু ঢেঁকি,
ঈষৎ ট্যারচা চোখে বরাভয়।
গেঁয়ো লোকে বলে: খুঁতো পশুদেরই শুধু বলি হয়
নিচ অবধি সিঁড়ি পড়ে আছে—
দিঘির থমকে থাকা স্রোতে প্রত্যেক কর্দমষষ্ঠীতেই অন্তত একটি করে চোখ ওল্টানো ধড়হীন মুন্ডু ভেসে ওঠে, কালো ধুতুরার বনে শুঁয়োপোকা শানবাসী শামুককে খবর পাঠালে তখন বোধন শুরু।
অথচ কবির মন্তব্যটুকু শোনা যায় শেষ দুই পঙক্তিতে, যেখানে কবি লেখেন – “তোমার পুজোর দিনে আসতে না হয়, ধনি, /এই বর চাই “।
শব্দে আগল পরানো কবির স্বভাব-বহির্ভূত। তাই কবি দেবারতি মিত্র-র শব্দচয়ন সজোরে আঘাত করে আমাদের সলজ্জ আধো অস্ফুট ট্যাবু-গুলোকে। নারীর দৃষ্টি দিয়েই তো পুরুষের শরীরকে আরও সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করা যায়, সৌন্দর্য্যচেতনা আর যৌনচেতনার মাঝে তো কোনো বিরোধ নেই। কবি যখন লেখেন – “প্রিয়তম পুরুষটি এক পা একটুখানি উঁচু করে / বিছানায় ভেসে আসছে দেবদূত / সুকুমার ডৌভরা মাংসল ব্রোঞ্জের ঊরু / অবিশ্বাস্য নিখুঁত সহজ গ্রীক ভাস্করতা” – তখন মিলনের পূর্বে পুরুষ সঙ্গীর প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা এক তরুণীর চোখ আমাদের মনে ভেসে ওঠে।
তবু এ সবকিছুর মাঝে এক সংসারী কবির ঘরকন্নাটুকুও তো মনে পড়ে যায়। তার সেই কেটলিতে অতিথির জন্য ফুটছে লাল চায়ের পাতা, ইতস্তত করতে করতে নির্দ্বিধায় বলে চলছেন নিজের জীবনের সরল ভাষ্য, অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন এগিয়ে দেবেন বলে। দেবারতি মিত্র-র কাছে এই ঘরকন্নাও ছিল এক প্রাত্যহিক কবিতা, যাকে নিয়ে ঘুমনো আর জেগে ওঠার মাঝে কিছু শব্দ জেগে উঠত, জীবনের –
ভোরবেলাকার গলন্ত নীল আর উড়ন্ত বাতাসের প্ররোচনায় আমার দমবন্ধ কেটলিতে স্বপ্ন উথলে উঠল।
চা ঢালা হল।
পেয়ালারা আজ হাসিতে ভরতি, লিকারের মতিগতি না বুঝেই দুধচিনি চড়া আলোর সঙ্গে আকাশের লালচে আভার মতো মিশে যেতে লাগল।
চা পর্ব শেষ, এবার কুটনো কোটা শুরু-
ঘুঘুর বুকের মতো ধুকপুকে শ্যামবর্ণ বেগুন কুটতে কুটতে পাখির মাংস কাটার মৃদু শিহরণ পাই। আমার কিশোরী মেয়ের আঙুল নরম সবুজ বাঁশি এই লম্বা লম্বা ঢ্যাঁড়স কাটতে গেলে সুর তছনছ হয়ে যাবে ভয়ে মরে যাই। তারপর তুকতুকে লাউ বর্ণকুমারী না সুকুমারী? কুমারীর লাবণ্য গোড়া থেকে ছিন্নভিন্ন করলে মেয়েলি কুয়াশা, হৃদয়ের গন্ধ আর হরিৎ বেদনা। পুরুষের প্রতিভূ কোনো সবজির সঙ্গে আজ হেস্তনেস্ত হবে না ভেবে নিরুপায় দীর্ঘশ্বাস ফেলি।”