নবব্রত ঘোষাল

নিউটন – ৮

 

নিউটনের অ্যালকেমি চর্চা  

১৬৭০-এর দশক। নিউটনের আলোর নতুন থিয়োরি ঘিরে ক্রমশ বাড়ছে জল্পনা, ইউরোপের বিজ্ঞানীরা নিঃসংশয় হতে পারছেন না। তাঁদের তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ কেমব্রিজের তরুণ বিজ্ঞানী। রয়্যাল সোসাইটির জার্নাল, ফিলজফিক্যাল ট্রানজাকশন-এ প্রকাশ পাচ্ছে সেসব সমালোচনা পত্র। সোসাইটির সেক্রেটারি হেনরি ওল্ডেনবার্গকে একের-পর-এক পত্র পাঠিয়ে নিজের তত্ত্বের স্বপক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন নিউটন। আবার কখনো-বা ক্ষোভে অভিমানে ভাবছেন আর কখনোই তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ্যে আনবেন না। এমন-কি র‍য়্যাল-সোসাইটির সদস্য পদ ত্যাগ করার কথাও জানাচ্ছেন ওল্ডেনবার্গকে। 

এরকমই এক সময় ওল্ডেনবার্গকে লেখা এক চিঠিতে (২১ শে সেপ্টেম্বর, ১৬৭২) নিউটন জানালেন – ‘…এই মুহূর্তে অন্য কাজে সম্পূর্ণ নিয়োজিত থাকায় আমি বাধ্য হয়েছি আলোক সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলি সরিয়ে রাখতে এবং আমি জানি না আবার কবে এগুলি নিয়ে বসতে পারবো।’

‘অন্য কাজ’ (‘some other business’) বলতে নিউটন কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? বছর দুই আগেই  ট্রিনিটিতে গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর হয়েছেন। তবে কি তিনি লেকচার প্রস্তুতিতে ভীষণরকম ব্যস্ত ছিলেন ওই সময়? ‘অপটিক্যাল লেকচার্স’-এর যে চারটি সেট কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে জমা দিয়েছিলেন সেজন্য নিশ্চিতভাবেই তাঁকে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য আলোর পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার মানুষ তো তিনি নন। আর ওই কালটিতে ইউনিভার্সিটির অপর কোনো কাজেও যে বিশেষ যুক্ত ছিলেন এমন কোনো তথ্যও মেলে না। তাহলে কি গণিত চর্চাই ছিল তাঁর সেই ‘অন্য কাজ’ যার জন্য বহির্বিশ্ব হতে বিযুক্ত হতে চান তিনি? একান্তে নিমগ্ন থাকতে চান গণিতের আরাধনায়? না, তাও নয়। কারণ, ১৬৭৬-এ জার্মান দার্শনিক ও গণিতবিদ গটফ্রিড লাইবনিতৎজ-কে লেখা একখানি চিঠিতে নিউটন লিখেছেন – ‘আমি এখন অন্য ভাবনায় এতটাই নিমগ্ন যে এই বিষয়গুলি (গণিত সংক্রান্ত) বিবেচনায় আনা আমার কাছে একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়।’ 

গণিত যাঁর শিরায় উপশিরায়, সেই তিনি, হঠাৎ গণিতের আলোচনায় কেন এত বিরক্ত? তাহলে কি যুবকটি নতুনতর কোনও সত্যের অনুধ্যানে আবারো মেতেছেন?  

নিউটনের জীবদ্দশায় গুটিকয় মানুষই কেবলমাত্র জানতেন সেই ‘অন্য কাজ’-এর কথা, সতের শতকে যে চর্চা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শাস্তি যোগ্য অপরাধ। কারাবাস নিশ্চিত, এমনকি হতে পারে মৃত্যুদন্ডও। তরুণ নিউটন কি জানতেন এই বিপদের কথা? সমস্ত জেনেশুনেও কি জড়িয়ে পরেছিলেন কোনো এক নিষিদ্ধবিদ্যার মায়াবী আকর্ষণে? 

নিউটনের মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পর কিছুটা আকস্মিকভাবেই উন্মোচিত হয় এক সত্য। ১৯৩৬ সালে নিউটনের এক উত্তরসূরি, সে-যাবৎ কাল পর্যন্ত অপ্রকাশিত ও যেগুলি নিউটন তাঁর জীবদ্দশায় নিজের কাছে আগলে রেখেছিলেন, সেই সব বিপুল পরিমাণ কাগজপত্র ও পান্ডুলিপি, লন্ডনের এক নিলাম হাউজ, সদেবিজ (Sotheby’s) মারফত নিলামে তোলেন। কিন্তু সেসময় ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইংল্যান্ডও। ফলে নিলামে আশানুরূপ উৎসাহ লক্ষ্য করা গেল না। শুধুমাত্র দুই ব্যক্তি নিউটনের সেই ব্যক্তিগত কাগজপত্রের গুরুত্ব বুঝলেন। জহুরি জহর চেনেন। নিলামের সিংহভাগ কিনে নিলেন তাঁরাই। 

এঁদের একজন, ইংল্যান্ডের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস্‌, আর অপরজন আব্রাহাম ইয়াহুদা। জেরুজালেমের ইহুদি বংশোদ্ভূত এই শেষোক্ত ভদ্রলোক ছিলেন প্রাচীন-নথি সংগ্রাহক। মূলত থিয়োলজি অর্থাৎ ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক পেপারগুলি কিনলেন ইয়াহুদা। 

আর কেইন্‌স যেগুলি সংগ্রহ করলেন সেগুলি বিজ্ঞান বিষয়ক বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল তাঁর। নিলামে কেনা সেই বিপুল পরিমাণ সায়েন্টিফিক পেপার খুঁটিয়ে দেখে খোঁজ পান এক অন্য নিউটনের। অবাক হন কেইন্‌স*।       

কোথায় সেই মহান বিজ্ঞানী যিনি গণিতের নিবিড় সাধক ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ হিসাবে পরিচিত এতকাল? অতীব গোপনে কীসের সাধনায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বহু মূল্যবান বছরগুলি! নিলামে কেনা কাগজ-পত্র, পান্ডুলিপি পড়ে কেইনস্‌ বুঝলেন মহান বিজ্ঞানী তাঁর জীবনের এক বড় অধ্যায় কাটিয়েছেন অ্যালকেমি চর্চায়। হ্যাঁ, অ্যালকেমি – অতি প্রাচীন সেই বিদ্যা, তান্ত্রিক কিমিয়া রূপে যার সূত্রপাত পাশ্চাত্যে প্রায় দু হাজার বছর আগে। 

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অ্যালকেমি গবেষণা শুরু হয় অবশ্য অনেক পরে। একাদশ শতাব্দীতে। ইউরোপিয় অ্যালকেমি চর্চার ভিত্তি ছিল গ্রেকো-মিশরিয় তথা আরব্য কিমিয়া।        

অ্যালকেমিস্টরা বিশ্বাস করতেন, লোহা, সীসা বা তামার মতো ‘নিকৃষ্ট’ ধাতুদের সোনায় রূপান্তরিত করা সম্ভব। আর তার জন্য চাই “ফিলোজফার্স স্টোন” বা পরশমণি, যা একবার সৃষ্টি করতে পারলে অর্জন করা যাবে সেই অলৌকিক ক্ষমতা যার দ্বারা হয়ে ওঠা যাবে বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রক, ‘নিকৃষ্ট’ ধাতুকে রূপান্তরিত করা যাবে সোনায়, লাভ করা যাবে অটুট স্বাস্থ্য-যৌবন, এমনকি অমরত্ব। তবে হ্যাঁ, যে-কেউ এই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন না। 

অ্যালকেমিস্টদের বিশ্বাস, এই পরশমণি আসলে, ‘‘donum dei’ অর্থাৎ “gift of God” – ঈশ্বরের দান। সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই কেবলমাত্র কোনো ব্যক্তি লাভ করতে পারেন বহু কাঙ্ক্ষিত এই “ফিলোজফার্স স্টোন”। “ফিলোজফার্স স্টোন”-এর অধিকারী যিনি তিনি “এডেপ্ট” (“adept”) রূপে পূজিত হন অ্যালকেমি চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গের কাছে। তবে অ্যালকেমিস্ট মহলের বাইরের দুনিয়ায় সে খবর ফাঁস হলে বিপদ হতে পারে বিশেষ ক্ষমতাধিকারী “এডেপ্ট”দের। লোহা বা তামার খন্ডকে সোনায় পরিণত করে ফেলতে পারেন যিনি তাঁর জীবন যে বিপদ সঙ্কুল, কাঁটায় ভরা, সে কথা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। তাই গোপনীয়তা রক্ষা ছিল অ্যালকেমিস্টদের প্রাথমিক শর্ত। আরও একটা কারণ ছিল যে জন্য অত্যন্ত গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই সাধনা চালাতেন তাঁরা। অসাধু ব্যক্তি অথবা নিম্ন মেধার কেউ যাতে এই চর্চায় সামিল হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। এ-প্রকার মানুষদের হাতে পরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই তান্ত্রিক সাধনা। আর তারই জন্য নানা প্রকারের সাংকেতিক চিহ্ন ও ধাঁধাপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন অ্যালকেমিস্টরা। 

 

মধ্যযুগের প্রথম ভাগে ইউরোপে একাধিক অ্যালকেমিস্ট নিজেকে “এডেপ্ট” বলে জাহির করেন। ছদ্মনামেই পরিচিত তাঁরা। ষোল এবং সতের শতকে “এডেপ্ট”দের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। প্রত্যেকেরই দাবী, তাঁর হাতে আছে ম্যাজিকাল “ফিলোজফার্স স্টোন” অর্থাৎ পরশমণি যার ছোঁয়ায়, লোহা বা তামা বনে যাবে সোনা। আর রয়েছে আয়ুবর্ধক “ইলিক্সর্‌” (“elixir”) –  সর্বরোগহর মহৌষধ। অনেক রাজা এই স্বঘোষিত “এডেপ্ট”দের ঠাঁই দিলেন তাঁদের রাজদরবারে। বলা বাহুল্য এদের সকলেই প্রতারক। তামা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুর মিশ্রণে অবিকল সোনার মতো দেখতে সংকর ধাতু তৈরি করে অনেকে ঠকালেন রাজাকে। প্রতারণায় ধরা পরে কঠোর সাজাও পেলেন। সেই কালে, অনেক দেশেই এই প্রকার প্রতারকদের প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মৃত্যু দন্ড দেওয়াই ছিল দস্তুর। ‘বিশুদ্ধ’ অ্যালকেমিস্টদের বিচারে এঁরা সব পথভ্রষ্ট সাধক। ‘প্রকৃত’ “এডেপ্ট”, কখনই নিজের পরিচয় এবং তাঁর বিশেষ ক্ষমতার কথা সাধারণের কাছে প্রকাশ করেন না। এই ছিল অ্যালকেমিস্টদের বিশ্বাস।   

ঠিক যে বছর নিউটন লুকাসিয়ান প্রফেসর হলেন সেই বছরই অর্থাৎ ১৬৬৯-এ, নিউটনের একটি নোটবুকে (Fitzwilliam Notebook) দেখা যায়, লন্ডন থেকে তিনি কিনে এনেছেন দুটি ফার্নেস, হরেক রকম রাসায়নিক পদার্থ, কাচের যন্ত্রপাতি, আর সেই সঙ্গে অ্যালকেমি বিষয়ক ছ-খন্ডের বৃহৎ আকারের বই, “থিয়েট্রাম কেমিকাম”। এরপর ট্রিনিটির বাসগৃহে গড়ে তুললেন রসায়নের পরীক্ষাগার। উপযুক্ত ফার্নেসও বসালেন। এই ফার্নেস বা চুল্লীতে একটানা উচ্চ উষ্ণতায় তপ্ত করে ধাতুদের গলিয়ে তরল করে ফেলা সম্ভব। অ্যালকেমিস্টদের ভাষায় এই ফার্নেসের নাম “অ্যাথানর”। আহার নিদ্রা ভুলে শুরু হল নতুন গবেষণা। গ্রান্থামের সেই মডেল প্রস্তুতকারক হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর অ্যালকেমিস্ট। 

এই যে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, আহার নিদ্রা ভুলে অ্যালকেমি চর্চায় ডুবে গেলেন নিউটন, তার চালিকা শক্তি কি হতে পারে? নিকৃষ্ট ধাতুর স্বর্ণে রূপান্তরণ অথবা সুদীর্ঘ জীবনলাভ – এসবই কি ছিল তাঁর  প্রেরণা? নিউটনের বিখ্যাত জীবনিকার, রিচার্ড ওয়েস্টফলের মতে, এগুলির কোনওটিই নয়। “ট্রুথ” – সত্য, সত্যের অনুসন্ধানই ছিল সেই চালিকা শক্তি। অ্যালকেমি চর্চার পথিকৃৎ সব ব্যক্তিত্ব, যাঁদের দ্বারা নিউটন প্রভাবিত, যাঁদেরকে “এডেপ্ট” রূপে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের সকলের কাছেই সত্যের সাধনাই ছিল মুখ্য। অন্তত নিউটনের বিশ্বাস তেমনই। “থিয়েট্রাম কেমিকাম” এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে, “এডেপ্ট”দের অর্জিত ক্ষমতার সর্ব নিম্নস্তরে রয়েছে সোনা প্রস্তুতি। আর একটি বই থেকে নিউটন যে নোট লিখেছেন সেখানেও রয়েছে একই কথা – অজ্ঞ ইতর বর্গের যে ধারণা, ধাতু নিয়ে কাজকারবারই অ্যালকেমিস্টদের প্রধান কাজ, মোটেও তা সঠিক নয়। বরং, নৈতিক উন্নতি সাধনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর উপলব্ধি ও তাঁর ক্রিয়া কলাপ বোঝাই হল মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এই বিশ্ব প্রকৃতি ঠিক কিভাবে কাজ করে তা জানা। এই সাধনার অপর লক্ষ্য প্রকৃত মহৌষধের সন্ধান, যার দ্বারা জীবকুল হবে উপকৃত, মহিমান্বিত হবেন ঈশ্বর।  

অ্যালকেমি বিদ্যায় সদ্য দীক্ষিত নিউটন এই শাস্ত্রীয় দর্শনে গভীরভাবে প্রভাবিত। তাঁর স্থির বিশ্বাস, ঈশ্বরের কৃপাধন্য তিনি। সূর্যালোক যে বিশুদ্ধ নয়, বহু বর্ণের সমষ্টি – এ-সত্য তো তাঁর মাধ্যমেই উন্মোচিত হয়েছে। তিনি “এডেপ্ট” হয়ে উঠবেন ঠিকই একদিন। কিন্তু ভয়ংকর কঠিন এই হয়ে ওঠা। সুবিখ্যাত ডাচ রসায়নবিদ জোয়ান ব্যাপ্টিস্ট ভন হেলমন্ট-এর সাবধান বাণী শুনেছেন তিনি – ‘the art could only be bought with sweat, the product of intense labor”। অনেক ঘাম ঝরিয়ে, কঠোর পরিশ্রমের দ্বারাই শুধুমাত্র আয়ত্ত  করা সম্ভব এই বিদ্যা। 

ঈশ্বরের অনুগ্রহেই যে তিনি এই বিদ্যালাভের যোগ্য ব্যক্তি এ-বিশ্বাসে নিঃসংশয় ছিলেন নিউটন। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, তাঁর অ্যালকেমি চর্চায় ঐশ্বরিক ভাবনার যোগ নেই কোথাও। সেখানে তিনি আধুনিক অর্থেই একজন গবেষক। অ্যালকেমি বিশারদদের বই পত্র পড়ে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন রাসায়নিক পরীক্ষার সঠিক ধাপ। এই ধারায় প্রচলিত সাংকেতিক ভাষার অর্থোদ্ধার করেছেন নিজের মতো করে। আর সব অ্যালকেমিস্টদের থেকে এখানে তিনি অবশ্যই পৃথক। বিখ্যাত পোলিশ অ্যালকেমিস্ট, মাইকেল সেনডিভোজিয়াস-এর ‘নোভাম লুমেন কেমিকাম’ বইটি থেকে নোট নেওয়ার সময় নিউটন এই বইয়ে উল্লেখিত,  “From one two arise, from two one. One is God, the son was born from this God: One has given two, two gave one holy spirit.” – এই অংশটির অর্থোদ্ধার করতে গিয়ে “God”, “son” ও “holy-spirit”-এই তিন শব্দের স্থলে যথাক্রমে বসালেন তিনটি পদার্থের নাম – “mercury”, “gold” ও “philosophers’ stone”। অর্থাৎ সেনডিভোজিয়াস-এর এই যে অংশটির কথা  এখানে বলা হল, নিউটন তাঁর রাসায়নিক গবেষণার উপযোগী করে সারবস্তুটুকু লিখে রাখলেন – পারদ বিপাকীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে স্বর্ণের জন্ম দেয়, পারদ ও স্বর্ণ একত্রে, বিপাকীয় ক্রিয়ায় সৃষ্টি করে “ফিলোজফার্স স্টোন”।

ঠিক কবে থেকে “কিমিস্ট্রি”-র প্রতি আকৃষ্ট হলেন নিউটন? সতের শতকের ইউরোপে রসায়ন ও অপরসায়নের মধ্যে স্পষ্ট কোনো বিভেদ রেখা ছিল না। একত্রে “কিমিস্ট্রি” (“Chymistry”) নামেই এই শাখাটি পরিচিত তখন।  

গ্রান্থামের ওষুধ ব্যবসায়ী উইলিয়াম ক্লার্ক-এর বাড়িতে থাকাকালীন জন বেট-এর ‘দ্য মিস্ট্রিজ অব নেচার অ্যান্ড আর্ট’ বইটি, বলতে গেলে, কাছ-ছাড়া করতেন না নিউটন। নিউটন তখন কিংস স্কুলের ছাত্র। বেট-এর বই থেকে নানান রকমের আকর্ষণীয় মেক্যানিকাল মডেল বানানোর কৌশল শিখেছিলেন। সেই সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে কিভাবে রঙ প্রস্তুত করতে হয়, আতশবাজি তৈরি করতে হয়, গিল্ড করতে হয় – রপ্ত করেছিলেন সেসবও। একটি ছোট নোটবুকে লিখে রেখেছিলেন প্রয়োজনীয় ফর্মুলা। বেট-এর বই থেকে চুনজল, ফটকিরি-জল, গঁদের আঠা ইত্যাদির সহজ প্রস্তুত প্রণালীরও উল্লেখ আছে নোটবুকটিতে। 

ওই সময় আর একখানি বই (“Mathematical Magick”) নিউটন পড়েন। তা থেকে বেশ কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্যের আশ্চর্য প্রয়োগের বিবরণ নোটবুকে লিখে রাখেন। বইটির লেখক সেকালের বিখ্যাত প্রকৃতি দার্শনিক জন উইলকিন্স। লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকায় ছিলেন এই ভদ্রলোকউইলকিন্স-এর বই থেকে নিউটন তাঁর নোটবুকে যে অংশটি লিখে রেখেছেন তা বড়ই আকর্ষণীয়। তাঁর বইয়ে উইলকিন্স অবিরাম গতি সৃষ্টির পদ্ধতি বাতলেছেন – “কুইক সিলভার” (অর্থাৎ পারদ), টিন ও এক প্রকার উদ্বায়ী পদার্থ, মারকিউরিক ক্লোরাইড-এর মিশ্রণকে ঊর্ধপাতিত করে অবিরাম গতি পাওয়া যাবে। অবিরাম গতি সৃষ্টির এই রেসিপি নোটবুকে কপি করেছেন নিউটন। 

উইলকিন্স-এর বইয়ে আর এক ধরণের আশ্চর্য প্রদীপ (“perpetual lamp”)-এর কথা বলা হয়েছে যা নাকি কয়েক-শো বছর অবিরাম আলো দানে সক্ষম। এই আশ্চর্য প্রদীপের পলতে কিভাবে প্রস্তুত করতে হবে, এর জ্বালানী তেল কোন পদ্ধতিতে খনিজ পদার্থ থেকে আহরণ করতে হবে সেসবের বিশদ বিবরণ লিখে রেখেছেন নিউটন তাঁর নোটবুকে। একটি বিষয় স্পষ্ট, গ্রান্থামের কিংস স্কুলে পড়ার সময়ই রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন নিউটন।  

সে কালের বিচারে, উচ্চ পর্যায়ের “কিমিস্ট্রি” বলতে যা বোঝায় তার চর্চা, অ্যালকেমি গবেষণায় সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় নিউটনের। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে যখন তিনি আন্ডার গ্র্যাজ্যুয়েট স্তরের ছাত্র, অর্থাৎ ১৬৬৪-৬৫ সাল নাগাদ, সেই সময় রবার্ট বয়েলের প্রাকৃতিক দর্শন বিষয়ক বইপত্র যেখানে,  কেমিক্যাল ফিলজফি ও মেকানিক্যাল ফিলজফি একসাথে আলোচিত হয়েছে, তার সাথে পরিচিত হন নিউটন। একটি নোটবুকে (MS Add. 3996) বয়েলের লেখা সব বই থেকে বিভিন্ন বিষয় কপি করে রেখেছেন। এই সেই নোটবুক যার মধ্যে তিনি ‘কয়েকটি দার্শনিক প্রশ্ন’ (‘Certain Philosophical Questions’) লিপিবদ্ধ করেছিলেন। 

বয়েলের বইয়ে রসায়নের যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার বিবরণ রয়েছে, তা পড়ে তরুণ নিউটনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বয়েল একবারে প্রথম সারির একজন রসায়নবিদ। কিন্তু সেই মুহূর্তে নিউটন যা জানতে পারলেন না তা হল, রবার্ট বয়েল নিজেই একজন অ্যালকেমিস্ট। গোপনে অ্যালকেমিস্টদের যে র‍্যাকেট রয়েছে সেখানে তিনি মিস্টার বি নামে পরিচিত। 

১৬৬৬-তে রবার্ট বয়েলের একখানি বই (‘Origin of Forms and Qualities’) প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই নিউটন তা পড়ে ফেলেন। এই বইটি ছাড়াও রসায়ন সংক্রান্ত তাঁর দ্বিতীয় পর্বের পড়া আর একটি বই-এর লেখকের নাম জানা যায়নি। লেখকের নাম বিহীন এই গ্রন্থটি (‘Treatise of Chymistry’) থেকে এবং বয়েলের লেখাপত্র থেকে নিউটন তাঁর মতো করে ‘কিমিক্যাল’ শব্দকোষ (‘Index Chemicus’) গড়ে তুললেন। ধাতুর রূপান্তরের বিষয় এই শব্দকোষেই সর্বপ্রথম উল্লেখ করতে দেখা গেল নিউটনকে।  

সরাসরি অ্যালকেমি বিষয়ক বই পড়ার সূত্রপাত ১৬৬৯-এ। Fitzwilliam Notebook-এর পাতা ওল্টালে দেখা যায়, ওই বছরের এপ্রিল মাসে নিউটন লন্ডন থেকে কিনে এনেছেন “থিয়েট্রাম কেমিকাম”। ছ-খন্ডের বৃহৎ আয়তনের এই সংগ্রহে রয়েছে মূলত মধ্যযুগের ও সমকালীন অ্যালকেমিবিদদের লেখাপত্র। ল্যাটিন ভাষায় রচিত হয়েছে গ্রন্থটি। ১৬৬৯-এ প্রকাশিত বয়েলের অপর একটি বইয়ের (‘Certain Physiological Essays’) দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে বিভিন্ন ধাতুদের মূলে যে ‘বীজ-পদার্থ’ রয়েছে তা পৃথক করার পরীক্ষা পদ্ধতি লিখলেন তাঁর কেমিক্যাল নোটবুকে (CU Add 3975)। এর আগে এই নোটবুকেই তাঁর নতুন আলোক তত্ত্ব লিপিবদ্ধ করেছিলেন নিউটন। বোঝা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে “কিমিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট”-এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন যুবকটি।  

শুধুমাত্র রবার্ট বয়েল নন, একে-একে নিউটন চিনলেন দেশ-বিদেশের সব অ্যালকেমি পণ্ডিতদের। বলা বাহুল্য, এই পরিচয়ের সমস্তটাই হয়েছে এঁদের লেখা নানা বইপত্র পাঠের মারফত। যাঁদের তত্ত্ব ট্রিনিটির সদ্য দীক্ষিত অ্যালকেমিস্ট-এর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলল তাঁরা হলেন, পোলিশ অ্যালকেমিস্ট মাইকেল সেনডিভোজিয়াস, তিন জার্মান ‘কিমিস্ট’, জোহান গ্র্যাসার্স, মন্টি স্নাইডার ও মাইকেল মাইয়ার্‌, এবং রয়েছেন ব্যাসিলিয়াস ভ্যালেন্টিনাস ও আইরেনিয়াস ফিলালেতিস – এই ছদ্মনামের দুই অ্যালকেমিস্ট। নিউটন পড়লেন এঁদের রচিত সব গ্রন্থ। অ্যালকেমি শাস্ত্রে কীসব সাংকেতিক ভাষা! সবুজ সিংহের রক্ত! আগুনে ড্রাগন! মার্কারির সাত ঈগল! বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, মঙ্গল-এসব গ্রহদের নিয়ে নানা ভুতুড়ে কথা! তার ওপর সকল গ্রন্থেই ছড়িয়ে আছে হাজারো সাংকেতিক চিহ্ন! এইসব দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষা, চিহ্নের অর্থোদ্ধার করতে সচেষ্ট হলেন প্রখর বুদ্ধি ও সুতীব্র কল্পনা শক্তির অধিকারী যুবক নিউটন। 

ষোল-সতের শতকে রচিত অ্যালকেমিস্টদের বইপত্র পড়ে নিউটনের যেন বিস্ময়ের সীমা রইল না। এতকাল তিনি ছিলেন “মেক্যানিকাল ফিলজফি” অর্থাৎ যান্ত্রিক দর্শনের সাধক। জড় নির্জীব প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপের অনুসন্ধানে ছিলেন মগ্ন। এখন যেন নতুন এক জগতের দরজা হাট হয়ে গেল চোখের সামনে। অ্যালকেমি শাস্ত্র মতে, এই পৃথিবী প্রাণহীন কোনো যন্ত্র নয়। নিউটন জানলেন, এর চেতনা আছে। আত্মা আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে সজীব এই ভূ-গোলক। নতুন এক তত্ত্বে (‘organismic theory’) ঘোরতর বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন নিউটন।

১৬৭০ থেকে ১৬৭৪ এই ক’বছর কাটল নিবিড় অধ্যয়নে। সেনডিভোজিয়াস ও জোহান গ্র্যাসার্স-এর মতো অনেক অ্যালকেমিস্ট-ই খনিজবিদ্যাতেও যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ফলে, তাঁদের দেওয়া তত্ত্বের প্রতি আস্থাশীল হলেন নিউটন। তিনি শুধু নিজের মতো করে, যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে, সাজিয়ে গুছিয়ে নিলেন তত্ত্বটিকে। লিখলেন দুই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ – যারা, ‘Of Natures obvious laws & processes in vegetation’ ও ‘Humores minerales’ – এই নামে পরিচিত।  

এই দুই গ্রন্থে, ধাতুদের জীবনচক্রের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন নবীন অ্যালকেমিস্ট। তাঁর ভাষায় – পৃথিবী এক “Great animall” বা সুবৃহৎ প্রাণী, যে তার চারপাশে পরিব্যাপ্ত ইথার মাধ্যমে শ্বাস নেয় ও সজীব থাকে। আর এই সজীব পৃথিবীর অভ্যন্তরে ধাতুদের জন্ম-মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া চলছে নিরন্তর। এই জীবনচক্র সচল রয়েছে দু-প্রকার ‘স্পিরিট’ বা প্রাণ-বস্তুর মাধ্যমে। সালফার (গন্ধক) ও মার্কারি (পারদ) এই দুই পদার্থের বাষ্পই হল সকল জীবজন্তু, গাছপালা, পাথর, লবণ ও ধাতুদের সেই প্রাণ-বস্তু। গন্ধক ও পারদ বাষ্পীভূত অবস্থায় পৃথিবীর উপর সতত বিচরণ করে ও বস্তুতে প্রাণ সঞ্চার করে।  

এই তত্ত্বে যে অংশটি তাঁর অ্যালকেমি চর্চায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুধাবন করলেন নিউটন তা হল, ধাতুদের পুনর্জন্ম প্রক্রিয়া। তিনি যেন হদিশ পেলেন বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই রাসায়নিক পন্থার যা এনে দেবে “ফিলোজফার্স স্টোন”। সম্ভব হবে ধাতুর রূপান্তরণ। ধাতুর এই পুনর্জন্মের তত্ত্বটি নিউটন নিজেই উপস্থাপন করলেন। তত্ত্বটি ভারী অদ্ভুত – পৃথিবীর অভ্যন্তরে এমন এক শক্তিশালী “সর্ব দ্রাবক” (“menstruum”) আছে যার ক্রিয়ায় ধাতু ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অতি সূক্ষ্ম কণায় বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। এরপর সেই ধাতুর কণারা খনিজ-জলে দ্রবীভূত হয়ে মাটির অসংখ্য ছিদ্র পথ ধরে পৌঁছে যায় ধরিত্রীর জঠরে। সেখানে তীব্র উত্তাপের প্রভাবে বাস্পীভূত হয়ে সৃষ্টি হয় “মেটাল স্পিরিট”, যা পৃথিবীর উপর স্তরে ফিরে আসে। আর ফিরে আসার পথে খনিজ জলে দ্রবীভূত ধাতুর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণাদের সাথে মিলিত হয় অতি সক্রিয় এই “মেটাল স্পিরিট” এবং ওই কণাদের দুটি মৌলিক উপাদানে ভেঙ্গে দেয়। এই দুই মৌলিক উপাদান হল – সালফার ও মার্কারি। এদের মধ্যে মার্কারি উপাদান উদ্বায়ী, আর সালফার উপাদান অনুদ্বায়ী।   

 

এই পর্যন্ত লিখে নিউটন যেন ফিরে গেলেন অ্যালকেমিস্টদের প্রাচীন ধ্যান-ধারণায়। লিখলেন, মার্কারি ঈষৎ পঙ্গু (“wounded in the foot”) আর তাই, পরিপুষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ ধাতুর আকার পেতে পারে না বহুকাল। অপরদিকে দ্রবীভূত সালফার উপাদান পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে ফিরে যায় ও তাপীয় পাকে, ‘মেটালিক স্পিরিটের’ উপস্থিতিতে ধাতুর জন্ম দেয়। এই প্রক্রিয়ায় যদি অবিশুদ্ধ পদার্থ মিশে যায়, অথবা যথেষ্ট তাপশক্তি না থাকে,  তাহলে জন্মায় লোহা। আর অতি উচ্চ তাপের ক্রিয়ায়, নির্মল পরিবেশে, বিশুদ্ধ সালফার উপাদান ও ‘মেটালিক স্পিরিটের’ সংযোগে সৃষ্টি হয় ঝলমলে সোনা।

এবার নিউটনের মনে হল, প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়ার হুবহু অনুকরণ করা যদি সম্ভব হয় ল্যাবরেটরিতে, তাহলে  লোহা, তামা বা সীসা থেকে অবশ্যই রূপো বা সোনা পাওয়া সম্ভব। 

এখন চাই সঠিক কেমিক্যাল, চাই সেই “সর্ব দ্রাবক” বা “menstruum” যার মধ্যে সকল ধাতুর ক্ষয় ঘটে। বিশ্লিষ্ট হয়ে যায় অতি সূক্ষ্ম কণায়। নিউটন তাঁর কেমিক্যাল নোটবুকটি (CU Add 3975) খুলে বসলেন। 

ইতিপূর্বে বয়েলের ‘Certain Physiological Essays’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে বিভিন্ন ধাতুদের মূলে যে ‘বীজ-পদার্থ’ রয়েছে তা পৃথক করার পরীক্ষা পদ্ধতি লিখে রেখেছেন এই নোটবুকে। দু-আউন্স “অ্যাকোয়া ফর্টিস” (অর্থাৎ নাইট্রিক অ্যাসিড)-এর মধ্যে এক আউন্স “কুইক সিলভার” (অর্থাৎ পারদ) যোগ করলে স্বচ্ছ এক দ্রবণ তৈরি হবে। এরমধ্যে সীসা (লেড) চূর্ণ মেশালে দ্রবণের রাসায়নিক ক্রিয়ায় একপ্রকার সাদা পাউডারের অধঃক্ষেপ পাওয়া যাবে। আর সেই সঙ্গে “কুইক সিলভার” পৃথক হয়ে পড়বে যার ওপর “অ্যাকোয়া ফর্টিস” ভাসতে থাকবে টলমল করে। বয়েলের মতে, এই সাদা পাউডার সীসার-ই ভিন্ন এক রূপ। 

বয়েলের সাথে নিউটন কিন্তু একেবারেই একমত হলেন না। নিউটনের ধারণা, অধঃক্ষিপ্ত এই সাদা পাউডার আসলে ধাতব সীসার দুই মৌলিক উপাদানের একটি অংশ – সালফার উপাদান। আর পৃথক হয়ে যাওয়া “কুইক সিলভার” মোটেও সাধারণ মার্কারি নয়। সীসার মার্কারি উপাদান। এক-কথায়, বয়েলের অ্যাসিড-মার্কারি দ্রবণটিকেই নিউটন “সর্ব-দ্রাবক” বলে গ্রহণ করলেন। 

এখানে বলা দরকার, বয়েল-বর্ণিত ওই রাসায়নিক বিক্রিয়াজাত সাদা পাউডার প্রকৃতপক্ষে সীসার এক লবণ (লেড নাইট্রেট) এবং পৃথক হয়ে যাওয়া “কুইক সিলভার” সাধারণ মার্কারি-ই। অর্থাৎ, বয়েলের অনুমান অনেকাংশেই সঠিক ছিল।

বোঝাই যাচ্ছে, নিউটন ভুল পথে হাঁটছেন। মার্কারি-সালফার তত্ত্বেই সমর্পিত তাঁর চিন্তাজগত। প্রথম দিকের অ্যালকেমি চর্চা এভাবেই শুরু হল নিউটনের। ১৬৮০-র দশকের গোড়ার দিক তখন। নিউটন “সর্ব-দ্রাবক”-এর পরীক্ষায় মশগুল তাঁর ল্যাবরেটরিতে। সীসার বদলে টিন ব্যবহার করে প্রায় অনুরূপ ফলাফল পেলেন। টিন ধাতুর মূলেও যে ‘বীজ-পদার্থ’ রয়েছে অর্থাৎ, টিনের মার্কারি উপাদান ও টিনের সালফার উপাদান তা পৃথক করা গেছে – এমনটিই ভাবলেন নিউটন।   

এরপর তামার দুই ‘বীজ-পদার্থ’ পৃথক করতে গিয়ে পড়লেন সমস্যায়। তামার সালফার উপাদানের কোনোপ্রকার অধঃক্ষেপ পেলেন না। অদ্ভুত এক নীলচে-সবুজ দ্রবণ তৈরি হল, “সর্ব-দ্রাবক”-এর সাথে তামা যোগ করার ফলে। নিউটনের মনে হল, কপারের মার্কারি উপাদান কিংবা সালফার উপাদান, হয়তো এরকমই রঙিন। নিউটনের মনে প্রশ্ন রয়ে গেল। নিশ্চিত হতে পারলেন না।

১৬৭৩-এর শেষদিকে নিউটন উঠে এলেন ট্রিনিটির ‘গ্রেট গেট’-এর ঠিক পাশে এক দোতলা বিল্ডিং-এ তাঁর নতুন চেম্বারে। ছাত্রাবস্থার রুমমেট, জন উইকিন্সও রইলেন একসাথে। উইকিন্স চলে যাওয়ার পর নিউটন একাই থাকতেন চেম্বারটিতে এবং প্রায় দু-দশক কাল, ১৬৯৬-এ কেমব্রিজ ছেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, ট্রিনিটিতে এই হল তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। বিল্ডিং-এর নিচের তলায় তাঁর কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি। পাশেই একটি ছোট বাগান। মাঝে মধ্যে সেই বাগানে আপন মনে পায়চারি করেন। তাছাড়া ল্যাবরেটরি থেকে বড় একটা বের হতে দেখা যায় না আর।                                    

চার দেওয়ালে ঘেরা ট্রিনিটির সেই গবেষণাগারে, একান্তে কি এক্সপেরিমেন্ট করছেন নিউটন, তা কেউ জানে না। শুধুমাত্র তাঁর এক ছাত্র ও সহকারী, হাম্ফ্রে নিউটনের স্মৃতিচারণা থেকে যতটুকু জানা যায়। 

হাম্ফ্রে লিখেছেন – ‘রাত ২ টো বা ৩ টের আগে শয্যা গ্রহণ করতেন না বললেই চলে, কখনো-কখনো ৫ টা বা ৬ টাও বেজে যেত, বড় জোর ৪ বা ৫ ঘণ্টা শয়ন করতেন। বিশেষত বসন্ত বা শরত-হেমন্ত কালে, প্রায় ৬ সপ্তাহ একটানা কাটাতেন গবেষণাগারে, দিন-রাত জ্বলত চুল্লী – এক রাত তিনি জাগতেন, তো পরের রাত আমি, এভাবেই চলত যতক্ষণ না তাঁর “কিমিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট” সম্পূর্ণ হচ্ছে। তাঁর কাজে এতটুকুও ভুল ছিল না, ছিল কঠোর অনুশাসন, একেবারে নিখুঁত। তাঁর কাজের উদ্দেশ্য ঠিক কি ছিল তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। কিন্তু ওই সময় তাঁর মধ্যে যে যন্ত্রণা, যে শ্রম দেখেছি তা থেকে বুঝেছিলাম, তাঁর লক্ষ্য এমনকিছু যা মানুষের সাধ্যের বাইরের কোনো বিদ্যার সাধনা। … গবেষণার সময় তাঁর চোখে মুখে ছড়িয়ে থাকত পরিতৃপ্তি আর আনন্দ। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর পরীক্ষায় সেরকম অসাধারণ কিছু ঘটতে আমি দেখিনি। আর যদি তেমন কিছু ঘটেও থাকে, আমি তা আন্দাজ করতে পারিনি কারণ, তিনি সর্বদাই অত্যন্ত শান্ত আর গম্ভীর।’  

হাম্ফ্রের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়, কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন নিউটন, কী অতিশয় আকুল ছিলেন অপরসায়নের সেই ঈপ্সিত বস্তু, “ফিলোজফার্স স্টোন” অর্জনের লক্ষ্যে। 

নিউটন তাঁর ল্যাবরেটরিতে অ্যালকেমি সংক্রান্ত ঠিক কি ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন, তার সাক্ষ্য বহন করে আছে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত দুটি নোটবুক, ‘MS 3973’ এবং ‘CU Add 3975’। ১৬৭৮ থেকে ১৬৯৬ এই সময়কালে তাঁর গবেষণার নানান তথ্য এই দুই নোটবুক থেকে পাওয়া যায়।   

কেমিক্যাল নোটবুক (CU Add 3975) থেকে জানা যায়, নিউটন নিজেই একটি “সর্ব-দ্রাবক” উদ্ভাবন করেছিলেন। এই “সর্ব-দ্রাবক”-কে একাধিক নামে উল্লেখ করেছেন – “স্পিরিট অফ অ্যান্টিমনি”, “সল্ট অফ অ্যান্টিমনি”, “ভিনিগার অফ অ্যান্টিমনি” ইত্যাদি। নিউটন কোথাও স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি এই “স্পিরিট অফ অ্যান্টিমনি” বস্তুটি ঠিক কিভাবে প্রস্তুত করেছেন তিনি**। 

নিউটন তাঁর নিজস্ব ফর্মুলায় তৈরি এই “সর্ব-দ্রাবক”টিকে স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরি রিয়েজেন্ট হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন পরের প্রায় দু-দশককাল। 

এই রাসায়নিক পদার্থটি সৃষ্টি করে নিউটনের মনে হয়েছিল “ফিলোজফার্স স্টোন” তৈরির পথে এক ধাপ তিনি এগিয়েছেন। এরপর কাজ হল তাঁর “সর্ব-দ্রাবক”টিকে অশুদ্ধি মুক্ত করে নির্মল করে তোলা। কাজটি সহজ হল না। ১৬৭৮-এর ডিসেম্বর থেকে নানান পরীক্ষা করে চললেন। 

১৬৮০-র জুলাই মাস। গ্রীষ্মকাল। নিউটনের গবেষণাগার থেকে অস্ফুটে শোনা গেল – ইউরেকা!! যেন তিনি সফল হলেন। এক আদর্শ “সর্ব-দ্রাবক” সৃষ্টি করেছেন তিনি। যে কোনো ধাতুকে গলিয়ে ও বাষ্পীভূত করে “মেটাল স্পিরিট” সৃষ্টি করে ফেলতে পারে এই শক্তিশালী রাসায়নিক তরল। “স্যফিক স্যল অ্যামোনিয়াক” নামে চিহ্নিত করলেন তরলটিকে। অভীষ্ট লক্ষ্যে যেন আরো এক কদম এগোলেন নিউটন।

এই সময় নিউটন একান্ত গোপনে অ্যালকেমির পরীক্ষা করছেন ঠিকই, কিন্তু তার জন্য কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লুকাসিয়ান প্রফেসরের অন্যান্য একাডেমিক কাজ কর্ম, গণিত চর্চা, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা একেবারে থেমে থাকেনি। ক্রমশ তিনি রয়্যাল সোসাইটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও হয়ে উঠছেন। 

১৬৮৭-তে প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশিত হল। ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে নিউটন তখন সুপরিচিত। এই ১৬৮৭-তেই জেনেভা (বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের এক শহর, কিন্তু সতের শতকে ছিল ফ্রান্সের অধীনে) থেকে লন্ডনে এলেন তেইশ বছরের এক তরুণ। নাম নিকোলাস ফাতিও দে দ্যুইলার্‌। অল্প বয়সেই গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে যথেষ্ট জ্ঞানার্জন করেছেন। পরের বছরই রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হলেন ফাতিও। নিউটনের সঙ্গে পরিচয় হল ওই সময়ই। গণিত, মহাকর্ষ ছাড়াও নিউটন এই তরুণ বিজ্ঞানীর সাথে অ্যালকেমি বিষয়েও আলোচনা করলেন। সম্ভবত এই প্রথম নিউটন নিজের অ্যালকেমি চর্চার কথা জানালেন অপর কোনো ব্যক্তিকে। নিউটন তাঁর  অ্যালকেমির গবেষণায় ফাতিওকে সঙ্গে নিলেন। 

অ্যালকেমি চর্চায় গোপনীয়তার বিষয়ে নিউটন ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। এই সময় (১৬৮৯) অ্যালকেমি সংক্রান্ত তাঁর পান্ডুলিপিতে “Jeova Sanctus Unus”-এই ছদ্মনামটি ব্যবহার করতে দেখা যায় নিউটনকে***।  ফিলজফিক্যাল ট্রানজাকশন-এ রবার্ট বয়েলের এক প্রবন্ধ প্রকাশ পায়। সেখানে বয়েল এমন এক বিশেষ ধরণের মার্কারির কথা বলেছেন, যা সোনার উপস্থিতিতে নাকি প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই প্রবন্ধটি পড়ে নিউটন বুঝলেন, বয়েল মোটেও সঠিক লেখেননি। সর্বোপরি, বিষয়টি বয়েলের নিজের আবিষ্কৃতও নয়। ফিলালেতিস-এর রচনায় এর উল্লেখ তিনি আগেই দেখেছেন। রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারিকে চিঠি লিখে বিশদে জানালেন (১৬৭৬-এ) বয়েলের এই তত্ত্বে ভুল কোথায়। এ-প্রসঙ্গে ফাতিওকে লেখা এক চিঠিতে, রবার্ট বয়েল সম্পর্কে নিউটন মতামত ব্যক্ত করেন এভাবে – “বয়েল বড় বেশি খোলামেলা, সবকিছুই প্রকাশ্যে এনে ফেলেন, আর বড় বেশি যশ অভিলাষী।” চিঠিতে, নিউটন তাঁর আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেন – অ্যালকেমির গোপন তথ্য এভাবে প্রকাশ করে ফেলে অসাধু ব্যক্তিদের সুবিধা করে দেওয়া হল। 

১৬৯০-এর দশকে নিউটন নবীন বন্ধু ফাতিও-র ওপর কিছুটা নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। ফাতিও তখন লন্ডনে থাকেন। নিউটন লন্ডনে গেলে ফাতিও-র বাসাতেই ওঠেন। কয়েকজন অ্যালকেমিস্ট-এর সাথে নিউটনের পরিচয়ও করিয়ে দেন ফাতিও। 

এই সময় ফাতিও এক চিঠিতে নিউটনকে জানালেন, তিনি এমন এক অ্যালকেমিস্টকে চেনেন যিনি “সপ্রাণ-পারদ” (“animated mercury”) প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ল্যাবরেটরি ভেসেল-এর মধ্যে সোনার গাছ সৃষ্টি করেছেন। এই “সপ্রাণ-মার্কারি” প্রস্তুত করতে হলে চাই বিশেষ এক খনিজ পদার্থ। “ব্ল্যাক পাউডার” বলে উল্লেখ করলেন এই পদার্থটিকে ফাতিও। “ফিলোজফার্স স্টোন” তৈরির ইঙ্গিত দিলেন চিঠিতে – ওই কালো পাউডার দিয়ে পারদকে বিশুদ্ধ করে নিলে তা প্রাণযুক্ত হবে। লম্বা গলা যুক্ত ফ্লাস্কে এই বিশুদ্ধ পারদকে উচ্চ তাপে স্ফুটনের মাধ্যমে এক স্বচ্ছ তরল পাওয়া যাবে। এরপর এই তরলকে শীতল করে নিলে বিশেষ গুণ যুক্ত সাদা ও লালা বর্ণের কঠিন পদার্থ পাওয়া যাবে। এই কঠিন পদার্থের পাউডারের প্রয়োগে কঠিন রোগের  নিরাময় হয়। 

নিউটন শুনেছিলেন, যে “ফিলোজফার্স স্টোন” থেকে সোনা পাওয়া যায় তার বর্ণ লাল, আর সাদা বর্ণের হলে পাওয়া যাবে রূপো। ফাতিও-র চিঠি পড়ে নিউটন আশান্বিত হলেন। তাঁর মনে হল, “ফিলোজফার্স স্টোন” লাভের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তাঁরা। এরপর নিউটন ও ফাতিও-র মধ্যে চিঠির আদান প্রদান চলে এই বিষয় নিয়ে। “ফিলোজফার্স স্টোন” তৈরির ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক রেসিপি তাঁদের আলোচনায় ওঠে। প্রক্রিয়াগুলি ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়। “ফিলোজফার্স স্টোন” অধরাই রয়ে যায়। 

আধুনিক বিজ্ঞান জানে নিউটনের ভুল কোথায়। সাধারণ কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে নিউটন চেয়েছিলেন নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটাতে। হায়! তিনি যদি আরো দুশো বছর পরে জন্ম নিতেন, তাহলে হয়তো এভাবে তাঁকে পথ হারাতে হত না!  

অ্যালকেমি বিষয়ক নিউটনের শেষ গ্রন্থ, “Praxis”। ১৬৯৩ সালে রচিত। অনেকের মতে “প্র্যাক্সিস” আসলে নিউটনের মানসিক বৈকল্যের ফসল। এই কালটি নিউটনের জীবনে “ব্ল্যাক ইয়ার” হিসাবে চিহ্নিত। রিচার্ড ওয়েস্টফল লিখেছেন – ‘a time of great emotional stress’। 

আধুনিক গবেষকদের মতে, “প্র্যাক্সিস”-কে এভাবে দেখা যায় না। অ্যালকেমি শাস্ত্রে, ভিন্ন ভিন্ন ঘরানা – নানা মুনির নানা মত। নিউটন যেন শেষ চেষ্টা করেছেন। এদের এক সূত্রে গাঁথতে চেয়েছেন নিউটন। অ্যালকেমি চর্চায় তাঁর শেষ প্রচেষ্টা অনেকটা এভাবেই যেন ধরা রয়েছে “প্র্যাক্সিস”-এ। 

নিউটন, অ্যালকেমি বিষয়ে কম করেও দশ লক্ষ শব্দ লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর নোটবুকে অথবা নানা প্রকার কাগজপত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন মনে জাগে – অ্যালকেমি চর্চায় নিউটনের কি কোনো সাফল্যই মেলেনি? নিট ফল কি জিরো? 

আধুনিক গবেষকদের মতে, নিউটন তাঁর আলোক তত্ত্বের চাবিকাঠিটি পেয়েছেন অ্যালকেমি শাস্ত্র পাঠ করেই। সুপ্রাচীন এই শাস্ত্রে উল্লেখ আছে পদার্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি। যে কোনো পদার্থকে তাই যেমন তার গঠনকারী কণায় বিশ্লিষ্ট করা যায়, বিপরীত পদ্ধতিতে কণাদের একত্রিত করে পদার্থটি ফিরে পাওয়া সম্ভব। নিউটন পদার্থের এই “হেটেরোজিনিয়াস” চরিত্রের নিরিখে সাদা আলোকে বিচার করলেন। সাদা আলো বহু বর্ণের কণার সমষ্টি – এই হাইপথিসিস-এ উপনীত হলেন। “কিমিক্যাল অ্যানালিসিস” ও “সিন্থেসিস” এই যুগ্ম বিপরীত প্রক্রিয়ার অনুরূপে তাঁর প্রিজমের এক্সপেরিমেন্টের নক্সা প্রস্তুত করলেন। গড়লেন তাঁর পরীক্ষাসিদ্ধ  নতুন আলোক তত্ত্ব।       

আঠারো শতকের প্রথম দশকে, নিউটন যখন লন্ডনে রয়্যাল মিন্ট-এর মাস্টার পদে নিযুক্ত, সেই সময়ও  উইলিয়াম ইয়র্থ, ক্যাপ্টেন হিলিয়ার্ড এরকম আরো বেশ কয়েকজন অ্যালকেমিস্ট, নিউটনের লন্ডনের বাড়িতে গোপনে যাতায়াত করতেন। 

“ফিলোজফার্স স্টোন” তিনি অর্জন করতে পারেননি। “এডেপ্ট” হয়ে ওঠা তাঁর হয়নি। তথাপি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অ্যালকেমি শাস্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন নিউটন। হয়তো-বা মানুষের সাধ্যাতীত বলেই অভীষ্টে পৌঁছতে পারেননি মহান বিজ্ঞানী।                  

(চলবে)

অলঙ্করণঃ সৌহার্দ্য চক্রবর্তী

সূত্রনির্দেশ 

  1. R. S. Westfall, Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
  2. R. Iliffe, Priest of Nature, Oxford University Press, New York, 2017.
  3. W. R. Newman, Newton the Alchemist, Princeton University Press, Princeton, 2019.
  4. L. M. Principe, The Aspiring Adept : Robert Boyle and His Alchemical Quest, Princeton University Press, Princeton, 1998.
  5. Sarah Dry, “The Strange Tale of Newton’s Papers,” The New Atlantis, Number 44, Winter 2015, pp. 104–115.

 

* কেইনস্‌-এর এই সংগ্রহ বর্তমানে কেমব্রিজের কিংস কলেজে সংরক্ষিত আছে। 

** “স্যল অ্যামোনিয়াক” (অর্থাৎ অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড) সাদা চূর্ণ এক খনিজ পদার্থ। অ্যালকেমি শাস্ত্রে এটি  যে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়, নিউটন তা জানতেন। এই খনিজ পদার্থটিকে “অ্যাকোয়া ফর্টিস”-এর সাথে মিশিয়ে তৈরি করেন “অ্যাকোয়া রিজিয়া”। নিউটন-গবেষকদের অনুমান, ‘স্টিবনাইট’ (অ্যান্টিমনির আকরিক)-কে ওই “অ্যাকোয়া রিজিয়া”-র মধ্যে দ্রবীভূত করে “স্পিরিট অফ অ্যান্টিমনি” তৈরি করেছিলেন নিউটন। 

*** ‘আইজাক নিউটন’-এর ল্যাটিন রূপ, “Isaacus Neuutonus”-এর অ্যানাগ্রাম করে তিরিশটিরও বেশি ছদ্মনাম সৃষ্টি করেন নিউটন।   

**** ওই সময়ের একজন বিখ্যাত আমেরিকান অ্যালকেমিস্ট, জর্জ স্টার্কি, যিনি আইরেনিয়াস ফিলালেতিস এই ছদ্মনামে বইপত্র লিখতেন, তাঁর লেখা একখানি বই (“ম্যারো অফ অ্যালকেমি”) নিউটন পড়েন এবং সেখানে অদ্ভুত এক ধাতু-সংকরের কথা জানতে পারেন। সাংকেতিক ভাষায় লেখা সেই প্রস্তুতি পদ্ধতির অর্থোদ্ধার (ডিকোড) করেন নিউটন। তারপর তাঁর ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টিও করেন সেই ধাতু-সংকর। স্টার্কি এর নাম রেখেছিলেন “নেট”। অ্যালকেমি চর্চায় এটিও নিউটনের এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বলে ধরা যায়

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment