লুকাসিয়ান প্রফেসর
১৬৬৯ সাল। নিউটনের জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছরের একেবারে গোড়ার দিকে লন্ডন নিবাসী এক ভদ্রলোক সদ্য প্রকাশিত একখানি গণিত বই প্রফেসর ব্যারোকে ডাক মারফত পাঠালেন। ভদ্রলোকের নাম জন কলিন্স। ব্যারোর পূর্বপরিচিত। কলিন্স এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। পেশায় সরকারি কেরানি, কিন্তু গণিত তাঁর নেশা। রয়্যাল সোসাইটির সদস্যও তিনি। ইউরোপের কোথায় গণিতে নতুন কি আবিষ্কার হল, নতুন কি প্রকাশ পেল, সেসবের সমস্ত খবরাখবর সংগ্রহ করে বেড়ান। ইউরোপের প্রথম সারির প্রায় সব গণিতজ্ঞের সাথেই নিয়মিত যোগাযোগও রাখেন। ব্যারোকে অঙ্কের যে বইটি পাঠিয়েছেন, তার লেখক নিকোলাস মার্কেটর। মার্কেটর, তাঁর এই বইয়ে অসীম শ্রেণি সংক্রান্ত নতুন গণিত উপহার দিয়েছেন। মার্কেটর-আবিষ্কৃত সেই গণিত, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গণিতের প্রফেসর ব্যারোর গোচরে আনাই উদ্দেশ্য কলিন্সের।
বইটির পাতা উল্টে প্রফেসর ব্যারো বিস্মিত হলেন। এ অঙ্ক তাঁর চেনা। ইতিপূর্বেই দেখেছেন তিনি। কলিন্সকে চিঠি লিখে জানালেন সে কথা – ‘অল্পদিন আগে এক ব্যক্তি গণিতের কিছু পেপার আমাকে দেখান, যেখানে তিনি হাইপারবোলা সংক্রান্ত গণনা করেছেন। সেই গণিত মার্কেটর-এর অনুরূপ কিন্তু অনেক বেশি জেনারেল বা সার্বিক অর্থাৎ, প্রয়োগ ক্ষেত্র ব্যাপকতর।’
ব্যারো কথা দিলেন কলিন্সকে, এই সংক্রান্ত গবেষণা পত্রের একখানি খসড়া অচিরেই পাঠাবেন তাঁকে। ব্যারোর চিঠি হাতে পাওয়ার ঠিক দশ দিন পর কলিন্সের কাছে সত্যিই পৌঁছে গেল গবেষণা পত্রের অনুলিপি। পেপারটির শিরোনাম ‘অন অ্যানালাইসিস বাই ইনফাইনাইট সিরিজ’। ল্যাটিন সংক্ষিপ্ত রূপ ‘দ্য অ্যানালাইসি’। কিন্তু গবেষকের নাম কোথাও উল্লেখ করলেন না ব্যারো। প্রায় এক মাস অপেক্ষার পর কলিন্স আরও একটি চিঠি পেলেন প্রফেসর ব্যারোর কাছ থেকে। সেই চিঠিতে ব্যারো লিখেছেন, ‘গবেষক তাঁর নাম প্রকাশে রাজি হয়েছেন। ইনি মিস্টার নিউটন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির এক ফেলো। অল্প বয়েস। এম-এ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গণিতে অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতার অধিকারী এই যুবক।’
সেই কালটিতে নিউটন ও আইজাক ব্যারো হয়ে উঠেছিলেন পরস্পরের বন্ধু। যুবকটির গাণিতিক দক্ষতায় তিনি মুগ্ধ। গণিত শাস্ত্রে তিনি নিজেও কম কিছু নন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাঁর মতো সুপণ্ডিত কজনই-বা আছেন? ইউনিভার্সিটির প্রথম লুকাসিয়ান প্রফেসর তিনি। তবুও এই ছাত্রটিকে যতই দেখেন ততই বিস্মিত হন ব্যারো। গণিত ও আলোক তত্ত্বের নানান সমস্যা আলোচনা করেন তিনি নিউটনের সঙ্গে। নিউটনও, তাঁর গণিতের যে নোটবুক অর্থাৎ ‘ওয়েস্ট-বুক’টি, বিনা দ্বিধায় প্রফেসর ব্যারোর হাতে তুলে দেন। ওয়েস্ট-বুকের পাতায় ছড়িয়ে থাকা মণি মুক্তো উল্টে পাল্টে দেখেন প্রফেসর ব্যারো। যুবকটি যে প্রতিভাধর ব্যারো তা বোঝেন। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে সময় লাগে না।
আইজাক ব্যারো শুধুমাত্র গণিতের একজন শিক্ষক নন, তাঁর কাছে গণিত চর্চা এক অর্থে ঈশ্বর উপাসনা। গ্রীক দার্শনিক হায়ারোক্লস (Hierocles)-এর উক্তিটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন প্রফেসর ব্যারো – ‘A knowledge of mathematics is the purification of the rational mind’। তরুণ নিউটনের গণিত সাধনায় সেই একই সুর শুনতে পান তিনি।
এই দুই ছাত্র-শিক্ষকের জীবনের অনেকাংশে মিলও রয়েছে। জন্মের কয়েকমাস আগেই নিউটনের পিতৃবিয়োগ ঘটে। তিন বছর যখন বয়স, মা হান্না চলে যান এক পাদ্রীকে বিয়ে করে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছেলেবেলা। আইজাক ব্যারোরও তাই। মাত্র চার বছর বয়সেই মারা যান মা। বাবা ছিলেন রাজা প্রথম চার্লসের বস্ত্র সরবরাহকারী – লিনেন ড্রেপর। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে ব্যারো ভর্তি হন সর্বনিম্ন গোত্রের ছাত্র হিসাবে। নিউটনের মতোই ‘সাব সাইজার’ গোত্রভুক্ত হয়েই ট্রিনিটিতে আসা। গ্রিক ভাষা শিক্ষার প্রফেসর জেমস্ ড্যুপোর্ট ছিলেন ব্যারোর টিউটর। নতুন ছাত্রটির মেধা ও অধ্যাবসায় দেখে মুগ্ধ হন টিউটর ড্যুপোর্ট। ছাত্রের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল নয়, সে কথা জেনে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন ব্যারোকে। সে সময় ট্রিনিটি কলেজে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রফেসর হলেন এই ড্যুপোর্ট। প্রায় শ-দুয়েক আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ছাত্রের টিউটর তিনি। গ্রিক, ল্যাটিন ও ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তি। গ্যালিলেও ও কোপারনিকাসের নতুন বিজ্ঞান ভাবনা একেবারেই সমর্থন করেন না ড্যুপোর্ট। আর তাই প্রাকৃতিক দর্শন ও গণিত তাঁর কাছে উৎকর্ষতার বিচারে দ্বিতীয় শ্রেণীর। অ্যারিস্টটলিয় ভাবাদর্শে দীক্ষিত এই প্রফেসর মূলত, সাহিত্য, দর্শন ও থিয়লজি অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রীয় বিষয়ই চর্চা করেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যেও যাতে এই সকল বিষয়ে অনুরাগ জন্মায় সে ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল।
এদিকে আবার জেমস্ ড্যুপোর্ট একজন আদ্যপ্রান্ত রাজতন্ত্রবাদী, রয়্যালিস্ট। ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা কালে, ১৬৬২-তে, কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে একাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিতাড়িত হন, পার্লামেন্টারিয়ানদের সমর্থক ছিলেন তাঁরা – এই অপরাধে। লক্ষণীয়, ড্যুপোর্ট যে-সমস্ত ছাত্রদের টিউটর ছিলেন তাদের একজনকেও কিন্তু ট্রিনিটি ছাড়তে হয়নি। ড্যুপোর্ট-এর প্রিয় ছাত্র আইজাক ব্যারোও রয়্যালিস্ট হিসাবেই পরিচিত হলেন ইউনিভার্সিটিতে।
সতের শতকের প্রথম ও মধ্য ভাগে ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। কেমব্রিজ তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অক্সফোর্ডে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা ছিল প্রথাগত শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। কোপারনিকাসের তত্ত্ব, মহাবিশ্বের অনন্ত ব্যাপ্তি, জগতের বহুত্ববাদী তত্ত্ব (Cosmic pluralism), ভূ-চুম্বকত্ব – এসব নিয়ে রীতিমত চর্চা হত। যদিও ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ওই সময় শিক্ষার্থীদের যে সনাতন দর্শনের পাঠদান চলত তার সঙ্গে ধর্ম শাস্ত্রে বিশেষ ফারাক ছিল না। স্যর ফ্রান্সিস বেকন ছিলেন এর ঘোরতর বিরোধী। বরং, তিনি প্রাকৃতিক দর্শন বিষয়ক প্রফেসর চেয়ার পদ সৃষ্টির পক্ষেই সওয়াল করতেন।
১৬১৯-এ স্যর হেনরি স্যাভেল্, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যামিতির দুটি প্রফেসর চেয়ার পদ প্রতিষ্ঠা করেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সমসাময়িক কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে এরকম বিজ্ঞান বিষয়ক কোনও চেয়ার পদ না থাকা, গণিত অথবা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চায় ঔৎসুক্যহীনতার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। কেমব্রিজে আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট স্তরে তখনও মুখ্য পাঠ্য বিষয় অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও লজিক। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ, অ্যারিস্টটলের ভ্রান্ত ভূকেন্দ্রিক মডেলকে সরিয়ে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা, তার চর্চা শুরু হয়ে গেছে অক্সফোর্ডে ও ইউরোপের অন্য প্রান্তে। কেমব্রিজে শুধুমাত্র এম-এ কোর্সের ছাত্রদের পড়তে হয় জ্যামিতি, প্রাকৃতিক দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা।
১৬৫০-এর দশকে অক্সফোর্ডে জন উইলকিন্স-এর নেতৃত্বে জন ওয়ালিস, ক্রিস্টোফার রেন, উইলিয়াম নীল, জোনাথন গডার্ড এর মতো তরুণ বিজ্ঞানীদের একটি দল যখন জোট বাঁধে, আধুনিক বিজ্ঞান চর্চায় কেমব্রিজকে পিছনে ফেলে অক্সফোর্ড আরও কয়েক কদম এগিয়ে যায়। তাঁরা জোর দিতেন পরীক্ষা নির্ভর বিজ্ঞান চর্চায়। এই দলটি ‘Experimental Philosophical Club’ বা ‘Wadham Group’ নামে পরিচিত। উইলকিন্স-এর এই গ্রুপে রবার্ট বয়েল এবং রবার্ট হুকও পরে যোগ দেন। ‘Wadham Group’-এর সদস্যরাই, ১৬৬০ সালে, লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
ঠিক এই সময় কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতেও বিজ্ঞান চর্চায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা দিল। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার আদান-প্রদান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনে সংগঠিত হল। জন রে, ওয়াল্টার নীদ্যম, জন নিড এবং আইজাক ব্যারো ছিলেন এই গ্রুপের নিউক্লিয়াস। ইতিমধ্যে আইজাক ব্যারো ইতালি, ফ্রান্স, তুরস্ক সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে দীর্ঘ চার বছর ভ্রমণ করে কেমব্রিজে ফিরে এসেছেন। ওই সময় ইউরোপের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিত বিশারদদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, বিশেষত ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রি বিষয়ে সুযোগ হয় জ্ঞান লাভের।
১৬৫৯-এ ট্রিনিটি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেলেন পিউরিটান ভাবাদর্শে বিশ্বাসী জন উইলকিন্স। যদিও এক বছরেরও কম সময় তিনি এই পদে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন, তবু তারই মধ্যে জীব বিজ্ঞানী জন রে ও তরুণ গণিত বিদ আইজাক ব্যারোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে লুকাসিয়ান প্রফেসর চেয়ার পদে এই উইলকিন্সই ছিলেন আইজাক ব্যারোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে আবারও রাজতন্ত্র ফিরে এসেছে। জন উইলকিন্স-এর মতো বিজ্ঞানী ও সংস্কারককে ট্রিনিটির মাস্টার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। কলেজের অধ্যক্ষ বা মাস্টার হয়ে এলেন ‘ব্রেভ-লয়্যালিস্ট’ হেনরি ফার্ন। ১৬৬২-তে চালু হল ‘ইউনিফর্মিটি অ্যাক্ট’। যাঁকে ঘিরে আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছিল কেমব্রিজে, সেই জন রে-কেই বাধ্য করা হল কেমব্রিজ ছাড়তে। ট্রিনিটি কলেজ তথা সমগ্র কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতেই বিজ্ঞান সাধনা যেন মুখ থুবড়ে পড়ল। ঠিক এই সময় আইজাক নিউটন ট্রিনিটির দ্বিতীয় বর্ষের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র। নিউটনের টিউটর বেঞ্জামিন পুলিন। গণিত অথবা প্রাকৃতিক দর্শন নয়, নিউটনকে তখন পড়তে হচ্ছে অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞান, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা, সনাতন দর্শন, আর ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক বইপত্র।
১৬৬৩-তে, হেনরি লুকাস নামক এক ব্যক্তি, যিনি একসময় রাজা প্রথম চার্লসের পার্লামেন্টে কেমব্রিজের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর ঠিক এক মাস আগে একটি উইল করে যান। সেই উইলে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শন বিষয়ক একটি প্রফেসর চেয়ার পদ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করা হয়। এই পদের জন্য বেশ কয়েকজনের নাম সুপারিশ করা হয়। আইজাক ব্যারোর নামও ছিল এই তালিকায়। জন উইলকিন্স ছিলেন ব্যারোর পেট্রন এবং সম্ভবত তাঁর সুপারিশ ক্রমেই রয়্যালিস্ট আইজাক ব্যারোই প্রথম লুকাসিয়ান প্রফেসর মনোনীত হন। ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে ব্যারোর নাম অজানা রইল না।
১৬৬৯-এর সেই ঘটনার কথায় এবার আসা যাক। জন কলিন্স, অন্যান্য গণিতজ্ঞদের সাথে যেরকম নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন ব্যারোর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। ব্যারোকে প্রায়শই গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ক বইপত্র পাঠান তিনি। কলিন্স প্রেরিত মার্কেটর-এর সদ্য প্রকাশিত সেই বইটি নিউটনকে দেখালেন ব্যারো।
‘বায়নোমিয়াল এক্সপ্যানসান’ অর্থাৎ দ্বিপদ বিস্তারের যে ফর্মুলাটি উলসথর্পের বাড়িতে বসে নিউটন তাঁর ওয়েস্টবুকে রচনা করেছিলেন, সেটি ছিল এক বহুমূল্য হীরের টুকরো। বিশ্ব গণিতকে দেওয়া তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। কিন্তু ট্রিনিটিতে তাঁর গণিত গবেষণা বোঝার মতো লোক আর কেই-বা আছে, এক প্রফেসর ব্যারো ছাড়া?
ব্যারো নিউটনকে বললেন, ওয়েস্টবুকে যে-সব অঙ্ক কষা আছে সেগুলিকে গুছিয়ে অতি দ্রুত যেন একটি গবেষণা পত্র প্রস্তুত করেন তিনি। নিউটন এতটুকুও সময় নষ্ট না করে লিখে ফেললেন তাঁর প্রথম গবেষণা পত্রের খসড়া। ইউরোপের গণিত বিশারদরা এবার চাক্ষুষ করবেন তাঁর আবিষ্কার। তরুণ গবেষক কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত। সমালোচিত হতে চান না। ব্যারোকে শর্ত দিলেন, তাঁর নাম অপ্রকাশিত রাখতে হবে। ব্যারো তাই কলিন্সকে যে গবেষণা পত্রটি পাঠালেন, সেখানে গবেষকের কোনো নাম উল্লেখ করেননি।
নিউটনের সেই বিখ্যাত ম্যাথম্যাটিক্যাল পেপার (‘দ্য অ্যানালাইসি’) জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা প্রকারের ‘মেকানিক্যাল কার্ভ’, তাদের ক্ষেত্রফল ও স্পর্শক নির্ণয় প্রণালী। নিউটনের নিজস্ব ঘরানার ক্যালকুলাস – ‘ফ্লাক্সিওন্স’ আর ‘ফ্লুয়েন্টস’। পেপারটি দেখে কলিন্স তো রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। সেকথা চিঠি লিখে জানালেন ব্যারোকে। নিউটন যেন ভরসা পেলেন। এবার তিনি নাম প্রকাশে আর বাধা দিলেন না।
ইতিমধ্যে প্রফেসর ব্যারো আলোক বিজ্ঞান সংক্রান্ত একখানি বই ‘অপটিক্স’ প্রকাশ করতে চলেছিলেন। লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসাবে তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতামালা বা লেকচার সিরিজের সংকলন ছিল এই বইটি। প্রকাশের আগে বইটির পান্ডুলিপি নিউটনকে দেখতে দিয়েছিলেন ব্যারো। নিউটনের পরামর্শ মতো বইটিতে কিছু পরিমার্জনও করেন। এছাড়াও এতে নিউটনের কিছু অবদানও ছিল। আলোক রশ্মির গতিপথের কয়েকটি জ্যামিতিক চিত্র এঁকেছিলেন এবং বিশেষ জ্যামিতিক আকারের লেন্স প্রস্তুত প্রণালীর বর্ণনা যুক্ত করেছিলেন বইটিতে। বইটির ভূমিকায় ব্যারো ঋণ স্বীকার করে লেখেন – ‘..Mr Isaac Newton, our colleague (a man of outstanding abilities and notable experimental skill) who revised the text, pointing out some needful corrections and also offering some suggestions which you will find, suitably acknowledged, amidst my own work…’। বইটি প্রকাশের ঠিক আগে ব্যারো, নিউটনকে প্রস্তাব দিলেন ‘দ্য অ্যানালাইসি’-কে বইয়ের পরিশিষ্ট আকারে প্রকাশ করা হোক। কলিন্সও নিউটনকে বোঝালেন, দেরি না-করে দ্রুত পাবলিশ করা দরকার এই আবিষ্কার। কিন্তু নিউটনকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। সত্যিই ভারি অদ্ভুত চরিত্র যুবকটির! মাঝে মধ্যেই অজানা এক আশঙ্কা গ্রাস করে। ভয়ে গুটিয়ে যান তিনি।
শেষমেশ প্রচারের আলো থেকে আড়াল করে নিলেন নিজেকে। এরপর কলিন্স-এর কাছ থেকে ‘দ্য অ্যানালাইসি’ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন ব্যারো। ফেরত দেওয়ার আগে এমন মহা মূল্যবান রত্নটির একখানি কপি কলিন্স নিজের কাছে রাখলেন। শুধু তাই নয়, ইউরোপের নামজাদা কয়েকজন গণিতজ্ঞকে জানালেন নিউটনের এই আবিষ্কারের কথা। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির তৎকালীন সেক্রেটারি হেনরি ওল্ডেনবার্গ তাঁর একটি চিঠিতে নিউটনের গণিতের বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখও করেছেন। তথাপি ‘ম্যাথম্যাটেসিয়ান নিউটন’ বিখ্যাত হন ‘অপটিক্যাল এক্সপেরিমেন্টর নিউটন’-এর পরে। প্রতিফলক টেলিস্কোপ অথবা প্রিজমের পরীক্ষার ফলাফল ও আলোর নতুন তত্ত্ব তিনি জনসমক্ষে এনেছিলেন ১৬৭১-৭২ সাল নাগাদ, যেখানে তাঁর গাণিতিক দক্ষতার আভাস মিলেছিল বছর দুই আগেই। প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পর, ১৭১১ সালে, ‘দ্য অ্যানালাইসি’ প্রকাশিত হয় নিউটনের আরো বেশ কয়েকটি গাণিতিক আবিষ্কারের সঙ্গে একত্রে (‘Analysis per quantitatum series, fluxiones, ac differentias’)।
‘দ্য অ্যানালাইসি’ সেই মুহূর্তে প্রকাশ পেল না ঠিকই কিন্তু এই গবেষণা পত্রের পাণ্ডুলিপি নিউটনের জীবনের মোড় দিল ঘুরিয়ে। ওই বছরই প্রফেসর ব্যারোর পদত্যাগের কারণে ‘লুকাসিয়ান চেয়ার’ পদটি শূন্য হয়ে যায়। গণিত ও বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে ধর্মপ্রাণ ব্যারো সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বর সাধনায় মনোনিবেশ করলেন। ব্যারোর স্থান হল রাজ দরবারে। রাজার চ্যাপেলিন নিযুক্ত হয়ে চলে গেলেন লন্ডনে।
এখন খোঁজ শুরু হল লুকাসিয়ান চেয়ার পদটির উপযুক্ত ব্যক্তির। কে হবেন ব্যারোর উত্তরাধিকারী? লুকাসিয়ান প্রফেসর চেয়ার পদটি গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শন সম্পর্কিত। মর্যাদায় কলেজ মাস্টার অর্থাৎ প্রিন্সিপাল-এর ঠিক পরের ধাপ। স্টাইপেন্ড বাৎসরিক একশো পাউন্ড। এই আকর্ষণীয় পদটির যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন সাতাশ বছরের প্রায় অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবক – মিস্টার আইজাক নিউটন। সম্ভবত প্রফেসর ব্যারোর ব্যবস্থাপনাতেই এই নির্বাচন। ‘দ্য অ্যানালাইসি’ যাঁরা দেখেছেন সেই গুটিকয় মানুষই জানেন এই তরুণ বিজ্ঞানীর গাণিতিক প্রতিভার কথা।
লুকাসিয়ান প্রফেসর হওয়ার পর নিউটনের জীবনযাপনের ধরণ গেল বদলে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির উচ্চ মর্যাদার পদে আসীন তিনি। নিয়ম অনুসারে এখন থেকে তাঁকে উজ্জ্বল লাল রঙের গাউন পড়তে হবে যা ট্রিনিটির অন্যান্য শিক্ষকদের থেকে অনেকটাই আলাদা। বেতনও সেকালের বিচারে রীতিমত ঈর্ষণীয়। ইউনিভার্সিটির বিধান অনুসারে সাধারণ কোনো ফেলোর বিয়ে করা নিষিদ্ধ। অন্যথায় ফেলোশিপ যাবে বন্ধ হয়ে। কিন্তু নিউটন প্রফেসর হওয়ায় সে বাধা নেই। নিউটন অবশ্য বিয়ে করবেন না। তাঁর সঙ্কল্প আজীবন চির কুমার থাকবেন তিনি।
লুকাসিয়ান প্রফেসর হওয়ার অল্পদিন পরেই লন্ডন শহরে গেলেন নিউটন। ২৬ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর থাকলেন সেখানে। এবার তিনি এসেছেন অন্য পরিকল্পনা নিয়ে। রয়্যাল সোসাইটিতে গেলেন না। কোনো বিজ্ঞানীর সাথেও দেখা করলেন না। দেখা হল জন কলিন্স-এর সঙ্গে। নিজেই দেখা করতে এসেছিলেন কলিন্স।
এই সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে কলিন্স, সমকালীন ব্রিটিশ গণিত ও জ্যোতির্বিদ জেমস গ্রেগরি-কে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে কলিন্স লিখেছেন – ‘ইতিপূর্বে মিস্টার আইজাক নিউটনকে আমি দেখিনি। আপনার চেয়ে বয়সে ছোটই হবেন। এক শনিবার রাত্রে তাঁর পান্থনিবাসে প্রথম সাক্ষাৎ হল।… ঠিক তার পরদিন তাঁকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সেখানে গণিত নিয়ে যে সামান্য আলোচনা হয়, তার মধ্যে আমি জানতে চেয়েছিলাম, প্রথম লেকচার সিরিজ কোন বিষয়ে শুরু করবেন বলে ভেবেছেন তিনি। মিস্টার নিউটন জানালেন, মিস্টার ব্যারো যেখানে শেষ করেছেন, তারপর থেকেই আরম্ভ করতে চান – তাই অপটিক্স অর্থাৎ আলোকবিদ্যাকেই নির্বাচন করেছেন…।’
লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসাবে নিউটন তাঁর প্রথম লেকচার সিরিজ আরম্ভ করেন ১৬৭০-এর জানুয়ারি-তে। এই সময় চারটি লেকচারের যে সেট (‘Lectiones Opticae’ বা ‘Optical Lectures’; MS Add. 4002) কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে জমা দিয়েছিলেন তা ছিল মূলত আলোর বর্ণ সংক্রান্ত। এই ‘অপটিক্যাল লেকচার্স’-ই পরবর্তী কালে তাঁর প্রথম বই, ‘অপটিক্স’-এ স্থান পায়। পরবর্তীকালে আলোক তত্ত্ব ছাড়াও নিউটনের লেকচারের বিষয় ছিল অ্যালজেব্রা, মেকানিক্স ও অ্যাস্ট্রনমি। একটি বিষয় নিশ্চিত যে নিউটনের লেকচারের বিষয় কখনো ক্যালকুলাস ছিল না। সম্ভবত তিনি জানতেন সদ্য আবিষ্কৃত এই বিষয়টি তাঁর ছাত্রদের বোধগম্যতার বিস্তর দূরে।
লুকাসিয়ান চেয়ার পদের বিধিনিয়ম অনুসারে বছরে তিনটি পঠনকালে প্রতি সপ্তাহে একটি করে লেকচার প্রদান করতে হবে পাবলিক স্কুলে। শিক্ষার্থীদের গণিত অথবা প্রাকৃতিক দর্শনে অনাগ্রহের কারণেই হোক বা ইউনিভার্সিটির ঢিলেঢালা চরিত্রের জন্যই হোক ব্যারো বছরে একটি মাত্র পঠনকালেই শিক্ষাদান সমাধা করতেন। এ ব্যাপারে নিউটনও অনুসরণ করেছিলেন ব্যারোকে।
শোনা যায়, নিউটনের লেকচার কক্ষ নাকি কার্যত ছাত্র শূন্য থাকতো এবং অধিকাংশ সময়ই তিনি দেওয়ালের উদ্দেশ্যেই লেকচার প্রদান করতেন। বিষয়টি জানা যায় তাঁর এক ছাত্র হাম্ফ্রে নিউটন-এর স্মৃতিচারণা থেকে। হাম্ফ্রে লিখেছেন – ‘When he (Newton) read (lectured) in the Schools … so few went to hear Him, and fewer that understood him, that of times he did in a manner, for want of Hearers, read (lectured) to the walls.’।
তবে এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে হয় যে, হাম্ফ্রে যখন ছাত্র ছিলেন অর্থাৎ নিউটন লুকাসিয়ান প্রফেসর হওয়ার প্রায় পনের বছর পর, সেসময় নিউটনের পাঠদানের বিষয় ছিল মেকানিক্স যা অনেকের কাছেই সেসময় দুর্বোধ্য ছিল। কিন্তু প্রথম কয়েক বছর যখন তিনি আলোক তত্ত্ব অথবা বীজগণিত বিষয়ে লেকচার প্রদান করতেন তখন হয়তো তাঁর লেকচার শুনতে আগ্রহী ছাত্রের অভাব হত না। হাম্ফ্রে ছাড়াও নিউটনের ক্লাসে যাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম উল্লেখ করতে হয়। প্রথম জন হলেন জন ফ্ল্যামস্টিড, যিনি পরে প্রথম অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল হন। অপরজনের নাম উইলিয়াম হুইস্টোন, যিনি লুকাসিয়ান প্রফেসর হয়েছিলেন নিউটনের ঠিক পরেই। দু-তিনটি লেকচার তিনি শুনেছিলেন কিন্তু সবটাই ছিল তাঁর বোধগম্যতার বাইরে।
লুকাসিয়ান প্রফেসর হওয়ার অল্পদিন পরেই নিউটন লন্ডনে গিয়েছিলেন একটি বিশেষ কারণে। রসায়নের বেশ কিছু বই ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। নিউটন-গবেষকদের মতে, ঠিক এই সময় গণিত নয়, এমনকি আলোর নতুন তত্ত্বও নয়, একেবারে ভিন্ন এক বিষয় – রসায়ন, নিয়ে তাঁর মনোজগৎ আচ্ছন্ন। এরপর রসায়ন ও অপ-রসায়ন অর্থাৎ অ্যালকেমি চর্চায় নিয়োজিত থাকবেন সুদীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর।
(চলবে)
অলঙ্করণঃ সৌহার্দ্য চক্রবর্তী
সূত্রনির্দেশ
- R. S. Westfall, Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
- R. Iliffe, Priest of Nature, Oxford University Press, New York, 2017.
- A. R. Hall, Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
- M. Feingold, Before Newton – The Life and Times of Isaac Barrow, Cambridge University Press, New York, 1990.
- B. J. Shapiro, The Universities and Science in Seventeenth Century England, Journal of British Studies, Vol. 10, No. 2 (May, 1971), pp. 47-82.