দেবব্রত কর বিশ্বাস

নিজেকে খোঁজার পঞ্চবাণ

 

১.

কবিতা কী কবিতা কেন কবিতা কোথা থেকে আসে কবিতা কোথায় নিয়ে যায় এসব নিয়ে আবহমান কাল ধরে মানুষ ভেবে এসেছেন। এখনও ভাবেন। এসব ভাবনার কোনও সিলেবাস নেই। এলোমেলো ভাবে খানিকটা নিজের মতো করেই ভাবতে হয়। আমিও ভাবতাম। এই যে লেখালেখি করি, তা না করলে কী হতো? কিন্তু এমন কী হলো যে লেখালেখি না করে আমি থাকতে পারি না? কীসের সেই তাগিদ? আমার কোন জিন আমাকে দিয়ে লেখায়? এসব ভাবতে ভাবতে আমি দেখি, নিজেকে নিজেই ভেঙে ফেলছি। মানে আমি, দেবব্রত। আমার মধ্যে অসংখ্য দেবব্রত। কিন্তু সেইসব খণ্ডগুলোর আলাদা কোনও নাম নেই। সব মিলিয়ে একত্রভাবে তারা দেবব্রত। তাহলে ওই যে খণ্ড, ওগুলো কী? ধরে নিই, ওগুলো আমার সন্তান। মানে আমার ভাবনা থেকে উদ্ভুত অনেকগুলো আমি, যা কিনা সামগ্রিক আমি’র থেকে আলাদা, সেগুলো আমার সন্তান। আমার মগজের সন্তান। আমার হৃদয়ের সন্তান। তবে এই অনুভব কি আমার একার হয়? না, বোধহয়। তাই তো মালদার কবি প্রীতম বসাক লিখেছেন, “হে বাৎসল্য! মাতৃভিটে থেকে অপাপবিদ্ধ ক্রন্দন নিয়ে এসো।/ আমি পিতৃভাব ছড়িয়ে রাখব দুপুরের নিমফলে।” নিজের কন্যাকে নিয়ে গোটা একটা বই লিখেছেন প্রীতম। বইটির পাতায় পাতায় যেন কন্যার বড় হয়ে ওঠা, তাকে পিঠে নিয়ে বাবার ঘোড়া সাজার গল্প। আমি পড়ি। পড়তে পড়তে আবার ভাবনায় পড়ে যাই আমি। সত্যিই কি শুধু নিজের মেয়ের কথা ভেবে একটা বই লিখে ফেলেছেন প্রীতম? দেখি তিনি লিখেছেন, “এই সাতসকালে একটা ছুমন্তর হয়ে গেল/ অদ্ভুত আলোর পিণ্ড। কেঁদে উঠল।/ সেই কান্নার কোনো উচ্চারণবিধি নেই/ রঙিন বার্তা হাতে আমি ছড়িয়ে পড়লাম/ এই গাছে। ওই বৃক্ষে।” এই লেখাটা পড়েই আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, আমি যা ভাবছি ঠিক তাই। আসলে সন্তানের প্রতি অনুভূতি তো প্রকারন্তরে নিজেকে খুঁজতে চাওয়া। বায়োলজিকাল দিক দিয়েও সন্তান তো নিজেরই একটা প্রতিবিম্ব যেন। আর বৌদ্ধিক স্তরেও তাই। এই অদ্ভুত আলোর পিণ্ডর কথা বলেছেন প্রীতম, এই আলো কোথায় থাকে? এই আলো থাকে নিজের ভিতরেই। তা প্রকাশ পায় সন্তানের রূপ ধরে। আর প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা কেঁদে ওঠে। বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের সেই আলো যেন। সেই আদিম সৃষ্টির প্রবল শব্দও যেন সন্তানজন্মের পর পিতার আনন্দ-কান্না। যে জন্মালো, সেও কেঁদে ওঠে। দুই কান্নার মিলনে সার্থক হয় জন্ম। সার্থক হয় সৃষ্টি। নিজের ভিতরে জন্ম নেওয়া নিজেরই এক ‘আমি’র সৃষ্টি। এর কোনও ব্যাকরণ হয় না। কোনও ব্যাকরণ দিয়ে, উচ্চারণবিধি দিয়ে সেই শব্দকে ধরতে পারা যায় না। তখন রঙিন বার্তা হাতে এই গাছ, সেই বৃক্ষে ছড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। এখানে আমি থেমে যাই। একবার গাছ, আবার বৃক্ষ কেন? দুটো তো একই। খানিক ভেবে বুঝতে পারি, গাছ হলো আমাদের ব্যবহারিক জগত। আর বৃক্ষ হলো বৌদ্ধিক মহাজগত। পরের কবিতাতেই প্রীতম লিখেছেন, “তর্ক করো না/ বিশ্বাস করতে শেখো/ যে এসেছে/ সে এনেছে/ ঈশ্বরের সংবাদ” আহা! কী সুন্দর অনুভূতি। এখানে ঈশ্বর মানে মূর্তিটুর্তি নয়। ওসবে আমার বিশ্বাস নেই। ওসবে আমার তর্কও নেই। আমি জানি যে এসেছে সে এনেছে আমার সংবাদ। এখানে আমি আর ঈশ্বর একাকার হয়ে যায়। যে আমিকে আমি নিজেই চিনি না, কিন্তু জানি সে আছে, সেই অজানা যখন দেহের রূপ ধরে সামনে আসে তার মুখে দু’একটা অন্নদানা তুলে দিতে ইচ্ছে করে। লালনে পালন করে নিজেকে বড় হয়ে উঠতে দেখতে ইচ্ছে করে। প্রীতম লিখেছেন, “এই যে তোমার মুখে/ একটা একটা করে/ অশ্রুদানা তুলে ধরছি/ জেনো নিজেকেই টিপে টিপে/ দেখছি আমি/ দেখছি যথাযথ সেদ্ধ হয়েছে কিনা/ ভাত হওয়া কি মুখের কথা বলো/ বাবা হওয়া!” কী অপূর্ব লিখেছেন প্রীতম। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়তেই থাকি। নিজেকে টিপে টিপে দেখি সেদ্ধ হয়েছে কিনা! আহা! আহা! তারপরেই অমোঘ সেই লাইন- “ভাত হওয়া কি মুখের কথা বলো” এই লাইনটি চিরকাল থেকে যাওয়ার মতো। একজন মানুষ যখন তার সন্তানের মধ্যে নিজেকে খোঁজেন আর পেয়ে যান আর পেয়ে গিয়ে আবার খুঁজতে শুরুর করেন এই লাইন সেই মহাসাধকের কলমে রচিত হয়।

বইটির নাম- পিতা-পুরাণ। কবি- প্রীতম বসাক। প্রকাশক- বৈভাষিক। মূল্য- ১২০ টাকা।

 

২.

“দাদুর কাঠের আলমারির লকারের দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞাসা করলেই মা বলত ওখানে ঝগড়াঝাটি থাকে বড়দের।” লিখেছেন আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়। কী অদ্ভুত একটা ভাবনা তাই না? আলমারির লকার খুব আশ্চর্য একটা জিনিস। আবার যদি সেই আলমারি পুরোনো হয়, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু সেখানে তো গল্প থাকবে। স্মৃতি থাকবে। পুরোনো সময়ের হেঁটে চলে বেড়ানোগুলো থাকবে। ঝগড়া কেন আছে? চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি। বড়দের ঝগড়া! মানে, এমন কিছু সেখানে প্রবেশ নিষেধ? এদিকে আমার তো গোপন বিষয়ে চিরকালের টান। আমি ঢুকে পড়ি। দেখি একটি ছেলে আর একটি মেয়ে খেতে বসেছে। একসঙ্গে, একই টেবিলে। রান্নায় নুন কম ছিল। ছেলেটি মুখে কিছু না বলে খেয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি বুঝতে পেরে নুন এগিয়ে দিল তাতে। মেয়েটিকে ভালো লেগে গেল ছেলেটির। ছেলেটি মনে মনে বলে, “না-পাওয়ার সংসারে অভাবের সদব্যবহার জানে মেয়েটি।” ছেলেটির মতো আমারও মন ভালো হয়ে যায়। ছেলেটি আবেগপ্রবণ। এমন আবেগপ্রবণ ছেলেকে কোন মা সংসারে বড়দের ব্যাপারে প্রবেশ করতে বলবেন? বলবেন না। কারণ লকার মানেই গোপনীয়তা। লকার মানেই গুহ্য। কিন্তু ছেলেটি কি গুহ্য বিষয়ে প্রবেশ করে না? আকাশ লিখেছে, “ক্রমশ সিগন্যাল লিখতে/ মুছে যাচ্ছে চাঁদমারি রোগ/ উরুর জখম জুড়ে বিন্দু বিন্দু তারা জেগে আছে” সিগন্যাল, এটাও সেই লকারের মতো। এগোতে বাধা দেয়, অথবা অনুমতি দেয়। জীবনের চলার পথে এমন সিগন্যাল অজস্রবার পেরোতে হয় আমাদের। সিগন্যালের কথা অমান্যও করি আমরা। কী হয়? মাঝেমধ্যে ছিটকে যেতে হয়। উরুতে বিন্দু বিন্দু জখম তারাদের মতো হয়ে যায়। আকাশ জীবনের কথাকে সরাসরি ভঙ্গীতে তুলে আনতে পছন্দ করে নিজের কবিতায়। ওর লেখা পড়ে আমার মনে হয় রাগ, বিরক্তি, হতাশা, ভালোবাসা, বিষাদ সব মিলেমিশে আছড়ে পড়ে ওর লেখায়। বলা ভালো, ওর ডায়রিতে। আমি বিশ্বাস করি, যারা ডায়রি লেখার মতো কবিতা লেখে, অর্থাৎ মনে যত কথা জমছে সব লিখে রাখতে পছন্দ করে কবিতায়, তারা সত্যিকারের কবি। আমাদের জীবন আসলে সাপ-লুডোর খেলার মতো আমাদের এগিয়ে নিয়ে খেলে। সেখানে আরোপিত কাব্যবোধ নেই, সেখানে একটাই লক্ষ্য, এগিয়ে চলা। এগিয়ে চলতে চলতে দুম করে নীচে পড়ে যাওয়া। আবার এগোনো। আকাশ লিখেছে “সাপ ও সিঁড়ির মাঝে ঘুমিয়েছি বেহেড মাতাল।” এই লাইনটা পড়ে বড় কষ্ট হয় আমার। বড্ড সৎ লাইন এটি। এই যে নিত্য সাপ লুডো খেলা, এই ক্লান্তির নেশায় আমরা মাতাল হয়ে যাই। এই ক্লান্তি কাটাতেও আমরা মাতাল হয়ে যাই। তারপর সব হাল ছেড়ে দিয়ে সাপ আর লুডোর মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের খেলায় ভাবনা থাকে না, গতকাল কী হয়েছে, অথবা আগামীকাল কী হবে! গন্তব্যও ঠিক ঘুমিয়ে পড়া অচেনা স্টেশনের মতো হুইসল দিয়ে ডাকে আমাদের। তাই আমাদের সংশয় হয়। আমরা বুঝে ফেলি “তুমি যাকে পুজো করো,/ আমি তাকে দেবতা মানি না/ একথা বলার পর বিতাড়িত হতে পারি/ সুসজ্জিত এ বাগান থেকে”। দেখি, আকাশ লিখেছে, “ছাদের দিকে একটি জানলা পাগল হয়ে উঠেছে/ জানলার নীচে মেঝেটির পা নেই আর মাটিতে”। থম মেরে যাই। এসব মধ্যবিত্ত ঘর গেরস্থালি কবিতায় লিখে ফেলা কম কথা নয়। গোটা বই জুড়ে এমন সব কবিতা রেখেছে আকাশ, যে আলাদা ভাবে কোনও একটি তুলে ধরা কঠিন। বলেছে, ও নাকি আর ডায়রি লেখে না। কিন্তু ওর লেখার ভঙ্গী ডায়রির মতোই। নিরন্তর পড়ে গেলে বোঝা যায় একজন সত্যিকারের কবি কথা বলছে আপন মনে।

বইয়ের নাম- পক্ষপাতদুষ্ট। কবি- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রকাশক- আদম। মূল্য- ১২৫ টাকা

 

৩.

মাঝেমধ্যে মনে হয় ‘আমি’ তৈরি হয় কীভাবে? শুধুই কি জন্মপ্রদত্ত শরীর? কিংবা পড়াশোনা এবং বোধচালিত মন? নাকি আরও অন্য কিছু থাকে? থাকে তো। আরও অনেক কিছু কাজ করে ‘আমি’ গড়ে ওঠার পেছনে। যেমন আমাদের জন্মস্থান। একে অনেকে ঘটনাচক্র বললেও আমি তেমনটা ভাবি না। আমি কোন মাটিতে জন্মেছি সেটা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ‘মানুষের শিকড়’ নামক এক বায়বীয় বিষয়কে যদি অগ্রাহ্যও করি, তাহলেও বলতে হয় আমার জন্মস্থানের বৈশিষ্ট্য আমি বয়ে নিয়ে চলেছি। বয়ে চলব সারা জীবন। তাকে অস্বীকার করব কীভাবে? কবি প্রশান্ত সরকারও অস্বীকার করে না সেই সত্যকে। তাই সে লিখে ফেলেছে ‘কলোনি কলকাতা’। আমি খুব মন দিয়ে পড়তে শুরু করি। কোথাও কি মিলে যাচ্ছে আমার ভাবনার সঙ্গেও? ও লিখেছে, “প্রতিটা প্রতীক্ষার পর/ যেভাবে সহজ হয়ে যাচ্ছে ট্রেনের সময়/ প্রতিটা পায়ের পঙক্তিতে/ মিলে যাচ্ছে আরেকটা পা- গন্ধ চিনে চিনে…” হেসে ফেলি আমি। পায়ের পঙক্তি! হু? এরকম ব্যাপার? মন ভালো হয়ে যায় আমার। কবি মানেই তো এরকম। তার প্রতিটি পদক্ষেপ কবিতার মতো ছন্দে বাধা থাকে। কিন্তু এই যে গন্ধ চিনে চিনে মিলে যাচ্ছে আরেকটা পা, সেটা তবে কার? সেই পা নিঃসন্দেহে পাঠকের। আহা! পায়ের পঙক্তি! বহুদিন মনে থাকবে আমার। এই যে মিলে যাওয়া এটাও একপ্রকার বিবাহ। কবি আর পাঠকের বিবাহ। কবিতা নামক একটা জলাশয়ের দুই দিকের দুই পাড়ে দুজন বসে থাকেন। কবি আর পাঠক। কবিতা যদি দুজনকে ছুঁয়ে যায়, তাহলে ঢেউ ওঠে সেই জলাশয়ের জলে। ওই ঢেউ হলো বিয়ের মন্ত্র। সইসাবুদ। এমনও হতে পারে, এক পাড়ের মন ভেঙে গেছে বলে আরেক পাড়েরও মন ভেঙে গেল। তখন কি সেটা বিবাহবহির্ভুত? প্রশান্ত লিখেছে, “দুই পাড় ভাঙলে, এমনিই/ ভরে আসে ঘট…/ ডুবসাঁতার, স্নানোদন, কথামালা উহ্য থাক…” ঠিকই তো। ভাঙলেও ভরে আসে ঘট। বাদবাকি না হয় উহ্য থেকে যায় বোধের উচ্চারণে। এও এক ধরনের বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ হেঁটে চলে বেড়াতে থাকে গোটা শহরে। বাড়ি ফিরতে না চাওয়া সেইসব অবুঝের সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে আমাদেরও ক্লান্তি আসে। প্রশান্ত লিখে ফেলে, “কতটা ভিজে ওঠার নাম শ্রাবণ, জানিও…/ পতন যতটা শীঘ্র হলে অযৌন হয়ে থাকে ঘর, তাও-” এই যে ভিজে ওঠা, এটা কি কামুক কিছু? নাকি এটা ক্লান্তির প্রতীক? নাকি বয়স বেড়ে চলা শহরে বর্ষা নামতে চাইছে না আর কিছুতেই? বাড়ি ফিরে এসে বিছানায় দুম করে শরীর ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে আজকাল। ঘুমের দিকে পতন ঝুঁকে থাকে। এমন এক ক্লান্ত হয়ে যাওয়া শহরের একলা এক ঘর অযৌন হয়ে থাকে। এই যে শীঘ্র পতন, এও এক নিয়তির রেশ যেন। ঝড়ের কাছে বারংবার আঘাত পেতে পেতে এক সময় খুব তাড়াতাড়ি যেভাবে ভেঙে পড়ে গাছ, সেরকম। এসব লেখা দেখলে নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে। আমাদের সবার জীবনেই তো কিছু কমন ঘটনা থাকে। সেই কারণেই “আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই, বহুবার… ভেবেছি ক্ষরণ/ ভেবেছি, ব্যবহারযোগ্যতা না থাকলে/ সব মানুষই কেমন সচরাচর আসবাব হয়ে ওঠে”। এসব পড়ার পর আর কিছুই বলার থাকে না। এসব বোধ ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। অনেকটা গভীরে নেমে নিজের শিকড়কে না দেখলে এসব লাইন লেখা যায় না। প্রশান্ত যে অনেকটাই গভীরে ঢোকার প্রয়াস করেছে সেটা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। ওর বই আরও পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। ও তো নিজেই লিখেছে “পাতাদের সাথে পাথরের/ বন্ধুতা হোক, কিছুটা শহর বরং/ হেঁটে আসুক… পায়েদের প্রতিটা অক্ষরে” আমিও তাই চাই। পায়ের পঙক্তিতে ঘুরে বেড়াক কলোনি কলকাতা।

বইয়ের নাম- কলোনি কলকাতা। কবি- প্রশান্ত সরকার। প্রকাশক- হাওয়াকল। মূল্য- ১৬৫ টাকা

 

৪.

শহরে বসবাস করতে আমাদের কারও কারও দেখার চোখগুলো ক্লান্ত হয়ে গেলে আমরা বেড়াতে যাই। কেউ পাহাড়। কেউ সমুদ্র। কেউ রিল্যাক্স করতে। কেউ কিছু এক্সপ্লোর করতে। কেউ ঘুমোতে। কেউ জেগে উঠতে। কবিতাও তেমন। তন্ময়ের কবিতার কাছে যেতে ইচ্ছে করে জেগে উঠতে। ও লিখেছে, “দ্বন্দ্ব থেকে উঠে আসা প্রাণ, তোমাকে আমি রেখে যাচ্ছি মানে কিন্তু এই নয়, ফিরে আসব। দুটি আয়ুষ্কাল গেল। তিনটি। চারটি। আমি গুহা সামলে ঘর খুঁজতে শিখিনি। নইলে এত হ্রীং ক্লীং বেদভাষা স্বভাবে নিতাম; শুধু জপ করে পাওয়া যায় না জেনেছি বলেই এই ছেড়ে যাওয়া-” মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে এই অনুভবে পৌঁছে যাওয়া কম কথা নয়। এই যে কথা, শুধু জপ করে পাওয়া যায় না। এর মানে কী? এর মানে তো আসলে পুথিগত জ্ঞান আমাদের নিয়ে যেতে পারে না প্রকৃত সত্যে। বড়জোর পথ দেখায়। বড়জোর শিখিয়ে দেয় কোন পদ্ধতিতে খুঁজতে হবে। তার বেশি কিছু নয়। তন্ময়ের অন্য সব বইয়ের মতোই ‘বেইমানির যা-কিছু চিরাগ’ বইটিও সত্যের সন্ধান করছে। তবে পুথিগত দিক দিয়ে নয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিজেকে খুঁজছে। আসলে মনেপ্রাণে যারা ভিড়-বিমুখ হয়, স্রোতের উল্টোদিকে হেঁটে চলা মানুষ হয় তারা লিখে ফেলে “এখনও সময় আছে, সব ত্রাণ ছাপিয়ে আমার/ সীমানা ভাঙুন…” দূরে যেতে মানুষ বিপ্লবী হয়ে ওঠে। প্রেমে ফিরে আসতে চেয়েও তাই হয়। সে তখন লেখে, “ও-আলো আমার চাই, যেমন তোমাকে, বাতিদান/ যত সন্ধ্যা হয়ে ওঠো তত পাই ছায়ারও প্রমাণ”। এই যে আলো পেতে চেয়ে একরোখা হয়ে যাওয়া, এই যে মনের চোখ দিয়ে দেখতে পাওয়া সন্ধার বুকে ফুটে উঠেছে ছায়ার প্রমাণ, এও কি বিপ্লব নয়? একাত্মবোধের চেয়ে মায়াবী অরূপরতন আর কী’ইবা থাকে জীবনে! সেই অরূপরতন কেউ হারাতে চায় না। তেমন কোনও সম্ভাবনা তৈরি হলে সন্দেহ জন্ম নেয়। মনে হয়, এসব হারিয়ে গেলে নিজেকেও হারিয়ে ফেলতে হবে। একটি কবিতায় আমি সেই অসহায়তার আভাস পাই, “আমাকে ঠকিয়ে আজ সূর্যাস্তে বসেছে পাখিটি/ কমলা রঙের গান ধুয়ে দিচ্ছে পাপের চেহারা… আমি ব্যাধ। আমি বিদ্ধ। আজানুলম্বিত পরিবারে/ সময়ে হয়েছে, আর থাকাও যাবে না তাকে ছাড়া”। বিদ্ধ তো আমরা সবাই। নিজের নিজের জীবনের আলাদা আলাদা ঘটনায় বিদ্ধ। ক্ষত হয়ে আছে আমাদের অলংকার। রক্ত বেরোয়, আমরা ভাবি, এই যে রক্ত এই যে শোক, এও তো আমাকে নিয়ে যাচ্ছে নিজের কাছেই। এই আঘাতও আপন। একে ছেড়েও কি আমরা থাকতে পারি? পারি না তো। ‘রং-বেরং’ নামের একটা কবিতায় তন্ময় লিখেছে “একের পর এক বিষ/ জমে জমে ভরেছে শরীর/ বের করে দিতে হলে/ নিজেকে বেরিয়ে যেতে হয়” তাই ভিতরে ভিতরে রাগ হয়। সেই চাপা রাগ, ছাই চাপা রাগ উষ্ণ করে রেখেছে এই বইটিকে। ঝলসে যাওয়ার বদলে জীবন কবিতা লেখে, বলে, “অনন্ত নক্ষত্র থেকে নেমে আসা অভিশাপ জিভের ডগায় খেলিয়ে নেব একবার। ‘মর’।” এসব রাগ আসলে অসহায়তা। এসব রাগ আসলে প্রেম। গোটা বইটা পড়ে আমার খুব ভালোবাসার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। আমি দেখি মায়াচিহ্ন ফুটে আছে গোটা চরাচর জুড়ে। দূরে, খুব দূরে ছায়া নড়াচড়া করছে। আলো ফেলতে ভয় হয়। যদি ভুল করে নিজেকে দেখে ফেলি?

বইয়ের নাম- বেইমানির যা-কিছু চিরাগ। কবি- তন্ময় ভট্টাচার্য। প্রকাশক- মাস্তুল। মূল্য- ১১০ টাকা

 

৫.

অভিজ্ঞতা আমাদের সংযমী হতে শেখায়। অভিজ্ঞতা বলে, কম কথায় যে সেতু গড়ে ওঠে তার প্রতি নদী সারাদিন হাসি ছুঁড়ে দেয়। সেই নদীর ওপর দিয়ে কত জল বয়ে যায়। সেতু সব খেয়াল রাখে। এই যে পরস্পরের প্রতি চেয়ে থাকা, এও জীবনের এক মহার্ঘ্য দিক। সত্যিই কি তাই? এই যে নদী দূর থেকে দেখছে, এই যে দূর থেকে ঝুলে রয়েছে সেতু, এটা তো স্পর্শ করা নয়। জীবন কি তবে দূর থেকে দেখার জিনিস? কাছাকাছি গেলে সেতুর ভেসে যেতে পারে। প্রথম দশকের উজ্জ্বল কবি মনোজ দে লিখেছে “এ সমস্ত অভিযোগ দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে, শোনো/ আমাদের দিন কাটে নিজেদের প্রমাণ করায়” মনোজের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, ওর দেখা বেশি, কথা কম। যেটুকু কথা বললে তা কবিতা হয়ে ওঠে তার চেয়ে একটাও বেশি শব্দ লিখতে তার অনীহা। টুকরো টুকরো দৃশ্য, টুকরো টুকরো ভাবনাকে মনোজ সেলাই করে দেয় নিপুণ দক্ষতায়। তা সত্ত্বেও সেলাইয়ের জায়গাটা উঁচু হয়ে থাকে। মেলে না। সেলাই তার প্রমাণ রাখতে ছাড়েনা কখনও। ও নিজের লেখাতেই আছে “প্রিয় সেলাই মেশিন/ আমরা দাগগুলো দেখি/ উঁচু হয়ে থাকাটুকু/ তোমার অমসৃণতা।” এই অমসৃণতা কীসের প্রতীক? এগুলো সন্ধির প্রতীক। সন্ধি মানে আপোষ নয়, সন্ধি মানে মিলন। রোদের সঙ্গে জ্যোৎস্নার মিলন। এমন মিলনের অমসৃণ। উঁচু নীচু ঢেউয়ের মতো আমাদের ভাসিয়ে রাখে। এমন মিলনের পরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ঠিক তখনই ছোঁয়াচে সব কবিতা লিখতে শুরু করে মনোজ, “ঘুমিয়ে যাওয়ার পর কেউ জানল না অথচ/ শুরু হয় নিঃশব্দ ভ্রমণ। নিষেধের অলিগলি/ প্রিয় হয়ে ওঠে। নীচু আলো। লিপস্টিক।/ নিশাচর বাড়ি। অদ্ভুতরকম তার বিজ্ঞাপন/ তুমি সানাই নামিয়ে রাখলে/ আমার যৌনতা মনে হয়।” এসব লেখা পড়লে বুঝতে অসুবিধে হয় না, প্রতিটি যৌনতা যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার পথ। বলা ভালো, নিজেকে খোঁড়ার পথ। নিজের মনেই গুণ গুণ করে উঠি আমি, মনোজের কবিতা পড়ে। প্রেমে পড়ে যাই এমন সংযমী এবং গভীর কলমের। পাতা উলটে দেখি, মনোজও প্রেমে পড়েছে। লিখে ফেলেছে ‘সংগীত মিডিয়াম’ নামক অপার্থিব সিরিজ। লিখেছে “স্কুলে যায়নি/ ভাষাজ্ঞান স্পষ্ট নয়/ শুধু তুমি রেওয়াজে বসলেই/ বাকি পৃথিবী বধির মনে হয়” আমি স্তব্ধ-কলম যাই। এমন সুরের কাছে কলম চালানোর সাহস নেই আমার। পরের অংশটুকু পড়ি, “যেন সে অঞ্জলি দেবে/ ফুল নেই। স্তোত্র নেই/ শুধু জানে/ বিকেল পাঁচটায়/ রেওয়াজ। নির্ঘণ্ট।” মন ফুরফুর করে ওঠে। হাওয়া দেয় ভিতরের দরজা জানলা জুড়ে। সেই ফাঁকে মনোজকে লিখে রাখতে দেখি, “যে কোনো বৃষ্টির পর/ অসম্ভব নির্জনতা আসে/ আলো নেই। দীর্ঘ গাছ/ ঝরে যায় স্নান করা জল/ ভেজা চুল স্পর্শ করলে/ মনে পড়ে নীল শাড়িটির কথা/ সম্মতির অভাবে যে গৃহপালিত হয়েছে” কিছু বলার থাকে না। ভিজে হয়ে আসা বিকেলবেলায় অফিসের জানলার কাচ দিয়ে দেখি দূরে আকাশে ক্রেন ভাসছে বড় বাড়ির মাথায়। মনটা কেমন আবছা হয়ে আসে। কারা যেন ঢুকে পড়ে মনের রাস্তায়। ফিরে আসি আবার কবিতার কাছে- “চোরাগোপ্তার সাম্রাজ্য কীভাবে আমাকে/ গ্রহণ করেছে বলো? সেই স্বপ্ন মুছি/ আমাদের দোষ লাগে সিঁদুর অভাবে/ মুছে দাও। যাদু হও। এঁটো হওয়া রুচি” এখানে এঁটো শব্দটা পড়ে খটকা লাগে আমার। এটা লেখার দরকার ছিল কি? অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করা যেত না? তারপর ভাবি, এঁটো মানে অশুচি কেন হবে? কেন ভাবছি এরকম? এঁটো মানে তো খেতে বসে অথবা খেয়ে উঠে যাওয়া। খাওয়ার থেকে পবিত্র আর কী হতে পারে! আমি চেটেপুটে খেতে থাকি মনোজের কবিতা। আমার পরবর্তী প্রজন্মের এই কবি আমাকে বুঁদ করে রাখে। পাঠক হিসেবে আমার মন যে চোরাগোপ্তা সাম্রাজ্য, তা গ্রহণ করে মনোজের কবিতাকে। আর বিবাহ? পাঠক আর কবির বিবাহে রচিত হয় জাদুবাস্তব। রচিত হয় এমন একটা আয়না, যেদিক তাকালে অন্য কাউকে দেখতে পাই। অনেকটা আমার মতোই। অনেকটাই আমার মতো নয়।

বইয়ের নাম- শরীরে সংগীত রেখো। কবি- মনোজ দে। প্রকাশক- তবুও প্রয়াস। মূল্য- ১১০ টাকা

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment